পুলিশকে জানানো দরকার, কিশোর বললো চিন্তিত ভঙ্গিতে। আলোচনা করে দুজনেই একমত হলো। মুসা ঘুমিয়ে পড়েছে, সে এসবের কিছু জানলো না।

হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, রাতে এখন রাস্তায় বেরোনো উচিত হবে কিনা। প্রশ্নটা অবাক করলো লোকটাকে। যেন বুঝতে পারছে না, রাতের বেলা আর দিনের বেলা রাস্তায় বেরোনোর কি তফাৎ থাকতে পারে। চোর-ডাকাতের ভয় আছে কিনা, একথা কিশোর বুঝিয়ে বললে ম্যানেজার। জবাব দিলো, অকজাকার পুলিশ খুবই সতর্ক। এখানে কোনো রকম অঘটন ঘটে না।

তাই নাকি? না বলে পারলো না রবিন। এই তো খানিক আগেই আমার বন্ধুকে পিটিয়ে বেহুশ করে দিলো কয়েকটা ডাকাত। ঘটে না মানে?

আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে ম্যানেজার বললো, তাহলে ওরা বাইরের লোক। এখানকার লোক খারাপ না।

এই লোকের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা, বুঝতে পেরে, থানাটা কোথায় জেনে নিয়ে রবিনকে সহ বেরিয়ে এলো কিশোর। তখন ডিউটিতে রয়েছেন ক্যাপ্টেন ডগলাস। মনটি অ্যালবানে যা যা ঘটেছে খুলে বললো তাকে দুজনে।

ভ্রূকুটি করলেন অফিসার। তাই! এখানে অপরাধ খুব কমই ঘটে! আশ্চর্য! কাগজটা এনেছো?

বের করে দিলো রবিন। পড়তে পড়তে ভাঁজ পড়লো ডগলাসের কপালে। মুখ তুলে বললেন, হুঁ, বুঝতে পারছি। একদল তরুণ আছে এই এলাকায়, বেশি দেশপ্রেমিক। তাদের উদ্দেশ্যটা ভালোই, তবে মাঝেসাঝে বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলে দেশপ্রেম দেখাতে গিয়ে। আইন বিরোধী কাজ করে বসে।

ওরা কি করে, জানতে চাইলো কিশোর।

ক্যাপ্টেন জানালেন, বাইরে থেকে কেউ এলেই তাদের পেছনে লাগে। তাদের ধারণা, যে-ই আসুক, মেকসিকো থেকে প্রাচীন নিদর্শন সব বের করে নিয়ে যাবে। ঠেকানোর জন্যে উঠে পড়ে লাগে ওরা। বাইরের কেউ কিছু আবিষ্কার করলে কেড়ে নিয়ে গিয়ে মিউজিয়ামে জমা দেয়, হাসলেন তিনি। অকজাকার স্টেট মিউজিয়াম সাংঘাতিক। দেখলে বুঝবে। অনেক অমূল্য সংগ্রহ রয়েছে ওখানে।

বাইরে থেকে কেউ এলেই যে তারা চোর হবে, প্রতিবাদের সুরে বললো রবিন। তা ঠিক নয়।

আমরা সেটা বুঝি, ক্যাপ্টেন বললেন। কিন্তু ওই মাথা গরম ছেলেগুলোকে বোঝানো শক্ত। ফ্যানাটিক।

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো কিশোর, তথ্য বের করে নিতে চাইলে ডগলাসের কাছ থেকে, দুজন লোককে খুঁজতে এসেছি আমরা। ঠিক বেড়াতে আসিনি। সেজন্যেই গিয়েছিলাম মনটি অ্যালবানে। একজনের নাম পিন্টো আলভারো, আরেকজন ডা স্টেফানো তিনি আরকিওলজিস্ট।

আরকিওলজিস্ট? নাম শুনেছি, মাথা নাড়লেন ক্যাপ্টেন। আর পিন্টো আলভারো অনেক আছে এদেশে। কজনের কথা বলবো? কাছেই থাকে একজন। পিন্টো আলভারো রবার্টো হারমোসা আলবার্টো সানচেজ।

চোখ কপালে তুললো রবিন। একজনের নাম, না তিনজনের?

হাসলেন ক্যাপ্টেন। একজনেরই। ম্যাটাডর।

মানে বুল ফাইটার? ভুরু কোঁচকালো কিশোর।

মাথা ঝাকালেন ডগলাস।

না, তাকে আমাদের দরকার নেই। আমরা যাকে খুঁজছি, ও আর যাই হোক, বুল ফাইটার নয়।

তবে কি আরেকজন আরকিওলজিস্ট?

তা হতে পারে।

আরকিওলজিস্টেরও অভাব নেই এদেশে। মেকসিকান তো আছেই, বাইরে থেকেও প্রচুর আসে। শুনেছি, খুব বড় একজন আরকিওলজিস্ট কাজ করছেন এখন মনটি অ্যালবানে। তিনিই ডা স্টেফানো হতে পারেন, জানি না।

কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে ভাবলেন পুলিশ অফিসার। তোমাদেরকে খুব একটা সাহায্য করতে পারছি না। দেখ, তোমরা যদি কিছু বের করতে পারো। তবে নোটটা রেখে দিলাম। অতি দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ রইলো। আবার যদি কিছু করে ধরতে পারবো। খুব সাবধান। ওরা ডেনজারাস। বুঝেই তো গেছ সেটা।

হোটেলে ফেরার সময় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো কিশোর। আসলেই কি দেশপ্রেমিক তরুণেরা হামলা করেছে ওদের ওপর? নাকি অ্যাজটেক যোদ্ধাকে যারা খুঁজছে, তারা?

কাল সকালেই বেরোতে হবে, রবিন বললো। বোঝা গেল একই ভাবনা চলেছে তার মাথায়ও। আর দেরি করা যায় না। মনটি অ্যালবানে গিয়ে তদন্ত করতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি পারা যায় এই রহস্যের সমাধান করে ফেলা উচিত।

হ্যাঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর।

পরদিন সকালে রাক্ষুসে খিদে পেয়ে গেল যেন মুসার। ফল, সিরিয়াল, ডিম, গরুর মাংস ভাজা, আর বড় বড় দুটো পাউরুটি দিয়ে নাস্তা সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। অনেকটা সুস্থ বোধ করছে। তাকে নোটটার কথা জানালো রবিন আর কিশোর। রাতে যে থানায় গিয়েছিলো সেকথাও বললো।

চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, মনটি অ্যালবানে যাচ্ছাে নাকি?

নিশ্চয়, কিশোর বললো।

চলো, আমিও যাবো। ব্যাটারা এলে বাড়ি মারার শোধ না নিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়।

না, তোমার আজ ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। শরীর এখনও ঠিক হয়নি। ওখানে ঘোরার অনেক ধকল, সহ্য করতে পারবে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো না লাগলে বরং আরেক কাজ করো, শহরে স্টেট মিউজিয়ামে চলে যাও। কিউরেটরের সঙ্গে আলাপ করতে পারো ইচ্ছে হলে। জানার চেষ্টা করবে অ্যাজটেক যোদ্ধা সম্পর্কে। সূত্র পেয়েও যেতে পারো।

তা মন্দ বলোনি। মিউজিয়াম দেখতে ভালোই লাগে আমার।

কাপড় পরে দুই সহকারীকে নিয়ে নিচে নামলো কিশোর। রকি বীচের খবর জানা দরকার। মিস্টার সাইমনকে ফোন করলো। এখানকার সমস্ত খবর জানিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তিনি কতখানি এগিয়েছেন। ডিটেকটিভ বললেন, প্রায় কিছুই না। জ্যাক আর আমি কয়েকবার করে গিয়েছি রেডফোর্ড এস্টেটে, লাভ হয়নি। জ্যাক ফাইবার তার সহকারী, আরেকজন তুখোড় গোয়েন্দা।

সাইমনের কথা থেকে নতুন একটা খবরই জানতে পারলো কিশোর, তা হলো, যে গাছটায় অ্যাজটেক যোদ্ধার মাথা আঁকা আছে, তাতে আরও একটা ছবি আঁকা রয়েছে। ছোট একটা তীর, জানালেন তিনি। খুব ভালো করে না তাকালে চোখেই পড়ে না। দেখে মনে হলো কোনো কিছু নির্দেশ করতে চেয়েছে। আমি আর জ্যাক অনেক জায়গায় খুঁড়েছি, পাইনি কিছু।

আর কাউকে এস্টেটে রহস্যজনক ভাবে ঢুকতে দেখা গেছে কিনা, কিশোরের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, না। পুলিশ কড়া নজর রাখছে। তারপর কিশোরদেরকে সাবধান থাকতে বলে, গুড লাক জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন তিনি।

বেরিয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। শহরের দিকে চলে গেল মুসা। কিশোর আর রবিন মনটি অ্যালবানের দিকে। হোটেলের নিউজ স্ট্যান্ড থেকে মনটি অ্যালবানের ওপর লেখা একটা পুস্তিকা কিনে নিয়েছে কিশোর।

দিনের আলোয় পুরানো শহরটাকে অনেক বেশি জমকালো মনে হলো রাতের চেয়ে। সত্যি, দেখার মতো। এতো প্রাচীন কালে যখন যান্ত্রিক সুবিধা বলতে গেলে ছিলোই না, তখন কিভাবে এরকম একটা শহর গড়া হয়েছিলো, দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো দুজনে। বিরাট বিরাট মন্দির, স্তম্ভ, প্রাকার, পিরামিড তৈরি করা হয়েছে পাথর দিয়ে। প্রাকারের গায়ে নানারকম চির আঁকা হয়েছে পাথর কুঁদে। পাথরের তৈরি মূর্তিও রয়েছে অনেক। রাতের বেলা যে পিরামিডের ওপরে আলো দেখা গিয়েছিলো, তার নিচে এসে দাঁড়ালো দুজনে। চ্যাপ্টা চূড়ায় উঠে এলো। ওপর থেকে নিচে তাকিয়ে পুরো শহরটা দেখা যায়।

একবার তাকিয়েই সূত্র খুঁজতে শুরু করলো কিশোর। একটা ভাঙা পাথরের টুকরো দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তার। আস্ত বড় কোনো পাথর থেকে ভেঙে আনা হয়েছে টুকরোটা, দুই বাই তিন ফুট, চার ইঞ্চিমতো পুরু। একটা কোণ ভাঙা। একটা ছবি খোদাই করা রয়েছে ওটাতে।

অ্যাজটেক যোদ্ধা! উত্তেজনায় স্বাভাবিক স্বর বেরোলো না রবিনের, ফিসফিসিয়ে বললো। আশ্চর্য! এটা এখানে কেন?

হয়তো এটাই নিতে উঠেছিলো লোকটা। তাড়াহুড়োয় বা অন্য কোনো কারণে ফেলে গেছে। হয়তো মূল্যবান কোনো আবিষ্কার।

কি জানি! পাথরটা তোলার চেষ্টা করলো কিশোর। বেজায় ভারি। দুজনের পক্ষে বয়ে নেয়াই মুশকিল। হাত থেকে ফেলে দিলে ভেঙে নষ্ট হতে পারে। খুব সাবধানে জিরিয়ে জিরিয়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলো ওরা। নিরাপদেই নামিয়ে আনলো অবশেষে। আর কেউ নেই তখন। একেবারে নির্জন। বোধহয় দর্শকদের আসার সময় হয়নি এখনও।

পাথরটাকে গাড়ির বুটে রেখে দিয়ে এলো ওরা। মুসাকে যেখানে বাড়ি মারা হয়েছিলো, সেজায়গাটায় এসে দেখতে লাগলো কিছু পাওয়া যায় কিনা। গাইড বুক বলছে, কিশোর বললো। এটা সাত নম্বর কবর। অনেক মূল্যবান নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে এখানে। স্টেট মিউজিয়ামে রাখা আছে ওগুলো।

আরও অনেক খোঁজাখুঁজি করলো ওরা। যে ঘরটায় মুসাকে ফেলে রাখা হয়েছিলো, সেটাতেও খুঁজলো। কিছু পাওয়া গেল না।

আর থাকার প্রয়োজন মনে করলো না কিশোর। তাছাড়া পাথরটাকে ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। হতো না, যদি ওটাতে অ্যাজটেক যোদ্ধার ছবি আঁকা না থাকতো।

হোটেলে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, ওদেরকে চোর ভেবে বসতে পারে। সোজা অজাকার মিউজিয়ামে চলে এলো ওরা। কিউরেটরের সঙ্গে দেখা করলো।

পাথরটা অফিসে এনে ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর আরও নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন কিউরেটর। অবশেষে মুখ তুললেন, ভালো। খুব ভালো। তবে সাংঘাতিক কিছু না। এরকম জিনিস পাওয়া যায়।

কোনোই বিশেষত্ব নেই? নিরাশই হয়েছে কিশোর।

আছে, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কিউরেটর বললেন। কোণের কাছে খরগোশের ছবি আর কয়েকটা বৃত্ত আঁকা আছে দেখ। এটা একটা অ্যাজটেক ক্যালেন্ডার। খরগোশ দিয়ে বছর গুনতো ওরা। একে বলে খরগোশ বছর। আমাদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটা পনেরোশো দশ সাল।

কিন্তু এটা বের করলো কে? রবিনের প্রশ্ন। পিরামিডের মাথায় নিশ্চয় আপনাআপনি ওঠেনি?

না, তা তো নয়ই, মাথা নাড়লেন কিউরেটর। হয়তো কোনো কবরের ভেতরে পেয়েছে কেউ।

কিন্তু ওখানে গেল কি করে? কিশোর বললো। পিরামিডের ওপরে?

একথার জবাব দিতে পারলেন না কিউরেটর। তাঁর কাছেও রহস্যময় লাগলো ব্যাপারটা।

মিউজিয়াম থেকে ফেরার পথে বিড় বিড় করে যেন নিজেকেই বোঝালো কিশোর, জবাব একটাই হতে পারে। আমাদেরকে ফাঁকি দিতে চেয়েছে। পেয়েছে কোনো কবরের ভেতর। ভেঙে এনেছে। ফেলে রেখেছে আমাদেরকে বোঝানোর জন্যে, যে এটাই অ্যাজটেক যোদ্ধা। যাতে আমরা এটা নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরে যাই।

কারা?

আর কারা? যারা আমাদের পিছে লেগেছে। যারা মুসাকে বাড়ি মেরেছে। যারা হুমকি দিয়ে নোট লিখেছে। এভাবে ফাঁকি দেয়ার জন্যেই মনটি অ্যালবানে টেনে এনেছে আমাদের।

তোমার কি মনে হচ্ছে, যারা নোট লিখেছে তারা দেশপ্রেমিক তরুণের দল নয়?

না। ওটাও আরেকটা চালাকি। তরুণদের ওপর নজর ফেলতে চেয়েছে। আমাদের এবং পুলিশের। নিজেরা আড়ালে থাকতে চেয়েছে।

<

Super User