আধ ঘন্টা পর রোজারের দরজায় টোকা দিল কিশোর। খুলে দিল রক রেনাল্ড। গলাবন্ধ কালো শার্ট গায়ে, চোখে সানগ্লাস।

ও, তুমি, রক বলল। আমাদের মহাগোয়েন্দা। কিছু জেনে এসেছ? রোজার খুশি হবে তো?

রেগে গেল কিশোর। কিছু বলল না। ঝকঝকে পরিষ্কার লিভিং রুম পেরিয়ে রান্নাঘরে এসে ঢুকল। জানালার ধারে সেই একই জায়গায় চেয়ারে বসে আছে রোজার, হাতে কফির কাপ। তার সামনাসামনি বসল কিশোর। কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করল রক।

কফি খাই না, ভদ্রভাবে বলল সে।

নিশ্চয়, রক বলল। ভুলেই গিয়েছিলাম, আমেরিকান ছেলেরা কফি খায় না। তোমাকে কিন্তু আমেরিকান লাগছে না।

আঙুরের রস মেশানো সোডা আছে, রোজার বলল। খাবে?

কিছুই লাগবে না আমার, ধন্যবাদ। লাঞ্চ সেরেই চলে এসেছি।

আমি জানতাম বাচ্চারা খাওয়া পেলেই খায়, পেটে জায়গা থাক আর না থাক, বলল রক। তুমি কি আলাদা? স্বাস্থ্য দেখে অবশ্য মনে হয় না, খাওয়ার প্রতি তেমন টান আছে।

অনেক কষ্টে চেহারা স্বাভাবিক রাখল কিশোর।

খাও না কেন? এই বয়সেই ডায়েট কন্টোল?

জবাব দিল না কিশোর। আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।

স্টোভের কাছে ফিরে গেল রক। কেটলিতে পানি ফুটছে। কাপে ইনসট্যান্ট কফি বানিয়ে নিয়ে এসে বসল দুজনের কাছে। টেবিলে রাখা চিনির পাত্র থেকে চিনি নিয়ে কাপে মিশাল।

তারপর, কি খবর নিয়ে এলে? জিজ্ঞেস করল সে।

এই আরকি, কিশোর বলল। তেমন কিছু না।

তেমন কিছু পেলে কি করতে?

অবশ্যই পুলিশকে জানাতাম। –

হ্যাঁ, সেটাই উচিত। কফি শেষ করে উঠে গিয়ে কাপটা সিংকে ভেজাল রক। বেরিয়ে গেল। ড্রাইভওয়েতে একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হল। রান্নাঘরের জানালার পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা নতুন মডেলের স্পোর্টস কার।

বিমর্ষ হয়ে আছে রোজার।

পুলিশ এসে দোষী বলেনি তো আপনাকে? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

মাথা নাড়ল রোজার। নাহ, তবে একই গল্প তিনবার বলিয়েছে আমাকে দিয়ে। কিশোরের দিকে তাকাল সে। ওরা চাইছে আমি একটা ভুল করে বসি। কিন্তু আমি…আমি ভুল করছি না।

সত্যি যা ঘটেছে, তা হাজারবার বললেও ভুল হওয়ার কথা নয়। মিস্টার রোজার, আপনার দুশ্চিন্তার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। আপনি একটা দুর্ঘটনার শিকার মাত্র। পুলিশও নিশ্চয় বুঝতে পারছে। আপনার জায়গায় অন্য কোন গার্ড থাকলেও একই ব্যাপার ঘটতে পারত। ডাকাতেরা যে মারধর করেনি, এইই বেশি।

না, তা করেনি। বরং বলা যায় দ্র ব্যবহারই করেছে। বিশেষ করে যে লোকটা কথা বলছিল।

কান খাড়া করে ফেলল কিশোর। কথা কি শুধু একজনই বলেছে?

হ্যাঁ, ঝাড়ুদারের ছদ্মবেশে যে এসেছিল।

সব কথা? আর কেউ কিছু বলেনি?

না, কিছু বলেনি।

পুরো একটা রাত তিনজন লোকের সঙ্গে কাটালেন, দুজন কোন কথাই বলল?

না।

একটা বর্ণও না?

না। তুমি বলায় এখন আমার কাছেও অদ্ভুত মনে হচ্ছে ব্যাপারটা।

হুম। ডাকাতদের কেউ কি মেয়েলোক ছিল? বোঝা গেছে?

মেয়েলোক! তা হতেও পারে। তিনজনেই প্রায় একই রকম লম্বা। পাঁচ ফুট সাতের মত। ঢোলা শার্ট আর ওভারঅল, পরে এসেছিল। হাতে গ্লাভস। মুখে এত কিছু লাগিয়েছিল, কে যে পুরুষ আর কে মেয়ে বোঝাই যায়নি। দুজন পরেছিল সানগ্লাস, আয়নার মত কাচ, চোখ দেখা যায়নি। একজনের দাড়ি ছিল, আমার মনে হয় নকল। আরেকজনের লাল পরচুলা, লাল গোঁফ। ভুরু এত মোটা, প্রায় চোখের ওপর এসে ঝুলে পড়েছিল।

যে কথা বলছে তার কথায় বিদেশী টান ছিল? বয়েস কম, না বেশি?

বুড়ো মানুষের গলা নকল করছিল। আমার বিশ্বাস, সে অল্পবয়েসী। বিশতিরিশের বেশি না। না, কথায় টান ছিল না।

আবার হুম্! বলে চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল কিশোর। তারপর বলল, মিস্টার রোজার, আপনি নিকারো অ্যাণ্ড কোম্পানিটা চেনেন? ফিশিং কোম্পানি। বোটও ভাড়া দেয়। ম্যালিবুর পরে ওদের ডক।

চিনি। আমার ছেলেকে নিয়ে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যেতাম, তখনও সে বিয়ে করেনি। মিসেস নিকারোকেও চিনি। এককালে সুন্দরী ছিল মহিলা। তার ছেলের বৌ এলসিকেও চিনি। মেয়েটা আইরিশ। সে-ও, সুন্দরী। খুব অল্পবয়েসে স্বামী মারা গেছে। বোট অ্যাক্সিডেন্ট। সেদিন এলসিই বোট চালাচ্ছিল। লাইসেন্স আছে তার।

ওদের ওখানে বিল নামে একটা লোক কাজ করে।

করে নাকি? আমরা যখন যেতাম, তখন ওই নামে কেউ ছিল না। জিম না কি যেন, এরকমই নাম ছিল একটা ছোকরার। ঘন ঘন লোক বদলায় হয়ত ওরা।

ইদানীং কখনও গিয়েছেন?

না।

তাহলে বিলকে চিনবেন না। অন্ধের ব্যাপারে কিছু জানেন?

অন্ধ? শূন্য দৃষ্টি ফুটল রোজারের চোখে। লোক?

হ্যাঁ। ডাকাতরা যখন ঢোকে, ওকেও দেখা গেছে ব্যাংকের কাছাকাছি। গালে কাটা দাগ। চোখে কালো চশমা। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এসেছিল।

মাথা নাড়ল রোজার। বলতে পারব না।

আজ সকালে একটা মেয়েকে দেখলাম, আপনি যখন তাস খেলা দেখছিলেন? মেয়েটা কে?

সিনথিয়া ব্যানালিস? তুমি জানলে কি করে?

আপনার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি।

কি হয়েছে তাতে? একটা মেয়ের বয়েসী মেয়ে কি কোন বুড়োর সঙ্গে কথা বলতে পারে না?

পারে, আমি সেকথা বলছি না। গোয়েন্দাদের কোন কিছুই উপেক্ষা করতে নেই। সিনথিয়ার সঙ্গে আপনার কেমন পরিচয়?

দেখা হলে কথা বলি। সময় পেলেই কুকুর নিয়ে বেরোয়, হাঁটাহাঁটি করে। মনে হয় কোন সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করে। ভাল মেয়ে। দেখা হলে দাঁড়াবেই। দুচারটা কথা না বলে যাবে না।

আপনি ব্যাংকে চাকরি করেন, একথা জানে?

কি জানি। বলেও থাকতে পারি। কোন তথ্য জানতে চেয়েছে কিনা এটাই তো জানতে চাইছ? চায়নি। জাস্ট কথা বলে।

অ। তা আরও বন্ধু নিশ্চয় আছে আপনার। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন? ব্যাংকের কাজকর্ম সম্পর্কে?

করি। তবে কেউ এ নিয়ে ইন্টারেস্টেড হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না।

রক রেনাল্ড?

ও নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, এসব ফালতু আলোচনার সময় কই? বাইরে বাইরেই থাকে বেশি। এখানে যখন থাকে, তখনও কথা বিশেষ হয় না। খাওয়ার সময় খায়, বাকি সময় ঘরে দরজা আটকে বসে থাকে। মিথ্যে কথা বলছি না। ওর দরজার তালা দেখবে?

দরকার নেই, উঠে দাঁড়াল কিশোর। হতাশ হবেন না, মিস্টার রোজার। পুলিশ ঘন ঘন আসে, বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করে, তার কারণ, ওদের ধারণা আপনি কোন জরুরি তথ্য জানাতে ভুলে যাচ্ছেন। কয়েক বার বললে হয়ত মনে পড়বে, এই আরকি।

জবাব দিল না রোজার।

সাড়ে চারটা নাগাদ ইয়ার্ডে ফিরে এল কিশোর। গেট দিয়ে না ঢুকে চলে এল বেড়ার পেছনে, যেখানে ছবিতে আঁকা একটা মাছ মাথা তুলে একটা জাহাজকে দেখছে। মাছের চোখ টিপল সে। ওপরে উঠে গেল দুটো বোর্ড। বেরিয়ে পড়ল প্রবেশ পথ, তিন গোয়েন্দার কয়েকটা গোপন পথের একটা। এটার নাম সবুজ ফটক এক।

ওখান দিয়ে ঢুকে আউটডোর ওঅর্কশপে এসে ঢুকল কিশোর। মুসার সাইকেলটা আছে। মুচকি হেসে নামিয়ে দিল আবার বোর্ড দুটো।

এই সময় কানে এল শব্দটা। কাপড়ের মৃদু খসখস আর নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ।

ঝট করে ফিরে তাকাল সে।

দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ধ ভিক্ষুক! মাথা সামান্য কাত করে রেখেছে, গালের কাটা, দাগটা কিশোরের দিকে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি এখন নেই। লাঠিও নেই হাতে। কাটা দাগের কারণে ভয়ঙ্কর লাগছে মুখটা।

একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেল কিশোরের। তারই মত লোকটাও স্থির হয়ে আছে। শ্বাস টানল কিশোর, নড়ে উঠল লোকটা। আরেকটু কাত করল মাথা, চমুকে গেছে বোঝা যায়। হাতে কি যেন আছে, তার ওপর আঙুলগুলো শক্ত হল।

হঠাৎ মাইকেলের হ্যাণ্ডেল ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপ দিল কিশোর। চেপে ধরল লোকটার হাত।

চেঁচিয়ে উঠে ঝাড়া মেরে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল লোকটা।

ছাড়ল না কিশোর, প্রাণপণে আঁকড়ে ধরেছে। কজিতে মোচড় দিতে লাগল দুহাতে। লোকটার আঙুল খুলে গেল, মাটিতে পড়ে গেল হাতের জিনিস।

গায়ের জোরে ঝাড়া দিয়ে হাত ছাড়াল লোকটা। তারপর হামলা চালাল। প্রচণ্ড ঘুসি এসে লাগল কিশোরের চোয়ালে। চোখে সর্ষে ফুল দেখল সে। বো করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। অবশ হয়ে গেল দেহ।

খুব সামান্য সময়ের জন্যে জ্ঞান হারাল কিশোর। চোখ মেলে দেখল, তাকে ডিঙিয়ে যাচ্ছে লোকটা। পৌঁছে গেল সবুজ ফটক এক-এর কাছে। ওপরে উঠল বোর্ড দুটো, আবার নামল। বেরিয়ে গেছে অন্ধ ভিক্ষুক।

<

Super User