লম্বা, ঋজু-দেহী যুবক জিম বোম্যান। চওড়া কাঁধ। রোদে পোড়া মুখ। পাহাড় পর্বত-মরুভূমির সঙ্গে যেন রক্তের সম্পর্ক। কত বছর বয়েসে রাইফেল-পিস্তল চালাতে শিখেছে মনে নেই।
ইয়া বড় দুই শিক-কাবারের সঙ্গে বড় এক প্লেট সীমের বীচি খাওয়া শেষ করেছে জিম! প্লেটের কানার কাছে দু-চারটে লেগে আছে এখনও। একটা একটা করে তুলে মুখে পুরল। পরিষ্কার করে ফেলল প্লেট। তারপর হেলান দিল চেয়ারে। বাড়ি থেকে হাজার মাইল দূরে ছোট্ট শহর টাকার, অপরিচিত লোকজন।
রেস্টুেরন্টের দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকাল সে। বেঁটেখাটো, মোটা এক লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তার দিকে চেয়েই চমকে উঠল লোকটা, অস্ফুট শব্দ বেরোল মুখ থেকে। পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের অন্ধকারে।
অবাক হলো জিম। চোখ মিটমিট করে আরও এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। শ্রাগ করে কফির কাপ টেনে নিল নিজের দিকে। কেটলি থেকে ঢালতে শুরু করল কফি। এ-শহরে কেউ চেনে না তাকে, সে-ও কাউকে চেনে না।
বাইরে ঘোড়ার খুরের শব্দ হলো। দ্রুত সরে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ভাবটা এখনও কাটেনি জিমের। চিন্তিত ভঙ্গিতে কাগজ আর কাটা-পাতা বের করে সিগারেট বানাল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আবার হেলান দিল চেয়ারে। টেক্সাস থেকে বেরিয়েছিল গরুর পাল নিয়ে। চলে গিয়েছিল উত্তর-পশ্চিমের এক বড় শহরে। ওখান থেকে টাকারের দূরত্ব আড়াইশো মাইল। গরু বিক্রি করে পেয়েছে দশ হাজার ডলার। কোমরের বেল্টের গোপন ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছে বড় নোটগুলো। কিছু খুচরো রেখেছে প্যান্টের পকেটে, খরচাপাতির জন্যে। ফিরে চলেছে টেক্সাসে। লাভের টাকা ব্যাংকে রেখে দিয়ে বাকি টাকায় আবার গরু কিনবে। খাবার ও রাতের আশ্রয়ের জন্যে এসে উঠেছে এই ছোট্ট শহরে। ভোর হলেই চলে যাবে।
আবার খুলে গেল দরজা। রেস্টুরেন্টে এসে ঢুকল একটা মেয়ে, বেশ লম্বা। জিমের দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। সতর্ক দৃষ্টি। দ্রুত এগিয়ে এল টেবিলের কাছে। ‘পাগল হয়ে গেছ!’ ফিসফিস করে বলল সে, ‘বসে বসে খাচ্ছ এখানে। সারা শহরে টহল দিচ্ছে ডাগা গ্যালুশের লোক, তোমার জন্যে, তোমার শহরে ঢোকার অপেক্ষাই করছে ওরা।’
হাসল জিম। ‘ভুল করছেন, ম্যাডাম। আপনার মত সুন্দরী যার কথা ভেবে অস্থির হয়, সেই ভাগ্যবান মানুষটি আমি নই। আমি এখানে নতুন মাত্র ঘন্টাখানেক আগে এসেছি।’
এক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা, যেন ভূত দেখছে।
ঠিক এই সময় তৃতীয়বার খুলে গেল দরজা, এবার ঝটকা দিয়ে। ঘরে এসে ঢুকল একজন লোক। জিমের সমান লম্বা। তবে আরও হালকা-পাতলা। রাগে জ্বলছে কালো চোখের তারা। ‘সরো বেলিন্দা, সরে যাও ওর সামনে থেকে! খুন করব আমি ব্যাটাকে।’
কোমরের রিভলভারের কাছে হাত চলে গেছে লোকটার।
বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন জিমের শরীরে। কাত হয়ে গেল একপাশে, মেঝেতে পড়ছে। সেই অবস্থায়ই হাতে বেরিয়ে এল রিভলভার।
গুলির শব্দ হলো একবার। লম্বা লোকটার রিভলভারের।
জিমও গুলি চালাল, পর পর দুবার।
হঠাৎ স্থির হয়ে গেল আগন্তুক। ঝটকা দিয়ে বাঁ হাতটা উঠে এসে বুক চেপে ধরুল। বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। শ্বাস টানার চেষ্টা করছে, পারছে না। অকেজো হয়ে গেছে ফুসফুস। ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকল মাথা, হাত থেকে খসে পড়ে গেল রিভলভার, মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে।
উঠে দাঁড়াল জিম। চেয়ে আছে পড়ে থাকা লোকটার দিকে হঠাৎ ঘুরল মেয়েটার দিকে, প্রশ্নের তুবড়ি ছোটাল, ‘কে লোকটা? কি ঘটেছে এখানে? আমাকে কোন লোক বলে ভাবা হচ্ছে?’
‘তুমি..তুমি… জিম স্যাবার নও?’ গলা কাপছে মেয়েটার। চোখ বিস্ফারিত।
‘স্যাবার?’ মাথা নাড়াল জিম, ‘না। আমি জিম, তবে স্যাবার নই, বোম্যান। এর আগে কখনও আসিনি এ-শহরে।’
বাইরের রাস্তায় একাঁধিক লোকের ছুটন্ত পায়ের শব্দ হলো।
দুই লাফে আরও কাছে চলে এল বেলিন্দা। খপ করে চেপে ধরল জিমের হাত! ‘জলদি, জলদি আসুন। আপনার কথা শোনার অপেক্ষা করবে না ওরা। দেখলেই গুলি চালাবে! সব-ক’টা খুনে ডাকাত, ড্যাগা গালুশের লোক!’
জিমের পাশাপশি দৌড়াচ্ছে মেয়েটা। হোটেলে ঢুকে পড়ল। পেরোল একটা বড়সড় হলঘর। রেস্টুন্টের দরজা খুলে যখন হুড়মুড় করে ঢুকতে শুরু করেছে ভ্যাগার লোক, ওরা তখন বেরিয়ে পড়েছে পেছনের অন্ধকার গলিপথে।
বায়ে মোড় নিল বেলিন্দা। পাশে জিম। হোটেলটা পেরিয়ে এসেছে। সামনে আরেকটা বাড়ি। ওটার পেছনে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলা। জিমকে নিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। পাল্লা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল গাঢ় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে।
পাশের বাড়ির দরজার কাছে হাঁকডাক, শোরগোল শোনা যাচ্ছে। জোরে দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হলো একবার। রিভলভারটা এখনও হাতেই ধরা আছে জিমের। দ্রুতহাতে খুলে ফেলে দিল দুটো খালি খোসা, নতুন বুলেট ভরল চেম্বারে। ছয় গুলির ম্যাগাজিন। এমনিতে একটা গুলি কম করে ভরে রাখে সে, স্প্রিঙের আয়ু বাড়ানোর জন্যে। এখন ছটা পুরো করে রাখল।
‘এ-বাড়িতে ঢুকবে না?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল জিম।
‘না। এটা শেরিফের অফিস,’ জানাল বেলিন্দা। ‘আপনি যে ঢুকলেন? বেআইনী হয়ে গেল না?’
‘না। পার্ট-টাইম চাকরি করি আমি এখানে।’ দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা দরজার লাঠিটা তুলে জায়গা মত বসিয়ে দিল বেলিন্দা। ‘দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আসুন, বসে থাকুন। এখানে খুঁজতে আসবে না ওরা।’
অন্ধকারে হাত ধরে একটা টেবিলের কাছে জিমকে নিয়ে এল বেলিন্দা। চেয়ারে বসিয়ে দিল। আরেকটা চেয়ারে নিজে বসল।
জানালার কাছ থেকে দূরে রইল জিম। মেয়েটা বসেছে জানালার পাশে। আবছা আলোয় তার চেহারা অস্পষ্ট, শুধু আকৃতিটা চোখে পড়ছে। খুব সুন্দরী, রেস্টুরেন্টে লণ্ঠনের আলোয় ভাল করেই দেখেছে সে। বড় বড় ধূসর চোখ, বৃষ্টির পানির মত টলটলে পরিষ্কার। চমৎকার ফিগার।
‘কি ঘটছে এ-শহরে?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘আমাকে খুন করতে চাইল কেন লোকটা?’
‘আপনাকে নয়, জিম স্যাবারকে। অবিকল আপনার মত দেখতে। যমজ ভাই বলা যায়!’
‘সে এখন কোথায়? কেন খুন করতে চায় তাকে ওরা? যাকে মেরে রেখে এলাম, সে কে?’
চুপ করে রইল বেলিন্দা।
জিম বুঝল, মেয়েটা এখনও তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে যে জিম স্যাবার নয়, নিশ্চিত হতে পারছে না।
অবশেষে জবাব দিল বেলিন্দা, ‘যাকে খুন করলেন, সে মরগান কালফেন। খুন-খারাপিই ছিল পেশা। ড্যাগা গালুশের ভাড়াটে গুণ্ডা। স্যাবার ওকে চোর, খুনে বদমাশ বলে গাল দিয়েছিল। সামনে নয় অবশ্যই, ড্যাগার সঙ্গে কথা বলার সময়। মরগান একথা শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। ঘোষণা করে দিয়েছিল, স্যাবারকে দেখলে কুকুরের মত গুলি করে মারবে। এটা দিন চারেক আগের ঘটনা। এরপর থেকে আর স্যাবারকে দেখা যায়নি। শহরের সবাই ধরে নিয়েছে মরগানের ভয়ে পালিয়েছে সে। তবে এজন্যে কাপুরুষ ভাবছে না তাকে কেউ। মরগানের ভয়ে যে কেউই পালাতে পারে।’
‘আমি পালাতাম না।’
‘সে তো নিজের চোখেই দেখলাম।’
‘তাহলেই বুঝতে পারছেন, আমি স্যাবার নই,’ অন্ধকারেই হাসল জিম, ‘তার হাসিটা দেখতে পেল না বেলিন্দা। যাই হোক, ড্যাগা গালুশের সঙ্গে স্যাবারের শত্রুতাটা কি নিয়ে? গোলমাল তো নিশ্চয় একটা হয়েছে, নাকি?’
এখান থেকে উত্তরে ব্ল্যাক রক পাহাড়ের ওপাশে, এলডার ক্রীক বলে একটা জায়গা আছে। তিন পাশে পাহাড়। উপত্যকায় বেশ বড়সড় একটা তৃণভূমি। টাকার আর এর আশপাশে শুকনো অঞ্চল, পানির বড় অভাব। কিন্তু এলডার ক্রীকে পানি আছে। পর্বতের গা বেয়ে ঝর্না নেমে চলে গেছে মরুভূমির দিকে। সব সময় পানি থাকে ওতে। তবে মরুভূমিতে বেশিদূর এগোতে পারে না, একজায়গায় গিয়ে শুকিয়ে মরে যায় ঝর্না। অনবরত চলছে এই অবস্থা। ঝর্না যেখান দিয়ে বইছে, সেখানে চমৎকার ঘাস জন্মায়। উপত্যকাটার মালিক ছিল…’
‘জিম স্যাবার?’
‘কি করে বুঝলেন?’
‘অনুমান।’
‘আপনার অনুমান ভুল। জায়গাটার মালিক ছিল এক বৃদ্ধ, বিল হার্ভে। দিন বিশেক আগে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেছে। পাকা ঘোড়সওয়ার ছিল, ঘোড়া থেকে তার পড়ে মরাটা একেবারেই অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য। যাই হোক, তার মৃত্যুর পর উইল খুলল উকিল। দেখা গেল, জায়গাটা ভাতিজা-ভাস্তিকে দিয়ে গেছে হার্ভে। নিউ ইয়র্কে থাকে দু-ভাইবোন। এখানে কোনদিনই আসবে না। জায়গাটা বিক্রি করে টাকাটা নিউ ইয়র্কে পাঠিয়ে দেবার অনুরোধ করে গেছে, দায়িত্বটা উকিলের ওপর। জায়গা কেনার ব্যাপারে দু-জন মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে গেছে সে। প্রথমজন জিম স্যাবার। পয়লা কিস্তিতে দশ হাজার ডলার দিতে হবে, তারপর ছ-বছরে শোধ করতে হবে বাকি চল্লিশ হাজার ডলার।’
‘তারমানে, মিস্টার হার্ভে চেয়েছেন জায়গাটা স্যাবারই কিনে নিক? এ-জন্যেই প্রথম সুযোগ দেয়া হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। দ্বিতীয় সুযোগ আমার। আমরা দুজনে কেউই যদি কিনতে না পারি, কিংবা কিনতে রাজি না হই, কেবল তখনই নিলামে উঠবে হার্ভে-র্যাঞ্চ। আর নিলাম হলে মালিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রাস্টি কানাহান কিংবা হোরউইক বেন্টলির। প্রচুর টাকা ওদের। এখানে এত টাকা আর কারও নেই, নিলাম ডেকে ওদের দুজনের সঙ্গে পারবে না কেউ।’
বাইরে কমে আসছে হই-চই। নির্জন হয়ে আসছে রাস্তা।
কান পেতে শুনল বেলিন্দা। ‘মনে হয়, খোজাখুঁজি বন্ধ করে দিয়েছে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আংকেল হার্ভের খুব ইচ্ছে ছিল, র্যাঞ্চটা স্যাবারের হাতেই যাক। ওটার ফোরম্যান ছিল সে, র্যাঞ্চের উন্নতির জন্যে অনেক কিছু করেছে, অনেক খেটেছে। হার্ভে-র্যাঞ্চ গড়ে ওঠার পেছনে অনেক অবদান রয়েছে তার। আমি অবশ্য র্যাঞ্চটার জন্যে কিছু করিনি, তবে ভালবাসতাম। আংকেলকেও বাসতাম। সে-ও আমাকে পছন্দ করত, ভালবাসত, অনেকটা মেয়ের মত। তাই আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়ে গেছে। কিন্তু আমার টাকা নেই। ডাকাতগুলো জানে সেটা। আমাকে গোণায়ই ধরে না সে-জন্যে। কিন্তু জিমের কাছে কিছু টাকা ছিল। বাকিটা জোগাড় করতে পারত। ওর পেছনে লাগার হয়তো এটাই প্রধান কারণ। ওই ড্যাগা দস্যুটাই মরগানকে লেলিয়ে দিয়েছে জিমের পেছনে। খুন করতে পাঠিয়েছে। মরগানকে গালাগাল করেছে জিম, এটা একটা ছুতো, খুন করার বাহানা মাত্র, আর কিছু না।’
‘এর মধ্যে ড্যাগার কি লাভ? সে-ও কিনতে চায়?’
‘চায় তো বটেই। তারও টাকা আছে, তবে রাস্টি কিংবা বেন্টলির ধারেকাছেও না। আমার বিশ্বাস, কোন ভাবে কায়দা করে র্যাঞ্চটা দখল করতে চায় সে। আপাতত রাস্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। তবে শেষ পর্যন্ত কে যে কাকে ঠকিয়ে বসবে, কিছুই বলা যায় না।’
‘বেন্টলি?’
‘বেন্টলি নির্লোভ মানুষ। ভাল মানুষ। আর যাই করুক, অন্তত ঠকাঠকির মধ্যে যাবে না। হয়তো দেখা যাবে, শেষ পর্যন্ত কিনতেই রাজি হলো না র্যাঞ্চটা। আসলে, তার দরকারও নেই ওটার।’
‘তার মানে জিম আর রাস্টিই এখন ড্যাগার পথের কাঁটা? বুড়ো হার্ভে তো মারাই গেছে…’
জিমের কাছে ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এ-ধরনের ষড়যন্ত্র আরও হতে দেখেছে সে, যদিও নিজে সে সবে জড়ায়নি কখনও। এসব মরু অঞ্চলে পানির সাংঘাতিক অভাব, গরুমোষ যারা পালে, তাদের কাছে পানি সোনার চেয়েও দামী…
হঠাৎ জিমের হাত খামচে ধরল বেলিন্দা। বাইরে কথা শোনা যাচ্ছে।
‘নাহ, ব্যাটা পালিয়েছে,’ বলল একজন। ‘বুড়ো বেন কসম খেয়ে বলেছে, সঙ্গে শুধু বেলিন্দা ছিল, আর কেউ না। সামনা-সামনি মরগানকে গুলি করে মারবে মেয়েটা, এ ভাবাই যায় না। তারমানে জিমই গুলি করেছে। সেটাও আরেক আশ্চর্য! সে এতবড় গানম্যান কোন দিন ছিল না!’
‘ছিল তো না-ই। আর হঠাৎ করে হয়ে যাবে, সেটাও সম্ভব না,’ বলল আরেকটা কণ্ঠ। এমন খসখসে গলা, মনে হয় শিরিষ কাগজ দিয়ে কাঠ ঘষা হচ্ছে। ‘ও জিম স্যাবার নয়, রাস্টি! হত
জিমের কানে কানে বলল বেলিন্দা, ‘ড্যাগা গালুশ!’
‘কিন্তু বেন যে কসম খেল! বলল রাস্টি, একবার কারও চেহারা দেখলে ভোলে না বুড়ো…’
‘ভুলুক আর না ভুলুক, আমি বলছি ও জিম স্যাবার নয়!’ অধৈর্য শোনাল ড্যাগার কণ্ঠ। ‘সে হলে মরগানকে দেখলেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলত, থাক তো গুলি করা-রিভলভার চালাতে জানে নাকি সে? দশবার গুলি করলে নয়বারই মিস… ওই লোক টেক্কা দেবে মরগানের সঙ্গে? অসম্ভব! আমি বিশ্বাস করি না।’
‘তাহলে কে মারল মরগানকে?’
‘মরেছে যখন, কেউ তো নিশ্চয় মেরেছে… মরগানকে ঢুকতে দেখেই গুলি করে বসেছে…’
‘বুড়ো কিন্তু সে-কথা বলেনি। সে বলেছে, আগে গুলি চালিয়েছে মরগান। মিস করেছে। তারপর গুলি করেছে জিম। তাজ্জব হয়ে গেছে সে। ওরকম গানম্যান নাকি কমই দেখেছে…’
‘লোকটা যে জিম স্যাবার নয়, আরও শিওর হলাম।’
‘কিন্তু চেহারা…’
‘জাহান্নামে যাক চেহারা।’ সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে না পেরেই যেন রেগে গেল ড্যাগা। সামলে নিল সঙ্গে সঙ্গেই। কণ্ঠস্বর কিছুটা কোমল করে বলল, ‘আর মাত্র তিন দিন বাকি। বেলিন্দা টাকা জোগাড় করতে পারবে না। জিম স্যাবারও আর ফিরবে না। অহেতুক ঝামেলা না করে আমাদের এখন উচিত চুপ করে বসে থাকা। ওরা টাকা জোগাড় করে আগে আসুক, তারপর দেখব কি করা যায়। কেনার সামর্থ্যই নেই যাদের, তাদের সঙ্গে শুধু শুধু লাগতে যাচ্ছি কেন আমরা?’
‘তা-ও কথা ঠিক,’ কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল, নিশ্চিন্ত হতে পারছে না রাস্টি। বাইরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বুটের শব্দ।
চুপচাপ বসে আছে জিম। তারার আবছা আলো কাচের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। অন্ধকারও সয়ে এসেছে চোখে। বেলিন্দার চেহারা আবছামত দেখতে পাচ্ছে এখন সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসেছে মেয়েটার। ছোট্ট অফিসের কোথায় কি আছে, তা-ও আবছাভাবে চোখে পড়ছে। একটা টেবিল, খানকয়েক চেয়ার, একটা ফাইল রাখার আলমারি। একপাশে বুক-কেস, বইয়ে ঠাসা।
উঠে দাড়াল জিম। হোটেলে যেতে হবে আমাকে। জিনিসপত্র সব রয়ে গেছে, ঘোড়াটাও ওখানেই।
‘আপনি…আপনি চলে যাবেন?’ জিমের চলে যাওয়াটাই যে স্বাভাবিক, যেন ভুলে গেছে বেলিন্দা।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল জিম। ‘নিশ্চয়! এটা আরেকজনের লড়াই, আমার নয়। ইতিমধ্যেই একজনকে খুন করে বসে আছি। এখানে থাকলে আরও ক’জনকে করতে হবে, কে জানে। নিজেও হয়ে যেতে পারি…’
‘একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন?’ জিমের কথাগুলোকে বেলিন্দা খুব একটা গুরুত্ব দিল বলে মনে হলো না। ‘জিম স্যাবার যে ফিরবে না, এ-ব্যাপারে ড্যাগা নিশ্চিত কি করে হলো? আপনাকে না দেখেও বলে দিতে পারল, আপনি স্যাবার নন।’
ভ্রুকুটি করল জিম; ‘করিনি, তা নয়। তবে মাথা ঘামাচ্ছি না। জিম ফিরে আসুক বা না আসুক, তাতে আমার কি?’
চুপ হয়ে গেল বেলিন্দা।
আবছা অন্ধকার অফিস ঘর। বেলিন্দার এই নীরবতায় অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জিম! বুঝতে পারছে, বেশি রুক্ষ হয়ে গেছে তার কথাগুলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যাবার মারা গেলে আপনার অসুবিধে কি?’
‘ভাই মারা গেলে বোনের যে অসুবিধে হয়।’
‘স্যাবার আপনার ভাই!’
‘মায়ের পেটের নয়। রক্তের সম্পর্কও ছিল না। কিন্তু ও আমাকে ছোট বোনের মত ভালবাসত। সে র্যাঞ্চটা কিনতে পারলে আমিও ওখানে ঠাঁই পেতাম। ও আমাকে সাহায্য করতই।’
‘আপনজন কেউ নেই আপনার এখানে?’
‘এখানে কেন, দুনিয়ার কোনখানেই নেই। আমি একেবারে একা,’ থেমে গেল বেলিন্দা। ‘কি বলছি। এসব কথা আপনি শুনে কি করবেন? আসলে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে নির্ভরতা চলে এসেছিল আপনার ওপর…’
‘অন্য কেউ ব্যাঞ্চের মালিক হলে আপনার খুব অসুবিধে হবে?’
‘আমার আর কি হবে? আমি যেমন আছি, থাকব। জিম হলে সুবিধে হত, এই আরকি। ক্ষতি যাদের হবে, তারা র্যাঞ্চের কর্মচারী। অনেক পুরানো লোক, বহুদিন ধরে আছে। একজনকেও রাখবে না রাস্টি। সবাইকে বিদেয় করে দিয়ে নিজের লোক ঢোকাবে। আমাদের তো পছন্দ করতই, ওদের মুখের দিকে চেয়েও জিম আর আমাকে র্যাঞ্চটার মালিক করতে চেয়েছিল আংকেল হার্ভে।’
‘হু,’ এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার বদল করল জিম, ‘আপনার মনোকষ্টের কারণ বুঝতে পারছি। জিমের কথা ওরকম করে বলা উচিত হয়নি আমার। না জেনে দুঃখ দিয়ে ফেলেছি, সরি।’
দরজার কাছে পৌঁছে ফিরে তাকাল সে। ‘রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে আনার জন্যে ধন্যবাদ।’
জবাব দিল না বেলিন্দা।
এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল জিম। কান পেতে শুনল বাইরে শব্দ আছে কিনা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল। আস্তে করে পেছনে ভিড়িয়ে দিল পাল্লা। সময় নষ্ট করতে চায় না। ভোরের আলো ফোটার আগেই চলে যেতে হবে শহর থেকে অনেক দূরে লোকজনের লড়াইয়ে নাক গলানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তার কোনও স্বার্থ নেই। কেন শুধু শুধু মরার ঝুঁকি নেবে? মেয়েটাকে সাহায্য করতে পারত, থেকে যাবার পক্ষে একটা কারণ হতে পারত সেটা। কিন্তু র্যাঞ্চের মালিকই হয়নি এখনও বেলিন্দা, কিনে নেবার টাকাও নেই। তার সঙ্গে বিরোধ নেই কারও, কোনরকম বিপদে পড়েনি; কি সাহায্য করবে তাকে জিম?
দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে হোটেলের পেছনের দরজায় এসে দাড়াল সে। চট করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। নিরাপদেই এসে ঢুকল নিজের ঘরে। রাতের জন্যে ভাড়া নিয়েছিল ঘরটা। না, তার জিনিসপত্র কেউ ছোঁয়নি। যেটা যেখানে যেভাবে রেখেছিল, সেভাবেই আছে। কোটটা তুলে নিয়ে জিনের সঙ্গে আটকানো ব্যাগে ভরল। তুলে নিল দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা রাইফেল। ব্যাগসুদ্ধ জিন কাঁধে তুলে নিয়ে রাইফেল হাতে বেরিয়ে এল ঘর থেকে বেড়ালের মত নিঃশব্দে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। পেছনের দরজা দিয়েই বেরিয়ে এসে নামল আবার গলিপথে।
অন্ধকার, নীরব, নির্জন পথ! ড্যাগা গালুশ তার দলবল নিয়ে কোথায় গেছে, জানে না সে। কাউকে চোখে পড়ছে না কোথাও। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে অসতর্ক হলো না। পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল আস্তাবলের দিকে, বাড়ির ছায়ায় গা ঢেকে।
চওড়া দরজা, ভেতরে আলো জ্বলছে। দাঁড়িয়ে পড়ল জিম। ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই। ঘোড়াটা রয়েছে আস্তাবলের ভেতর, ওটা বের করে আনতে হবে। দরজার পাশের অন্ধকার ছায়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে আরেকবার তীক্ষ্ণ নজর বোলাল সে, কাউকে চোখে পড়ল না। চট করে ঢুকে পড়ল আস্তাবলের খোলা দরজা দিয়ে।
বিশাল কালো একটা ঘোড়া। জিন পরাতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগল। লাগাম ধরে টেনে ঘোড়াটাকে নিয়ে চলে এল দরজার কাছে। ঘোড়ায় চড়তে যাবে, এই সময় জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ, ‘চলে যাচ্ছ?’
রাস্টি কানাহানের গলা।
থমকে গেল জিম! ধীরে, অতি ধীরে জিন থেকে হাত সরিয়ে আনল। ফিরে তাকাল। একটা খড়ের গাদার ওপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল ওখানে।
‘কেন নয়?’ মুখে হাসি ফোটাল জিম। অকারণে মানুষ খুন পছন্দ করি না। আমি। তাছাড়া এখানকার লোকও নই। অহেতুক গণ্ডগোলে জড়াব কেন? আমার বাড়ি টেক্সাসে, সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।’
মৃদু হাসল রাস্টি। ‘বুদ্ধিমান হলে সেটাই করা উচিত। তবে টাকা কামানোর সুযোগ ছাড়াটাও বোকার কাজ, যদি ক্ষমতা থাকে? পাঁচ হাজার ডলার দেব আমি তোমাকে, নগদ পাঁচ।’
‘পাঁচ হাজার!’ চোখ মিটমিট করল জিম। তার বেল্টে এখন যা রয়েছে, তার অর্ধেক। দশ হাজার কামাতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে তাকে, অনেক পরিশ্রম করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গরুর পালসহ পাড়ি দিয়েছে হাজার মাইল অতি-দুর্গম পথ। রক্তপানি করা টাকা ওগুলো।
শান্তকণ্ঠে বলল, ‘পাঁচ হাজার অনেক টাকা। কেন দেবেন আমাকে?’
আবছা অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে এল রাস্টি। কাছে এসে দাঁড়াল। চামড়ার রঙ দেখে মনে হয় মরচে-পড়া। রাস্টি অবশ্য তার নাম নয়, লোকে দিয়েছে, ওই মরচের মত রঙের কারণে। ওর নাম আসলে বিল কানাহান।
‘কাজ তো অবশ্যই করতে হবে তোমাকে। শুধু শুধু কি আর টাকা দেয় কেউ। তবে তেমন কঠিন কিছু না, বলল রাস্টি। তুমি যা আছ তাই থাকবে, জিম স্যাবার…’
‘আমি স্যাবার নই।’
‘জানি। সেটা এখানকার কাউকে বুঝতে দেবে না। জিম স্যাবার সেজে থাকবে, এবং সেজন্যেই টাকাটা দেয়া হবে তোমাকে। র্যাঞ্চটা আমি কিনে নেয়ার পর তোমার পারিশ্রমিক দিয়ে দেব। যেখানে খুশি চলে যেয়ো।’
ও, এই ব্যাপার। এখনই ড্যাগার সঙ্গে বেঈমানী করার ফন্দি এঁটেছে রাস্টি! কৌশলে জিমকে দিয়ে র্যাঞ্চটা কিনিয়ে নেবে।
দ্বিধা করছে জিম। টাকা যেমন, ঝুঁকিও তেমন। রাস্টির পক্ষ নিলে সে ড্যাগার শত্রু হয়ে যাবে। ড্যাগা তখন গুণ্ডা লেলিয়ে দেবে তার পেছনে। খুন করাবে। রাস্টিকেও একবিন্দু বিশ্বাস নেই। পাঁচ হাজার ডলার তাকে দেয়ার চেয়ে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার বুকে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়ার জন্যে অন্য কাউকে খুব সামান্য কিছু দিয়ে দেবে। ব্যস, কাজও উদ্ধার হবে, টাকাও বাঁচবে।
জিমের চুপ করে থাকাটাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিল রাস্টি। বলল, ‘ভয় নেই, তোমাকে লুকিয়ে রাখা হবে। পাহাড়ের ওপর একটা কেবিন আছে আমার। চার পাঁচজন লোকও আছে। গানম্যান হিসেবে খুব একটা খারাপ বলতে পারবে না ওদের। পাহারা দিয়ে রাখবে তোমাকে। সময় হলে বেরিয়ে আসবে তুমি। টাকা নিয়ে পকেটে ভরবে। কয়েকটা কাগজ সই করে দিয়ে চলে যাবে নিজের পথে। খুব কি কঠিন কাজ?’
‘না, বেশি সহজ, সেজন্যেই ভাবছি। জিম স্যাবারের সই ওরা মিলিয়ে দেখবে না?’ দ্রুত চিন্তা চলছে জিমের মাথায়। টাকার জন্যে এতবড় একটা অন্যায় করবে কিনা ভাবছে।
‘জীবনে তিন-চারটের বেশি সই করেনি জিম স্যাবার,’ হাসল রাস্টি। হাসিটাও কেমন যেন মরচে-পড়াই মনে হয়। ‘খোঁজ নিয়েছি, ওসব কাগজপত্রেরও কোন চিহ্ন নেই।’
একজন বৃদ্ধ, সৎ মানুষের আজীবন পরিশ্রমের ফসল ওই হার্ভে-র্যাঞ্চ। কয়েকজন অর্থলিন্দু ডাকাত ওটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে ভাবতেই রাগ হতে লাগল জিমের। স্যাবারকে খুন করেছে ড্যাগা, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই। বৃদ্ধ হার্ভের ঘোড়া থেকে পড়ে মরাটাও হয়তো দুর্ঘটনা নয়-খুন। দুর্ঘটনার মত করে সাজানো হয়েছে। বেলিন্দার কথাগুলো কানে বাজতে লাগল : আপনি চলে যাবেন!… জিম আমাকে ছোটবোনের মত ভালবাসত, সে র্যাঞ্চটা পেলে আমিও ওখানে ঠাঁই পেতাম… পুরানো কর্মচারী সব বিদেয় করে নতুন লোক রাখবে রাস্টি…’
কি করবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না জিম। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘চলুন, কোথায় যেতে হবে?’
বার্টলেট পিকের উত্তর ঢালে চুড়ার কাছাকাছি তৈরি করা হয়েছে কেবিনটা। চারপাশে ঝোপঝাড় আর পাথরের টিলার জন্যে পাহাড়ের গোড়ায় দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে না ওটা। এখানেই জিমকে রেখে গেল রাস্টি কানাহান। নিজের চারজন লোক রেখে গেল পাহারায়। দু-জন রইল কেবিনের সামনের ছোট্ট চত্বরে। অন্য দু-জন নিচে, শহরের দিক থেকে আসা পাহাড়ে চড়ার পথের ওপর। ওদের চোখ এড়িয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না কেবিনে।
রাত কাটল। পরের সারাটা দিন কেবিন আর বাইরের চত্বরে শুয়ে-বসে কাটাল জিম। একের পর এক সিগারেট ধ্বংস করল, গল্প করল দুই পাহারাদারের সঙ্গে।
একজনের নাম টম মর্সি, বিগ টম বলে ডাকে সবাই। প্রায় সাত ফুট লম্বা বিশাল এক দানব। ফোলা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সব সময় মেজাজ খারাপ থাকে। কথা বলে কম। হুঁ-হা আর ঘেঁৎ-ঘোৎ দিয়ে বেশির ভাগ প্রশ্নের জবাব সারে। দ্বিতীয় লোকটা ঠিক তার উল্টো। নাম, কিপ লিনটন। বেঁটেখাটো শরীর, বিশাল বুকের ছাতি, অনেকটা মঙ্গোলিয়ান ছাদের চ্যাপ্টা মুখ। হাসি লেগেই আছে ঠোঁটে। বকর বকরও করতে পারে প্রচুর।
এখানে থাকলে তার ভাগ্যে কি ঘটবে নিশ্চিত হয়ে গেছে জিম। টাকা তাকে ঠিকই দেবে রাস্টি, তবে সে-টাকা নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেবে না। শহর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে খুন করার চেষ্টা করবে। সেটা করতে পারলে যার টাকা আবার তার পকেটেই ফিরে যাবে।
তবে রাস্টিকে পরোয়া করে না জিম। কচি খোকা নয় সে। এমন বিপদে এর আগেও পড়েছে, বেরিয়ে এসেছে নিজের ক্ষমতায়। যত ভয়ঙ্কর বিপদই আসুক, রুখে দাঁড়ানোর সাহস তার আছে।
থেকে থেকেই বেলিন্দার কথা মনে আসছে। রাতের অন্ধকারে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল দু-জনে। বাহুতে নরম হাতের ছোঁয়া লেগে আছে যেন এখনও। কানে বাজছে চাপা নিঃশ্বাসের শব্দ। ধূসর বড় বড় চোখ। মেয়েটা সত্যি সুন্দরী।
একটা ইচ্ছে লুকোচুরি খেলছে মনের কোণে। শেকড় গাড়ার আগেই খেলাটা বন্ধ করতে চাইছে সে, পারছে না। ভাবনাটা হার্ভে-র্যাঞ্চ ও বেলিন্দাকে নিয়ে।
স্যাবার মৃত। র্যাঞ্চটা কেনার সামর্থ্য যে তিনজনের আছে তারা হলো বেন্টলি, রাস্টি, এবং ড্যাগা গালুশ। প্রথমজনের দেখা এখনও পাওয়া যায়নি, অবতীর্ণ হয়নি রঙ্গমঞ্চে। কাজেই তাকে রাঞ্চের ব্যাপার থেকে আপাতত বাদ রেখে দেয়া যায়। নিজেরা নিজেরা মারামারি করে মরবে বাকি দু-জনের অন্তত যে কোন একজন। দু জনও যেতে পারে, কিন্তু ধরা যাক একজন বাঁচল। যে বাঁচবে, তার হাত থেকে র্যাঞ্চটা আদায় করতে হলে লড়তে হবে বেলিন্দাকে।
হার্ভে-র্যাঞ্চের যারা বর্তমান কর্মচারী, দীর্ঘদিন ধরে ওখানে কাজ করছে তারা প্রায় সবাই পুরানো। এই মুহূর্তে ওদের কাজ চলে যাওয়ার মানে নিশ্চিন্ত একটা ঠাই থেকে অকস্মাৎ বঞ্চিত হওয়া। হঠাৎ করে যাবে কোথায় ওরা? কি করবে? সাংঘাতিক বেকায়দায় পড়ে যাবে। এই এলাকায় কাজের বড় অভাব। চট করে আরেকটা জোগাড় করা কঠিন, আর তা করতে না পারলে না খেয়ে মরতে হবে। এটা ঘটতে দেয়া যায় না। কারও ক্ষমতা থাকলে এই অন্যায় তার ঠেকানো উচিত।
কেবিনে আরেকটা রাত কাটাল জিম। পরদিন সকালে, নাস্তার পর ঘোড়াটা নিয়ে বেরোবে ঠিক করল। বাইরে বেরোতেই চোখ তুলে তাকাল বিগ টম, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘ঘুরতে,’ শান্তকণ্ঠে জবাব দিল জিম। ‘ভেব না, শিগগিরই ফিরে আসব।’
দাঁত দিয়ে একটা ঘাসের ডগা কাটছে টম। ‘কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। বস বলে গেছে, চোখে চোখে রাখতে।’
হাত থেকে জিনটা ছেড়ে দিল জিম। বসে থাকতে আর ভাল্লাগছে না, বুঝলে। ‘একটু ঘুরে আসি, দেখে আসি দেশটা।’
‘হবে না, ঘাসের ডগার শেষ টুকরোটা থুহ্ করে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল টম। বিশাল থাবা তুলে কেবিনটা দেখাল, ‘বসের নির্দেশ, কেবিনে থাকতে হবে তোমাকে। যাও, লক্ষ্মী ছেলের মত চুপচাপ শুয়ে থাকোগে।’
‘রাস্টি তোমার বস, আমার নয়। আমি তার নির্দেশ মানতে যাব কেন?’
‘কারণ আমি তোমাকে মানতে বলছি।’
নিচু হয়ে জিনটা তোলার ভঙ্গি করল জিম। চোখের কোণ দিয়ে দেখছে, এগিয়ে আসছে টমের বিশাল বুটজোড়া। তুলেই টমের পা সই করে ধা করে ছুঁড়ে মারল জিনটা? লাগল গিয়ে হাঁটুর সামান্য নিচে। তৈরি ছিল না টম। ভারসাম্য হারাল। মাটি থেকে সরে গেল পা। তাল সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল একটা মুহূর্ত। পারল না। পড়ে গেল উপুড় হয়ে।
পড়েই উঠতে গেল আবার। বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন জিমের শরীরে। দুই লাফে পৌঁছে গেল কাছে। আঙুল সোজা রেখে দা দিয়ে কোপানোর মত করে রদ্দা মারল টমের ঘাড়ে। ভয়ানক আঘাত। টমের মত দানবও সহ্য করতে পারল না। আবার পড়ল মুখ থুবড়ে।
চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে আবার উঠল টম। তাকে দাঁড়ানোর সুযোগ দিল জিম। কিন্তু আঘাত করার সময় দিল না। ঘাড়ে যে-ভাবে মেরেছে তেমনি করেই মারল পেটের মাঝামাঝি।
উঁক করে একটা শব্দ বেরোল দানবের মুখ থেকে। সামনে বাঁকা হয়ে গেল শরীর।
ঘুসি চালাল জিম। পরপর দু-বার।
টমের মনে হলো, মাথার দু-পাশে মুগুরের বাড়ি পড়ল। মাথা ঝাড়া দিয়ে আবার সোজা হতে না হতেই এলোপাতাড়ি কয়েকটা মারাত্মক ঘুসি এসে পড়ল নাকে-মুখে।
চোখের পলকে চেহারা পাল্টে গেল তার। নাক বসে গেছে, নিচের ঠোঁট আধ ইঞ্চি কাটা, সামনের একটা দাঁত অদৃশ্য। টলে উঠল কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে আছড়ে পড়ল। মাথার একপাশে বুটের জোর এক ঠোকর খেয়ে জ্ঞান হারাল নীরবে।
গায়ের জোরে মেরেছে জিম। ব্যথা পেয়েছে হাতে। আঙুল টানতে টানতে ফিরল কিপের দিকে।
দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সিগার টানছে কিপ লিনটন। চোখে বিস্ময়। জিম তাকাতেই হাসল।
‘তোমার ওপর বসের কোন নির্দেশ আছে?’ ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল জিম।
‘থাকলেই কি?’ বুড়ো আঙুল দিয়ে টমকে দেখাল কিপ, ‘আমি কি এটার মত গাধা? অত প্রভুভক্ত আমি নই। তোমার যেখানে ইচ্ছে যাও।’
পাহাড় থেকে নেমে এল জিম। সরু একটা পায়ে চলা পথ এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে উত্তরে। সে-পথ ধরেই চলল। তেল চকচকে শরীর তার ঘোড়াটার। হাঁটার তালে তালে শক্তি যেন ফেটে পড়ছে পেশী থেকে।
মাইল দুয়েক গিয়ে ঘোড়ার মুখ ঘোরাল জিম। সামনে একটা উপত্যকা। সবুজ ঘাস। একপাশে পাহাড়শ্রেণী।
পথ থেকে ঘোড়া নামাল সে। তৃণভূমির ওপর দিয়ে ছোটাল।
ঘাসে ঢাকা ছোট্ট জমিটুকু পেরিয়ে এল দ্রুত। আবার মোড় নিল ঘোড়া। পাহাড় এখন পেছনে, সামনে ঢালু হয়ে নেমে গেছে উপত্যকা। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির ঠিক মাঝ বরাবর কেটে দুভাগ করে দিয়ে বইছে ঝর্না, যেন চওড়া একটা রূপালি ফিতে। তৃণভূমির এক প্রান্ত থেকে আবার উঠে গেছে পাহাড়। ঢালের গায়ে জন্মে আছে গাছপালা, ঝোপঝাড়। তার ভেতরে দেখা যাচ্ছে ঘরের চাল।
ঘোড়ার রাশ টেনে ধরল জিম। সিগারেট ধরাল। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে তাকিয়ে দেখল সামনের দৃশ্য। একটানা মাইল দশেক তৃণভূমি। মরুভূমির দিকের প্রান্ত শুকনো লাগছে এখন, তবে পর্বতের গোড়ায় যেখানে পানি রয়েছে, সেখানে ঘাস বেশ ভাল। বসন্তের শুরুতে আরও তাজা, আরও সবুজ, রসাল হয়ে উঠবে। গরু-মোষের জন্যে সত্যি খুব চমৎকার চারণভূমি।
জিম নিজে পশুপালক, কোথায় কোন্ ঘাস আর ঝোপ গরু মোষের প্রিয়, ভাল করেই জানে। জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল তার। উত্তর পশ্চিমে অনেক দুরে পর্বতের গায়ে একটা চওড়া কালো ফাটল, নিশ্চয় গিরিপথ। ওখানেও সবুজের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বন রয়েছে, তারমানে শিকারও মিলবে ওখানে।
ভাল জায়গা পছন্দ করেছিল বুড়ো বিল হার্ভে।
আবার ঘোড়া চালাল জিম। বড়সড় একটা পুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়াল। পর্বতের গা থেকে নেমে আসা ঝর্নার গতিপথে খোড়া হয়েছে ওই পুকুর। পানি সব সময় ধরে রাখার জন্যে। পরিশ্রম কম করেনি হার্ভে। বুদ্ধিও ছিল লোকটার।
বোঝা যাচ্ছে, আন্তরিকভাবে খেটেছে হার্ভে-র্যাঞ্চের প্রতিটি লোক। স্যাবারেরও প্রচুর ঘাম ঝরেছে ওই তৃণভূমিতে। খামারটার আরও অনেক উন্নতি করতে পারত সে। ইচ্ছে করলে জিমও পারে, যদি মালিক হয় জায়গাটার। বেলিন্দা গ্যাটলিন পাশে থাকলে তো কথাই নেই।
সারাটা সকাল ঘুরে বেড়াল জিম। ঘুরে ঘুরে দেখল র্যাঞ্চ ও তার আশপাশের অঞ্চল। তবে খামারবাড়ির বেশি কাছাকাছি গেল না।
দুপুর পেরোল। বিকেল হয়ে এল। এই সময় দেখল পাহাড়ের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে একদল ঘোড়সওয়ার। সে-ও ওদিক থেকেই এসেছে। র্যাঞ্চ হাউসের দিকে চলেছে ওরা। তাড়াতাড়ি কয়েকটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল জিম। উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল ঘোড়সওয়ারদের।
বেশি তাড়াহুড়ো করছে যেন লোকগুলো। বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে এমন করে না মানুষ। নিশ্চয় কিছু একটা করে এসেছে।
লোকগুলো চলে গেলে পাথরের আড়াল থেকে বেরোল সে। ফিরে চলল রাস্টির কেবিনে।
পাহাড়ের পাশ দিয়ে মোড় নিয়ে এগিয়ে গেছে পথ। পেছনের অপরূপ দৃশ্যের দিকে আরেকবার ফিরে তাকাল জিম। তারপর গতি বাড়াল ঘোড়ার।
মোড় নিয়ে, খানিকটা খোলা জায়গা পেরিয়ে, আরেকটা পাহাড়ের গোড়ায় এসে পড়ল সে। কেবিনে যাওয়ার পথটা ঢাল বেয়ে উঠে গেছে, সেটা ধরে উঠতে শুরু করল।
ভাবতে ভাবতে চলেছে বলেই হয়তো পথের ওপর পড়ে থাকা লোকটাকে প্রথমে দেখতে পায়নি। ঘোড়াটা তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে থমকে দাঁড়াতে চোখ পড়ল সামনের দিকে। তখনই দেখল, মরে পড়ে আছে লোকটা। রক্তাক্ত, থেতলানো দেহ। রাস্টি কানাহানের প্রহরী ছিল। পেটে গুলি করা হয়েছে। তারপর তার দেহ মাড়িয়ে দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে চলে গেছে খুনী।
একনজরেই বোঝা গেল, মারা গেছে লোকটা। একটানে কোমরের খাপ থেকে রিভলভার বের করল জিম। ভীষণ সতর্ক হয়ে গেছে। টান টান হয়ে উঠেছে স্নায়ু।
পথের ওপর ঘোড়সওয়ার যাওয়ার চিহ্ন দেখতে পেল। অন্তত বারোটা ঘোড়া গেছে ও-পথ দিয়ে।
গাছের পাতায় শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। দূর থেকে ভেসে এল ঈগলের ডাক। আর কোন শব্দ নেই। পুরোপুরি নীরব।
কেবিনের কাছে উঠে এল জিম। আরেকজন লোক মরে পড়ে আছে আঙিনায়। না, বিগ টম নয়। পাহাড়ের গোড়ায় প্রহরারত দু-জনের একজন। নিশ্চয় তাড়া খেয়ে পিছিয়ে এসেছিল এখানে।
লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামল জিম। হাতে উদ্যত রিভলভার। তীক্ষ্ণ চোখে দেখল একবার আশপাশটা। কাউকে চোখে পড়ল না। কোন শব্দ নেই। দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। কেউ নেই ভেতরে। ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলা হয়েছে সমস্ত জিনিসপত্র।
ঘরে ঢুকল সে। ভাঙা খাটের তলায় রয়েছে তার জিনিসগুলো। ঠিকই আছে সব। ছোয়নি কেউ। তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
জিনিসগুলো চাপাল ঘোড়ার পিঠে। পরীক্ষা করে দেখল উইনচেস্টারের চেম্বার। বুলেট ভরা আছে, স্প্রিঙও ঠিকমত কাজ করছে। আবার ঘোড়ায় চরতে যাবে, এই সময় কানে এল চাপা গোঙানি।
পাই করে ঘুরল জিম। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
আবার এল আওয়াজ। সেই সঙ্গে সামনে ঝোপের ভেতর মৃদু নড়াচড়া। ঝোপের পেছনে পাহাড়ি মেহগনির ছোট্ট জঙ্গল। পা টিপে টিপে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। বেশ খানিকটা ঘুরে ঝোপের পেছনে এসে দাঁড়াল।
ভেতরে পড়ে আছে কিপ লিনটন। ফ্যাকাসে চেহারা, রক্তে লাল শার্ট। শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকাল। কোনমতে শুধু বলল, ‘ড্যাগার লোক…’
কিপের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসল জিম। আলতো হাতে খুলে দিল শার্টের বোতাম। বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর। তবু বাঁচার ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে এখনও।
দ্রুত হাত চালাল সে। আগুন জেলে পানি গরম করল। কিপের ক্ষতস্থান ভাল করে ধুয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল।
থেমে থেমে জানাল কিপ, ড্যাগার লোকেরা জেনে গেছে, জিমকে এখানে এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে খুঁজতেই এসেছিল। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করেছে। টাকা খেয়ে বেঈমানী করেছে টম, জিমের কথা বলে দিয়েছে ড্যাগাকে।
কিপের ধারণা, রাস্টিকেও ছাড়বে না ড্যাগা, খুন করবে। হয়তো এতক্ষণে করে ফেলেছে। এমন করে সাজাবে কেসটা, মনে হবে রাস্টিই তাকে আক্রমণ করেছিল, আত্মরক্ষার জন্যে বাধ্য হয়ে গুলি করতে হয়েছে ড্যাগাকে।
রাস্টির ওপর ড্যাগার এখনই রেগে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কথা ছিল, দু জনে মিলে র্যাঞ্চটা দখল করবে। কিন্তু জিমকে দেখে সে-সব চুক্তি ভুলে গিয়ে একাই মালিক হওয়ার ফন্দি আঁটল রাস্টি। সেটা সহ্য করবে কেন ড্যাগা?
মরুকগে, ভাবল জিম, তার কি? রাস্টি মরলেও তার কিছু না, ড্যাগা মরলেও। বরং মরলে শত্রুর সংখ্যা কমবে। জিজ্ঞেস করল, ‘মুখোমুখি হলে কে জিতবে?’
হাসল কিপ। ‘অবশ্যই ড্যাগা। রাস্টির নিশানা তার চেয়ে ভাল। কিন্তু সে অস্থির স্বভাবের। আর ড্যাগা হলো বরফের মত শীতল।… তবে, ড্যাগা একা মুখোমুখি হতে যাবে বলে মনে হয় না। কোন ঝুঁকিই নেবে না সে। দলবল নিয়ে ঘেরাও করবে রাস্টিকে। কুকুরের মত গুলি করে মারবে। এমনও হতে পারে, নিজে সামনেই যাবে না। ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে কাজ সারাবে।’
কিপের পাশে কিছু খাবার আর এক ক্যানটিন পানি রেখে দিল জিম। দুটো কম্বল এনে রাখল। তারপর এসে চড়ল ঘোড়ায়।
পথ খোলা। ইচ্ছে করলে এখন টেক্সাসে রওনা হয়ে যেতে পারে সে। কিন্তু মনস্থির করতে পারল না। ঘোড়া চালাল একদিকে। একসময় অনেকটা অবাক হয়েই দেখল, টেক্সাস নয়, হার্ভে-র্যাঞ্চের দিকে চলেছে সে।
কতটা ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছে। কাছাকাছি ড্যাগার লোক থাকতে পারে। চোখ রাখতে পারে র্যাঞ্চের ওপর। সে যে বেঁচে আছে এটা জানতে দেরি হবে না। তার বেঁচে থাকাটা ড্যাগার জন্যে খুবই বিপজ্জনক।
স্যাবার সেজে হার্ভে-রাঞ্চ দখলে রাস্টিকে সহায়তা করতে যাচ্ছিল জিম, এটা বুঝে যাওয়ার পর ড্যাগা উঠে-পড়ে লাগবে তার পেছনে। খুন করার জন্যে পাগলা কুত্তা হয়ে যাবে।
সতর্ক রইল জিম, খুব সতর্ক। সাবধানে পথ চলল।
র্যাঞ্চে পৌঁছুল সূর্য ডোবার পর। গাছপালার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল খামারবাড়িটার দিকে। কয়েকজন লোক দেখা যাচ্ছে, কাজ করছে সবাই। তবে ওদের অস্থিরতা দেখেই বোেঝা যায় মন বসাতে পারছে না কাজে। এভাবে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পারার কথাও নয়। শেষ অবধি কি ঘটে, দেখার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে ওরা।
বাদামী একটা ঘোড়া বেরিয়ে এল খামারবাড়ি থেকে। পিঠে সওয়ারী। শহরের দিকে চলেছে বোধহয়।
পশ্চিম আকাশে রঙের খেলা। গোধূলির আলোয় দূর থেকে চেনা গেল না সওয়ারীকে।
কাছে চলে এল ঘোড়া। চিনতে আর অসুবিধে হলো না। বেলিন্দা গ্যাটলিন।
দ্বিধা করল না জিম। পেছনে ছুটল। ঢাল বেয়ে নেমে ধরে ফেলতে সময় লাগবে না।
জিমকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল বেলিন্দার। ‘আপনি! আমি তো ভেবেছিলাম এতক্ষণে বহুদূরে চলে গেছেন। গরুখোজা খুঁজছে ওরা আপনাকে।’
‘ড্যাগার লোক?’
‘না। তবে সে-ও লোক লাগিয়েছে। আপনাকে এখনও খুঁজে পেল না কেন সেটাই আশ্চর্য। শেরিফকে উস্কে দিয়েছে সে। বুঝিয়েছে, রাস্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্যাবারকে খুন করেছেন আপনি। হার্ভে-র্যাঞ্চের লোভে।’
‘তাই?’ বেলিন্দাও একথাই বিশ্বাস করে কিনা বোঝার জন্যে তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জিম, কিছু বুঝল না।
মাথা ঝাঁকাল বেলিন্দা। ‘বোঝানো হয়েছে, এ-শহরে হঠাৎ করে এসে পড়েননি আপনি। কোনভাবে অন্য কোথাও আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রাস্টির। জিম স্যাবারের মত দেখতে বলে অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে আপনাকে স্যাবার সাজার প্রস্তাব দিয়েছে সে। কথামত যথাসময়ে এসে আপনি হাজির হয়েছেন টাকারে। এসেই খুন করেছেন ড্যাগার লোককে। জিমের চোখে চোখে তাকাল সে। সব কেমন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে না?’
‘তা যাচ্ছে,’ জিমের কণ্ঠে অস্বস্তি। ‘তবে একটা কথা বিশ্বাস করতে পারেন, জিম স্যাবারের নাম আপনার মুখেই প্রথম শুনেছি। রাস্টির সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে এখানে এসেই! কোন কুমতলব নিয়ে আসিনি আমি এখানে এসেছিলাম রাত কাটাতে, পরদিন সকালে উঠেই চলে যেতাম। কিন্তু আমার চেহারাটাই কাল হলো।’
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে জিমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বেলিন্দা। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘আপনি এখান থেকে চলে যান, এক্ষুণি। সমস্ত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ওরা। শেরিফের হাতে পড়লে তো ভাগ্য ভাল, জেলে যাবেন। কিন্তু ড্যাগার লোকের সামনে পড়লে রক্ষা নেই, গুলি করে মারবে।’
‘রাস্টি কোথায়?’
আবার জিমের চোখে চোখে তাকাল বেলিন্দা। ‘আপনার তো জানার কথা। অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে সে।’
খবরটা জিমকে বিশেষ নাড়া দিল বলে মনে হলো না। এই দোষটাও নিশ্চয় আমার ঘাড়েই চাপানো হয়েছে?
‘হলে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু আছে কি?’
‘আছে। কারণ খুনটা আমি করিনি। এর জন্যে ড্যাগা দায়ী। হয় সে নিজের হাতে করেছে, কিংবা কাউকে দিয়ে করিয়েছে। আমাকে যেখানে আটকে রেখেছিল বাস্টি, সেই জায়গাটা তছনছ করে দিয়ে এসেছে ড্যাগার লোক। যাকে সামনে পেয়েছে নির্বিচারে গুলি করেছে। মারতে গিয়েছিল আসলে আমাকে। পায়নি বলে বেঁচে গেছি।’
‘আপনি এখান থেকে চলে যান,’ আবার বলল বেলিন্দা।
ধীরেসুস্থে সিগারেট বানাতে লাগল জিম। চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছে বেলিন্দা।
অবশেষে মুখ তুলে তাকাল জিম। ‘ম্যাডাম, আমি এসেছিলাম শান্তিতে রাত কাটিয়ে ভোরে উঠে চলে যেতে। আমাকে সেটা করতে দেয়া হয়নি। ঘাড়ে চাপল ড্যাগা। ওর মত একটা তৃতীয় শ্রেণীর গুণ্ডার ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালানো কি আমার উচিত, আপনার কি মনে হয়? তাছাড়া এখন পালালে সবাই ভাববে, খুনগুলো আমিই করেছি।’ খস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে সিগারেটে আগুন ধরাল সে। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাল কথা, র্যাঞ্চটা পাওয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পেরেছেন?’
‘কি করে? টাকাই নেই।’
‘ধরুন,’ সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে জিম, ‘যদি কোন বন্ধু… কোন পার্টনার প্রথম কিস্তির টাকাটা দেয়? দশ হাজার ডলার…’
‘অসম্ভব!’ জোরে জোরে মাথা নাড়ল বেলিন্দা, ‘এখানে তেমন কোন বন্ধু নেই আমার। দশটা ডলারও কেউ দেবে না…’
‘আমার কাছে আছে দশ হাজার ডলার।’
চুপচাপ কয়েকবার সিগারেটে টান দিল জিম। হাঁ করে তাকে দেখছে বেলিন্দা। চোখে সন্দেহ। এরকম পুরানো, ময়লা বেশভূষার একজন মানুষের কাছে সত্যি এত টাকা আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছে।
‘বিশ্বাস করতে পারছেন না তো?’ হাসল জিম, ‘সত্যি আছে। এই গোলমালে আমি ইচ্ছে করে ঢুকিনি, কতগুলো শয়তান লোক জোর করে ঢুকিয়েছে। বাধ্য করেছে ঢুকতে। এখন এর শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না। চলুন শহরে যাই। উকিলের সঙ্গে দেখা করে কাগজপত্র ঠিক করতে বলব আপনার নামে। কি বলেন?’
‘টাকাটা সৎপথে উপার্জন করা?’
আবার হাসল জিম, ‘রাস্টির কাছ থেকে নিয়েছি ভাবছেন?’
‘না মানে …’
‘অত ভাবনার কিছু নেই, ম্যাডাম। এর প্রতিটি পয়সায় ঘাম লেগে আছে আমার গায়ের, রক্তপানি করা টাকা। কয়েকজনে মিলে মন্টানায় গরু নিয়ে গিয়েছিলাম। বিক্রি করে যা পেয়েছি তাতে আমার ভাগে পড়েছে দশ হাজার। চলুন, যাই।’
‘এত তাড়া কিসের!’ বলে উঠল একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। ‘রুডি, মেয়েটাকে ধরো!’
কে কথা বলল, দেখারও প্রয়োজন মনে করল না জিম। জুতোর গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে তো লাগাল। চটাস করে চাটি মারল বেলিন্দার ঘোড়ার পেছনে।
স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল দুটো ঘোড়া। তীব্র গতিতে ছুটল। পেছনে গর্জে উঠল রাইফেল। জিমের প্রায় কান ছুঁয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট।
‘থামবেন না, খবরদার!’ চেঁচিয়ে উঠল জিম, ‘চালিয়ে যান।’
এক ছুটে উপত্যকায় নেমে এল দুটো ঘোড়া। অন্ধকার হয়ে গেছে। আবছামত চোখে পড়ছে, আরেকটা সরু পথ বেরিয়ে চলে গেছে বায়ে। বাদামী ঘোড়াটার লাগামের একপাশ ধরে টান দিল জিম, মাথা হেলিয়ে ইঙ্গিত করল। অন্ধকারে ইঙ্গিতটা দেখতে পেল না বেলিন্দা, তবে লাগামের টানে আপনি ঘুরে গেল তার ঘোড়া। পেছন পেছন ঢাল বেয়ে উঠে চলল একটা পাহাড়ে, গাছপালার ভেতর দিয়ে। পায়ের তলায় ঝরাপাতা আর নরম কাটাঝোপ ঢেকে দিচ্ছে ঘোড়ার খুরের শব্দ।
পাইন বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল দু-জনে; জিম আগে আগে, পেছনে বেলিন্দা।
মূল রাস্তা ধরে ছুটে যাবে ড্যাগা ও তার দলবল। তবে দু-এক মিনিটের মধ্যেই বুঝে ফেলবে, ধোঁকা দেয়া হয়েছে তাদেরকে। ফিরবে তখন। জিমেরা কোনদিক দিয়ে গেছে, বুঝে যাবে সহজেই। আবার পিছু নেবে।
পাহাড়ী পথের ডান পাশে খাড়া দেয়াল। ঘন অন্ধকার এখানটায়। দেয়ালের ধার ঘেঁষে রইল জিম। আরেকটু এগিয়ে শুরু হলো আরেকটা দেয়াল, বাঁ পাশে। বক্স ক্যানিয়ন নয়তো! সর্বনাশ হবে তাহলে।
পেছনে শোনা গেল চিৎকার দূরে। বোঝা গেল, ওরা কোন পথ দিয়ে গেছে আবিষ্কার করে ফেলেছে ড্যাগা। ছুটে আসবে এখন দ্রুতগতিতে।
সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের বড় বড় চাঙড়। মাঝে মাঝে ফাঁক। সরু ওই ফাটলের ভেতর দিয়েই পথ করে করে এগিয়ে চলল জিম, পেছনে বেলিন্দা। মাঝে মাঝে পথ সামান্য চওড়া হচ্ছে, পাশাপাশি চলা যাচ্ছে তখন। টুকটাক কথা বলতে পারছে। তবে থামছে না মুহূর্তের জন্যে। বাচতে হলে এগিয়ে যেতে হবে। পেছন থেকে খসাতে হবে ড্যাগাকে। অসম্ভবই মনে হচ্ছে কাজটা।
দুদিক থেকে ধীরে ধীরে চেপে আসছে দুটো দেয়াল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাথরের চাঙড়, ওগুলো আরও বড়। কাছেই কোথাও পানি পড়ছে, শব্দ আসছে কানে। রাতের শীতল বাতাস কেমন ভেজা পরশ বুলাচ্ছে মুখে। নাকে আসছে পাইনের নেশা ধরানো গন্ধ। সামনে বন, ওখানে লুকিয়ে থাকা যাবে। কিন্তু অস্বস্তি-বোধটা গেল না জিমের। মাথার অনেক ওপরে উঠে গেছে দু-পাশের দেয়াল, এর মাঝে কোথাও ফাটল চোখে পড়ছে না। বক্স ক্যানিয়ন হলে সামনের দুটো দেয়াল এক হয়ে মিশে যাবে, তাহলেই হয়েছে। বোতলের ভেতর ঢুকে যাওয়া পোকার অবস্থা হবে ওদের। খোলা মুখটা রুদ্ধ করে দেয়া খুবই সহজ হবে শত্রুদের পক্ষে, রাইফেল হাতে তখন মাত্র একজন লোকই ওদেরকে ঠেকিয়ে দিতে যথেষ্ট।
ধীরে ধীরে উঠে গেছে পথটা। কয়েক মিনিট চলে সমতল ছোট্ট একটা তৃণভূমিতে উঠে এল দুটো ঘোড়া। চাঁদ উঠছে। তবে খাড়া দেয়ালের জন্যে এখনও আলো এসে পৌঁছায়নি এই গভীর গিরিসঙ্কটে।
পেছন থেকে পাশে চলে এল বেলিন্দা। ‘জিম,’ এই প্রথম নাম ধরে ডাকল সে, ‘মনে হয় ফাঁদে পড়েছি। খাঁচা। খুব সম্ভব এটা বক্স ক্যানিয়ন। এদিকে আসিনি কখনও, তবে এর কথা অনেক শুনেছি। বেরোতে হলে আবার পিছিয়ে যেতে হবে, সামনে পথ নেই।’
‘আমিও এই আশঙ্কাই করছিলাম।’ থামার নির্দেশ দিতে হলো না, নিজে নিজেই দাঁড়িয়ে গেল জিমের ঘোড়া। কানে আসছে পানি পড়ার আওয়াজ। ঘোড়াটাকে আগে বাড়ানোর চেষ্টা করল সে, কিন্তু গ্যাট হয়ে রইল ওটা। লাফ দিয়ে নেমে পড়ল জিম। সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল, ‘পুকুর। পানি। যাক, ভালই হলো। রাতটা যাক, দিনে দেখব, কি করা যায়।’
এক জায়গায় কয়েকটা বড় বড় গোল পাথর পড়ে আছে। ওগুলোর মাঝখানে ক্যাম্প করা যাবে।
দুটো ঘোড়র জিন খুলে পেছনের ছোট একটুকরো তৃণভূমিতে নিয়ে গিয়ে বাধল জিম। চমৎকার ঘাস। ঘোড়ার খাবারের অভাব হবে না।
পাথরগুলোর মাঝখানে ঢুকে পাশাপাশি বসল দু-জনে। অনেক রাত অবধি গল্প করল। খই ফুটতে লাগল যেন মুখে।
নিজের জীবনের অনেক কথা জানাল জিম। নিউসেসে কাটিয়েছে কৈশোর। চোদ্দ বছর বয়েসে চলে গিয়েছিল মেক্সিকোতে, ঘোড়া শিকারীদের সঙ্গে। জ্যান্ত ঘোড়া ধরে আনা খুবই বিপজ্জনক কাজ। ফেরার পথে আক্রমণ করে বসেছিল অ্যাপাচি ইণ্ডিয়ানরা। মোট তিনবার লড়াই হয়েছিল ওদের সঙ্গে; দক্ষিণ সীমান্তের কাছাকাছি দু-বার, একবার তার খানিকটা উত্তরে।
কখন শুয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে পড়ল কখন, বলতে পারবে না জিম। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখে পড়ল ধূসর আকাশ। রাত শেষ। পাশে তাকাল। কাছেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘাসের ওপর শুয়ে আছে বেলিন্দা। একটা হাত পড়ে আছে জিমের বিশাল বুকে। ঠোঁট দুটো আধখোলা, কোনরকম দুশ্চিন্তার ছাপ নেই চেহারায়। ভোরের আবছা আলোয় অনেক বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে তাকে।
ঝুঁকে চুমু খাবার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করল জিম। বুকের ওপর থেকে আস্তে করে নামিয়ে রাখল হাতটা। আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল বেলিন্দার গালে এসে পড়া একগুচ্ছ চুল। উঠে পড়ল। এগিয়ে গেল ঘোড়া দুটোর দিকে।
ঘন হয়ে জন্মেছে সবুজ, রসালো ঘাস। চারদিকে তাকিয়ে নিজেদের অবস্থান লক্ষ্য করল সে। খোলা একটা চত্বরমত জায়গায় রয়েছে। সামনে পুকুর, ওপারে এক হয়ে মিশে গেছে দু-দিকের দেয়াল। যেখানে মিশেছে সেখানটাতেই উচ্চতা কম, তা-ও প্রায় তিনশো ফুট। একরখানেক মত হবে জলাশয়টা। টলটলে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি। একপাশের পাহাড় চূড়া থেকে ঝরে পড়া ঝর্না থেকেই এর উৎপত্তি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাইন গাছ জন্মেছে পুকুরের পাড়ে। এদিক ওদিক পড়ে আছে অসংখ্য ছোটবড় পাথর। পেছনে, গিরিসঙ্কটের দু-ধারে ঘন ঝোপঝাড়। তিনদিক ঘেরা জায়গাটায় বেরোনোর একটাই পথ, সেটা নিশ্চয় দখল করে বসে আছে ড্যাগা আর তার দলবল। তবে, ওদের দুজনের অবস্থানও যথেষ্ট ভাল, বেরোতে পারবে না, এই যা সমস্যা। চত্বরের পাথরের আড়ালে বসে একটা মাত্র রাইফেল দিয়েই ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব গিরিপথ ধরে এগিয়ে আসা সেনাবাহিনীর গোটা একটা দলকে।
পেট ভরে ঘাস খেয়েছে ঘোড়া দুটো। পানি খাওয়াল জিম। তারপর আবার আগের জায়গায় এনে বাঁধল। একটা পাথরের ধারে বসে আগুন জেলে কফির পানি চড়াল। পুকুরের পানিতে অনেক মাছ, বিশেষ করে ট্রাউট। এদিকটায় আসে না কেউ, মাছগুলোকে বিরক্ত করে না। বড়শি ফেলতেই টোপ গিলে নিল ইয়া বড় এক ট্রাউট। মাছটা নিয়ে ফিরে এসে দেখল পানি ফুটছে।
পাথরের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল বেলিন্দা। হাসিতে উজ্জ্বল মুখ। ‘কি হচ্ছে? পিকনিক?’
জিমও হাসল। হাত বোলাল গালে। কয়েকদিন শেভ করতে পারেনি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ‘দূর, এই দাড়িভর্তি মুখ নিয়ে পিকনিক!’ তাকাল বেলিন্দার মুখের দিকে। ‘এখানে রাত কাটাতে হবে, ভেবেছ কখনও?’
‘ভাবিনি। কাটাতে কিন্তু খারাপ লাগেনি।’
‘সত্যি?’
আস্তে করে মাথা ঝাঁকাল বেলিন্দা।
‘ভাল। শোনো, কাজের কথায় এল জিম, রাইফেল চালাতে পারো? ড্যাগার খোকারা এলে কতক্ষণ ঠেকাতে পারবে?’
ফিরে তাকাল বেলিন্দা। গিরিপথটা দেখল। চত্বরের ওদিকের প্রান্তে, প্রায় ষাট ফুট দূরে একটা বড় পাথর। সামনের পথ খুবই সরু। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘সহজে এখানে উঠে আসতে দেব না কাউকে। কেন?’
তিনশো ফুট উঁচু দেয়ালটা দেখাল জিম, ‘আমি ওখান দিয়ে বেরিয়ে যাব। একা হলে পারব, তোমাকে নেয়া যাবে না।’
রক্ত সরে গেল বেলিন্দার মুখ থেকে। অসম্ভব! এত খাড়া দেয়াল কোন দরকার নেই, জিম। চুলোয় যাক র্যাঞ্চ। লাগবে না আমার। এখানেই বসে থাকব, র্যাঞ্চটা বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত। বেরোবই না।
‘হেরে যেতে বলছ? কিছুতেই না!’ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল জিম। ‘এখান থেকে বেরিয়ে যাবই আমি? কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ অদ্ভুত রকম বদলে গেছে তার চেহারা, কণ্ঠস্বর; মানুষটাকে নতুন লাগছে বেলিন্দার কাছে। কুগারের লেজে পা দিয়েছে ড্যাগা, আমি তাকে ছাড়ব না! ওই র্যাঞ্চ তোমার, বেলিন্দা। জায়গাটা তোমাকে ছাড়া বেমানান। কাল সন্ধ্যায়ই বুঝেছি। ওখানে থেকেছ কখনও?’
‘জীবনের বেশির ভাগটাই। আমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনরা সবাই ছিল আংকেল হার্ভের বন্ধু। ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা গেছে সব। তারপর থেকে ওই র্যাঞ্চটাই ছিল আমার বাড়ি।’
‘তোমার জন্যে আলাদা করে কিছু রেখে গেছেন মিস্টার হার্ভে?’
‘না,’ মাথা নাড়ল বেলিন্দা, ‘দরকারই মনে করেনি। আংকেল ভেবেছিল, র্যাঞ্চটা কিনে নিতে পারবে জিম, এবং আমি তাকে বিয়ে করব। আর কিসের ভাবনা। তবে একটা ভুল করেছিল আংকেল, আমার আর জিমের মাখামাখিটাকে অন্যভাবে দেখেছিল, কল্পনাই করেনি ভাইবোনের মত ছিলাম আমরা। তবে জিমকে বিয়ে না করলেও আমার কোন অসুবিধে হত না। সে ওটার মালিক হলে আমিও সারাজীবনই থাকতে পারতাম ওখানে।’
খেতে খেতে আরও অনেক কথা হলো। বার বার পাহাড়-চূড়াটার দিকে তাকাচ্ছে জিম। কাজটা মোটেও সহজ নয়, তবু যেভাবেই হোক, ডিঙাতেই হবে ওই পাহাড়।
হঠাৎ পেছনে গর্জে উঠল রাইফেল। ডাইভ দিয়ে পাথরের আড়ালে এসে পড়ল দু-জনে। কাউকে দেখতে পেল না গিরিপথটায়।
একটা পাথরের আড়াল থেকে চিৎকার করে বলল ড্যাগা, ‘বেলিন্দা, তুমি বেরিয়ে আসতে পারো। তোমার কোন ক্ষতি করা হবে না। মাথার ওপর দু-হাত তুলে বেরোলে জিমকেও কিছু করব না।’
বেলিন্দার দিকে তাকাল জিম।
মাথা নাড়ল বেলিন্দা। ‘যাব না।’
চেঁচিয়ে জবাব দিল জিম, ‘এখানেই আমাদের পছন্দ। বেশি দরকার থাকলে এসে ধরে নিয়ে যাও।’
নীরবতা।
ফিসফিস করে বলল বেলিন্দা, ‘ও বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। শহরে যেতেই হবে। নিলাম ডাকার সময় থাকতে হবে ওখানে।’
‘রাইফেলটা তুলে নাও,’ বলল জিম। ‘এগোলেই গুলি চালাবে। সোজা মেরে ফেলবে, কোন মায়াদয়া নেই। আমি যাচ্ছি।’
উঠে দাড়াল জিম। ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর বিশাল একটা পাথরের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে যাবে দেয়ালের কাছে, যেখান থেকে ঝর্না নেমেছে। চূড়ায় উঠবে।
‘জিম!’ মৃদু সলজ্জ কণ্ঠে ডাকল বেলিন্দা।
ডাকটা অন্যরকম। ফিরে তাকাল জিম।
ইশারায় কাছে ডাকল বেলিন্দা। পরক্ষণেই চোখ নামাল। রক্ত জমেছে গালে।
কাছে এসে দাঁড়াল জিম। উঁচু হয়ে তার গালে টুক করে চুমু খেল বেলিন্দা।
হাত চেপে ধরল। ‘জিম, প্লীজ, মারা যেয়ো না। আমাকে কথা দাও!’
‘দিলাম, মারা যাব না।’
‘এখনও ভেবে দেখো, জিম, ওই র্যাঞ্চ আমাদের দরকার নেই। শুধু তোমাকে পেলেই আমি…’
হাতটা ছাড়িয়ে নিল জিম। মৃদু হাসল বেলিন্দার মুখের দিকে তাকিয়ে। ‘আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো তুমি।’ আর একটাও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
পুকুরের ধার ধরে এগোল সে। আরেকবার তাকাল ওটার দিকে। গভীর কালো পানি। মনে রাখার মত।
দেয়ালের গোঁড়ায় এসে দাঁড়াল। তাকাল ওপর দিকে। দূরে থেকে দেখে যতটা মনে হয়েছিল, ততটা কঠিন বোধহয় হবে না কাজটা। এর চেয়েও খাড়া আর বিপজ্জনক পাহাড়ে চড়েছে সে। চড়া নিয়ে ভাবছে না। বড় অসুবিধেটা অন্যখানে। গিরিপথে ঘাপটি মেরে আছে শত্রু। শক্তিশালী রাইফেল আছে ওদের কাছে। ওদের চোখে পড়ে গেলে…
ভাবনাটা মন থেকে প্রায় ঠেলে সরাল সে।
<