পক প্রণালীতে একবার একজোড়া বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ তার সঙ্গে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটেছিল। অলক ভয় পায়নি। জলে তার কোনও কিছুকেই ভয় নেই। হাঙর, কুমির, কামট কাউকেই নয়। জলে যদি কোনওদিন তার মৃত্যু হয় তবে সে এক অনন্ত অবগাহনের আহ্লাদ বুকে নিয়ে যাবে।

আজ হেমন্তের এক কুয়াশামাখা সকালে একটি মৃতদেহের মতো চিত হয়ে জলে স্থির ভেসে ছিল অলক। আকাশের রং এখনও কুয়াশার সাদা আর আঁধারের কালোয় মাখা ছাইরঙা। আজ তার সেই সাপদুটোর কথা খুব মনে পড়ছিল। তার দু’পাশে চার-পাঁচ গজের মধ্যেই দুই যমজ ভাইয়ের মতো প্রকাণ্ড সেই সাপদুটো কিছুক্ষণ পাল্লা টেনেছিল। সামনে গার্ডের নৌকোয় প্রস্তুত ছিল রাইফেল, হারপুন, শার্ক রিপেলন্ট, আরও সব অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু অলক গার্ডদের ডাকেনি। সাপদুটোকে পাল্লা টানতে দিয়েছিল তার সঙ্গে। ওই সাবলীল গতি, জলের সঙ্গে ওই মিশে থাকা একাত্মতা দুটো সাপের কাছ থেকে শিখে নিচ্ছিল সে। যেমনটা সে বার বার শিখেছে মাছ ও কুমির, হাঙর বা কামটের কাছেও।

ভয় হল, যখন জল থেকে ডাঙায় উঠল, তখন। অত কাছাকাছি কিছুক্ষণ দুটো মারাত্মক বিষধর সাপ তার সঙ্গে সাঁতার দিয়েছে সে কথা ভেবে গা শিউরে উঠেছিল তার। জলে অলক অন্যরকম। জলের অলক আর ডাঙার অলক যেন দুটো মানুষ।

আজ হেমন্তের সকালে চিত হয়ে স্থির হয়ে জলে ভেসে আকাশের দিকে চেয়ে অলক দু’রকম নিজের কথা ভাবল। ভাবল দুটো সাপের কথা। তারপর ভাবনা মুছে গেল মাথা থেকে।

মাঝে মাঝে তার সব ঘুমিয়ে পড়ে। মাথা ঘুমোয়, মন ঘুমোয়, দৃষ্টিশক্তি ঘুমোয়।

মা গো!

একটা অদ্ভুত করুণ টানা বাঁশির সুরের আর্তনাদ শুনে ঘুম ভাঙল অলকের। সে সচকিত হতে গিয়েও হেসে ফেলল।

মেয়েটা কি পাগল? রেলিং-এর ওপর যেন ভেজা কাপড়ের মতো নেতিয়ে পড়ল। তারপর… মা গো-ও-ও…! সেই আর্তনাদ কখনও ভুলবে না অলক।

আলো ফুটেছে। অলক ধীরে ধীরে পাড়ে এসে উঠল।

ক্লাবের বারান্দায় আজও বসে আছে সুছন্দা। প্রায়ই থাকে।

অলক গা মুছে পোশাক পরে এসে মুখোমুখি বসল।

সুছন্দা আজও চোখের দিকে তাকাতে পারে না তার। টেবিলে আঁকিবুকি কাটে আঙুল দিয়ে।

অলক!

বলো।

কী ঠিক করলে?

কিছু না।

আমাকে আর কত নির্লজ্জ হতে বলবে তুমি? বিয়ের পর আমি তোমার সঙ্গে যে-কোনও জায়গায় চলে যেতে রাজি আছি। কথা দিচ্ছি কখনও আর সিনেমায় নামব না। সব ছাড়ব, সব ভুলে যাব।

ডাঙা। ডাঙায় উঠলেই যত জটিলতা, যত কিছু যন্ত্রণা। অলক চুপচাপ বসে রইল সুছন্দার দিকে স্থির চোখে চেয়ে।

সুছন্দার চোখ দিয়ে আজও টস টস করে জল পড়ছিল। মাথা নিচু করে সে বলল, যা হয়ে গেছে তা কি খুব সাংঘাতিক কিছু অলক? ওরকম তো কতই হয়। তোমারও কি হয়নি কোনও মেয়ের সঙ্গে? ভেবে দেখো। সে মেয়ে কি তবে নষ্ট হয়ে গেছে?

অলক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাই।

কিছু বলবে না? ভিতরে ভিতরে আমি যে শেষ হয়ে আসছি। এই টেনশন কতদিন সইতে পারব আমি?

স্কুটারে তার পিছনে বসে সুছন্দা খুব নিবিড় করে বেষ্টন করল তাকে।

অলক! প্লিজ, অলক!

বাতাসে আর স্কুটারের শব্দে কথাগুলো উড়ে গেল। অলক শুনল না। বা শুনলেও গা করল।…

সত্যকাম আজকাল সকালের দিকেই যা খানিকক্ষণ বাড়িতে থাকে। তারপর বোধহয় বেরিয়ে যায়। রাত্রে মাতাল হয়ে ফেরে, ফিরে আরও মাতাল হয়। সকালে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ মনীষার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। সে ঝগড়া এমনই বে-আব্রু, এমনই নির্লজ্জ যে মনে হয় দু’জনেই একটা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

আর এগোনোর রাস্তা নেই তাদের। একটা নিরেট দেয়ালে ঠেকে গিয়ে তারা অক্ষম মাথা কুটে মরে।

সুছন্দাকে পৌঁছে যখন বাড়ি ফিরল অলক তখন মনীষা আর সত্যকাম রোজকার মতোই ঝগড়া করছে। চেঁচিয়ে নয়, তবে বেশ উঁচু গলায়। সত্যকাম ডিমের পোচ টোস্টে বিছিয়ে নিয়ে খেতে খেতে এবং মনীষা চা করতে করতে।

সত্যকাম বলছে, কেন? তোমার ছেলে সুছন্দাকে বিয়ে করবে না কেন? শি ইজ কোয়াইট অলরাইট। বিউটিফুল, কোয়ায়েট, কোয়ালিফায়েড। এর চেয়ে বেশি কী আশা করো তুমি?

কোন মুখে বলছ ওসব কথা? তোমার লজ্জা করে না? ওই প্রসটার সঙ্গে অলকের বিয়ে দেব আমি? তুমি ভেবেছটা কী?

ওসব আনডিগনিফায়েড টার্ম ব্যবহার করছ, তোমারই লজ্জা করা উচিত। আজকাল ক’টা মেয়ে ইনোসেন্ট আছে বলতে পারো? আর ইউ ইওরসেলফ ইনোসেন্ট? তোমার দুটো মেয়ের একটাও কি বিয়ের আগে ইনোসেন্ট ছিল? আর তোমার ওই গাছের মতো আকাট ছেলে, তার খবরই বা তুমি কতটুকু রাখো? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে, বুঝলে?

ইনোসেন্ট নয় সে এক কথা, কিন্তু সুছন্দা ইজ ইনভলভড উইথ ইউ। ইভন ইউ স্লিপ উইথ হার।

ঝগড়ার সময় অশ্লীল ইঙ্গিতগুলি দু’জনেই ইংরিজি ভাষায় করে। এটা রোজই লক্ষ করছে অলক।

সত্যকাম গলা তুলে বলল, নেভার। কোন শালা ওকথা বলে? আই ট্রিট হার অ্যাজ মাই… মাই..

থাক, আর সাধু সেজো না। কিছুই আমার অজানা নেই।

সত্যকাম ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, আর চতুরলালের সঙ্গে ঝুমুরের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত চুলকুনি কেন তোমার সে কি আমি জানি না ভেবেছ? ঝুমুরের চেয়ে ও বিশ বছরের বড়। বাট ইউ জাম্পড অ্যাট দা প্রোপোজাল। চতুরের গাড়িতে করে তুমি কোথায় কোথায় যেতে তার একখানা লগবুক আমার আছে। বেশি সাধ্বী সেজো না।

মনীষার ফেঁপানির শব্দ ওঠে, প্রতিবাদের নয়।

এই সকালে দুটো বিষধর সাপ পরস্পরের ওপর তাদের সমস্ত বিষ উজাড় করে নিঃস্ব হয়। সারা দিন ধরে আবার জমিয়ে তোলে বিষ, আবার ওগড়াবে বলে। একই পদ্ধতি।

অলক টের পায়, ওদের আর এগোবার রাস্তা নেই। দেয়ালে ঠেকে গেছে।
হেঁচকি-তোলা ধরা গলায় মনীষা বলে, এত মেয়ে থাকতে সুছন্দাকেই কেন অলকের বউ করতে চাও?

আই অ্যাম গোয়িং টু মেক হার এ বিগ স্টার। কিন্তু মেয়েটা বড্ড বেশি চঞ্চল। এর-ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আজেবাজে প্রোডিউসারের পাল্লায় পড়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওর কেরিয়ার। অথচ শি ইজ ভেরি প্রমিজিং। একটা জায়গায় স্থির না হলে ওর কেরিয়ার তৈরি হবে না। তোমার ওই হাঁ-করা বোকা ছেলেটাকে বোধহয় ও ভালবাসে। বিয়ে হলে আমার দুদিকেই সুবিধে। ওকে তৈরি করতে পারব, তোমার ছেলেরও হিল্লে হবে। ইট ইজ নট এ ব্যাড প্রোপোজাল।

অবশেষে মনীষা চুপ করে। সত্যকাম চা খায় এবং হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। সে জিতে গেছে।

আজ বহুকাল বাদে পক প্রণালীর সেই দুটো প্রকাণ্ড সাপের কথা ভেবে অলক শিউরে ওঠে ভয়ে। গা ঘেঁষে দু’দিকে তার সমান্তরাল সাঁতরে চলেছে দুটো ভয়ংকর বিষধর।

তিন দিন বাদে মনীষা একদিন চড়াও হয় অলকের ওপর, তুই ভেবেছিসটা কী?

কী ভাবব?

তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তা জানিস?

না।

সুছন্দার সঙ্গে।

কথাটা বলে কিছুক্ষণ অপলক চোখে চেয়ে ছেলের মুখে একটা প্রতিক্রিয়া খুঁজল। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ, শূন্য ও অকপট চোখ, সুখ দুঃখ কিছুই খেলা করে না ওর মুখে। ওর বাবা বলে, গাছ। তাই হবে। আগের জন্মে বোধহয় গাছই ছিল।

একা একা ফিরে গিয়ে মনীষা একা একা কাঁদতে বসে। সে জানে, সত্যকাম কী চায়। বোকা নির্বোধ ছেলেটা টেরও পাবে না তার আড়ালে ওই শয়তান সত্যকাম আর শয়তানি সুছন্দা কী লীলা করে যাবে। যে-কোনও ছুতোয় ঘরে ওই অলক্ষ্মীকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সত্যকাম। মনীষা শুনেছে, সুছন্দাও অলকের পিছু পিছু ঘুরঘুর করে। মনীষা কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না ঘটনাটা। ঘটে যাবে। যদি তার নিজের নৈতিক জোর থাকত তা হলে পারত আটকাতে। চতুরলালের ঘটনাটা তো আর মিথ্যে নয়। মস্ত ইমপ্রেসারিও। মনীষাকে সে-ই ইনডোর স্টেডিয়ামের বিশাল ফাংশনে চান্স করে দিয়েছিল। লতা, আশার মতো গায়িকাদের সঙ্গে এক সারিতে তো বসতে পেরেছিল সে। তার জন্য একটু দাম দিতে হবে না? সত্যি বটে, ঝুমুরের সঙ্গে লটকে না পড়লেও পারত চতুর। কিন্তু পড়লেই বা দোষটা কী এমন হয়েছে? চতুরের কত কানেকশন, কত বড় বড় ফাংশন অর্গানাইজ করে। ঝুমুরটাকে ঠিক তুলে দেবে ওপরে।

সেই একটুকু অপরাধের এই শাস্তি। এই প্রায়শ্চিত্ত।

একা একা মনীষা অনেক কাঁদল। এই যে বহু-ব্যবহৃত শরীর, যৌবন যায়-যায়, এর কি তেমন কোনও আলাদা শুদ্ধতা আছে? ক’দিন আর? দশ-বিশ বা পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর একদিন ধুকধুকুনি থামবে। কিছু লোক কাঁধে নিয়ে গিয়ে কেওড়াতলায় জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। কী দাম এর?

 

ডাঙায় বড় ক্লান্তি বেড়ে যায় অলকের। আজকাল তার কেবলই মনে হয়, এক অনন্ত জলাশয় তার। দরকার। দরকার নিরেট নির্জনতা। ফোম রবারের চেয়েও নরম ঠান্ডা জলে অন্তহীন এক সাঁতার। একদিন ধীরে ধীরে ক্লান্ত অলককে জলই মিশিয়ে নেবে নিজের বুকে। জলে মিশে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে তার? সে নিজেই এক শান্ত জলাশয়ের মতো নিস্তরঙ্গ, শীতল। সে রাগে না, উত্তেজিত হয় না।

না, হয়েছিল। জীবনে মাত্র একবার। বোধহয় মাত্র ওই একবারই। দাদুর বাড়ির ছাদে সেদিন আচমকা উঠে গিয়ে মেয়েটাকে মুখোমুখি পেয়ে যায় সে। কেন যে সেদিন তার ওই রাক্ষুসে রাগ ঝড় তুলল বুকে!

দোষ নেই অলকের। ওকে যে বহুবার দেখেছে অলক জলে ভেসে থাকতে। ভোরের সুন্দরবনে, গোপালপুরের সমুদ্রে, শেষ রাতে লেক-এর কুয়াশামাখা নীল জলে। জলকন্যা কেন উঠে আসবে ডাঙায়? কেন সে পরের উচ্ছিষ্ট খাবে? কেন হবে পরামভোজী? কেন সে চুল শুকোবে রোদে বসে? এইসব প্রশ্নই সে করতে চেয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, তুমি কে? তুমি আসলে কে?

মেয়েটা কেন যে অমন ভয় পেয়ে গেল। বুঝতেই পারল না অলক কী বলতে চায়। এক বোবা ভয়ে রেলিং টপকে…

সেই ঘটনার বহুদিন বাদে আজ দাদুর বাড়িতে এল অলক।

প্রথমে টের পেল ঠাকুমা। ঠাকুমাই তাকে বরাবর সবচেয়ে ভাল টের পায়। বনলতা বললেন, অত রোগা হয়ে গেছিস কেন? চোখের কোল বসে গেছে! রাতে ঘুম হয়?

অলক হাসল। তারপর বলল, এবার এক লম্বা সাতারে যাচ্ছি, বুঝলে?

কত লম্বা? ক’মাইল?

ঠিক নেই।

তার মানে?

এখনও ঠিক হয়নি কিছু। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা সাঁতার।

পারবি? দরকার নেই।

দেখা যাক না। মানুষ তো সব পারে।

বেলা এগারোটার রোদে বারান্দায় বসে সৌরীন্দ্রমোহন কোলে প্যাড আর স্কেচ–পেনসিল নিয়ে বসেছিলেন। সামান্য রেখায় একটি-দুটি ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন আনমনে।

অলককে দেখে বললেন, বোস তো ওই মোড়াটায়। তার একটা স্কেচ করি।

একটু সময় নিলেন সৌরীন্দ্রমোহন। কিন্তু ফুটিয়ে তুললেন অসাধারণ। অলকের শূন্য চোখ, শীর্ণ হয়ে আসা মুখ, চোখের নীচে বসা—সব এল ছবিতে।

মাথা নেড়ে সৌরীন্দ্রমোহন বললেন, না, তোর চেহারাটা ঠিক এরকম নয়।

অলক হাত বাড়িয়ে প্যাডটা নিয়ে দেখল। বলল, এরকমই। এই তো আমার হুবহু মুখ।

একটা সিকনেস ফুটে উঠেছে না ছবিতে? তুই তো হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট।

ছবিটায় কোনও ভুল নেই, দাদু।

সৌরীন্দ্রমোহন তবু সন্দিগ্ধভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অলকের মুখটা ফের দেখলেন ভাল করে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, স্টিল সামথিং ইজ রং। ভেরি মাচ রং। একটা কিসের যেন ছায়া পড়েছে তোর মুখে। এরকম তো নয় তোর মুখ! এবম তো হওয়ার কথা নয়!

সংশয়টা বাড়তে দিল না অলক। উঠে এল বারান্দা থেকে।

সিঁড়ির দিকে মুখ করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেয়েটা দাঁড়ানো। মুখে সেই বোবা ভাব, চোখ-ভরা ভয়। আজ পালাল না। চেয়ে রইল। অলক নিজে প্রায় বোবা। এ মেয়েটা কি তার চেয়েও বোবা?

কে জানে কেন মেয়েটার সঙ্গে আজ একটু খুনসুটি করতে ইচ্ছে হল অলকের। এমন ইচ্ছে তার কোনওদিন হয়নি। ইচ্ছেটা হল বলে ভারী অবাকও হল অলক। একটু হাসল সে।

কী খুকি, আজ যে বড় পড়লে না? আমি এলেই তো তুমি হয় সিঁড়ি থেকে, না হয় ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করো। আজ কী হল?

মেয়েটা জবাব দিল না। মুখটা সামান্য ফাঁক, ঘন শ্বাস পড়ছে, চোখদুটো স্থির, অপলক।

আবার একটু হাসল অলক। বড় সুন্দর মেয়েটা। জলকন্যা বলে মনে হয়েছিল অলকের। সেই দুপুরে যখন ছাদ থেকে রেলিং টপকে পড়ে যাচ্ছিল তখনই বিভ্রম ভেঙে অলক বিদ্যুতের গতিতে গিয়ে ওকে প্রায় শূন্য থেকে চয়ন করে আনে। আর ভুল করবে না অলক।

সে স্মিত মুখে বলল, ভয় নেই। আমাকে ভয় পেয়ো না। যাচ্ছি।

মেয়েটা জবাব দিল না।

কিট ব্যাগ কাঁধে অলক ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। শেষ ধাপে পা রাখল।

হঠাৎ ওপর থেকে প্রশ্ন এল, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

অলক মুখ তুলল। মেয়েটা সিঁড়ির রেলিং-এ ঝুঁকে চেয়ে আছে তার দিকে।

যাচ্ছি কোথাও। কেন?

তুমি আর আসবে না?

অলক অবাক হল। মেয়েটা কি কিছু টের পেয়েছে? পাওয়ার কথাই তো নয়। সৌরীন্দ্রমোহন হয়তো পেয়েছিলেন। আটিস্টের চোখ তো। কিন্তু স্পষ্ট করে ধরতে পারেননি। এ মেয়েটা কি পেল?

না, সেটা সম্ভব নয়। তাই মেয়েটার দিকে চেয়ে অলকের হঠাৎ সত্যি কথাটাই বলতে ইচ্ছে হল। বললে ক্ষতি কী?

না, আর আসব না।

মেয়েটা অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠল। মুখটা সরে গেল আড়ালে।

অলক ভীষণ অবাক হল। আর্তনাদ করল কেন? অলক আসবে না, তাতে ওর ক্ষতি কী?

কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাভরে সঁড়িয়ে থেকে অলক সদরের দিকে এগোয়।

একটু দাঁড়াও।

সবিস্ময়ে ফিরে তাকায় অলক।

মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।

কৌতুকের হাসি মুখে নিয়ে অলক বলল, কী চাও?

প্রায় দৌড়ে নেমে এসেছে বলে মেয়েটা হাঁফাচ্ছে। বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছো? জলে? আমাকে সঙ্গে নেবে? নাও না!

অলক হাঁ করে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে, আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?

জলে। আমিও তো মরতেই চাই। অনেক পাপ হল যে!

মরবে! মরবে কেন?

আমার তো মরতেই জন্ম।

কে বলল ও কথা?

আমি জানি। আমার বাবাও বলত, তুই তো মরতেই জন্মেছিস।

অলক খানকক্ষণ বিস্ময়ে চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমি আর আসব না এ কথা তোমাকে কে বলল?

জানি যে। তোমার চোখ দেখে, মুখ দেখে টের পাইনি বুঝি?

তোমার পাপ হয়েছিল? কিসের পাপ?

ভীষণ পাপ। তোমার দিকে তাকাতুম যে! পিনি বারণ করেছিল।

অলক এত হেসে উঠল যেমনটি সে জীবনেও হাসেনি। তারপর সামলে গিয়ে বলল, মরার খুব জরুরি দরকার বুঝি?

মেয়েটা অলকের মুখের দিকে তেমনি ডাগর দুই চোখে নিষ্কম্প তাকিয়ে ছিল। বলল, শুধু বেঁচে থাকতেই যে কত কষ্ট। তুমি তো জানো না, দুটো ভাত, মাথার ওপর একটু চালা, এটুকুও জোটে যে কিছুতেই। এর বাড়ি থেকে তাড়ায়, ওর বাড়ি থেকে তাড়ায়। কবেই মরতুম গলায় দড়ি দিয়ে।

তা সেটা করোনি কেন?

একদিন স্টেশনে বটকেষ্টকে দেখলুম যে। চোখ নেই, নাক নেই, হাত নেই, পা নেই, শুধু মুখ আর নাকের জায়গায় দুটো ফুটো। ও কি মানুষ? একটা মাংসের ঢেলা। তবু বেঁচে আছে তো? ভয় হল, বাঁচা কত শক্ত। শুধু বেঁচে থাকাই কত শক্ত। ইচ্ছে যায় না বলো বেঁচে থাকতে? বটকেষ্টরও যদি ইচ্ছে যায় তো আমার দোষ কী?

তবে মরতে চাও কেন?

তুমি যে আর আসবে না। তুমি না এলে কী হবে জানো?

কী হবে?

আবার রোগা ল্যাকপ্যাকে হয়ে যাব আমি। শরীরে ঘা বেরোবে। কত কী হবে। তুমি এলে বলেই তো আমি সেরে গেলুম।

অলক এ যেন এক রূপকথার গল্প শুনছে। এরকম কেউ তাকে কখনও বলেনি তো! অলকের চোখ জ্বলতে লাগল। খাস গাঢ় হল।

মেয়েটার চোখে স্বপ্নাতুর এক বিভোর দৃষ্টি। সম্মোহিতের মতো। প্রগাঢ় এক স্বরে বলল, তাই ভাবলুম, ও তো চলে যাচ্ছে। এবার তো আমি মরবই। তা হলে ওর সঙ্গে যাই না কেন?

বুক মথিত করে একটা শাস বেবিয়ে এল অলকের। দীর্ঘ এক সাঁতার অপেক্ষা করছে তার জন্য। অপেক্ষা করছে নদী, মোহনা, সমুদ্র। তারপর জলই টেনে নেবে তাকে, জলে মিশে যাবে সে, যেমন চিনি মিশে যায়। তবে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে জল। সে মেয়েটার দিকে চেয়ে আরও কিছু আবিষ্কার করে নিচ্ছিল।

খুব কষ্ট পেয়েছ তুমি?

মেয়েটা একটু হাসল, কী যে কষ্ট! তবু কী জানো? শুধু বেঁচে থাকাটাও কিন্তু ভীষণ ভাল। শুধু যদি বেঁচে থাকা যায় তাহলেও কত কী হয়! মরব মরব করেও আমার যে বেঁচে থাকতে কী ভালই লেগেছে কটা দিন। উফ, কোনওরকমে বেঁচেছিলুম বলেই না একদিন হঠাৎ তোমার দেখা পেলুম। কত কী হয়ে গেল! তুমি ঠিক যেন ভগবান।

অলক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভারী অন্যমনস্ক, চিন্তিত।

যাবে না?

ভারতবিখ্যাত সাঁতারু আজ জীবনে প্রথম অনুভব করল, ডাঙায় যেন প্লাবনের মতো জলের ঢল নেমে এসেছে। ফোম রবারের চেয়েও নরম, সফেন, ঠান্ডা জল তাকে আকণ্ঠ ঘিরে ধরল আজ।

বনানী বলল, যাবে না?

সাঁতারু ডাঙার প্লাবনে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃদু হেসে বলল, যেতে দিলে কই?

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়