পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ওপরের একটা তলায় রকি বীচ জেলখানা। তালাবদ্ধ গরাদের সামনে ডেস্কে বসে আছে একজন ডিউটিরত পুলিশ্যান। দ্বিধাজড়িত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। রিগো আলভারেজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলো।

সরি, বয়েজ, লোকটা বললো, লাঞ্চের পরে ভিজিটিং আওয়ার। তবে আসামীর উকিল যখন খুশি তার সঙ্গে দেখা করতে পারে। একটা বিমল হাসি উপহার দিলো পুলিশম্যান।

কেউকেটা গোছের মানুষ ওরা, এমন ভাব দেখিয়ে রবিন বললো, সে আমাদের মক্কেল।

অনেকটা উকিলের মতোই ধরতে পারেন আমাদেরকে, মুসা বললো।

দেখো, আমি বস্ত। অহেতুক বকবক করার সময়…

অহেতুক করছি না, তাড়াতাড়ি বললো রবিন। আমরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রিগো আমাদের মক্কেল। এই কেসের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে চাই। খুব জরুরী। আমরা

হাসি হাসি ভাব দূর হয়ে গেছে লোকটার। পুরোপুরি গভীর এখন। ভ্রুকুটি করে বললো, যাও, বেরোও এখন! বেরোও।

ঢোক গিললো রবিন। মুসাকে নিয়ে বেরোতে যাবে, এই সময় পেছনে কথা বলে উঠলো একটা কণ্ঠ, ওকে তোমাদের কার্ডটা দেখাও না, তাহলেই তো হয়।

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো রবিন আর মুসা। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রকি বীচের পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার।

কার্ড বের করে কর্তব্যরত পুলিশম্যানকে দেখালো রবিন। ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেটের একটা ফটোকপিও দেখালো।

কি জন্যে এসেহো, রবিন? চীফ জিজ্ঞেস করলেন।

জানালো রবিন।

সব শুনে মাথা ঝাঁকালেন চীফ। পুলিশম্যানের দিকে ফিরে বললেন, দেখা করতে দিতে পারো।

দিচ্ছি, স্যার, উঠে দাঁড়ালো লোকটা। আমি জানতাম না আপনি ওদেরকে সার্টিফাই করেছেন। আগে ওটা দেখালেই হতো।

ওরা যে কতোবার কতোভাবে পুলিশকে সাহায্য করেছে, জানো না তুমি। বয়েস কম হলে কি হবে, তুখোড় গোয়েন্দা, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন চীফ। ছেলে চেয়ে বললেন, আমি যাই, কাজ আছে। একবার হেসে চলে গেলেন তিনি।

একটি কলিংবেলের বোতাম টিপলো পুলিশম্যান। একটা করিডর দিয়ে বেরিয়ে এলো আরেকজন পুলিশ। গোয়েন্দাদেরকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললো তাকে প্রথম পুলিশম্যান।

আসামীর সঙ্গে দেখা করতে যাবারও নানা ঝক্কি। অনেক নিয়ম-কানুন। সেগুলো পালন করার পর গিয়ে আসামীর দেখা পেলো দুই গোয়েন্দা।

এসেছো, শান্তকণ্ঠে বললো রিগো। ভালো। তবে আমার কিছু দরকার নেই।

আমরা জানি আগুনটা আপনি লাগাননি, মুসা বললো।

হাসলো রিগো। জানি আমিও। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে?

আমরা সেটা প্রমাণ করে ছাড়বো, দৃঢ়কণ্ঠে বললো রবিন।

কিভাবে?

বেলা তিনটায় যে রিগোর মাথায় হ্যাট দেখেছে, সেকথা তাকে বললো রবিন।

তাহলে নিশ্চয়ই, উজ্জ্বল হলো রিগোর চোখ, আগুন লাগার পর কোনোভাবে ডয়েলদের জমিতে গিয়ে পড়েছিলো হ্যাটটা!

এমনও হতে পারে, অন্য কোথাও পড়ে ছিলো ওটা, কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ডয়েলদের এলাকায়?

হ্যাঁ, পারে! আমাকে ফাঁসানোর জন্যে।

সেটা জানার চেষ্টা করছি আমরা। কে, কিভাবে ক্যাম্পফায়ারের কাছে নিয়ে গিয়ে হ্যাটটা ফেললো।

কাজেই আমাদের জানা দরকার, রবিনের কথার পিঠে বললো মুসা, কখন আপনার মাথা থেকে খুলেছেন ওটা। ট্রাকে করে যখন আগুন নেভাতে যাচ্ছিলাম, তখন কি ছিলো?

গাল চুলকালো রিগো। চোয়ালে হাত বোলালো। তারপর মাথা নাড়লো, নাই, মনে করতে পারছি না।

ভাবুন! জোর দিয়ে বললো মুসা।

হ্যাঁ, ভাবুন, গলা মেলালো রবিন।

কিন্তু অসহায় চোখে শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো বেচারা রিগো।

 

পুরানো খবরের কাগজের সমস্ত সংস্করণ মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে। মাইক্রোফি রীডারে সেগুলো পুরে পড়ছে পিনটু। তাকে রকি বীচ লাইব্রেরিতে রেখে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে চলে গেছে কিশোর। দুজনে দুই জায়গায় খোঁজার জন্যে।

কাগজের প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে দেখছে পিনটু। সেপ্টেম্বরের ষোল থেকে অক্টোবরের শেষ হপ্তায় চলে এলো। কিছুই পায়নি এতোক্ষণেও, শুধু একটা সংখ্যায় ডন পিউটোর মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত খবর ছাড়া। সার্জেন্ট ডগলাসের রিপোর্টেরই পুনরাবৃত্তি, আর কিছু না।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাত মাথার ওপরে তুলে শরীর টানটান করলো সে। ঘরটা নীরব। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে।

পত্রিকা দেখতে ইচ্ছে হলো না আর তার। বুঝলো, ওগুলোতে কিছু পাওয়া যাবে। টেবিলে হাতের কাছেই একগাদা বই ফেলে রেখেছে। ওগুলো সব ছাপানো মেমোয়ার আর ডায়েরী, উনিশ শতকে লেখা স্থানীয় মানুষের। যতোগুলো জোগাড় করতে পেরেছে লাইব্রেরি, সব তুলে এনে একসাথে করে ছেপে নিয়েছে।

প্রথম মেমোয়ারটা টেনে নিলো পিনটু। লিস্ট দেখে পাতা খুললো : মিড-সেপ্টেম্বর,

১৮৪৬।

পঞ্চম জার্নালটা বন্ধ করে কান পাতলো কিশোর পাশা। বাইরে ঝমঝম ঝরছে অব্রিাম বৃষ্টি। স্প্যানিশ সেটেলারদের হাতে লেখা পুরানো ইতিহাস পড়তে দারুণ লাগে তার, তবে সেগুলোর ওপর থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে এনে শুধু খুঁজছে ডন পিউটোর খবর। কিন্তু এততক্ষণেও কোনো সূত্র চোখে পড়েনি।

কিছুটা হতাশ হয়েও হয় নম্বর জার্নালটা টেনে নিলো সে। এটা পড়তেততো কষ্ট হবে না, বুঝলো, কারণ এটা ইংরেজিতে লেখা।

মিনিট দশেক পরে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে গেল সে, ঢিলেমি ভাবটা দূর হয়ে গেছে মুহূর্তে। চকচক করছে চোখ। বার বার করে পড়লো লেখাটা। আমেরিকান সেনাবাহিনীর একজন সেকেণ্ড লেফটেন্যান্টের কথা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। পৃষ্ঠাটার একটা ফটোকপি করে নিলো। জার্নালগুলো অ্যাসিসটেন্ট হিসটোরিয়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রায় ছুটে বেরোলো ঘর থেকে। বাইরের বৃষ্টির পরোয়াই করলো না।

 

আবার মাথা নাড়লো রিগো। নাহ্, কিছু মনে করতে পারছি না!

বেশ, রবিন বললো, জোর করে শান্ত রাখছে নিজেকে, আমরা আপনাকে সাহায্য করছি। ধাপে ধাপে আসা যাক। ইস্কুলে আপনার মাথায় হ্যাটটা ছিলো। কিশোরের সেটা মনে আছে, আমারও। এখন

টেরি আর ডরিরও নিশ্চয় মনে আছে, বাধা দিয়ে তিক্ত কণ্ঠে বললো মুসা। হাজার চাপ দিলেও ব্যাটারা স্বীকার করবে না সেটা।

না করুক, রবিন বললো। মুসা বলেছে, স্যালভিজ ইয়ার্ডে আপনার মাথায় ওটা দেখেছে, তাই না মুসা?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো মুসা।

ট্রাকে আলভারেজদের ইতিহাস আমাদের শুনিয়েছেন আপনি। আমার পরিষ্কার মনে আছে, হাত তুলে তুলে জায়গা দেখাচ্ছিলেন আপনি, আপনার হাতে ছিলো না হ্যাট। ট্রাকে করে যাওয়ার সময় জোরালো বাতাস ছিলো, কনকনে ঠাণ্ডা, কাজেই মাথায় যাতে বাতাস না লাগে সেজন্যে হ্যাটটা তখন মাথায় পরে থাকাই স্বাভাবিক।

তারপর আমরা হাসিয়েনডায় পৌঁছলাম, রবিনের কথার খেই ধরলো মুসা। ট্রাক থেকে নামলাম। আপনি রাশেদ আংকেলের সঙ্গে করটেজের মূর্তিটা নিয়ে কথা বললেন। তারপর? হাসিয়েনডায় ঢুকেছিলেন? হ্যাটটা খুলেছিলেন?

ভালো রিগো। না, আমি ঘরে ঢুকিনি।…আমি…দাঁড়াও দাঁড়াও…হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে!

কী? চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। জলদি বলুন! তাগাদা দিলো রবিন।

জ্বলজ্বল করছে এখন রিগোর চোখ। সরাসরি গোলাঘরে ঢুকেছিলাম, মিস্টার পাশাকে মাল দেখানোর জন্যে। ভেতরে আলো কম ছিলো। হ্যাটের কানা ছায়া ফেলছিলো চোখের ওপর, তাই খুলে হাতে নিয়েছিলাম। তারপর, ছেলেদের দিকে তাকালো সে, ওটা দরজার কাছে একটা হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। ওটা ওখানেই থাকলো। হুগো আর ষ্টেফানো যখন আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠলো হ্যাট না নিয়েই ছুটে বেরোলাম।

হুঁ। তাহলে ওটা ওখানেই থাকার কথা, রবিন কললো। ক্যাম্পফায়ারের কাছে নয়।

তারমানে কেউ একজন, বললো মুসা, ওটা বের করে নিয়ে গেছে ঘরে আগুন লাগার আগেই। নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ক্যাম্পফায়ারের কাছে।

কিন্তু, রিগো কললো, সেটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

দেখি গোলাঘরে গিয়ে কিছু মেলে কিনা, আশা করলো রবিন। সব নিশ্চয় পুড়ে মাটিতে মিশে যায়নি। সূত্র পেলে পেতেও পারি। মুসা, চলো, কিশোরকে গিয়ে বলি।

রিগোকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এলো দুজনে।

বাইরে বৃষ্টি। তারমধ্যেই সাইকেল চালিয়ে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে চললো ওরা। কিন্তু ওখানে পাওয়া গেল না কিশোরকে।

গেল কোথায়? রবিনের দিকে তাকালো মুসা।

কি জানি, ঠোঁট কামড়ালো রবিন। অন্ধকার হতে দেরি আছে, আরও ঘণ্টা দুয়েক। চলো, আমরাই গিয়ে খুঁজি।

চলো। কিশোররাও হয়তো ওখানেই গেছে।

আবার বাইরে বৃষ্টিতে বেরিয়ে এলো ওরা। রওনা হলো আলভারেজ র‍্যাঞ্চে।

<

Super User