বিন্দু বলিল, কপাল নিয়ে যে জন্মেছিলুম দিদি, সে কথা তোমার মানি; ধন-দৌলত, আদর-আহ্লাদ অনেকেই পায়, সেটা বেশী কথা নয়, কিন্তু এমন দেবতার মত ভাশুর পেতে অনেক জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যার ফল থাকা চাই। আমার অদৃষ্ট দিদি, তুমি হিংসে করে কি করবে? কিন্তু আদর দিয়ে তিনি ত মাথা খাননি, আদর দিয়ে যদি কেউ মাথা খেয়ে থাকে ত, সে তুমি।

অন্নপূর্ণা হাত নাড়িয়া বলিলেন, আমি? সে কথা কারো বলবার জো নেই। আমার শাসন বড় কড়া শাসন—কিন্তু কি করব, আমার কপাল মন্দ, কেউ আমাকে ভয় করে না—দাসী-চাকরগুলো পর্যন্ত মুখের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে ঝগড়া করে, যেন তারাই মনিব, আর আমি দাসী-বাঁদী! আমি তাই সয়ে থাকি, অন্য কেউ হলে—

তাঁহার এই উলটা-পালটা কথায় বিন্দু খিলখিল করিয়া হাসিয়া ফেলিল। বলিল, দিদি, তুমি সত্যযুগের মানুষ। কেন মরতে একালে এসে জন্মেছিলে? কৈ, আমার সঙ্গে ত কেউ ঝগড়া করে না? বলিয়া সহসা সুমুখে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দুই বাহু দিয়া অন্নপূর্ণার গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, একটা গল্প বল না, দিদি!

অন্নপূর্ণা রাগিয়া বলিলেন, যা, সরে যা।

কদম ছুটিয়া আসিয়া বলিল, দিদি, অমূল্যধন জাঁতিতে হাত কেটে ফেলে কাঁদচে।

বিন্দু তৎক্ষণাৎ গলা ছাড়িয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জাঁতি পেলে কোথায়? তোরা কি কচ্ছিলি?

আমি ও-ঘরে বিছানা করছিলুম দিদি, জানিও নে কখন ও বড়মার ঘরে ঢুকে—

আচ্ছা হয়েচে—হয়েচে—যা, বলিয়া বিন্দু ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। খানিক পরে অমূল্যের আঙুলের ডগায় ভিজা ন্যাকড়ার পটি বাঁধিয়া কোলে করিয়া আসিয়া বলিল, আচ্ছা দিদি, কতদিন বলেচি তোমাকে, ছেলেপুলের ঘরে জাঁতি-টাঁতিগুলো একটু সাবধান করে রেখো—তা—

অন্নপূর্ণা আরো রাগিয়া গিয়া বলিলেন, কি কথা যে তুই বলিস ছোটবৌ, তার মাথা-মুণ্ডু নেই। কখন তোর ছেলে ঘরে ঢুকে হাত কাটবে বলে কি জাঁতি নোয়ার সিন্দুকে বন্ধ করে রাখবো?

বিন্দু বলিল, না, কাল থেকে ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো, তা হলে আর ঢুকবে না, বলিয়া বাহির হইয়া গেল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়