সে যা হউক, না ছাপিবার কি কারণ তা তিনিই জানেন কিন্তু দিলীপকুমারের বিরুদ্ধে অধিকাংশ বিষয়েই প্রমথবাবুর সহিত আমি যে একমত তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। এমন কি ষোল আনা বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। প্রমথবাবু হিন্দুস্থানী সঙ্গীত লইয়া চুল পাকাইয়াছেন, তথাপি দিলীপের বক্তব্যের অর্থগ্রহণ করা শক্তিতে তাঁহার কুলায় নাই। প্রমথবাবু বলিতেছেন তিনি কথার কারবারী নহেন, সুতরাং ‘বিনাইয়া নানা ছাঁদে’ কথা বলিতে পারিবেন না–তবে মোদ্দা কথায় গালিগালাজ যা করিবেন তাহাতে ঝাপসা কিছুই থাকিবে না।
প্রমথবাবুর চুল পাকিয়াছে, আমার আবার তাহা পাকিয়া ঝরিয়া গেছে। দিলীপ বলিতেছেন, “আমাদের সঙ্গীতে ‘একটা নূতন কিছু’ করার সময় এসেছে, তা আমাদের সঙ্গীত যতই বড় হোক–কেন না প্রাণধর্মের চিহ্নই গতিশীলতা।” কিন্তু বলিলে কি হইবে? দিলীপের যখন একগাছিও চুল পাকে নাই, তখন এ–সকল কথা আমরা গ্রাহ্যই করিব না।
দিলীপ বলিতেছেন, “যে আসলটুকু আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি,–তাকে হয় সুদে বাড়াও, না হয় আসলটুকু খোয়া যাবে, এই হচ্চে জ্ঞানরাজ্যের ও ভাবরাজ্যের চিরন্তন রহস্য।”
প্রমথবাবু বলিতেছেন, “এ সাধারণ সত্য আমরা সকলেই জানি।” জানিই ত।
পুনশ্চ বলিতেছেন, “কিন্তু সৃজন কাজটা এত সোজা নয় যে, যে-কেউ ইচ্ছা করলেই পারবে। এ পৃথিবী এত উর্বর হলে ...। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ধারায় যদি পঞ্চাশ-ষাট বৎসর কোন নূতন সৃষ্টি না হয়ে থাকে তাহলে সেটা এতবড় দীর্ঘকাল নয় যে, আমাদের অধীর হয়ে উঠতে হবে।”
আমারও ইহাই অভিমত। আমাদের চুল পাকিয়াছে, দিলীপের পাকে নাই। আমরা উভয়ে সমস্বরে বলিতেছি, অধীর হইয়া ছটফট করা অন্যায়। পৃথিবী অত উর্বর নয়। পঞ্চাশ-ষাট বছরের বেশি হয় নাই যে, ইহারই মধ্যে ছটফট করিবে! আর যতই কেন কর না, কিছুই হইবে না সে স্পষ্টই বলিয়া দিতেছি,–ইহাতে ঝাপসা কিছুই নাই।
কিন্তু ইহার পরেই যে প্রমথবাবু বলিতেছেন, “যখন কোন স্রষ্টা সৃষ্টির প্রতিভা নিয়ে আসবে, তখন সে সৃষ্টি করবেই, শৃঙ্খল ভাঙবেই, অচলায়তন ভূমিসাৎ করবেই–তাকে কেউ ঠেকিয়ে, কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না ...”। প্রমথবাবুর এ উক্তি আমি সত্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না, কারণ সংসারে কয়টা লোকে আমার নাম জানিয়াছে? কয়টা লোক আমাকে স্বীকার করিতেছে? ও-পাড়ার মনু দত্ত যে মনু দত্ত, সে পর্যন্ত আমাকে দাবাইয়া রাখিয়াছে! পৃথিবীতে অবিচার বলিয়া কথাটা তবে আছে কেন? যাক, এ আমার ব্যক্তিগত কথা। নিজের সুখ্যাতি নিজের মুখে করিতে আমি বড়ই লজ্জা বোধ করি।
কিন্তু ইহার পরেই প্রমথবাবু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় উচ্চ-সঙ্গীত সম্বন্ধে যে সত্য ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহা অস্বীকার করিবার সাধ্য কাহারও নাই। প্রমথবাবু বলিতেছেন, “ভারতের উচ্চ-সঙ্গীত ভাবসঙ্গত। কেবল সা রে গা মা পর্দা টিপে শ্রুতি-সুখকর শব্দ-পরম্পরা উৎপন্ন করলেই সে সঙ্গীত হয় না। এক কথায় রাগ-রাগিণীর ঠাট বা কাঠাম ভাবগত, পর্দাগত নয়।”
আমিও ইহাই বলি, এবং আমাদের নাগ মহাশয়েরও ঠিক তাহাই অভিমত। তিনি পঞ্চাশোর্ধ্বে লড়াইয়ের বাজারে অর্থশালী হইয়া একটা হারমোনিয়ম কিনিয়া আনিয়া নিরন্তর এই সত্যই প্রতিপন্ন করিতেছেন।
প্রবন্ধ : স্বদেশ ও সাহিত্য Chapter : 1 Page: 42
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 560