ছয়

প্রায় এক মাস অতীত হইল কেহই কাহারো সহিত সাক্ষাৎ করিল না। মেরি মনে করে যে, তাহার বাল্যসখাটি তাহার শরীরের ও মনের চতুষ্পার্শ্বে যে মমতার আবরণে ঢাকিয়া দিয়াছিল,তাহা অল্পে অল্পে সে কাটিয়া ফেলিয়াছে; আর তাহার উপর কোন স্নেহ নাই, মায়া নাই—এক বিন্দু সম্বন্ধ পর্যন্ত নাই। এই এক মাসের মধ্যে সে এই কথাগুলি নিশিদিন ধরিয়া মনে মনে তোলাপাড়া আলোচনা করিয়া দেখিয়াছে। কিন্তু যত অধিক সে এ বিষয় আলোচনা করিয়াছে, তত বেশি সে আপনাকে প্রতারিত করিয়াছে। নিজের হৃদয়ের তলায় সে এক দিনও প্রবেশ করে নাই, করিলে দেখিতে পাইত যে, সেখানে শুধু লিও আর নিজে অষ্টপ্রহর মুখোমুখি করিয়া বসিয়া আছে। প্রেমালাপ করিতেছে না—কলহ করিতেছে। উঠিতে বসিতে সে সর্বদাই চিন্তা করে, কি করিলে এ কলহটা আরও পাকাইয়া তুলিতে পারা যায়, কিরূপ নিত্য নব উপায় উদ্ভাবন করিতে পারিলে লিওর বিরক্তি আরও একটু সজীব করিয়া তুলিতে পারা যায়। কিরূপ আচার-ব্যবহার আরম্ভ করিলে তাহাকে আরও একটু ম্রিয়মাণ করা যাইতে পারে। ইতিমধ্যে আরও দুই-একবার ভোজন উৎসবাদি সমাধা হইয়াছে, ব্যয়বাহুল্য এবং আয়োজনাদির পারিপাট্য দেখিয়া গ্রামের লোক কত সুখ্যাতি করিয়াছে, কিন্তু তাহাতে তাহার মন নাই। মানস-চক্ষে সে শুধু দেখিতে চাহে, এ-সকল কাহিনী শুনিয়া লিওর মুখ কিরূপ বিশুষ্ক এবং পাণ্ডুবর্ণ হইয়াছে, কর্ণে শুনিতে চাহে, লিও কিরূপ ফুলিয়া ফুলিয়া হৃদয়ের যন্ত্রণায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিতেছে। এত অর্থব্যয় বুঝি তাহা হইলে সার্থক হয়। অর্থব্যয়ের কারণ ঐ লিও এবং উদ্দেশ্য তাহার যাতনা বৃদ্ধি করা;—কিন্তু সফলতার কথা কেহ বলে না। এ কথা কাহাকেও জিজ্ঞাসা করা যায় না— কিন্তু এমন কি কেহ নাই, এমন কি কোন সর্বদর্শী অন্তর্যামী পদার্থ নাই, যাহা এ কথা বলিয়া যাইতে পারে? মেরি অন্যমনস্কভাবে এই সব ভাবে। কিন্তু যখন মনে হয়, লিও তাহার পুষ্পের মত শুভ্র শান্ত দেহটি লইয়া হৃদয়ের মধ্যে জগতের শক্তি এক করিয়া পর্বতের মত দৃঢ় হইয়া আছে, এত সমারোহ, হট্টগোল তাহার হৃদয়ের দ্বারে আঘাত খাইয়া ঠিকরিয়া পড়িতেছে, ভিতরে একটিবারও প্রবেশ করিতে পারিতেছে না; হয়ত বা সে-হৃদয়ে জ্বালার পরিবর্তে অবহেলা ও ঘৃণার স্থান হইয়াছে, তখন মেরির সমস্ত শিরা, অস্থি, মজ্জা—যাহা কিছু আছে সমস্ত এক সাথে ঝমঝম করিয়া সুরে-বেসুরে নিতান্ত একটা অবসন্ন হতাশ ছবি চক্ষের উপর দাঁড় করাইয়া দেয়।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়