কাঁচা-পাকা ভুরু কুঁচকে আছে। কপালের পাশে একটা রগ তিরতির করে কেঁপে উঠল। গভীর মনোযোগের সাথে একটা ফাইল দেখছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সুযোগ্য। কর্ণধার মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান।
কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পার্ট ওয়ান
মিকোয়ান প্রজেক্ট
মস্কো থেকে ছয়শো মাইল দূরে বিলিয়ারস্ক-এ মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়। পাঁচ বছর আগে। এটা মিগ-৩১ তৈরির একটা মহা পরিকল্পনা। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র একজোড়া বিমান তৈরি করা হয়েছে।
মিগ-৩১ সোভিয়েত সমর-বিজ্ঞানীদের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। এর ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে পৃথিবীর গোটা আকাশ রাশিয়ান পাইলটদের হাতের মুঠোয় চলে যাবে। আকাশ-যুদ্ধে। সোভিয়েত এয়ারফোর্স হয়ে উঠবে অপরাজেয় একটা শক্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে এ-ধরনের কিছু নেই, তারমানেই এক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়ে দশ বছর পিছিয়ে পড়বে তারা। ন্যাটো আর সি.আই.এ. মিগ-৩১-এর সার্থক নামকরণ করেছে-এয়ারকিং।
দুটো অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে এয়ারকিং (মিগ-৩১)-এর। একটা হলো থট-গাইডেড উইপনস সিস্টেম, অপরটি অ্যান্টি রাডার।
ইনভ্যালিড চেয়ার কিভাবে কাজ করে জানা থাকলে থটগাইডেন্স সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। ইনভ্যালিড চেয়ার বেসামরিক পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হতে যাচ্ছে। এই চেয়ারের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে একজন পঙ্গু বা অচল ব্যক্তি তার কোন হাত, পা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া না করে শুধু পজিটিভ থট অ্যাকটিভিটির সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অনায়াসে যাওয়া-আসা করতে পারবে। চেয়ারটা তৈরি করা হবে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে, ব্রেন-এর সাথে সংযুক্ত (একটা ক্যাপ বা হেডরেস্টের মাধ্যমে) সেনসরগুলো ব্রেন থেকে পাওয়া নির্দেশ হুইলচেয়ার বা ইনভ্যালিড ক্যারিজের মেকানিক্সের কাছে ট্রান্সমিট করবে-ইলেকট্রনিক ইমপালসের মত। মনের নির্দেশগুলো-সামনে এগোও, উল্টো দিকে ঘোরো, ডানে বা বাঁয়ে বাঁক নাও-সরাসরি ব্রেন থেকে আসবে। এই নির্দেশ সরাসরি হুইলচেয়ারের অন্তরে গিয়ে পৌঁছুবে।
পরীক্ষামূলকভাবে এই চেয়ার তৈরি করা সম্ভব হলেও, সামরিক প্রয়োজনে এই পদ্ধতি এখনও ব্যবহার করা শুরু হয়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এ-ধরনের একটা পদ্ধতি আরও নিখুঁত করে নিয়ে সামরিক কাজে ব্যবহার করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। (পশ্চিম ইউরোপ এমনকি ইনভ্যালিড চেয়ার পর্যন্ত তৈরি করছে না।)
ডিটেকশন আর গাইডেন্সের জন্যে আধুনিক একটা এয়ারক্রাফটে রাডার আর ইনফ্রা-রেড সিস্টেম থাকতেই হবে, এয়ারকিং-এ এ-সবের সাথে রাশিয়ানরা যোগ করেছে চিন্তাপরিচালিত এবং চিন্তা নিয়ন্ত্রিত (থট-গাইডেড অ্যান্ড থটকন্ট্রোলড়) অস্ত্রাগার। রাডারের সিগন্যাল নিরেট একটা জিনিসে। বাড়ি খায়, স্ক্রীনে দেখা যায় আসলে ওখানে জিনিসটা কি রয়েছে। আর ইনফ্রারেড স্ক্রীনে দেখায় ডিটেকশন ইকুইপমেন্টের। চারদিকে হিট-সোর্স কোথায় রয়েছে। মিসাইল পরিচালনা বা লক্ষ্যস্থির করার জন্যে দুটোর যে-কোন একটা বা দুটো সিস্টেমই ব্যবহার করা যেতে পারে। মিসাইলেও দুটো সিস্টেমের যে-কোন। একটা অথবা দুটোই থাকে। তবে থট-গাইডেড সিস্টেমের সুবিধে হলো এই যে মিসাইল ছোড়ার পরও পাইলটের হাতে ওটাকে পরিচালনা করার ক্ষমতা থেকে যায়। পাইলট আরও একটা সুবিধে পাচ্ছে, এরও কোন তুলনা হয় না, বোতাম টিপলেই মিসাইল বেরোয়, কিন্তু বোতাম টেপা থেকে শুরু করে মিসাইল বেরুনো পর্যন্ত কিছুটা সময় লেগে যায়। থট-গাইডেড সিস্টেমে মিসাইল রিলিজ হতে প্রায় কোন সময়ই লাগবে না, কারণ পাইলটের মনের নির্দেশ সরাসরি ফায়ারিং সিস্টেমে চলে যাবে, কোন রকম শারীরিক তৎপরতার দরকার হবে না।
এই সফিসটিকেটেড সিস্টেমের কাছ থেকে পুরোমাত্রায় সুফল পেতে হলে নতুন ধরনের সফিসটিকেটেড কামান আর মিসাইলও দরকার। যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্রদের তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি সম্ভবত সোভিয়েত রাশিয়াও এখনও ওগুলো তৈরি করতে পারেনি। এয়ারকিং-এ তারা নিশ্চই প্রচলিত মিসাইল আর রকেটই ব্যবহার করবে। তবু, রাশিয়ার যা প্রোগ্রাম, এই মুহূর্তে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠে পড়ে না লাগে, নতুন ধরনের মিসাইল আর কামান টেকনোলজিতেও পিছিয়ে পড়বে তারা।
এয়ারকিং-এর অ্যান্টি-রাডার কৌশল সম্পর্কে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। ওটার প্রাথমিক উড্ডয়নের সময় স্যাটেলাইট রাডারে ওটাকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সি.আই.এ.। কিভাবে জানা না গেলেও, এতে কোন সন্দেহ নেই যে এয়ারকিং যে-কোন ধরনের রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
এ-সব তথ্য পাবার পর, সঙ্গত কারণেই, ন্যাটো, সি.আই.এ. আর পেন্টাগনের ওরা সবাই হতভম্ব হয়ে পড়ে।
এই বিস্ময়কর হানাদার বিমান ব্যাপক হারে তৈরি করার জন্যে কয়েকশো বিলিয়ন রুবল আলাদা করে রেখেছে সোভিয়েত সরকার। মিগ-২৫ (ন্যাটো আর সি.আই.এ-র দেয়া নাম-এয়ারউলফ)-কে আরও উন্নত করার দুটো প্রজেক্ট এরইমধ্যে বাতিল করে দেয়া হয়েছে বা হবে। সোভিয়েত সমরবিদরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, মিগ-৩১ (এয়ারকিং) ব্যাপক হারে তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সোভিয়েত এয়ারফোর্সের পয়লা নম্বর হানাদার বিমান হিসেবে মিগ-২৫-ই বহাল থাকবে। ব্যাপক হারে মিগ-৩১ উৎপাদনে সহায়তা করার জন্যে রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে অন্তত তিনটে ফ্যাক্টরি-কমপ্লেক্স তৈরির কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। একই সাথে এয়ারকিং-এর দুধরনের সংস্করণ তৈরি করা হবে-ইনটারসেপটর আর স্ট্রাইকার। এগুলোর উৎপাদন শুরু হলে ক্ষমতার ভারসাম্যে গুরুতর পরিবর্তন দেখা দেবে, তার পরিণতি কারও জন্যেই ভাল হবে বলে আশা করা যায় না।
এই হুমকি মোকাবিলার জন্যে প্রেসিডেন্টের কাছে দুটো গোপন প্রস্তাব পাঠায় সি.আই.এ.। তাদের প্রস্তাব ন্যাটো আর পেন্টাগন সমর্থন করে। এক নম্বর প্রস্তাব-কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে গোটা মিকোয়ান প্রজেক্ট ধ্বংস করে দেয়া হোক। দুনম্বর প্রস্ত বি-একটা এয়ারকিং বিলিয়ারস্ক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসা হোক।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে, এই কথা বলে প্রেসিডেন্ট দুটো প্রস্তাবই বাতিল করে দিয়েছেন। এটা প্রায় দুবছর আগের কথা।
কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট পার্ট টু
সি.আই. এ. এবং জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যান।
মিকোয়ান প্রজেক্টে একজন প্রথমশ্রেণীর ইহুদি বিজ্ঞানী কাজ করছে। তার নাম নেসতর কোইভিসতু। কোইভিসতু শুধু একজন বিজ্ঞানী নয়, সেইসাথে একজন স্পাইও। জন্মসূত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার নাগরিক এবং সেখানেই মানুষ হলেও, ইহুদি রাষ্ট্র। ইসরায়েলের স্বার্থ তার কাছে সব সময় বড়।
রাশিয়ার সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও মিকোয়ান প্রজেক্ট সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করতে কোইভিসতুর কোন অসুবিধে হয় না। মস্কোর মার্কিন দূতাবাসের ট্রেড অ্যাটাশে টিম ওয়াইজম্যান সি.আই.এ-র লোক, তার বিশ্বস্ত এজেন্ট হলো চাইম জসেস্কু। জসেস্কুও একজন রাশিয়ান ইহুদি। বিলিয়ারস্ক থেকে কোইভিসতুর পাঠানো তথ্য মস্কোয় রিসিভ করে এই জসেস্কু, তথ্যগুলো নিয়ে আসে মোলায়েভ নামে এক মুদি। সেগুলো টিম ওয়াইজম্যানের হাত ঘুরে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে পৌঁছে যায় তেল আবিবে। কোইভিসতুর দুই ইহুদি বন্ধু আছে বিলিয়ারস্কে, তারাও বিজ্ঞানী এবং মিকোয়ান প্রজেক্টে কাজ করে। এদের। দুজনকেও দলে ভিড়িয়েছে সে। এদের একজন ড. ইসরাফিলভ, অপরজন ড. করনিচয়।
এই খুদে স্পাই রিঙে রাশিয়ান ইহুদি যারা রয়েছে তারা কেউ পেশাদার স্পাই নয়, কিন্ত সবাই ইসরায়েলের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। ইসরায়েল বা ইহুদিবাদের বড় কোন উপকারের বিনিময়ে মৃত্যুবরণ করতেও কুণ্ঠিত নয় তারা। কাজেই এদের।
শক্তিকে খাটো করে দেখা চলে না।
প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব দুটো বাতিল করে দিলেও, সি.আই.এ.. কিন্তু হাল ছাড়ে না। নাসা আর পেন্টাগনের সাথে পরামর্শ করে। নেসতর কোইভিসতুর কাছে একটা প্রস্তাব পাঠায় তারা। উত্তরে কোইভিসতু জানায় সে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আমেরিকায় পৌঁছুলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এয়ারকিং-এর উইপনস সিস্টেমের ডিজাইন তার তৈরি, সিস্টেমটার উন্নতিও তার হাতে হয়েছে, কিন্তু বিমানের আর সব অংশ নিয়ে কাজ করছে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা, সেখানে তার নাক গলাবার কোন উপায় নেই। মিকোয়ান প্রজেক্টে সিকিউরিটি অত্যন্ত কড়া, তার ওপর ইহুদি বিজ্ঞানীদের, সামান্য হলেও, কিছুটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখা হয়। বিমানের সমস্ত গোপন তথ্য হাত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আমেরিকা তাকে নিরাপদে রাশিয়া থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারলেও এয়ারকিং-এর মার্কিন সংস্করণ তৈরির কাজে তেমন কোন সাহায্য সে করতে পারবে না।
এই উত্তরের সাথেই পাল্টা একটা প্রস্তাব পাঠায় কোইভিসতু। তাতে বলা হয়, সি.আই.এ-র সহায়তায় জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স যদি রাশিয়ার একটা এয়ারকিং চুরি করতে চায়, বিলিয়ারস্কের ইহুদি বিজ্ঞানীরা তাহলে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য করবে।
প্রস্তাবটা লুফে নেয় সি.আই.এ. চীফ রবার্ট মরগ্যান। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর আইজ্যাক ময়নিহানের সাথে গোপন বৈঠকে বসে সে। দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, অপারেশনটা ইসরায়েলের নামে পরিচালিত হবে। সি.আই.এ. তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সাহায্য করবে বটে, কিন্তু গোপনে। শেষ পর্যন্ত যখন সব জানাজানি হয়ে যাবে, এর সাথে যে সি.আই.এ. জড়িত ছিল, সেটা প্রকাশ পাওয়া চলবে না। চুরি করা এয়ারকিং ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হবে, কাজেই পাইলটকে হতে হবে একজন ইসরায়েলি ইহুদি। সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টার ল্যাংলি, ভার্জিনিয়াতে ট্রেনিং দেয়া হবে তাকে। রিফুয়েলিং পয়েন্ট কোথায় হবে, নির্ধারণ করার দায়িত্ব সি.আই. এ-র। রিফুয়েলিং পয়েন্ট খুঁজে পাবার জন্যে পাইলটের কাছে কোন এক ধরনের হোমিং ডিভাইস থাকতে হবে, রাশিয়ানরা দেখেও সেটার অস্তিত্ব যেন টের না পায়। চুরি করা এয়ারকিং তেল আবিবেই থেকে যাবে, তবে যখন বা যতক্ষণ খুশি সেটা মার্কিন বিজ্ঞানীদের দেখতে। দিতে বাধ্য থাকবে ইসরায়েল। এয়ারকিং-এর মার্কিন সংস্করণ তৈরি হলে এক স্কোয়াড্রন বিমান উপহার হিসেবে চাইবে ইসরায়েল, সি.আই.এ. ইসরায়েলের এই দাবি সমর্থন করবে। মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজ শেষ হতে দুবছর বাকি, কাজেই সময় নষ্ট না করে একটা প্ল্যান তৈরি করে ফেলা দরকার। ইসরায়েল পাইলট নির্বাচন করে পাঠালেই তাকে ট্রেনিং দেয়ার কাজ শুরু। করা হবে।
দুই ইন্টেলিজেন্স চীফের মধ্যে এই সমঝোতা হওয়ার পর। প্রায় দুবছর পেরিয়ে গেছে। ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভ-এর। ট্রেনিং শেষ, সিগন্যাল পাওয়ার অপেক্ষায় লন্ডনে রয়েছে সে। মিকোয়ান প্রজেক্টের কাজও প্রায় শেষ, তিন-চার মাসের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে উড়বে এয়ারকিং। সে-অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি। এই অনুষ্ঠানের মাত্র দুচার দিন আগে সিগন্যাল দেয়া হবে পিটি ডাভকে। সিগন্যাল পেয়ে লন্ডন থেকে মস্কোর পথে রওন হয়ে যাবে সে।
কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট/পার্ট থ্রী (ডিটেলস্)।
বি.সি.আই-এর কর্তব্য।
কেনেথ রবসন একজন ডাবল এজেন্ট, তার সাথে রানা ইনভেস্টিগেশনের যোগাযোগ বহুদিনের। ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভ সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টারে ট্রেনিং নিচ্ছে, এই তথ্য মাসুদ রানার কাছে মাত্র পাঁচশো ডলারে বিক্রি করে সে। দুদিন পর নিউ ইয়র্কের একটা পাব-এ অজ্ঞাতনামা একজন আততায়ীর গুলিতে রবসন মারা যায়। রবসন মারা যাওয়াতেই তার দেয়া তথ্যটা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। তদন্ত শুরু করে রানা। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাপ। সি.আই.এ. আর জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যানের অনেকটাই জেনে ফেলে ও।
বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করে রানা, সেই সাথে নুমার ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটনকেও ব্যাপারটা জানায়। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তিনি, একটা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর চীফও বটেন। এই এজেন্সীর অস্তিত্ব। সম্পর্কে সি.আই.এ, এফ.বি.আই. সহ অনেক প্রতিষ্ঠানই ধরতে গেলে কিছুই জানে না, জর্জ হ্যামিলটন একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি তার কাজের রিপোর্ট দেন। এদিকে আবার, বি.সি.আই. চীফ মেজর জেনারেল রাহাত খানের সাথেও তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রয়েছে। রানাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন ভদ্রলোক, ঠেকায়-বেঠেকায় সাহায্য নেন এবং করেন। মার্কিন প্রশাসনে অল্প যে দুএকজন ইসরায়েল-বিরোধী ব্যক্তি আছেন, তিনি তাদের অন্যতম।
রানার কাছ থেকে ব্যাপারটা জানার পর প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দেন তিনি। তার ধারণা, প্রেসিডেন্টকে গোপন করে। সি.আই.এ. এ-ধরনের কোন প্ল্যান করতে পারে না। কিন্তু রানা সিরিয়াস বুঝতে পেরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
দিন পনেরো পর ওয়াশিংটনে আবার তার সাথে দেখা করে রানা। প্রথমদিকে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। অ্যাডমিরাল। কিন্তু রানা নাছোড়বান্দা বুঝতে পেরে স্বীকার করেন, হ্যাঁ, সি.আই.এ. আর জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের গোপন প্ল্যান সম্পর্কে বিস্তারিত সবই জানতে পেরেছেন তিনি। মিকোয়ান প্রজেক্ট সম্পর্কেও সব কথা তার মুখ থেকে শোনে রানা। কিন্তু সবশেষে অ্যাডমিরাল জানান, ওরা দুপক্ষই সাংঘাতিক সতর্ক, এর সাথে যে সি.আই.এ. জড়িত সেটা প্রমাণ করা এক কথায় অসম্ভব। আর প্রমাণ ছাড়া সি.আই.এ-র বিরুদ্ধে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে পারেন না।
অথচ রাশিয়াকে সাবধান করা দরকার।
অ্যাডমিরাল জানিয়ে দিলেন, সে দায়িত্বও তিনি নিতে পারেন না। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ইচ্ছে করলে কে.জি.বি-র। সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কে.জি.বি-ই বা বি.সি.আই-এর কথা। বিশ্বাস করবে কেন?
প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলল। ইসরায়েলি পাইলটের নাম-ধাম, চেহারা, তার ট্রেনিং, টাইম শিডিউল ইত্যাদি নিশ্চই কোন ফাইলে লেখা আছে। সেই ফাইলটা বি. সি. আই-এর দরকার।
ওয়াশিংটন গিয়ে জর্জ হ্যামিলটনের সাথে দেখা করলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। তিন দিন আলোচনার পর অ্যাডমিরাল বি.সি.আই-কে সাহায্য করতে রাজি হলেন। বললেন, তিনি চান ইসরায়েলের এই অপারেশন ব্যর্থ হোক, কিন্তু। সি.আই.এ-র বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি গোপনে বি.সি.আই-কে সাহায্য করবেন-তবে প্রেসিডেন্টের। কাছে ব্যাপারটা গোপন রাখবেন না। সি.আই.এ. যে এর সাথে জড়িত, সেটা প্রেসিডেন্টকে জানানো হবে না। শুধু জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কথা বলা হবে।
এ-সবের আগে বি.সি.আই. হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ পেয়ে। ইউরোপে এসে কে.জি.বি-র একজন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্টের সাথে দেখা করল রানা। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর সি.আই.এ-র। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সব কথা খুলে বলা হলো তাকে। রানা অনুরোধ। করল, ব্যাপারটা এখুনি তুমি তোমার হেডকোয়ার্টারকে জানাও। কিন্তু কে.জি.বি. এজেন্ট হেসেই অস্থির। তার ধারণা রাশিয়া থেকে মিগ-৩১ চুরি করে আনা দুনিয়ার কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এ-ধরনের একটা ভুয়া তথ্য নিয়ে তার কাছে আসার জন্যে রানাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেও ছাড়ল না সে।
এরপর মেজর জেনারেল রাহাত খান নিজেই রাশিয়াকে সাবধান করার দায়িত্ব নিলেন। অনেক চেষ্টা-তদবির করার পর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হলো। রুমানিয়ার রাজধানীতে দুই ইন্টেলিজেন্স চীফ মুখোমুখি বসলেন। আগাগোড়া সব ব্যাখ্যা করে বললেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। শুধু জর্জ হ্যামিলটনকে বাদ রাখলেন প্রসঙ্গ থেকে।
গভীর মনোযোগের সাথে সব শুনলেন কে.জি.বি. চীফ উলরিখ বিয়েগলেভ। রাহাত খান যতক্ষণ কথা বললেন, এক চুল নড়লেন না পর্যন্ত। রাহাত খান থামার পরও অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ভদ্রলোক। মনে হলো, কার ওপর যেন রাগ হয়েছে তার। তারপর, ধীরে ধীরে তার চেহারা থেকে রাগের ভাব দূর হয়ে গেল। রাহাত খানকে তিনি হাভানা চুরুট অফার করলেন। ধন্যবাদ বলে পাইপ ধরালেন রাহাত খান। প্রতিক্রিয়ার জন্যে অপেক্ষা করছেন তিনি।
চুরুট ধরালেন কে.জি.বি. চীফ। তারপর রাহাত খানের ব্যক্তিগত কুশলাদি জানতে চাইলেন। বৈঠক এরপরও পনেরো মিনিট চলল বটে, কিন্তু প্রসঙ্গে আর ফিরে এলেন না উলরিখ বিয়েগলেভ। অপমানিত বোধ করলেন রাহাত খান। হোটেল থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে এলেন। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে প্লেন আধঘণ্টা লেট হবে শুনে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন। তিনি। পনেরো মিনিট পর একজন মেসেঞ্জার এল, রাহাত খানের হাতে একটা এনভেলাপ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল সে। এনভেলাপের ভেতর থেকে কে.জি.বি. চীফের নিজের হাতে লেখা একটা চিরকুট বেরুল-সংশ্লিষ্ট সবার জন্যে চ্যালেঞ্জ রইল, মিকোয়ান প্রজেক্টে একটা পিঁপড়েও ঢুকতে পারবে না। গোটা প্রজেক্ট দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ইন্টেলিজেন্স কে.জি.বি. পাহারা দিচ্ছে, আমাদের চোখ ফাঁকি দেয়া খোদ শয়তানের পক্ষেও সম্ভব নয়। সিংহকে ইঁদুরের ভয় দেখানো, হাস্যকর নয় কি?
এতকিছুর পরও আবার বাংলাদেশ মন্ত্রী পর্যায়ে সোভিয়েত প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু এবারও কোন লাভ হয়। না। বাংলাদেশকে জানিয়ে দেয়া হয়, বি.সি.আই. যে তথ্য দিতে। চাইছে সেটা ভুয়া। তাছাড়া, রাশিয়ায় ঢুকে মিগ-৩১ চুরি করা, এ শুধু বদ্ধ পাগলই চিন্তা করতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
উপকার করতে চাইছে, বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত পেল। বি.সি.আই.।
ইতোমধ্যে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স হেডকোয়ার্টার থেকে সেই গুরুত্বপূর্ণ ফাইলের ফটো কপি বের করা গেছে। ওদের প্ল্যান। সম্পর্কে বিস্তারিত সবই এখন জানে বি.সি.আই.। ব্যাপারটা কাকতালীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু ইসরায়েলি পাইলট পিটি ডাভের বয়স, গায়ের রঙ, চুলের ধরন, চোখের রঙ, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি হুবহু। প্রায় মাসুদ রানার মত। এই মিল আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারে। বিষয়টা নিয়ে জর্জ হ্যামিলটনের সাথে বিস্তারিত আলাপ করেছে রানা।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা।
ইসরায়েল এক অশুভ শক্তি। এই রাষ্ট্রের হাতে এয়ারকিং থাকলে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো ভয়ঙ্করভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। যা-খুশি তাই করবে তখন ইসরায়েল, টু শব্দটি করার সাধ্য থাকবে না কারও।
কে.জি.বি-র গোয়ার্তুমি অসহ্য। ওরা ভাবছে ওদের বিরুদ্ধে। ষড়যন্ত্র সম্ভব, এটা স্বীকার করলেও ওদের মান যাবে। কারও কোন কথায় কান দিতে তারা নারাজ।
কেউ চ্যালেঞ্জ করলে সেটা গ্রহণ করা অন্যায় নয়। কে.জি.বি-র চ্যালেঞ্জ ইচ্ছে করলে বি.সি.আই. গ্রহণ করতে পারে।
পিটি ডাভের জায়গায় রানাকে বিলিয়ারস্ক-এ পাঠানো সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু মিগ চালাবার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে রানার।
জর্জ হ্যামিলটন কথা দিয়েছেন, ওর ট্রেনিঙের ব্যবস্থা করা তেমন কঠিন হবে না।
সিদ্ধান্ত।
এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, কাজেই ফাইলে এব্যাপারে কিছু লেখাও হয়নি।
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন রাহাত খান। কপালের পাশে রগটা আবার একবার লাফিয়ে উঠল। চোখ বুজে ধ্যানমগ্ন হলেন তিনি। এবার নিয়ে পর পর তিনবার গোটা ফাইলটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছেন, কিন্তু তবু মনস্থির করতে পারছেন না।
তিন মিনিট পর চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন রাহাত খান, নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে কার্পেটের ওপর পায়চারি শুরু করলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, তার জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স আর
সি.আই. এ-র অপারেশন ব্যর্থ করে দিতে হবে। কিভাবে ব্যর্থ করা সম্ভব, তা-ও তিনি জানেন। দ্বিধায় ভুগছেন সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা কারণে।
কারণটা হলো মাসুদ রানা।
ওকে তিনি ভালবাসেন বললেও সবটা বলা হয় না। হে করেন বললেও কোথায় যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর নিজের সন্তান নেই, বোধহয় সেজন্যেই মাঝেমধ্যে এই প্রশ্নটা নিজেকে করেন তিনি, আমার সন্তান থাকলে আমি কি তাকে রানার চেয়ে বেশি ভালবাসতাম?
কিন্তু রানাকে তিনি যতটা ভালবাসেন তারচেয়ে বেশি। ভালবাসা কোথায় ধরে, তার জানা নেই।
ওকে কি তিনি ভুল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? যে দায়িত্ব সি.আই.এ-র মত একটা প্রতিষ্ঠানকে দিতে সাহস পাননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট, সেই দায়িত্ব একা রানার ওপর চাপিয়ে দেয়া কি ওকে খুন করারই নামান্তর নয়?
আজ তিন দিন ধরে এই দ্বিধায় ভুগছেন রাহাত খান। ফলে সিদ্ধান্ত লিখতে দেরি হচ্ছে।
বি.সি.আই-এ আরও অনেক এজেন্ট রয়েছে, তাদের অনেকেই রানার চেয়ে কম যোগ্য নয়। কিন্তু বাঘের খাঁচায় কাউকে পাঠাতে হলে রানার কথাই মনে পড়ে সবার আগে। কঠিন কাজ? তাহলে রানাকে ডাকো, ও-ই পারবে। এটা স্রেফ একটা অনুভূতি, আর কিছু নয়। নাকি আরও কিছু?
এই অনুভূতি তার মনের শক্তি আর সাহস শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে হাতে এমন এক-আধটা কাজ আসে যখন এই অতিরিক্ত শক্তি আর সাহস তাঁর দরকার হয়ে পড়ে।
এবারকার কাজটা সেরকম। কাজেই, পাঠালে মাসুদ। রানাকেই।
দ্বিধা? পায়চারি থামিয়ে আপনমনে হাসলেন মেজর জেনারেল। দ্বিধা কেন! পিটি ডাভ তার কাজে সফল হবে এব্যাপারে শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত হয়েছেন তিনি। সেই ভয়েই তো তিনি জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সকে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পিটি ডাভকে সি.আই.এ-ও সাহায্য করছে। এখন যদি ডাভের জায়গায় রানা যায়, আর কেউ যদি সেটা টের না পায়, কেন রানা ব্যর্থ হবে?
সন্দেহ নেই রানাকে তিনি বাঘের খাঁচায় পাঠাচ্ছেন, কিন্তু বাঘের চোখে ধুলো দেয়ার ব্যবস্থাও তো করাই আছে।
রিভলভিং চেয়ারে এসে বসলেন রাহাত খান। খোলা ফাইলটা টেনে নিলেন সামনে। তুলে নিলেন কলম। সিদ্ধান্ত-এর নিচে লিখলেন
পিটি ডাভের জায়গায় মাসুদ রানা। একই অ্যাসাইনমেন্ট। মিগট্রেনিং নেয়ার জন্যে কালই ভার্জিনিয়ার পথে রওনা হোক ও।
<