চার

ইঁহাদের পিসতুতো বোন এলোকেশীর অবস্থা ভাল ছিল না। যাদব তাঁহাকে প্রায়ই অর্থসাহায্য করিয়া পাঠাইতেন। কিছুদিন হইতে তিনি তাঁহার পুত্র নরেনকে এইখানে রাখিয়া লেখাপড়া শিখাইবার ইচ্ছা জানাইয়া চিঠিপত্র লিখিতেছিলেন, এই সময়ে তিনি ছেলে লইয়া উত্তরপাড়া হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার স্বামী প্রিয়নাথ সেখানে কি করিতেন, তাহা ঠিক করিয়া কেহই বলিতে পারে না, দিন-দুয়ের মধ্যে তিনিও আসিয়া পড়িলেন। নরেনের বয়স ষোল-সতের। সে চওড়া পাড়ের কাপড় ফের দিয়া পরিত এবং দিনের মধ্যে আট-দশবার চুল আঁচড়াইত। টেরিটা তাহার বাস্তবিকই একটা দেখিবার বস্তু ছিল।

আজ সন্ধ্যার পর রান্নাঘরের বারান্দায় সকলে একত্রে বসিয়াছেলেন এবং এলোকেশী তাঁহার পুত্রের অসাধারণ রূপ-গুণের পরিচয় দিতেছেলেন।

বিন্দু জিজ্ঞাসা করিল, নরেন, কোন্ ক্লাসে পড় তুমি?

নরেন বলিল, ফোর্থ ক্লাস। রয়েল রিডার, গ্রামার, জিয়োগ্রাফি, এরিথ্‌মেটিক, আরো কত কি ডেসিমেল্‌-টেসিমেল্‌—ও-সব তুমি বুঝবে না মামী।

এলোকেশী সগর্বে পুত্রের মুখের দিকে একবার চাহিয়া বিন্দুকে বলিলেন, সেকি এক-আধখানা বই, ছোটবৌ? বইয়ের পাহাড়; কাল বইগুলো বাক্স থেকে বার করে তোমার মামীদের একবার দেখিও ত বাবা!

নরেন ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা দেখাব।

বিন্দু বলিল, পাস করতে এখনো ত দেরি আছে।

এলাকেশী বলিলেন, দেরি কি থাকত ছোটবৌ, দেরি থাকত না। এতদিনে একটা কেন, চারটে পাস করে ফেলতো। শুধু মুখপোড়া মাস্টারের জন্যই হচ্ছে না। তার সর্বনাশ হোক, বাছাকে সে যে কি বিষ-নজরেই দেখেচে, তা সেই জানে। ওকে কি তুলে দিচ্চে? দিচ্চে না। হিংসে করে বছরের পর বছর একটা কেলাসেই ফেলে রেখেচে।

বিন্দু বিস্মিত হইয়া কহিল, কৈ, এ-রকম ত হয় না!

এলোকেশী বলিলেন, হচ্চে, আবার হয় না! মাস্টারগুলো সব একজোট হয়ে ঘুষ চায়; আমি গরীব মানুষ, ঘুষের টাকা কোথা থেকে যোগাই বল ত?

বিন্দু চুপ করিয়া রহিল। অন্নপূর্ণা আন্তরিক দুঃখিত হইয়া বলিলেন, এমন করে কি কখন মানুষের পিছনে লাগতে আছে? সেটা কি ভাল কাজ? কিন্তু আমাদের এখানে ও-সব নেই। আমাদের অমূল্য ত ফি বছর ভাল ভাল বই প্রাইজ ঘরে আনে, কিন্তু কখ্খন ঘুষটুষ দিতে হয় না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়