বনানীর এক অদ্ভুত সুখকর অস্বস্তি শুরু হল।

সৌরীন্দ্রমোহন, বনলতা, সোনালি সকলেই আজকাল কেমন যেন বিস্ময়ভরে এবং বিমূঢ়ের মতো তার দিকে তাকায়। তারা এমন কিছু দেখে বনানীর মধ্যে, যা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ঠিকে ঝি একদিন বলে উঠল, ও মা, এ যে অশৈলী কাণ্ড গো! সেই পেটমরা মেয়েটা যে একেবারে ধান ফুটে খই হল গো।

গয়লা দুধ দিতে এসে হাঁ করে তাকে দেখে। দেখে সৌরীন্দ্রমোহনকে খেউড়ি করতে এসে বিশে নাপিত। দেখে পাড়াপড়শি। প্রত্যেকের চোখেই অবিশ্বাস।

বনানীর আয়না লাগে না। অন্যের চোখেই সে আজকাল নিজেকে দেখতে পায়।

বাস্তবিকই আয়নার দিকে তাকায় না বনানী। কী দেখবে তা নিয়ে তার যত ভয়। সে যে বদলে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু বদলটা কেমন হল তা সে জানতে চায় না।

সোনালি পছন্দ করে না বলে সে পারতপক্ষে বারান্দায় যায় না। নিজেকে সে প্রাণপণে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতেই চেষ্টা করে। তার জীর্ণ শরীরে প্লাবন আসার এই ঘটনা তার কাছে এখনও তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়। একা, ঘরে বসে মাঝে মাঝে নিজের স্তনভার অনুভব করতে করতে সে লজ্জায় ঘেমে ওঠে। স্নানঘরে পুরন্ত ঊরু, গভীর নাভি, মসৃণ হাতের গঠন দেখে সে তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নেয়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, ভগবান!

একদিন সোনালি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই সর্বনাশী রূপ এতকাল কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি রে হারামজাদি? তুই যে বহু সংসারে আগুন লাগাবি!

রূপ! রূপের কথা বনানী আজকাল বিশ্বাস করে।

সোনালি ফতোয়া দিল, খবরদার সাজবি না। লোকের সামনে ধিঙ্গির মা সিঙ্গি হয়ে গিয়ে দাঁড়াবি না।

বনানী ম্লান মুখে বলে, কারও সামনে যাই নাকি?

সোনালি বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে বলে, মনে কোনও পাপ নেই তো রে মুখপুড়ি? খুব সাবধান কিন্তু!

পাপ! বনানী পাপের কথা ভাবতে গিয়ে বড় অস্থির হয় মনে মনে। একা ঘরে টপ টপ করে চোখের জল পড়ে। পাপ! পাপ কি না তা তো সে জানে না। কিন্তু ওই যে একজন এসেছিল একদিন, তারপর বহুদিন আর আসেনি, ওই একজন লোক তার জীবনের সব এলোমেলো করে দিল। কেন এল ও? কিছুতেই যে বনানী ওকে মন থেকে, চোখ থেকে মুছে দিতে পারে না!

প্রায় ছ’মাস বাদে আবার বনানী পড়ল ভূমিকম্পে, ঝড়ে, বজ্রপাতে।

দুপুরবেলা। বুড়োবুড়ি ঘুমোচ্ছ। সোনালি ইস্কুলে। এমন সময় কলিং বেল-এর শব্দ।

বনানী ভাবল, পিয়োন বুঝি। নীচে নেমে দরজা খোলার আগে সে নিয়মমতো জিজ্ঞাসা করল, কে?

আমি। আমি অলক। কে, পিসি নাকি? শিগগির দরজা খোলো, ভীষণ খিদে পেয়েছে।

বনানী দরজা খুলল না। তাড়া-খাওয়া হরিণের মতো ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে পড়ে গেল ভীষণ জোরে।

মা গো!

শব্দে বনলতা নেমে এলেন, ও মা! এ কী রে? কী হল তোর?

ওদিকে কলিং বেল বেজে যাচ্ছিল, সঙ্গে অলকের গলা, কী হল? ও পিসি?

বনলতা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আয় দাদা, আয়। দেখ তো কী কাণ্ড! মেয়েটা আছাড় খেয়েছে, কী যে করি! হাত পা ভাঙল কি না।

হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, তিন জায়গাতেই প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছিল বনানী। এমন ব্যথা যে তার মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রণায়। তবু অলক ঢুকতেই সে ফের ‘মা গো’ বলে একটা আর্ত চিৎকার করে দুড়দাড় সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে এসে বুক চেপে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

সে পারবে না। সে আর বেঁচে থাকতে পারবে না। সে মরে যাবে।

বালিশে মুখ চেপে সে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। পাপ! পাপ! নিশ্চয়ই পাপ? সে যে মরে যাবে।

ঘরে কেউ এল। মাথায় হাত রাখল।

দিদিমার গলা পাওয়া গেল, খুব লেগেছে তোর? দেখি কোথায় লাগল। কাঁদছিস কেন? কাদিস। আমি ডাক্তার ডেকে পাঠাচ্ছি।

না। মাথা নাড়ল বনানী।

একটু বরফ লাগা ব্যথার জায়গায়। ফ্রিজ থেকে এনে দিচ্ছি।

লাগবে না দিদিমা। সেরে গেছে ব্যথা।

দিদিমা অর্থাৎ বনলতা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুই পালিয়ে আসছিলি কেন বল তো! ভয় পেয়েছিলি?

বনানী কী করে বলবে যে, হ্যাঁ ভয়, ভীষণ ভয়।

বনলতা একটু হেসে বললেন, মেয়েমানুষের ভয় থাকা ভাল। হড়াস করে যে দরজা খুলে দিসনি সেটা ভালই করেছিস। অলকের বদলে গুন্ডা বদমাশও হতে পারত তো।

বনলতা চলে গেলে একা ঘরে বনানী আক্রোশে পা দাপাতে দাপাতে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, গুডাই তো! গুন্ডা! ডাকাত! কেন এল ও? কেন এল? আমার যে পাপ হচ্ছে। আমার যে ভীষণ পাপ হবে। আমি এখন কী করব? ছাদে উঠে ঝাপ দেব? ফিনাইল খাব? মুখে কালি মাখব?

বনানী কিছুই করল না। শুধু কাদল। উপুড় হয়ে। অনেকক্ষণ।

 

তারপর তড়বড় করে উঠে বসল হঠাৎ। ভীষণ অবাক হয়ে ভাবল, আচ্ছা, এই যে আমি ওরকমভাবে পড়ে গেলুম, ব্যথা পেলুম, কাঁদলুম, কই ও তো একবারও এল না আমাকে দেখতে। বাড়ির ঝি বলে কি এতটাই ফেলনা! একটা মানুষ তো! সে ব্যথা পেলে একটু দেখতে আসতে নেই বুঝি?

ভাবতে ভাবতেই আবার বুক ঢিবঢিবিয়ে উঠল তার। মাথা নেড়ে আপনমনে বলল, থাক বাবা। না এসে ভালই হয়েছে। ও এসে সামনে দাঁড়ালে আমার ঠিক হার্টফেল হবে।

শরীরের ব্যথা তেমন সত্যিই টের পাচ্ছিল না বনানী। অলক ঘণ্টা দুয়েক থেকে চলে গেল। বিকেল হল। সন্ধের মুখে বনানীর কনুই নীল হয়ে ফুলে উঠল। হাঁটু আর গোড়ালিতেও তাই। অসহ্য টাটানি।

সৌরীন্দ্রমোহন এলেন, বনলতা এলেন, এল সোনালিও।

বনানী কাতর স্বরে বলল, তোমরা যাও না! আমার কিছু হয়নি।

সোনালি কঠিন গলায় বলল, সেটা আমরা বুঝব। চুপ।

ডাক্তার শুভ্র দাস এসে বনানীকে দেখল। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল, হ্যাঁ রে বনা, যে মেয়েটাকে বর্ধমানের গা থেকে তুলে এনেছিলাম তুই ঠিক সেই মেয়েটাই তো? তোকে যত দেখি তত আমার অবিশ্বাস হয়। তোর বাবা যদি দেখে তো মুছা যাবে।

সবাই আজকাল এরকম সব কথা বলে,বনানীকে। বনানীর সুখ না দুঃখ হয় তা বলতে পারবে না সে। তবে ভারী অস্থির, উত্তেজিত বোধ করে সে।

রাত্রিবেলা ব্যথায় মলম মালিশ করতে এল সোনালি। আঁতকে উঠে বসল বনানী, তুমি কেন? মালিশ আমিই করতে পারব। দাও আমাকে।

সোনালি ধমক দিয়ে বলল, খুব হয়েছে। কনুই ফুলে ঢোল, ওই হাতে উনি মালিশ করবেন!

তা বলে ঝিয়ের পায়ে হাত দেবে? পাপ হবে না আমার?

ঝি! ঝি কোন দুঃখে হতে যাবি? তোকে আমি পুষ্যি নিয়েছি মনে মনে। আজ রাতে আমার সঙ্গে শুবি।

ও মাগো! পারব না। পায়ে পড়ি।

এই কমপ্লেক্স কেন তোর? তোকে তো আমরা ছোট ভাবি না, তবে তুই কেন ভেবে মরিস? রাত্রে ব্যথা বাড়লে কে দেখবে তোকে?

লজ্জায় মরে গেল বনানী। আর মনে মনে বলল, হে ভগবান, এই বাড়ি থেকে যেন আমাকে কখনও তাড়িয়ে না। এরা বড় ভাল।

তিন-চারদিন পর দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে বনানী চুল শুকোতে গেল ছাদে। রোদুরে পিঠ আর চিলেকোঠার ছায়ায় মুখ রেখে কোলে বই নিয়ে বসে পড়া তার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে হেমন্তের খণ্ড-মেঘ ভেসে ভেসে যায়, চিল ওড়ে, চিলেকোঠার ছাদে বসে কাক ডাকাডাকি করে। ভারী শান্তি পায় সে মনে।

বনানী হঠাৎ শুনতে পেল সিঁড়ি দিয়ে একজোড়া পায়ের শব্দ উঠে আসছে।

চকিত হল সে। বাড়িতে তারা সাকুল্যে তিনটি প্রাণী এই নির্জন দুপুরে। ছাদে তবে কে আসবে?

সতর্ক হওয়ার বা নিজেকে লুকিয়ে ফেলার সময় পেল না বনানী। হঠাৎ ছাদে এসে দাঁড়াল দীর্ঘ, ছিপছিপে সেই সাঁতারু। একদম মুখোমুখি। সোজা তার চোখে চোখ। ভয়ে বনানী উঠে দাঁড়িয়ে শিউরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

বনানী নিশ্চল হয়ে গেল। কিন্তু ভিতরে সেই ঝড়, ভূমিকম্প, বজ্রপাত। চোখ আঠাকাঠিতে আটকানো পাখির মতো লেগে আছে ছেলেটার চোখে।

হঠাৎ ছেলেটা আশ্চর্য এক প্রশ্ন করল, তুমি কে বলল তো?

বনানী জবাব দেওয়ার জন্য নয়, আর্তনাদ করার জন্য হাঁ করেছিল। কিন্তু কোনও শব্দ হল না। বুকে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে পড়ে যেতে চাইছে ভয়ংকর দোলায়। মাথার মধ্যে অদ্ভুত রেলগাড়ির ঝিক ঝিক শব্দ হচ্ছে।

ছেলেটা তাকিয়ে আছে। স্থির শূন্য একরকম পাগলাটে দৃষ্টি। ফের বলল, কে তুমি? কোখেকে এলে? কেন?

বনানীর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, আমি কেউ না। আমি নেই। আমি কখনও জন্মাইনি। আমাকে ছেড়ে দিন।

পারল না। গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। ছাদের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে সে শুধু বোবা চোখে চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে।

বললে না তুমি কে? কী চাও?

বনানীর বুকে কথার বুদবুদ ভেসে ওঠে, আমি! আমি কিছুই চাই না। শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাত, মাথার ওপর একটু ঢাকনা…

ছেলেটা এগিয়ে এল কাছে। বনানী উভ্রান্ত, সন্ত্রস্ত, বোবা। তবু লক্ষ করল, ছেলেটার মাথা উস্কোখুস্কো, চোখ দুটো লাল, মুখখানায় শুকনো ভাব।

ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বলবে না?

বনানী বলল, অনেক কথা বলল সে। কিন্তু কোনও কথাই মুখে এল না। অনুচ্চারিত সেই সব কথা তার বুকে ঘুরতে লাগল অন্ধের মতো। সে বলল, বলছি তো, শুনতে পাচ্ছেন না কেন? আমার গায়ে ঘা ছিল, ন্যাড়া মাথা, লোেগাও ছিলুম বড়, বিছানায় পেচ্ছাপ করতুম। চাঁপারহাটের চাটুজ্যেদের মেয়ে আমি। বাবা খুব ভালবাসত আমায়। তার কোলে চেপে বিয়েতে যাই। তারপর কী যে সব হল! বলছি, শুনতে পাচ্ছেন? ছেড়ে দিন, মরি বাঁচি আবার সেখানেই ফিরে যাব। পাপ কি সয় গো ধর্মে? এ বাড়িতে ঝিয়ের বেশি আর কিছু হতে চাইনি তো। পাপ করলে তাড়িয়ে দেবে। তবু পাপ তো হলই। বেশি চেয়ে ফেললাম যে মনে মনে। এবার চলে যাব। চলে যাব।

সেই বিশাল পুরুষ যখন আর এক পা এগোল তখন বনানীর চোখ ভরে টস টস করে নেমে এল জল। মা গো! আর সয় না তো! আর সয় না তো!

চকিতে মনে পড়ল পিছনে রেলিং, তার ওপাশে অবাধ তিন তলার শূন্যতা। একটু দুলিয়ে দিলেই হয় নিজেকে।

আর কী করার ছিল বনানীর? অবোধ, ভাষাহীন ভয়ে আপাদমস্তক অসাড় বনানী নিচু রেলিং-এর ওপর দিয়ে নিজেকে ঠেলে দিল পিছনের দিকে। মা গো!

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়