মায়ানমারে আজ রানার তৃতীয় দিন।
স্টেশনের পরিবেশ গ্রামীণ হাটের চেয়েও খারাপ। ট্রেন এসে পেঁৗছানোর আগেই নরক গুলজার হয়ে উঠল। সারং আর লুঙ্গি পরা। মানুষ গিজগিজ করছে প্ল্যাটফর্মে। পুলিশের তাড়া খেয়ে তাদের ভিতর দিয়ে ছুটোছুটি করছে হকাররা।
ভিড় ঠেলে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে রানা, জানে নন্দিনীর হাত ছেড়ে দিলে তাকে আর খুঁজে বের করা যাবে না।
ভুল হয়ে গেছে! রানার কানের কাছে মুখ তুলে চেঁচাল মেয়েটা। প্লেনে করে যাওয়া উচিত ছিল।
এখন আর বলে লাভ কী। তা ছাড়া, মায়ানমারের গ্রাম্য। পরিবেশ আর বনভূমি দেখতে হলে ট্রেনে তোমাকে চড়তেই হবে। ঠিক?
নন্দিনী মাথা ঝাঁকালেও, চেহারা থেকে বিরক্তির ছাপটুকু দূর হলো না।
ট্রেনে একটাই পুলম্যান কার আছে, রানার মত নন্দিনীও ওই। কারের একটা স্লিপার বুক করেছে।
আরও একটা স্পেশাল কার আছে ট্রেনে, আর্মি অফিসারদের জন্য রিজার্ভড।
নন্দিনীকে তার কমপার্টমেন্টে তুলে দিয়ে জনারণ্যে ফিরে এল রানা, আগেই তাকে বলে রেখেছে কিছু ফল কিনতে হবে। তবে নারকেল বা আপেল নয়, এই মুহূর্তে শুধু কার্গোর কথা ভাবছে ও।
ট্রেনের পাশ ঘেষে, প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটছে রানা। ব্যাগেজ কারটাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে হাঁটার গতি কমাল, তারপর এক সময় দাঁড়িয়ে পড়ল।
হান সাম্রাজ্যের আর্টিফ্যাক্ট তোলা হচ্ছে ট্রেনে। কাজটা সুপারভাইজ করছেন চিনা দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাশে। কাছাকাছি পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে বার্মিজ সেনাবাহিনীর একটা সশস্ত্র ডিটাচমেন্ট। ওখান থেকে খানিকটা সরে এল রানা, চাইছে না কেউ ওকে দেখে ফেলুক-কে জানে, কালেকশানকে বিদায় জানাবার জন্য থাইগন লোবাং হয়তো স্টেশনে চলে এসেছেন। আর্টিফ্যাক্টের সঙ্গে একই ট্রেনে রানাকে উঠতে দেখলে ব্যাপারটাকে তিনি কাকতালীয় হিসাবে না-ও দেখতে পারেন।
দূরে দাঁড়িয়ে কার্গো লোড করার কাজটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রানা। চিনা বলতে একা শুধু কালচারাল অ্যাটাশেই উপস্থিত।
চার নম্বর লোকটা কি এরই মধ্যে ট্রেনে উঠে পড়েছে? নাকি চিনা আর্টিফ্যাক্ট সার্চ করা হয়ে গেছে তার, মাইক্রোফিল্ম নিয়ে এই মুহূর্তে নাগালের বাইরে কোন প্লেনে রয়েছে?
হয়তো সার্চ করেছে ঠিকই, কিন্তু মাইক্রোফিল্মটা পায়নি। অর্থাৎ রানাকে এখনও দরকার বলে ভাবছে সে।
এক ঝুড়ি তাজা ফল নিয়ে ট্রেনের সামনের দিকে ফিরে এল রানা।
এ তো আমরা সারা জীবন খেয়েও শেষ করতে পারব না। ঝুড়িটা দেখে হেসে ফেলল নন্দিনী।
সেক্ষেত্রে লোকজন ডেকে একটা পার্টির আয়োজন করব, এমন অভিনয় করছে রানা, যেন কোন কিছুই বিরক্ত করছে না ওকে, বিশেষ করে নন্দিনীর উপস্থিতি। জানে না ভালো করছে না খারাপ, তবে নন্দিনী কিছু খেয়াল করছে বলে মনে হলো না।
কী কারণে দেরি তার কোন ব্যাখ্যা নেই, অবশেষে বেলা প্রায় বারোটার দিকে ট্রেন ছাড়ল। অবশ্য দেরি হওয়াটা রানার জন্য কোন সমস্যা নয়, কারণ রাতের আগে সার্চ শুরু করার কোন ইচ্ছে নেই ওর। একটাই সম্ভাব্য সংকট দেখতে পাচ্ছে ও-আগামী কাল। খুব ভোরে ট্রেন ছেড়ে নেমে যাবার সময় হবে নন্দিনীর। তার ঘুমাবার সময়টায় রানাকে তল্লাশি চালাতে হবে। এটাকে এড়াবার স্রেফ কোন উপায় নেই।
বেশ কিছুক্ষণ প্রচুর কথা বলে সময়টা উপভোগ্য করে তুলল। নন্দিনী। তারচেয়ে এক বছরের বড় একটা ভাই আছে, শান্তি নিকেতনে পারফর্মিং আর্টসে মাস্টার্স করেছে, পরস্পরকে তুই। বলে ওরা-সেই ভাইই নন্দিনীর রক্তে একা একা ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা সংক্রমিত করেছে। তার পাল্লায় পড়ে গোটা ভারতবর্ষ দেখা শেষ করেছে সে। তবে শুধু যে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিল, তা নয়; তার প্রতিটি ভ্রমণই আসলে শিক্ষা সফর।
এক সময় সব কথা ফুরিয়ে গেল নন্দিনীর। রানা তাকে পেগান সম্পর্কে প্রশ্ন করলে হাই তুলতে শুরু করে ক্ষমা চাইল সে, বলল অল্প একটু ঘুমাবে। হাতঘড়ি দেখল রানা। ১:৫২। ওর। সামনে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, কেউ জানে না কীভাবে সেটার অবসান হবে। হয়তো হিসাব আর অনুমানে ভুল হয়ে গেছে, খালি হাতে ফিরতে হবে ওকে।
ট্রেনটাকে এক্সপ্রেস না বলে গরুর গাড়ি বললেই যেন বেশি মানাত। সারাটা বিকেল বারবার সামনের গ্রামগুলোয় থেমে প্যাসেঞ্জার তোলা হলো। তরুণী হকারদের ছুটোছুটি দেখে কে, কে কার আগে কমপার্টমেন্টের জানালায় পৌঁছাবে। তাদের পিঠে বাঁধা ঝুড়ি থেকে উপচে পড়ছে দুনিয়ার জিনিস-পত্ৰ-চুলের কাটা থেকে শুরু করে ঘরে তৈরি আচার, কী নেই।
আগের কেনা ফল পড়ে আছে, তা সত্ত্বেও আম সহ চেনাঅচেনা আরও কিছু ফল কিনল, শুধু যে কিনল তা নয়, চেখেও দেখল। নন্দিনী ওর দিকে এমনভাবে তাকাল, ও যেন পাগল হয়ে গেছে।
আসলে তা হয়নি রানা। ওর এই অদ্ভুত আচরণের পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। নন্দিনীর সঙ্গে রাত-শেষ রাতটা-না কাটানোর একটা গ্রহণযোগ্য অজুহাত দরকার হবে, সেই অজুহাত তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে ও। পেটে গোলমাল দেখা দিয়েছে বললে সে যাতে বিশ্বাস করে।
তবে সব কিছুরই একটা সীমা আছে। রানা যখন ঠিক করেছে। আর নয়, এই সময় এক বার্মিজ তরুণী টকটকে লাল একটা ফল ধরল ওর সামনে, দেখতে অনেকটা আতার মত, তবে আকারে আরও অনেক বড়। রানা মাথা নেড়ে বলল, খাবে না।
ইজ গুড, ইজ গুড, মেয়েটা নাছোড়বান্দা। প্রথমে ইংরেজিতে অনুরোধ করল, তারপর শুরু করল বার্মিজ ভাষায়। আহ্ লুঙ কাউং পা দা। ঠোঁট নেড়ে খাওয়ার ভঙ্গি নকল করে পেটে হাত চাপড়াল-আবেদনে নাটকীয়তা আনার জন্য।
কিন্তু রানা সিদ্ধান্ত বদলাতে রাজি নয়।
কী বলছে ও? জানতে চাইল নন্দিনী।
নন্দিনী বার্মিজ ভাষা জানে না দেখে বিস্মিত হলো রানা। অন্তত দুচারটে শব্দ না জানাটা কেমন দেখায়! স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাকে না পাঁচ হপ্তা পেগানে কাটাতে হবে? বলছে-ভেরি গুড, মেয়েটার কথা ভাষান্তর করে শোনাল ও।
ইয়েস-হাকি কেত, সায় দিল বার্মিজ তরুণী। ভে-দি গুড।
নাও, খেয়ে দেখো, হেসে উঠে বলল নন্দিনী।
মাথা নাড়ল রানা, তারপর তরুণীকে ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইল ওর পেটে জায়গা নেই।
অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল হকার মেয়েটি।
সামান্য একটু খেতে, বলল নন্দিনী। এত করে বলছিল যখন।
খাই, তারপর আরও অসুস্থ হই, না?
আরও অসুস্থ…তোমার শরীর খারাপ?
পেট খামচে ধরে কোটরের ভিতর চোখের তারা ঘোরাল রানা, যতক্ষণ না হি-হি করে হেসে উঠল নন্দিনী। শুধু শুনে রাখো, এরচেয়ে সুস্থ থাকার অভিজ্ঞতা আমার আছে, এর বেশি কিছু জানতে চেয়ো না।
ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে, নয়াউঙ্গলিবিন শহরে তিন ঘণ্টা দেরি করল ট্রেন। রানার ইচ্ছে ছিল প্ল্যাটফর্মে নেমে কার্গোর খোঁজ-খবর নেবে, অন্যান্য কমপার্টমেন্টে উঠে দেখবে। রহস্যময় চার নম্বরকে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়াল। পুলিশ আর কাস্টমস। স্টেশন থেকে যারা বেরুতে চায় তাদেরকে। সার্চ করা হচ্ছে, অন্যদের প্ল্যাটফর্মে নামতেই দেওয়া হচ্ছে না।
তবে খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে ব্যাগেজ কারটা দেখতে পেল রানা। প্ল্যাটফর্মে নেমে এসে পাঁচ-সাতজন মায়ানমার সৈনিক টহল দিচ্ছে ওটার সামনে, হাতে বাগিয়ে ধরা কারবাইন।
রানার ইচ্ছে ছিল রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করবে। ট্রেন জার্নি ক্লান্তিকর, নন্দিনী নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়তে দেরি করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল রাত এগারোটার দিকে স্লিপারে ওঠার জন্য রানার সাহায্য চাইছে সে।
নন্দিনীকে স্লিপারে তুলে দিয়ে পরদাটা টেনে দিল রানা, তারপর পিছু হটল। আলো জ্বলছে, ফলে পরদার গায়ে ছায়া পড়েছে নন্দিনীর-চাদরের নীচে আশ্রয় নেওয়ার আগে সে তার ব্লাউজ খুলল, তারপর স্কার্টের চেইন ধরে টান দেবার সময় স্থির হয়ে গেল হাত।
পরদা সরিয়ে তাকাল নন্দিনী। কিছু ঘটেছে, সম্ভব? জানতে চাইল সে, চোখে একাধারে বিস্ময় আর উদ্বেগ।
বলো কী ঘটেনি।
মানে?
আমার সত্যি অসুস্থ লাগছে। আজ রাতে আমি বোধহয় কারও কোন কাজে লাগব না, নন্দিনী। দুঃখিত, ভাই। বিষন্ন সুরে দুঃসংবাদটা দিয়ে হঠাৎ এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরল রানা, আরেক হাতে স্লাইডিং ডোর-এর নব হাতড়াচ্ছে। বমি আটকাবার চেষ্টা চলছে, বিড় বিড় করে বলল, কথা বলতে পারছি না, কথা বলতে পারছি না!
ইস, তখনই মনে হয়েছে এতসব অচেনা ফল খাওয়া কি উচিত হচ্ছে! এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দিল নন্দিনী। বেচারিকে নিয়ে এখন আমি কী করি!
সেন্ট্রাল আইল ধরে ছুটল বেচারি, বাথরুমের দিকে যাচ্ছে।
এরকম কয়েকবারই ছুটতে হলো রানাকে, অর্থাৎ অভিনয় করে নন্দিনীকে দেখাতে হলো যে ওর অবস্থা সত্যি করুণ। এক সময় পরদা টেনে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুমিয়ে পড়ল অন্যান্য। আরোহীরাও। আরেকবার কমপার্টমেন্ট থেকে বেরুবার জন্য দরজা খুলল রানা।
ওর রোলেক্সে সময় এখন রাত ১২:১৭। নিজের পিছনে। দরজাটা বন্ধ করে সেন্ট্রাল আইল ধরে এগোল ও, পুলম্যান থেকে পাশের কারে যাচ্ছে।
প্রতিটি কমপার্টমেন্টেই ঘুমে ঢুলছে আরোহীরা। কিছু তরুণকে দেখা গেল এক কোণে তাস নিয়ে বসেছে। আইল ধরে রানাকে। হাঁটতে দেখে খেলা ছেড়ে তাকিয়ে থাকল তারা-কৌতূহলী, তবে চুপচাপ। বন্ধুসুলভ অমায়িক হাসি উপহার দিল রানা।
একে একে পাঁচটা কমপার্টমেন্টকে পাশ কাটিয়ে এল রানা। কেউ ওর পিছু নেয়নি-না মিস্টার এক্স, না ওয়াই বা জেড।
আরও তিনটে কারকে পিছনে ফেলার পর সামনে পড়ল ব্যাগেজ কমপার্টমেন্ট। বড় করে শ্বাস টেনে বুকটা ভরে নিল রানা, তারপর হাতল ধরে টান দিল। ভারী ধাতব দরজা গুঙিয়ে উঠে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাচ্ছন্ন তিনটে মুখ উঁচু হলো, কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।
নো অ্যালাওয়িং, সৈনিকদের একজন বলল, হাত ইশারায় পিছাতে বলছে-এমনকী ভিতরে পা রেখে রানা নিজের পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখেও।
হোয়াট? ইংরেজি বলছে রানা।
তিন সৈনিকই যান্ত্রিক পুতুলের মত একযোগে দাঁড়িয়ে পড়ল। নো অ্যালাওয়িং, দ্বিতীয় গার্ড বলল।
সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল তৃতীয় গার্ড। নট…পারমিটেড, বলল। সে, শব্দটা পেট থেকে বের করতে যেন হিমশিম খেয়ে গেল।
তাদের পিছনে স্তুপ করা বাক্সগুলো দেখতে পাচ্ছে রানা, গায়ে চিনা হরফে লেখা হান সাম্রাজ্যের আর্টিফ্যাক্ট।
সামনে এগোল একজন সৈনিক, পিঠের ঝুলন্ত কারবাইন আঁকি খাচ্ছে। বার্মিজ ভাষায় কথা বলল রানা। সঙ্গে সঙ্গে অনুকূল প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। একজনকে দাঁত বের করে হাসতেও দেখল ও।
সবাই ঘুমাচ্ছে, বলল রানা, ইঙ্গিতে নিজের পিছন দিকটা দেখাল, যেন গোটা ট্রেনের সমস্ত আরোহীর কথা বলতে চাইছে। তাই ভাবলাম দেখি কাউকে সিগারেট খাইয়ে প্রাচীন বার্মার কিছু গল্প শোনা যায় কিনা। জ্যাকেটের পকেট থেকে সোনালি সিগারেট কেসটা বের করল। চলবে?
ধন্যবাদ, একের পর এক এগিয়ে এসে জবাব দিল, রানার বাড়ানো হাতের প্যাকেট থেকে বের করে নিল একটা করে ফাইভ ফিফটি-ফাইভ।
লাইটারটাও তৈরি রেখেছিল রানা, সেটার কাঁপা কাঁপা শিখার আলোয় সৈনিকদের মুখগুলো কচি আর নিস্পাপ দেখাচ্ছে।
ওদের পিছনে নিঃসঙ্গ একটা সেফটি ল্যাম্প নরম আলো ছড়াচ্ছে। নিজের সিগারেটটা ধরিয়ে মেঝেতে প্রথমে উবু হলো রানা, তারপর যেন আরও আরাম পাবার জন্য পায়ের উল্টে করা পাতার উপর নিতম্ব দিয়ে বসল; অপেক্ষা করছে সৈনিকরাও কখন ওকে অনুকরণ করে। ধীরে ধীরে নিচু হলো তারা, মন্তব্য করছে-দামী সিগারেটের স্বাদই আলাদা।
আমি একজন রিপোর্টার, শ্রীলঙ্কার একটা দৈনিক পত্রিকায়। লেখালেখি করি।
লেখক? হাই তুলে জানতে চাইল একজন সৈনিক, ঘুম পাচ্ছে তার।
হ্যাঁ। চাইনিজ প্রদর্শনীর ওপর একটা ফিচার লিখছিলাম, ইঙ্গিতে ওদের পিছনের কাঠের বাক্সগুলো দেখাল রানা, যেগুলোর একটার ভিতর তো ওয়ানের জেড সুট আছে।
আপনি মায়ানমারে থাকেন, ইয়াঙ্গুনে? আরেকজন সৈনিক জানতে চাইল, ইংরেজি জানে বলে রীতিমত গর্বিত দেখাচ্ছে তাকে।
মাথা ঝাঁকাল রানা। দা ইরাবতী প্লাস ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। আমার নাম সিংঘেরানা সিংঘে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়াল রানা, কিন্তু তিনজনই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। অন্তত ঘণ্টখানেকের আগে জাগবে না।
জ্যাকেটের পকেট থেকে তুলো আর নাইলন কর্ড বের করল। রানা। সৈনিকদের মুখে তুলো গুঁজে দিয়ে পিছমোড়া করে হাত বাঁধল। তারপর পাগুলো এক করে বাঁধল। অজ্ঞান শরীরগুলো। টেনে সরিয়ে রাখল একপাশে।
কাজ শুরু করল রানা রোলেক্সে চোখ রেখে-১২:৫১। বাক্সের গায়ে লেখাই আছে তো ওয়ানের ডেথ সুট, কাজেই খুঁজে বের করতে কোন সমস্যা হলো না। আকার-আকৃতিতে কফিনের মত, ব্যাগেজ কারের একেবারে পিছন দিকে পাওয়া গেল সেটাকে। কয়েকটা বাক্স সরিয়ে ওখানে পৌছাল রানা। জ্যাকেটের পকেট থেকে এক সেট মিনিয়েচার টুলস বের করল।
বাক্সের ঢাকনিটা খুলে একপাশে নামাতে প্রচুর সময় লাগল। কাঁচের ভিতর দিয়ে নীল-সবুজ জেডের দিকে মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রানা। তারপর দেখল নকশা করা সোনার তার দিয়ে তৈরি রেখাগুলো পরস্পরের উপর দিয়ে কত বিচিত্র ভঙ্গিতে আসা-যাওয়া করেছে, যাবার পথে জড়িয়ে নিয়েছে হাজার হাজার আলাদা পাথরকে।
কার্গো কমপার্টমেন্টের ওপাশেই রয়েছে আর্মির লোকজন ভর্তি একটা কোচ। তাদের কেউ, হয়তো কমান্ডারই, ব্যাগেজ কারে ঢুকতে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখবে সে। তারপর কী ঘটবে সেটা নির্ভর করে রানার ভাগ্যের উপর।
কাচের ঢাকনিটা খুলতে দশ মিনিট সময় লাগল। ইতিমধ্যে বদ্ধ জায়গার ভিতর উত্তেজনায় ঘেমে নেয়ে উঠেছে রানা। কেসের ভিতর হাত গলিয়ে সুটটা নয়, মেরুন রঙের ফেল্টটা ধরল রানা, যেটার গায়ে শোয়ানো রয়েছে ওটা। ডেথ সুটের চারধারে আর কাঠের বাক্সের পাশে বা কিনারায় ফালি করে কাটা কাপড় খুঁজে রাখা হয়েছে, বহন করার সময় আমার যাতে ঝনঝন শব্দ না করে। ছোট পকেট নাইফের সাহায্যে কাপড়গুলো কেটে ফেল্ট লাইনার ছাড়িয়ে আনল ও। কাপড়ের কাভার পুরোপুরি সরাবার জন্য সুটটাকে এক পাশে কাত করতে হলো ওকে।
কিন্তু বাক্সটার পুরো সারফেস উন্মুক্ত করার পরও মাইক্রোফিল্মটা কোথাও পাওয়া গেল না।
কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে থাকল রানা। হাত-পা বাঁধা, অজ্ঞান সৈনিকদের দিকে তাকাল একবার। নিজেকে বলছে-এখানেই কোথাও আছে জিনিসটা, না থেকে পারে না। মাথা ঘামাও, রানা! চিন্তা করো, কোথায় লুকিয়ে রাখা হতে পারে।
জিনিসটা ফেল্টের নীচে নেই।
সুটের নীচেও নেই।
অর্ধচন্দ্র আর চাকতিটা আগেই পরীক্ষা করেছে ও, ওগুলোতেও নেই।
তা হলে আর কোথায়?
ফিউনারারি আর্মার-এর মাথাটা উঁচু করল রানা, আরেক হাতে। ধরল তো ওয়ানের বালিশটা। গিল্ড করা, জেড বসানো ব্রোঞ্জের হেডরেস্টটা আশ্চর্য রকম হালকা। নিরেট এক টুকরো ব্রোঞ্জ যথেষ্ট ভারী হওয়ার কথা। কিন্তু অলঙ্কৃত মেটাল হেডরেস্ট মোটেও ভারী নয়।
জিনিসটা ফাঁপা, বুঝতে পারল রানা।
আর্টিফ্যাক্টটার সারফেসে আঙুল বুলিয়ে আলগা কোন পাথর খুঁজছে রানা, হয়তো মেকানিক্যাল ডিভাইস হিসাবে কাজ করে, যার সাহায্যে জিনিসটার ভিতরের অংশ খোলা যায়।
ফাঁপা একটা হেডরেস্টের অর্থ, চৌ মিন বা বেইজিং মিউজিয়ামে দায়িত্ব পালনরত তার কোন বিশ্বস্ত সহকারী আসল। ব্রোঞ্জ বালিশটা সরিয়ে সেটার জায়গায় হুবহু একই রকম দেখতে একটা ইমিটেশন রেখেছিল।
কাঠের বাক্সের গায়ে ওটা ঠুকল রানা। বালিশের একটা কোণ ভেঙে গেল। জিনিসটা ব্রোঞ্জ নয়। এমন কী এটাতে জেডও ব্যবহার করা হয়নি। স্রেফ প্লাস্টার অভ প্যারিস, কৌশলে পেইন্ট করা হয়েছে।
আরেকবার ঠুকল রানা। এবার একটু জোরে। প্লাস্টার হেডরেস্ট একেবারে মাঝখান থেকে দুভাগ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে। দেখতে পেল রানা-রাইস পেপারে মোড়া একটা প্যাকেজ। জানা। কথা এটাই খুঁজছে ও। মোড়কের ভিতর কালো নকশার মাইক্রোফিল্ম আছে।
মিস্টার এক্স-এর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে রানা-এই মুহূর্তে যেখানেই সে থাকুক না কেন।
মোড়ক ছিড়ে মাইক্রোফিল্মের খুদে রোলটা বের করল রানা। ক্রু খুলে রোলেক্সের পিছনটা সরাল, রোলটা লুকিয়ে রাখল ঘড়ির ভিতর।
১:২১। তবে এখানকার কাজ এখনও শেষ হয়নি রানার।
এতক্ষণ যা করেছে, এবার তা উল্টো ভাবে শুরু করল রানা। প্রথমে ফেল্ট ব্যাকিং জায়গা মত বিছাল, তার উপর আমারটা রাখল। ঘেঁড়া কাপড়গুলো জোড়া লাগিয়ে চারদিকে গুঁজে দিল, কেসের ভিতর যাতে বেরিয়াল সুট নড়াচড়া না করে। ভারী কাচের ঢাকনিটা জায়গা মত বসাল। সবশেষে পেরেক মেরে আটকাতে হলো কাঠের ঢাকনি।
১:৩৫। হিসাবে যদি ভুল না হয় রানার, আগামী পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে থাজিতে থামছে না ট্রেন।
সবশেষে আরেকটা কাজ করল রানা। সঙ্গে অতিরিক্ত একটা পাসপোর্ট আছে, অন্য লোকের ফটো আর পরিচয়ে-সেটা একজোড়া বাক্সের মাঝখানে ফেলে রাখল।
অবশেষে বোল্ট সরিয়ে ভারী মেটাল ডোরটা একপাশে সরাল রানা। সামনে বিস্ফারিত একজোড়া চোখ দেখতে পেল ও। চোখ দুটো ওর পিছনের দৃশ্য দেখে ফেলেছে-হাত-পা বাঁধা তিনজন সৈনিক ব্যাগেজ কারের মেঝেতে পড়ে রয়েছে।
নিজের পিছনে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল রানা। তারপর হাত বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেলল-ছুটে পালিয়ে যাবার আগেই।
নন্দিনী অপরূপা এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, সে যেন একটা ভূত দেখতে পেয়েছে।
<