অন্ধকার হয়ে গেল। ফিরল না আম্মারা। অস্বস্তি বাড়তে লাগল আমার। যদিও চিন্তার কিছু নেই। একটা গরু পোড়াতে কতটা সময় লাগে তা তো দেখেছি। তেমন কোন বিপদেরও আশঙ্কা দেখছি না। বাড়ি থেকে বেশি দূরে যায়নি যে হারিয়ে যাবে। হারালেও সমস্যা নেই। জাম্পার রাস্তা চেনে। ইয়েলার তো রয়েছেই।

তবু অস্বস্তি গেল না আমার। খারাপ কিছু ঘটার বোধটা কিছুতেই সরতে চাইল না মন থেকে। আরলিস বাড়ি না থাকলে কি হয়েছে দেখার জন্যে বেরিয়ে পড়তাম। ওর খাবার সময় হয়েছে। খিদে পেলেই চেঁচানো শুরু করবে। তারপরেই ঘুম।

ওকে আর বাচ্চাটাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম। মোম জ্বেলে দিয়ে মাটিতেই বসালাম দুজনকে। একটা বাটিতে দুধ ঢেলে তার মধ্যে রুটি ভিজিয়ে দিলাম। একটু একটু করে এক বাটি থেকেই খেতে লাগল ওরা। এভাবে মানুষ আর কুকুরে এক পাত্র থেকে খাওয়া উচিত হচ্ছে না। সেটা জানে আরলিস। আমি তো জানিই। কিন্তু বারণ করলাম না। এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না।

আরলিস আর বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি। ওদের খাওয়া প্রায় হয়ে গেছে এই সময় একটা শব্দ কানে এল। কুকুরের ঝগড়ার মত। দরজায় এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকার বনের ওদিক থেকে আসছে শব্দটা। বেরিয়ে এলাম উঠানে। ওল্ড ইয়েলারের গলা চিনতে ভুল হলো না আমার।

মরণপণ লড়াইয়ের সময় ও এরকম চিৎকার করে। সেদিন আমাকে খেপা শুয়োরগুলোর কবল থেকে বাঁচানোর সময়ও এমন করেই চেঁচিয়েছিল।

ভয়ে কলজে কেঁপে গেল আমার। পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে। নড়তে পারছি না। কি হয়েছে? কি এমন হতে পারে? আমার কি করা উচিত?

হঠাৎ শুনতে পেলাম জাম্পারের ডাক। পরক্ষণেই চিৎকার করে আম্মা বলল, ট্র্যাভিস, আলো জ্বাল! বন্দুক নিয়ে আয়! জলদি কর!

ঝাকি খেয়ে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। সাড়া দিয়ে জানালাম তার ডাক শুনতে পেয়েছি। দৌড় দিলাম বন্দুক আনার জন্যে। কি ধরনের আলো দরকার বুঝতে পারলাম না প্রথমে। তারপর মনে এল ভালুক-ঘাসের কথা। এগুলোর জোগান রাখি আমরা। প্রয়োজন হয়। একধরনের তৈলাক্ত রস থাকে এই ঘাসে, অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে, উজ্জ্বল আলো দেয়।

দৌড়ে গিয়ে চার গোছা ঘাস টেনে বের করলাম। অল্প দিন আগে তোলা। ভাল করে শুকায়নি। শক্ত ঘাসের চোখা মাথা বিধল আমার হাতে, বুকে। কেয়ার করলাম না। সময় নেই। নিয়ে এসে ফেললাম উঠানের বেড়ার ধারে। তারপর ছুটলাম চুলা থেকে জ্বলন্ত কয়লা আনতে।

লোহার হাতা দিয়ে কয়লা এনে ঘাসের ওপর ঢেলে দিয়ে হ্যাট খুলে বাতাস করতে লাগলাম তাড়াতাড়ি ধরানোর জন্যে। পুড়লে বাজে গন্ধ বেরোয় এই ঘাস থেকে। যা খুশি বেরোক। এখন আমার আলো দরকার। প্রথমে মৃদু আগুন দেখা দিল, কাঁপল দু-একটা ধোয়াটে শিখা, হঠাৎ যেন বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের ফুল ফুটল।

লাফ দিয়ে সরে এলাম। বন্দুক তুলে নিলাম হাতে। তাকানোর সুযোগ পেলাম এতক্ষণে। আলোর সীমানায় ঢুকে পড়েছে লড়াকু জানোয়ার দুটো। একটা আমাদের ওল্ড ইয়েলার, আরেকটা একটা বুনো জানোয়ার।

আলোর বাইরে থেকে চিৎকার করে আম্মা বলল, সাবধান, ট্রাভিস! দেখে গুলি করবি! ওটা নেকড়ে, পাগল হয়ে গেছে!

ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। এতবড় নেকড়ে আমাদের এই এলাকায় সচরাচর দেখা যায় না। নিশ্চয় ধূসর নেকড়ে। ওগুলোর কথা অনেক শুনেছি। ভয়াবহ জানোয়ার। শোনা যায় গরু-ঘোড়াকেও মেরে ফেলতে পারে। আর ওরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করছে অসুস্থ ইয়েলার! এতক্ষণ টিকছে কি করে সে!

বন্দুক কাঁধে ঠেকিয়ে আম্মাকে বললাম, ঘরে ঢোকো। গুলি করতে পারছি না। কার গায়ে লেগে যাবে ঠিক নেই।

মহা গণ্ডগোল শুরু করে দিয়েছে জাম্পার। খালি এদিক ওদিক সরে যেতে চায়। বাড়ি মারল আম্মা। গুঙিয়ে উঠল ওটা। তবে এগোতে আর অরাজি হলো না। অনেকটা ঘুরে দৌড়ে এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। আমার পেছনে দরজায় আম্মার সাড়া পাওয়ার পরেও গুলি করতে পারলাম না। ইয়েলারের গায়ে লেগে যাওয়ার ভয়ে।

প্রচণ্ড লড়াই করছে ইয়েলার আর নেকড়েটা। ঘুরছে, লাফাচ্ছে, জড়াজড়ি, কামড়াকামড়ি করছে। আগুনের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওদের চোখ। সবুজ দেখাচ্ছে।

গড়াগড়ি শুরু করল দুটোতে। ইয়েলারের ওপর উঠে গেল নেকড়েটা। বুক দিয়ে চেপে ধরে কামড়ে ধরল গলা। এই আমার সুযোগ। এক গুলিতেই সাবাড় করতে হবে। বেশি সময় পাবে না ইয়েলার। এমনিতেই দুর্বল। দ্রুত আমি কিছু করতে না পারলে বিশাল নেকড়ের ভয়ঙ্কর কামড় থেকে নিস্তার নেই তার।

কাঁপা কাঁপা ওই আলোয় বন্দুকের মাছি আর নেকড়ের মাথা কোটাই ভাল দেখতে পাচ্ছি। লক্ষ্য স্থির করতে পারছি না। অনেকটা আন্দাজের ওপরই গুলি চালাতে হবে।

তা-ই করলাম। টিপে দিলাম ট্রিগার। আলগা করেই ধরেছিলাম বোধহয়, আমার কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত করল বন্দুকের বাট। নলের মাথা দিয়ে বেরোনো আগুনের ঝলকে অন্ধ হয়ে গেলাম যেন ক্ষণিকের জন্যে। ওপাশের কিছুই দেখতে পেলাম না।

তবে টের পেলাম গর্জন আর গরগর থেমে গেছে। দৌড় দিলাম। পাশাপাশি পড়ে আছে দুটো ধূসর শরীর।

ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো ইয়েলারকেও মেরে ফেলেছি। কিন্তু না, আমি ওর কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে নড়ে উঠল সে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসল। ভীষণ কাঁপছে। ওই অবস্থায়ই হাত চেটে দিল আমার।

এতটাই স্বস্তি বোধ করলাম, মনে হলো হঠাৎ করেই সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে আমার। ধপ করে বসে পড়লাম। আমিও কাঁপছি ইয়েলারের মত।

দৌড়ে এল আম্মা। একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। কি হয়েছিল বলল।

যা অনুমান করেছিলাম তা-ই। কাঠ জোগাড় করে গরুটাকে ভাল করে ঢেকে দিয়ে আগুন লাগাতে অনেক সময় লেগেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। লিজকে নিয়ে জাম্পারের পিঠে চেপে বাড়ি রওনা হলো। বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আর পানি খায়নি। খুব পিপাসা পেয়েছে। বার্ডসং ক্ৰীকের কাছে এসে পানি খাওয়ার জন্যে খচ্চরের পিঠ থেকে নামল দুজনে। উবু হয়ে বসে পানি খাচ্ছে, এই সময় নেকড়েটা এসে হাজির।

কি মনে হতেই ঝট করে চোখ তুলে তাকাল আম্মা। দেখে, একটা বিশাল কালো ছায়া ছুটে আসছে তাদের দিকে। গর্জন করে উঠল ছায়াটা। হাতের কাছেই একটা ডাল পড়ে ছিল। এক থাবায় ওটা তুলে নিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আম্মা। ঘুরিয়েই গায়ের জোরে নেকড়ের মাথায় মারল বাড়ি।

পড়ে গেল নেকড়েটা। ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ইয়েলার।

পড়িমরি করে দৌড়ে গিয়ে জাম্পারের পিঠে চেপে লিজকে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটল আম্মা। ওদের পিছু নিল নেকড়েটা। না ধরে ছাড়বে না। ধরে ফেলতও। পারল না ইয়েলারের জন্যে। বাধা হয়ে দাঁড়াল সে। গায়ের জোর অনেক কম তার, আকারেও ছোট। নেকড়েটার সঙ্গে পারার প্রশ্নই ওঠে না। তবু মরিয়া হয়ে লড়তে লাগল সে। বাধা দিয়ে চলল। জাম্পারের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল নেকড়েটাকে।

পাগল হয়ে গিয়েছিল ওটা, আম্মা বলল। না হলে ওরকম আচরণ করে না নেকড়েরা। সে যে কোন নেকড়েই হোক।

কথাটা আমিও জানি। বললাম, ইয়েলার যে ওকে কি করে ঠেকাল খোদাই জানে! ওর জন্যেই বাঁচলে আজ।

একটা মুহূর্ত চুপ করে থাকল আম্মা। তারপর বলল, আমরা বাঁচলাম। কিন্তু ওর মস্ত ক্ষতি হয়ে গেল, ট্রাভিস।

মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর। ঝট করে সোজা হলাম। কি বলো! ইয়েলার ঠিকই আছে। কয়েকটা জখম-টখম হয়েছে এই যা। ও সেরে যাবে। দেখলে না, হেঁটে চলে গেল ঘরের দিকে। জখমগুলো মারাত্মক না…

আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে যেন থেমে গেলাম। দেরিতে হলেও আম্মা কি বোঝাতে চেয়েছে বুঝে ফেলেছি। জমে যাচ্ছে যেন হাত-পা। দম নিতে পারছি না।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভীষণ ভয় পেয়েছি। সাংঘাতিক! কিন্তু আম্মা! চিৎকার করে উঠলাম, এই মাত্র তোমাদের জীবন বাঁচাল সে! আমাকে বাঁচিয়েছে সেদিন! আরলিসকে বাঁচিয়েছিল! ওকে আমরা…

উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল আম্মা। জানি, বাবা। কিন্তু কিছু করার নেই আমাদের। পাগলা নেকড়েতে কামড়েছে ওকে।

আগুন নিভে আসছে। অন্ধকারে পাক খেয়ে খেয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলাম এদিক ওদিক।

যেন আমি একটা ইঁদুর। খাঁচায় আটকে দেয়া হয়েছে আমাকে। মুক্তি পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছি।

আম্মা, নিজেকেই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছি, আমরা এখনও শিওর না। অপেক্ষা করে তো দেখতে পারি। বেঁধে রাখতে পারি, কোথাও ওকে ভরে আটকে রাখতে পারি। শিওর না হওয়া পর্যন্ত।

আর সইতে পারল না আম্মা। কেঁদে ফেলল। আমার কাঁধে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল গলা। চাপ লাগছে। প্রায় শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে আমার।

এই ঝুঁকি নিতে পারি না আমরা, বাবা, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল আম্মা। এর পরের শিকার তুইও হতে পারিস। কিংবা আরলিস, কিংবা আমি, কিংবা লিজ। তোর যদি কষ্ট হয়, আমিই গুলি করব ওকে। যে-ই করুক, কাজটা কাউকে না কাউকে করতেই হবে। একটুও আর দেরি করা উচিত না। ওর ছোঁয়াও এখন ভয়ঙ্কর। তোকে যে চাটল, তাতেও ভয় পাচ্ছি আমি।

মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার। বুঝতে পারলাম, আম্মা ঠিকই বলছে। ঝুঁকি নেয়া একদম ঠিক হবে না। নেকড়েটার যে জলাতঙ্কই হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাবতেও ভেতরটা চুরচুর হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু তবু আমি জানি, গুলিটা আমাকেই করতে হবে। জিইয়ে রেখে অহেতুক ইয়েলারকে কষ্ট দেয়ারও কোন মানে হয় না।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেই আর কোন দ্বিধা রইল না আমার। কোন অনুভূতিও যেন নেই। একেবারে ভোতা হয়ে গেছে মনটা। পাথর।

দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ালাম আগুনের কাছে। আবার গুলি ভরলাম বন্দুকে। ঘর থেকে ডেকে বের করে আনলাম ইয়েলারকে। ও কিছু বোঝার আগেই নলটা মাথায় ঠেকিয়ে টিপে দিলাম ট্রিগার।

<

Super User