বিশ্বেশ্বরী। একলা তোমার মাথায় পড়েনি মা, আমরা সবাই মিলে তাকে ভাগ কোরে নিয়েচি। অসত্যাচারী সমাজের যে কাপুরুষের দল মিথ্যে দুর্নামের ভয় দেখিয়ে তোমাকে ছোট করেচে, এ পাপের ভারে তাদের মাথা আজ পথের ধূলায়। বেণীর মা আমি, আমার মাথা মাটিতে লুটোচ্চে রমা, কখনও আর তুলতে পারব না।

রমা। অমন কথা তুমি বোলো না জ্যাঠাইমা। কিন্তু আমি কি করেছিলাম জানো? জনশূন্য অন্ধকার-পথে একলা দেখা কোরে সেধেছিলাম, রমেশদা, তুমি যাও,—যাও এখান থেকে। বিশ্বাস করলেন না, বললেন, আমি চলে গেলে তোমার লাভ কি? আমার লাভ? হঠাৎ ব্যথার ভারে যেন পাগল হয়ে গেলাম। বললাম, লাভ কিছুই নেই,—কিন্তু না গেলে আমার অনেক ক্ষতি। আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না,—তুমি দেশে থেকে আমাকে সকল দিক দিয়ে নষ্ট কোরো না। কিন্তু এতবড় মিথ্যে আমি কোথায় পেলাম জ্যাঠাইমা? রাগ কোরে বললেন, এই? এইমাত্র? না, এর জন্যে আমার কাজ ছেড়ে আমি কোনমতেই যাব না। অভিমানে ভাবলাম, তবে হোক একটা শিক্ষা। বিশ্বাস ছিল, সামান্য কিছু একটা জরিমানা হবে। কিন্তু সে শাস্তি যে এমনি কোরে আসবে,—তাঁর রোগশীর্ণ মুখের পানে চেয়েও বিচারকের দয়া হবে না,—তাঁকে জেলে দেবে এ কথা আমার অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি জ্যাঠাইমা।

বিশ্বেশ্বরী। সে জানি মা।

রমা। শুনলাম, আদালতে তিনি কেবল আমার পানেই চেয়েছিলেন। তাঁর গোপাল সরকার চাইলেন আপিল করতে, তিনি বললেন, না। সারা জীবন যদি জেলের মধ্যে বাস করতে হয় সেও ঢের ভাল, কিন্তু আপিল করে খালাস পেতে চাইনে। এ শাস্তি আমার কত বড় বল ত জ্যাঠাইমা?

বিশ্বেশ্বরী। কিন্তু তার মিয়াদের কালও পূর্ণ হয়ে এলো। মুক্তি পেতে আর বেশী দিন নেই।

রমা। তাঁর মুক্তি হবে, কিন্তু তাঁর সেই নিবিড় ঘৃণা থেকে ইহজীবনে আমার ত মুক্তি নেই মা!

[বৃদ্ধ সনাতন হাজরাকে লইয়া বেণীর প্রবেশ]

বেণী। এই আমাদের তিনপুরুষের প্রজা। সুমুখে দিয়ে যাচ্ছিলেন, ডাকতে তবে বাড়ি ঢুকলেন। হাঁ রে সনাতন, এত অহঙ্কার কবে থেকে হোল রে? বলি, তোদের ঘাড়ে কি আর একটা কোরে মাথা গজিয়েচে রে?

সনাতন। দুটো করে মাথা আর কার থাকে বড়বাবু? আপনাদেরই থাকে না ত আমাদের মত গরীবের!

বেণী। কি বললি রে হারামজাদা?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়