জোর করে তোমাকে? আচ্ছা, এখন যাচ্চ যাও, তার পর হবে। বলিয়া তাহাকে পোশাক পরাইতে লাগিল।

মাস-দুই পূর্বে অমূল্যর পৈতা হইয়াছিল; সে নেড়া মাথায় জরির টুপি পরিতে ভয়ঙ্কর আপত্তি করিল। কিন্তু বিন্দু ছাড়িবার লোক নয়, সে জোর করিয়া পরাইয়া দিল। অমূল্য নেড়া-মাথায় জরির টুপি পরিয়া দাঁড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল।

মাধব ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে বলিলেন, আর ওর কত দেরি হবে গো?

পরক্ষণেই অমূল্যর দিকে দৃষ্টি পড়িলে হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, বাঃ—এই যে মথুরার কৃষ্ণচন্দ্র রাজা হয়েছেন।

অমূল্য লজ্জায় টুপিটা ফেলিয়া দিয়া খাটের উপর গিয়া উপুড় হইয়া পড়িল।

বিন্দু রাগিয়া উঠিল। বলিল, একে ছেলেমানুষ কাঁদচে, তার উপর তুমি—

মাধব গম্ভীর হইয়া বলিলেন, কাঁদিস নে অমূল্য, ওঠ্, লোকে পাগল বলে ত আমাকেই বলবে, তুই আয়।

ঠিক এই কথাটাই ইতিপূর্বে আর একদিন হইয়া গিয়াছিল এবং বিন্দু তাহাতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিল। সেই কথাটার পুনরাবৃত্তিতে সে হাড়ে হাড়ে জ্বলিয়া গিয়া বলিল, আমি সব কাজ পাগলের মত করি, না? বলিয়া উঠিয়া গিয়া অমূল্যকে তুলিয়া আনিয়া পাখার বাঁটের বাড়ি ঘা-কতক দিয়া দামী মখমলের পোশাক টানিয়া টানিয়া খুলিয়া ফেলিতে লাগিল।

মাধব ভয়ে ভয়ে বাহির হইয়া গিয়া অন্নপূর্ণাকে সংবাদ দিলেন, মাথায় ভূত চেপেচে বৌঠান, একবার যাও।

অন্নপূর্ণা ঘরে ঢুকিয়া দেখেলেন, বিন্দু সমস্ত পোশাক খুলিয়া লইয়া একটা সাধারণ বস্ত্র পরাইয়া দিতেছে, অমূল্য ভয়ে বিবর্ণ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে।

অন্নপূর্ণা বলিলেন, বেশ ত হয়েছিল ছোটবৌ, খুললি কেন?

বিন্দু অমূল্যকে ছাড়িয়া দিয়া হঠাৎ গলায় আঁচল দিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, তোমাদের পায়ে পড়ি বড়গিন্নী, সামনে থেকে একটু যাও। তোমাদের পাঁচজনের মধ্যস্থতার জ্বালায় ওর প্রাণটাই মার খেয়ে যাবে।

অন্নপূর্ণা বাক্‌শূন্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

বিন্দু অমূল্যর একটা কান ধরিয়া টানিয়া আনিয়া ঘরের এক কোণে দাঁড় করাইয়া দিয়া বলিল, যেমন বজ্জাত ছেলে তুমি, তেমনি তোমার শাস্তি হওয়া চাই। সমস্তদিন ঘরে বন্ধ থাক। দিদি, বাইরে এস। আমি দোর বন্ধ করব। বলিয়া বাহিরে আসিয়া শিকল তুলিয়া দিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়