চাঁপারহাটের দাসশৰ্মাদের বাড়িতে বনানী নামে যে বামুনের মেয়েটা কাজ করে সে বামুন না বাগদি সে কথাটা বড় নয়। বড় প্রশ্ন হল মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে কোনওরকমে।

বনানীর শোওয়ার জায়গাটা একটু অদ্ভুত। স্বাভাবিক খাট-বিছানা তাকে দেওয়া হয় না। সে শোয় লাকড়ি-ঘরের পাটাতনে। খানিকটা শুকনো খড় পুরু করে পেতে তার ওপর দুটো চট বিছিয়ে তার শয্যা। গায়ে দেওয়ার একটা তুলোর কম্বল আছে তার। আর একটা সস্তা নেটের ছেঁড়া মশারি। ফুটো আটকানোর জন্য নানা জায়গায় সুতো বাঁধা। গেরস্তর দোষ নেই। বনানী তেরো বছর বয়সেও বিছানায় মাঝে মাঝে পেচ্ছাপ করে ফেলে। নিজেই চট কাচে, খড় পালটায়। বড়ই রোগাভোগা সে। তেরো বছরের শরীর বলে মনেই হয় না। হাড় জিরজির করছে শরীরে। হাঁটুতে কনুইয়ে গোড়ালিতে কণ্ঠায় হনুতে হাড়গুলো চামড়া যেন ঠেলে বেরিয়ে আছে। মাথাটা তার প্রায় সর্বদাই ন্যাড়া। কানে দীর্ঘস্থায়ী ঘা। ঘা কনুইয়ে, মাথায়, হাঁটুতেও। বনানী ফরসা না শ্যামলা তা তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। রোগা শরীরটায় একটা পাকাপাকি ধূসর বর্ণ বসে গেছে। তার মুখখানা কেমন তাও বলার উপায় নেই। হাড়ের ওপর চামড়ার একটা ঢাকনা, তাতে মনুষ্য অবয়ব আছে মাত্র।

দাসশৰ্মাদের প্রকাণ্ড সংসার। একশো বিঘের ওপর জমি। দুটো লাঙ্গল, একটা ট্রাক্টর। সারাদিন মুনিশ খাটছে, জন খাটছে, দাসদাসী খাটছে। বেহানবেলা কাক না ডাকতেই দাসশৰ্মাদের বাড়িতে শশারগোল পড়ে যায়। নিজের পাটাতনের বিছানায় শুয়েই বনানী শুনতে পায় উঠোনে গোরুর দুধ দোয়ানোর চ্যাং-ছ্যাং মিষ্টি শব্দ। সন্ধি ঝি উঠোন ঝাঁটাতে থাকে, পৈলেন বালতি বালতি জল ঢেলে গোহাল পরিষ্কার করে, ডিজেল পাম্প চালিয়ে গুরুপদ জল দেয় বাগানে। বশিষ্ঠ দাসশর্মা তারস্বরে তাণ্ডব স্তোত্র পাঠ করতে থাকে। ভোরবেলায় চারদিককার গাছগাছালিতে পাখিও ডাকে মেলা। উদুখলের শব্দ ওঠে। পৃথিবীর হৃৎপিন্ডের মতো চলতে থাকে টেকি। এ বাড়িতে কত কী হয়!

বনানীর বড় ভাল লাগে এই সংসারটা। কারণ এখানে বেশ পালিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়। এত লোকজন চারদিকে যে, তার বড় একটা খোঁজখবর হয় না। প্রথম প্রথম সে রান্নাঘরে কাজ পেয়েছিল। কিন্তু গায়ে ঘা বলে সেখান থেকে তাকে সরানো হয়। এরপর বামুনের মেয়ে বলে তাকে দেওয়া হয় পুজোর ঘরে। কিন্তু বনমালী পুরুত ক্ষতযুক্ত মেয়ের হাতের জল বিগ্রহকে দিতে নারাজ। বনানীকে তাই সেখান থেকেও সরানো হল। এখন বলতে গেলে তার কোনও বাধা কাজ নেই। শুধু এর ওর তার ফাইফরমাশ খাটতে হয়। এই ফাইফরমাশের মধ্যে বেশিরভাগই মুদির দোকানে। যাওয়া।

বনানীর বাড়ি এই চাঁপারহাটেই। দাসশৰ্মাদের বাড়ি থেকে বেশিদুরও নয়। সেখানে তার বাবা আছে, মাসি আছে, মাসির দুটো মেয়ে আছে। মাসিকে মাসিও বলা যায়, মাও বলা যায়। তবে মা বলতে কখনও ইচ্ছে করে না বনানীর। তার নিজের মা মরার পর যখন বাবা মাসিকে বিয়ে করতে গিয়েছিল তখন বাবার কোলে চেপে সেও যায়। বাবার বিয়ে সে খুব অবাক হয়ে দেখেছিল। এমনকী সাত পাকের সময়েও সে বাবাকে ছাড়েনি, কোলে চেপে কাঁধে মাথা রেখে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে বাবার সঙ্গে মাসির শুভদৃষ্টি দেখেছিল। এখনও সব মনে আছে তার। দু’রকম মাছ, আমড়ার চাটনি আর দই খেয়েছিল খুব বাবার কোলে বসে। প্রথম প্রথম মাসি কি কম আদর করেছে তাকে? চান করাত, খাওয়াত, সাজাত। তারপর একদিন মাসির একটা মেয়ে হল। তারপর আর-একটা। তারপর কী যে হল তা বনানী ভাল বুঝতে পারে না। উঠতে বসতে বনানীর নামে বাবার কাছে নালিশ। তারপর মার শুরু হল। সঙ্গে গালিগালাজ। চান হয় না, খাওয়া হয় না, সাজগোজ চুলোয় গেল। বনানী কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে লাগল দিন দিন। মাসি তাকে দেখলেই রেগে যায়। প্রথম-প্রথম তবু বাবা একটু আড়াল করত তাকে। পরে বাবাও গেল বিগড়ে। অত নালিশ শুনলে কার না মন বিষিয়ে যায়? বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হল যখন তার বাবার সঙ্গে মাসির ঘন ঘন ঝগড়া লাগতে লাগল। সে এমন ঝগড়া যে পারলে এ ওকে খুন করে। সেই সময় তার বাবা হাটে গিয়ে নেশা করে আসা শুরু করল। বাড়িটা হয়ে গেল কুরুক্ষেত্র। কত সময় সাঝঘুমোনি বনানী মারদাঙ্গার শব্দে সভয়ে উঠে বসে বোবা চোখে বাবা আর মাসির তুলকালাম কাণ্ড দেখেছে। মাসি। কতবার গেছে গলায় দড়ি দিতে, তার বাবা কতবার গেছে রেললাইনে মাথা দিতে। শেষ অবধি কেউ মরেনি। এসব যত বাড়ছিল মাসির রাগও তার ওপর তত চড়ে বসেছিল। প্রায় সময়েই বাবা বেরোনোর পর মাসি তাকে তুচ্ছ কারণে মারতে মারতে, লাথি দিতে দিতে ঘর থেকে বের করে দিত। সারাদিন বনানী বসে থাকত বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে। অভুক্ত, কখন বাবা আসবে সেই আশায় পথ চেয়ে থাকা। বাবা আসত ঠিকই, কিন্তু সেই বাবা যে আর নেই তা খুব টের পেত বনানী।

চুরি করে খাওয়া তার স্বভাবে ছিল না কখনও। কিন্তু খিদের কষ্টটা এমন অসহ্য লাগত যে বনানী সামলাতে পারত না। একদিন ছোট বোনের হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে খেয়েছিল বলে মাসি তাকে হেঁটমুড় করে বেঁধে রাখে। আর তাই নিয়ে বাবা খেপে গিয়ে মাসিকে দা দিয়ে কাটতে যায়। আর তারই শোধ নিতে মাসি বনানীকে ভাতের সঙ্গে ইঁদুর-মারা বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। বনানী মরেই যেত, হেলথ সেন্টারের ডাক্তারবাবুটি ভাল লোক বলে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। এরপরই বাবা ঠিক করে ও বাড়িতে বনানীকে আর রাখা ঠিক হবে না। তবে তার বাবা গগন চাটুজ্যে গরিব মানুষ, বিষয়-আশয় নেই। মেয়ের জন্য তেমন কিছু ব্যবস্থা করার সাধ্য ছিল না তার। তবে বশিষ্ঠ দাসশর্মার সঙ্গে তার খুব ভাব-ভালবাসা। সব শুনেটুনে দাসশর্মা বলেছিলেন, আমার বাড়িতেই দিয়ে দাও। কত লোক থাকে খায়, ওই রোগা মেয়েটা থাকলে কেউ টেরও পাবে না। বামুনের একটা মেয়ে থাকলে ভালই হবে। গুরুদেব আসেন, বামুন অতিথ-বিতিথ আসেন, বামুনের মেয়ে থাকলে সুবিধেও হবে।

বছর দুই আগে একটা পুঁটলি বগলে করে বাপের পিছু পিছু এসে সে এ বাড়িতে ঢোকে। ভারী মজার বাড়ি। চারদিকে কত লোক, কত মেয়েমানুষ, কত ছানাপোনা, কাচ্চাবাচ্চা। বনানী এ বাড়িতে আগেও এসেছে। তখন অন্যরকম ভাব ছিল। এবার এল কাজের মেয়ে হিসেবে। মাথা তাই নোয়ানো, লজ্জা-লজ্জা ভাব। তবে কিনা তার মতো অবস্থার মেয়ের বেশি লজ্জা থাকলে চলে না।

রোগাভোগা সে ছিলই। এখানে এসেও শরীরটা আর সারল না। তবে তার শরীর নিয়ে কারই বা মাথাব্যথা? বনানী ছুটতে পারে না, ভারী কাজ করতে পারে না, হাঁফিয়ে পড়ে। এ বাড়িতে তার যত্ন নেই, অযত্নও নেই। ঝি-চাকরদের সঙ্গেই তার খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সে খাওয়া খারাপ নয়। ডাল, ভাত, তরকারি, কখনও-সখনও মাছ, কালেভদ্রে দুধ এবং পাশাপার্বণে পিঠে-পায়েস বা পোলাও। বেশ আছে বনানী।

সকালে ঘুম ভেঙে উঠতে বড় কষ্ট হয় বনানীর। শরীরটা যেন বিছানার সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়। মাথা তুললেই টলমল করে। অথচ এই ভোরবেলাটায় বাইরে ফিকে আলোয় পৃথিবীটা দেখলে তার বুক জুড়িয়ে যায়। এ সময়টা তার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।

উঠে প্রথমেই সে বিছানাটা দেখে, পেচ্ছাপ করে ফেলেছে কি না। যদি করে ফেলে থাকে তবে তার মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। আর যেদিন না করে সেদিন তার মনটা বড় ভাল থাকে।

পুকুরধারে পৈঠায় বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে যখন সে কালো জলে ভোর আকাশের ছায়া দেখে তখন তার মনটা কেমন শান্তিতে ভরে ওঠে। তার রোজ এ সময়ে মনে হয়, জলে আকাশে বাতাসে মউ মউ করছে ভগবানের গায়ের গন্ধ! তার মনে হয়, আমি কোনওদিন মরব না।

বশিষ্ঠ দাসশর্মার এক বিধবা দিদি আছে। এ বাড়িতে যেমন কিছু বাড়তি লোক থাকে, ঠিক তেমনই। এইসব বাড়তি লোকের কোনও আদরও নেই, আবার অনাদরও নেই। আছে, থাকে, এইমাত্র। এই বিধবা দিদিটি থাকে একখানা মাটির ঘরে। নিঃসন্তান, একা। সকালের দিকে বনানী তার ঘরে হানা দেয়।

ও লক্ষ্মীপিসি, কী করছ গো?

লক্ষ্মীপিসি এ সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসন পেতে বসে মালা জপেন। সাড়া দেন না। বনানী বালতিতে গোবর গুলে দাওয়াটা নিকিয়ে দেয়। উঠোন ঝেটিয়ে দেয়। দাওয়ার কোলে লক্ষ্মীপিসির বেড়াঘেরা রান্নাঘরে গিয়ে কাঠের উনুনে জ্বাল তুলে সসপ্যানে চায়ের জল বসায়।

চা যেই হয়ে যায় লক্ষ্মীপিসির মালার জপও সেই শেষ হয়।

তারপর দুজনে দুটো কাসার গেলাসে চা নিয়ে বসে দাওয়ায়। বেশ গল্পটল্প হয় তাদের। তবে মেয়েমানুষের কথাই বা কী, কূটকচালি ছাড়া! লক্ষ্মীপিসি বসে বসে সংসারের নানাজনের নানা কথা খানিক বাড়িয়ে, খানিক রাঙিয়ে, কখনও-বা বানিয়ে বলতে থাকে। আর বনানী হু হুঁ করে যায়। কোটনামি করলেও লক্ষ্মীপিসি লোকটা তেমন খারাপ নয়। তার একখানা গুণ হচ্ছে, অসাধারণ সেলাইয়ের হাত। সেলাই আর বোনা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সেলাই করে আর সোয়েটার বা লেস বুনে তার কিছু আয় হয়। সুতরাং লক্ষ্মীপিসি একেবারে ফ্যালনাও নয়, গলগ্রহও নয়। মাঝে মাঝে পিসি বলেন, আমার যা আছে সব তোকে দিয়ে যাব।

বনানী এ কথাটা ভাল বোঝে না। লক্ষ্মীপিসিরটা সে পাবে কেন? পিসির তো অনেক আপনজন আছে। সে অবাক হয়ে বলে, আমাকে দেবে কেন পিসি? তোমার তো মদন আছে, ফুলু আছে, মণিপান্তি আছে।

আছে! সারাদিনে একবার খোঁজ নিতে দেখিস? এই যা সকালে এসে তুই-ই একটু খোঁজখবর করিস। তোকেই সব দেব আমি। তুই ভাল করে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবি।

এ কথাটায় একটু শিহরিত হয় বনানী। ডাক্তাররা তার কাছে জাদুকর, ভগবান। ওষুধ হল অমৃতস্বরূপ। সে জানে একজন ভাল ডাক্তার যদি তাকে দেখে ওষুধ দেয় তবে তার এই রোগাভোগা শরীরে রক্তের বান ডাকবে। মণিপান্তিরা যেমন বুক ফুলিয়ে ডগমগ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেরকম ঘুরে বেড়াতে পারবে সেও। একবার এক ডাক্তারই না তাকে ফিরিয়ে এনেছিল মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে! কিন্তু এই জীবনে ডাক্তার দেখানোর কথা বনানী ভাবতেই পারে না। কত টাকা খরচ হয় ডাক্তার দেখাতে!

চুরি করে একবার হেলথ সেন্টারে গিয়েছিল সে। আগের ডাক্তারটি আর নেই। নতুন একজন গোমড়ামুখো ডাক্তার তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না। ঘায়ের জন্য একটু মলম দিল, ব্যস। আর একটা কাগজে কী একটু লিখে দিয়ে বলেছিল, এটা জোগাড় করতে পারলে খাস।

কাগজটা এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছে বনানী। একবার বাবাকে দেখিয়েছিল। বাবা উদাস হয়ে বলল, তোকে বাঁচাবে কে বল? মবতেই জন্মেছিস।

মরতেই যে তার জন্ম এটা বনানী খুব ভাল করে জানে। বেঁচে থাকতে পারে তারাই যাদের বেঁচে থাকাটা অন্য কেউ চায়। যাদের ভালবাসার লোক আছে। বনানীর তো সেরকম কেউ নেই। কে চাইলে যে সে বেঁচে থাকুক?

আর এই রোগা ঝলঝলে শরীর, এটা নিয়েই বা কী করে সে বেঁচে থাকবে তা বোঝে না বনানী। বড্ড অসাড, বড্ড ঠান্ডা তার শরীর। বর্ষায়, শীতে গাঁটে গাঁটে একরকম ব্যথা শেয়ালের কামড়ের মতো তার হাড়গোড় চিবোয়। এক-এক সময়ে শোয়া থেকে উঠতে পারে না কিছুতেই শত চেষ্টাতেও। জেগে থেকেও এক-এক সময়ে তার মনে হয়, মরে গেছে বুঝি!

বনানী অ আ ক খ শিখেছিল সেই কবে। বাবা তখন মা-মরা মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে মাথা চেপে ধরে কত আদর করে শেখাত। পাঠশালাতেও ভরতি হয়েছিল সে। তারপর মাসি এল। একটা ঝড় যেন সব উলটে-পালটে দিয়ে গেল।

দাসশৰ্মাদের বাড়িতে বনানী কেমন আছে? বেশ আছে, যতদিন থাকা যায়। কিন্তু সে খুব বোকা-বোকা দেখতে হলেও ততটা বোকা নয়। সে টের পায় বশিষ্ট দাসশর্মার এই সুখের সংসার খুব বেশিদিন নয়। তারা চার ভাই। অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে বশিষ্ঠর তেমন বনিবনা হচ্ছে না। চারদিকে একটা গুজগুজ ফুসফুস উঠেছে, বাড়ি ভাগ হবে, হাঁড়ি আলাদা হবে, বিষয়-সম্পত্তির বাঁটোয়ারাও হবে সেই সঙ্গে। কদিন হল শহর থেকে উকিল আসছে, কানুনগো আসছে।

লক্ষ্মীপিসি মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার ঘরখানা যে কার ভাগে পড়বে! বশিষ্ঠর ভাগে পড়লে রক্ষে। অন্য তিনজনের কেউ হলে ঝটা মেরে তাড়াবে।

এ ভয়টা একটু একটু বনানীও পায়। বাড়ি যখন ভাগ হয় তখন লোকজনও ভাগ হয়। চাকর ঝি মুনিশ জন সব ভাগ হয়। বনানীকে নেবে কে? কেউ কি নেবে? যদি বশিষ্ঠ দাসশর্মা নেয়ও তখন আর এমন বসে কাজে ফাকি দিয়ে দিন কাটাতে পারবে কি সে? তখন তো ভাগের সংসারে এত লোক থাকবে না, গা ঢাকা দেওয়াও চলবে না। তখন তাকেও তাড়াবে।

সংসারে কাজেরই আদর, বনানী জানে। তার ইচ্ছেও যায়। কিন্তু পারলে তো! শরীরে যে দেয় না।

মাসি বিষ দিয়েছিল বেশ করেছিল। পুরোটা যদি মুখ চেপে ধরে খাইয়ে দিত, আর হেলথ সেন্টারের সেই ডাক্তারবাবুটি যদি ভাল মানুষ না হত তা হলে একরকম বেঁচে যেত বনানী। বিষটা অল্প ছিল বলে আর বাবা বানিয়ে একটা গল্প বলেছিল বলে থানা-পুলিশ হয়নি। সে মরলে কিন্তু হত। মাসির ফাঁসিই হত হয়তো-বা। তাতে বাবাটা বেঁচে যেত।

এ বাড়ির সামনে দিয়েই বাবা সকাল-বিকেল যায় আসে। আগে আগে ওই সময়টায় রাস্তার ধারে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকত বনানী। বাবাকে দেখলেই আহ্লাদে চিৎকার দিত, বাবা গো!

বাবা খুশি হত কি না বলা যায় না। তবে মরা চোখে তাকাত। একটু দাঁড়াত সামনে। মাথায় একটু হাত দিত। সে সময়ে বাবার কাঁচাপাকা চুল, অল্প সাদাটে দাড়ি, শুকনো মুখ আর জলে-ডোবা চোখ

দেখে বড় মায়া হত বনানীর। এই একটা লোক হয়তো চাইত, বনানী বেঁচে থাক।

বাবা এখনও যায় আসে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে গেলে বনানী গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ায়। দুটো কথা বলে। দেখা হয় মুদির দোকানে বা কয়লার ডিপোয়। একটা-দুটোর বেশি কথা বলে না বাবা। কীই বা বলার আছে! এক-এক সময়ে কি মানুষের কথা একেবারে ফুরিয়ে যায়? নিজের বাবাকে দেখে সেরকমই মনে হয় বনানীর। তার মা যখন মরে যায় তখন সে ছোট্টটি। চঞ্চল দুরন্ত মেয়ে বলে বাবা পায়খানায় যাওয়ার সময়ও তাকে কোলে করে নিয়ে যেত। পাছে ঘরে রেখে গেলে কোনও বিপদ ঘটায়। সেইসব কথা মনে আছে বনানীর। সেই বাবাই তো তাকে বেড়াল-পার করে দিয়েছে এ বাড়িতে।

মরবে বনানী। মরতেই তার জন্ম।

উঠোনে লক্ষ্মীর পায়ের মতো জলছাপ ফেলে পুকুরঘাট থেকে কে যেন ঘরে গেছে।

কী ছোট্ট আর কী সুন্দর নিখুঁত সে পায়ের পাতার গড়ন! বনানী চিহ্ন ধরে ধরে এগোয়। জানে এ পা হল বশিষ্টর বড় ছেলে শুভবিকাশের নতুন বউ চিনির।

নতুন বউ মাত্রই ভাল। কী যে অদ্ভুত নতুন বউয়ের গায়ের গন্ধ, মুখের লজ্জা-রাঙা ভাব, রসের হাসি। চিনি তাদের মধ্যেও যেন আরও ভাল। দূর ছাই করে না, হাসিমুখে কথা কয়। তার ঘরের কাছে আজকাল একটু বেশিই ঘুর ঘুর করে বনানী। হুট করে ঘরে ঢোকে না, অত সাহস তার নেই।

আজও দাওয়ায় উঠে কপাটের আড়াল থেকে দেখছিল বনানী। চিনি জানালার ধারে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কষে সিঁদুর দিচ্ছে সিথিতে। নতুন বউরা খুব সিদুর দিতে ভালবাসে।

চোখে চোখ পড়তেই চিনি হাসল। ডাকল, আয়। ভিতরে আয়।

বনানী ঘরে ঢোকে। দরজার গায়েই দাঁড়িয়ে থাকে।

চিনি ফিরে তাকাল, তোর ঘা-গুলো সারে না, না রে?

না।

চুলকোয়?

মাঝে মাঝে চুলকোয়।

ওষুধ দিস না?

না। মাছি বসে বলে শুকোয় না। নইলে—

তোর মাথা। আমার কাছে একটা পেনিসিলিন অয়েন্টমেন্ট আছে, নিবি? লাগিয়ে দেখ তো কয়েকদিন। না শুকোলে বলিস। আমার দাদাকে লিখে দেব, ওষুধ পাঠিয়ে দেবে। আমার দাদা কলকাতার ডাক্তার।

ডাক্তারদের প্রতি একটা খুব শ্রদ্ধাবোধ আছে বনানীর। চিনি ডাক্তারের বোন জেনে সে খুব ভক্তিভরে চেয়ে রইল।

চিনি উঠে একটা ছোট বাক্স খুলে নতুন একটা টিউব তার হাতে দিয়ে বলল, ঘা ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকনো করে মুছে লাগাবি।

ঘাড় নেড়ে বনানী বলে, আচ্ছা।

তুই নাকি বামুনের মেয়ে?

হ্যাঁ। চাটুজ্জে।

লেখাপড়া শিখেছিস?

না গো, পাঠশালায় পড়তাম। তারপর আর হয়নি।

একটু-আধটু পড়তে পারিস তো?

যুক্তাক্ষর তেমন পারি না।

বিয়েতে আমি কয়েকটা বই পেয়েছি। সবই বাজে বই। ভাবছিলাম কাকে দিয়ে জঞ্জাল সরাব। তা তুই দুটো নিয়ে যা। বুঝিস, না বুঝিস, পড়ার চেষ্টা কর। না পারলে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিস।

নতুন বউ যা বলে সবই তার শিরোধার্য মনে হয়। বনানী বই আর ওষুধ এনে তার পাটাতনের আস্তানায় সযত্নে লুকিয়ে রাখল।

এই মরা-মরা জীবনেও মাঝে মাঝে এরকম ঘটলে একটু কেমন বাঁচার ইচ্ছে জাগে। বই বা ওষুধ, ওগুলো কিছু নয়। আসল হল ওই আদরকাড়া কথা। প্রাণটা নিংড়ে যেন জল বের করে আনে চোখ দিয়ে। এটুকু, খুব এইটুকু আদর পেলেও বনানীর মনে হয় অনেকখানি পেয়ে গেল সে। আর বুঝি কিছু চাওয়ার নেই।

চিনি আর-একদিন বলল, মাথা সব সময় ন্যাড়া করিস কেন?

ঘা যে!

ঘা সারিয়ে ফেল তাড়াতাড়ি। তোর খুব ঘেঁষ চুল। অত চুল আমার মাথায় নেই। চুল হলে তোকে বেশ দেখাবে।

ওম্মা গো। বনানী লজ্জায় মুখ ঢাকে। সে বলে আধমরা, তাকে চুল দেখাচ্ছে চিনিবউ! লজ্জাতেই মরে যাবে সে।

আশ্চর্য! অয়েন্টমেন্টে বেশ কাজ দিতে লাগল। কয়েকদিন খুব যত্ন করে লাগিয়েছিল বনানী। ঘায়ে টান ধরল। মামড়ি খসতে লাগল। কালো হয়ে এল দগদগে ঘায়ের মুখ।

যুক্তাক্ষর বিশেষ ছিল না বলে একটা বই টানা পড়ে শেষ করে ফেলল বনানী। ছোটদের জন্য সহজ করে লেখা বঙ্কিমের রাজসিংহ। কী সুন্দর যে গল্পটা! বনানী আবার পড়ল।

পড়ে খুবই অবাক হয়ে গেল বনানী। একটা বাঁধানো বই যে সে আগাগোড়া পড়ে উঠতে পারবে এ তার ধারণার বাইরে ছিল।

শুধু বেঁচে থাকতে পারলে, কোনওরকমে কেবলমাত্র বেঁচে থাকতে পারলেও জীবনে কত কী যে হয়।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়