হেদুয়ায় এলে অলক একবার দাদুর বাড়ি হানা না দিয়ে যায় না।

বাপ আর ছেলের মধ্যে যেমন জেনারেশন গ্যাপ থাকে, দাদু আর নাতির মধ্যে তেমনটা না থাকতেও পারে। বাপ আর ছেলে সব সময়েই সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনার মধ্যে থাকে। দাদু আর নাতির সেই ভয় নেই। প্রজন্মগত পার্থক্যটা বেশি হওয়ার দরুনই বোধহয় তাদের মধ্যে এক সমঝোতা গড়ে ওঠে।

অলকের দাদু সৌরীন্দ্রমোহন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন। সে আমলে তার পেশায় তেমন পয়সা ছিল না। তবু সৌরীন্দ্রমোহন কিছু টাকা করতে পেরেছিলেন সিনেমা থিয়েটারে কাজ করে এবং একটা ফোটোগ্রাফির স্টুডিয়ো চালিয়ে। স্টুডিয়ো বেচে দিয়েছেন, এখন আর আঁকেন না। বয়স পঁচাত্তর। তিন ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা। সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিটের বাড়িটা কিনেছিলেন। পঁয়তাল্লিশ সালে। সেই বাড়ি নিয়েই ছেলেদের সঙ্গে বখেরা।

সৌরীন্দ্রমোহনের মেয়ে সোনালির বিয়ে হয়নি। সোনালি দেখতে ভাল নয়, উপরন্তু তার পিঠে একটা কুঁজ থাকায় বিয়ে বা সংসারের স্বপ্ন সে ছেলেবেলা থেকেই দেখে না। সৌরীন্দ্রমোহন মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে বাড়িটা তার নামে লিখে দেন এবং নিজের টাকাপয়সার সিংহভাগটাই তার নামে ব্যাংকে জমা করেন। ছেলেরা গর্জে উঠল, আপনি কি ভাবেন সোনালিকে আমরা দেখব না?

এই ঝগড়া দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ছেলেরা লায়েক হয়ে যে যার আলাদা এস্টাবলিশমেন্ট করে চলে গেছে। এমনিতেও আজকাল পৈতৃক বাড়িতে ছেলেরা থাকতে চায় না। সৌরীন্দ্রমোহন জানেন, তার ছেলেরাও আলাদা হতই, সোনালি উপলক্ষ মাত্র।

সুতরাং উত্তর কলকাতার এই বাড়িতে সৌরীন্দ্রমোহন, তার স্ত্রী ও মেয়ে মোট এই তিনটি প্রাণী। ছেলে বা নাতি-নাতনিরা কেউই আসে না। সম্পর্ক একরকম চুকেবুকে গেছে।

এই পুরনো নোনাধরা প্রকৃতিহীন বাড়ি এবং তার অভ্যন্তরের তিনটি প্রাণীর প্রতি অলকের এক ধরনের টান আছে। হেদুয়ায় যখনই তার সাঁতার থাকে তখনই সে একবার দাদু আর ঠানুর কাছে হানা দেয়।

সৌরীন্দ্রমোহন তাঁর এই গম্ভীর ও ঠান্ডা প্রকৃতির নাতিটার ওপর এক প্রগাঢ় মায়া অনুভব করেন। ছেলেদের ওপর থেকে যে স্নেহ প্রত্যাহার করার নিষ্ফল চেষ্টায় ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন তা এই একটি অবলম্বন পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তবে তার প্রকৃতি গম্ভীর বলে বাইরে তেমন প্রকাশ নেই।

সৌরীন্দ্রমোহনের স্ত্রী বনলতা একটু সেকেলে। নাতির তিনি আর কিছু বুঝুন না বুঝুন, শুধু এটুকু বোঝেন যে, ছেলেটা নিজেদের বাড়িতে তেমন ভাল-মন্দ খেতে পায় না। বনলতা একটু ঠোঁটকাটাও বটে। কথায় কথায় তিনি মনীষার উল্লেখ করেন নাচনেওয়ালি’ বলে। ৩ার ধারণা, নাচনেওয়ালির কি আর সংসারে মন আছে? সে কেবল নেচে আর নাচিয়ে বেড়ায়। বনলতার দৃষ্টিভঙ্গি পুরনো আমলের বলেই তার মূল্যবোধ অন্যরকম। তার মতে, গুছিয়ে সংসার করা, ভাল-মন্দ রাঁধা এবং পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হওয়াই মেয়েদের ধর্ম। সেই বিচারে মনীষা একেবারেই ধোপে টেকে না। বাস্তবিকই মনীষা রান্নাবান্না বা খাওয়া-দাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। অনেক সময়ে দোকানের খাবার আনিয়ে এক-আধবেলা চালিয়ে নেয়। রান্নাঘরে বাঁধা পড়লে তো তার চলবে না। বনলতা। তাই নাতি এলেই খাবার করতে বসেন এবং পেট পুরে খাওয়ান তাকে। অলক বিনাবাক্যে খেয়েও নেয়।

পিসি সোনালি ইংরিজির এম এ। শারীরিক ত্রুটির ফলেই কি না কে জানে তার মেজাজ সাংঘাতিক তিরিক্ষি। মা-বাপকে সে রীতিমতো শাসনে রাখে। একটু কিছু হলেই সে রেগে আটখানা হয়, নয়তো কাঁদতে বসে। স্থৈর্য, ধৈর্য, সহনশীলতা তার খুবই কম। কিছুদিন আগে সোনালি একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। সময়টা কাটে ভাল। কিন্তু তার একটাই অসুবিধে, টাকা খরচ করার মতো যথেষ্ট উপলক্ষ খুঁজে পায় না। শাড়ি গয়না ইত্যাদিতে তার আকর্ষণ নেই, সে রূপটান ব্যবহারই করে না। তা হলে একটা মেয়ে খরচ করবে কীসে? অনেক সময়ে প্রিয়জন কাউকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার প্রিয়জনই বা কে আছে?

অলককে পেয়ে পিসির সেই অভাবটা মিটল। এই ঠান্ডা সুস্থির ভাইপোটাকে অপ্রয়োজনে দেদার জিনিস কিনে দিয়ে সোনালি প্রায় পাগল করে দিল।

একদিন অলক বিরক্ত হয়ে বলল, আমার জন্য রানিং বুট কিনেছ কেন? রানিং বুট দিয়ে আমার কী হবে?

বিস্মিত সোনালি বলে, কেন, তুই দৌড়োস না?

দৌড়োব কেন? আমি তো সাঁতরাই।

সাঁতারুদের দৌড়োত হয় না বুঝি? আমাকে স্কুলের গেম-টিচার বলেছিল সাঁতারুদের দৌড়োতে হয়। একসারসাইজ করতে হয়।

ধুস! ওসব কিছুই লাগে না। ঠিক আছে, কিনেছ যখন, মাঝে-মাঝে দৌড়োব।

জলে ভাসে এমন একটা দাবার ছক তাকে একদিন কিনে দিল সোনালি। বলল, জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে খেলবি।

অলক দাবার ছকটা দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, এর যে অনেক দাম!

তাতে কী?–উদাসভাবে বলল সোনালি।

এ ছাড়া দামি পোশাক, ভাল জুতো, হাতঘড়ি এসব প্রায়ই কিনে দেয় সোনালি। আর এইসব দেয়া-থোয়া নিয়ে মনীষা গুজরাতে থাকে বেহালায়। তার ধারণা, এইভাবে দাদু-ঠাকুমা আর পিসি অলককে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার প্রশ্ন, কেন? আমরা কি ছেলেকে কিছু কম দিই? কিন্তু মনীষা কখনও এমন কথা অলককে বলতে পারে না যে, ওদের কাছ থেকে নিস না। কথাটা বলা যায় না। শত হলেও ওরা অলকের আপন ঠাকুমা-দাদু, আপন পিসি। কথাটা বললে হয়তো অলক তেমন খুশি হবে না।

এ বাড়িতে সকলেই অলকের প্রিয় বটে, কিন্তু তার আসল আকর্ষণ ঠাকুমা। তার প্রতি ঠাকুমার ভালবাসাটা ক্ষুধার্তের মতো। ভীষণ ঝাঁঝালো, দ্বিধাহীন এবং প্রত্যক্ষ সেই স্নেহ। সে এলে ঠাকুমা কেমন ডগমগ হয়ে ওঠে, অনেক বকে এবং রাজ্যের খাবার করতে বসে যায়। কাছে বসিয়ে অনেক প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

ঠাকুমার প্রতি অলকের আকর্ষণের আর-একটা কারণ হল, জল। সে আবিষ্কার করেছে ঠাকুমাও তার মতোই জল ভালবাসে। ঠাকুমা বলে, সুযোগ পেলে আমি কবে আরতি সাহার মতো ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যেতাম।…পুরীতে যখন প্রথম সমুদ্র দেখি তখন ভয়ে সবাই অস্থির। আমার একটুও ভয় করল না। নুলিয়া না নিয়েই দিব্যি নেমে পড়লাম জলে।… ছেলেবেলায় যখন পুকুরে ড়ুবসাঁতার কাটতাম তখনকার মতো আনন্দ বোধহয় আর কোনও কিছুতেই ছিল না।

ঠাকুমা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, ওরা তোকে ঠিকমতো খেতে-টেতে দেয়?

দেবে না কেন?

তোর মা রাধে আজকাল?

রাঁধে। মাঝে মাঝে।

রান্নার লোক নেই এখন?

মাঝে মাঝে এক-আধজন রাখা হয়। সে কিছুদিন বাদে ঝগড়া করে চলে যায়। ফের কিছুদিন বাদে একজনকে রাখা হয়। এইরকম আর কী!

তোর অফিসের ভাত বেঁধে দিতে পারে?

অলক হাসে, না। আমি তো দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিই। তুমি অত খাওয়া-খাওয়া করো কেন?

ঠাকুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সাঁতারে যে অনেক দম লাগে। খাওয়ার দিকে নজর না দিলে বাঁচবি নাকি?

দাদু, ঠাকুমা, পিসির সঙ্গে অলকের এই টান-ভালবাসার কথা খুব ডিটেলসে না জানলেও আন্দাজ করতে পারে মনীষা। অনুমান করতে পারে তার দিদি মধুরা অর্থাৎ নূপুর এবং বোন প্রিয়াঙ্গি অর্থাৎ ঝুমুর। এবং শোধ নেওয়ার জন্যই বোধহয় একসময়ে মনীষা উঠে-পড়ে অলকের যত্ন নিতে শুরু করে। রোজ ভাল ভাল রাঁধতে থাকে, মেটে চচ্চড়ি, মুরগির সুপ, টেংরির ঝোল ইত্যাদি। বিনা উপলক্ষেই একটা টু-ইন-ওয়ান উপহার দিয়ে বসে তাকে তার বাবা সত্যকাম। খুব বেশিরকম আদর দেখাতে থাকে ঝুমুর।

তার চেয়েও মারাত্মক কাণ্ড করে বসে নূপুর। রোজ সকালে উঠে সে ভাইয়ের মেডিকেল চেকআপ শুরু করে দেয়। আর তাই করতে গিয়েই একদিন সে বিকট চেঁচিয়ে ওঠে, মা! বাবা! শিগগির এসো!

সবাই যথাবিধি ছুটে এসে জড়ো হয় এবং নুপুর ঘোষণা করে, অলকের হার্ট বড় হয়ে গেছে। হি নিডস ইমিডিয়েট মেডিকেল অ্যাটেনশন। সাঁতার বন্ধ।

কথাটা মিথ্যেও নয়। নুপুর নিজেই যখন একজন মস্ত হার্ট স্পেশালিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করাল অলককে তখন তিনিও বললেন, হার্ট বিপজ্জনক রকমের এনলার্জড। সম্ভবত সার্জারি কেস।

খবর পেয়ে অলকের সাঁতারু বন্ধুরা চলে এল। এলেন কোচ নিজেও। দু’দিন বাদে ন্যাশনাল ওয়াটারপোলো শুরু হবে। অলক বেঙ্গল টিমের অপরিহার্য খেলোয়াড়। কোচের না এসে উপায় কী! তবে এনলার্জড হার্টের কথায় তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, সাঁতারুদের হার্ট তো বড় হওয়ার কথা, যেমন হয় লং ডিসট্যান্স রানারদের। যাই হোক আপনারা ভাববেন না। খেলোয়াড়দের আলাদা ডাক্তার আছে, আমি তাকে আনাচ্ছি।

তিনি এলেন এবং একটু পরীক্ষা করেই অলককে বিছানা থেকে টেনে তুলে বললেন, যাঃ, জলে নাম গে। কিস্যু হয়নি। তঅর কলজে বড় হবে না তো কি পাঁঠার কলজে বড় হবে?

সেই থেকে বাড়ির যত্ন আবার কমে গেল। কিন্তু দুই বাড়ির তাকে নিয়ে এই কমপিটিশনটা মনে রইল অলকের। কিছু বলেনি কখনও, কিন্তু মাঝে মাঝে সে আপনমনে হেসে ফেলে। কিন্তু এই ‘অসুখ অসুখ’ রবে তার একটা ক্ষতিও হল। দিদি নূপুর যেদিন তার হার্ট বড় হয়েছে বলে ঘোষণা করল, সেদিন থেকেই সে ভীষণ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেছিল। বাঁ বুকে একটা অস্বস্তি এবং সেই সঙ্গে মনের মধ্যে ভয়। সেই অলীক অসুস্থতার মানসিক ধাক্কাটা বড় কম নয়। অসুখ হওয়াটা বড় কথা নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি বড় হল অসুখ-অসুখ ভাবটা। কেন এই শরীর ধারণ তা অনেক ভেবে দেখেছে অলক। ব্যাধিময়, ব্যথাময়, নশ্বর এই শরীর নিয়ে মানুষের কত না ভাবনা। কিন্তু এই শরীরখানা দেওয়া হয়েছে এটাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্যই, বসিয়ে রাখা বা আরাম করার জন্য,তো নয়।

শরীরের সহনশক্তিরও কোনও সীমা নেই। কিছুকাল আগের একটা ঘটনা। ঝুমুর তার সঙ্গে সাঁতার শিখতে লেক এ যেত। ফুটফুটে মেয়ে, সাঁতারের পোশাকে তাকে বেশ রমণীয় দেখাত। লেক-এর ধারেকাছে বদ ছেলের অভাব নেই। একদিন গুটি পাঁচেক ছেলে ফেরার পথে তাদের পিছু নেয়।

প্রথমটায় টিটকিরি, দুটো-একটা অশ্লীল কথা ও ইঙ্গিতের পর তারা আরও একটু বাড়াবাড়ি শুরু করে দিল। রুখে দাঁড়াল ঝুমুর। তার চেঁচামেচিতে ছেলেগুলো একটুও ভড়কাল না, বরং একজন এসে টপ করে তার হাত ধরে এক পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি–

অলক খুব বেশি কিছু করেনি। সে গিয়ে ছেলেটার হাত ধরে ফেলেছিল। হয়তো সে কিছুই করত না, হয়তো করত। কিন্তু সে কিছু করার আগেই সেই ছেলেগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সে যে ঝুমুরের দাদা, প্রেমিক নয়, ওটা হয়তো তারা আন্দাজ করেনি। ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ের সঙ্গে একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষকে দেখেই সম্ভবত তাদের ঈর্ষা হয়ে থাকবে। একটু ছোট ইন্ধন দরকার ছিল তাদের।

অলক মারতে পারত উলটে। তার গায়ে যথেষ্ট জোর। কিন্তু সে মারেনি। শুধু ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। ঠোঁট ফাটল, নাক ফাটল, কপাল ফাটল, বুকে পিঠে লাগল শতেক ঘুসি ও লাথি। নীরবে সহ্য করে গেল অলক। শুধু এই ফাঁকে ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে ক্লাবে খবর দেওয়ায় অলকের বন্ধুরা ছুটে আসে এবং পালটি নেয়। কিন্তু সে অন্য গল্প। শুধু এটুকু বলতে হয় যে, সেই কচুয়া ধোলাই থেকে অলক শিখেছিল যে, শরীর অনেক সয়।

দাদাকে ওরকম নির্বিকারভাবে মার খেতে দেখে ঝুমুরের বিস্ময় আর কাটে না। মারপিটের সময় সে একঝলক অলকের দু’খানা চোখ দেখতে পেয়েছিল। সেই চোখের বর্ণনা সে বোধহয় কোনওদিনই সঠিক দিতে পারবে না। ভয়হীন, নিরাসক্ত, উদাসীন অথচ উজ্জ্বল সেই চোখ দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, কতগুলো ইতর ছেলের হাতে অলক মার খাচ্ছে। তা ছাড়া অলকের মুখে এবং চোখে একটা আনন্দের উদ্ভাসও দেখেছিল ঝুমুর।

কথাটা সে কাউকে বলেনি কখনও। কিন্তু অলককে সেই থেকে মনে মনে কেমন যেন ভয় পায় ঝুমুর। তার মনে হয়, দাদা স্বাভাবিক নয়। হয়তো পাগল। সঠিক অর্থে পাগল না হলেও মনোরোগী। আর তা যদি না হয় তো খুব উঁচু থাক-এর কোনও মানুষ।

মেয়েদের সঙ্গে অলকের সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক। বিভিন্ন মিট-এ মেয়ে সাঁতারুদের সঙ্গে দেখা হয়, আলাপ বা আড্ডা হয়, ঘনিষ্ঠতা ঘটে। তা ছাড়া ফ্যানরা আছে, আছে সাঁতারুদের বোন বা দিদি।

জানকী কেজরিওয়াল ছিল বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে। মোটামুটি ভালই সাঁতরাত। তাদের ছিল নিজস্ব সুইমিং পুল, একজন ব্যক্তিগত কোচ। এলাহি ব্যাপার। দেখতেও মন্দ ছিল না জানকী। একটু ঢলানি স্বভাব ছিল, এই যা।

সে একটু ঢলেছিল জানকীর দিকে, লোকে বলে। দিল্লিতে একটা ট্রায়ালের ব্যাপার ছিল। জানকী খারিজ হয়ে খুব কান্নাকাটি বাধিয়েছিল সেখানে। মায়াবশে একটু সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল অলককে। সেই থেকে পরিচয়টা ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়িয়ে যায়। জানকীর বাবার কোম্পানির একটা রেস্ট হাউজ আছে হাউজ খাস-এ। জানকী আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, সুইসাইড করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো এসব বলতে বলতে একরকম টেনে নিয়ে গেল সেইখানে। জানকীর দুঃখ কী ছিল বলা মুশকিল, তকে একেবারে চূড়ান্ত কাণ্ডটা ঘটানোর আগে অবধি সেই দুঃখ-দুঃখ ভাবটা তার যাচ্ছিল না। সারা রাত দু’জনে এক বিছানায় কাটানোর পর সকালে অলক জানকীকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, তোমার শরীরের মধ্যে শরীর ছাড়া আর কিছু নেই?

বস্তুত সারা রাত ধরে জানকীর মধ্যে ড়ুব দিয়ে অলক একটা কিছু খুঁজেছিল। এমন কিছু যা ভোগে ক্লান্তি আনে না, যা কিছুটা দেহাতীত, কিছুটা রহস্যাবৃত। জীবনের প্রথম সংগম তাকে প্রায় কিছুই দিল না।

এরকম কয়েকবার ঘটেছে অলকের। মেয়েদের ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকলেও উদ্যম নেই। সে কারও পিছনে ঘোরে না। কিন্তু জুটে যায়। প্রতিবারই সংগম-শেষে এক হাহাকারে ভরে যায় অলক, এক বিতৃষ্ণা ও বিষণ্ণতায় তার শরীর ভেঙে পড়ে। সে কেন অনুভব করে এক পরাজয়ের গ্লানি? এটা কোনও পাপবোধ নয়। সে অনুভব করে কোনও শরীরেরই তেমন গভীরতা নেই যাতে ড়ুবে যাওয়া যায় আকণ্ঠ। জলের মতো শরীর নেই কেন কোনও মেয়ের?

এক বন্ধুর অ্যারেঞ্জমেন্টে তারা অর্থাৎ সাঁতারুদের একটা দল সেবার গেল সরকারি লঞ্চে চেপে সুন্দরবনে বেড়াতে। দু’দিনের চমৎকার প্রোগ্রাম। খাও, দাও, জঙ্গল দেখো, গান গাও বা ঘুমাও। আছে আচ্ছা, তাস, ড্রিংকস।

শুধু জলে নামা ছিল বারণ। মোহনার নদী এমনিতেই লবণাক্ত, তার ওপর কুমির, কামট, হাঙরের অভাব নেই। ডেক-এ দাঁড়িয়ে আদিগন্ত জল আর প্রগাঢ় অরণ্য দেখতে দেখতে কেমন

অন্যরকম হয়ে গেল অলক। গভীর জল, গভীর আকাশ, গভীর অরণ্য।

শেষ রাতে একদিন চুপি চুপি উঠে পড়ল অলক। মাঝদরিয়ায় নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চ। চারদিকে শীতের কুয়াশা, নিথর জল, অদূরে অরণ্যের গভীরতা। এক অলৌকিক আবছায়ায় চারিদিক মায়াময়।

ঝাঁপ দিলে জলে শব্দ হবে, তাই একটা দড়ি ধরে ধীরে ধীরে জলে নেমে গেল অলক। কুমির হাঙর, যাই থাক, জলে সে কখনও ভয় খায় না। শীতের ভোরে ঠান্ডা নোনা জল যখন তার শরীরে কামড় বসাল তখনও তেম। খারাপ লাগল না তার! দু’হাতে জল টেনে সে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল তিরবেগে। কোথায় যাচ্ছে তা জানে না।

জানে না, আবার জানেও। কুয়াশামাখা সেই সমুদ্রগামী বিস্তীর্ণ নদীর মধ্যেই ছিল সেই অলৌকিক। তার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। সেই ডাকই শুনে থাকবে নিশি-পাওয়া অলক।

ক্ষয়া এক চাঁদ অলক্ষে অস্তাচল থেকে নামিয়ে দিয়েছিল তার আলোর কিছু জাদু। সেই আলোয় কুয়াশায় ঘনীভূত হয়ে উঠল জল থেকে এক অপরূপ উত্থান। অলক তখন লঞ্চ থেকে অনেক দুরে, নিরুদ্দেশ যাত্রায় ভেসে যাচ্ছে আয়াসহীন। হঠাৎ দেখল অদূরে জলের ওপর সোনালি নীল রুপালি গোলাপি মাখানো এক অপরূপ জলকন্যা। আনমনে ভেসে আছে জলের ওপর। চোখ সুদূরে। এলো সোনারঙের চুল উড়ছে হাওয়ায়।

কয়েক পলক মাত্র। তারপরেই কুয়াশা এসে ঢেকে দিল তাকে। চাঁদ ড়ুবল।

জলের ওপর স্রোতের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ভেসে থাকল অলক। এইজন্যই ভূতগ্রস্তের মতো তার এতদূর আসা? কে ডাকল তাকে? কেন?

খুব ক্লান্ত হাতে-পায়ে উজান ঠেলে যখন সে লঞ্চে এসে উঠল তখনও সকলেই ঘুমে। গা মুছে, শুকনো কাপড় পরে আবার কম্বলের তলায় গিয়ে ঢুকল অলক। কিন্তু ঘুম হল না। সারা দিনটাই কেটে গেল আনমনে।

সেই শুরু। কিন্তু শেষ নয়। মাঝে-মধ্যে তাকে দেখেছে অলক। ভোরবেলার নির্জনতায় লেক-এ রোয়িং করার সময়। গঙ্গায়। গোপালপুর অন সি-তে। নীল সোনালি রুপালি গোলাপির এক অদ্ভুত কারুকার্য!

ভুল। অলক জানে ভুল। বিশ শতকের এই ভাটিতে কে বিশ্বাস করবে জলকন্যার কথা? জলের বিভ্রম তাকে দেখায় ওই মরীচিকা। সে জানে। তবু দেখে। বারবার দেখে।

<

Shirshendu Mukhopadhyay ।। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়