কিন্তু পুরুষেরা শুধুই বহুবিবাহ করে না, কথায় কথায় স্ত্রী-হত্যা করে—নারীর স্থান এখানে গৃহপালিত পশুর সমান, বরং নীচে। জননীরা প্রার্থনা করে, তাহাদের সন্তান যেন প্রসিদ্ধ চোর-ডাকাত এবং খুনে হয়। পুত্ররাও অনেক সময়ে জননীর প্রাণ বধ করিয়া হাতেখড়ি দেয়। বাপ শুনিয়া হাসে, বলে, ছেলে আমার বীরপুরুষ হইবে। কিন্তু, রমণীগুলির নিষ্ঠুর অন্তঃকরণের উল্লেখ করিয়া অনেক পর্যটকই বলিয়া গিয়াছেন, পুরুষেরা লড়াই করিয়া কাহাকেও বন্দী করিয়া আনিলে তাহাকে আহার করিবার পূর্বে মেয়েদের আমোদের জন্য অন্তঃপুরে পাঠাইয়া দেয়। তাহার হাত-পা বাঁধা—স্ত্রীলোকদিগের সবচেয়ে বড় আমোদ খোঁচা দিয়া তাহার চোখ তুলিয়া ফেলা। স্ত্রীলোকেরা সেই হতভাগাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া কেহ–বা চোখ তুলিতে থাকে, কেহ ছুরি দিয়া পেট কাটিয়া নাড়ি বাহির করিতে থাকে, কেহ পাথর দিয়া দাঁত ভাঙ্গিতে থাকে; সে যত চেঁচায়, ইহারা ততই আমোদ পায়। এই সে–দেশের নারী, অথচ, অসভ্য কেন, সুসভ্যের মধ্যেও তাহাদের মত পতিভক্তি ও সতীত্ব পাওয়া কঠিন। তবে, কেমন করিয়া এমন সম্ভব হইল? সতীত্বে যাহাদের প্রায় সমকক্ষ নাই, কি দোষে, কাহার পাপে সেই নারীহৃদয় এমন পাথরের মত হইয়া গেল!

নারী-সম্বন্ধে পুরুষের সহৃদয়তা ও ন্যায়পরতার পরিচয় দিতে গিয়া অনেক নজির এবং অনেক কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। আর বলিতে চাহি না। কারণ, ইহাতেও যদি যথেষ্ট না হইয়া থাকে, ত আর হইয়াও কাজ নাই। অতঃপর আর দুই-একটা স্থূল কথা বলিয়াই এ প্রবন্ধ শেষ করিব। আগে নর-নারীর নানাবিধ সম্বন্ধের উল্লেখ করিয়া প্রথমেই দাম্পত্য-সম্বন্ধের আলোচনা করিয়াছি। তাহার হেতু শুধু ইহাই নহে যে, যেখানে অন্যান্য সম্বন্ধ অস্পষ্ট, সেখানেও ইহা স্পষ্টতর, অপিচ, জীবমাত্রেরই সমস্ত সম্বন্ধ হইতে ইহার আকর্ষণও যেমন দৃঢ়তর, স্পৃহা ও মোহও তেমনি দীর্ঘকাল-ব্যাপী।

আমাদের দেশের বিজ্ঞজনেরাও বলিয়াছেন, ছয়টা রসের মধ্যে মধুর রসটাই শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠ রসের উৎপত্তি মানবের যৌনবন্ধন হইতে। বস্তুতঃ, সামাজিক মানব যত প্রকারের সম্বন্ধে রস-ভোগ করিতে শিখিয়াছে, সর্বশ্রেষ্ঠ এই মধুর রসের মধ্যেই যাবতীয় রসের সমাবেশ ও বিকাশ দেখিতে পাওয়া যায়; এবং এইজন্যই একটু লক্ষ্য করিয়া দেখিলেই চোখে পড়ে, যে-কোন দেশে এই রসের ধারণা যত ক্ষীণ, বন্ধন যত ক্ষণস্থায়ী ও ভগ্নপ্রবণ, নর-নারীর অপরাপর সম্বন্ধও সেখান সেই অনুপাতে হীন। জগতের যে-কোন দেশ বা জাতির সম্বন্ধে স্ত্রী অপেক্ষা জননী বা ভগিনী প্রিয়তর, এমন কথাটা বলিতে পারিলে হয়ত ভালই শোনায়, কিন্তু সেটা মিথ্যা বলা হয়। তবে এইখানে একটা বিষয়ে পাঠককে সতর্ক করাও আবশ্যক। যেহেতু, এমন কয়েকটা দৃষ্টান্ত আছে, যেখানে তলাইয়া না দেখিলেই EÒV¡ ব্যাপার ঘটিতেছে বলিয়া ভ্রম হয়। কয়েকটা অসভ্য বা অর্ধ-সভ্য জাতির মধ্যে একদিকে নারীর যেমন দুর্দশার সীমা-পরিসীমা নাই, অন্যদিকে তেমনি ইহাকেই বাটীর, এমন কি সমাজের কর্ত্রী হইতেও দেখা যায়।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়