লাঞ্চের পর পরই বেরিয়ে গেল ডিনো। বলে গেল, পথের ধারে পাইন গাছের কিছু ডাল ছাঁটতে যাচ্ছে। ছেলেরা আর মিসেস ডাই ফিরে এলেন লিভিংরুমে। দ্বিতীয় জার্নাল থেকে সূত্র বের করায় মনোযোগ দিল।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, বক্তৃতার ঢঙে শুরু করল কিশোর। জার্নাল ঠিক ডায়েরী নয়, কিছুটা আলাদা। নিজের চিন্তা-ভাবনা পরিকল্পনার কথা এতে লেখেননি বাওরাড, কোন ঘটনারও বিশ্লেষণ করেননি। প্রতিটি ঘটনাই খুব সংক্ষিপ্ত, এক কি দুই লাইনে শেষ। এই যেমন, আজ চত্বরে কাজ করেছি, কিংবা, একটা ঈগল দেখেছি, এরকম। জাহাজের লগবুকের মত অনেকটা।
অন্য জার্নালটাও একই রকম, রবিন বলল।
তারমানে, ঘটনার উল্লেখ খুব একটা কাজে লাগছে না আমাদের। তবে চিঠিতে বলেছেন বাওরাড, তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে, আর শেষ দিনগুলো কিভাবে তৈরি করেছেন, সেটা মেনে চলতে। কি কি করেছেন তিনি, সেটার ওপর গুরুত্ব দিতে বলেননি নোরিয়াকে। বলেছেন, কোথায় গেছেন আর কি বানিয়েছেন, সেটা লক্ষ্য করতে।
জার্নালের দিকে তাকাল এড। হ্যাঁ, প্রথমেই রয়েছে কোথায় গিয়ে কি করেছিল। লিখেছেঃ নোরয়াকে চমকে দেয়ার পালা আজ থেকেই, কাজ শুরু করেছি। প্রথমে পাউডার গালচে গেছি লোক আর টিম্বার সুস জোগাড় করার জন্যে।
নিশ্চয় কিছু বানাতে! মুসা বলল।
মনে হয়, বলল কিশোর। তারপর কি লিখেছে, এড?
কয়েকটা পাতা ওল্টাল লাল-চুল ছেলেটা। দুহপ্তা আর তেমন কিছু নেই। শুধু ছোট ছোট নোট। তারপর একটা দ্বীপে গেছে।
মিসেস ডাই? কিশোর জিজ্ঞেস করল। নোরিয়াকে চমকে দেয়ার ব্যাপারটা কি, বলতে পারেন?
নাহ।
থাক, এ-নিয়ে পরে ভাবব। লোক এবং টিম্বার স্কুস জোগাড়। কেন? এসব এলাকায় শুনেছি, একসময় খনি ছিল। খনির লোকেরা টিম্বার সুস দিয়ে আকরিক ছাকত। এড, ফ্যান্টম লেকের কাছে কোন খনি চেন?
না। সোনার খনির কথা বলছ?
হতে পারে, মুসা আন্দাজ করল। গোপনে কোন খনিতে কাজ চালিয়েছে বাওরাড! ;
তা পারে, বলল কিশোর। তবে আমার মনে হয় না, সেরকম কিছু বলতে চেয়েছেন তিনি। নির্দেশ অনুসরণ করতে বলেছেন। তারমানে, এমন কোথাও গিয়েছেন, যেখানে রয়েছে সূত্র। পাউডার গালচে যেতে হবে আমাদের, বুঝেছ।
পাউডার গালচ কি কাছাকাছিই নাকি? মুসা জিজ্ঞেস করল।
এড জানাল, হাইওয়ে ধরে গেলে বড়জোর এক মাইল।
আশ্চর্য, মুসা, তুমি জান না? ভুরু কোঁচকাল কিশোর। বিখ্যাত জায়গা। লোকাল হিস্টরিতে জায়গাটার নাম রয়েছে। পড়েছি…
গোস্ট টাউন! উত্তেজনায় মোর চেড়ে উঠে পড়ল রবিন। পুরানো ভূতুড়ে শহর! তাই তো বলি, নামটা চেনা চেনা লাগে কেন?
ভূ-ভূতের শহর..! ভয় দেখা দিল মুসার চোখের তারায়। আ-আমরা যাচ্ছি নাকি?
যেতে হবে, উঠে দাঁড়াল কিশোর। এখুনি।
জীর্ণ, মলিন রোড-সাইনঃ পাউডার গালচ। তীর চিহ্ন নির্দেশ করছে সরু একটা কাঁচা সড়ক। সাইকেল চালিয়ে চলল চার কিশোর। মিনিট দশেক পরেই নিচে দেখা গেল গোস্ট টাউন।
ওপর থেকে দেখার জন্যে থামল ওরা। শুকনো খাড়ির পাড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কতগুলো পুরানো, ভাঙা ছাউনি। পথের কিনার ঘেঁষে তৈরি হয়েছিল কিছু বাড়ি, বেশির ভাগই পাথরধসে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা বড় একটা বাড়ির কপালে সাইনবোের্ড রয়েছে, স্যালুন। আরেকটাতে জেনারেল স্টোর। কাত হয়ে যাওয়া একটা বাড়িতে লেখা, জেল। একটা কামারশালা আর একটা আস্তাবল আছে। পথের শেষ মাথায় পর্বতের গায়ে মস্ত এক কালো ফোকর, খনির প্রবেশ মুখ। ওই খনির জন্যেই গড়ে উঠেছিল শহরটা।
আঠারশা নব্বই সালে ফুরিয়ে আসে খনি, কিশোর বলল। চলে যেতে শুরু করে লোকে। ততদিনে খাড়িও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।
গুঙিয়ে উঠল মুসা। একশো বছর পর এখানে কি খুঁজতে এসেছি আমরা, কিশোর?
জানি না, সেকেণ্ড। তবে আমি শিওর, নোরিয়াকে এখানে এসেই খুঁজতে বলেছেন বাওরাড। হয়ত এক-আধটা খবরের কাগজও বের হত তখন এখানে। খুঁজলে কয়েক সংখ্যা পাওয়াও যেতে পারে।
বলা যায় না, খবরের কাগজের মর্গও থাকতে পারে, রবিন আশা করল।
মর্গের নামে চমকে উঠল মুসা। খাইছে! যে শহরে এসেছি, আমরাও না শেষে মর্গের বাসিন্দা হই!
তার কথা কানে তুলল না কিশোর। বলল, এস, যাই।
পুরানো শহরের পাশে এসে সাইকেল থামাল ওরা। তালা দেয়া বড় একটা ফটকের সামনে। উঁচু বেড়ায় ঘেরা পুরো শহরটা
বেড়া দেখছ! এড বলল। দেখ, ওই বিল্ডিঙের লেখাটাও নতুন। কেউ এসে বাস করতে আরম্ভ করেছে নাকি আবার?
কি জানি, গাল চুলকাল কিশোর।
মিনিটখানেক অপেক্ষা করল ছেলেরা, কান পেতে রইল। কিন্তু নীরব হয়ে রইল পাউডার গালচ।
বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকতে হবে, অবশেষে বলল কিশোর।
সাইকেল রেখে, বেড়া বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। ওপাশে নেমে তাকাল ধুলো-ধূসরিত পথের দিকে।
রবিন, মুসা, কিশোর বলল। তোমরা বাঁয়ের বাড়িগুলোতে খুঁজবে। আমরা যাচ্ছি জেলখানা, আস্তাবল আর অন্য কয়েকটাবাড়ি খুঁজতে। খনির কাছে গিয়ে মিলিত হব। দেখা যাক, কিছু পাই কিনা।
মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে জেনারেল স্টোরে গিয়ে ঢুকল রবিন আর মুসা। পা টিপে টিপে ঢুকে থামল। দুজনেই অবাক। একশো বছর আগে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়েছে স্টোরটা। তাকে, তাকে মাল বোঝাই। ময়দা আর শুকনো আপেলের পিপা, লোহার নানারকম জিনিস-হাতুড়ি, বাটালি, করাত, শাবল, বেলচা, কুড়াল এসবই বেশি। চামড়ার জিন, আর আরও নানারকম জিনিস স্তূপ করে রাখা আছে মেঝেতে। দেয়ালে ঝোলানো পুরানো আমলের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ম্লান আলোতেও চমকাচ্ছে। লম্বা কাউন্টারটা চকচকে পালিশ করা, পরিষ্কার।
কেউ থাকে এখানে! রবিন বলল।
কি-কিন্তু, তোতলাতে লাগল মুসা। নি-নিশ্চয় এ-যুগের কেউ নয়! জিনিসপত্র সব একশো বছর আগের মত…মানে, স্টোরটা এখন ভূতের দখলে! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাল সে। যেন আশঙ্কা করছে, হ্যাল্লো, কেমন আছ? বলে এখুনি বেরিয়ে আসবে ভূত।
রবিনেরও গা ছমছম করছে। ঢোক গিলল। হ্যাঁ, স্টোরটা যখন খোলা থাকত, এরকম সাজানোই থাকত বোধহয়। যেন…যেন এখনও খোলা…পোড়ো নয়! মুসা, কাউন্টারে দেখছ, পুরানো ধরনের একটা হিসেবের খাতা এখনও রয়েছে, যেন বেচা-কেনা চলছে! :
খুব সাবধানে কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। খোলা পড়ে আছে খাতাটা। খদ্দেরের নাম লেখাঃ জিনিসের অর্ডার দিয়ে গেছে। অনেক দ্বিধা করে শেষে খাতাটায় আঙুল ছোঁয়াল রবিন। কাঁপা হাতে পাতা উল্টে চলল। নব্বইয়ের পরেও আরও কয়েক বছর টিকে ছিল এই শহর। ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৬ সাল পাওয়া গেল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখে জোরে জোরে পড়ল মুসা, বাওরাড ডাই, ফ্যান্টম লেক-সাপোর্ট সহ ২০০ বোর্ড-ফুট মুস টিম্বার, ২ পিপা ময়দা, ১ পিপা গরুর মাংস, ৪ বাক্স শুকনো সীমের বীচি। চোখ মিটমিট করল সে। খাইছে! কত লোকের জন্যে অর্ডার দিয়েছে?
অনেক লোক ভাড়া করেছিল নিশ্চয়। শ্রমিক। তাদের খাবার লাগবে না? আর কিছু চোখে পড়ছে, মুসা? মাথা নাড়ল মুসা। দেখছি না।
স্টোরের বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ল দুজনে। এরপর ঢুকল স্যালুনে।
আরি, এটা তো কমুনিটি সেন্টার ছিল মনে হচ্ছে, রবিন বলল। লোকে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করত এখানে, মেসেজ রেখে যেত। নিশ্চয় এখানে ঢুকেছিল বাওরাড।
ঘরটা বড়, অন্ধকার। পেছনে একটা দরজা, শোবার ঘরে ঢোকার জন্যে। বা ধারে কারুকাজ করা একটা পিয়ানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চকচকে বারের ওপাশে সারি সারি মদের বোতল। পেছন দিকে গোল একটা টেবিলে কয়েকটা বোতল, গেলাসে ঢালা মদ, তাস ছড়িয়ে আছে, যেন এই খানিক আগে মদ খাওয়া আর তাস খেলা চলছিল।
এ-এটাও তো স্টোরের মতই, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। যেন এইমাত্র ছিল খনির শ্রমিকেরা, হঠাৎ উঠে চলে গেছে।
কথা শেষ হল না তার। অনেকগুলো, কণ্ঠের মিলিত শব্দে ভরে উঠল ঘর। সীমান্ত এলাকার পুরানো গানের সুর বাজতে শুরু করল পিয়ানোতে। কিন্তু মানুষজন কাউকে চোখে পড়ল না। বোতল আর গেলাস ঠোকাঠুকির মৃদু টুংটাং পান করার শব্দ, মানুষের হুল্লোড় চলছে। পেছনে গোল টেবিলের কাছে জোরে শব্দ, আবছা একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল বলে মনে হল। চুপ! একচুল নড়বে না! ধমক শোনা গেল।
সামান্য স্পষ্ট হল আবছা মূর্তিটা। দেখা গেল, দুহাতে দুই পিস্তল।
ভূ-ভূত! চিৎকার করে উঠল মুসা। মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল! রবিন, দৌড় দাও!
দৌড়াতে গিয়ে একজন আরেকজনের ওপর এসে পড়ল। ওদের কাণ্ড দেখেই বুঝি পেছনে হো হো করে হেসে উঠল লোকেরা। বেজেই চলেছে পিয়ানো। বাইরে গরম। পরোয়াই করল না দুই গোয়েন্দা। ধুলোয় ঢাকা পথ ধরে ছুটল খনির দিকে।
খনির ভেতরে লম্বা সুড়ঙ্গটা আলোকিত। ঢালু শ্যাফট ধরে ছুটল ওরা। সামনে দেখা গেল কিশোর আর এডকে।
কিশোর! চেঁচিয়ে ডাকল মুসা। আরেকটু হলেই ভূতে…! এবারেও শেষ হল না তার কথা। দেখল, থমকে দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর আর এড়। দৃষ্টি সামনে। কিছু একটা ওদেরকেও অবাক করেছে।
রবিন আর মুসারও কানে এল বিচিত্র শব্দ। পানি পড়ছে, মেশিন চলছে, থেকে থেকেই বন্য কণ্ঠে হেসে উহছে কোন পাগল! গুলি ফোটার বিকট আওয়াজ হল বদ্ধ সুড়ঙ্গে, কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল যেন বুলেট, গুলির শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাল সুড়ঙ্গের ভেতর।
কি হল, কিশোর? ফিসফিসিয়ে বলল রবিন, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে।
ঢোক গিলল কিশোর। বুঝতে পারছি না!…ঢুকলাম…গুলি করল আমাদেরকে…লোকটা…।
লোকটাকে দেখতে পেল মুসা আর রবিন।
সুড়ঙ্গের আবছা অন্ধকারে বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রাইফেলের নল ওদের দিকে ফেরানো। দাড়িওয়ালা এক খনি-শ্রমিক। গায়ে লাল উলের শার্ট। পরনে হরিণের চামড়ার প্যান্ট। পায়ে গোড়ালি ঢাকা উঁচু চামড়ার বুট।
চুরি করে যারা ঢোকে, তাদের কি করে তাড়াতে হয়, জানি আমরা! খসখসে গলায় বলল লোকটা। হেসে উঠল খলখল করে। হাতের রাইফেল উঁচু করে আবার ট্রিগার টিপল।
<