কিন্তু এ-সকল কথার উত্তর দিতে আমার লজ্জা বোধ হয়।
আগে আদিম ও অসভ্য মানব-জাতির সামাজিক ও সাংসারিক আচার-ব্যবহারের উল্লেখ করিতে গিয়া এমন অনেক কথা বাধ্য হইয়া আমাকে বলিতে হইয়াছে যাহা পাঠ করিলেও মানুষ শিহরিয়া উঠে। কিন্তু ও-সব উল্লেখের প্রয়োজন শুধু যে পুরুষের দোষ দেখাইবার জন্যই হইয়াছিল তাহা নহে। সামাজিক মানব সম্বন্ধে এই যে একটা উক্তি আছে যে, “perhaps in no way is the moral progress of mankind more clearly shown than by contrasting the position of women among savages with their position among the most advanced of the civiliazed” ইহা সত্য বলিয়া মনে করি বলিয়াই ঐ-সব দৃষ্টান্ত দিবার আবশ্যক হইয়াছিল। বস্তুতঃ মানবের নৈতিক উন্নতি-অবনতি বুঝিয়া লইবার ইহা অপেক্ষা প্রকৃষ্ট উপায় আছে কি না জানি না বলিয়াই অত কথা বলিয়াছি, তা আমার আত্মীয় দুটি বিশ্বাস করুন, আর নাই করুন।
আর একবার মধুর রসের কথাটা পাড়িব। কারণ, এই রস মানুষকে কতভাবে কত দিক দিয়া যে মানুষ করিয়া তুলিয়াছে তাহা বুঝিয়া লওয়া আবশ্যক। সুতরাং একবার যাহা বলিয়াছি পুনরায় তাহার আবৃত্তি করিতেছি,—এই রস-বোধ যেখানে যত কম, এদিকে দৃষ্টি যাহার যত ক্ষীণ সে ততই অমানুষ। এই রস অক্ষুণ্ণ রাখিবার প্রয়াসেই মানবের অজ্ঞাতসারে সতীত্বের সৃষ্টি, এই রস-মাহাত্ম্য গাইয়াই মানুষ কবি। এই রসের অবমাননা করিয়াই ভারতের যুগ-বিশেষ, এবং মধ্যযুগের ইউরোপ, নারীকে peculiar representative of sexuality বলিয়া ভুল করিয়া যে অধঃপথে গিয়াছিল তাহা অস্বীকার করা চলে না। এই রস-বোধের প্রধান উপাদান নারীর সৌন্দর্য। পুরুষ যত বর্বরই হউক, রূপের সম্মান সে না করিয়াই পারে না, এমন কি পুটুয়ারা, যাহারা গরুর অভাবে স্ত্রীলোকদিগের কাঁধে লাঙ্গলের জোয়াল তুলিয়া দিয়া জমি চাষ করে, তাহাদের মধ্যেও দেখা যায় যে, যে রমণীগুলি অপেক্ষাকৃত সুন্দরী, তাহারা লাঙ্গল কম টানে। আবার সৌন্দর্যের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগকেই বেশি করিয়া লাঙ্গল টানিতে হয়। রেভঃ জন রস্ কোরিয়ার ইতিহাসে, কোরিয়াবাসীদের সম্বন্ধেও ঠিক এইরূপ ব্যবহার অনেক স্থানেই লিখিয়া গিয়াছেন।
তবেই দেখা যায়, তা যত অল্পই হউক, রূপের একটু সুবিধা আছেই, এবং এই সুবিধা শুধু তাহার একার নহে, পুরুষেরও হৃদয়বৃত্তি উচ্চ করিবার পক্ষেও ইহা যথেষ্ট সাহায্য করে। নিজের নিষ্ঠুরতা সে দুটো দিনের জন্যও দমন করিতে শিক্ষা করে। কিন্তু, এই শিক্ষা তাহার নিজের দোষেই অধিকদূর অগ্রসর হইতে পায় না। দেখা যায়, সমাজ যাহার যত নীচ, নারীর সৌন্দর্যও সেখানে তত অল্প, এবং ততোধিক ক্ষণস্থায়ী। নজির তুলিয়া আর প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করিব না, কিন্তু প্রায় পর্যটকই লিখিয়া গিয়াছেন, যাহাদের মধ্যেই নারীর status অত্যন্ত low, তাহাদের মধ্যেই পুরুষেরা বরং দেখিতে ভাল, কিন্তু রমণীরা এতই কুৎসিত কদাকার যে চাহিয়া থাকিতেও ঘৃণা বোধ হয়।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 38
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 209