রাস। ছোট জাত ত আর মিছে কথা নয়! হাজার হোক সেই চাষার ছেলে ত! বামুন-কায়েতের ছেলে হলে ভদ্রতাও শিখতিস, নিজের ভাল-মন্দও বুঝতিস, হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানও জন্মাত। যাও, এখন মাঠে মাঠে হাল-গরু নিয়ে কুলকর্ম করে বেড়াও গে! উঠতে-বসতে তোকে পাখিপড়া করে শেখালাম যে, ভালোয় ভালোয় কাজটা একবার হয়ে যাক, তারপরে যা ইচ্ছে হয় করিস; তোর সবুর সইল না, তুই গেলি তাকে ঘাঁটাতে! সে হলো রায়-বংশের মেয়ে। ডাকসাইটে হরি রায়ের নাতনী। তুই হাত বাড়িয়ে গেছিস তার নাকে দড়ি পরাতে—মুখ্য কোথাকার! মান-ইজ্জত সব গেল, এত বড় জমিদারির আশা-ভরসা গেল, মাসে মাসে দু-দুশো টাকা মাইনে বলে আদায় হচ্ছিল সে গেল—যাও এখন চাষার ছেলে লাঙ্গল ধর গে। আবার আমার কাছে এসেছেন—চোখ রাঙ্গিয়ে তার নামে নালিশ করতে! দূর হঃ!—তোর আর মুখদর্শন করব না!

[বলিয়া রাসবিহারী নিজেই দ্রুতবেগে চলিয়া গেলেন, পিছনে পিছনে বিলাসও বিহ্বলের
ন্যায় ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। ধীরে ধীরে বিজয়া প্রবেশ
করিয়া টেবিলে মাথা নত করিয়া বসিল। দয়ালের প্রবেশ]

দয়াল। এ কি কাণ্ড করে বসলে মা! আর তা-ও আমার মত একটা হতভাগ্যের জন্যে! আমি যে লজ্জায়, সঙ্কোচে, অনুতাপে মরে যাচ্চি।

বিজয়া। (মুখ তুলিয়া চোখ মুছিয়া) আপনি কি বাড়ি চলে যাননি?

দয়াল। যেতে পারলাম না মা। পা থরথর করে কাঁপতে লাগল, বারান্দার ওধারে একটা টুলের ওপর বসে পড়লাম। অনেক কথাই কানে এল।

বিজয়া। না এলেই ভাল হতো, কিন্তু আমি অন্যায় কিছু করিনি। আপনাকে অপমান করার তাঁর কোন অধিকার ছিল না।

দয়াল। ছিল বৈ কি মা। যে কাজ আমার করা উচিত ছিল করিনি, একটা চিঠি লিখে তাঁর কাছে ছুটি পর্যন্ত নিইনি—এ-সব কি আমার অপরাধ নয়? রাগ কি এতে মনিবের হয় না?

বিজয়া। কে মনিব, বিলাসবাবু? নিজেকে কর্ত্রী বলতে আমার লজ্জা করে দয়ালবাবু, কিন্তু ও দাবী যদি কারো থাকে সে আমারই। আর কারো নয়।

দয়াল। ও কথা বলতে নেই মা, রাগ করেও না। আমাদের মনিব যেমন তুমি তেমনি বিলাসবাবু। এই ত আমরা সবাই জানি।

বিজয়া। সে জানা ভুল। আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ মনিব নেই।

দয়াল। শান্ত হও মা, শান্ত হও। বিলাসবাবু একটু ক্রোধী, অল্পেই চঞ্চল হয়ে পড়েন এই তাঁর দোষ, কিন্তু মানুষ ত সর্বগুণান্বিত হয় না, কোথাও একটু ত্রুটি থাকেই। এইখানে নলিনীর সঙ্গে আমার মেলে না। সেদিন রোগে তুমি শয্যাগত, তোমার ঘরের মধ্যে নরেনকে অপমান করার কথা শুনে নলিনী রাগে জ্বলতে লাগল। বললে, এর আসল কারণ বিলাসবাবুর বিদ্বেষ। নিছক হিংসা আর বিদ্বেষ।

বিজয়া। বিদ্বেষ কিসের জন্যে দয়ালবাবু?

দয়াল। কি জানি, কেমন করে যেন নলিনীর মনে হয়েছে নরেনকে তুমি মনে মনে—করুণা—করো। এইটেই বিলাসবাবু কিছুতে সইতে পারচেন না।

বিজয়া। কিন্তু করুণা ত তাঁকে আমি করিনি। আমার একটা কাজেও ত তাঁর প্রতি করুণা প্রকাশ পায়নি দয়ালবাবু।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়