পালানোর চেষ্টা করলে অবশ্য সবাই ধরা পড়তো না, কিন্তু সে চেষ্টা করলো না ওরা। জনি আর মুসার কজি চেপে ধরলো টেড। অবাক হলো মুসা। সাংঘাতিক জোর লোকটার গায়ে। হাতই নাড়াতে পারছে না সে, এতো জোরে ধরেছে।
বেরিয়ে এলেন মিস্টার ডাউসন আর ডরি। কিশোরকে ধরলেন।
এখানে কি করছো? কাচের ঘর ভাঙলে কেন? রেগেমেগে বললো ডাউসন। ভাঙা ফোকর দিয়ে এখন আমাদের সমস্ত প্রজাপতি বেরিয়ে যাবে!
ছাড়ুন, হাত ছাড়ন, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো কিশোর। আমরা ভাঙিনি।
ও-ই ভেঙেছে! চিৎকার করে বললো টেড। আমি দেখেছি।
মোটেই দেখোনি, মিথ্যুক কোথাকার। ভাঙলে তো তুমি! এখন বলছো আমাদের নাম! পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জনি। ছাড়ো আমাকে। আমি জোনার কলিউড। ভালো চাইলে ছাড়ো আমাকে, নইলে আমার বাবা তোমার মুণ্ডু চিবিয়ে বাবে!
ও জনি, দাঁত বের করে হাসলো টেড। জোনার কলিউড। যার বাবা টেডকে খারাপ লোক বলে ফার্মে চাকরি দিতে চায় না। অথচ দিনমজুরী করাতে বাধে না। দাঁড়াও, এইবার পেয়েছি সুযোগ। অপমানের প্রতিশোধ নেববা আমি। মুরগী চুরি করতে আসার অপরাধে পুলিশ যখন তার ছেলেকে কান ধরে টেনে নিয়ে যাবে, তখন টের পাবে কে খারাপ আর কে ভালো।
ডাউসনকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিশোর, কিন্তু তিনিও কিছুই শুনতে চাইলেন না।
মুসা আর জনিকে টানতে টানতে ছাউনির দিকে চললো টেড। ডাউসন আর ডরিকে বললো, ওদেরকেও নিয়ে আসুন। সারারাত অন্ধকার ঘরে বন্দী থাকলে সকালে আপনিই তেজ কমে যাবে।
হাত ছাড়ানোর কোনো চেষ্টাই করলো না কিশোর।
এই সময় শোনা গেল কুকুরের ঘেউ ঘেউ।
রাফিয়ান! শান্তকণ্ঠে কিশোর বললো, কামড় খেতে না চাইলে হাত ছাড়ন।
রাফি! রাফি! চেঁচিয়ে ডাকলো মুসা। এদিকে আয়! আমরা এখানে!
এমন বিকট গর্জন করে উঠলো রাফিয়ান, টেড পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। লাফিয়ে কাছে চলে এলো। কামড় বসানোর আগে টেডের পায়ের কাছে মুখ এনে খটাস করে বন্ধ করলো হাঁ। ভয় দেখানোর জন্য। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেয়ে যে আওয়াজ হলো, তাতেই ভয়ে সিটিয়ে গেল টেড। কখন যে ছেড়ে দিলো মুসা আর জনিকে নিজেই বলতে পারবে না। ডাউসন আর ডরি কিশোরকে ছেড়ে দিয়ে আগেই দৌড় দিয়েছে দরজার দিকে।
টেডও তাদের পিছু নিলো। তেড়ে গেল রাফি।
চলো দেখি, কিশোর বললো, লোক দুটোর কি হলো?
কিন্তু নেই ওরা। ঘুসি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু গোলমালের সুযোগে গা ঢাকা দিয়েছে।
পালিয়েছে! জনি বললো। তো, এখন? আর তো কিছু করার নেই এখানে?
না, কিশোর বললো। আমরা ক্যাম্পে ফিরে যাবো। খুব একটা কিছু জানতে পারলাম না। শুধু জানা গেল, ডাউসন সত্যি কথাই বলেছেন, চশমাওয়ালা লোকটা ডরি নয়। টেড ডেনভার খারাপ লোক, বাজে লোকের সঙ্গে তার মেলামেশা…
এবং ওদেরকে কোনোভাবে সাহায্য করেছে, কিশোরের কথাটা শেষ করলো মুসা। ওদেরকে এখানে এনে লুকিয়েছে। কাজের বিনিময়ে পয়সা পায়নি। কিন্তু কাজটা কি করেছিলো?
জানি না। মাথা আর কাজ করছে না এখন। চলো, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কাল এসব নিয়ে ভাববো। জনি, বাড়ি চলে যাও।
অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে রবিন আর জিনা। কিশোরদেরকে দেখেই বলে উঠলো, কি ব্যাপার? কি হয়েছিলো? এতো রাত করলে? রাফি তাহলে ঠিকমতোই খুঁজে পেয়েছে তোমাদের?
এক্কেবারে সময়মতো, হেসে বললো মুসা। আমাদের দেরি দেখে পাঠিয়েছিলে, না?
হ্যাঁ, জিনা বললো। আমরাও যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রবিন বললো, আগে রাফিই যাক। ও যদি না ফেরে তাহলে আমরা যাবো। তা হয়েছিলো কি?
সব কথা ওদেরকে জানালো মুসা আর কিশোর।
অবাক কাণ্ড! রবিন বললো। হচ্ছেটা কি ওই প্রজাপতির খামারে! টেড ওই লোক দুটোকে কি সাহায্য করেছে? কিভাবে বের করা যায়, বলো তো?
হাজার চেষ্টা করেও টেডের কাছ থেকে জানা যাবে না, কিশোর বললো। দেখি, কাল আবার যাবো খামারে। টেড যদি তখন না থাকে, তার মাকে ফুসলেফাঁসলে কিছু কথা আদায়ের চেষ্টা করবো।
হ্যাঁ, ওই মহিলা নিশ্চয় অনেক কিছু জানে, রবিন বললো। দুজন লোককে কটেজে লুকিয়ে রেখেছিলো তার ছেলে। এর মানে ওদের খাওয়া মিসেস ডেনভারকেই জোগাতে হয়েছে। কিন্তু বলবে তো?
সেটা কাল দেখা যাবে। কথা বলতে আর ভাল্লাগছে না এখন। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।
পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো ওদের।
ভাঁড়ারে গিয়ে দেখা গেল, খাবার ফুরিয়েছে। কিশোর আশা করলো, জনি ওদের জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। আর যদি না-ই আসে, ওরাই যাবে ফার্মে, খাবার আনতে। রুটি, মাখন আর সামান্য পনির দিয়ে নাস্তা সেরে বসে রইলো জনির অপেক্ষায়।
এখান থেকে সোজা প্রজাপতির খামারে যাবো আমরা, কিশোর বললো। রবিন, মিসেস ডেনভারের সঙ্গে কথাবার্তা তুমিই বলবে। তোমার কথার জবাব হয়তো দিতে পারে। কারণ টাকাটা তুমিই তার হাতে দিয়েছে। কাজেই চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও কিছু বলে ফেলতে পারে।
ঠিক আছে, মাথা কাত করলো রবিন। তা যাবো কখন? এখনই?
দেখি আরেকটু। জনি আসে কিনা।
জনি এলো না। প্রজাপতির খামারে রওনা হলো গোয়েন্দারা।
কটেজের কাছে এসে সাবধান হলো ওরা। টেড-এর সামনে পড়তে চায় না। কিন্তু কটেজে সে আছে বলে মনে হলো না। এমনকি প্রজাপতি মানবদেরও দেখা
গেল না।
প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছে হয়তো, মুসা বললো। ওই যে, মিসেস ডেনভার। কতগুলো কাপড় ধুয়েছে দেখেছো? খুব পরিশ্রম হয়েছে বোধহয়। দড়িতে টানাতেই হাত কাঁপছে এখন। রবিন, যাও, ওকে সাহায্য করো।
মহিলার কাছে চলে এলো রবিন। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো, এই যে মিসেস ডেনভার, কেমন আছেন?…আহহা, অনেক কষ্ট হচ্ছে তো আপনার। দিন, আমি মেলে দিই। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। ডান চোখের চারপাশ কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। আরে, আপনার চোখে কি হলো?
মিসেস ডেনভারের কাছ থেকে কাপড়ের বালতিটা নিয়ে নিলো রবিন। বাধা দিলো না মহিলা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রবিনের কাজ দেখতে লাগলো।
মিস্টার ডাউসন আর মিস্টার ডরি কোথায়? জিজ্ঞেস করলো রবিন।
বিড়বিড় করে যা বললো মহিলা, বুঝতে বেশ অসুবিধে হলো রবিনের। কথার মর্মোদ্ধার করতে পারলো শুধু, দুজনে প্রজাপতি ধরতে বেরিয়েছে।
আপনার ছেলে টেড কোথায়? আবার প্রশ্ন করলো রবিন।
হঠাৎ ফোঁপাতে আরম্ভ করলো মহিলা। নোংরা অ্যাপ্রন তুলে মুখ ঢেকে এগোলো রান্নাঘরের দিকে।
আশ্চর্য! আনমনে বিড়বিড় করলো রবিন। হলো কি আজ মহিলার! কাপড় মেলা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি তার পেছনে পেছনে গেল সে। ধরে বসিয়ে দিলো রকিং চেয়ারটায়।
মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে রবিনের দিকে তাকালো মহিলা। তুমিই আমাকে ডলারটা দিয়েছিলে; না? রবিনের হাতে আলতো চাপড় দিয়ে বললো, খুব ভালো ছেলে তুমি। মনটা খুব নরম। জানো, কেউ ভালো ব্যবহার করে না আমার সঙ্গে। আর আমার ছেলেটা তো একেবারেই না। যখন তখন শুধু মারে।
আপনার চোখে ঘুসি মেরেছিলো, না? নরম গলায় সহানুভূতির সুরে বললো রবিন। কবে? কাল?
হ্যাঁ। টাকা চাইছিলো। ও সব সময় আমার কাছে টাকা চায়। আবার ফুপিয়ে উঠলো মহিলা। টাকা দিতে পারিনি বলে মেরেছে। তারপর পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল ওকে।
কি বললেন! পুলিশ! নিশ্চয় আজ সকালে। অবাক হয়ে গেছে রবিন। পায়ে পায়ে অন্যেরাও এসে দাঁড়িয়েছে দরজার কাছে, তাদের কানেও গেছে কথাটা।
পুলিশ বললো, সে নাকি চোর, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো মিসেস ডেনভার। মিস্টার হ্যারিসনের হাঁস চুরি করেছে। আগে এরকম ছিলো না আমার ছেলে। ওই শয়তান লোকগুলো এসেই তার সর্বনাশ করেছে, তাকে বদলে দিয়েছে।
কোন লোক? মহিলার হাড্ডি-সর্বস্ব হাতে হাত বুলিয়ে দিয়ে রবিন বললো, আমাদেরকে সব খুলে বলুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আপনাকে সাহায্য করবো।
ওই লোকগুলো তাকে নষ্ট করেছে!
কোন লোক? কোথায় থাকে ওরা? এখনও কি এখানে লুকিয়ে আছে?
ওরা চারজন, এতো নিচু গলায় বললো মহিলা, শোনার জন্যে মাথা নিচু করে কান পাততে হলো রবিনকে। আমার ছেলেকে এসে বললো, ওদেরকে যদি খামারে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে অনেক টাকা দেবে। বদলোক ওরা, নিশ্চয় কোনো খারাপ মতলব আছে, তখনই বুঝেছি। ওপরে আমার শোবার ঘরে বসে কানাকানি, ফিসফাঁস করতো ওরা, দরজায় আড়ি পেতে সব শুনেছি।
মতলবটা কি ওদের, জানেন?হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে গেছে রবিনের।
কোনো কিছুর ওপর নজর রাখছিলো ওরা। পাহাড়ের ওদিকের কোনো কিছুর ওপর। কখনও দিনে, কখনও রাতে। আমার শোবার ঘরটাও দখল করেছিলো ওরা, এখানে ঘুমাতো। আমি ওদের খাবার বেঁধে দিতাম। কিন্তু এর জন্যে একটা পয়সাও দেয়নি আমাকে। জঘন্য লোক!
আবার কাঁদতে লাগলো মহিলা। সবাই এসে ঘরে ঢুকেছে। কোমল গলায় সান্ত্বনা দিলো কিশোর, কাঁদবেন না, মিসেস ডেনভার। এর একটা বিহিত আমরা করবোই।
বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল এই সময়। জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন মিস্টার ডাউসন। তোমরা! আবার এসেছে! কিশোর আর মুসার ওপর চোখ পড়তে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। তোমাদের শাস্তির ব্যবস্থাও হয়েছে। পুলিশকে সব বলে দিয়েছি। আজ সকালে টেডকে যখন নিতে এসেছিলো তখন। রাতের বেলা আমার প্রজাপতির ঘর ভাঙো! মজা টের পাবে। কত্তোবড় সাহস, আবার এসেছে এখানে!
<