সোনার তরী আর পূর্ণিমা খাঁটি মৌলবাদীদের পত্রিকা। এসব পত্রিকায় আমি কখনও কোনও সাক্ষাৎকার দিইনি। কিন্তু যখন তাদের কোনও প্রয়োজন হয় আমার মুখে কিছু বাক্য বসাবার, তারা নিজ দায়িত্বে সেসব বসিয়ে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষ মুদ্রিত যে কোনও লেখাকে খুব বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসটিই ইনকিলাব গোষ্ঠীর মূলধন। মুখে ফেনা তুলে ফেলছে কোনও একটি কথা বলে বলে, কারও কানে ঢোকে না তা, আর যখনই লিখে দিচ্ছে সে কথা, পড়তে গিয়ে লোকের মস্তিষ্কে তা সুরুৎ করে ঢুকে যায়। মস্তিষ্কগুলোই এখন এই গোষ্ঠীর খুব প্রয়োজন। এই জাতির মস্তিষ্কের ওপরের আবরণটি খুব পাতলা, খুব য়চ্ছ, খুব সহজে যে কোনও মাল আবরণ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়, গোবর ঢোকালে গোবরও ঢুকে যায়, ধর্ম ঢোকালে ধর্মও। আমার বিবৃতিটিই কেবল ঢোকেনি। আমি যে লিখেছি কোরান সংশোধনের কথা আমি বলিনি, সেটির দিকে কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। অথবা তাকালেও মনে মনে বলছে, তুমি কোরানের সংশোধনের কথা এখন হয়তো না বলতে পারো, তাতে কি! কোরান সম্পর্কে কম বাজে কথা এ যাবৎ বলেছো ! এখন জল ঘোলা করোনি, কিন্তু আগে তো করেছো। ভাল যে বলেনি, তুমি জল ঘোলা না করলেও তোমার বাপ ঘোলা করেছে, বাপ না করলেও তোমার বাপের বাপ করেছে, তাই তোমাকে আমরা চিবিয়ে খাবো।

চিঠি আসছে বিদেশ থেকে। নভেম্বরে নরওয়ের লেখক সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ, অক্টোবরে ফ্রান্সের বই মেলায়, সুইডেনের লেখক-সংগঠন থেকে আমন্ত্রণ, আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের জন্য লেখালেখির ওপর বিদ্যে নেওয়ার আমন্ত্রণ, নিউ ইয়র্কে মেরেডিথ ট্যাক্স এর নারীবাদী লেখক সভায় আমন্ত্রণ। আমি নিজেই অবাক হই এমন সামান্য লেখকের জন্য এত বড় সম্মান দেখে। বিদেশি কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমাদের আশংকা হয় কবে কখন কে আপনাকে মেরে ফেলে। আপনি বরং অন্য কোনও দেশে চলে যান। বাংলাদেশ আপনার জন্য নিরাপদ নয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিই এমন অলক্ষুণে প্রস্তাব। এ দেশ আমার, এ দেশ ছেড়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো কেন? আমি কি পাগল হয়েছি নাকি যে এমন কথা ভাবব? যতদিন বাঁচি এ দেশেই থাকবো। এ দেশে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমি একা লড়াই করছি না। মৌলবাদ-বিরোধী একটি বড় শক্তি এ দেশে আছে, আমরা সবাই মিলে দেশটিকে মৌলবাদ মুক্ত করতে চাইছি, সবাই মিলে দেশটির মঙ্গলের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি। অন্য দেশে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করার কুৎসিত ভাবনাটি আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও মুহূর্তের জন্যও কখনও উঁকি দেয় না।

তাণ্ডবের মধ্যেও জীবন যাপন করছি। শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি। লড়াকু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, আলোচনা করছি, প্রেরণা পাচ্ছি, প্রেরণা দিচ্ছি, ভাবছি, লিখছি, পড়ছি, প্রতিবাদ করছি, মিছিলের মুখে পড়ছি, উল্টোদিকে দৌড়োচ্ছি, মিছিল চলে গেলে বেরোচ্ছি, আবার দৌড়োচ্ছি। গন্তব্য অনেক দূর, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে আমাদের। কিছু একটা করা শক্ত, কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। শামুকের মত গুটিয়ে থাকলে চলবে কেন! শান্ত হও, বাঁধন মানো, ধীরে বল, চিৎকার কোরো না। কিন্তু আমি শান্ত হচ্ছি না, বাঁধন মানছি না, ধীরে বলছি না, আমি চিৎকারই করছি। একটি সম্ভাবনাকে পিষে ফেলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। আমি কি একা? না, আমার সঙ্গে অনেকেই আছেন। সরব এবং নীরব অনেকে। কাছের এবং দূরের অনেকে।

হঠাৎ একদিন অভাব এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ে। অনেকদিন থেকেই আসছি আসছি করছিল, এবার এসেই পড়ে, ঢুকেই পড়ে চৌহদ্দিতে। না, এমন অভাবকে বরণ করলে চলবে না। আমার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, এই খবরটি চাউর হয়ে গেলে আমাকে খুবলে খাওয়ার জন্য শকুনের ভিড় বাড়বে। এতদূর এসে এখন কোনওভাবেই মাথায় হাত দিয়ে আমার বসে গেলে চলবে না। আমাকে সাহায্য করার জন্য কোথাও কোনও প্রাণী অপেক্ষা করে নেই। যত রকম মেরুদণ্ড আছে, সব মেরুদণ্ডই শক্ত করে আমাকে স্রোতের বিপক্ষে বৈঠা বাইতে হবে। কলাম লিখে টাকা রোজগারের একটি পথই এখন অবশিষ্ট। কিন্তু কলাম থেকে আসা টাকা দিয়ে সংসার চলে না। আমার লেখা থাকে বলে পত্রিকা আপিসে হামলা হয়, পত্রিকাগুলোও এখন লেখায় সরকার বা ধর্ম বিষয়ে কোনও মন্তব্য থাকলে ছাপছে না। ভয়। ভয় সরকারি বিজ্ঞাপন হারাবার। সরকারি রোষানলের শিকার হবার ভয়, মৌলবাদীদের হামলার ভয়। ইয়াসমিন আর মিলন সংসারের বাজার খরচ দিচ্ছে, তার ওপর ভালবাসার জন্য ওদের খরচ আছে। আমার টেলিফোনের বিল বাকি, বিল বাকি বিদ্যুৎএর। প্যারিস ছাড়ার পর ফরাসি প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস আমার ঠিকানায় লজ্জা বইটির জন্য অগ্রিম রয়্যালটির চেক পাঠিয়েছিলেন। চেকটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমি।

চেক আসে না, কিন্তু ফোন আসে ক্রিশ্চান বেস এর। মাঝে মাঝে ফোন করে ভাল আছি কি না, নিরাপদে আছি কি না, কোনওরকম কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না ইত্যাদি জানতে চান। তাণ্ডবের খবর তো সবখানেই যাচ্ছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলতে আমার এমনিতে লজ্জা হয়, কিন্তু ক্রিশ্চানকে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেই বসি যে তাঁর যে চেক পাঠানোর কথা ছিল, তা কি তিনি পাঠিয়েছেন? ক্রিশ্চান আকাশ থেকে পড়েন শুনে। –বল কি? আমি তো সেই কবেই তোমার ঠিকানায় রেজিস্ট্রি ডাকে চেক পাঠিয়েছি। সেই চেক তুমি নিশ্চয়ই জমা দিয়েছো তোমার ব্যাংকে। কারণ আমাদের ব্যাংক থেকে সে টাকা অনেক আগেই চলে গেছে।

–অসম্ভব। এ হতে পারে না। আমি কোনও রেজিস্ট্রি ডাকে আসা কোনও চিঠি পাইনি, কোনও চেক পাইনি। কোনও চেকই ব্যাংকে চেক জমা দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি জোর দিয়ে বলি।

ক্রিশ্চান ব্যাপারটির তদন্ত করবেন বলে ফোন রেখে দেন।

এর কদিন পর আবার ফোন করে বলেন –দেখ, আমি ব্যাংকের ম্যানেজারকে বলেছি আমাকে তোমার চেক এর কপি পাঠাতে। ওরা চেক এক কপি যোগাড় করে আমাকে পাঠিয়েছে। আমার কাছে আছে, চেক এর পেছনে তোমার সই আছে।

আমি বলি, ক্রিশ্চান, আমি কোনও চেক পাইনি। কোনও চেক এর পেছনে আমি সই করিনি।

ক্রিশ্চান বলেন, এ কি করে হবে! তুমি না দাও, তোমার অ্যাকাউণ্টে অন্য কেউ জমা দিয়েছে। তুমি খোঁজ নাও তোমার ব্যাংকে।

আমি কূল কিনারাহীন ভাবনায় ডুবতে থাকি। যে চেক আমার হাতে পৌঁছেনি, সেই চেক আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ জমা দিয়েছে। কিন্তু কারও হাতে যদি পড়ে আমার চেক, কি করে সে জানবে কোন ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট আছে?

আমি ব্যাংকে খোঁজ নিই। ব্যাংক থেকে জানানো হল, আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ কোনও চেক জমা দেয়নি।

তবে কার হাতে চেক পড়েছে? কে রেজেস্ট্রি ডাকের চিঠি রিসিভ করেছে? যদি অন্য কেউ রিসিভ করেই থাকে, তবে চেক ভাঙাবে কি করে, আমার নামের চেক আমার অ্যাকাউন্ট ছাড়া জমা হবে না। যদি আবদুল জলিল নামের কোনও চোর আমার চিঠি চুরি করে, চিঠির ভেতরে একটি চেক ও পেয়ে যায়, তবে চেকটি তো তার কোনও কাজেই লাগবে না।

এর মধ্যে ক্রিশ্চান আমাকে চেকএর কপিটি ফ্যাক্স করে পাঠান। যেহেতু আমার নিজের ফ্যাক্স মেশিন নেই, ইয়াসমিনের আপিসের ফ্যাক্স নম্বর দিয়েছিলাম তাঁকে। জরুরি কোনও চিঠি পত্র তিনি ফ্যাক্সে পাঠাবেন বলেছেন। চেক পেলাম বটে। তবে এ সত্যিকারের চেক নয়, আসল চেকটির ফটোকপির ফ্যাক্সকপি। চেক এর পেছনে বাংলায় তসলিমা নাসরিন লেখা। লেখা বটে, কিন্তু আমার হাতের লেখা নয়। এটি সই বটে, কিন্তু আমার সই নয়।

ভাবনার জলে ডোবা আমি পাশের অ্যাপার্টমেণ্টের দরজায় কড়া নাড়ি। অ্যাপার্টমেন্টটি একজন ব্যাংকারের। তাঁর কাছেই সাহায্য চাই চেক এর জট খোলার। তাঁকে সব বলি, চেকটি দেখাই। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, খুব সোজা ব্যাপার। যে আপনার চেক পেয়েছে, সে আপনার নাম দিয়ে যে কোনও ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছে।

— কিন্তু সে কি করে প্রমাণ করবে সে তসলিমা নাসরিন?

–এটি তো আরও সোজা, এই নামের একটি আইডি করে নেবে।

–যদি কোনও পুরুষ এটি পায়? তসলিমা নামের আই ডি কি করে করবে?

এর মত সহজ জিনিস আর হয় না। লোকটির বউ কিংবা বোনের ছবি দিয়ে নাম তসলিমা নাসরিন বলে একটি মিথ্যে আইডি করে নিল। কে এখানে খোঁজ নিচ্ছে কার আসল নাম কী! আর যদি সিঙ্গাপুরে হয়..

সিঙ্গাপুরে?

হ্যাঁ ওখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল দল আছে, এদের কাজই ডাকে পাঠানো চেক চুরি করা। ওখানে বা অন্য কোনও দেশে চেক ভাঙালে তসলিমা নামটি যে কোনও মেয়ের নাম, তাও তো বুঝবে না।

আমি আঁতকে উঠছি এসব শুনে। এত জটিল কথা ব্যাংকার এমন ভাবে বলছেন, যেন এসবের মত সহজ সরল জিনিস আর হয় না।

‘একটি প্রশ্ন। আমার ঠিকানায় তো চিঠিপত্র আসছে। কোনও চিঠি তো মার যায় না। কিন্তু চেকঅলা চিঠিটি মার গেল কেন?’

জ্ঞপোস্টাপিসে অভিজ্ঞ লোকেরা থাকে, খাম দেখলেই বোঝে কোন খামের ভেতর চেক আছে।’

‘কিন্তু আমি এখন কি করে টাকা পাবো?’

‘আপনি পাবেন না।’ গলাটি এখন আরও শান্ত। নিশ্চিন্ত।

হলুদ হলুদ লাগে সবকিছু। সর্ষেফুলও বুঝি কারও চোখে এত হলুদ লাগে না।

‘তাহলে টাকাটা কিছুতেই আমার আর পাওয়া হচ্ছে না?’

মাথা নাড়লেন, ‘না’।

ব্যাংকারের ব্যাখ্যার পরও আমার ইচ্ছে করে না কোনও অন্যায় চুপচাপ মেনে নিতে। জাতীয় ডাকঘর আপিসে নিজে গিয়ে এর মাথার কাছে আমার শান্তিনগরের বাড়ির ঠিকানার চিঠি যে চুরি হয়েছে বলি। তিনি আমাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। তাও দিই। মাথার কোনও মাথাব্যথা নেই আমার চিঠি আর চিঠির পেটের চেক চুরি হওয়া নিয়ে। তদন্তের কোনও রিপোর্ট আমার কোনওদিনই পাওয়া হয় না। তদন্ত করতে কেউ ডাকঘরে যান না, তবে তদন্ত করতে আমার বাড়িতে আসেন। যখন হতাশা আমাকে ভাসাচ্ছে ডোবাচ্ছে, অভাবের হুলঅলা হিংস্র মশকরা আমাকে নিয়ে নিরবধি মশকরা করছে,তখন ইনকাম ট্যাক্সএর আপিস থেকে দুজন লোক এলেন আমার বাড়িতে। ঘরে ঢুকে ঘরের জিনিসপষেনর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বললেন, কমপ্লেইন এসেছে, আপনার বাড়িতে নাকি দামি ফার্নিচার আছে। আমরা তদন্ত করতে এসেছি।

আমি যে অকারণে অপদস্থ হচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে যে পাঁকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, আমি বুঝি। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার যে শক্তি আর সাহস ছিল আমার, সেটি টেনে ছিঁড়ে টুকরো করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। আমি আমার মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছি, আমাকে ধাককা দিয়ে গভীর খাদে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। খাদে পড়ে যেন আমি মরি অথবা যদি না মরি আমি যেন কেঁচোর মতো পড়ে থাকি, আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করি। আমি মুঠোবন্ধ করি দুই হাত। আমার শেষ শক্তিটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠছে লোকে। আমার অক্ষমতার জন্য আমার রাগ হয়। লজ্জায় ঘৃণায় হতাশায় আমি কুঁকড়ে থাকি। আমার শক্তি সাহস সব উবে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে আমি কোনও গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি। গর্তে আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করছি।

কেঁচো তার গর্ত থেকে শুনতে পাচ্ছে বাইরের চিৎকার, ফাঁসি চাই, দিতে হবে।

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন