তৃতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

বিজয়ার বসিবার ঘর

[বিজয়া সুস্থ হইয়াছে, তবে শরীর এখনও দুর্বল। কালীপদর প্রবেশ]

কালী। (অশ্রুবিকৃত-স্বরে) মা, এতদিন তোমার অসুখের জন্যেই বলতে পারিনি, কিন্তু এখন আর না বললেই নয়। ছোটবাবু আমাকে জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। কেন?

কালী। কর্তাবাবু স্বর্গে গেছেন—তাঁর কাছে কখনো মন্দ শুনিনি, কিন্তু ছোটবাবু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না—দিনরাত গালাগালি করেন। কোন দোষ করিনে তবু—(চোখ মুছিয়া ফেলিয়া) সেদিন কেন তাঁকে জানাই নি, কেন নরেনবাবুকে তোমার ঘরে ডেকে এনেছিলুম,—তাই জবাব দিয়েছেন।

বিজয়া। (কঠিনস্বরে) তিনি কোথায়?

কালী। কাছারিঘরে বসে কাগজ দেখছেন।

বিজয়া। হুঁ। আচ্ছা দরকার নেই—এখন তুই কাজ করগে যা।

[কালীপদর প্রস্থান

[দয়াল প্রবেশ করিলেন]

দয়াল। তোমার কাছেই আসছিলাম মা!

বিজয়া। আসুন দয়ালবাবু, আপনার স্ত্রী ভাল আছেন ত?

দয়াল। আজ ভাল আছেন। নরেনবাবুকে চিঠি লিখতে, কাল বিকেলে এসে তিনি ওষুধ দিয়ে গেছেন। কি অদ্ভুত চিকিৎসা মা, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পীড়া যেন বারো আনা আরোগ্য হয়ে গেছে।

বিজয়া। ভাল হবে না! আপনাদের সকলের কি সোজা বিশ্বাস ওঁর উপর!

দয়াল। সে কথা সত্যি। কিন্তু বিশ্বাস ত শুধু শুধু হয় না মা! আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি কিনা, মনে হয় ঘরে পা দিলেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে।

বিজয়া। তা হবে!

দয়াল। একটা কথা বলব মা—রাগ করতে পাবে না কিন্তু। তিনি ছেলেমানুষ সত্যি, কিন্তু যে-সব নামজাদা বিজ্ঞ চিকিৎসকের দল তোমার মিথ্যে চিকিৎসা করে টাকা আর সময় নষ্ট করলে, তাদের চেয়ে তিনি ঢের বেশী বিজ্ঞ—এ আমি শপথ করে বলতে পারি। আর একটা কথা মা, নরেনবাবু শুধু ওঁরই চিকিৎসা করে যাননি—আরও একজনের ব্যবস্থা করে গেছেন। (টেবিলের উপর একটুকরা কাগজ মেলিয়া) তোমাকে কিন্তু উপেক্ষা করতে দেব না, ওষুধটা একবার পরীক্ষা করে দেখতেই হবে বলে দিচ্চি।

বিজয়া। কিন্তু এ যে অন্ধকারে ঢিল ফেলা দয়ালবাবু—রুগী না দেখে prescription লেখা।

দয়াল। ইস, তাই বুঝি! কাল যখন তুমি তোমাদের বাগানের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলে—তখন ঠিক তোমার সুমুখের পথ দিয়েই যে তিনি হেঁটে গেছেন। তোমাকে ভাল করেই দেখে গেছেন—বোধ হয় অন্যমনস্ক ছিলে বলেই—

বিজয়া। তাঁর কি পরনে সাহেবী-পোশাক ছিল?

দয়াল। ঠিক তাই। দূর থেকে দেখলে ভুল হয়, বাঙালী বলে হঠাৎ চেনাই যায় না।

বিজয়া। (হাসিয়া) ওটা আপনার অত্যুক্তি দয়ালবাবু—স্নেহের বাড়াবাড়ি।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়