পাশাপাশি ভেসে আছে মুসা আর রবিন। তল থেকে পাঁচ ফুট ওপরে। বিচিত্র শব্দ তুলে ব্রীদিং টিউব থেকে বেরিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে বুদবুদ। পাশ দিয়ে অলস ভঙ্গিতে ভেসে চলে গেল এক ঝাঁক সাগর-কই, ঢুকে পড়ল সামনে দেয়ালের গর্তে, হারিয়ে গেল অন্ধকারে।

মণি ছাড়া বিশাল এক চোখের মত দেখতে লাগছে। সুড়ঙ্গমুখটাকে। এক কোণ থেকে আরেক কোণের দৈর্ঘ্য বারো ফুট। চোখের মাঝামাঝি জায়গার উচ্চতা ফুট পাঁচেক। ধারগুলো মসৃণ, শেওলা জন্মাতে পারে না স্রোতের জন্যে।

সুড়ঙ্গমুখের বিশ ফুট দূরে পড়ে আছে পাপালোর নৌকাটা। দুলছে। জায়গা বদল করছে। ধীরে ধীরে। এগিয়ে আসছে। এদিকেই। সেদিকে একবার চেয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো রবিন। নৌকার প্রতি খেয়াল দেবার সময় নেই এখন।

দুই গোয়েন্দার হাতে টর্চ। সুড়ঙ্গে ঢুকতে ইতস্তত করছে।

পাপালোর কথামত, কোন বিপদ নেই গুহায়। কম্পাস খুঁজতে এসেছিল সে। পায়নি। উঠে যাবার সময়ই নজরে পড়েছে সুড়ঙ্গমুখটা। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এসেছে। ওটার কাছে। ঢুকে পড়েছে।

ভেতরের দিকে প্রথমে সরু হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। খানিকটা এগিয়ে পেছনে ফিরে চেয়েছে পাপালো। সুড়ঙ্গমুখ দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছে করলে ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু ফেরেনি সে। সামনে কি আছে, দেখার ইচ্ছে।

দম ফুরিয়ে আসতেই টনক নড়েছে পাপালোর। সামনে অন্ধকার, কি আছে কে জানে! পেছনে তাকিয়ে দেখেছে, অনেক দূরে আলো। এতদূর যেতে পারবে না, তার আগেই দম ফুরিয়ে যাবে।

আতঙ্কে ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল হাত-পা, দুই গোয়েন্দাকে বলছে পাপালো। কিন্তু মাথা গরম করলাম না। ফিরে যাবার চেষ্টা করলে মরবো। সামনে এগোলে হয়ত বেঁচে যাব। সুড়ঙ্গটা কোন গুহায় গিয়ে শেষ হলে বাতাস পেয়ে যেতে পারি। প্ৰাণপণে সাঁতরে চললাম। খানিকটা এগোতেই আলো চোখে পড়ল। ভরসা পেলাম। আলোর দিকে উঠতে লাগলাম। ভুসস করে মাথা ভেসে উঠল পানির ওপরে। দম নিয়ে তোকালাম চারদিকে। আবছা অন্ধকার। একটা গুহায় ঢুকেছি। আমি। দ্বীপের তলায়। শেওলায় ঢাকা একটা পাথুরে তাকে উঠে বসলাম। জিরিয়ে নিয়ে নামব ভাবছি, এই সময়ই হাতে লাগল শক্ত জিনিসটা। শেওলার ভেতরে আটকে আছে। কৌতূহল হল। তুলে নিলাম। ও মা! সোনা!! তালগোল পাকানো মোহরা গুহার তলায় অন্ধকার। দেখা যায় না। কিছু। আমার বিশ্বাস, আরও গুপ্তধন আছে ওখানে।

পানির তলায় গুহা, জলদস্যুর গুপ্তধন, আর কি চাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল দুই গোয়েন্দা, ঢুকবে ওখানে। কোনরকম সরঞ্জাম ছাড়া পাপালো যদি পারে, আধুনিক ডুবুরির সরঞ্জাম নিয়ে ওরা ঢুকতে পারবে না কেন? তাড়াতাড়ি চলে এসেছে এখানে। কিন্তু সুড়ঙ্গমুখের চেহারা দেখেই ভয় ঢুকে গেছে মনে। ইতস্তত করছে ভেতরে ঢুকতে।

এই সময় ওপর থেকে নেমে এলো পাপালো। দুই গোয়েন্দার পাশ কাটিয়ে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। আর দ্বিধা করার কোন মানে হয় না। যা থাকে কপালে, ভেবে, ঢুকে পড়ল দুজনে।

দুটো টর্চের জোরালো আলোয় অন্ধকার কেটে গেল। পরিষ্কার পানি, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের অনেক দূর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে সুড়ঙ্গ। পাথুরে দেয়ালের খাঁজে খাঁজে ভরি হয়ে জন্মেছে শেওলা। উজ্জ্বল আলোয় চমকে গেল মাছের দল। এদিক ওদিক ছুটে পালাল। অন্ধকার ছোট একটা গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা সবুজ মাথা।। হাঁ করা কুৎসিত মুখে খুরের মত ধারালো দাঁতের সারি। কুতকুতে চোখ। বান পরিবারের এক ভয়ানক সদস্য, মোরে ঈল। মাছটার ওপর চোখ রেখে অনেক দূর দিয়ে সরে এল দুই গোয়েন্দা।

পাপালোকে দেখা যাচ্ছে। অনেক সামনে রয়েছে সে। ওর মত তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটতে পারছে না। দুই গোয়েন্দা। পাথুরে দেয়ালে ঘষা লাগলে ছল চামড়া উঠে যাবে। টিউব কিংবা পিঠের ট্যাংকের ক্ষতি হতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হচ্ছে ওদের।

মাঝে মধ্যে উপরের দিকে টর্চের আলো ফেলছে ওরা। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল পাথরের দেয়াল। উঠতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। বিশ ফুট. তিরিশ ফুট… আচমকা মাস্ক বেরিয়ে এলো পানির ওপরে।

টর্চের আলো ফেলল দুজনে। একটা পাথরের তাকে উঠে বসে আছে পাপালো। পা দুটো বুলছে পানিতে। মাথার চার পাঁচ ফুট ওপরে গুহার ছাত এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ। পিচ্ছিল শেওলায় ঢাকা তাকে পাপালোর পাশে সাবধানে উঠেবসলো দুই গোয়েন্দা।

দ্য হ্যান্ডের পেটে এসে ঢুকেছি। আমরা, বলল পাপালো। কেমন লাগছে। গুহায় ঢুকে?

বেশ ভালই তো! জবাব দিল রবিন। আমাদের আগে নিশ্চয় এখানে কেউ ঢোকেনি!

চারদিকে টর্চের আলো ঘুরিয়ে আনল একবার রবিন। নির্দিষ্ট কোন আকার নেই গুহাটার। পানির সমতল থেকে ছাতের উচ্চতা একেক জায়গায় একেক রকম, চার থেকে ছয় ফুটের মধ্যে। গুহার এক প্রান্তে দুদিকের দেয়াল অনেক কাছাকাছি, মাঝে পরিসর কম। আলো আসছে ওদিক থেকেই।

টর্চ নিভিয়ে নিলো ওরা। আবছা আলো গুহার ভেতরে। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে কুলকুল শব্দ তুলছে পানি। দেয়ালের গা আঁকড়ে ধরে আছে সরু শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে, ওঠানামা করছে ভয়াবহ কোন অজানা দানবের রোম যেন। শিউরে উঠল রবিন। নিশ্চয় কোন ফাটল আছে গুহার ছাতে। আলো আসছে ওপথেই। গুহার দূরতম প্রান্তের দিকে চেয়ে বলল সে।

ফোয়ারা! প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল পাপালো। এবার বুঝেছি। ওই ফাটল দিয়েই পানি ছিটকে বেরোয় ঝড়ের সময়। কেউ জানে না, তলায় একটা গুহা আছে। লোকের ধারণা, ফাটলাটা সাগরের অতলে কোথাও নেমে গেছে।

ঠিক ঠিক! বলে উঠল রবিন। মনে পড়ল, দুরাত আগে ঝড়ের সময় কি করে পানি ছিটকে উঠেছিল টিলার চুড়ার ছিদ্র দিয়ে। অনেক আগেই ওই ফোয়ারা আবিষ্কার করেছে লোকে। জানত না, কেন শুধু ঝড়ের রাতেই পানি ছিটায় ওটা।

একটা কথা। হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। আমরাই যদি গুহাটা প্ৰথম আবিষ্কার করে থাকি, গুপ্তধন আসবে কোথা থেকে এখানে?

তাই তো! গুঙিয়ে উঠল মুসা। এটা তো ভাবিনি।

আমরাই প্রথম নই, তাই বা জনছি কি করে? প্রশ্ন রাখল পাপালো। এত হতাশ হবার কিছু নেই। একটা মোহর যখন পেয়েছি, আরও পাবার আশা আছে। রবিন, টর্চটা দাও তো, দেখে আসি।

ওপরে বসে ধীরে ধীরে পানির তলায় আলো নেমে যেতে দেখল দুই গোয়েন্দা।

মোহর লুকানোর জন্যে এরচে ভাল জায়গা আর হয় না, বলল মুসা। কিন্তু রবিন, মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। আমাদের আগেও কেউ এসেছিল এখানে।

তলায় নেমে গেছে পাপালো। এদিক ওদিক আলো নড়তে দেখল মুসা আর রবিন।

সময় কেটে যাচ্ছে। পাপালো আর ওঠে না। নিচে আলো নড়াচড়া করছে। নাহ্, দাম রাখতে পারে বটে। গ্ৰীক ডুবুরির ছেলে। ঝাড়া আড়াই মিনিট পরে উঠে এলো পাপালো। উঠে বসিল দুই গোয়েন্দার পাশে।

ঠিকই বলেছি, রবিন, বলল পাপালো। গুপ্তধন নেই এখানে। শামুক-গুগলির সঙ্গে কিছু কিছু এ-জিনিস আছে। মুঠো খুলে দেখাল সে।

অবাক হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা, পাপালোর হাতে দুটো মোহর।

ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গুপ্তধন নেই, তাহলে এগুলো কি?

আমি বলতে চাইছি, হাজার হাজার মোহর এক জায়গায় স্তুপ করে রাখা নেই। একটা দুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বালিতে।

হাত থেকে হাতে ঘুরতে লাগিল মোহর দুটো। ভারি। ধারগুলো বেশি ক্ষয়ে যায়নি এ-দুটোর।

মোট তিনটে পেলাম! বলল পাপালো। একেকজনের ভাগে একটা করে।

না, তুমি পেয়েছ। ওগুলো, প্রতিবাদ করল রবিন। তিনটেই তোমার।

এক সঙ্গে এসেছি। যে-ই পাই, সমান ভাগে ভাগ করে নেব, দৃঢ় গলায় বলল পাপালো। চল, তিনজনে যাই এবার। আরও পাওয়া যাবে। হয়ত নতুন আরেকটা নৌকা কিনতে পারব। বাবার চিকিৎসা করতে পারব। চল চল!

দ্রুত হাতে ফেস মাস্ক পরে নিল মুসা আর রবিন। পাপালোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল পানিতে।

তলার বালিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শামুক-গুগলি, ঝিনুক। নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাথুরে দেয়ালের কাছে চকচকে বস্তুটা দেখতে পেল মুসা। কান্ত হয়ে আছে একটা ডাবলুন, অর্ধেকটা ড়ুবে আছে বালিতে।

আলতো করে ফ্লিপার নেড়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল রবিন। শিগগিরই একটা ঝিনুকের তলা থেকে বেরিয়ে থাকা মোহরের অর্ধেকটা চোখে পড়ল। তুলে নিল ওটা।

উত্তেজিত হয়ে পড়ল তিন কিশোর। আরও মোহর আছে। এই গুহায়, বুঝতে পারল। সেগুলো খুঁজে বের করতেই হবে।

মোহর খুঁজতে খুঁজতে খিদে ভুলে গেল ওরা। সময়ের হিসেব রাখল না। এক ধার থেকে প্রতিটি ঝিনুক-শামুক উল্টে দেখতে লাগল। ফ্লিপার কিংবা হাতের নাড়া লেগে বালির মেঘ উঠছে মাঝে মাঝে, আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে দৃষ্টি। থেমে, বালি নেমে যাবার অপেক্ষা করতে হচ্ছে তখন। তারপরই আবার শুরু হচ্ছে খোঁজা।

দেখতে দেহকতে প্রায় দেড় ডজন মোহর বের করে ফেলল মুসা আর রবিন। একেকজনের ভাগে ছয়টা করে। হাতে আর জায়গা নেই। মুসার গায়ে টোকা দিল রবিন। ওঠার ইঙ্গিত করল। দাম ফুরিয়ে যাওয়ায় ওদের আগেই উঠে গেছে পাপালো।

তাকে উঠে এল তিন কিশোর। পানি থেকে দূরে তাকের এক জায়গায় রাখল। মোহরগুলো।

ঠিকই বলেছ, পাপু মাস্ক সরিয়ে বলল রবিন। মোহর আছে এখানে আরও আছে।

হ্যাঁ, আছে। আরও আছে, বলল পাপালো। হাসল। হাতের মুঠো খুলে দেখাল। শেওলার তলায় এই তিনটে পেয়েছি আমি।

মোট হল চব্বিশটা বলল রবিন। কিন্তু মোহরগুলো এই গুহায় এল কি করে!

সেটা পরে ভাবলেও চলবে, বলল মুসা। চল, আরও কিছু তুলে আনি।

নেশা বড় ভয়ানক ব্যাপার, বিশেষ করে গুপ্তধনের নেশা। হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ। সেই নেশায় পেয়েছে তিন কিশোরকে। পাগল হয়ে উঠেছে যেন ওরা। পুরো গুহার প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখতে লাগল ওরা। কি ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে, জানতেই পারল না।

স্রোতের টানে আস্তে আস্তে কাছে চলে এসেছে পাপালোর ভাঙা নৌকা। ছেলেদের বেরোনোর পথ বন্ধ করে দিয়ে বোতলের মুখে কর্কের ছিপির মত আটকে গেছে সুড়ঙ্গমুখে।

<

Super User