ফিরবার সময়ে সেকেন্ড ক্লাস ট্রামের জানালার ধার ঘেঁষে বসা একটা লোক মাথা নিচু করে তাকে আদাব দিল। পরনে পায়জামা, লক্ষৌ-এর কাজ করা পাঞ্জাবি আর মাথায় মোটা সুতোয় বোনা নেট-এর একটা গোল টুপি, যা মাথার সঙ্গে চেপে বসেছে। চোখে সুর্মা। ইরফান!

ইরফান! কেমন আছ!

শ্যাম ট্রামে উঠতেই লোকটা খুব বিনয়ের সঙ্গে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা ছেড়ে দিল, বসুন চক্রবর্তীবাবু।

শ্যাম বসল না, ইরফানের কাধে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বলল, আরে তুমি বোসো।

বোসো। ইরফান মৃদু হেসে বলে, আপনি বসুন, আমি পার্ক স্ট্রিটে নেমে যাব।

শ্যাম ক্লান্তভাবে বসে হেসে বলল, কী খবর?

ইরফানের মুখে আবার সেই বিনয়ের হাসি, আজকাল আসেন না আর।

না, অনেককাল শ্যাম আর যায় না রাজাবাজারের ইরফানের কাছে। যাওয়ার দরকার হয় না। আগে প্রতি মাসে যেতে হত। আড়াইশো টাকা জমা দিলে ইরফান তার ঢাকার এক আত্মীয়কে চিঠি লিখে দিত–”আমাদের দক্ষিণের বাগানে এবার খুব আম হইয়াছে। বানিখাড়ার কমলাক্ষ চক্রবর্তীকে দুইশত আম পাঠাইয়া দিবেন।” আর বাবা ঠিকঠাক দুই শ’ টাকা পেয়ে যেত ওখানে।

কাজ-কারবার কেমন! শ্যাম জিজ্ঞেস করে।

মন্দা। হুন্ডি ধরে ফেলেছে। নিচু গলায় বলে ইরফান। হাসে, এখন কারবার সাহাবাবুদের হাতে আর ঢাকার মাড়োয়ারি।

কোনও কথাই ভাল করে শুনছিল না শ্যাম। একটা অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে ট্রাম, হু হু করে হাওয়া লাগে। শ্যাম বয়স্ক ইরফানের সুর্মা-টানা সঙের চোখের মতো চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকে। ভদ্রতার হাসি হাসে।

পার্ক স্ট্রিটে নেমে গেল ইরফান। নামার আগে হঠাৎ কানের কাছে মুখ এনে বলল, যদি পাকিস্তানে যাওয়ার দরকার পড়ে তো বলবেন। হাতে ভাল এজেন্ট আছে, বর্ডার পার করে দেবে, আবার দশদিনের মাথায় ফিরিয়ে আনবে। কোনও ভয়-ডর নেই। বলবেন।

পার্ক স্ট্রিটে নেমে গেল ইরফান। যাওয়ার সময়ে আবার আদাব দিল রাস্তা থেকে।

ইরফান নেমে গেলে হঠাৎ শ্যামের মনে পড়ল যে, লোকটা মুসলমান। মনে পড়ল যে, সে হিন্দু। আশ্চর্য! সে যে হিন্দু এ-কথাটা অনেক দিন হয় তার খেয়ালই ছিল না। মনে পড়েনি-আমি হিন্দু। মনে পড়তেই শ্যাম সামান্য হেসে ওঠে—আশ্চর্য, আমি হিন্দু! কেমন হিন্দু আমি! হিন্দু হয়ে আমি কেমন আছি।

অনেক ভেবেও শ্যাম শব্দটার কোনও অর্থ খুঁজে পেল না। অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, সে হিন্দু। সে ভারতীয়। কিংবা সে বাঙালি। অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, সে কমলাক্ষ চক্রবর্তীর ছেলে, সাকিন-বানিখাড়া, ঢাকা জেলা। অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, শ্যাম চক্রবর্তী নামে কেউ সেইন্ট মিলারের প্রাক্তন ছোটসাহেব, কিংবা…ক্লাবের এককালের লেফট আউট! অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, এইসব নাম-পরিচয়ের মধ্যে সে বাঁধা আছে। অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, এইসব নাম-পরিচয়ের বাইরে তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই!

.

কুয়াশার ভিতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ট্রাম, ময়দান পেরিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট চাঁদের আলোয়। শ্যাম জানালার কাঠে মাথা হেলিয়ে দেয়। তারপর ক্রমে লক্ষ্য ভুলে গিয়ে তার ট্রামগাড়ি অচেনা অজানায় পাড়ি দেয়। চারদিকে চাঁদ আর কুয়াশার মায়া, হু হু করে কেঁদে ওঠে প্রকাণ্ড নিষ্ফলা মাঠ, গাছের ভুতুড়ে ছায়া পাথরের মতো জমে আছে।

টিকিট!

বিরক্ত শ্যাম হাত তুলে কন্ডাক্টরকে সরে যেতে বলে। কন্ডাক্টর সরে যায়।

মায়াবী ট্রামগাড়ি চেনা পথ ছেড়ে দিয়ে বেঁকে যায়, ঘুরে যায় অচেনায়। গাছপালা ডেকে ওঠে, এসো শ্যাম! বাতাস ফিস ফিস করে বলে, এসো শ্যাম! তারপর তাকে ছুঁয়ে আনন্দে বাতাস ছুটে যায় গভীরতর রাজ্যের ভিতরে পাহাড়ে, গুহায়, নদী কিংবা সমুদ্রের ওপর দিয়ে সুগন্ধের মতো ভেসে যায় সুসংবাদ–শ্যাম, আমাদের শ্যাম। মাটিতে পা রাখতেই মায়ের মতো মাটি ডেকে ওঠে, শ্যাম! পাখির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের মতো শিশির জমে আছে ঘাসে। কালকাসুন্দির ঝোপে, কুলবড়ই গাছের তলায়, কুয়োর পাড়ে আতাবনে বাদুড়ের মতো ঝুলছে অন্ধকার, চকমক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে জোনাকি পোকা। নোনাপুকুরের আঁশটে গন্ধ পায় শ্যাম, শাপলার গায়ের গন্ধ, নিথর রাতকে চমকে দিয়ে জলে ঘাই দেয় বড় মাছ, তারপর শান্ত জলের নীচে পরিদের গভীর রাজ্যে চলে যায় তার অতিকায় নিঃশব্দ গতিময় ছায়া।

দূরে গঙ্গায় বেজে ওঠে জাহাজের ভোঁ। মাথার ওপর উড়োজাহাজের বিষণ্ণ শব্দ। শ্যাম অন্যমনে সাড়া দেয়, যাই।

ময়দানের পাশ ঘেঁষে যেতে যেতে মাত্র কয়েক পলকের জন্য স্বপ্নের সেই দেশ শ্যামের চেতনাকে ছুঁয়ে গেল।

ক্লান্ত শ্যাম ট্রাম থেকে নেমে ধীর পায়ে পেরিয়ে গেল গড়িয়াহাটার মোড়। তার গা ঘেঁষে বুড়ো গেঞ্জিওয়ালা উলটো দিকে হেঁটে যায়, ধীর গম্ভীর স্বরে হাঁকে, গেঞ্জি…!

কয়েক পা হেঁটে যায় শ্যাম, তারপর শোনে হতাশ এক গেঞ্জিওয়ালা স্বর টেনে চলেছে—গেঞ্জি…! দূরে চলে যাচ্ছে সেই ডাক। মাথার ভিতরে হঠাৎ আবার টলমল করে ওঠে ঘোলা জল, কিন্তু মনে পড়ে না, মনে পড়ে না–

আবার কয়েক পা হেঁটে যায় শ্যাম, তারপর ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ে, অস্ফুট গলায় বলে ওঠে, সোনাকাকা!

ঘুরে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলে উজিয়ে আসতে চেষ্টা করে শ্যাম। কিন্তু ততক্ষণে বহুদূরে চলে গেছে। গেঞ্জিওয়ালার ওই ডাক। শ্যাম মাথা নেড়ে আপনমনে বলে, আঃ, সোনাকাকা!

তার মনের মধ্যে বুড়ো মুখ তুলে ছানি-পড়া চোখে বে-ভুল চেয়ে থাকে সোনাকাকা, অঃ মনু! মাথা নেড়ে বলে, মনু রে!

তার কাঁধে হাত রাখে শ্যাম, সোনাকাকা, বাইচ্যা থাইকো। আরও কিছুদিন বাইচ্যা থাইকো। বিড় বিড় করে কথা বলে শ্যাম, আমি নিয়ে আসব সুদিন। অপেক্ষা করো।

হোটেলে মিত্রর সঙ্গে দেখা হলে মিত্র চোখ কপালে তুলে বলল, আজ একটা কাণ্ড হয়ে গেল মশাই, ভালবাসার ব্যাপার, খুব ইন্টারেস্টিং…

শ্যাম ভ্রূ তুলে হাসল, বটে!

মিত্র ঝুঁকে বলল, মেয়েটা কুমারী থেকে এক লাফে বিধবা হয়ে গেছে। ডবল প্রমোশন।…মাঝখানে মাসখানেক আসেনি, আজ এল, পরনে সাদা থান, হাতে চুড়ি নেই, কানে দুল, গলায় হার নেই, মুখ-চোখ থমথম করছে। আমরা তো প্রথমে কিছু জিজ্ঞেসই করতে পারি না, এ ওর মুখ চাই—এই সেদিনকার কুমারী মেয়ে, বিয়ে হয়নি, হঠাৎ এ কী? জিজ্ঞেস করতেই প্রথমে কেঁদে ভাসাল, বলল, আমি বিধবা। আমার স্বামী মারা গেছে।…কিন্তু বিয়ে হল কবে? জিজ্ঞেস করলে কেবল মাথা নেড়ে বলে, হয়েছিল।…কিন্তু কবে? অনেক কষ্টে তারপর মুখ ফুটল মেয়ের, বিয়ে হয়নি, কিন্তু হয়ে যেত। আমি মনে মনে ওকে স্বামী বলে জানতুম, আর কেউ কখনও কোনও দিন আমার স্বামী হবে না…শুনলুম ছোকরা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে মশাই…।

বলতে বলতে মিত্র গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ, বলল, অদ্ভুত ব্যাপার মশাই, এই ভালবাসা! কী বলেন?

শ্যাম হাসে। হঠাৎ তার মাথার ভিতরে আস্তে জেগে ওঠে ভ্রমরের শব্দের মতো মোটর সাইকেলের আওয়াজ। অ্যাকসিডেন্ট! কীরকম অ্যাকসিডেন্ট?

মিত্র অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, কী জানি, আজকাল লোকে বলে ভালবাসা-টাসা আর নেই, সব অ্যাডজাস্টমেন্ট! আমারও সেইরকম বিশ্বাস এসে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ আজ পুরনো ঘায়ে খোঁচা। লেগেছে মশাই! খুব মজা করলুম বটে অফিসে ব্যাপারটা নিয়ে, কিন্তু মনটা ভার হয়ে আছে। ভিতরে ভিতরে একটা হেমারেজ টের পাচ্ছি।

আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ কেটে যায়। খাওয়া হয়ে গেলে আঁচিয়ে এসে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ে দু’জনে। চলে যাওয়ার আগে মিত্র হঠাৎ বলল, দেখুন, আমাকেও কীরকম বিধবা করে রেখে গেছে একজন। পুরুষ বলে থানটা পরিনি, কিন্তু ভিতরে ভিতরে…না মশাই, হাসবেন না, কিন্তু এক-একদিন নিরালা ঘরে বসে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে।

.

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে শ্যাম টের পেল রাস্তা দিয়ে একজন হকার গেঞ্জি’ হাঁকতে হাঁকতে চলে যাচ্ছে।

এত রাতে? মনে হতেই লেপ সরিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল শ্যাম। বাঁ দিকে চেয়ে দেখল— রাস্তা শূন্য। ডান দিকে চেয়ে দেখল-রাস্তা শূন্য। তবু বহু দূর দূর থেকে দূরে রাতের গভীরে চলে যাচ্ছে ওই ডাক—গেঞ্জি…গেঞ্জি…।

সোনাকাকা! নিজের কান চেপে অভিভূত শ্যাম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর আস্তে আস্তে আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখল শ্যাম। নিথর কালপুরুষ, ছায়াপথ, নক্ষত্রমণ্ডলী। আর সেই হিম আকাশে, নক্ষত্রে, তারা থেকে তারায়, ছায়াপথ পেরিয়ে রোগা, বুড়ো, প্রায়-অন্ধ সোকাকা ফেরি করতে করতে চলে যাচ্ছে তার সওদা-গেঞ্জি…গেঞ্জি…!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়