অবাক হয়ে অন্ধকার প্যাসেজের দিকে চেয়ে আছে দুজন।

ইয়াল্লা বলে উঠল মুসা। একটা গোপন পথ!

আয়নার পেছনে লুকানো! ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। ভেতরে ঢুকব, দেখব, কি আছে।

মুসা প্ৰতিবাদ করার আগেই প্যাসেজে পা রাখল কিশোর। টর্চের আলোয় দেখা গেল, সরু লম্বা একটা প্যাসেজ। দুপাশে অমসৃণ পাথরের দেয়াল। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা দরজা।

এস, ফিরে মুসাকে ডাকল কিশোর। কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যায় প্যাসেজটা, দেখি।

দ্বিধায় পড়ে গেল মুসা। প্যাসেজে ঢোকাটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। তার। এদিকে অন্ধকার ঘরে একা থাকতেও চায় না। শেষে ঢুকেই পড়ল।

আলো ফেলে দুপাশের দেয়াল দেখল কিশোর। আয়না বসানো দরজাটা পরীক্ষা করল। সাধারণ দরজা, কাঠের পাল্লা। এক পাশে পাল্লার সমান একটা আয়না বসানো। কোন নব নেই, ছিটিকিনি নেই।

আশ্চর্য! বিড়বিড় করল কিশোর। বন্ধ করে আবার খোলে কি করো নিশ্চয় গোপন কোন ব্যবস্থা আছে।

ঠেলে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল কিশোর। মোলায়েম একটা ক্লিক করে আটকে গেল পাল্লা।

সেরেছো? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বন্দি হয়ে গেলাম!

হুমম। আপনমনেই মাথা দোলাল কিশোর। পাল্লার ধারে আঙুল চালিয়ে দেখল, কোন খাঁজ আছে কিনা, ধরে টান দেয়া যায় কিনা। কিছু নেই। দরজার ফ্রেম, পাল্লা মসৃণ করে চাঁছা। ফ্রেমের মধ্যে নিখুঁত ভাবে বসে গেছে পাল্লাটা, ফাঁক নেই।

কোন না কোন উপায় আছেই খোলার, বিড়বিড় করল। কিশোর। ওপাশ থেকে তো খুব সহজেই খুলে গেলা ব্যাপারটা কি?

সেটা তুমি বোঝ, বলল মুসা। আবার সহজে খুলে গেলেই বাঁচি বেরিয়ে যেতে আমি।

বেশি পুরু না। ভাঙার দরকার পড়বে মনে হয় না। প্যাসেজের আরেক দিকে তো পথ রয়েছেই।

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। ঘুরে রওনা হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান।

এক পা দুপা করে এগিয়ে চলেছে। নিরেট, এক সময় বলল সে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। শুনতে পাচ্ছি।

দাঁড়িয়ে পড়ল। মুসাও। কান পাতল।

অর্গান বাজছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে যেন শব্দটা। কাঁপা কাঁপা। সেই সঙ্গে মিশেছে তীক্ষ্ম ক্যাঁচকোচ আর চাপা চিৎকার। এর আগের বার যেমন শুনেছিল মুসা, ঠিক তেমনি। পরিবর্তন নেই।

নীল ভুতা চাপা গলায় বলল গোয়েন্দা সহকারী। অর্গান বাজাচ্ছে!

একদিকের দেয়ালে কান চেপে ধরল। কিশোর। ধরে রইল। দীর্ঘ এক সেকেণ্ড। সরে এল। দেয়াল ভেদ করেই যেন আসছে। আওয়াজ! মানে কি? দেয়ালের ঠিক ওপাশেই আছে। অর্গানটা।

বলতে চাইছ, এই দেয়ালের ওপাশেই আছে ভূতটা আঁতকে উঠল মুসা।

আমার তাই ধারণা, বলল কিশোর। যে করেই হোক, আজ ওর ছবি তুলবই। সম্ভব হলে কথাও বলব।

কথা বলবে? গোঙানি বেরোল মুসার গলা থেকে। ভূতের সঙ্গে কথা বলবে!

যদি ধরতে পারি।

আমরা ধরার আগেই যদি আমাদেরকে ধরে? ঘাড় মটকে দেয়?

সে-ভয় কম, জোর দিয়ে বলল কিশোর। এ-পর্যন্ত কারও কোন ক্ষতি করেনি। ওটা। রেকর্ড নেই। এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করছি আমি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক ভেবেছি। একটা ধারণা জন্মেছে মনে। পরীক্ষা করে দেখব। আজ। আর খানিক পরেই জানব, ধারণাটা ঠিক কিনা।

যদি ভুল হয়? হঠাৎ যদি আজ ঠিক করে ভূতটা, তার দল বাড়াবে, তাহলে?

তখন মেনে নেব ভুল করেছি, শান্ত গলায় বলল কিশোর। একটা আগাম কথা বলছি। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তীব্র আতঙ্ক এসে চেপে ধরবে। আমাদেরকে।

কয়েক মুহূর্ত পরো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তাহলে এখন কি বোধ করছি?

অস্বস্তি।

চল পালাই। দুজনে ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিলে ভেঙে যাবে পাল্লা। লাগবে ছুট?

না, মুসার হাত চেপে ধরল। কিশোর। অস্বস্তি, ভয় কিংবা আতঙ্ক কারও কোন ক্ষতি করে না। ওগুলো এক ধরনের অনুভূতি। আতঙ্কিত হয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করে না বসলে, কোন ক্ষতিই হবে না তোমার।

জবাবে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটছে প্যাসেজে। বাজনার শব্দ আর নিজেদের কথাবার্তায় মগ্ন থাকায় এতক্ষণ খেয়াল করেনি। ব্যাপারটা। কুয়াশা! আজব এক ধরনের ধোঁয়াটে কুয়াশা উদয় হয়েছে হঠাৎ । মেঝেতে কুয়াশা, দেয়ালের ধার ঘেঁষে কুয়াশা, সিলিঙে কুয়াশা।

ওপরে নিচে আলো ফেলল। মুসা। উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল, পাক খাচ্ছে কুয়াশা, কুণ্ডলী পাকিয়ে ভাসছে বাতাসে। কোথা থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ছে ধীরে ধীরে কুয়াশার ভেতর অদ্ভুত কিছু আকৃতি দেখতে পেল যেন সে।

দেখ দেখা কাঁপা গলায় বলল মুসা। বিচ্ছিরি সব মুখ্যা ওই, ওই যে একটা ড্রাগন. একটা বাঘ. ওরেকবাপারে! ভয়ানক এক জলদস্যু…

থাম! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। আমিও দেখছি ওসব ছাতে বসে ভেসে যাওয়া মেঘের দিকে চাইলেও দেখতে পাবে ওই কাণ্ড। এই কুয়াশা কোন ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না। তবে আতঙ্ক আসছে।

সঙ্গীর হাতে হাতের চাপ বাড়াল কিশোর। কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। ঠিকই বলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। হঠাৎ তীব্র আতঙ্ক এসে ভর করল মনে, ছড়িয়ে পড়তে লাগল যেন সারা শরীরে। পায়ের তালু থেকে মাথার চাঁদি পর্যন্ত সব জায়গায়। অদ্ভুত শিরশিরে এক অনুভূতি চামড়ায়, কুঁচকে যাবে যেন। ছুটে পালাতে চাইছে সে। শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে কিশোর, যেতে দিচ্ছে না। একই অনুভূতি হচ্ছে কিশোরেরও, কিন্তু পাথরের মত অটল দাঁড়িয়ে আছে সে।

আতঙ্কের একটা স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরা। খেয়াল করল, কুয়াশা বাড়ছে, ঘন হচ্ছে। কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, ঘুরছে ফিরছে, ভাসছে বাতাসে। সৃষ্টি করছে আজব আজব সব আকৃতি। কুয়াশাতঙ্ক, অল্প অল্প কাঁপছে কিশোরের গলা। কিন্তু মুসার বাহুতে আঙুলের বাঁধন শিথিল হচ্ছে না। সামান্যতম। অনেক বছর আগে এখানে ঢুকে এর কবলে পড়েছিল কে একজন। রেকর্ড আছে। লোক তাড়ানোর শেষ অন্ত্র টেরর ক্যাসলের। চল, ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়ি এবার। নীল ভূতকে ধরতে হবে। ও হয়ত ভেবে বসে আছে, এতক্ষণে ভয়ে অবশ হয়ে গেছি আমরা।

আমি যাব না, কোনমতে বলল মুসা। দাঁতে দাঁত ঠোকাঠুকি করছে। আমার শরীর অবশ্য কিছুতেই পা নাড়াতে পারছি না!

কি ভাবল কিশোর। তারপর বলল, শোন, খামোকা ভয় পেয় না। ভাবনা-চিন্তা করে কি বুঝেছি আমি জান? বুঝেছি, টেরর ক্যাসল সত্যিই ভূতুড়ে…

সেকথাই তো তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। এত দিন।

…তবে ভূতুড়ে করে তোলার পেছনে রয়েছে। একজন মানুষ। জীবন্ত মানুষ। জন ফিলবি নিজে। যে আত্মহত্যা করেছে বলে লোকের ধারণা।

বল কি? এতই অবাক হয়েছে মুসা, আতঙ্ক ভুলে গেছে।

ঠিকই বলছি। ভূত সেজে এতগুলো বছর বাস করে আসছে টেরার ক্যাসলে। লোককে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে।

কিন্তু তা কি করে হয়? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। আমরাও তো কয়েকবার ঢুকলাম ক্যাসলে। কখনও তার দেখা পাইনি। তাছাড়া খাবার? লোকের চোখ এড়িয়ে কি করে জোগাড় করে?

জানি না। দেখা হলে জিজ্ঞেস করব। আসলে লোককে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো পর্যন্তই, এর বেশি কিছু করে না সে। কারও কোন ক্ষতি করে না। ক্যাসলটা তার দখলে থাকলেই খুশি। আতঙ্ক গেছে?

আরো হ্যাঁ! চলে গেছে! আর ভয় পাচ্ছি না। পা-ও উঠছে। যেদিকে নিয়ে যাব, যাবে।

চল তাহলে। নীল ভূতের সঙ্গে দেখা করি।

পা বাড়াল কিশোর। পেছনে চলল। মুসা। ভয় কেটে গেছে। অবাক হয়ে ভাবছে, এতগুলো বছর একা টেরর ক্যাসলে কি করে বাস করল। জন ফিলবি আরও অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করছে মনে, কিন্তু জবাব খুঁজে পাচ্ছে না ওগুলোর।

প্যাসেজের শেষ মাথায় দরজার কাছে চলে এল ওরা। অবাক কাণ্ড ধাক্কা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ওপাশে গাঢ় অন্ধকার। কি আছে না আছে, আলো না জ্বেলে বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ বেড়ে গেল যেন বাজনার শব্দ। দেয়ালে প্ৰতিহত হচ্ছে। একটা বড় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা।

প্রোজেকশনরুম, ফিসফিস করে মুসার কানের কাছে বলল কিশোর। আলো জ্বেল না। চমকে দিতে হবে ওকে।

দেয়ালের ধার ঘেঁষে পাশাপাশি এগিয়ে চলল দুজনে। একটা কোণে এসে ঠেকল।

হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নরম হালকা কিছু একটা তার মুখ-মাথা পেচিয়ে ধরেছে। টেনে সরাতে গিয়েই বুঝল, মখমলের ছেড়া পর্দার কাপড়।

কোণ ঘুরে আবার এগোল ওরা। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল কিশোর। হাত চেপে ধরল মুসা। ভাঙা অর্গানের সামনে নড়াচড়া করছে স্নান নীল আলো। অন্ধকারেই বুঝতে পারল মুসা, ক্যামেরা রেডি করছে তার সঙ্গী।

পা টিপে টিপে এগোবে, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়াব। ছবি তুলব।

কাঁপা কাঁপা আলোটার দিকে চেয়ে রইল মুসা। হঠাৎই দুঃখ হল জন ফিলবির জন্যে। বেচারা এতগুলো বছর নিরাপদে কাটিয়ে বুড়ো বয়েসে একটা ধাক্কা খাবে। মুখোশ খুলে যাবে টেরর ক্যাসলের ভূতের।

ওকে ভয় পাইয়ে দিতে হবে, ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। নাম ধরে ডাকলেই তো পারি। বোঝাতে পারি, আমরা ওর শক্র নই, বন্ধু।

ভাল কথা, সায় দিল কিশোর। তবে এখন না। আরও কাছে গিয়ে ডাকব।

নীল আলোর দিকে আবার এগিয়ে চলল ওরা।

মিস্টার ফিলবি! হঠাৎ জোরে ডাক দিল কিশোর। মিস্টার ফিলবি, আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। বন্ধু।

কিছুই ঘটল না। বেজেই চলল। অর্গান, কাঁপতে থাকল নীল আলো।

মিসটার ফিলবি আরও কয়েক পা এগিয়ে আবার ডাকল কিশোর। আমি কিশোর পাশা। আমার সঙ্গে মুসা আমান। আপনার সঙ্গে শুধু কথা বলতে চাই।

থেমে গেল বাজনা।

জোরে কেঁপে উঠল একবার আলোটা। তারপর চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। ছাতের কাছে গিয়ে বুলে রইল।

আলোটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর আর মুসা। এই সময়ই টের পেল, কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পেছনে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটল ঘটনা। ক্যামেরা হাতেই ধরা রইল। কিশোরের। জ্বলে উঠল মুসার হাতের টর্চ। জালে আটকা পড়ে গেল দুজনে। মাথার ওপর থেকে নেমে এসেছে জাল। এতই আচমকা, কিছু করারই সুযোগ পেল না। ওরা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন আরব।

ছুটতে গেল মুসা। জালের খোপে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কার্পেটে ঢাকা মেঝেতে। পড়েই গড়ান খেল। পিছলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল জালের তলা থেকে। পারল না। আরও পেচিয়ে গেল। জালে আটকা পড়লে মাছের কেমন লাগে, অনুভব করতে পারল সে।

কি-শো-র! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আমাকে ছাড়াও!

সাড়া এল না।

ঘাড় ফেরাল মুসা। টাৰ্চটা হাতেই ধরা আছে। জ্বালল আবার। বুঝল, কেন সাড়া দিল না কিশোর।

আরেকটা জালে তারই মত আটকে পড়েছে কিশোর। ময়দার বস্তার মত তকে তুলে নিয়েছে দুই আরব। একজন ধরেছে পায়ের দিক, আরেক জন কাঁধ। এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে।

জালের ভেতর আটকা পড়ে ছটফট করছে মুসা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। গড়াগড়ি করে ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে ফেলল। নিজেকে।

চিত হয়ে পড়ে রইল মুসা। ছাতের কাছে এখনও আছে নীল আলো। কাঁপছে। গোয়েন্দা সহকারীর করুণ অবস্থা দেখে নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।

<

Super User