তেইশ ডিসেম্বর মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি আজ হাসপাতালে মারা গেছেন—এ-রকম একটা খবর পর পর কিছুদিন পত্রিকায় খুঁজে দেখল শ্যাম। নেই। নেই। অথচ প্রতিদিন খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠা থেকে দুর্ঘটনার খবর থাকে। কতভাবে যে মরে যাচ্ছে মানুষ ইঁদুর আরশোলা কিংবা রোজ জল-না-পাওয়া চারাগাছের মতো তা দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। এইভাবে মরে মরে যদি পৃথিবীর ভিড় কমে যায়! যদি আস্তে আস্তে নির্জন হয়ে আসে পৃথিবী! ভাবতেই শ্যামের চোখে-মুখে আনন্দে। রক্তোচ্ছাসের ঝাপটা এসে লাগে। তখন বড় সুন্দর হবে এই শহর, আরও রহস্যময়ি হবে পৃথিবী। তখন সব মানুষই হয়ে যাবে সব মানুষের চেনা পরিচিত আত্মজন। ভালবাসায় ভরে উঠবে পৃথিবী। থাকবে না প্রতিযোগিতা, আক্রমণ লোপ পাবে, তখন মানুষের ভাষা থেকে লুপ্ত হবে গালাগাল, অশ্লীল কিংবা কঠিন শব্দ। তখন দূরের মহাদেশ নিয়ে রূপকথার গল্প জমবে খুব। তখন আরও পাখি, প্রজাপতি ও উদ্ভিদের জন্ম হবে পৃথিবীতে। পরিষ্কার সুগন্ধি বাতাস বয়ে যাবে। তখন পাওয়া যাবে দূরের শব্দ কিংবা গন্ধ, আর নিজেকে পাওয়া যাবে হাতের মুঠিতে। অল্প কিছু লোকের ভিতর থেকে সহজেই বেছে নেওয়া যাবে কয়েকটি বন্ধু, কিংবা নিজের স্ত্রীকে, আলাদা করে চেনা যাবে ভাড় কিংবা শয়তানকে, এখনকার মতো সব গোলমেলে মনে হবে না।

কিংবা যদি আরও নির্জন হয়ে যায় পৃথিবী! যদি ক্রমে ক্রমে জনশূন্য হয়ে যায় শহর, প্রান্তর, মহাদেশ! সমস্ত পৃথিবীতে আর একটিও মানুষ বেঁচে নেই একমাত্র শ্যাম ছাড়া!

ভাবতে ভাবতে শ্যাম ঘরের মেঝেয় ছড়ানো সিগারেটের টুকরোর ওপর পা ফেলে দ্রুত পায়চারি করে, লাথি মেরে সরিয়ে দেয় একটা বই, জ্বরো রুগির মতো নিজের লম্বা জট-পাকানো চুল চেপে ধরে ‘উঃ’ বলে হেসে ওঠে, আয়না তুলে ধরে নিজের খেপাটে অচেনা মুখের সামনে। তঁা, তখন? মানুষের তৈরি কলকারখানাগুলি গভীর ঘাসের সবুজে ড়ুবে যাবে, রেল-ইঞ্জিনগুলি জং ধরে আস্তে আস্তে মিশে যাবে মাটিতে, জাহাজ গলে জল হয়ে যাবে, এরোপ্লেনের গা জড়িয়ে উঠবে মাধবীলতা, উঁচু উঁচু বাড়িগুলির মাথায় জাতীয় পতাকার মতো উড়বে অশ্বথের পাত, আমাদের কাঠের আসবাবগুলি আবার উদ্ভিদ হয়ে যাবে। একটি মানুষের জন্য থাকবে একটি সূর্য, একটি চাঁদ, এক-আকাশ নক্ষত্র, একটি পৃথিবীময় জল-স্থল-শূন্যময় খোলা জায়গা।

নিজেকেই বিড় বিড় করে প্রশ্ন করে শ্যাম। নিজেই উত্তর দেয়।

তখন কি তোমার খুব একা লাগবে না শ্যাম?

না! শ্যাম মাথা নাড়ে, না।

তখন কাউকেই কি তোমার দরকার হবে না শ্যাম! মায়ের মতো কেউ, কিংবা বৃন্দা, মাধবী, ইতুর মতো কেউ? শিশু সন্তানের মতো কেউ? ভাইয়ের মতো কেউ?

না! শ্যাম মাথা নাড়ে, না।

যদি তুমি তখন কথা বলতে ভুলে যাও! যদি ভুলে যাও গান গাইতে। কিংবা ভুলে যাও ভাষার ব্যবহার! রতিক্রিয়া ভুলে যাবে? চিঠি লেখা? তোমাকে প্রশংসা করার লোক থাকবে না? এমন কেউ থাকবে না যে তোমাকে সুন্দর দেখে? তোমার কাছে থেকে দূরে যাওয়ার কেউ থাকবে না? থাকবে না কাছে আসার কেউ?

না! শ্যাম মাথা নাড়ে, না।

তারপর শ্যাম আস্তে হেসে ওঠে। আয়নায় নিজের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করে–

বলো তো এমন একা কে? জল স্থল শুন্যময় যার অখণ্ড পরিসর! যে আত্মজনহীন! যার নেই দুরে যাওয়ার বা কাছে আসার কেউ? কে এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ, শ্যাম?

শ্যাম বিড় বিড় করে বলে, আমি।

আবার খবরের কাগজ তুলে নেয় শ্যাম। হতাশভাবে মাথা নাড়ে। না, লোকটা মরেনি। হয়তো কিছু হয়নি লোকটার। সে হয়তো আড়াল থেকে শ্যামকে লক্ষ করে যাচ্ছে, অপেক্ষা করছে একটি মুহূর্তের যখন শ্যাম কোনও রাস্তার বাঁকে মোড় নেবে, তখন তার হাতের আয়নায় রোদ ঝলসে উঠে পড়বে শ্যামের মুখে।

না, লোকটা মরেনি। শ্যাম নিশ্চিত। সে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। রাস্তাটা ভাল করে দেখে নেয়। ওই তো চেনা পেট-মোটা বেঁটে লাল ডাকবাক্সটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে, ল্যাম্পপোস্টে লাগানো চৌকো বাক্সের গায়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন, চেনা লাল হলুদ সাদা কয়েকটা বাড়ি, দত্তদের বাগানে খেলছে কাক আর সিঁড়িতে শুয়ে আছে পাঁচটা বেড়াল, দুটো ট্যাক্সি গেল পর পর, পিছনে মন্থরগতি এক ঠেলাওয়ালা, একটি-দুটি মেয়ে আর কয়েকজন শান্ত নিরীহ চেহারার লোক, সকালের রোদ চারদিকে ফসলের মতো ফলে আছে। কোনওখানেই সন্দেহের কিছু নেই, তবু শ্যাম টের পায়, এই সব কিছুর আড়াল থেকে দুটি চোখ তাকে চোখে চোখে রাখছে।

কেমন সেই লোক যার মুখে শ্যাম আলো ফেলেছিল? মিনুর মতোই নিষ্ঠুর কেউ কি? তার মুখ দেখেনি শ্যাম, লক্ষ করেনি তার গায়ের রং, জানে না সে কতটা লম্বা কিংবা তার বাড়িতে কে কে আছে, কে জানে সে সুবোধ মিত্রর অফিসের সেই কুমারী বিধবা মেয়েটির প্রেমিক কি না। কিংবা কে বলতে পারে যে লোকটা মিনু নয়! বিধবা নয় তার সঙ্গীদের একজন!

শ্যাম মনে মনে বলে, তবু পৃথিবী থেকে লোকজন ঢের কমে যাওয়া ভাল। আরও শালিক আরও চড়াই আরও উদ্ভিদের, আরও ভালবাসা, রহস্য ও স্বপ্নের বড় প্রয়োজন আমাদের।

একদিন এসপ্ল্যানেডের খোলা রাস্তায় হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টি নামল। অকালে। গোপনে মেঘ জমেছিল আকাশে, শ্যাম টের পায়নি। হঠাৎ খেয়াল করল তার চার পাশে হরিণের খুরের শব্দ। চরাচর জুড়ে ছুটে আসছে অজস্র অসংখ্য হরিণ। হাওয়ার সামান্য গতিতে ছুটে যাচ্ছে তার চারপাশ দিয়ে।

শ্যাম ছুটে গিয়ে দাঁড়াল একটা গাড়ি বারান্দার তলায় এক পাল লোকের ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে। ময়লা, ভ্যাপসা গন্ধওয়ালা রুমালটা পকেট থেকে বের করে বহুদিন পর কাজে লাগাল শ্যাম, চুল আর দাড়িতে জল মুছে নিল। ঠান্ডা হাওয়ায় বড় শীত করে উঠল তার। সে ভিড়ের ভিতরে একজন মোটাসোটা লোক খুঁজে দেখল যার পিছনে দাঁড়ানো যায়। নেই। পকেটে হাত দিল সিগারেটের জন্য। নেই। আর্কেডের তলায় খুঁজল একটা সিগারেটের দোকান। পেয়ে গেল। মন্থর পায়ে ভিড় ঠেলে দোকানটার সামনে এসে দাঁড়াতেই ভয়ংকর চমকে গেল শ্যাম। প্রায় চার ফুট চওড়া একটা দোকান-জোড়া আয়না—অজস্র মাথা ও মুখের ভগ্নাংশ দেখা যাচ্ছে, সে নিজের সম্পূর্ণ অচেনা ভিখিরির মতো কাঙাল মুখ দেখতে পাচ্ছিল, আর দেখল পিছনের ভিড় থেকে একটি আবো-চেনা মুখ ঘাড় ঘুরিয়ে সামান্য কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। একটি মেয়ে। সিগারেটের জন্য খুচরো পয়সা-ধরা বাড়ানো হাত থেমে রইল, শ্যামের বুকের ভিতরটায় হঠাৎ শূন্যতার মধ্যে চমকে ওঠে তার হৃৎপিণ্ড, রেলগাড়ির আওয়াজ শুরু হয়ে যায়।

মুখ ফিরিয়ে শ্যাম মেয়েটির দিকে তাকাতেই মেয়েটি কৌশলে অন্যমনস্কতার ভান করে সরিয়ে নিল চোখ, তারপর খুব সাবধানে, যেন বিশ্রী না দেখায় এমনভাবে, ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিল।

বয়ঃসন্ধির সময়ের মতো লাজুক হয়ে গেল তার হাত-পা। সমস্ত শরীরে কাটা দিল।

চেনে শ্যাম। মেয়েটিকে সে চেনে। কিন্তু কোথায় দেখেছিল ওই অসম্ভব সুন্দর মুখ! ওই কপাল-ঢাকা চুল, গোল মুখ, মুখে নিঃশব্দ কথা জানো আমি খুব বেঁচে আছি! আমার এখনও বয়স হয়নি। আমার কাছে অদেখা পৃথিবী অনেক বড় রয়ে গেছে দেখা-পৃথিবীর চেয়ে।

ওই মুখ কোথায় দেখেছিল শ্যাম? কবে? মাথার ভিতরে ঘোলা জল টলমল করে ওঠে। কোথায়?

পিছন থেকে কেবল মেয়েটির একটু দীর্ঘ বাঁকা ঘাড় দেখা যাচ্ছিল। সে পরেছে হালকা নীল রঙের শাড়ি, মেটে সিদুরের রঙের যার পাড়, কাশ্মীরি একটা স্কার্ফ গলায় জড়ানো। হাত দুটি বুকের ওপর মুড়ে রাখা, পিছন থেকে ভাল বোঝা যায় না, হয়তো সে বুকের ওপর কিছু একটা চেপে ধরে আছে। হয়তো তার ব্যাগটা। বোঝা যায় যে সে একা।

একটু লালচে আভার চুলের বড় খোঁপা তার, যার ওপর কয়েক বিন্দু বৃষ্টির জলে বজ্রবিদ্যুৎ আর অহংকার ফুটে আছে নিঃশব্দে।

আর-একবার তার মুখখানা দেখতে ইচ্ছে করে শ্যামের। কিন্তু মেয়েটি মুখ ফেরায় না! যেন অদৃশ্য কোনও থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমনি অলস এবং অবহেলার ভঙ্গি তার।

খুচরো পয়সাগুলি আস্তে আস্তে পকেটে রেখে দেয় শ্যাম। মৃদু হেসে সে বিড় বিড় করে বলে, তোমাকে এমন কোথাও দেখেছি যেখানে তোমাকে মানায় না। তাই তোমাকে মনে করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দাঁড়াও, আগে ভাল করে তোমাকে দেখতে দাও

কিন্তু কাছে যেতে সাহস হয় না শ্যামের। সে ভিড়ের ভিতরে গা-ঢাকা দেয়, একটু কুঁজো হয়ে ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে, অর্ধ চক্রাকারে ঘুরে যেতে থাকে মেয়েটির সামনের দিকে, নিজেকে মেয়েটির কাছ থেকে যথেষ্ট দূরে রাখার চেষ্টা করে। ভিড়ের মধ্যে বিরক্ত মানুষেরা তার দিকে চেয়ে দেখে। শ্যাম গ্রাহ্য করে না।

বুড়ো এক পাঞ্জাবির পা মাড়িয়ে দেয় শ্যাম, বাচ্চা একটা ছেলের পিঠে হাত রেখে তাকে সরিয়ে দেয়, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল দুটি ছেলে, তাদের ঠেলে মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যায় সে। তার মুখ বাঁ দিকে ঘোরানো, চোখ লক্ষ্যবস্তুর ওপর স্থির। ক্রমে তার চার পাশে মানুষেরা ছায়ার মতো অলীক হয়ে আসে, যেন আর কারও কোনও অস্তিত্ব নেই। শুধু ক্রমে ক্রমে মেয়েটির ছোট কানের ইয়ারিং থেকে গালের ডৌল, একটু চাপা নাক, ঠোঁট, ক্রমে গোল সম্পূর্ণ মুখটি চলে আসে তার চোখের নাগালে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে।

ফুটপাথের ধারে চলে এসেছিল শ্যাম। তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টির জলকণা, হু-হু বাতাস তার এভির চাদর নিশানের মতো ওড়াতে থাকে। কনকন করে ওঠে কান। শ্যাম গ্রাহ্য করে না। একটা চোর-বেড়ালের মতো সে মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকে। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে দূরগামী হরিণের পায়ের শব্দের মতো বৃষ্টির শব্দ হয়ে যেতে থাকে।

মেয়েটির গা ঘেঁষে চলে যায় কয়েকটি পুরুষ। হাত-পা রি-রি করে ওঠে শ্যামের। কী সাহস। আবার অনেক দিন পর শ্যামের মনে হয় যে, বহুদিন হয়ে গেল সে আর নিজেকে সাজায় না। তার গালে রুক্ষ দাড়ি, মাথায় লম্বা জটার মতো জড়িয়ে থাকা এলোমেলো চুল, গায়ে ময়লা এভির চাদর। সে অনেক লোগা, লাবণ্যহীন আর দুর্বল হয়ে গেছে। তার আর সেই সাহস নেই সহজেই যে-কোনও মেয়ের কাছাকাছি চলে যাওয়ার। কোথায় গেল সেই ভেলার মতো ভাসমান হালকা মন! সেই খেলার ছল। এখন তার বুকের মধ্যে সেই রেলগাড়ির স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার আর পুল পেরিয়ে যাওয়ার শব্দ। সে নিজের বুকে হাত রাখে। না, এই অচেনা রহস্যময় শ্যামকে চেনে না শ্যাম। তার শরীরের ভিতরে, মনের ভিতরে ডেকে উঠছে মেঘ, চমকে উঠছে বিদ্যুৎ, আর সমস্ত চেতনা জুড়ে নেমে আসছে অদ্ভুত এক নিঃশব্দ বৃষ্টি। বুক ভরে ওঠে। ভরে ওঠে ভালবাসায়। ছোঁয়া যায় না। এখন আর শরীর ছোঁয়া যায় না। কাটা দেয়।

মেয়েটির চোখে হঠাৎ চোখ পড়ে যায় শ্যামের, ভ্রূ কুঁচকে মেয়েটি তাকে এক পলক দেখে, তারপর অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নেয়। সামান্য এক-আধ পা সরে যায়, একটু ঘুরে দাঁড়ায়। শ্যাম আবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় ফুটপাথের ধার ঘেঁষে, আবার মেয়েটির মুখোমুখি হয়। মেয়েটির চোখ আবার তার চোখের ওপর ঘুরে যায়। সামান্য নড়ে ওঠে মেয়েটি, শীতে কিংবা ভয়ে সামান্য কেঁপে ওঠে। মুখ ফিরিয়ে নেয়। অসহায়ের মতো হঠাৎ চারদিকে চেয়ে দেখে। বিরক্তিতে কামড়ে ধরে ঠোঁট, মাটিতে পা ঘষে নেয় রাগে।

হঠাৎ শ্যামের খেয়াল হয় যে, তার চারপাশে কথাবার্তার শব্দ থেমে গেছে। অনেকেই লক্ষ করছে তাকে। কথা থামিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে অনেক লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ সরিয়ে দেখে নিচ্ছে মেয়েটিকে। তাদের চোখে-মুখে কৌতুক। ভীষণ চমকে ওঠে শ্যাম, তার হাত-পা কেঁপে ওঠে। সে নিজের দিকে চেয়ে দেখে–কী করেছে সে। এতক্ষণ সে কী করেছে।

চকিতে শ্যাম মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার নাকে মুখে ছুটে আসে রক্তের গরম ঝাপটা। অপমানে কেঁপে ওঠে তার শরীর। দ্রুত সে ফুটপাথ ছেড়ে বৃষ্টির রাস্তায় নেমে পড়ে। হেঁটে যেতে থাকে।

তারপর কেবল হরিণ আর হরিণ। চারদিকে অজস্র অসংখ্য ধাবমান অদৃশ্য হরিণের পায়ের শব্দ। যতদূর চোখ যায়, বাষ্পকার জলকণায় আঘো-অন্ধকারে রাস্তাঘাট, ময়দান আদিগন্ত রহস্যময় হয়ে গেছে। নিশ্চিন্ত মনে নিরুপদ্রবে হেঁটে যায় শ্যাম। তার মাথা গাল দাড়ি বেয়ে নেমে আসে কেঁচোর মতো হিম জলের কয়েকটা রেখা। শীতে তার শরীর কাঁপে। তবু সে টের পায় তার ভিতরে উষ্ণ রক্তস্রোত, বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল, মাথার মধ্যে যন্ত্রণার মতো একটি প্রশ্ন, তুমি কে? তুমি কে?

হঠাৎ মনে পড়ে যায় শ্যামের। দুটি সাদা সুন্দর হাত টেলিফোন থেকে নোটবইয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মদরঙের কাঠের পালিশে ছায়া ফেলে। লীলা!

‘ইয়াঃ’ বলে হেসে ওঠে শ্যাম। লীলাই। হায় ঈশ্বর! তোমার জন্যই আমি বৃষ্টির মধ্যে ভোলা রাস্তায় নেমে এলুম! গায়ে তুলে নিলুম-শীত!

হঠাৎ দুটি হাত ওপরে তুলে পাগলের মতো আপনমনে আবার হাসে শ্যাম, ঠিক আছে, তোমার জিত।

অনেক দিন পর নিজেকে একটু জীবন্ত বলে মনে হয় শ্যামের। সে শুনতে পায় তার শরীরের মধ্যে কারখানা চলার মতো শব্দ করে চলেছে কলকবজা। সে বড় বেঁচে আছে।

রাতে বিছানায় শুয়ে আধো ঘুমের ভিতরে সে তার বালিশের কাছে একটা নাম বলে রাখল। বালিশে নাক ঘষল। হাসল। লীলা! আঃ–হাঃ!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়