রমা। (কিছুতেই যেন আর সহিতে পারিল না) যা তাঁর হাতে আছে তা তাঁর হাতেই থাক না রমেশদা।

রমেশ। তাই ত আছে রমা।

রমা। তবে—তবে, আজকেই বা বাড়িতে পেয়ে আমাকে অপমান করচেন কেন?

রমেশ। অপমান! কিছুমাত্র না। এর মধ্যে মান-অপমানের কথাই নেই। এ যাদের কাহিনী শুনচো, সে রমাও তুমি কোনদিন ছিলে না, সে রমেশও আর আমি নেই।

রমা। রমেশদা, আপনার নিজের কথাই বলুন। রমার কথা আমি আপনার চেয়ে বেশী জানি।

রমেশ। যাই হোক শোন। কেন জানিনে, সেদিন আমার অসংশয়ে বিশ্বাস হয়েছিল, তুমি যা ইচ্ছে বল, যা খুশি কর, কিন্তু আমার সত্যিকার অকল্যাণ তুমি কিছুতে সইতে পারবে না। বোধ করি ভেবেছিলাম, সেই যে ছেলেবেলায় একদিন ভালবেসেছিলে, সেই যে হাতে কোরে চোখ মুছিয়ে দিয়েছিলে, হয়ত তা আজও একেবারে ভুলতে পারনি। তাই মনে করেছিলাম কোন কথা তোমাকে না জানিয়ে তোমারি ছাওয়ায় বসে সমস্ত জীবনের কাজগুলো আমার ধীরে ধীরে কোরে যাব। কিন্তু সে রাত্রে আকবরের নিজের মুখে যখন শুনতে পেলাম তুমি নিজে—ও কি? বাইরে এত গোলমাল কিসের?

[দ্রুতবেগে গোপাল সরকারের প্রবেশ]

গোপাল। ছোটবাবু! (অকস্মাৎ রমাকে দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া থামিল)

রমেশ। কি হয়েচে সরকারমশাই?

গোপাল। পুলিশের লোক ভজুয়াকে গ্রেপ্তার করেচে।

রমেশ। ভজুয়াকে? কেন?

গোপাল। সেদিন রাধাপুরের ডাকাতিতে সে নাকি ছিল।

রমেশ। আচ্ছা, আমি যাচ্চি। আপনি বাইরে যান।

[গোপাল সরকার প্রস্থান করিল]

রমেশ। যতীন ঘুমিয়ে পড়েচে, সে থাক। কিন্তু তুমি আর একমুহূর্ত থেকো না রমা, খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে যাও। পুলিশ খানাতল্লাশি করতে ছাড়বে না।

রমা। (উঠিয়া দাঁড়াইয়া ভীতকণ্ঠে) তোমার নিজের ত কোন ভয় নেই?

রমেশ। বলতে পারিনে রমা। কতদূর কি দাঁড়িয়েচে সে ত এখনো জানিনে।

রমা। তোমাকেও ত গ্রেপ্তার করতে পারে?

রমেশ। তা পারে।

রমা। পীড়ন করতেও ত পারে?

রমেশ। অসম্ভব নয়।

রমা। (সহসা কাঁদিয়া উঠিয়া) আমি যাব না রমেশদা।

রমেশ। (সভয়ে) যাবে না কি-রকম?

রমা। তোমাকে অপমান করবে, তোমাকে পীড়ন করবে—আমি কিছুতেই যাব না রমেশদা।

রমেশ। (ব্যাকুল-কণ্ঠে) ছি ছি, এখানে থাকতে নেই। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে রানী!

[এই বলিয়া দুই হাত ধরিয়া জোর করিয়া তাহাকে বাহির করিয়া দিল।
ওদিকে বহু লোকের পদশব্দ ও গোলমাল স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল]

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়