একটি অসমাপ্ত গল্প

আচ্ছা, জ্যাঠামশাই?

কেন মা? বলিয়া গোবিন্দ মুখুয্যে ভাগবত হইতে মুখ তুলিয়া পরম স্নেহে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রীর দিকে চাহিলেন।

সুরমার দুই চোখে জল টলটল করিতেছিল। হাত দিয়া একগোছা কালো চুল মুখের উপর হইতে পিঠের দিকে সরাইয়া দিয়া মহা অভিমান ভরে অভিযোগ করিল,—আচ্ছা, সাহেবরা যদি এতই পারে তবে কেন তারা দাঁড়কাকগুলো সব মেরে ফেলে না? বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

গোবিন্দ ব্যাপার বুঝিয়া সুরমাকে কাছে টানিয়া লইয়া তাহার চোখ মুছাইয়া দিলেন। বাটীর ভিতরে তাঁহার স্ত্রী দুরারোগ্য পীড়ায় শয্যাগত,—মরণাপন্ন। এবং এইমাত্র চিলের ছাদে বসিয়া একটা দাঁড়কাক অতি কর্কশ কণ্ঠে খাখা করিয়া চীৎকার করিতেছিল।

সেটাকে তাড়াইয়া দিয়া সুরমা অত্যন্ত বিরক্ত ও ভীত হইয়া জ্যাঠামশায়ের কাছে জানিতে আসিয়াছিল—কি জন্য সরকার বাহাদুর এত ক্ষমতাশালী হইয়াও এই ভীষণ অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিতেছেন না।

খানিক পরে গোবিন্দ একটুখানি শুষ্ক মলিন হাসি হাসিয়া বলিলেন, সাহেবদের কথা ত জানিনে মা, কিন্তু দাঁড়কাকের অপরাধটা কি শুনি?

সুরমা তখন চোখের জল মুছিয়া ফিসফিস করিয়া অনেক নালিশ করিল। কহিল, ইহারাই যমরাজের গুপ্তচর, এবং তাহার অকাট্য প্রমাণ এই যে, দাঁড়কাক হইয়াও ইহাদের গলা ময়ূরের মত চিকচিক করে। ছাদে কিংবা নিকটবর্তী কোন বৃক্ষশাখায় বসিয়া আয়-আয়-খাখা করিয়া ইহারা বাটীতে যমদূত ডাকিয়া আনে। বউদিদি বলিয়াছেন, কাহারও ছাদে বসিয়া ডাকিলে আর রক্ষা নাই,—সে বাটীর কেহ-না-কেহ নিশ্চিত মরে। বলিতে বলিতে সুরমা সহসা জ্যাঠামশায়ের বুকে মুখ লুকাইয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহার বাপ-মা নাই, কবে মরিয়াছেন জানেও না। জ্যাঠাইমাই মানুষ করিয়াছেন। সেই স্নেহময়ী আজ সুদীর্ঘ ছয় মাস কাল রোগশয্যায় পড়িয়া। আজ তাঁহারই মরণ কামনা করিয়া ওই ঘৃণিত পক্ষীটা যখন বারংবার ডাকিয়া গিয়াছে, তখন কি উপায়ে কেমন করিয়া তাঁহাকে আর মৃত্যুর অনিবার্য কবল হইতে রক্ষা করা যাইবে! উপায় না পাইয়া যখন সে বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতে লাগিল, তখন এই উপায়বিহীনাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া আর এক নিরুপায়ের চোখ দিয়া টসটস করিয়া জল গড়াইয়া পড়িল।

রাত্রে আহার করিতে বসিয়া গোবিন্দ বধূকে ডাকিয়া মৃদু অনুযোগের স্বরে বলিলেন, ছি মা, ও মেয়েটার জ্যাঠাইমা-অন্ত প্রাণ, তাকে কি এমন করে ব্যাকুল করে দিতে আছে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়