॥ তিন ॥

পেট্রল পাম্পে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নেমে দেবাশিস আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল। হাই তুলতে তুলতে বলল, বিশ লিটার। বলে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করে দিল।

রবি নেমে আইসক্রিমের স্টলটার কাছে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলে, বাবা, বন্ধ যে। কী আর করা যাবে!

রবি বুটের শব্দ করে ছুটে আসে— আজ কেন বন্ধ?

একটু পরে খোলে। চলো, তোমাকে ক্যান্ডি কিনে দেব।

গাড়ির ভিতর থেকে চাঁপা ডেকে বলে, সোনাবাবু, তোমার জন্য আমি তো খাবার এনেছি, বাইরের জিনিস তবে কেন খাবে?

রবি তার বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছোট চোখে বাবাকে একটু দেখল। প্যান্ট-শার্ট-পরা দীর্ঘকায় বাবা, গলায় একটা সিল্কের ছাপা সাদা-কালো স্কার্ফ। একটু অন্যমনস্ক হয়ে বাবা জুতোর আগাটা তুলছে নামাচ্ছে, পকেটে হাত, ক্রু কোঁচকানো।

রবি ডান পা বাড়িয়ে ডান হাত মুঠো করে তুলে মুখ আড়াল করে দাঁড়াল। তারপর বাঁ হাত বাড়িয়ে বক্সিংয়ের স্ট্যান্স তৈরি করে এগিয়ে এসে বাঁ হাতটা বাবার পেটে চালিয়ে দিয়ে মুখে শব্দ করে–হোয়্যাম!

দেবাশিস কোলকুঁজো হয়ে সরে যায়। তারপর সেও ঘুরে দাঁড়ায়। অবিকল রবির মতো স্ট্যান্স নিয়ে এগিয়ে ভুয়ো ঘুসি মারে তার মুখে, রবি চট করে মুখটা সরিয়ে নিয়ে ঘুরে এগিয়ে আসে। নিঃশব্দে দুজন দুজনের দিকে চোখ রেখে চক্কর খায়, ঘুসি চালায়। চাঁপা গাড়ি থেকে মুখ বার করে স্মিত চোখে চেয়ে থাকে। পেট্রল ভরতে ভরতে পাম্পের অ্যাটেনডেন্ট লোকটা খুব হাসে।

দেবাশিস পেটে ঘুসি খেয়ে উবু হয়ে বসে পড়ে। সামনে তেজি বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রবি রেফারির মতো গুনতে থাকে— ওয়ান–টু–থ্রি–এইট-নাইন আউট! বলে শূন্যে আঙুল তুলে রবি।

দেবাশিস উঠে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে বলে, কংগ্রাচুলেশন ফর জাস্ট বিয়িং দা নিউ হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন অব দা ওয়ার্ল্ড।

থ্যাংকস। হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। মৃদু হাসে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, মে আই পুট এ টেলিফোন কল?

টু হুম?

মাই ফ্রেন্ড রঞ্জন।

গো এহেড।

দ্বিধাহীন গটমটে পায়ে রবি কাচের দরজা ঠেলে গিয়ে অফিস ঘরে ঢোকে। ফোন তুলে নেয় চালাক চতুর ভঙ্গিতে। দেবাশিস কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। শুনতে পায় রবি বলছে–হেল্লো, ইজ রঞ্জন। অ্যারাউন্ড? ইয়েস, রঞ্জন, দিস ইজ রবি— আউট ফর ফান–ফাস্ট টু জু, দেন টু মণিমা অ্যাট মানিকতলা-ইয়েস। ও নো, নট মহেশতলা, মানিকতলা–এম ফর–এম—ফর–

দরজার কাছ থেকে দেবাশিস প্রম্পট করে মীরাট।

চোখের কোণ দিয়ে দেবাশিসকে একবার দেখে নিয়ে মাথা নাড়ে রবি। ফোনে বলে…এম ফর মাদার। এ ফর–

এলাহাবাদ।

এলাহাবাদ। রবি প্রতিধ্বনি করে— অ্যান্ড এন ফর নিউ দিল্লি আই ফর ইন্ডিয়া।

দেবাশিস আস্তে আস্তে সরে আসে। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে। অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরায়। কথাটা কানে বিধে থাকে। এম ফর মাদার।

রবি যখন গাড়িতে এসে উঠল দেবাশিস একটু গম্ভীর। গাড়ি ছেড়ে চালাতে চালাতে বলে, তুমি ওভাবে স্পেলিং করছিলে কেন? ফোনে স্পেলিং করতে জায়গার নাম বলাই সুবিধা। মাদার কি কোনও জায়গা?

রবি একটু শিশু হাসি হাসে। বলে, জায়গাই তো।

জায়গা? মাদার আবার কী রকম জায়গা?

যেমন মাদারল্যান্ড।

দেবাশিস হাসে। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলে, কিন্তু তুমি তো শুধু মাদার বললে, ল্যান্ড তো বলেনি।

লজ্জায় দু’হাতে চোখ ঢেকে একটু হাসে রবি। বলে, ভুল হয়েছিল।

গভীর একটা শ্বাস ফেলে দেবাশিস। রবি এখনও ভোলেনি, শুধু চেপে আছে। ওর ভিতরে হয়তো শুধু কষ্ট হয় মায়ের জন্য। কে জানে!

রবি সিটের ওপর হাঁটু মুড়ে বসেছে, মুখে আঙুল, দুলছে সিটের ওপর, চাঁপা সতর্ক গলায় বলে, পড়ে যাবে সোনাবাবু।

তোমার কেবল ভয়। বলে রবি ইচ্ছামতো দোল খায়। বলে, বাবা, আমি পিছনের সিটে বসব, দিদির কাছে?

যাও। দেবাশিস অন্যমনস্কভাবে বলে।

চাঁপা হাত বাড়িয়ে সিটের ওপর দিয়ে পিছনে টেনে নেয় রবিকে। সারাক্ষণ এরকমই করে রবি। একবার পিছনে যায়, একবার সামনে আসে। দুই হয়েছে খুব। দেবাশিস ওকে বকে না। মায়া হয়। ওর কি বড় মায়ের কথা মনে পড়ে?

দেবাশিস চন্দনাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। একটা সময় অনেক মেয়ের সঙ্গে ভাব ছিল তার। কাকে বিয়ে করবে তার কিছুই ঠিক ছিল না। চন্দনা ছিল সে সব মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে দুঃসাহসী আর কৌশলী। কুমারী অবস্থায় সে গর্ভে দেবাশিসের সন্তান নেয়। সেই অবস্থায় তাকে ফেলতে পারার সাধ্য দেবাশিসের হয়নি। চন্দনা সন্তান নষ্ট করতে দেয়নি। বলেছে—তুমি যদি বিয়ে না কর না করবে, ও আসুক কুমারী মায়ের কোলে।

সেটাই ছিল ওর কৌশল। দেবাশিস দু’মাসের গর্ভবতী চন্দনাকে বিয়ে করে আনল। যথাসময়ে রবি হল। ওর চার বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিল চন্দনা।

বড় রাগি ছিল, ভেবেচিন্তে কিছু করত না।

তৃণার সঙ্গে দেবাশিসের সম্পর্কটা তখনও তৈরি হয়নি। তৃণা মাঝে-মধ্যে তাকে ডাকত ছবি আঁকার সুলুকসন্ধান জানতে। ওটা তখন তার বাই। জলরঙা ছবি আঁকতে গিয়ে তুলির জ্যাবড়া দাগ আর অসহিষ্ণু টান দিয়ে হয়রান হত। দেবাশিস তাকে তুলি চালাতে শিখিয়েছিল। দুটো রঙের মাঝখানে কীভাবে একটা রঙের সঙ্গে আর একটাকে মেলাতে হয় তার কৌশল অভ্যাস করাত। কিন্তু তাতে সময় নিত বড্ড বেশি। ব্যস্ত দেবাশিস তার অর্থকরী সময়টা যে নষ্ট করছে তা খেয়াল করত না। বড় ভাল লাগত।

তৃণা দেখতে খুব সুন্দর তা তো নয়, উপরন্তু বিবাহিতা, দুটি বড় বড় সন্তানের মা, এমন মেয়ের প্রতি আকর্ষণবোধ বড় অদ্ভুত দেবাশিসের পক্ষে। সে তো মেয়ে কিছু কম দেখেনি! তৃণার প্রতি এই দুর্বলতার তবে কারণ কী?

কারণ একটাই, কৈশোরকাল। সেই বয়সটায় যাবতীয় স্মৃতি বড় মারাত্মক। তৃণার মধ্যে আর কিছু

থাক, ছিল সেই স্মৃতির সৌরভ তাকে ঘিরে। রোগা দুঃখী সেই কিশোরী মেয়েটাকে সে কবে ভুলে গিয়েছিল। দুরন্ত সময় তাকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে তার কাছে। আর একটা কারণ চন্দনা নিজে।

তৃণার সুখের ঘর কেন ভাঙতে যাবে দেবাশিস? সে ভাল লোক ছিল না কোনওদিনই। তবু তার তো রুচি ছিল। সুযোগ পেলে সে যে-কোনও মেয়েকেই উপভোগ করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পাগল হয় না তো কারও জন্য! আর তৃণা পাগল করা মেয়েও নয়। যদিও তৃণার বয়স গড়িয়ে যায়নি, তবু তো ছেলেমেয়ের মা, গিন্নিবান্নি। এখন কি আর চোখে রং ছুড়ে দেয়ালা করে কেউ? ছবি-আঁকার ছলে তারা পরস্পরের দীর্ঘশ্বাস শুনেছিল। একজনের ছিল শচীন, অন্যজনের ছিল চন্দনা। তবু এও ঠিক, পৃথিবীতে কেউ কারও নয়।

দেবাশিস একটা জীবন যদি মেয়েবাজি না করত তবে তার চরিত্রে রাশ টানার অভ্যাস হত। কিংবা যদি চন্দনা হত মনের মতো বউ, তবে রাশ টানতে পারত চন্দনাই।

তা হল না। চন্দনা তাকে ঘরে টিকতে দিত না। কেবলই বলত— কোথায় ছবি আঁকা হচ্ছে, সব আমি জানি। তুমি মরে।

তখন সুন্দর ফ্ল্যাটটায় বাস করে তারা। লিফটে ওঠে নামে। গ্যারেজে গাড়ি। রবি তখন অজস্র কথা বলে। সংসারটা তখন সবে জমে উঠেছে।

একদিন ছুটির সকালে চন্দনা দেরি করে ঘুম থেকে উঠল। রবি ঘুমন্ত মাকে জ্বালাচ্ছিল খুব। উঠেই ঘা কতক দিল রবির পিঠে। যখন মারত তখন বড় নির্মমভাবে মারত, মায়া করত না, আবার একটু পরেই হামলে আদর করত। চন্দনার মাথায় একটু ছিট তো ছিলই।

সেদিন সকাল থেকেই চন্দনা বিগড়ে গেল।

দেবাশিস রোজকার মতো বসেছিল তার বাইরের ঘরে। সামনে খোলা স্টেটসম্যান, টুলের ওপর রাখা পা, পায়ের পাশে কফির কাপ। চন্দনা এসে স্টেটসম্যানটা কেড়ে নিল হাত থেকে। বলল, কী ভেবেছ তুমি?

কী ভাবব? ক্লান্ত দেবাশিস জবাব দেয়।

কত লোক অন্যায় করে ধরা পড়ে। তুমি কেন পড়ো না?

দেবাশিসের মনে পড়ে, সে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাইটা হাত বাড়িয়ে নিয়েছিল। মনে মনে প্রার্থনা করেছিল–হে ঈশ্বর, চন্দনা কেন বেঁচে আছে? মুখে বলেছিল— চুপ করো।

চন্দনা চুপ করল না। অসম্ভব রেগে গেল। উলটোপালটা বকতে লাগল দেবাশিসকে। গালাগাল দিল। অজস্র। অবশেষে কাঁদল এবং কাঁদতে কাঁদতেই অসংলগ্ন বকতে লাগল একা তুমি আমার বাবাকে ঠকিয়েছ…আমার ছেলেকে ঠকিয়েছ তুমি আমাকে লুকিয়ে টাকা জমাও—

এ সব কথা বাস্তব সত্য নয়। কোনও মানেও হয় না। ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার মত দিল–অজস্র মাথাধরার বড়ি, ঘুমের পিল, তার ওপর নিজের নির্ধারিত অসুখের জন্য নিজস্ব প্রেসক্রিপশানে খাওয়া ওষুধ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ— সব মিলেমিশে একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে।

সেই মানসিক ভারসাম্যহীনতা আর স্নায়ুর বিকার থেকে কোনও দিন সুস্থ হতে পারেনি চন্দনা। একদিন মরল। সাততলা থেকে সোজা লাফিয়ে পড়ল। তখন খুব ভোর। দেবাশিস আর রবি তখনও ওঠেনি।

দেবাশিস অবশ্য ছাড়া পেয়ে গেল কোর্ট থেকে। কিন্তু বেঁচে চন্দনা যতটা না ছিল, মরে তার চেয়ে ঢের বেশি ফিরে এল জীবনে। তাকে ভুলতেই তখন তৃণার পিপাসা ইচ্ছে করে খুঁচিয়ে তোলে দেবাশিস। যা অবৈধ তার মতো মাদক আর কী আছে!

বাবা! রবি ডাকে।

উঁ। দেবাশিস অন্যমনস্ক উত্তর দেয়।

চিড়িয়াখানায় আমরা কেন যাচ্ছি?

যাবে না?

অনেকবার গেছি তো। ভাল লাগেনি।

বিস্মিত দেবাশিস প্রশ্ন করে তবে কোথায় যাবে?

রবি লজ্জার সঙ্গে বলে, বেড়াতে ইচ্ছে করছে না।

তবে?

মণিমার কাছে চলো।

ও। দেবাশিস গাড়ি থামিয়ে একটু হাসে। তারপর মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলে, ঠিকই তো! সব ছুটির দিনে চিড়িয়াখানা কি আর ভাল লাগে!

ফিরে যাই চলো।

দেবাশিস মাথা নেড়ে বলে, পার্ক স্ট্রিটের কোন রেস্টুরেন্টে কী যেন খাবে বলেছিলে। খাবে না?

রবি তার চালাক হাসিটা হেসে বলে, পিপিং।

দেবাশিস বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে, যাবে না?

যাব। বুড়োদা, নিকু, পন্টু, থাপি, ঝুমু আর নানির জন্য নিয়ে যাব। ওদের বলেছিলাম এই রবিবারে পিপিঙের খাবার খাওয়াব।

হ্যাঁ?

হ্যাঁ। রবি হাসে!

স্নিগ্ধ চোখে তার দিকে চেযে থাকে দেবাশিস। গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।

বাবা।

উঁ।

মণিমা আমাকে খুব ভালবাসে।

জানি তো।

বুড়োদা, নিনকু, পন্টু সবাই।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। খুব ভালবাসে। গেলে ছাড়তেই চায় না। বলে, তুই আমাদের কাছে থাক।

ও!

আমি কেন ওদের কাছে থাকি না বাবা? মণিমা সকলের চেয়ে আমাকে বেশি ভালবাসে।

দেবাশিস সামান্য গম্ভীর হয়ে যায়। প্রথমটায় কথা বলতে পারে না। অনেকক্ষণ রবি নিঃশব্দে বাবার মুখখানা চেয়ে দেখে। মুখ দেখে বোধ হয় বুঝতে পারে, বাবা খুশি হয়নি।

পিছন থেকে চাঁপা বলে, তুমি বাড়িতে না থাকলে আমরা কার কাছে থাকব সোনাবাবু? বাবার যে তোমাকে ছাড়া ভীষণ মন খারাপ হয়।

অল্প কদিন থাকব। উত্তর দেয় রবি।

তারপর চলে আসবে? চাঁপা প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। আমিও তো বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারি না।

ময়দানের ভিতর দিয়ে গাড়ি উড়িয়ে দেয় দেবাশিস। এম ফর মাদার— কথাটা ভুলতে পারে না সে। তার ফ্ল্যাটবাড়িতে চন্দনার কোনও ফটো নেই। ইচ্ছে করেই চন্দনার সব ফটো সে তার লকারে চাবি দিয়ে রেখেছে, যাতে রবির চোখে না পড়ে। এই বয়সে মাতৃহীনের মায়ের কথা বেশি মনে পড়া বড় কষ্টকর। চন্দনার শাড়ি পোশাক, রূপটানের সব জিনিসপত্র, তার হাতের কাগজ কিংবা যত চিহ্ন ছিল সবই সরিয়ে দিয়েছে দেবাশিস, শাড়িগুলো বিলিয়ে দিয়েছে একে-ওকে। মানিকতলায় বোন ফুলিকে কয়েকটা দামি শাড়ি দিয়েছে, ও নিতে চায়নি তবু জোর করে দিয়েছিল দেবাশিস পড়ে থেকে নষ্ট হবে, তুই পর।

একদিন মনের ভুলে ফুলি একটা জয়পুরি ছাপওলা সিল্কের শাড়ি পড়েছিল রবির সামনে। রবি হাঁ করে কিছুক্ষণ দেখল শাড়িটা, তারপর মুখখানায় হাসি কান্না মেশানো একরকম অদ্ভুতভাব করে বলল, মণিমা, আমার মায়ের ঠিক এমন একটা শাড়ি ছিল।

শিশুদের মনের খবর রাখা খুবই শক্ত। ওদের স্মৃতি কত দূরগামী, কত ছবির মতো স্পষ্ট ও নিখুঁত তা বুঝতে পেরে একরকম অদ্ভুত যন্ত্রণা পেয়েছিল দেবাশিস। পারতপক্ষে সে তার মায়ের কথা বলে না। জানে, সে মায়ের কথা বললে তার বাবা খুশি হয় না। এতটা বুদ্ধি ওই শিশু-মাথায়।

বুকের ভিতরটা চলকে ওঠে দেবাশিসের। ছেলেটার প্রতি হঠাৎ ভালবাসায় ছটফট করে। পার্কস্ট্রিটের একটা বড় রেস্টুরেন্টে বসে মেনুটা রবির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, তোমার যা ইচ্ছে অর্ডার দাও। যা খুশি।

বলে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে।

রবি অবাক হয়ে বাবার দিকে চায়। মিটমিটে চোখে বাবার মুখখানা দেখে বলে, আমার তো ক্ষিদে নেই।

দেবাশিস হতাশ হয়ে বলে, সে কী!

রবি মাথা নেড়ে বলে, দিদি সকালে কত খাইয়েছে! বলতে বলতে গেঞ্জিটা ওপর দিকে তুলে পেটটা দেখিয়ে বলে, পেট দ্যাখো কেমন ভর্তি।

দিনের মধ্যে একশোবার রবির গায়ে হাত দিয়ে দেখত চন্দনা, টেম্পারেচার আছে কি না! রবির গায়ে হাত দিয়ে আবার নিজের গা দেখত, কখনও বা দেবাশিসকে ডেকে বলত দেখি তোমার গা রবির চেয়ে ঠাণ্ডা না গরম।

সব মায়েরই এই বাতিক থাকে। তার নিজের মায়েরও ছিল। আরও, দিনে একশোবার রবিকে খাওয়ানোর জন্য মাথা কুটত চন্দনা, খাইয়ে পেট দেখত। খেতে না চাইলে অনুনয় বিনয়, খোশামোদ, তারপর কিলচড় কষাত। বলত— না খেয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবি। আমি মরলে কেউ তোর খাবার নিয়ে ভাববে ভেবেছিস?

খাওয়ার ব্যাপারটা হলেই ছোট্ট রবি মাকে পেট দেখাত।

গেঞ্জিটা নামিয়ে করুণ চোখে রবি বলে, খাব না বাবা।

দেবাশিস একটা শ্বাস ফেলে বলে, আচ্ছা।

বাবা।

উঁ।

মণিমা তো মুরগি খায় না।

দেবাশিস খেয়াল করল। বলল, তাই তো! কিন্তু অর্ডার দিয়ে দিলাম যে।

মণিমার জন্য কী নেবে?

তুমিই বলো।

সন্দেশ আর দই, হ্যাঁ বাবা?

আচ্ছা।

রবি খুশি হয়ে হাসল। দেবাশিস রবির কথা শোনে। রবি যা চায় তাই দেয়। রবির যা ইচ্ছা তাই হয়। চন্দনার সময়ে তা হত না। রবি কিছু বায়না করলেই ক্ষেপে যেত চন্দনা। বকত। মারত। তবু সারাদিন চন্দনার পায়ে পায়ে ঘুরত রবি। বকা খেত, মার সহ্য করত, তবু আঁটালির মতো লেগে থাকত।

ওই রাগি আহাম্মক মেয়েটার মধ্যে আকর্ষণীয় বস্তু কী ছিল? ভেবেই পায় না দেবাশিস। যে অবস্থায় চন্দনার বিয়ে হয়েছিল তাতে তার বাপের বাড়ির দিকের কেউ খুশি হয়নি। চন্দনার বাবা তাকে প্রচুর মারধর করে বেঁধে রেখেছিলেন, মা কাঁদতে কাঁদতে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হন। সেই গোলমাল হাঙ্গামার ভিতর থেকে চন্দনাকে খুব শালীনতার সঙ্গে বিয়ে করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। দেবাশিস কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে একদিন ওদের বাড়ি চড়াও হয়। পাড়ার ছেলেদের আগে থাকতেই মোটা পুজোর চাঁদা দেওয়া ছিল। দেবাশিস চন্দনার বাবাকে শাসিয়ে এল ফের ওর গায়ে হাত তুলবেন তো মুশকিল। আছে।

চন্দনার বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। আজকাল ভদ্রলোক মানেই ভেড়ুয়া। এরপর থেকে চন্দনার ওপর অত্যাচার কমে গেল বটে, কিন্তু বাড়ির লোক তার সঙ্গে কথা বলত না। দেবাশিস তখন মানিকতলায় বোনের বাড়িতে আলাদা একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। একজন গর্ভবতী মেয়েকে বিয়ে করে তোলা ভগ্নীপতি ভাল চোখে দেখেনি। বোনও রাজি ছিল না। চন্দনা প্রায়ই টেলিফোন করে বলত— বেশি কিছু তো চাইনি, কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে সিথিতে একটু সিঁদুর ছুঁইয়ে দাও। তা হলেই হবে।

দেবাশিস বলত–তা হবে না। সেটা তো পরাজয় মেনে নেওয়া। আমি তোমাকে ফুল ফ্লেজেড বিয়ে করে নিজের বাসায় তুলব।

তাই করছিল সে। পাগলের মতো ঘুরে যাদবপুরে বাসা ঠিক করে ফেলল। হাতে টাকার অভাব ছিল না। প্রচুর গয়না শাড়ি দিয়ে সাজিয়ে বিয়েবাড়ি ভাড়া করে পুরুত ডেকে বিয়ে করল। চন্দনার এক দাদা সম্প্রদান করে যান।

চন্দনার মতো একটা অপদার্থ মেয়ের জন্য এত পরিশ্রম আর হাঙ্গামা কেন করেছিল দেবাশিস, তা ভাবতে অবাক লাগে। বিয়ের অল্প কিছু পরেই চন্দনার তাগাদায় অভিজাত পাড়ায় অনেক টাকা দিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ খোলা ফ্ল্যাট কিনল। এই বিপুল উদ্যোগ বৃথা গেছে। বিয়ের অল্প কিছু পরেই দেবাশিস বুঝতে পারে, বিয়ে কোনও স্বর্গীয় বিধি নয়। চন্দনা তার বউ হওয়ার উপযুক্ত নয়। এত অগভীর মন, এত রাগ, অধৈর্য, এমন অর্থকেন্দ্রিক মন-সম্পন্ন মেয়ের সঙ্গে কী করে থাকবে সে। নিজে চরিত্রহীন হলেও তার কিছু শিল্পীসুলভ নিস্পৃহতা আছে, সামান্য কিছু ব্যবসায়িক সততা, কর্মনিষ্ঠা। তার মনে হত সারাদিন কাজের পর পুরুষ যখন বাসায় ফেরে তখন দগ্ধ দিনে ছায়ার মতো স্ত্রী তাকে আশ্রয় দেয়। স্ত্রী। হচ্ছে বিশ্রামের জায়গা।

দেবাশিস প্রায়দিনই বাসায় ফিরে চন্দনাকে দেখতে পেত না। হয় মার্কেটিং, নয় সিনেমা-থিয়েটার, নয়তো বাপের বাড়ি চলে যেত চন্দনা। বিয়ের পর বাপের বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক কীভাবে যেন নিদারুণ ভাল হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে নিঃসঙ্গ তৃণা এক নিভৃত জলস্রোতে নৌকোর মতো তার কাছাকাছি এসে গেল। উতরোল স্রোত। কিন্তু নিশ্চিত। দেবাশিস কোনওদিনই কারও প্রেমে পড়েনি এতকাল। এবার পড়ল। এক অসহনীয় অবস্থায়। অসম্ভব এক প্রেম।

রবি এখন ওই তার মুখোমুখি বসে আছে। কী চোখে রবি চন্দনাকে দেখেছিল তা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। ওই রাগি, অপদার্থ, অগভীর মাকে কেন অত ভালবাসত রবি? রবির কাছ থেকে তা জানতে ইচ্ছে হয়! জানতে ইচ্ছে করে, কোনওভাবে না কোনওভাবে ভালবাসার কোনও উপায় ছিল কি না।

বেয়ারা মস্ত একটা বাদামি কাগজের প্যাকেটে মোড়া বাক্স নিয়ে এল ট্রেতে। সঙ্গে বিল। দাম আর টিপস মিটিয়ে উঠে পড়ে দেবাশিস। ঘড়ি দেখল। এখনও অনেক সময় আছে। চিড়িয়াখানার সময়টা বেঁচে গেল।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়