মৃত্যুর প্রতিনিধি
কাজী আনোয়ার হোসেন
আকাশে চাঁদ নেই আজ। তারাও নেই। কালিগোলা অন্ধকারে। ডুবে আছে বিশ্ব চরাচর।
বড়সড় একটা জলজ দানবের মত পানির বুক চিরে তরতর করে এগিয়ে চলেছে জাহাজটা। নেভিগেশন লাইট জ্বালানো। হয়নি। আলোর বিন্দুমাত্র আভাস নেই জাহাজের আর কোথাও। বো থেকে স্টার্ন পর্যন্ত ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ভৌতিক একটা অবয়ব। গুঁড়ি মেরে সন্তর্পণে এগোচ্ছে। হুইল হাউসে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন জাহাজটির ব্রিটিশ। ক্যাপ্টেন, ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড। ভেতরে ভেতরে সাঙ্ঘাতিক উৎকণ্ঠিত।
দুহাজার টনি লোট্টি ও মারা নিয়ে এক সপ্তাহ আগে কুয়েত এসেছিলেন রকফোর্ড বিভিন্ন ব্রিটিশ ভোগ্যপণ্য নিয়ে। আজ ফিরে। চলেছেন স্বদেশে। শূন্য জাহাজ নিয়ে। এবারই প্রথম এমনটি ঘটল। আগে কখনও শূন্য যায়নি লোট্টি ও মারা। ব্যাপারটা অকল্পনীয়।
কিন্তু কি আর করা! যেদিন কুয়েত বন্দরে নোঙর করেন। রকফোর্ড, সেই দিনই সন্ধের পর ব্রিটিশ দূতাবাসে তলব করা হয় তাঁকে। জরুরী তলব। কী-না, উপসাগরীয় বাতাসের মতিগতি ভাল নয়। ইরাক কুয়েত বর্ডারে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে শুরু করেছে, যে কোন মুহূর্তে যা খুশি তাই ঘটে যেতে পারে বলে সিআইএ এবং স্থানীয় ব্রিটিশ সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে।
অতএব মাল যত দ্রুত সম্ভব খালাস করতে হবে রকফোর্ডকে, এবং পালাতে হবে বন্দর ছেড়ে। এক মুহূর্ত দেরি করা চলবে না। কেবল লোট্টি ও মারার বেলাই নয়, অন্য সমস্ত ইঙ্গ-মার্কিন জাহাজের ক্যাপ্টেনদের ডেকেও একই নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছে যার যার দূতাবাস।
নির্দেশটার গুরুত্ব বুঝতে ভুল করেননি অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন। পরদিনই ফিরে যাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয়সহ অন্যান্য সাপ্লাই কিনে স্টোর ভরে ফেলেছিলেন তিনি। শুধু ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভরার কাজ বাকি ছিল, আজই সকালে সেরেছেন সেটা। তারপর সন্ধে নামতেই দে ছুট। কোনদিক দেখাদেখি নেই।
অবশ্য জাহাজ যে একেবারেই শূন্য, তা কিন্তু নয়। মাল রাখার খোলে কিছু নেই ঠিকই, তবে ওপরের এক কেবিনে আছেন একজন যাত্রী। অত্যন্ত মূল্যবান এক যাত্রী। ধনকুবের এক কুয়েতি শেখ। কুয়েতে ব্রিটিশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির বিশিষ্ট বন্ধু। বন্ধুর মুখে কুয়েতে সম্ভাব্য ইরাকি আগ্রাসনের আভাস পাওয়ামাত্র দেশ ত্যাগের জন্যে তৈরি হয়ে যান শেখ। ষাটের বেশি বয়স ভদ্রলোকের, বিপত্নীক। এক নাতনী ছাড়া আর কেউ নেই। নিউ ইয়র্কে পড়াশুনা করে সে।
পয়সার অভাব নেই ভদ্রলোকের। প্রতিবছর অকল্পনীয় অঙ্কের অর্থ ওড়ান শখের পিছনে। অদ্ভুত শখ তার। পৃথিবীর যেখানে যত হীরে-জহরৎ, মণি-মুক্তার নীলাম হয়, সেখানেই হাজির হয়ে যান। বগলদাবা করে নিয়ে আসেন সব। সাফাত সিটিতে নিজের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় বিশাল এক গ্যালারি বানিয়ে সেখানেই সে সব সংরক্ষণ করেন তিনি।
কোটি কোটি ডলার মূল্যের রত্ন সম্ভার। অনেকের মতে এই। পরিমাণ টাকায় কুয়েতের পাঁচ বছরের প্রতিরক্ষা ব্যয় অনায়াসে। মেটানো সম্ভব। বন্ধুর মুখে ইরাকের সম্ভাব্য মতলব শুনে ভীষণরকম ঘাবড়ে যান ভদ্রলোক, কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভির কল্যাণে এই অদ্ভুত শখের জন্যে দুনিয়ার প্রায় সবাই কমবেশি চেনে তাঁকে, ইরাক তো বাড়ির। কাছে।
সত্যিই যদি ওরা কুয়েত আক্রমণ করে, রত্ন ভাণ্ডার তো পরের কথা, গ্যালারির একটা ইটও অবশিষ্ট থাকবে না। বন্ধুকে ধরে বসলেন শেখ পরিত্রাণের একটা উপায় খুঁজে দেয়ার জন্যে। অনেক ভেবে বুদ্ধি দিলেন ফাস্ট সেক্রেটারি, ওসব নিয়ে পালিয়ে যাও ইংল্যান্ডে। তাঁরই সহায়তায় লোট্টি ও মারায় প্যাসেজ পেয়েছেন ভদ্রলোক। সঙ্গে তিনটে বড়সড় ব্রিফকেসে রয়েছে তার। ভাণ্ডার।
নামে তাকে ভালই চেনেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড। ফার্স্ট সেক্রেটারি। খানিকটা আভাসও দিয়েছেন কি আছে ব্রিফকেসগুলোয়, ওটাই তার উৎকণ্ঠার কারণ। শুধু ওগুলোর নিরাপত্তার কথা ভেবেই নেভিগেশন রুলের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন আজ রকফোর্ড। বন্দর ছেড়ে আসার ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ করে নিভিয়ে দিয়েছেন। লোট্টি ও মারার সমস্ত আলো। কোনদিকে চলেছেন বুঝতে দিতে। চান না কাউকে। অন্তত গালফ অভ ওমানে না পড়া পর্যন্ত স্বস্তি। নেই তার। যাত্রীটি যেমন অমূল্য, তেমনি বিপজ্জনকও বটেন।
পায়ের নিচে ডেকের মৃদু, ছন্দোবদ্ধ কাপন অনুভব করছেন। ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড, সেই সঙ্গে ডিজেল এঞ্জিনের গুরুগম্ভীর ধুক্ পুক ধুক্ পু্ক। জাহাজটা বেশ পুরানো। তেমনি পুরানো তিনি নিজে। প্রায় চল্লিশ বছর হলো এর ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড। লক্ষ লক্ষ মাইল সাগর পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর।
লোট্টি ও মারার সবকিছু, সবকিছু রকফোর্ডের নখদর্পণে। তার জানা আছে আর বেশিদিন চলবে না এটা, সময় ফুরিয়ে এসেছে। আর বড়জোর পাঁচ বছর, তারপর পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে লোট্টি ও মারাকে। সম্ভবত সেই কারণেই দিন দিন জাহাজটার ওপর মায়া বেড়েই চলেছে তার। অনুভূতিটা এমন, যা কাউকে কোনমতেই ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না।
একটা ছোট, কালো চুরুট ধরালেন ক্যাপ্টেন। মাঝরাতের পর খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে মেঘের আড়াল ছেড়ে উঁকি দিল আধ খাওয়া চাঁদ। তারপর আবার অন্ধকার। অ্যামিডশিপের দিকে যাত্রীটি কি করছেন দেখতে একবার যাবেন কিনা ভাবলেন রকফোর্ড। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলেন। দরকার নেই। ভদ্রলোককে যথাসম্ভব বিরক্ত না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন ফার্স্ট সেক্রেটারি। কেবল তিনি যখন চাইবেন, এক কাপ হালকা লিকারের দার্জিলিং চা বা খাবার সার্ভ করার সময় ছাড়া কেউ যেন তার কেবিনে না যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে বলে দিয়েছেন। দিনে-রাতে দশবার চা পান করেন শেখ।
কত টাকা ভদ্রলোকের? ভাবলেন রকফোর্ড, কত বিলিয়ন ডলার? সন্ধের ঠিক আগে যখন জাহাজে এসে উঠলেন ঘর্মাক্ত শেখ, দেখে মনে হচ্ছিল এইমাত্র যেন গোসল করে এসেছে মানুষটা। চেহারা ফ্যাকাসে, চোখ দুটো অস্থির। যেন কেউ অ্যাই! বললেই ঝেড়ে দৌড় দেবেন যে দিকে দুচোখ যায়। বেচারী! পরে যখন কেবিনে ডাকিয়ে নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন ফার্স্ট সেক্রেটারি, তিন অক্ষরের শব্দটা মনে মনে কয়েকবার আওড়েছিলেন রকফোর্ড। তাঁর মনে হয়েছে, ভয়ে ভেতরে ভেতরে মরে আছেন যেন শেখ।
তোয়ালে সাইজের বড় একটা রুমাল দিয়ে ঘন ঘন মুখেরঘাড়ের ঘাম মুছছিলেন, আর বিড়বিড় করে কী সব যেন বলছিলেন। কেন যে মানুষের এত টাকা হয়, আর শখের পিছনে এত টাকা ঢালে মানুষ, ভেবে পান না রকফোর্ড। পালাও এখন। পকেটের টাকায় কেনা গলার কাঁটা আর গলা মুঠোয় নিয়ে। যত্তোসব!
হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাপ্টেন। হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন ডেকে। ভারি ঠাণ্ডা শেষ মার্চের রাত। ফুসফুস ভরে বরফ ঠাণ্ডা বাতাস টেনে নিলেন তিনি, বুকটা জ্বলে উঠল যেন। উপসাগরের কালো বুকে চোখ রাখলেন ক্যাপ্টেন। পানি নয়, বিশাল এক দোয়াত কালি উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ। বড় আকারের একটা পোকার মত লোট্টি ও মারা হাবুডুবু খাচ্ছে তার মধ্যে।
নিভে যাওয়া চুরুটটা ছুঁড়ে পানিতে ফেলে দিলেন ফ্র্যাঙ্ক। রকফোর্ড। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকালেন। তরুণ। সীম্যান পাগানকে দেখা গেল এদিকেই আসছে। কোন প্রশ্ন না করে চেয়ে থাকলেন ক্যাপ্টেন। তার চার হাতের মধ্যে পৌঁছে। দাঁড়াল পাগান।
ভদ্রলোক চা খেতে চেয়েছেন, স্যার।
দিয়ে এসো। খুব হালকা করে বানাতে বলবে চা। খুব হালকা।
আই, ক্যাপ্টেন, ঘুরে দাঁড়াতে গেল সীম্যান।
না, দাঁড়াও। চা করে নিয়ে এসো, আমিই নিয়ে যাব ওঁর কেবিনে।
দুচোখ সামান্য বিস্ফারিত হলো পাগানের। আপনি চা নিয়ে যাবেন?
হ্যাঁ।
আই আই, স্যার। ঘুরে দাঁড়াল সীম্যান। অদৃশ্য হয়ে গেল।
দাঁতের সঙ্গে সেঁটে থাকা খানিকটা তামাক পাতা আবিষ্কার করে জিভ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে আনলেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড, থোক করে ফেলে দিলেন। তারপর মন দিলেন এঞ্জিনের গান শোনায়।
ঠিক যেন তার হৃদস্পন্দনের আওয়াজ ওটা। একই রকম শোনাচ্ছে। আরও কয়েক পা হাঁটলেন ক্যাপ্টেন। মনে হলো আওয়াজটার প্রকৃতি হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেল, কেমন অন্যরকম শোনাচ্ছে এখন। টের পেলেন তিনি, ছন্দোপতন ঘটেছে কোথাও। অজানা এক অস্বস্তি চেপে ধরতে শুরু করেছে। তঁাকে। অন্ধকারে কারা যেন ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে রকফোর্ডের বিরুদ্ধে।
.
এঞ্জিন রুম।
সেকেণ্ড এঞ্জিনিয়ার মানুষটা খাটো, চেহারা ছুঁচোর মত। নাম মাইক পটার। তেল-কালি মেখে একাকার পুরানো একজোড়া কভারলস্ পরে আছে সে। মাথায় উলের টুপি। টুপির কিনারা টেনে কানের নিচ পর্যন্ত নামিয়ে রেখেছে পটার। যেন শীত ঠেকাচ্ছে।
যদিও বিন্দুমাত্র ঠাণ্ডা নেই এঞ্জিন রুমে। বরং গরমই লাগছে। এখানে। কিন্তু দুটোর একটাও অনুভব করছে না লোকটা। অন্য ধান্ধায় রয়েছে সে, ঠাণ্ডা-গরম অনুভব করার মত বোধ হারিয়ে ফেলেছে সাময়িকভাবে। হাতঘড়িতে চোখ বোলাল মাইক পটার, বারোটা বাজতে দুমিনিট বাকি।
ঠিক বারোটায়, ভাবল লোকটা, লোট্টি ও মারাকে নিশ্চল করে দিতে হবে।
তেলতেলে মুখটা নোংরা দুই হাতে ডলল মাইক পটার। মন। দিয়ে খানিকক্ষণ এঞ্জিনের আওয়াজ শুনল। তারপর ঘুরে ঘুরে ভালভ আর প্রেশার গজ পরীক্ষার ভান করতে লাগল। ওপাশে একটা কাঠের টুলে বসে টিনের মগে কফি পান করছে চীফ। এঞ্জিনিয়ার জ্যাক ফ্লেমিং। হাতে একটা ম্যাগাজিন, উল্টেপাল্টে। দেখছে। পটারের দিকে পিছন ফিরে বসা সে।
কভারলসের পকেট থেকে দীর্ঘ, ভারি একটা রেঞ্চ বের করল পটার। হাতে নাচিয়ে জিনিসটার ওজন বুঝে নিল। এই সময় শব্দ করে হেসে উঠল ফার্স্ট এঞ্জিনিয়ার কিছু একটা পড়ে। এদিক না ফিরেই অনুচ্চ স্বরে বলল কি যেন পটারকে। খেয়াল করল না সে। অন্য ভাবনায় আছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে ঘটতে যাচ্ছে ব্যাপারটা, এবং কয়েকদিনের মধ্যেই কোটিপতি বনে যাচ্ছে সে, এইসব।
জ্যাক ফ্লেমিঙের বড়সড় মাথার পিছন দিকটা দেখল পটার ভাল করে, কাছে এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। তারপর গায়ের জোরে রেঞ্চটা চালাল তার ডান কানের পিছনে খুলি সই করে। গুঙিয়ে উঠল ফার্স্ট এঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আশ্চর্য! পড়ল না, বসে থাকল খাড়া। বরং পটারের কলজের পানি জমিয়ে দিয়ে ঘুরে। তাকাল ধীরে ধীরে। চাউনিতে অবিশ্বাস, ঘৃণা, ক্রোধ আরও কী সব যেন।
অ্যাঁতকে উঠেই আবার রেঞ্চ হাঁকাল সেকেণ্ড এঞ্জিনিয়ার, এবার তার নাক সই করে। মুহূর্তে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল। লোকটার সারা মুখ। কফির মগ, ম্যাগাজিন, দুটোই ছুটে গেল হাত থেকে। টুল উল্টে গেল, হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ল ফ্লেমিং, দুহাতে মুখ চেপে ধরেছে। যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে।
জেসাস গড! বিড়বিড় করে বলল মাইক পটার। অস্ফুটে ফুপিয়ে উঠে শেষবারের মত আঘাত হানল লোকটার মাথার তালু লক্ষ্য করে। খুলি ভাঙার আওয়াজ পরিষ্কার শুনতে পেল সে এবার। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ফার্স্ট এঞ্জিনিয়ারের কাতরানি। সেজদার ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল লোকটা। পরমুহূর্তে গড়িয়ে পড়ল লাশ হয়ে।
বারোটার পর এক মিনিট গড়িয়ে গেছে তখন।
.
পর পর দুবার মৃদু নক্ করে কেবিনের দরজা খুলে ফেলল পাগান। পুরু গদি মোড়া বিছানায় শুয়ে এদিকেই তাকিয়ে ছিলেন যাত্রীটি, উঠে বসলেন ধড়মড় করে। মনে মনে হাসল পাগান। আপনার চা, স্যার।
চা! সামলে নিয়ে বিস্মিত চোখে তাকালেন আরব। কই, আমি তো চা চাইনি!
ক্যাপ্টেন পাঠিয়েছেন, স্যার, অত্যন্ত সপ্রতিভ কণ্ঠে বলল সীম্যান। উনি জানতে চেয়েছেন আপনার আর কিছু লাগবে কি না।
উত্তর দিলেন না শেখ। চেহারা দেখে বোঝা যায় বেশ বিরক্ত হয়েছেন। মাথা দুলিয়ে লোকটাকে বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করলেন তিনি। তাই করল পাগান, তবে তার আগে তার ব্রিফকেস তিনটের ওপর নজর বুলিয়ে নিল এক পলক। ওগুলোর হাতল এক করে পুরু স্টেইনলেস স্টীলের চেইন দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। চেইনের অন্য প্রান্ত হ্যাণ্ডকাফের মত করে বাঁধা মালিকের বা কজিতে।
লোকটা বেরিয়ে যেতে উঠে বসলেন ধনাঢ্য আরব। সামনেই একটা টিপয়ে চায়ের ট্রে রেখে গেছে সে। হাত বাড়িয়ে কাপটা। নিলেন তিনি। ভাবলেন ভালই হলো, তেষ্টায় গলা প্রায় কাঠ হয়ে আছে। মনে মনে ক্যাপ্টেনের প্রশংসা করতে করতে চায়ে চুমুক দিলেন শেখ।
স্বাদটা যেন কেমন লাগল। চিনি নিশ্চই বেশি দিয়ে ফেলেছে। ব্যাটারা!
আবার চুমুক দিলেন তিনি। এবং পরমুহূর্তে মনে হলো। দেহের সমস্ত রক্ত তীরবেগে তার মাথা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করেছে। পানিতে ভরে উঠল চোখ, সামনের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। একই সঙ্গে শেখের মনে হলো, ইস্পাতের একজোড়া হাত যেন সর্বশক্তিতে টিপে ধরেছে তার হৃৎপিণ্ড। ভীষণভাবে দুলে। উঠলেন শেখ, লাগল যেন এখনই গ্রেনেডের মত বিস্ফোরিত হতে। যাচ্ছেন তিনি।
দম নিতে পারছেন না, গলা দিয়ে শক্ত আর খুব বেশি গরম কিছু একটা ঠেলে ওপরে উঠে আসছে। উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। শেখ, কিন্তু পা দুটো যেন আর কোথাও রেখে এসেছেন তিনি, সঙ্গে নেই। বাঙ্কের কিনারা গলে পিছলে ডেকে পড়ে গেলেন। আরব, কাপ-ট্রেসহ টি পয়টা অনুসরণ করল তাকে।
চিত হয়ে পড়ে মুখ হাঁ করে দম নেয়ার জন্যে সংগ্রাম শুরু করেছেন বৃদ্ধ শেখ। এর মধ্যেও দুটো বিষয় তিনি পরিষ্কার। উপলব্ধি করলেন।
এক. তিনি মারা যাচ্ছেন।
এবং দুই. পিঠের নিচের দুলুনি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে। এঞ্জিনের আওয়াজ নেই। কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। চারদিকের পরিবেশে।
হঠাৎ ব্যাপারটা খেয়াল হতে ভুরু কোঁচকালেন ক্যাপ্টেন ফ্র্যাঙ্ক। রকফোর্ড। ব্যাটা, হারামজাদা! এক কাপ চা করে আনতে এত সময় লাগে? গ্যালির দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি, পরক্ষণে জায়গায় জমে গেলেন।
এঞ্জিন থেমে গেছে। সেই সঙ্গে থেমে গেছে ক্যাপ্টেনের রক্ত চলাচল। নিশ্চই মারক কোন ত্রুটি দেখা দিয়েছে এঞ্জিনে, যা আরও অনেক আগেই ঘটার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন রকফোর্ড। ব্যস্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে গেলেন তিনি, আবারও থেমে পড়তে হলো। চোখ কপালে তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ক্যাপ্টেন।
লোডি ও মারার শখানেক গজ সামনে ধীরে ধীরে আকার লাভ করছে সাদা রঙের একটা ইয়ট, অ্যাঁধার ফুড়ে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। ওটাতেও কোন আলো জ্বলছে না। রকফোর্ডের মনে হলো পানি ফুড়ে আচমকা উদয় হওয়া জাহাজটায় নিঃসন্দেহে কেউ নেই। ওটা নিশ্চই ভৌতিক কিছু হবে।
দৃষ্টি যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করে দেখতে থাকলেন ক্যাপ্টেন। কোন ফ্ল্যাগ নেই ওটায়, নেই-কোন আইডেন্টিফাইং সাইন। বো’তে কোন নাম নেই, প্রাণেরও কোন চিহ্ন নেই ডেকে। এর মানে চাঁদটা উকি দিত! আচমকা একটা ঝাঁকি খেয়ে সিধে হলেন রকফোর্ড।
কে যেন ভেতর থেকে বলে উঠল, সাবধান, রকফোর্ড! সামনে বিপদ!
এক দৌড়ে ব্রিজে গিয়ে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন। ঝটকা মেরে গান। কেবিনেটের পাল্লা খুলে ফেললেন। ভেতরে সাজানো রয়েছে দশটা পিস্তল, ছয়টা সেমি অটোমেটিক রাইফেল। একটা রাইফেল নিলেন তিনি। কাজের ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে রহস্যময় জলযানটার দিকে তাকালেন এক পলক।
একটু একটু করে এগিয়েই আসছে ওটা। থামার বা লোট্টি ও মারার পথ থেকে সরে যাওয়ার কোন লক্ষণ নেই। যেন দুটোর সংঘর্ষ না ঘটা পর্যন্ত থামবে না পণ করেছে ওটা। বিপদ সঙ্কেত বাজিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন রকফোর্ড। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডেকে দুদ্দাড়। কয়েক জোড়া পায়ের আওয়াজ উঠল, দৌড়ে আসছে লোট্টি ও মারার ক্রুরা।
তাদের কয়েকজন সবে ঘুম থেকে উঠে এসেছে, পরনে লম্বা। থার্মাল আন্ডারওয়্যার ছাড়া আর কিছু নেই। সবার হাতে অস্ত্র-গুলি তুলে দিলেন রকফোর্ড। নির্দেশ দিলেন, তাঁর সঙ্কেত না পাওয়া। পর্যন্ত কেউ যেন গুলি না ছোড়ে। তারপর রেলিঙের কাছে গিয়ে আবার নজর দিলেন সাদা ইয়টটার গতিবিধির দিকে। অনেক কাছে এসে পড়েছে ওটা।
সত্তর গজ!
ষাট!
ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না-ও হতে পারে হয়তো, ভাবলেন। একবার তিনি। হয়তো অনভিজ্ঞ কোন ট্যুরিস্ট জাহাজ চালনা শেখার চেষ্টা করছে। অথবা…নিজেকে চোখ রাঙালেন ক্যাপ্টেন, কী সব আবোল তাবোল ভাবছেন তিনি? ওটা নিশ্চই কোন…নিশ্চই কোন…
আরও কাছে এসে পড়েছে ইয়টটা।
পঞ্চাশ গজ…
চল্লিশ…।
হঠাৎ মনে হলো, ওটা মেরি সেলেস্টি নয় তো? সেই রহস্যময় প্রাণের স্পন্দনহীন জাহাজ, যে বুকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজের মৃত নাবিকদের কঙ্কাল? হঠাৎ হঠাৎ উদয় হয় যেখানেসেখানে? আবার গায়েব হয়ে যায় চোখের পলকে? অনেকেই তো দেখেছে মেরি সেলেস্টিকে, সেটাই নয় তো? অসংখ্য সাগররহস্যের মধ্যে যাকে বাস্তব বলে মেনে নিয়েছে পৃথিবী?
পঁচিশ গজ!
বিশ!
বাঁ হাতটা নিঃশব্দে শূন্যে তুললেন ক্যাপ্টেন রকফোর্ড। গুলি চালানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। অনেক গুরু দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে দিয়েছেন কুয়েতের ব্রিটিশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি, তা পালন করতেই হবে। তাতে যদি প্রাণও যায়, তাও সই। হঠাৎ হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল ক্যাপ্টেনের। ওই লোকের ব্রিফকেস তিনটে লুট করার…এঞ্জিনের হলো কি?
সঙ্কেত পুরো করার সময় পেলেন না ক্যাপ্টেন, ইয়ট থেকে নীলচে সাদা আলোর মোটা একটা স্তম্ভ ছুটে এসে আছড়ে পড়ল লোটির ওপর। দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। চোখ ঝলসে গেল, চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন রকফোর্ড। পরমুহূর্তে একটা মোটা গলার দুর্বোধ্য কমাণ্ড ভেসে এল ইয়ট থেকে। ওটা কোন ভাষা ধরতে পারলেন না তিনি।
পনেরো গজ!
দশ গজ!
আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। অস্ত্র বিশারদ নন ক্যাপ্টেন, তবু বেশ টের পেলেন পিস্তল আর। রাইফেলই নয়, আরও ভারি কিছু ব্যবহার করছে ও পক্ষ। রকেট। লঞ্চার সম্ভবত। এবং সেই সঙ্গে হ্যাণ্ড গ্রেনেডও। ডজন ডজন। গান মাজলের বিরতিহীন ঝলকে আলো আরও জোরাল হলো, রণক্ষেত্রে পরিণত হলো সাগর।
ব্রিজের কাচ, কাঠের প্যানেলিং চুরমার হয়ে বোলতার গুঞ্জন তুলে বিদ্যুৎগতিতে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। মর্টারের ক্রমাগত আঘাতে লোট্টি ও মারার পুরানো খোল তুবড়ে-বেঁকে একাকার হয়ে গেল। বড় বড় ছিদ্র হয়ে প্রায় চালুনির রূপ পেয়েছে। পোর্ট সাইডের খোল আর বাল্কহেড।
ডেকে মুখ গুঁজে পড়ে আছেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে চলছে শত্রুর গুলিবর্ষণ, কোনদিন থামবে বলে ভরসা হয় না। মাথার ওপর দিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটছে কাঁচকাঠের টুকরো, আরও কি কি ঈশ্বরই জানেন। আচমকা গোলাগুলি শুরুর মুহূর্তে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়া ক্রুদের যারা এখনও মরেনি, তাদের গোঙানি আর আর্ত চিৎকারে ভারি হয়ে। উঠেছে করডাইটের গন্ধ মাখা প্রায় স্থির বাতাস। বেশিরভাগই। মারা গেছে তারা।
একটা কাচের টুকরো ছিটকে এসে আঘাত করল ক্যাপ্টেনের। কপালে। জায়গাটা কেটে দরদর করে রক্ত গড়িয়ে নামতে শুরু করেছে, কিন্তু খেয়াল নেই তার। তিনি যাত্রীটির কথা ভাবছেন। নিশ্চই ওই লোকটির জন্যেই আক্রান্ত হয়েছে লোট্টি ও মারা। নইলে আর কি কারণ থাকতে পারে এর? এত বছরের অভিজ্ঞতা। তার, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা নিজের জাহাজকে কেন্দ্র করে। ঘটতে পারে, কল্পনাও করেননি কখনও।
ক্রাইস্ট ইন হেভেন! যাত্রীটিকে এ সময় সাহায্য করা রকফোর্ডের পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু নিজেই মাথা তুলতে পারছেন না, অন্যকে কি ছাই সাহায্য করবেন তিনি? তবু, এত কিছুর মধ্যেও স্বাভাবিক দায়িত্ব ও বিবেচনা বোধ হারাননি ক্যাপ্টেন। সিদ্ধান্ত নিলেন ক্রল করে অ্যামিডশিপে যাবেন, শত্রুর চোখ বাঁচিয়ে ভদ্রলোককে লাইফবোর্ডে তুলে দিয়ে সরে পড়তে সাহায্য করবেন।
সময় যেন নির্ধারণ করাই ছিল, এক যোগে থেমে গেল শত্রুর সবগুলো অস্ত্র। অকস্মাৎ নীরবতা পাথরের মত চেপে বসল পরিবেশের ওপর।
মুখটা সামান্য তুললেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড, পিটপিট করে তাকালেন আলোর আড়াআড়ি স্তম্ভটার দিকে। আগে তবু অস্পষ্ট হলেও দেখতে পাচ্ছিলেন ইয়টটাকে, এখন পারছেন না। আলোর পিছনে সব অন্ধকার। উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন ক্যাপ্টেন তবু, যদি কাউকে দেখা যায়! নাহ্! কিছুই দেখা যায় না।
রাইফেলটা শিথিল মুঠোয় ধরে আস্তে আস্তে উঠে বসলেন ক্যাপ্টেন হাঁটুতে ভর দিয়ে। আশেপাশে হাত পা ছড়িয়ে নানান ভঙ্গিতে পড়ে আছে অনেকগুলো লাশ। বেদনায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। কোন অপরাধ ছিল না মানুষগুলোর। তবু মরতে হলো। পৃথিবীতে বাড়ল আরও কিছু পিতৃহারা, বিধবার সংখ্যা। একটা কি দুটো দেহ এখনও মৃদু মৃদু নড়ছে ওর মধ্যে। উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন।
এখনও মরেনি ওরা। তবে মরবে। দুনিয়ার সর্বাধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রও লোকগুলোর কোন উপকারে আসবে না। প্রচণ্ড আক্রোশে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়লেন ক্যাপ্টেন। ক্ষমতা নেই, থাকলে এই মুহূর্তে চরম প্রতিশোধ নিতেন। দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেন ওই সাদা ইয়ট এবং তার দয়ামায়াহীন খুনী। আরোহীদের।
তবে কিছু তো এখনও করতে পারেন তিনি। গুলি বর্ষণ থেমে। গেছে বলে যে রকফোর্ড বেঁচে গেছেন, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। যে কোন মুহূর্তে লোট্টি ও মারার গায়ে ভিড়বে ইয়ট, খুনীর দল উঠে আসবে এটায়। কাজেই বসে বসে মরি কেন? তার আগে যে কটাকে পারা যায়…ভাবতে ভাবতে সেমি। অটোমেটিকটা তুলে কাঁধে ঠেকালেন।
ট্রিগার টানতে যাবেন, এই সময় শক্ত কি যেন ঠেকল মাথার পিছনে। গুঁতো খেয়ে টলে উঠলেন তিনি, বাধ্য হলেন এক পা। এগিয়ে যেতে। সামলে নিয়ে ঘুরে তাকালেন রকফোর্ড। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সীম্যান পাগান। দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। ভয়ঙ্করদর্শন একটা রিভলভার শোভা পাচ্ছে তার হাতে।
তুমি!
হাসিটা আরও প্রসারিত হলো পাগানের। আই, ক্যাপ্টেন। হাত বাড়াল সে, দিন, আপনার বোঝাটা আমাকে দিন।
হতভম্ব হয়ে কয়েক মুহূর্ত লোকটাকে দেখলেন রকফোর্ড। দাঁতে দাঁত চেপে হিস্ হিস্ করে বললেন, বিশ্বাসঘাতক! তা আর বলতে? ছিনিয়ে নিল পাগান রাইফেলটা।
শয়তান! দুমুখো সাপ!
একদম ঠিক বলেছেন, ক্যাপ্টেন। চুপ মেরে গেলেন ফ্র্যাঙ্ক রকফোর্ড। পাগানকে হাতের অস্ত্র তুলতে দেখে নিজেকে শক্ত করে নিলেন। শেষ প্রার্থনা করার। জন্যে কিছু সময় দাও আমাকে।
কিছু কেন? জায়গামত পৌঁছে যত খুশি নিন না, কে নিষেধ করতে যাবে?
আহত এক নাবিক মরণ যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠল। মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন। পরক্ষণেই ট্রিগার টেনে দিল পাগান। মাথার খুলি প্রায় পুরোটাই উড়ে গেল তার। প্রথম কাজ সেরে দ্রুতপায়ে শেখের কেবিনে এসে ঢুকল পাগান। ডেকে বাকাচোরা ভঙ্গিতে পড়ে আছেন শেখ। চোখ দুটো টকটকে লাল, বিস্ফারিত। যেন এখনই লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে।
ব্যথা সহ্য করার ভঙ্গিতে বিকৃত হয়ে আছে চেহারা। এক হাতে গলা চেপে ধরেছিলেন শেখ মৃত্যুর আগে, ওভাবেই আছেন। রক্ত জমে জবাফুলের মত হয়ে আছে মুখটা। চোখ সরিয়ে ব্রিফকেস তিনটের ওপর নজর দিল পাগান। হিপ পকেটে রাখা একটা পাউচ থেকে দীর্ঘ, সরু ব্লেডের একটা ছুরি বের করে হাঁটু মুড়ে বসল লাশের পাশে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল স্টেইনলেস স্টীলের বাঁধন খুলতে।
ঝাড়া দশ মিনিট খোঁচাখুঁচির পর কুট শব্দে খুলে গেল চেইনের বিল্ট ইন তালা। ফোস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল পাগান। রুমাল বের করে ঘাড়ের, মুখের ঘাম মুছল। দুহাতে বোঝাগুলো নিয়ে বেরিয়ে আসবে, এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ উঠল। কে যেন নাম ধরে ডেকে উঠল তাকে।
আমি এখানে! হাঁক ছাড়ল পাগান।
দোরগোড়ায় হাজির হলো খাটোমত এক লোক। গাট্টাগোট্টা, পেশীবহুল দেহ। পেয়েছ?
জ্বি, অত্যন্ত সমীহের সঙ্গে উত্তর দিল পাগান। এই যে।
ব্রিফকেসগুলো দেখল লোকটা। তারপর লাশটার দিকে তাকাল এক পলক। সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মুখে। গুড! ভেরি গুড! কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিস্তল তুলল লোকটা। বুকের বাঁ দিকে তিন তিনটে ফুটো নিয়ে মৃত শেখের ওপর পিঠ দিয়ে আছড়ে পড়ল বিস্মিত, হতবাক পাগান।
<