উৎসবরাত্রে যখন সকলে ব্যস্তভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, বাটীময় সাড়াশব্দে পূর্ণিত, শিখরে শিখরে উৎসবের সহস্র দীপ দৈত্যরাজার প্রমোদভবনের মত শোভা পাইতেছে—হয়ত সে সময়ে মেরি একটু নির্জনে বসিয়া একটা অপরূপ বিষাদচিত্র মনে মনে আঁকিতেছে। ভাবিতেছে, লিও হয়ত এতক্ষণে তাহার নৈশ কার্য শেষ করিয়া শীতল বায়ুর জন্য একটিবার মাত্র জানালা খুলিয়াছে; উৎসবের দীপামালা চক্ষে পড়িয়াছে—কিন্তু নিমেষের জন্য! নিতান্ত অবজ্ঞাভরে জানালা রুদ্ধ করিয়া পরক্ষণেই সে নিতান্ত নিশ্চিত- মনে আপনার স্নিগ্ধ শয্যাতলটি আশ্রয় করিয়া শুইয়া আছে,—নিদ্রাদেবী পদ্মহস্তে তাহার পদ্মের মত দুটি চক্ষের উপর হাত বুলাইয়া তাহাকে নিদ্রিত করিতেছেন। মেরি ছটফট করিয়া উঠিয়া পড়িল,—ভাবিল, সে নিজে? নিজের কথা নিজেই বুঝে না—মনে হয়, এত উৎসব-সমারোহ মিথ্যা পণ্ডশ্রম মাত্র! লিওর গ্রাহ্যের মধ্যেও আসে না।

জ্বালার উপর জ্বালা, মেরি ধনবতী কিন্তু লিও দরিদ্র, তাহার সহায়-সম্পদ আছে, লিওর কিছুই নাই, জনসাধারণ তাহাকে কত খাতির-যত্ন করে, লিওকে কেহ চিনে না, তবুও সে এত উচ্চে বসিয়া আছে যে, মেরি তাহার যথাসর্বস্ব ব্যয় করিয়াও তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারিতেছে না। তাহার রূপ যৌবন ঐশ্বর্যের পদতলে কতলোক নিত্য আসিয়া মাথা নত করিতেছে, স্বেচ্ছায় অযাচিত আপনাকে বিক্রয় করিবার জন্য তাহার পানে ঈষৎ সঙ্কেতের অপেক্ষামাত্র করিয়া দীন নয়নে চাহিয়া বসিয়া আছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র দারিদ্র্যপীড়িত, পরিশ্রমক্লিষ্ট, অসহায় অলৌকিক জীবটি একবার ফিরিয়াও দেখে না। সে ধরিতে চাহে না, ধরা দিতেও চাহে না। রাগের মাথায় মেরি আকাশের গায়ে থুথু ফেলিত। লিওর স্থান বড় উচ্চে, সেখানে এ-সব পৌঁছিত না, শুধু মেরির মুখে-চোখেই তাহা ফিরিয়া আসিত। দ্বিগুণ জ্বালায় সে আপনি জ্বলিয়া মরিত।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়