দয়াল। আমিও ত তাই বলি। বলি, তেমন করুণা ত বিজয়া সকলকেই করেন। আমাকেই কি তিনি কম দয়া করছেন!

বিজয়া। দয়ার কথা ইচ্ছে হলে আপনারা বলতেও পারেন, কিন্তু নরেনবাবু পারেন না। বরঞ্চ, বার বার যা পেয়েছেন সে আমার নিষ্ঠুরতারই পরিচয়। সত্যি কিনা বলুন?

দয়াল। (সলজ্জে) না না, সত্যি নয়—সত্যি নয়—তবে নরেন নিজে কতকটা তাই ভাবে বটে। সেদিন কালীপদকে দিয়ে তুমি আমার ওখানে তার microscope-টা পাঠিয়ে দিলে, নরেন জিজ্ঞাসা করলে, কত টাকা দিতে বলেচেন? কালীপদ বললে, টাকার কথা বলে দেননি—এমনি। এমনি কি রে? কালীপদ বললে, হাঁ, এমনি নিয়ে যান, টাকা বোধহয় দিতে হবে না। সত্যি ত আর এ বিশ্বাস করা যায় না—নিশ্চয় কালীপদর ভুল হয়েছে—এতেই নরেন রেগে উঠে বললে, তাঁকে বল্‌ গে যা, আমাকে দান করার দরকার নেই, ঠাট্টা করবারও দরকার নেই। যা, ফিরিয়ে নিয়ে যা।

বিজয়া। শুনেছি আমি কালীপদর মুখে।

দয়াল। কিন্তু নলিনী তাঁকে বারণ করেছিল। ওর ধারণা নরেনের হয়ত কাজ আটকাচ্চে ভেবেই বিজয়া পাঠিয়ে দিয়েছেন, নইলে উপহার বলেও নয়, বিদ্রূপ করার জন্যেও নয়। ভেবেচেন হাতে হাতে টাকা না নিয়ে যেদিন হোক পরে নিলেই হবে। আমারও তাই মনে হয়। বল ত মা সত্যি নয় কি?

বিজয়া। জানিনে দয়ালবাবু। অসুখের মধ্যে পাঠিয়েছিলুম, ঠিক মনে করতে পারিনে তখন কি ভেবেছিলুম।

দয়াল। কিন্তু নলিনী বলে নিশ্চয় এই। বললে, নরেনের মত ভদ্র, আত্মভোলা, নিঃস্বার্থপর মানুষকে কেউ কখনো অপমান করতে পারে না এক বিলাসবাবু ছাড়া। কিন্তু নরেন নিজে কোনমতেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারলে না, বললে, যে লোক আমার পরম দুর্গতির দিনে ওটা দুশো টাকা দিয়ে কিনে দুদিন পরেই নিজের মুখে চারশো টাকা চায় তার কিছুই অসম্ভব নয়। ওরা বড়লোক, ওদের অনেক ঐশ্বর্য—তাই আমাদের মত নিঃস্বদের উপহাস করতেই ওরা আনন্দ পায়। কিন্তু যাক গে এ-সব কথা মা! তোমাদের উভয়কেই ভালবাসি, ভাবলে আমার ক্লেশ বোধ হয়। (একটুখানি মৌন থাকিয়া) নরেন কিন্তু তোমার বিলাসকে অকপটে ক্ষমা করেছে। এমনি অন্যমনস্ক, নিঃসঙ্গ লোক ও, যে সবাই যখন শুনেচে তোমাদের বিবাহ স্থির হয়ে গেছে, তখনো শোনেনি কেবল ও-ই! তোমার ঘর থেকে বার করে এনে রাসবিহারীবাবু যখন খবরটা তাকে দিলেন তখন শুনে যেন ও চমকে গেল। বিলাসবাবুর রাগের কারণটা বুঝতে পেরে তাঁকে তখনি ক্ষমা করলে। শুধু এইটুকুই সে আজো ভেবে পায় না যে, তার মত দরিদ্র গৃহহীন দুর্ভাগাকে বিলাসবাবু সন্দেহের চোখে দেখলেন কি ভেবে। এত বড় ভ্রম তাঁর হলো কি করে? আমিও ঠিক তাই ভাবি, শুধু নলিনীই ঘাড় নাড়ে—সমস্ত কথাই সে শুনেচে।

বিজয়া। শুনেচেন? শুনে কি বলেন নলিনী?

দয়াল। বলে না কিছুই, শুধু মুখ টিপে হাসে।

বিজয়া। তিনি কি চলে গেছেন?

দয়াল। না, আজ যাবে। বলেছিল যাবার পথে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে। কিন্তু তিনটে বাজল বোধ হয়, এল বলে। কিংবা হয়ত নরেনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়