॥ চার ॥

পোশাক যতই পরুক, আর যতই সাজুক, তৃণার মুখের দুঃখী ভাবটা কখনও যায় না। একটা অপরাধবোধে মাখা মুখখানায় করুণ হাসিহীন, শুকনো ভাব ফুটে থাকেই। চোখে ভীরু চঞ্চল ভাব।

বেরোবার মুখে দেখল, হুড়মুড় করে সাইকেল নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকে এল মনু। চমৎকার লালরঙা স্পোর্টস সাইকেল। মনুর চেহারা বেশ বড়সড়। পরনে সাদা শর্টস, সাদা গেঞ্জি, কাঁধে একটা টার্কিশ তোতায়ালে, পায়ে কেডস আর মোজা। হাত পায়ের গড়ন সুন্দর, বুকের পাটা বড়। হাতে টেনিস র‍্যাকেট। মাটিতে পা ঠেকিয়ে সাইকেলটা গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড় করাল। চোখ তুলে মৌন মুখে মাকে দেখল একবার।

ভারী পাল্লার কাচের দরজার সঙ্গে সিটিয়ে যাচ্ছিল তৃণা। বুকের ভিতরটা কেমন চমকে ওঠে। ছেলের চোখে চোখ পড়তেই, হাত পায়ে সাড় থাকে না। মনু আজকাল কদাচিৎ কথা বলে। দিনের পর দিন একনাগাড়ে উপেক্ষা করে যায়।

কাচের দরজার কাছ থেকে একটুও নড়তে পারল না তৃণা। মনু সাইকেলে বসে থেকেই সাইকেলের ঠেস দেওয়ার কাঠিটা পা দিয়ে নামাল। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে লঘু পায়ে নেমে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। তৃণার দিকে এক পলক দেখল আবার। চোদ্দো বছরের ছেলের আন্দাজে মনুকে বড় দেখায়। চেহারাটা তো বড়ই, চোখের দৃষ্টিতে পাকা গাম্ভীর্য, এটা বোধ হয় ওর বাপের ধারা। বয়সের আন্দাজে ওর বাপও গভীর, বয়স্কজনোচিত হাবভাব।

সামনেই মস্ত কয়েরের পাপোশ পাতা। মনু তার কেডসটা ঘষে নিচ্ছিল, দরজার চৌকাঠে হাত রেখে। ওর শরীরের স্বেদগন্ধ, রোদের গন্ধ তৃণার নাকে এল। সে যে এই বড়সড় সুন্দর চৌখস ছেলেটির মা তাকে বিশ্বাস করবে! চেহারায় অমিল, স্বভাবে অমিল, তার ওপর মনু আজকাল ডাকখোঁজ করেই না। কতকাল ‘মা’ ডাক শোনেনি তৃণা।

তাকে কাচের দরজায় অমন সিঁটিয়ে থাকতে দেখে মনু আবার একবার তাকাল, ক্রু কোঁচকাল। মনে মনে বোধ হয় কী একটু এঁকে নিল বাতাসে। হঠাৎ চূড়ান্ত তরল গলায় বলল, চ্যানেল নাম্বার সিক্স!না?

তৃণা ভারী চমকে ওঠে। সত্যি কথা। সে যে সেন্টটা আনিয়েছে তা চ্যানেল নাম্বার সিক্স। কিন্তু এত ঘাবড়ে গিয়েছিল তৃণা যে উত্তর দিতে পারল না। কেবল বিশাল দুটি চক্ষু মেলে তাকিয়ে থাকল ছেলের দিকে, ভূতগ্রস্তের মতো। কারণ, ছেলের চোখে চোখ রাখতে আজকাল তার মেরুদণ্ড ভেঙে নুয়ে যায়।

মনু অবশ্য তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করে না। চটপটে পায়ে ভিতরবাগে চলে যায়, লবি পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে। ও এখন ঠাণ্ডা জলে স্নান করবে, পোশাক পরবে, তারপর বেরোবে কোথাও।

ওর চলে-যাওয়ার রাস্তার দিকে অপলক চেয়ে থাকে তৃণা। তক্ষুনি বেরোতে পারে না। আস্তে আস্তে ঘুরে আসে। অনেকখানি মেঝে পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসে দোতলায়। একটু বিশ্রাম করে যাবে।

মনু আর রেবার ঘর বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে। মাঝখানে হল, হলে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ দিকের ঘর থেকে সে মৃদু একটা শিসের শব্দ শোনে। এক পা এক পা করে এগোয় দক্ষিণের দিকে। এদিকে সে আজকাল একদম আসে না। এলে ছেলেমেয়েরা বিরক্ত হয়, জ কোঁচকায়, সামনে থেকে সরে যেতে চেষ্টা করে। এ বাড়িতে সে এক পক্ষ, আর ছেলে মেয়ে বাপ মিলে আর এক পক্ষ। মাঝখানে অদৃশ্য কুরুক্ষেত্রের বিচিত্র সব চোখের বাণ ছোটাছুটি করে, আর মৌনতার অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় পরস্পরের দিকে।

মনুর ঘরে মনু আছে। দরজা আধখোলা, পর্দা ঝুলছে। অন্যপাশে রেবার ঘর। ঘরটা নিস্তব্ধ। তৃণা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনে। না, ভিতরে কোনও শব্দ নেই। খুব দুঃসাহসে ভর করে সে কাঁপা, ঠাণ্ডা, দুর্বল হাতে পর্দা সরিয়ে ভিতরে পা দেয়। ফাঁকা ঘর। একধারে বইয়ের র‍্যাক, পড়ার টেবিল, ওয়ার্ডরোব, আলমারি, মাঝখানে দামি চেয়ার কয়েকটা। নিচ সেন্টার টেবিলে তাজা ফুল রাখা।

ঘরভর্তি মৃদু ধূপকাঠির সৌরভ। রেবার বয়স বারো, কিন্তু সে একজন প্রাপ্তবয়স্কা মহিলার মতোই থাকে। তৃণা ফোম রাবারের গদিআলা বিছানাটায় একটু বসে। বুকজোড়া ভয়। পড়ার টেবিলের ওপর স্ট্যান্ডে রেবার ছবি। পাতলা গড়নের ধারালো চেহারা। নাকখানা পাতলা ফিনফিনে, উদ্ধত। টানা চোখ।  সব মিলিয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ আছে। সে তুলনায় মনুর চেহারাটা একটু ভোঁতা, রেবার মতো বুদ্ধি মনু রাখে না। রেবা মডার্ন স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। সম্ভবত হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করবে। মনু অত তীক্ষ্ণ নয়, সে কেবল টেনিস কিংবা অন্য কোনও খেলায় ভারতের এক নম্বর হতে চায়। হাসিখুশি আদি ছেলে, মনটা সাদা। সেই কারণেই বোধ হয় কখনও সখনও মনু এক-আধটা কথা তার মার সঙ্গে বলে ফেলে।

কিন্তু রেবার গাম্ভীর্য একদম নিরেট আর আপসহীন। যেমন তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, তেমনই তীক্ষ্ণ তার উপেক্ষার ভঙ্গি। যতরকমভাবে অপমান এবং উপেক্ষা করা যায় ততরকমই করে রেবা। মার প্রতি মেয়ের এমন আক্রোশ কদাচিৎ কোনও মেয়ের মধ্যে দেখা যায়। মনুকে যতটা ভয় করে তৃণা, কিংবা শচীনকে, তার শতগুণ ভয় তার রেবাকে। মেয়েদের চোখ আর মন সব দেখে, সব ভাবে। ফ্রক-পরা রোগা মেয়েটাকে তৃণা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ মানুষ বলে জানে।

ঘরে ধূপকাঠির গন্ধ, স্নো ক্রিম ফাউন্ডেসনের গন্ধ, ঘর-সুগন্ধির মৃদু সুবাস। দেওয়ালের রং হালকা। নীল, আর ধূসর। বিপরীত দেওয়ালগুলি একরঙা। নানারকম আলোর ফিটিংস লাগানো, জানালা দরজায় পর্দা, পেলমেটে কেষ্টনগরের পুতুল সারি সারি সাজানো। বুককেসের ওপর একটা রেডিয়ো টেপরেকর্ডার, একধারে মিউজিক সিস্টেম আর সিডি এবং ক্যাসেটের ক্যাবিনেট। সমস্ত বাড়িটাই দেবাশিস সাজিয়েছিল। আসবাবপত্রগুলি সবই সাপ্লাই দিয়েছিল তার কোম্পানি।

ফটোস্ট্যান্ডে রেবার ছবিটার দিকে ভীত চোখে চেয়ে ছিল তৃণা। তার মনে হচ্ছিল, সে রেবার মুখোমুখি বসে আছে। রেবা তাকে দেখছে। ফটোতে রেবার সুন্দর হাসিটা যেন আস্তে আস্তে পাল্টে শ্লেষ আর ঘৃণার হাসি হয়ে যাচ্ছে।

তৃণার বুক কেঁপে কান্নার গন্ধ মেখে একটা খাস বেরিয়ে আসে। দুবে বৃষ্টি হলে যেমন জলের গন্ধ আসে বাতাসে তেমনই কান্নাটা ঘনিয়ে উঠছে। গন্ধ পায় তৃণা। কিন্তু বৃথা। কত তো কেঁদেছে তৃণা, কেউ পাত্তা দেয়নি।

তৃণা বহুকাল বাড়ির এদিকে আসেনি। রেবার ঘরে ঢোকেনি। এখন একা চোরের মতো ঢুকে তার বড় ভাল লাগছিল। বারো বছর বয়সে মেয়েরা মায়ের বন্ধু হয়ে ওঠে। এই বয়ঃসন্ধির সময়ে কত গোপন মেয়েলি তথোর লেনদেন হয় মা আর মেয়ের মধ্যে, এই বয়সেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় পাকা। মেয়ে আর। মেয়ে থাকে না, সখী হয়ে ওঠে।

কিন্তু হায়, রেবার সঙ্গে তৃণার কোনওদিনই আর সখিত্ব হবে না। ভিতু তৃণাকে মানসিক ভারসাম্যের শেষ সীমা পর্যন্ত ঠেলে দেবে রেবা—বুদ্ধিমতী এবং নিষ্ঠুব ওই মেয়েটা।

তৃণা উঠল, রেবা গানের স্কুলে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে, কিন্তু নিঃশব্দে ফিরবে না। ওর ছটফটে দৌড়পায়ের আওয়াজ অনেক দূর থেকেই পাওয়া যায়। তাই সাহস করে তৃণা উঠে ঘুরে ঘুরে ওর ঘরটা দেখে। বুককে খুলে বই হাতড়ায়। ওয়ার্ডদেবের ভিতরে ওর হরেক ফ্রক, ঘাগরা, প্যারালেলস আর শাডিতে হাত বুলিয়ে নেয়। বিছানার ওপর একটা নাইটি পড়ে আছে। ভীষণ পাতলা একটা বিদেশি কাপড়ের তৈরি। সেটা গুছিয়ে ভাঁজ করে রেখে দেয়। বেডকভারটা টান করে একটু। পড়ার টেবিলটা সাজানো আছে। তবু একটু নেড়েচেড়ে রেখে দেয়, খুঁজতে খুঁজতে কয়েকটা ড্রইং খাতা পায় তৃণা, তাতে জলরঙা সব ছবি আঁকা। বুকের ভিতরটা ধুপধুপ করে ওঠে। রেবা কি ছবি আঁকে!

বুককেসের মাথায় রঙের বাক্স আর তুলির আলি খুঁজে পায় তৃণা। হ্যাঁ, সন্দেহ নেই, রেবা ছবি আঁকে। দরজার পাশে একটা নিচু শেলফে তবলা ড়ুগি, হারমোনিয়ম, তানপুরা সব সাজানো। হারমোনিয়ামের বাক্সের ওপর একটা কবিতার বইও পেয়ে যায় সে। বুক একটা আনন্দ সদ্যোজাত পাখির ছানার মতো শব্দ করে। রেবা কি কবিতা পড়ে।

আবার গিয়ে বুককেসটা খোলে তৃণা। বইগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে রাখা নেই। তাই অসুবিধে হয়। তবু একটু খুঁজতেই তার মধ্যে কিছু কবিতার বই খুঁজে পায় তৃণা। অবাক হয়ে উল্টেপাল্টে বইগুলো দেখে সময়ের জ্ঞান হারিয়ে যায়।

অন্যমনস্কতাবশত সে পায়ের শব্দটা শুনতে পায়নি, যখন শুনল তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। পর্দা সরিয়ে রেবা ঘরে ঢুকেই দাঁড়িয়ে পড়ল। রোগা তীক্ষ্ণ মুখখানা হঠাৎ সন্দিগ্ধ আর কুটিল হয়ে উঠল। ভ্রূ কোঁচকানো, রেবা তার দিকে একপলক চাইল তারপর চোখ ফিরিয়ে পা নেড়ে চটিদুটো ঘরের কোণে ছুড়ে দিল। ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। একপলকে সে তাকিয়েছিল তৃণার দিকে তাতে চোখে একটু বুঝি বিস্ময়, আর একটু ঘৃণা। বাদবাকি ব্যবহারটা উপেক্ষার।

পরনে একটা কমলারঙের হালফ্যাশনের ফ্রক। রোগ হলেও রেবা বেশ লম্বা। গায়ে মাংস লাগলে একদিন ফিগারটা ভালই দেখাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের একটা ব্রণ টিপল। আঙুল দিয়ে ঘষল জায়গাটা।

বলল, কী বলতে এসেছ?

একটু চমকে উঠল তৃণা। এঘরে সে যে অনধিকারী তা মনে পড়ল। বিপদ যা ঘটবার তা ঘটে গেছে, সে তো আর পালাতে পারে না এখন। আস্তে করে বলল, তোর আজ তাড়াতাড়ি হয়ে গেল যে।

অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে রেবা উত্তর দেয়— এ সময়েই ছুটি হয়। তাড়াতাড়ি আবার কী?

বলে আয়নায় মুখ দেখতে থাকে। আয়নার ভিতর দিয়েই বোধ হয় তৃণাকে এক-আধ পলক দেখে নিল। কিন্তু তৃণার সেদিকে তাকাতে সাহসই হল না। অপরাধীর মতো মুখ নিচু রেখে বলে, তুই কি ছবি

আঁকিস রেবু?

রেবা একটু অবাক হয় বোধ হয়। বলে, হ্যাঁ আঁকি।

জানতাম না তো!

ক্লাসে আমাদের ড্রইং শেখায়। এ সবাই জানে।

কবিতা পড়িস?

পড়ি।

তৃণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

রেবা একটু ঝাঁজ দিয়ে বলে, আর কী বলবে?

কিছু না।

আমার এখন অনেক কাজ আছে। পোশাক ছাড়ব। তুমি যাও।

যাচ্ছি। তৃণা উঠে দাঁড়ায়। কোনও বয়সের মেয়েই মায়ের সামনে পোশাক ছাড়তে লজ্জা পায় না। তবু তৃণা সসঙ্কোচে উঠে দাঁড়াল। এই ঘরে তার উপস্থিতির কোনও জরুরি অজুহাত খুঁজে না পেয়ে দুর্বল গলায় বলে, তুই নতুন কী রেকর্ড কিনলি দেখতে এসেছিলাম।

রেবা উত্তর দিল না। আয়নায় মুখ দেখতে থাকল।

তৃণা একটু শুকনো গলায় বলে, তোর ওয়ার্ডরোবে শাড়ি দেখছিলাম। পরিস না কি?

ইচ্ছে হলে পরি। তুমি যাও।

যাচ্ছি। আমার তো অনেক শাড়ি। তুই নিবি?

না।

কেন?

আমার অনেক আছে। দরকার হলে বাপি আরও কিনে দেবে।

তৃণা খাস ছেড়ে আপন মনে ভ্রূ কুঁচকে মাথা নাড়ে। এ সত্য তার জানা। প্রয়োজন হলে শচীন রেবাকে বাজারসুদ্ধ শাড়ি কিনে এনে দেবে। রেবা নিজে গিয়েও কিনে আনতে পারে বাজার ঘুরে, পছন্দমতো। তবু বাঙালি ঘরের রেওয়াজ, বয়স হলে মেয়েরা মায়ের শাড়ি পরে। সেটা শাড়ির অভাবের জন্য নয়। নিজের শাড়ি পরিয়ে মা মেয়েকে দেখে। মুখ টিপে মনে মনে হাসে। মায়েরা ওই ভাবেই আবার জন্মায় মেয়ের মধ্যে। কিন্তু রেবার তা দরকার নেই।

মুখশোষ টের পায় তৃণা। হাতে পায়ে শীত, মাথা গরম, খাস গরম। দু-পা হেঁটে যায় দরজার দিকে। একটু দাঁড়ায়। ফিরে তাকায় একবার। তার জ কোঁচকানো, চোখে বিশুষ্ক কামা। ওই গুয়ের গ্যাংলা মেয়েটা কত সহজে তার মা-পনা ঘুচিয়ে দেয়।

এ বাড়িতে দুটো ভাগ আছে। একদিকে তৃণা একা, অন্যদিকে শচীন, মনু আর রেবা। সিন্ডিকেট। ঘরগুলোর মাঝখানে যোজন-যোজন ব্যবধান পড়ে থাকে সারাদিন। তার পক্ষে কেউ নয়। তবু ওর মধ্যে কি মনু একটু মায়ের টান টের পায়? অনেকদিন ভেবেছে তৃণা। ঠিক বুঝতে পারে না। ন’ মাসে ছ’মাসে এক-আধবার মা বলে ডেকে ফেলে মনু। হয়তো কোনও কথা বলে ফেলে। খেতে বসে হয়তো এটা-ওটা চায়। তড়িঘড়ি এগিয়ে দেয় তৃণা। মনু কখনও কিছু বললে বাধ্য মেয়ের মতো তাই করে, তাই দেয়। কিন্তু বুকে এত কাঙালপনা নিয়েও তৃণা জানে, মনুর আসলে টান নেই। ও সোজা সরল ছেলে, দিনরাত খেলার কথা ভাবে, মাকে নিরন্তর ঘৃণা করার কথা মনে রাখতে পারে না। অন্যমনস্কতাবশত ভুলে যায়। একটু আগে কেমন স্মিতমুখে বলেছিল–চ্যানেল সিক্স না?

রেবার ভুল হয় না। নিরন্তর বুকে সাপের মতো পুষে রাখে উপেক্ষা আর ঘেন্না। কখনও তা থেকে অন্যমনস্ক হয় না রেবা। বয়স মোটে বারো বছর, এখনও ঋতুমতী নয় বোধ হয়, তবু কেমন সব গোপন করে রেখেছে মায়ের কাছে। কেমন স্বাধীন, ডাকাবুকো।

তৃণা যাই-যাই করেও খানিক দাঁড়ায়, বলে, আমার লকারে গাদা গয়না পড়ে আছে। পাঠিয়ে দেবখন, পরিস।

কে চেয়েছে?

চাইতে হবে কেন? ও তো তোর পাওনা।

আমি গয়না পরি না! তার ওপর সোনার গয়না! মাগো! বলে ঠোঁট মুখের একটা উৎকট ভঙ্গি করে রেবা।

তৃণা হ্যাংলার মতো হাসে। বলে, তা অবিশ্যি ঠিক। সলিড সোনার গয়না তোদের বয়সিরা আজকাল কেউ পরে না। বরং ভেঙে নতুন করে গড়িয়ে নিস।

আমি পরব না। তুমি পরো।

তুই তো একরত্তি মেয়ে, ওই রোগা শরীরে আর কখানা গয়নাই বা ধরবে। আমার অনেক আছে। তোকে দিয়েও থাকবে–তোরই তো সব।

তোমার কিছুই আমার নয়। না পরলে বিলিয়ে দিয়ো।

কেন, পরবি না কেন?

ইচ্ছে। শাড়ি গয়নার কথা শুনলে আমার মাথা ধরে। তুমি এখন যাও।

ভুল অস্ত্র। কিন্তু এ ঠিক তৃণার দিক থেকে লোভ দেখানো নয়। কিছুক্ষণ রেবার ঘরে থাকার জন্য এ হচ্ছে এলোপাথাড়ি কথা কওয়া,নইলে সে জানে, রেবার কিছু অভাব নেই। এখনকার মেয়েরা শাড়ি গয়নার নামে ঢলে পড়ে না।

রেবা খাটের অন্যধারে বসে পা দোলায়। পায়ের আঙুলের রুপোর চুটকিতে ঝুনঝুন শব্দ হয় একটু। খুব অবহেলার অনায়াস ভঙ্গি। তৃণার বারো বছর বয়সটা কেটেছে বিছানায়। ওই সময়ে এত সতেজ, প্রাপ্তবয়স্কতার ভাবভঙ্গি তার ছিল না। ওই বয়সে ছিল কত ভয়, সংশয়, কত আত্ম-অবিশ্বাস! তবু তৃণা। মনে মনে একরকম খুশিই হয়। মেয়েটা তার মতো হবে বোধ হচ্ছে। ছবি আঁকে, কবিতা পড়ে, শাড়ি-গয়নার দিকে মন নেই।

ও ঘরের বাথরুম থেকে মনুর সুরহীন হিন্দি গান শোনা যায়। তার সঙ্গে জলের প্রবল শব্দ। সেই জলশব্দে তেষ্টা পায় তৃণার। আসলে বুকটা কাঠ হয়েই ছিল। জলের কথা খেয়াল হচ্ছিল না তার।

ভিখিরির মতো তৃণা বলে, একটু জল খাওয়াবি রেবু?

রেবা ভীষণ বিরক্ত হয়। তার রোগা, তিরতিরে বুদ্ধির মুখখানায় কোনও মুখোশ নেই। সহজেই রাগ, বিরক্তি, অভিমান বোঝা যায়। জ্ব, নাক, চোখ কুঁচকে উঠল। তবু পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে দেয়ালে পিয়ানো রিডের মতো একটা সুইচ টিপে ধরল।

ঠিন ঠিন করে গোটা-দুই সুরেলা আওয়াজ হল ভিতরে। অমনি ঝি দুর্গার মা এসে দাঁড়ায় দরজায়, নীরবে।

রেবা বলে, এক গ্লাস জল।

এরকমই হওয়ার কথা। রেবা নিজের হাতে জল গড়িয়ে দেবে না, এ কি জানত না তৃণা?

দুর্গার মা হলঘরের কুলার থেকে ঠাণ্ডা জল এনে দিল। ট্রের ওপর স্বচ্ছ কাটগ্নাসের পাত্র, ওপরে একটা কাচের ঢাকনা। জলটা হিরের মতো জ্বলছে। তৃণা সবটুকু খেয়ে নিল।

রেবা বলে, এবার হয়েছে? এখন যাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

তৃণা ভাল মেয়ের মতো বলে, এই খাড়া দুপুরে আবার বেরোবি নাকি?

বেরোলেই বা!

কোথায় যাবি?

কাজ আছে।

তুই যে কবিতার বইগুলো কিনেছিস ওগুলোর সব আমার নেই। এক আধখানা দিস তো, পড়ব।

রেবা উত্তর দিল না। ওয়ার্ডরোব থেকে পছন্দমতো পোশাক বের করতে লাগল। একটা লুঙ্গি আর কামিজ বের করে সাজাল বিছানার ওপর। বিশুদ্ধ সিল্কের হালকা জামরঙের লুঙ্গি। সোনালি সিল্কের ওপর ছুঁচের কাজ করা কামিজ।

বাঃ ভারী সুন্দর তো।

কী সুন্দর! ঝামরে ওঠে রেবা।

পোশাকটা। কবে করালি?

রেবা তার পাতলা ধারালো মুখখানা তুলে তৃণাকে এক পলকের কিছু বেশি লক্ষ করল। তৃণা চোখ সরিয়ে নেয়।

রেবা বলে, তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও।

তৃণা হ্যাংলার মতো তবু বলে, বড্ড রোদ উঠেছে আজ। ছাতা নিবি না?

সে আমি বুঝব।

রেবু, আমার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।

ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকে।

তুই অমন করছিস কেন?

রেবা উত্তর না দিয়ে তার ঘরের লাগোয়া নিজস্ব বাথরুমে চলে গেল। সশব্দে দরজা বন্ধ করল। ফাঁকা ঘরে একা তৃণা দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিই তার শরীর খারাপ লাগছিল। খুব খারাপ, যেন বা গা ভরে জ্বর আসছে। চোখে জ্বালা, হাত-পা কিছুই যেন তার বশে নেই। আর মাথার মধ্যে চিন্তার রাজ্যে একটা বিশৃঙ্খলা টের পায় সে। পূর্বাপর কোনও কথাই সাজিয়ে ভাবতে পারে না।

শরীরটা কাঁপছিল, খুব ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে তৃণা। হলঘরে হালকা অন্ধকার। ঠাণ্ডা। একটু দাঁড়ায়, তারপর অবশ হয়ে দেয়ালের গায়ে লাগানো নরম কৌচটায় বসে পড়ে। কৌচের পাশে মস্ত রঙিন কাঠের বাক্সে লাগানো পাতাবাহারের গাছের পাতা তার গাল স্পর্শ করে।

ঝিম মেরে একটুক্ষণ বসে থাকে তৃণা। কতকাল সে তার শরীরের কোনও খোঁজ রাখে না, ভিতরে ভিতরে কী অসুখ তৈরি হয়েছে কে জানে! মাথাটা ঠিক রাখতে পারছে না সে। স্খলিত হয়ে যাচ্ছে স্মৃতি, পারম্পর্যহীন সব এলোমেলো কথা ভেসে আসছে মনে। ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে খুব।

একটা তীব্র শিসের শব্দে সে মুখ তোলে। গায়ে ব্যানলনের দুধসাদা গেঞ্জি, পরনে সু-জিন্স পরা মনু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে যাচ্ছিল। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে ডান হাতের ব্রেসলেটে ঢিলা করে পরা ঘড়িটা দেখল। সময়টা বিশ্বাস হল না বুঝি। তারপর তৃণাকে লক্ষ না করেই আবার চলে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে।

পাতাবাহারের আড়াল থেকে মনুর সুন্দর চেহারাটা দেখে তৃণা। এই বয়সেই মনু মোটর চালায়, টেনিস খেলে, বিদেশি নাচ শেখে। তৃণার জগৎ থেকে অনেক দূরে ওর বসবাস। বড়সড় স্বাস্থ্যবান ওই ছেলেটা যে তার গর্ভজ সন্তান, তা তৃণার বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস হলেও এক এক সময়ে বড় ভয় করে, এক এক সময়ে অহংকার হয়। কিন্তু এ তো সত্যি কথা, মনুর জগতে তৃণা বলে কেউ নেই।

সিঁড়ির মাথায় চলে গিয়েছিল মনু। এক্ষুনি নেমে যাবে।

তৃণার গলায় একটুও জোর ফুটল না। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল–মনু!

ডাকটা মনুর শোনার কথা নয়। মস্ত হলঘরটার অন্য প্রান্তে চলে গেছে সে। তার ওপর শিসে একটা গরম হিন্দি টিউন তুলছে। তা ছাড়া যৌবনবয়সের চিন্তা আছে, আর আছে ঘরের বাইরে জগতের আনন্দময় ডাক। মায়ের ক্ষীণকণ্ঠ তার শোনার কথা নয়। তবু দ্রুত দু’ ধাপ সিঁড়ি চঞ্চল পায়ে নেমে গিয়েও দাঁড়াল সে! একটু এপাশ ওপাশ তাকাল। হয়তো ক্ষীণ সন্দেহ হয়ে থাকবে যে কেউ ডেকেছে।

পাতাবাহারের আড়ালে মুখখানা ঢেকে তৃণা তেমনি ক্ষীণ গলায় বলে, মনু, আমি এখানে।

এবার মনু শুনতে পায়। ফিরে তাকায়। মুখে একটু ভ্যাবলা অবাক ভাব। শরীরটা যত বড়ই হোক, ওর বয়সে এখনও ছেলেরা মায়ের আঁচলধরা থাকে।

মনু তাকে দূর থেকে দেখল। রাঙা শাড়ি পরেছে তৃণা, মেখেছে দামি বিদেশি সুগন্ধ, আর নানা রূপটান। নষ্ট মেয়ের সাজ। একটু আগে বাড়িতে ঢোকার সময়ে তাই কি ঠাট্টা করে মনু বলেছিলচ্যানেল নাম্বার সিক্স, না? নষ্টামিটা কি তৃণার শরীরে খুব স্পষ্ট হয়ে আছে?

মনু সিঁড়ির দু’ ধাপ উঠে আসে। হলঘরটা লম্বা পদক্ষেপে পার হয়ে সামনে দাঁড়ায়। মুখে একটা গা-জ্বালানো ঠাট্টার হাসি। হালকা গলায় বলে, আরে! তুমি তো বেরিয়ে গেলে দেখলাম।

তৃণা তৃষিত মুখখানা তুলে ওকে দেখে। কী বিরাট, কী প্রকাণ্ড সব মানুষ এরা।

মাথা নেড়ে তৃণা বলে, যাইনি।

যাওনি তো দেখতেই পাচ্ছি। কী ব্যাপার?

তুই কোথায় যাচ্ছিস?

বেরোচ্ছি।

আমার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।

শুনে মনুর মুখে খুব সামান্য, হালকা জলের মতো একটু উদ্বেগ খেলা করে গেল কি? বলল, শরীর খারাপ তো শুয়ে থাকো।

মনুর মুখখানা অবিকল তৃণার মতো। মাতৃমুখী ছেলে। ওর চোখে একটা মেয়েলি নম্রতা আছে। এ সবই তৃণার চিহ্ন। মনুর মুখে চোখে তৃণার চিহ্ন ছড়ানো আছে। অনেকদিন বাদে একটু লক্ষ করে তৃণা খুব গভীর একটা খাস ফেলে।

মনু একটু ঝুঁকে তাকে দেখে নিয়ে বলে, খুব সেজেছ দেখছি। তবু তোমাকে খুব পেল দেখাচ্ছে। চোখও লাল। ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো।

আমাকে একটু ধরে ধরে নিয়ে যাবি?

এসো। বলে সঙ্গে সঙ্গে মনু হাত বাড়ায়।

ভারী অবাক মানে তৃণা, ও কি তাকে ছোঁবে? ঘেন্না করবে না ওর? তৃণা সঙ্কুচিত হয়ে বলে, তোর দেরি হচ্ছে না তো!

হচ্ছে তো কী? এসো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাই ঘরে।

তৃণা উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ তাকে চমকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মনু তাকে এক ঝটকায়। পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে চেঁচিয়ে হেসে বলে, আরে! তুমি তো ভীষণ হালকা।

তৃণার মাথা ঘুরে যায়, দম বন্ধ হয়ে আসে। সে ককিয়ে কান্না গলায় বলে, ছেড়ে দে, ওরে!

তুমি কি ভাবছ তোমাকে নিতে পারব না?

ফেলে দিবি। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে তৃণা।

দূর! আমি ওয়েটলিফটার, জানো না? তুমি তো মশার মতো হালকা। বলে দুহাতে তৃণার শরীরটার। ওপরে নীচে একবার দুলিয়ে দেখায় মনু। তৃণা তখন ছেলের শরীরের সুঘ্রাণটি পায়। মৃদু সাবান পাউডার, আর জামাকাপড়ে ওয়ার্ডরোবের পোকা-তাড়ানো ওষুধের গন্ধ। এ সব ভেদ করে মনুর গায়ের রক্তমাংসের একটা গন্ধ, একটা স্পন্দন পায় না কি সে?

অনায়াসে মনু হলঘরটা পার হয়ে যায় তৃণাকে পাঁজাকোলে নিয়ে। তৃণা ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে ছিল, মুঠো হাতে খামচে ধরে ছিল মনুর গেঞ্জির বুকের কাছটা।

নরম বিছানায় মনু তৃণাকে ঝুপ করে নামিয়ে দিয়ে হাসে–দেখলে তো?

তৃণা একটু ক্ষীণ হেসে বলে, নিজের শরীরে অত নজর দিসনা। নিজের নজর সবচেয়ে বেশি লাগে। সবাই আমাকে নজর দেয়। বন্ধুরা আমাকে স্যামসন বলে ডাকে।

বালাই ষাট।

মনু ঠাট্টার হালকা এবং বোকাহাসি হাসে। বলে, চলি?

কোথায় যাবি?

যাওয়ার অনেক জায়গা আছে।

মনু মাথা ঝাঁকায়। দরজার কাছ থেকে একবার সাহেবি কায়দায় হাতটা তোলে। চলে যায়।

মনুর শরীরের সুঘ্রাণ এখনও ভরে আছে তৃণার শাসপ্রশ্বাসে। ছোট থেকেই মনু মোটাসোটা ভারী ছেলে, টেনে ওকে কোলে তুলতে কষ্ট হত। তখন থেকে সবাই ছেলেটাকে নজর দেয়। এখন দেখনসই চেহারা হচ্ছে। পাঁচজনে তাকাবেই তো! ভাবতে এক রকম ভালই লাগে তৃণার। দুঃখ এই যে, ছেলে তার হয়েও তার নয়। একটু বুঝি বা কখনও মনের ভুলে মাকে মা বলে মনে করে। তারপরই আবার আলগা দেয়। দূরের লোক হয়ে যায় সব। তৃণা ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। কত রকম যে ভয় তার! সে চুপ করে শুয়ে মনুর কথা ভাবতে থাকে।

শচীন কোথায় গিয়েছিল, এইমাত্র ফিরে এল। পাশের ঘর থেকে তার সুরহীন গুন গুন ধ্বনি আসে। হলঘরে ঘড়িতে ঘণ্টা বাজছে। ঘোরের মধ্যে শুয়ে থেকে সেই ঘণ্টাধ্বনি শোনে তৃণা। শুনতে শুনতে হঠাৎ চমকে উঠে বলল, এগারোটা না?

বুকের মধ্যে ধুপ ধুপ করে। উত্তেজনায় নয়। হঠাৎ উঠে বসায় বুকে একটা চাপ লেগেছে। বাসস্টপটা খুব দূরে নয়। দেবাশিস এসে অপেক্ষা করবে। নিজের মানুষজনের কাছে বড় পুরনো হয়ে গেছে তৃণা, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে এমন কাউকে চাই যার কাছে প্রতিদিন তৃণার জন্ম হয়।

সে উঠল। শরীর ভাল নেই। মন ভাল নেই। এই ভরদুপুরে সে যদি বেরিয়ে যায়, অনেকক্ষণ ফিরে আসে তবু কারও কোনও উদ্বেগ থাকবে না। কেউ একফোঁটা চিন্তা করবে না তৃণার জন্য।

হলঘর থেকে রেবার উচ্চকিত স্বর পাওয়া গেল— বাপি!

শচীন গভীর স্বরে জবাব দেয়— হুঁ!

আমি বেরোচ্ছি।

আচ্ছা।

শচীন তার দাঁড়ে সব পাখিকে শেকল পরাতে পেরেছে। এ সংসারে তৃণার মতো পরাজিত কেউ না। শচীন একই সঙ্গে ছেলেমেয়ের মা ও বাবা, ওরা কোথায় কি যায় কী করে, তা তৃণার জানা নেই। যেমন, আজ দুপুরে কে কে বাড়িতে খাবে, বা কার বাইরে নিমন্ত্রণ আছে, তা সে জানে না। কেউ বলে না কিছু। যা বলে তা শচীনকে। একা, অভিমানে তৃণার ঠোঁট ফোলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে তার কোঁচকানো শাড়িটা ঠিকঠাক করে নেয়, বেরোবে।

বেরোবার মুখে সে হলঘর পেরোতে গিয়ে দেখে শচীন টবে গাছগুলি ঝুঁকে দেখছে। তৃণার দিকে পিছন ফেরানো। চল্লিশের কিছু ওপরে ওর বয়স, স্বাস্থ্য ভাল। তবু ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে একজন বৃদ্ধের ভাবভঙ্গি লক্ষ করা যায়। কিছু ধীরস্থির, চিন্তামগ্ন বিবেচকের মতো দেখতে, পাকা সংসারীর ছাপ চেহারায়।

তৃণা নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল। শচীনের টের পাওয়ার কথা নয়। তবু শচীন টের পেল। হঠাৎ বুকে কী একটা তুলে নিয়ে ফিরে সোজা তার দিকে তাকাল। হাতে একটা ছোট্ট রুমাল। তৃণার।

শচীন জিজ্ঞেস করে–এটা তোমার?

খুব সুক্ষ্ম কাপড় আর লেস দিয়ে তৈরি রুমালটা তারই। সোফায় বসে থাকার সময়ে পড়ে গিয়ে থাকবে।

তৃণা মাথা নাড়ল।

এখানে গাছের গোড়ায় পড়ে ছিল। বলে শচীন রুমালটা সোফার ওপর আলতোভাবে রেখে দিয়ে আবার গাছ দেখতে লাগল। জাপান থেকে বেঁটে গাছ আনাচ্ছে, শুনেছে তৃণা। সে গাছ কাচের বাক্সে। হলঘরে রাখা হবে। বোধ হয় সে ব্যাপারেই কোনও প্ল্যান করছে।

রুমালটা তুলে নিতে গিয়ে তৃণাকে শচীনের খুব কাছে চলে যেতে হল। তার শ্বাস প্রশ্বাস, গায়ের গন্ধ ও উত্তাপের পরিমণ্ডলটির ভিতরেই বোধ হয় চলে যেতে হল তাকে। তৃণা নিজের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ টের পায়। অবশ্য শচীন খুবই অন্যমনস্ক। সে মোটে লক্ষই করল না তাকে।

তৃণা রুমালটা তুলে নিল। চলে যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে। হঠাৎ দাঁড়াল, তার কিছু হারাবার ভয় নেই, কিন্তু পাওয়ার আশাও নেই। তা হলে রেবা আর মনুর পর এ লোকটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? বেশ কিছুদিন আগে শচীন তাকে মেরেছিল। জীবনে ওই একবারই বোধহয় পদস্খলন হয়ে থাকবে লোকটার। তা ছাড়া আর কখনও তৃণার জন্য বোধ হয় কোনও আবেগ বোধ করেনি। শচীনের ওই মারটা একটা সুখস্মৃতির মতো কেন যে।

তৃণা আচমকা বলে, আমি যাচ্ছি।

শচীন শুনতে পেল না।

তৃণা মরিয়া হয়ে বলে, শুনছ!

অন্যমনস্ক শচীন দীর্ঘ উত্তর দেয়— উঁ…উঁ!

তারপর ধীরে ফিরে তাকায়। সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে মগ্ন চোখ!

আমি একটু বেরোচ্ছি। তৃণা হাঁফধরা গলায় বলে।

শচীন বড় অবাক হয় বুঝি! বিস্ফারিত চোখে তার রাঙা পোশাকপরা চেহারাটা দেখে। অনেকক্ষণ পরে বলে, ওঃ!

শচীনের উত্তেজনা কম, রাগ কম। কিন্তু একরকমের কঠিন কর্তব্যনিষ্ঠার বর্ম পরে থাকে। স্ত্রী বিপথগামিনী বলে তার মনে নিশ্চয়ই কিছু প্রতিক্রিয়া হয় কিন্তু তা প্রকাশ করা তার রেওয়াজ নয়, এমন। কী তৃণাকে সে তাড়িয়ে দিতে পারলেও দেয়নি; চমৎকার সুখ-সুবিধের মধ্যে রেখে দিয়েছে। লোকলজ্জাকেও গায়ে মাখে না। এ কেমনতর লোক? এমন হতে পারে, সে তৃণাকে ভালবাসে না, কখনও বাসেনি। কিন্তু ভালবাসুক চাই না বাসুক, পুরুষের অধিকারবোধও কি থাকতে নেই? কিংবা আত্মসম্মানবোধ? তৃণার শরীর ভাল নয়, মাথার ভিতরটাও আজ গোলমেলে। নইলে সে এমন কাণ্ড করতে সাহসই পেত না। সে তো জানে, শচীনের তাকে নিয়ে কিছুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সে কোথায় যায় বা না যায় তার খোঁজ কখনও রাখে না।

তৃণা খুব অসম্ভব একটা চেষ্টায় শচীনের ওপর নিজের চোখ রেখে তাকিয়ে রইল। শচীন খুব গভীর। অন্যমনস্কতা কেটে গেছে। একটি চিন্তিত দেখাচ্ছে মাত্র।

শচীন মাথাটা নেড়ে বলল, যাবে যাও। বলার কী?

এই উত্তরই আশা করেছিল তৃণা। কিন্তু আজ তার একটা মরিয়া ভাব এসেছে। কেবলই মনে হয়েছে টানবাঁধা উদ্বেগ ও শঙ্কায় ভরা এইসব সম্পর্কের ভিতরের সত্যটা তার জেনে নেওয়া দরকার। যেন আর খুব বেশি সময় নেই।

তাই তৃণা বলে, এ ছাড়া তোমার আর কিছু বলার নেই?

শচীন অবাক হয়ে বলে, কী থাকবে? এখন বলাকওয়াব স্টেজ পার হয়ে গেছে।

তৃণা তার শুকনো ঠোঁট বিশুষ্ক দাঁতে চেপে ধরল। মুখে জল নেই, পাপোশের মতো খসখসে লাগছে জিভটা। কিন্তু আশ্চর্য যে বহু দিন পরে শচীনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার বুক কাঁপছে না, ভয়ও হচ্ছে না তেমন।

তৃণা বলে, আমি যদি একেবারে চলে যাই, তা হলেও কিছু বলার নেই।

বলার অনেক কিছু মনে হয়। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে না।

কেন?

বলা মানে কাউকে শোনানো, আমার তো শোনানোর কেউ নেই!

তৃণা চুপ করে থাকে। কান্না আসে, কিন্তু কাঁদে না। তার কান্নার মূল্যই বা কী?

শচীন টেবিল থেকে জলের জগটা তুলে নিয়ে আলগা করে একটু জল খেল। তারপর তৃণার দিকে তাকিয়ে তেমনি চিন্তিত গলায় বলে, তুমি কি একেবারেই যাচ্ছ?

তৃণা কিছু বলল না। দুঃসাহসভরে তাকিয়ে থাকল।

শচীন বলে সিদ্ধান্তটা আরও আগেই নিতে পারতে।

তা হলে কী হত?

তা হলে অন্তত উদ্বেগ আর মানসিক কষ্ট হত না। দেবাশিসবাবুও নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।

তৃণা অধৈর্য হয়ে বলে, আমি সে-যাওয়ার কথা বলিনি।

তবে?

আমার মনে হচ্ছে আমি আর বেশি দিন বাঁচব না।

ও। শচীন একটু চুপ করে থাকে। তারপর, যেন বুঝেছে, এমনভাবে মাথা নাড়ল। বলল, তাও মনে হওয়া সম্ভব। বহুকাল ধরেই তোমার নার্ভের ওপর চাপ যাচ্ছে। তার ওপর আছে নিজেকে ক্রমাগত অপরাধী ভেবে যাওয়ার হীনম্মন্যতা! এ অবস্থায় মরতে অনেকেই চাইবে।

তুমি কি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছ?

না। কিন্তু তোমাকে সাহসী হতে বলছি। চোরের মতো বেঁচে আছ কেন? যা করেছ তা আরও সাহস আর স্পষ্টতার সঙ্গে করা উচিত ছিল।

কী বলতে চাও তা আরও স্পষ্ট করে বলল।

শচীন তার দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল, যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না তৃণার এই ব্যবহার। তারপর বলে, এ ঘরটা কথা বলার ঠিক জায়গা নয়। এসো।

বলে শচীন হলঘরের সামনের দিকের ঘরটায় ঢোকে। এই ঘরে পাতা রয়েছে সবুজ রঙের পিংপং টেবিল, ক্যারম, দাবা, দেয়ালে সাজানো টেনিস আর ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট। কাঠের ফ্রেমে গলফ কিট। একধারে জুতোর র‍্যাক, দেয়াল আলমারিতে সাজানো কয়েকটা বন্দুক, রাইফেল, কয়েকটা ভাল সোফা দেয়ালের সঙ্গে পাতা রয়েছে।

তৃণার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, শচীন তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে একটু আগ্রহ দেখাবে। ঘটনাটা যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে। কিন্তু জানে তৃণা, এত কথা বলে এ সমস্যার কোনও সুরাহা হওয়ার নয়।

ঘরটা একটু আবছায়া। শচীন ঢুকে তৃণার ঘরে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। পিংপং খেলার জন্য এ ঘরে কয়েকটা খুব বেশি পাওয়ারের আলো লাগানো আছে। শচীন আলো জ্বালে। চোখ ধাঁধানো আলো।

তৃণার মাথার মধ্যে একটা বিকারের ভাব। বন্ধ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েই তার মনে হয়, এ ঘরে একটা মিলনান্তক নাটক করার জন্যই শচীন তাকে ডেকে এনেছে। শেষমেশ জড়িয়ে-টড়িয়ে ধরবে না তো! না না, তা হলে সহ্য করতে পারবে না তৃণা। বড় বিতৃষ্ণা হবে তা হলে।

শচীন পিংপং টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ার টেনে বসল, টেবিলের ওপরে সাবধানে নিজের হাত দু’খানার ভর রেখে তৃণার দিকে চেয়ে বলল, এবার বলো।

তৃণা ভ্রূ কুঁচকে বলে, আমি কী বলব?

বলাটা তুমিই শুরু করেছ।

তৃণা একটু থমকে থাকে।

সময় চলে যাচ্ছে। ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে দেবাশিস তার গাড়ি নিয়ে এসে বসে থাকবে। সেটা ভাবতেই তার শরীরে অসুস্থতাকে ভাসিয়ে দিয়ে একটা জোয়ার আসে তীব্র, তীক্ষ্ণ আনন্দের! শচীনের দিকে তাকিয়ে তার এ লোকটাকে সঙ্গ করতে অনিচ্ছা হতে থাকে।

তৃণা শ্বাস ফেলে বলে, আমি বোধ হয় বেশিদিন বাঁচব না।

সেটা হঠাৎ আজ বলছ কেন?

আজ বলছি, আজই মনে হচ্ছে বলে।

শচীন মাথা নেড়ে ধীর স্বরে বলে, যদি মনে হয় তা হলে তার জন্যে আমরা কী করতে পারি?

তৃণা অধৈর্যের গলায় বলে, আমি কিছু করতে বলিনি।

তবে?

তৃণা একটু ভাবে। ঠিকঠাক কথা মনে পড়ে না। হঠাৎ বলে, আমি এ বাড়িতে কী-রকমভাবে আছি তা কি তুমি জানো না?

শচীন চুপ করে চেযে রইল খানিক। তৃণার আজকের সাহসটা বোধহয় তারিফ করল মনে মনে।

তারপর বলল, বাইরে থেকে কেমন আছ তা জানি। কিন্তু মনের ভিতরে কেমন আছ তা কী করে জানব? প্রত্যেক মানুষই দুটো মানুষ।

সে কেমন?

বাইরেরটা আচার-আচরণ করে, সহবত রক্ষা করে, হাসে বা কাঁদে, ভালবাসে ঘেন্না করে। আর ভিতরের মানুষটা এক পাগল। বাইরের জনের সঙ্গে তার মিলমিশ নেই, বনিবনা নেই, একটা আপসরফা হয়তো আছে। সেই ভিতরের মানুষটাকে জেনুইন অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানতে পারে না!

আমি তত্ত্বকথা শুনতে চাই না।

শচীনকে খুব শান্ত ও নিরুদ্বেগ দেখাচ্ছে। এ মানুষটার এই শান্তভাবটা তৃণা কখনও ভাল মনে নিতে পারে না। শচীন শান্তমুখে বলে, তত্ত্বকথা মানেই তো আর পুঁথিপত্রের কথা নয়। জীবন থেকেই তত্ব কিংবা দর্শন আসে। আমি তো স্পষ্ট করেই বলছি যে, তোমার জন্য আমরা কিছু আর করতে পারি না।

তা জানি। আমি তবু একটা কথা জানতে চাই। তোমার চোখে এখন আমি কীরকম? শচীন হাসল না। তবু একটু দুর্বোধ্য কৌতুক চিকমিক করে গেল তার চোখে। বলল, অ্যাপারেন্টলি তুমি তো এখনও বেশ সুন্দরীই। ফিগার ভাল, ছেলেমেয়ের মা বলে বোঝা যায় না।

তৃণা রেগে লাল হয়ে গেল। বলল, সে কথা জিজ্ঞেস করিনি।

তবে?

আমি জানতে চাইছি, তুমি আমাকে কী চোখে দেখ!

ও। বলে শচীন তেমনই চুপ করে চেয়ে থাকে তার দিকে। চোখে কোনও ভাষা নেই, নীরব কৌতুক ছাড়া। বলে, তোমাকে আসলে আমি দেখিই না। অনেক চেষ্টা করে তবে এই না-দেখার অভ্যাস করেছি।

তৃণার এ সবই জানা। তবু বলল, এই যেমন এখন দেখছ! এখন কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না?

হচ্ছে।

সেটা কেমন?

রাস্তার ভিখিরিদের আমরা লক্ষ করি না। আবার তাদের মধ্যে কেউ যখন সাহসী হয়ে, কিংবা মরিয়া হয়ে কাছে এসে তাদের দুঃখের কথা বলে তখন তাকে দেখি, মায়া হয়, করুণা বোধ করি। এও ঠিক তেমনি, তোমার জন্য মায়া এবং করুণা হচ্ছে। আবার যখন ভিখিরিটা দঙ্গলে মিশে যাবে, তখন আবার তাকে লক্ষ করব না। আমরা কেউ কাউকে কনস্ট্যান্ট মনে রাখতে পারি না, সে যত ভালবাসার বা ঘেন্নার লোক হোক না কেন। কখনও মনে রাখি আবার ভুলে যাই, ফের মনে করি এমনিভাবেই সম্পর্ক রাখি। মানুষ দুভাবে থাকে।

সে কেমন?

এক, কেবলমাত্র শারীরিকভাবে থাকে। দুই, মানুষের মনের মধ্যে থাকে। আমার কাছে, তুমি কেবল শারীরিকভাবে আছ, আমার মনের মধ্যে নেই।

তৃণা ভ্রূ কোঁচকায়। বিরক্তিতে নয়, যখন সে খুব অসহায় হয়ে পড়ে তখন কোঁচকানো তার স্বভাব।

তৃণা শ্বাস ফেলে বলে, এটা সত্যি কথা নয়।

তা হলে কোনটা সত্যি কথা? তুমি কি আমার মনের মধ্যে আছ?

তৃণা মাথা নেড়ে বলে, আমি সে কথা বলিনি। আমি জানতে চাই আমাকে–আমার প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়া কী?

শচীন মাথাটা নামিয়ে সবুজ টেবিলের ওপর তার দুহাতের আঙুল দেখল। তারপর মুখ না তুলেই বলল, আমি খুব সিমপ্যাথেটিক। তোমার সমস্যাটা আমি বুঝি, তাই তোমাকে সাহসী হতে বলেছিলাম।

আমাকে চলে যেতে বলছ?

শচীন মাথা নেড়ে বলল, না, তুমি এ বাড়িতে থেকেও যা খুশি করতে পারো। তাতে আমাদের যে কিছু আসে যায় না, তা তো তুমি বোঝেই, কিন্তু তোমার তাতে আসে যায়। তুমি কেবলই পাপবোধে কষ্ট পাচ্ছ, আমরা তোমাকে নিয়ে নানা জল্পনা করছি বলে সন্দেহ করছ। হয়তো একথাও ভাব যে, দেবাশিসবাবুর স্ত্রী তোমার জন্য আত্মহত্যা করেন। এ সব তোমার ভিতরে ক্ষয় ধরাচ্ছে। আমি তোমাকে চলে যেতে বলছি না, কিন্তু গেলে তোমার দিক থেকেই ভাল হবে।

আমি থাকি বা যাই, তাতে কি তোমাদের কিছু যায় আসে না?

না।

আর যদি মরে যাই?

সেটা স্বতন্ত্র কথা। অন্য মানুষকে মরতে দেখলে আমাদের নিজের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে, তাই মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু, তুমি মরবে কেন?

আমি ইচ্ছে করে মরব, এমন কথা বলিনি। কিন্তু মনে হয়, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না।

তা হলে সেটা দুঃখের ব্যাপার হবে। যাতে মরতে না হয় এমন কিছু করাই ভাল। শরীর খারাপ হয়ে থাকলে ডাক্তার দেখাও।

তৃণা ঘুরে দরজার দিকে এগোয়। ছিটকিনি খুলতে হাত বাড়িয়ে বলে, দেখাব। কিন্তু দয়া করে মনে কোরো না যে, আমি তোমার বা তোমাদের করুণা পাওয়ার জন্য মরার কথা বলেছিলাম।

শচীন চেয়ার ঠেলে উঠল। কথা বলল না।

তৃণা আর একবারও ফিরে তাকাল না। দরজা খুলে সে বেরিয়ে এল হলঘরে। তারপর সিঁড়ি ভেঙে বাগানের রাস্তা ধরে চলে আসে ফুটপাথে। খুব জোরে হাঁটতে থাকে।

আপন মনেই বিড়বিড় করে কথা বলছিল তৃণা–যাব না কেন? আমি তো তোমাদের কেউ না।

কোনও লক্ষ্য স্থির ছিল না বলে তৃণা ভুল রাস্তায় এসে পড়ল। ঘড়িতে খুব বেশি সময় নেই। দেবাশিস আসবে। ফাঁড়ির কাছের বাসস্টপে তাদের দেখা হবে। দেখা হলেই পৃথিবীর মরা রঙে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠবে।

তৃণা ঠিক করে ফেলল, আজ সে দেবাশিসকে বলবে, বরাবরের মতো চলে যাবে তৃণা, ওর কাছে।

সামনেই একটা থেমে-থাকা মোটর সাইকেল স্টার্ট দিচ্ছে অল্পবয়সি একটা ছেলে। স্টার্টারে লাথি মারছে লাফিয়ে উঠে। স্টার্ট নিচ্ছে না গাড়িটা, দু-একবার গরগর করে থেমে যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাস্তায় শব্দটা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি হয়ে মস্ত বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই শব্দটায় যেন তৃণা সংবিৎ ফিরে পেল। সে। চারধারে তাকিয়ে দেখল এ তার রাস্তা নয়। ফাঁড়ি আরও উত্তরে।

সে ঘুরে হাঁটতে থাকে। পিছনে মোটরসাইকেলটা স্টার্ট নেয় এবং ভয়ঙ্কর একটা শব্দ তুলে মুখ ঘুরিয়ে তেড়ে আসে। ফুটপাথে উঠে যায় তৃণা। মোটর সাইকেলটা ঝোড়ো শব্দ তুলে তাকে পেরিয়ে চলে যায়।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়