এই বধূটি অত্যন্ত মুখরা। এখন শ্বশুরের সুমুখে কিছু বলিল না বটে, কিন্তু তিনি আঁচাইতে বসিয়া স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন, বধূ অস্ফুট ক্রুদ্ধ বিড় বিড় করিতেছে—ইস কচি খুকি কিনা, তাই ভয় দেখিয়ে ব্যাকুল করে দিয়েচি! এগারো-বারো বছরের মেয়ে হল, ও নিজেই ত সব জানে! আজকাল রাত্তির হলে বাড়িসুদ্ধ লোকের ভয়ে গা ছমছম করে, বজ্জাত মেয়ে আবার তাই কিনা লাগিয়ে এসেচে।

গোবিন্দ বসিয়া সমস্তটা শুনিলেন, কিন্তু একটি কথাও না কহিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন।

তাহার পর হইতে সুরমা না খাইয়া, না শুইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া মাথা খুঁড়িয়া কি কাণ্ডই না করিয়া বেড়াইল। কিন্তু, মরণের দিনটিতে এমনি আশ্চর্য শান্ত হইয়া গেল যে, পাড়ার লোকেরা পর্যন্ত বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। মা-কে দেখিতে দুই মেয়ে এবং জামাইরা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। সকলের সুমুখে তিনি সুরমাকে স্বামীর হাতে-হাতে সঁপিয়া দিয়া বলিলেন, এটি আমার সকলের ছোট সন্তান। এর যেন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র অযত্ন না হয়। আর আমার গায়ের সমস্ত গহনা একে দিয়ে গেলুম।

তাঁহার অনেক টাকার অনেক রকমের অলঙ্কার ছিল—সুতরাং পুত্রবধূ এবং মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইল।

বহুদিন হইতে ভুগিয়া ভুগিয়া তিনি একটু একটু করিয়া মরিতে ছিলেন, সেই জন্য শেষ সময়টিতেও জ্ঞান ছিল, সুরমাকে বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া কানে কানে বলিলেন, সুরো, তোর বুড়ো জ্যাঠামশাইকে দেখিস মা,—তুই ছাড়া ওঁর আর কেউ রইল না। ওঁকে তোর ভরসায় রেখেই আমি নির্ভাবনায় যাচ্ছি।

মেয়েরা এই কানে কানে কথাটা শুনিতে না পাইয়া মনে মনে আরও ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া অনুমান করিল, তিনি নিশ্চয়ই গোপনে তাঁহার সঞ্চিত টাকাকড়ির সন্ধান বলিয়া দিয়া গেলেন।

জ্যাঠাইমা পরলোকে চলিয়া গেলেন। শুধু সেই দিনটি মাত্র সুরমা হতজ্ঞানের মত স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়া রহিল। কেমন করিয়া সেদিন সে রাত্রি কাটিল, তাহা সে ঠাহর পাইল না। কিন্তু পরদিন আপনা-আপনিই সুস্থির সুদৃঢ় হইয়া উঠিয়া বসিল। তাহার চোখে-মুখে বিহ্বলতার লেশমাত্র রহিল না। প্রচণ্ড ভূমিকম্প যেমন মুহূর্তের আলোড়নে সমুদ্রতলদেশকে পাহাড়ের চূড়ায় ঠেলিয়া তুলিয়া দিয়া যায়, জ্যাঠাইমার মৃত্যু তেমনি এই একটি দিনের নিদারুণ ধাক্কায় বালিকা সুরমাকে একেবারে প্রবীণতার সীমায় পৌঁছাইয়া দিয়া দু-দিনের আড়ালে পড়িয়া গেল।

শোকাচ্ছন্ন গোবিন্দ মুখুয্যে ঘাড় গুঁজিয়া বাহিরের ঘরে বসিয়া ছিলেন, সুরমা নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া তাঁহার কেশবিরল মাথাটিতে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে প্রশ্ন করিল, জ্যাঠামশাই?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়