প্রেতের অভিশাপ – তিন গোয়েন্দা (ভলিউম-৫১)
প্রথম প্রকাশ: ২০০২
লস অ্যাঞ্জেলেসের সীমানা প্রায় ছাড়িয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা।
জানো কোথায় এলাম? গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ বলে উঠল মুসা।
তন্ময় হয়ে প্রকৃতি দেখছিল তার পাশে বসা কিশোর পাশা। ফিরে তাকাল। ফ্লেমিং রক?
মুসার কথায় পেছনে বসা রবিনও কৌতূহলী হয়ে উঠল। পিঠ খাড়া করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কেন, ভুলে গেছ, পত্রিকায় সেদিন যে আর্টিক্যালটা পড়েছিলাম সেটার কথা? সেই যে, সেই শহরটার কথা, অদ্ভুত ভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল যেখানকার সমস্ত মানুষ।
ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। একটা রূপার খনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল শহরটা। পর্বতের গভীরে। সবচেয়ে কাছের লোকালয়টাও যেখান থেকে দুশো মাইল দূরে।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন। সিবিল ওঅয়েরর সময় আবিষ্কৃত হয় খনিটা। আর খনিটাকে ঘিরে শহরের সুদিন ছিল আঠারোশো তেষট্টি থেকে আঠারোশো পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত। তারপর রাতারাতিই একদিন গায়েব হয়ে গেল শহরের সব লোক।
আর বলতে হবে না, কিশোর বলল। সবটাই এখন মনে পড়েছে। খবরটা দিয়েছিল এসে একজন স্বর্ণসন্ধানী। ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর পরিশ্রমে আধপাগল হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে এসে ঢুকেছিল টাকসন শহরে। ফ্লেমিং রকের পাশ দিয়ে নাকি এসেছিল সে। জানিয়েছিল, শহরটার সমস্ত লোক নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
আর নিরুদ্দেশটাও স্বাভাবিক উপায়ে হয়নি, কিশোরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল রবিন। গোছগাছ করে চলে যাওয়া যাকে বলে তা নয়। বাড়িঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ফেলে গেছে। আসবাব, কাপড়-চোপড় যেখানে যা ছিল, সব রয়েছে। স্বর্ণসন্ধানী লোকটা যখন শহরে ঢুকেছিল, খাবারের পাত্রও তখন স্টোভে চাপানো। গরম। যেখানে যা থাকার কথা সব কিছুই ছিল, ছিল না কেবল মানুষ।
লোকটার কথায় কান দিল না কেউ, রবিনের মুখ থেকে আবার কথা কেড়ে নিল কিশোর। ভাবল, অতিরিক্ত রোদ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর একাকিত্ব লোকটার মাথার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। পাগল হয়ে গিয়েছিল সে।
একজন রিপোর্টার তো গিয়েছিল ফ্লেমিং রকে খোঁজ নিতে, মুসা বলল, তাই না?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর। কয়েকজন অভিযাত্রীকে সঙ্গে দিয়ে নিজের ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন একজন খবরের কাগজের সম্পাদক। বেরোনোর জন্যে উপযুক্ত সময় ছিল না সেটা। শীত আসার সময় হয়ে গিয়েছিল। ফলে তুষারপাতের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল ওরা। বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বসন্তকালে আবার চালাল অভিযান। কিন্তু শহরবাসীদের খুঁজে পাওয়া তো পরের কথা, শহরটাই খুঁজে বের করতে পারেনি ওরা।
দুনিয়ার বুক থেকে স্রেফ উধাও হয়ে গেল পুরো একটা শহর ভর্তি লোক। মুসা বলল। আশ্চর্য!
এখন অবশ্য লোকে ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিতে আরম্ভ করেছে, কিশোর বলল। একেকজন একেক কথা বলছে। ইনডিয়ানদের যারা দেখতে পারে না, তাদের বক্তব্য, খুনে ইনডিয়ানরা এসে চড়াও হয়েছিল শহরবাসীর ওপর। মেরেকেটে সাফ করে দিয়ে গেছে ওদের। এটা মেনে নেয়া যায় না। তার কারণ ওই এলাকার আশেপাশে যত ইনডিয়ান বসতি আছে বা ছিল, তাদের কেউই তেমন শত্রু ছিল না শেতাঙ্গদের, ঘৃণা করত না। তা ছাড়া এতবড় একটা ভয়ঙ্কর আক্রমণ চালানোর পর সেটা গোপন করে ফেলা সম্ভব ছিল না কোনমতেই।
কেউ বলে প্লেগ ছড়িয়েছে, রবিন থামতে কিশোর বলল। মড়ক লেগে সাফ হয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। দুচারজন অধিবাসী অবশিষ্ট যা ছিল তারা মড়ক ছড়ানোর ভয়ে লাশগুলোকে কবর দিয়ে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু এ রকম কিছু ঘটলে কোন না কোনভাবে সেটা বাইরের জগতে চলে আসতই, রবিন বলল। এমন একটা খবর চাপা থাকতে পারে না। কিন্তু কারও মুখে কখনও এ ধরনের কোন খবর শোনা যায়নি। আবার কেউ কেউ বলছে আরও অদ্ভুত কথা। সরকার নাকি ওখানে গোপন কোনও গবেষণা চালানোর জন্যে লোকগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে অন্য জায়গায়। সেটাও চাপ থাকার কথা নয়। কি গবেষণা, কোথায় সরানো হলো, কিছুই জানা যায়নি কোনদিন।
হুঁ, মাথা দোলাল কিশোর। পুরো ঘটনাটাই রহস্যাবৃত থেকে গেল এ শতকের গোড়া পর্যন্ত। তারপর আবার নতুন করে শুরু হলো ফ্লেমিং রক নিয়ে আলোচনা। ঘটনাচক্রে দুজন লোক গিয়ে ঢুকে পড়ল ওই শহরে। পরস্পরকে চিনত না ওরা। বিভিন্ন সময়ে শহরে ঢুকেছিল দুজনে। ফিরে এসে অবিকল এক গল্প বলেছে। দুজনেই শহরটা দেখেছে রাতের বেলা। প্রথমে ওদের চোখে পড়ে একটা আলো, অনেক ওপর থেকে ঝুলছে। আলো দেখে দেখে কাছে গিয়ে দেখে ফ্লেমিং রক হোটেলের টাওয়ারে ঝুলছে একটা লণ্ঠন…
থাক থাক, আর বলার দরকার নেই। বাধা দিল মুসা। বলেই করলাম ভুল। এ সব ভূতুড়ে কান্ডকারখানা…
মুসার কথা কানে তুলল না কিশোর। তাকে এখন কথার নেশায় পেয়েছে। পেছন ফিরে রবিনের দিকে তাকাল। আর্টিক্যালে কি লিখেছে, মনে আছে না? ওই লোকগুলো ঘরে ঢুকে দেখে এক আজব দৃশ্য। স্বর্ণসন্ধানী লোকটা যা যা বলেছিল, অবিকল এক রকম কাণ্ড। স্টোভে হাঁড়ি চাপানো, খাবার রান্না হচ্ছে। বাড়িঘরের নমুনা দেখে মনে হচ্ছিল মাত্র কয়েক মিনিট আগে বাসিন্দারা জায়গা ছেড়ে গেছে। সবই আছে, নেই কেবল কোন জীবন্ত প্রাণী। মানুষ তো নেইই, একটা কুকুর কিংবা মরুভূমির একআধটা কাঁকড়াবিছেও চোখে পড়ল না তাদের। পুরোপুরি একটা মৃত শহর।
এবং তারপর সেই লোক দুজনও মাসখানেকের মধ্যেই রহস্যময় ভাবে উধাও হয়ে যায়, যোগ করল রবিন। আর কোন খোঁজই পাওয়া গেল না তাদের। সে-ই শেষ। এ ঘটনার পর ফ্লেমিং রক দেখে এসেছে বলে দাবি করেনি আর কেউ।
গাড়ি রাখতে বলল কিশোর।
ব্রেক কষল মুসা।
রবিনের দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছ?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। মুসার দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার তাকাল কিশোরের দিকে। হ্যাঁ। জায়গাটা থেকে যখন দূরে নই আমরা, কিংবা বলা যায় জায়গাটার কাছাকাছি চলে এসেছি, একবার ঢু মেরে গেলে ক্ষতি কি?
খাইছে! বলো কি? আঁতকে উঠল মুসা। জেনেশুনে ওই ভূতের শহরে ঢুকব ওদের দলে সামিল হতে?
সেটাও তো একটা অভিজ্ঞতা হবে, কিশোর বলল। ভূত দেখার এতবড় সুযোগটা ছাড়ি কেন? নাকি ভোটাভুটি করতে চাও? গণতান্ত্রিক অধিকার?
অধিকার আর পাচ্ছি কোথায়? নিমের তেতো করল মুসার কণ্ঠে। তিনজনের মধ্যে দুজনই তো ভোট দিয়ে বসেই আছো যাওয়ার পক্ষে। আমি দিলেই বা কি না দিলেই কি?
দিলে একটা জিনিস ভাল হবে, হেসে বলল কিশোর। আমাদের দলে চলে আসতে পারলে। একা একা অন্য দলে থাকাটা কি ঠিক?
গীয়ার লিভারে ধরে আবার হ্যাঁচকা টান মারল মুসা। ঝাঁকি দিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি। ওর রাগ দেখে হেসে ফেলল কিশোর।
হাইওয়ে থেকে মোচড় দিয়ে পাশের একটা রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনল মুসা। মাইল তিরিশেক যাওয়ার পর আরেকটা কাঁচা রাস্তায় পড়ল। সোজাসুজি পবর্তের ওপরে উঠে গেছে রাস্তাটা।
ভীষণ এবড়োখেবড়ো পথ। প্রচণ্ড ঝাঁকি।
এ কি রাস্তা নাকি! বাপরে বাপ!
রাস্তা আসলে নয়ও। মাটিতে তৈরি হয়েছে গরুতে টানা গাড়ির চাকার গভীর দুটো খাজ। তার মধ্যে চাকা ফেলে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
ভাগ্যিস ফোর-হুইল ড্রাইভ গাড়ি ভাড়া করেছিলাম, কিশোর বলল। নইলে এ রাস্তায় অসম্ভব ছিল চালানো।
আর খাবারগুলো তো জোর করেই নিলাম আমি, মুসা বলল। তোমরা তো নিতেই চাচ্ছিলে না। কাজে লাগবে না এখন? কিন্তু কথা হলো, যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতেই এত কষ্ট হচ্ছে, সেটা ধরে গরুর গাড়ি চলে কি করে?
নিশ্চয় হাতির সাইজের একেকটা গরু, মন্তব্য করল রবিন। গায়ে দানবের জোর। তবে যা-ই বলো, দারুণ একটা অভিযানের পূর্বাভাস পাচ্ছি।
সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা গুঙিয়ে উঠল মুসা।
কি হলো? চমকে উঠল কিশোর।
দেখছ না, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, শক্ত হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে রেখে মুসা বলল। এ সব এলাকায় বৃষ্টির মানে জানো? মাটি এত শুকনো আর কঠিন, সহজে পানি শুষে নিতে পারে না। পর্বতের ওপর থেকে গড়িয়ে নামা পানিতে চোখের পলকে বন্যা হয়ে যাবে।
ঠিকই বলেছে মুসা। তথ্যটা কিশোরেরও জানা। অন্য চিন্তায় ছিল বলে এদিকে খেয়াল ছিল না তার। এ সব অঞ্চলে বছরে মাত্র কয়েকবার বৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন হয়, ঢল নামে। খুলে যায় যেন আকাশটা। মেঘের বুকে যত পানি জমা হয়, যত তাড়াতাড়ি পারে ছেড়ে দিয়ে যেন বাঁচতে চায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আলামত সবার আগে টের পায় বন্য প্রাণীরা! এতক্ষণ যাদেরকে প্রায় চোখেই পড়ছিল না, এখন তাদেরকেই দেখা যেতে লাগল পালে পালে। পানি থেকে বাঁচার জন্যে উঁচু অঞ্চলের দিকে ছুটে চলেছে ওরা। হরিণ, খটাশ আর অন্যান্য রোমশ প্রাণীদের ছুটতে দেখা গেল উদ্ধশ্বাসে।
শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। দেখতে দেখতে রাস্তার গভীর খাঁজ দুটো ভরে গেল পানিতে।
পূর্ণ গতিতে বিরামহীন ভাবে চলছে উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার। কিন্তু কোনমতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না জানালার কাঁচ বেয়ে নেমে যাওয়া পানির প্রবল স্রোতের সঙ্গে। চোখের পাতা সরু করে এনে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সেই পানির চাদরের মধ্যে দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা চালাচ্ছে মুসা। একটা উঁচু পাথুরে জায়গায় উঠে এল। গ্র্যাচ করে ব্রেক কষল। বিস্মিত।
কিশোর, দেখো দেখো, সামনে ওই যে আলো দেখা যাচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল সে।
আরে দুলছে দেখো, রবিনেরও চোখে পড়েছে আলোটা। পাশের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই লোকগুলোর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তাই না?
এবং তারপর একদিন রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল দুজনে, আনমনে বিড়বিড় করল মুসা। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ওদের!
আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিশোর বলল, কিসের আলো জানিই না আমরা এখনও। আদৌ ওটা ফ্লেমিং রক শহর কিনা, তাই বা শিওর হচ্ছি কি করে?
তা-ও তো কথা। তাহলে কি করব এখন?
আগে বাড়ো। কাছে না গেলে তো বোঝা যাবে না।
অচেনা জায়গা। রাস্তার অবস্থা ভাল না। খুব ধীরে ধীরে চালাতে শুরু করল মুসা। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ব্রেক কষল আবার। কিশোর, দেখো! ওই যে সাইনবোর্ডটা! ঢোক গিলল সে।
মলিন, ভাঙা তক্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। হেডলাইটের আলোয় পড়া যাচ্ছে খোদাই করা লেখাগুলো:
ফ্লেমিং রক
অ্যারিজোনা
লোকসংখ্যা: ৪৭৭
খাইছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মুসা। চারশো সাতাত্তর জন নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল! এ কি বিশ্বাস করা যায়?
ঘটনাটা যখন ঘটেছে, না করেই বা কি করব, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। দেখা যাক, আমরা ওদের খুঁজে বের করতে পারি কিনা। এত বছর পর দেখতে ওদের কেমন লাগবে আল্লাহই জানে।
কেমন আর লাগবে? ফাঙ্গাস পড়া কঙ্কাল। গলা কেঁপে উঠল মুসার। কিশোর, আমার ভাল্লাগছে না যেতে। চলো ফিরে যাই।
এতখানি এসে আর পিছিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, জবাব দিল কিশোর। রবিনের দিকে ফিরল। রবিন, কি বলো?
কেমন যেন ভয় ভয় করছে আমার এখন, নিচু স্বরে জবাব দিল রবিন। কিন্তু এতদূর এসে ফিরে যাব? রহস্যটার একটা কিনারা করে যাওয়াই উচিত। চলো, অন্তত ঝুলন্ত আলোটা কিসের দেখে যাওয়া যাক।
বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। বাতাসের বেগও কম। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করে নিয়ে নেমে পড়ল তিনজনে। এগিয়ে চলল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে খুব শীঘ্রি একটা বিল্ডিঙের অবয়ব চোখে পড়ল ওদের।
ওই যে, ঠিকই আছে, চারপাশে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কিশোর বল। শহরটাই এটা। ফ্লেমিংরক।
আর ওইটা বোধহয় এই হোটেলের টাওয়ার, টর্চের আলো ফেলে দেখাল রবিন। দেখো, আলোটা এখনও ঠিক আগের মতই দুলছে। নাড়াচ্ছে না তো কেউ?
সেটা জানতে হলে ওখানে উঠতে হবে, কিশোর বলল।
ও-ওখানে উঠবে! সাহস পাচ্ছে না মুসা।
হ্যাঁ, নাহলে দেখব কি করে? মুখে বললেও মনে মনে ভয় যে একেবারে পাচ্ছে না কিশোর, তা নয়।
হোটেলের বারান্দায় উঠল তিন গোয়েন্দা। লবিতে ঢুকল। কি আছে দেখার জন্যে না থেমে সোজা উঠে এল দোতলায়। সেখান থেকে ছাতে।
কাউকে দেখা গেল না সেখানে। লণ্ঠনটা যদি কেউ নাড়িয়েও থাকে, নেই এখন। চলে গেছে। লণ্ঠনটা আছে। কিন্তু আলো নেই। নিবে গেছে।
কাঁচটা ছুঁয়ে দেখল কিশোর। এখনও গরম।
মেরু বেয়ে ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তিনজনেরই।
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মুসা, দেখা তো হলো। এখন কি?
লণ্ঠন দুলিয়েছে যে লোকটা, তাকে খুঁজে বের করব, কিশোর বলল। চলো, নিচে চলো। আশেপাশেই কোথাও আছে সে।
সিঁড়ি বেয়ে আবার নেমে এল ওরা। সমস্ত হোটেলে খুঁজতে শুরু করল। ডাক দিল কিশোর, এই যে ভাই শুনছেন? কেউ আছেন?
জবাব পেল না।
একটা জিনিস লক্ষ করল, স্বর্ণসন্ধানী যা যা বলেছিল সব ঠিক। একটা বর্ণও বাড়িয়ে বলেনি। জিনিসপত্র যেখানে যা থাকার সব আছে। কাপড় ঝুলছে আলনা থেকে। বিছানায় পরিষ্কার চাদর পাতা। রান্নাঘরে জ্বলন্ত স্টোভের ওপরে খাবার রান্না হচ্ছে।
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। চোখে অবিশ্বাস। কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। লবি ধরে যাওয়ার সময় অ্যাশট্রেতে একটা জলন্ত সিগারেটের টুকরো দেখতে পেল।
হঠাৎ কানে এল বিচিত্র শব্দ।
যান্ত্রিক হাঁস প্যাক-প্যাক করছে।
দেখতে পেল ওটাকে। ডাকতে ডাকতে পর্দার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা খেলনা হাঁস। মেঝে ধরে হাস্যকর ভঙ্গিতে হেলেদুলে এগিয়ে এসে মুসার জুতোয় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল ওদের পায়ের কাছে।
নিচু হয়ে খেলনাটা তুলে নিল কিশোর। কিন্তু আর চালু করতে পারল না। দম দেয়ার চাবিটা নেই। আস্তে করে আবার মেঝেতে রেখে দিল হাসটা। হাত কাঁপছে।
কিশোর, মানুষজন আছে এখানে, কম্পিত কণ্ঠে বলল মুসা। জ্যান্ত মানুষ। যারা দম নেয়, কথা বলে, খায়দায়। কিন্তু কোথায় ওরা?
অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। জানি না। তবে খোঁজা বন্ধ করা যাবে না।
খুঁজতে থাকল ওরা। পেছনের দরজা দিয়ে এসে হোটেলের রান্নাঘরে ঢুকল। কাদামাখা পায়ের ছাপ দেখতে পেল মেঝেতে। বাইরে থেকে লবিতে ঢোকার পর ওদের যেমন ছাপ পড়েছিল এ ছাপগুলোও তেমনি।
বিগফুটের পায়ের ছাপ, রসিকতার চেষ্টা করল রবিন। পাহাড়ী অঞ্চলেই তো থাকে ওরা।
হাসল না অন্য দুজন।
বিগফুটেরা বুনো, কিশোর বলল। ওরা জুতো পরে না। তা ছাড়া বিগফুট নামেও যেমন বিগ, বাস্তবেও তেমন বড়। ওরা জুতো পরলে ছাপগুলো অনেক বড় হত।এগুলো স্বাভাবিক মানুষের পায়ের ছাপের সমান।
পুরো হোটেলটা তন্নতন্ন করে খুঁজল ওরা। সবখানেই মানুষ বসবাসের তাজা চিহ্ন দেখতে পেল, কিন্তু কোন মানুষ চোখে পড়ল না।
অবশেষে আবার বেরিয়ে এল বাইরের অন্ধকারে।
চারপাশে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর। কিছু কিছু বাড়ির সামনে কেরোসিনের বাতি আছে, দেখো। চলো, জ্বালাই। রাতের বেলা তো আর কোথাও যাওয়া সম্ভব হবে না। বরং আলো জ্বেলে এই মৃত শহরটারই কোথায় কি আছে দেখি।
তাই করি, আর কোন উপায় নেই যখন, রবিন বলল।
মুসা কিছু বলল না। তবে কিশোর আর রবিন যখন এগোল, সে-ও চলল ওদের সঙ্গে সঙ্গে।
হ্যারিকেন জ্বালানো মোটেও কঠিন হলো না। ঝেড়ে-মুছে ঝকঝকে করে তেল ভর্তি করে রেখে দেয়া হয়েছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। কেমন বিষণ্ণ একটা অসুস্থ চাঁদ উঁকি দিল মেঘের ফাঁকে। কিন্তু অস্থির মরুর আবহাওয়া বিদ্যুতের চমক দেখিয়ে, বজ্রের গর্জন তুলে আবারও বৃষ্টির হুমকি দিয়ে চলেছে ওদের। যেন বলতে চাইছে, এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। এখনও কাজ শেষ হয়নি আমাদের।
গীর্জাটার দিকে এগোল গোয়েন্দারা। হোটেল থেকে মাত্র দুটো বাড়ি পরেই। খুব সাধারণ একটা আয়তাকার বাড়ি। ওপরে ঘূণ্টাঘরের মাথায় দুটো খুঁটি বানিয়ে তাতে ঘণ্টা ঝুলানোর ব্যবস্থা করেছে শহরের স্থানীয় ছুতোর।
ওরা গীর্জায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল। বৃষ্টিভেজা রাতের বাতাসে কাঁপা কাঁপা ভূতুড়ে শব্দ ছড়িয়ে দিতে থাকল।
আতঙ্কিত হয়ে হুড়মুড় করে গীর্জা থেকে বেরিয়ে এল তিনজনেই। চোখ তুলে ওপরের ঘন্টাটার দিকে তাকাল।
বেজেই চলেছে ঘন্টা।
অসম্ভব। ইমপসিবল। ফিসফিস করে বলল রবিন। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
ঘন্টার রশি ধরে টান দিচ্ছে কেউ, ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। বাতাস নেই যে বাতাসে দোল খেয়ে নিজে নিজে বেজে উঠবে।
দুই সহকারীকে নিয়ে আবার গীর্জায় ঢুকল সে। দৌড়ে উঠে এল ঘন্টাঘরে, যাতে ওদের ফাঁকি দিয়ে পালাতে না পারে লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘণ্টা।
রশি ধরে টান দিল মুসা। নড়লও না ঘণ্টাটা। বহুকাল ব্যবহার না করলেই কেবল এমন করে অনড় হয়ে থাকে। মনেই হয় না এক মুহূর্ত আগেও বাজছিল ওটা।
বিমূঢ়ের মত সিঁড়ি বেয়ে নামছে আবার ওরা, দড়াম করে পেছনে বন্ধ হয়ে গেল ঘন্টাঘরের দরজা। ভীষণ ভাবে চমকে গেল ওরা।
বাবাবাবাব্বাতাসে। তাই না কিশোর? মুসা বলল।
বাতাস কোথায় দেখলে? কিশোর বলল। বাতাস তো স্তব্ধ।
গীর্জার পেছন দিকে চলে এল ওরা। দরজার গায়ে একটা তীর বিদ্ধ দেখে দ্বিতীয়বার চমকানোর পালা। ফ্লেমিং রকের মানুষগুলোকে পাইকারী ভাবে খুন করে গেছে বুনো ইনডিয়ানরা, এ ধারণার কথাটা মনে পড়তেই বরফের মত যেন জমে গেল ওরা।
তোতোত্তোমার কি মনে হয়, এটা কোনও ধরনের হুঁশিয়ারি? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
কিসের হুঁশিয়ারি পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর। তবে মুসাকে নয়, নিজেকেই। ওর বাস্তববাদী মন কিছুতেই অলৌকিক কোন কিছু মেনে নিতে পারছে না। নিজেকেই যেন বোঝাতে লাগল, কোন ধরনের ঠগবাজির শিকার হয়েছি আমরা। সত্যি কথাটা জানা গেলে দেখা যাবে, ব্যাখ্যাটা অতি সহজ। মনে আছে, একবার এক পাগল চিত্রপরিচালকের খপ্পরে পড়েছিলাম? সিনেমার সেট সাজিয়ে আমাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে গোপনে ছবি তুলে নিয়েছিল? এটাও সে-রকম কোন কিছু হতে পারে। সিনেমা কিংবা টিভি নাটকের সেট।
হলে তো ভালই হত, রবিন বলল। কিন্তু হোটেলের টাওয়ারে লণ্ঠন জ্বলে থাকা, গীর্জার ঘন্টা বাজানো…কি করে সম্ভব?
তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ।
গীর্জা থেকে বেরিয়ে এসে শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলল তিন গোয়েন্দা।
এরপর কোথায় যাব? মুসার প্রশ্ন।
অবশ্যই খুঁজতে, দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। এর একটা বিহিত করতেই হবে। এত বড় একটা রহস্যের সমাধান না করেই চলে যাব?…এক কাজ করা যাক। তিনজনে মিলে একই জায়গায় খোঁজার চেয়ে ভাগাভাগি হয়ে যাই চলো। তাতে অল্প সময়ে অনেক বেশি জায়গা দেখা হয়ে যাবে।
আ-আমি বাপু পারব না। দুই হাত নেড়ে বলল মুসা। একা একা যেতে পারব না আমি।
আরে যাও যাও, কিছু হবে না, সাহস দিয়ে বলল কিশোর ভূতে খেয়ে ফেলবে না তোমাকে।
না খাক, ঘাড় তো মটকাতে পারে?
কথা না বাড়িয়ে যাও তো। কি আছে, তেমন সম্ভাবনা দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু কোরো। তোমাকে উদ্ধার করতে ছুটে যাব আমরা।…মুসা, তুমি ওদিকটা দেখো। আমি ডানে যাচ্ছি। রবিন, তুমি বায়ে। আধ ঘন্টা পর ঠিক এইখানে মিলিত হব আমরা। ঠিক আছে?
কারও জবাবের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। ডান দিকে চলে গেল সে। রবিন চলল বাঁ দিকে। কিশোরের মত অতটা আত্মবিশ্বাস বা সাহস সে দেখাতে পারছে না। তবে কমও দেখাচ্ছে না। মুসা রওনা হলো সোজা।
পর পর কয়েকটা বাড়ি-ঘরে ঢুকে খুঁজে দেখল সে। ফ্লেমিং রকের স্বাভাবিক দৃশ্য। স্টোভে আগুন জ্বলছে। কোথাও খাবার রান্না হচ্ছে, কোথাও টেবিলে গরম খাবার সাজানো। ডিনারের সময় খাবার ফেলে চলে গেছে যেন বাসিন্দারা।
তারপর স্কুল হাউসটাতে এসে ঢুকল সে। এখানকার সবচেয়ে ভূতুড়ে বিল্ডিং এটা। নিখুঁত ভাবে সাজানো ছোট ছোট ডেস্কের সারি। সেগুলোতে বই খুলে পড়ে আছে। কালির দোয়াতের মুখ খোলা। পাশে কালিতে ভিজানো পালকের কলম। বাতাসে ফড়ফড় করছে খোলা বইয়ের পাতা।
ব্ল্যাকবোর্ডের নিচে রাখা চক আর মোছার ন্যাকড়া। টীচারের শেষ মেসেজ লেখা রয়েছে বোর্ডে: মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর। তার নিচে আজকের করণীয় শব্দ দুটোর নিচে লেখাপড়ার যে সব ফিরিস্তি রয়েছে, তার মধ্যে ভূত শব্দটা দেখা গেল। খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হলো মুসার কাছে। এখানকার কাণ্ড-কারখানার সঙ্গে ভূতের মিলই সবচেয়ে বেশি। যা সব ঘটছে, কেবল ভূতুড়ে বললেই এ সবের সঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
স্কুল থেকে বেরিয়ে এল সে। আরও কয়েকটা বাড়িঘরের পাশ কাটিয়ে এল। ভেতরে ঢোকার প্রয়োজন মনে করল না। বোঝা যাচ্ছে, কেউ নেই ওগুলোতে। ঢুকলে সেই একই রকম দৃশ্য দেখতে পাবে, সেটাও জানা। একটা বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। জেনারেল স্টোর বলে মনে হলো বাড়িটাকে। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাবতে ভাবতে ঢোকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলল। মনে হলো এর মধ্যে ফ্লেমিং রক রহস্য সমাধানের কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
দরজায় ঠেলা দিল সে। কাঁচকোচ করে উঠল কজা। মন বলছে, ঢুকো না, ঢেকো না, পালাও। কিন্তু পালাল না সে। বরং দরজা খুলে ভেতরে পা রাখল। প্রচণ্ড বাড়ি লাগল মাথায়। চোখের সামনে আঁধার হয়ে এল দুনিয়া।
জ্ঞান ফিরল এক সময়। মাথার পেছনে ব্যথা। কতক্ষণ বেহুঁশ হয়ে ছিল বুঝতে পারল না। উঠে বসে কপালে হাত বোলাল। হঠাৎ করেই মনে হলো তার, ঘরে একা নয় সে।
ধড়াস ধড়াস করতে লাগল বুকের মধ্যে। পাগল হয়ে গেল যেন হৃৎপিণ্ডটা। মাথার পেছনে হাত চলে গেল নিজের অজান্তে। ফুলে উঠেছে জায়গাটা। আঠা আঠা কি যেন লাগল হাতে। রক্ত, কোন সন্দেহ নেই।
আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ মুদল মুসা। স্পষ্ট অনুভব করছে, ঘরে অন্য কেউ আছে। তাকে যে বাড়ি মেরেছে সেই লোকটা? জ্ঞান ফিরতে দেখলে এখন কি করবে সে? আবার বাড়ি মেরে খতম করে দেবে?
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মুসা। কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহলের কাছে পরাজিত হলো ভয়। আস্তে করে একটা চোখ মেলল। বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল টর্চটা। মেঝেতেই পড়ে আছে ওটা এখন। তবে নেভেনি, জলেই আছে। সেই আলোর আভায় ঘরের মধ্যে যতখানি সম্ভব একটা চোখ বোলাল সে। সারি দিয়ে কিংবা স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা রকম পণ্য। পাতলা ধূলোর আস্তর পড়ে আছে সেগুলোতে। আরেকটু দৃষ্টি সরাতেই লোকটাকে চোখে পড়ল তার।
নানা ধরনের ক্যান্ডি সাজানো বড় একটা কাঁচের বাক্সের সামনে দাঁড়ানো লোকটা। ইনডিয়ান যোদ্ধা। কোমরের কাছে এক টুকরো কাপড় জড়ানো শুধু, এ ছাড়া সারা গা খালি গলায় রঙিন পুঁতির মালা। হাতে একটা খাটো কুড়াল, ইনডিয়ানদের ভাষায় টমাহক বলে এগুলোকে। কুড়ালটা কোপ মারার ভঙ্গিতে উদ্যত নয়। ঝুলিয়ে রেখেছে নিচু করে। এক হাত থেকে আরেক হাতে কুড়ালটা চালান করে দিল লোকটা।
মুসার মনে হলো, বাস্তব নয়, দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। মনে মনে গুঙিয়ে উঠল সে। খোদা! এটা স্বপ্নই হোক।
লোকটার গায়ের রঙ গাঢ় বাদামী। সুগঠিত শরীর। প্রায় চৌকোণা সুন্দর চেহারা। কপালে বাধা ইনডিয়ানদের হেডব্যান্ড, তাতে নীলকান্তমণি খচিত। বেশ রাজকীয় মনে হলো লোকটাকে। তবে ভয়ে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার কারণে মুসা লক্ষ করল না, লোকটার ভাবভঙ্গিতে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই।
আলতো করে ধরে রাখা টমাহকটার দিকে তাকিয়ে একমনে প্রার্থনা করতে লাগল সে; খোদা, ওই কুড়ালটা নামিয়ে রাখুক লোকটা! পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন হোক। কিংবা হোক তার গরম হয়ে ওঠা মগজের অতিকল্পনা।
এই সময় কথা বলে উঠল যোদ্ধা। খুব ভারী সুনিয়ন্ত্রিত কণ্ঠস্বর। কিন্তু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। কেমন ভূতুড়ে আর নাটকীয় কথাবার্তা, পবিত্র ভূমিতে অনুপ্রবেশ করেছ তোমরা! যেদিন থেকে চুরি গেছে এই ভূমি, সেদিন থেকেই অভিশাপ নেমেছে এখানে, চলবে যতদিন না এখানে ঘাস গজানো বন্ধ হবে। আমার গোত্রের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা প্রদর্শন করেছে বর্বর মাতাল খনিশ্রমিকেরা, তার শাস্তি তাদেরকে পেতেই হবে। ঘরবাড়ি সব তাদের থেকেও যুগ-যুগান্তর ধরে ঘরহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে।
উঠে বসল মুসা। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে লোকটার দিকে। ওকে বাস্তবও লাগছে, আবার অবাস্তবও। কোনমতে বের করে দিল যেন প্রশ্নটা, কিকিক্কি হয়েছিল ওদের?
তার প্রশ্নের জবাব দিল না ইনডিয়ান যোদ্ধা। যেন শুনতেই পায়নি। তারমত করে সেই একই স্বরে বলে গেল, তোমাকে আর তোমার দুই বন্ধুকে মাপ করে দেয়া হবে। তবে এক শর্তে। ফিরে গিয়ে এখানে যা যা দেখে গেল সব জানাতে হবে বাইরের পৃথিবীর মানুষকে। যাও, এখন চলে যাও।
কেঁপে উঠল মুসা। চলে যাও শব্দ দুটো বড়ই মধুর শোনাল তার কানে। যাওয়ার জন্যে তো সে রেডিই, বরং এ রকম একটা কথা শুনতে পাবে সেটাই আশা করেনি। তবে কিছু বলল না লোকটাকে।
হেডব্যান্ড খুলে নিয়ে সাবধানে ভাঁজ করল লোকটা। এগিয়ে গিয়ে রেখে দিল কাউন্টারের ওপর।
এটা নিয়ে যাও। তোমাকে দিলাম। তারপর হঠাৎ করেই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল লোকটা।
বসেই আছে মুসা। একটা আঙুলও নড়াতে পারছে না যেন। কিশোর আর রবিন এখন কোথায়? এখানে এখন চলে এলে ভাল হত। আরেকটা ভাবনা মাথায় আসতেই চমকে উঠল সে। তাই তো! ওরাও যদি ওরই মত বিপদে পড়ে থাকে? কিংবা তার চেয়ে বেশি বিপদে? কে জানে, হয়তো এ মুহূর্তে তার সাহায্য ওদের ভীষণ প্রয়োজন।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পা দুটো দেহের ভর রাখতে চাইছে না। টলমল করে উঠল। পড়ে গেল না। জখমটা মারাত্মক নয়।
মাথার পেছনে হাত দিল আবার। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে রক্ত। জট বেঁধেছে চুলে। বমিটমি আসছে না। তারমানে শুধু চামড়া কেটেছে, খুলিতে তেমন চোট লাগেনি। ভাঙেনি, কিংবা ফেটেও যায়নি।
কি ভাবে লাগল আঘাতটা? টমাহক দিয়ে বাড়ি মেরেছিল ইনডিয়ান যোদ্ধা? উঁহু। তার আচরণে সেটা মনে হয়নি। তা ছাড়া ওই কুড়ালের সামান্য ছোঁয়া লাগলেও ধূলি কেটে দুই ভাগ হয়ে যেত। ভয়ঙ্কর, মারাত্মক অস্ত্র। হতে পারে, বাতাসের ধাক্কায় বন্ধ হতে গিয়ে দরজার পাল্লাই বাড়ি মেরেছে তার মাথায়।
টর্চটা তুলে নিল সে। একটা পুরানো আমলের কয়লা তোলার অনেক বড় হাতা পড়ে থাকতে দেখল। এ সব দিয়ে সে-যুগে মানুষ কয়লা নিয়ে গিয়ে ফেলত তাদের ফায়ারপ্লেস আর চুলার মধ্যে।
আলোর রশ্মি চারপাশে ঘুরিয়ে আনল সে। ডজনখানেক হাতা ঝুলতে দেখল দরজার পাশের দেয়ালে। একটা হাতা হুক থেকে খুলে পড়ে আছে।
হুঁ, আনমনেই মাথা দোলাল সে, মাথায় বাড়ি লাগার রহস্য ভেদ হলো। দরজা খোলার সময় ঠেলা লেগে কোনভাবে হুক থেকে খুলে গিয়েছিল হাতাটা, মাথায় এসে পড়েছে। ফ্রেমিং রকে রাত দুপুরে ঘুরে বেড়ানোর খেসারত। আর আমি ভাবলাম কিনা ভূতের কাণ্ড! কিশোর আর রবিনকে বলা যাবে না এ কথা। হাসাহাসি করবে ওরা। তবে ভূত যে একটা সত্যিই এসেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। হেডব্যান্ডটা পড়ে আছে। দ্বিধা করতে করতে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। জিনিসটা বাস্তব। ভূতুড়ে কিংবা স্বপ্নের মধ্যে হাতে নিয়েছে মনে হলো না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর পকেটে ভরল। রওনা হলো দরজার দিকে।
বাইরে যখন বেরোল, তখনও মৃদু মৃদু কাঁপছে তার শরীর। মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হয়নি পুরোপুরি। বুক ভরে টেনে নিল রাতের ঠাণ্ডা তাজা বাতাস। দপদপ করছে মাথার পেছনটা। চিৎকার করে ডাকল রবিন আর কিশোরের নাম ধরে। কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল। বেশি দূর গেল না তার দুর্বল কণ্ঠ। কোন জবাবও এল না।
আবার ডাকল সে। এটুকু পরিশ্রমেই বে করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। ঘোলাটে হয়ে গেল দৃষ্টি। ভুলভাল দেখতে আরম্ভ করল। অন্ধকারে বহু লোকের জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল। তাদের কণ্ঠস্বর, কথাবার্তা কানে আসছে যেন। মনে হচ্ছে তাকে ঘিরে রেখেছে সবাই। হাঁটাচলা করছে আশপাশ দিয়ে।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরের মাকড়সার জালের মত ঘোলাটে ভাবটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল সে। লক্ষ করল, যে চোখগুলোকে এতক্ষণ মানুষের চোখ মনে করেছে, সেগুলো আসলে মরুভূমির নিশাচর প্রাণীর চোখ। ওদের ডাক, হাঁটাচলার শব্দকে ভেবেছে মানুষের শব্দ। খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কাঠবিড়ালী আর ইঁদুর। হুটোপুটি করছে। আশ্চর্য! মানুষের ঘোলাটে মগজ কত অসম্ভব দৃশ্যই না দেখিয়ে ছাড়ে। বাস্তব জিনিসগুলোকে কি ভাবে অবাস্তব করে তোলে।
বেরিয়ে এসে আবার চিৎকার করে রবিন আর কিশোরের নাম ধরে ডাকল। সাড়া পেল না এবারেও। গেল কোথায় ওরা? কোথায় গিয়ে বিপদে পড়ল? না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতে হবে। প্রতিটি ঘরে ঢুকে দেখতে হবে। খুঁজে বের করতেই হবে ওদের।
*
রবিনও ওদিকে বাড়ির পর বাড়ি খুঁজে চলেছে। আলো ফেলে ফেলে দেখছে। নতুন কিছুই চোখে পড়ল না। ফ্লেমিং রকের সেই একই রকম স্বাভাবিক দৃশ্য।
তাই বলে খোঁজায় বিরতি দিল না। জেদ চেপে গেছে তার। এই রহস্যের কিনারা করতেই হবে।
বড় আরেকটা ঘরে ঢুকল সে। একটা সেলার দেখতে পেল এখানে। মাটির নিচের ঘর। ঢোকার দরজা একটাই, কিন্তু বড় বড় দুটো পাল্লা রয়েছে তাতে। ভেতরে ঢুকে দেখবে ঠিক করল। দরজা দুটো খুলতে বেশ কষ্ট হলো। ভারী কাঠের পাল্লা। মরচে পড়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে কজা।
উঁকি দিয়ে দেখল রবিন। নানা রকম যন্ত্রপাতি, পুরানো কাঠের টুকরো, আর কিছু ভাঙা আসবাবপত্র পড়ে আছে ঘরটাতে। ঢুকে পড়ল সে। পরক্ষণেই বরফের মত জমে গেল। পা দিয়ে বসার পর বুঝতে পারল কিসের গায়ে পা দিয়েছে।
সাপ।
সাপটাও তার মতই চমকে গেছে।
কুণ্ডলী পাকিয়ে দরজার কাছে পড়ে ছিল। অন্ধকারে বিশ্রাম নিচ্ছিল বোধহয়। টর্চের আলোয় চকচক করছে খুদে খুদে দুটো চোখ। ডায়মন্ডব্যাক র্যাটলার। ফণার পেছনে হীরার টুকরোর মত ছাপ মারা বলেই এ রকম নাম দেয়া হয়েছে। র্যাটলম্নেককে সংক্ষেপ কবে বলা হয় ব্যাটলার।
ভাগ্য ভাল, সাপের গায়ে পায়ের পুরো চাপ পড়েনি। কেবল ছোঁয়া লেগেছে। পা ফেলতে গিয়ে টের পেয়েই মাঝপথে যে ভাবে ছিল সেভাবেই রেখে দিয়েছে পাটা। চাপ লাগলে এতক্ষণে শিওর ছোবল মেরে বসত। ডায়মন্ড র্যাটলারের ছোবল খাওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু।
দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল কপাল বেয়ে। পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। কানে আসছে হুটোপুটির শব্দ। ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে অসংখ্য ইঁদুর। এ রকম একটা খুনে সাপের সঙ্গে বাস করে এখনও বেঁচে আছে কি করে ইঁদুরগুলো ভেবে অবাক লাগল তার। একটা ইঁদুর দৌড়ে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সাপটার ফুটখানেক দূরে। চকচকে চোখ মেলে এক মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে দেখল সাপ আর রবিনের হাতের আলো দুটোকেই। তারপর বিরাট এক লাফ দিল সরে যাওয়ার জন্যে। চোখের পলকে ছোবল মারল সাপটা। কিন্তু মিস করল। নিরাপদে ইঁদুরটা চলে গেল ঘরের কোণে।
সুযোগটা রবিনও হাতছাড়া করল না। ছোবল মারতে গিয়ে সাপের মুখটা বেশ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছিল। রবিনের পায়ের দিকেও নজর ছিল না। ইঁদুরের মত অতটা না হলেও, বেশ বড়সড় একটা লাফ দিয়েই রবিনও পিছিয়ে চলে এল। একটা সেকেন্ডও আর দেরি করল না ওখানে। দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
*
একই ভাবে বাড়িঘরের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে শহরের জেলখানার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। ঢুকে পড়ল ভেতরে। সামনের দিকের একটা বড় ঘরকে বানানো হয়েছে অফিস আর ওয়েইটিং কম। পেছনে আসামী রাখার দুটো ঘর। দেয়ালে দেয়ালে আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর।
এক জায়গায় লেখা রয়েছে: গ্র্যাফিটি, ১৮৩০ স্টাইল।
বেশির ভাগ শব্দই ইনডিয়ান, ড্রয়িংগুলোও তাই। আপনমনেই বিষণ্ন হাসি হাসল কিশোর। লিখে অভিশাপ দেয়া হয়েছে নিশ্চয়। ড্রয়িং একে শেতাঙ্গ জবরদখলকারীদের জাদু করে তাদের শাস্তি দিতে চেয়েছে। বোঝা গেল এই জেলখানা তৈরি হয়েছে মূলত ইনডিয়ানদের তরে রাখার জন্যেই। ইতিহাসে পড়েছে, প্রচুর শয়তানি আর চালাকি কছিল ততকালীন শেতাঙ্গরা। সস্তা মদ খাইয়ে প্রথমে মাতাল করেছে ইনডিয়ানদের। মাতাল অবস্থায় তাদেরকে দিয়ে অপরাধ করিয়েছে। তারপর আসামী করে এনে ভরে রেখেছে জেলখানায়। আটকে থাকার সুযোগে দখল করে নিয়েছে ওদের বাড়িঘর, জমিজমা সব।
প্রথম সেলটায় এসে ঢুকল সে। কানে এল পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। খোলার চেষ্টা করল দরজাটা। অনড় রইল পাল্লা। জেলখানার ভেতরে আটকা পড়ল সে।
আশেপাশে মানুষ তো দূরের কথা, একটা প্রাণীকেও চোখে পড়ল না তার। সামান্যতম বাতাসও ঢুকছে না যে বাতাসে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগাবে। তাহলে?
মেরুদণ্ডে শীতল শিহরণ বয়ে গেল তার। শেষে আর কোন উপায় না দেখে মুসা আর রবিনের নাম ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল।
কিন্তু কোন জবাব এল না। সাড়া এল না কারও কাছ থেকে। শহরের দূরতম প্রান্তে চলে এসেছে সে। এখান থেকে তার চিৎকার কারও কানে পৌঁছবে না। আরেকটা ভাবনা মাথায় আসতে শঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। ওরা দুজনও কোন রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়নি তো? নিজের চেয়ে ভয়টা ওদের জন্যে বেশি বেড়ে গেল তার। সে নিজে আটকা পড়েছে জেলখানায়। ওরাও যদি কোথাও এমন করে আটকে পড়ে, কেউ বাঁচাতে আসবে না ওদের। কেউ কাউকে মুক্ত করতে পারবে না। ফ্লেমিং রকের অভিশাপের শিকার কি ওরাও হতে যাচ্ছে?
*
ডাকতে ডাকতে জেলখানার কাছে চলে এসেছে মুসা।
রবিনও জায়গামত গিয়ে কিশোর আর মুসাকে না পেয়ে এদিকেই আসছে। মুসার ডাক কানে ঢুকতেই ছুটতে শুরু করল সে।
জেলখানার আরও কাছে আসার পর ক্ষীণ একটা ডাক কানে এল মুসার। কান পেতে শুনল কোনদিক থেকে আসছে। দৌড় দিল জেলখানার দিকে।
আবার ডাকতেই আবারও সাড়া এল। কথাগুলো বুঝতে পারল এবার। কিশোর বলছে, মুসা, আমি এখানে।
জেলখানার দরজার দিকে দৌড় দিল সে। একছুটে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কিশোরকে গরাদের ওপাশে দেখে থমকে গেল প্রথমে। তারপর হাসতে শুরু করল।
হাসির কি হলো। যসির কি হলো? ভুরু নাচাল কিশোর। আগে বের করো আমাকে। তারপর যত খুশি হেসে। ওই যে, তোমার মাথার পেছনে দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে চাবি।
মুসা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ঢুকে পড়ল রবিন। কিশোরের শেষ কথাটা কানে গেছে তার। দেয়াল থেকে চাবি খুলে নিয়ে সেলের দরজা খুলতে এগোল।
দরজার তালায় চাবি ঢোকাল সে। মোচড় দিল। দেখে, তালাটা খোলা। ঠেলা দিতেই পাল্লাটাও খুলে গেল। অবাক হয়ে তাকাল কিশোরের দিকে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? দরজা তে খোলাই আছে।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ছিল না। এক মিনিট আগেও ছিল না। তোমরা মনে করেছ আমি চেষ্টা করিনি? বহু ভাবে চেষ্টা করে দেখেছি, খুলতে পারিনি।
ঢুকলে কি ভাবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
দেয়ালে টর্চের আলো ফেলে দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম, কিশোর বলল আমি ঢুকতেই পেছনে আপনাআপনি লেগে গেল দরজাটা। আশেপাশে কেউ ছিল না। বাতাস ছিল না। কি ভাবে বন্ধ হলো, জিজ্ঞেস কোরো না আমাকে। জবা দিতে পারব না।
জিজ্ঞেস আমি করবও না, বিড়বিড় করে বলল মুসা। কারণ আমি জানি দরজাটা কে বন্ধ করেছে!
দেয়ালের অবস্থা দেখো, টর্চের আলো ফেলল কিশোর। কি সব লিখে রেখেছে। মানে করতে পারবে এ সবের? শব্দগুলো কিছুই বুঝলাম না। তবে ড্রয়িংগুলোর মানে বোঝা যাচ্ছে।
দেখার জন্যে তো ভেতরে ঢুকতে হবে, মুসা বলল। এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না দেয়ালের লেখা। আমি ঢুকতে পারব না। আবার যদি লেগে যায় দরজাটা?
তা-ও তো কথা, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। রবিন বাইরে থাকলে অবশ্য খুলে দিতে পারবে।
দেখা গেল রবিনও খুলতে পারল না, তখন? ভূতের ওপর বিশ্বাস নেই। ওর কোন যুক্তি মেনে চলে না। তালা আটকে দিলে তখন আর বেরোনোর জো থাকবে না।
থাক তাহলে, ঢোকার দরকার নেই, বেরিয়ে আসতে আসতে বলল কিশোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। বসার ঘরের দেয়ালেও প্রচুর লেখা আছে।
ঘরের প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি কোণে আলো ফেলে ফেলে দেখল ওরা। একট লেখায় আলো ফেলে থেমে গেল রবিন। জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করল আজকের দিনে, সাদা মানুষদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩ এপ্রিল ১৮৭২ সালে ছয়জন ইনডিয়ান যোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে ঘোড়া চুরি অপরাধে, যে অপরাধটা করেইনি ওরা। আগামীকাল আমরা যাচ্ছি আমাদের ভাইদের সঙ্গে সাদা মানুষের দেয়া বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে। শিরচ্ছে করে হত্যা করা হবে আমাদের। এই অন্যায়ের বিচার হবে, এর শাস্তি ভোগ করতেই হবে ওদের। পুরো ফ্লেমিং রকের ওপর নামবে চিরকালের অভিশাপ। স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন মহান প্রেত, এই অন্যায়ের বিচার করতে। আমাদের মহান পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করবেন সাদা মানুষরে, সেই সব ভূমি, যেগুলো ফেঁড়ে কেটে খনি বানিয়েছে ওরা, তছনছ করে ছেড়েছে। ফ্লেমিং রককে মহাকাশের কালে শূন্য গর্ভে বিলীন করে দেবেন মহান প্রেত।
ফ্যানটাস্টিক। চিৎকার করে উঠল কিশোর। পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে দ্রুত টুকে নিল কথাগুলো। তারপর চোখ পড়ল দেয়ালের লিখনের ওপর, যেটা থেকে পড়েছে রবিন। দুর্বোধ্য ইনডিয়ান ভাষা দেখে চোখ কপালে উঠল তার।
রবিন। কণ্ঠস্বর ফিসফিসানিতে নেমে এল কিশোরের, কি করে পড়লে তুমি? তোমার তো এই ইনডিয়ান ভাষা জানার কথা নয়।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মগজের ভেতর থেকে কি যেন দূর করতে চাইল রবিন। কি জানি। মনে হলো, কে যেন আমার ভেতরে ঢুকে লেখাগুলোর মানে করে দিল ইংরেজিতে।
আশ্চর্য! কথাগুলো বানিয়ে বলোনি তো?
উঁহু, মাথা নাড়ল মুসা, বানিয়ে বলেনি ও। এ ধরনের অভিশাপের কথা একটু আগে আমিও শুনে এলাম। একজন ইনডিয়ান যোদ্ধার মুখে।
কার মুখে?
ইনডিয়ান যোদ্ধা। জেনারেল স্টোরে গিয়ে ঢুকেছিলাম। দরজার পাশে ঝোলানো কয়লার হাতারবাড়ি খেয়ে বেহুশ হয়ে গেলাম। হুঁশ ফিরলে দেখি একজন ইনডিয়ান যোদ্ধা হাতে টমাহক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। ও আমাকে জানাল ফ্লেমিং রকে ইনডিয়ানদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কারণে অভিশাপ নেমেছে তাদের ওপর। চিরকালের জন্যে অভিশপ্ত হয়ে থাকতে হবে তাদের। কোনদিন রেহাই পাবে না। মুক্তি পাবে না এভিশপ্ত অবস্থা থেকে। সে আমাকে শর্ত দিয়েছে, এ সব কথা যদি বাইরের দুনিয়াকে জানার কথা দিই, তাহলে এখান থেকে মুক্তি পাব আমরা।
তারপর? লোকটা কই?
উধাও হয়ে গেল। স্রেফ মিলিয়ে গেল বাতাসে।
তারমানে..তারমানে, বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর, সত্যিই একটা ভূত দেখেছ তুমি?
হ্যাঁ। সে যে এসেছিল, তার প্রমাণও আছে আমার কাছে। পকেট থেকে হেডব্যান্ডটা টেনে বের করল মুসা। আমাকে এটা উপহার দিয়ে গেছে সেই ইনডিয়ান যোদ্ধা।
হেডব্যান্ডটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। কেমন বিমূঢ়ের মত হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল সে। দুই সহকারীর দিকে তাকাল। বিশেষ করে মুসার দিকে। আর কি করতে বলেছে সে?
এখান থেকে চলে যেতে।
আমি আর রবিন থাকি, তুমি গিয়ে শেরিফকে ডেকে নিয়ে এসো।
না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল মুসা। সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। সকাল হলে দেখা যাবে শহরটাই নেই, আবার গায়েব। বোকা বনতে হবে তখন আমাদের। তা ছাড়া শেরিফকে ডাকাডাকি করতে গেলে সেই ইনডিয়ান যোদ্ধা রেগে গিয়ে ক্ষতি করে বসতে পারে আমাদের।
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। কি যেন ভাবছে। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। আরেক কাজ করি না কেন? চলো, গাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। কাটিয়ে দিই রাতটা। ভোরের আলো ফুটলে যদি দেখি তখনও রয়েছে শহরটা, ছবি তুলে নেব পটাপট। তাতে প্রমাণ করতে পারব, ফ্লেমিং রক নামে একটা শহর সত্যিই ছিল এক সময়।
দারুণ। চমৎকার! একমত হয়ে মুঠো ঝাঁকাল রবিন।
চলো, বেরিয়ে যাই, তাগাদা দিল মুসা। এ শহরে থাকতে আর একটা মুহূর্তও ইচ্ছে করছে না আমার।
*
নিরাপদেই গাড়িতে ফিরে এল ওরা। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে কোনমতে কাটিয়ে দিল রাতটা। সকাল হলো। আলো ফুটল। সূর্য উঠল। তারপরেও যখন শহরটা মিলাল না, কেন যেন খানিকটা হতাশই হলো ওরা।
গ্লাব কম্পার্টমেন্ট থেকে ৩৫এম এম ক্যামেরাটা বের করল কিশোর। প্রায় পুরো ফিল্মটাই খরচ করে ফেলল রহস্যময় শহরটার ছবি তুলে। টেলিফটো লেন্স লাগিয়ে হোটেল, জেনারেল স্টোর, স্কুলহাউস, গির্জা, জেলখানার ছবি তুলল।
যাক, হয়ে গেল কাজ, সন্তুষ্ট হয়ে ক্যামেরাটা রেখে দিল সে। এখন আর লোকে অবিশ্বাস করতে পারবে না আমাদের।
কিন্তু মুসার মুখে হাসি নেই। এ শহরের গল্প তো গিয়ে আগেও লোকে বলেছে। লাভটা হয়েছে কি? মাঝখান থেকে নিজেরাই গায়েব। আমাদের বেলায়ও যদি সেরকম কিছু ঘটে?
ঘটবে না, কিশোর বলল। তোমার ইনডিয়ান ভূত-বন্ধুটি তো শর্তই দিয়েছে, শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কথা বাইরের দুনিয়াকে গিয়ে জানালে ছেড়ে দেবে আমাদের। আমার ধারণা, বেঁচে থাকতে ভাল লোক ছিল লোকটা। আমাদের ওপর সুনজর আছে তার।
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। এ সব ভূতপ্রেতের কথা তুমি বিশ্বাস করছ?
করতে ইচ্ছে করছে, জবাব দিল কিশোর। কি করব বলো? হয়তো ফ্লেমিং রক শহরটাই এর জন্যে দায়ী।
যাক, খুশি হলো মুসা, ভূত সম্পর্কে তোমার মানসিক অবস্থার পরিবর্তনে আমি খুশি।
বেশি খুশি হয়ো না, সাবধান করল রবিন। আবেগের বশে এখন বলছে বটে, বাড়ি গিয়েই দেখবে বদলে গেছে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা।
রাস্তার খাঁজকাটা সেই দাগে চাকা ফেলেই চালাতে হলো গাড়ি। দিনের বেলা এখন ভালমত দেখতে পারছে চারপাশটা। পথ কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। কোথাও পাহাড়ের ওপর দিয়ে গেছে, কোথাও উপত্যকা ধরে। একটা পাহাড়ের মাথায় গাড়ি উঠলে শেষবারের মত ফ্লেমিং রককে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল কিশোর।
মুসা! রবিন। চিৎকার করে উঠল সে। শহরটা নেই।
ব্রেক প্যাডালের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল মুসা। ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল গাড়ি। সে আর রবিন একই সঙ্গে ঘুরে তাকাল, দেখার জন্যে।
সত্যিই নেই শহরটা।
*
হুঁ, ভূতুড়েই। দিন কয়েক পর ঘটনাটার কথা শুনে বলল ওদের বন্ধু টম।
কিংবা টাইম-ডিসটশন জাতীয় কোন কিছুর খপ্পরে পড়েছিলাম, কিশোর বলল। কিছুক্ষণের জন্যে কোনও ধরনের স্পেস হোলেও ঢুকে গিয়ে থাকতে পারি আমরা।
শেরিফকে দেখিয়েছ ছবিগুলো?
কোত্থেকে দেখাব? ওঠেইনি।
মানে? তুমি নিজের হাতে তুলেছিলে বলেছ।
হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু একটা ছবিও স্পষ্ট হয়নি। সব ঘোলা।
একটু দুরে সোফায় বসে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর রবিন। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে টমের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর। শহর তো দূরের কথা, আশেপাশের পাহাড়-পর্বত, আকাশ কোন কিছুই ওঠেনি।
তাহলে ব্যাখ্যাটা কি এর? প্রশ্ন করল বিমূঢ় টম। এমন হতে পারে না, পত্রিকায় লেখাটা পড়ে ফ্লেমিং রক গেঁথে গিয়েছিল তোমাদের মগজে, তারপর রাতবিরেতে দুর্যোগের মধ্যে ওই পাহাড়ের ওপরে গাড়িতে বসে পুরো ব্যাপারটাই কল্পনা করে নিয়েছ তোমরা?
তিনজনের অবিকল এক রকম কল্পনা?
পকেট থেকে হেডব্যান্ডটা টেনে বের করল মুসা। তা ছাড়া এটা কি? কল্পিত জিনিস কি বাস্তবে আসতে পারে?
দেখতে তো জিনিসটা নতুনই লাগছে, টম বলল। কয়েক বছরের বেশি ব্যবহার করেনি।
হ্যাঁ, তাই, মাথা ঝাঁকাল মুসা। ভেতরের দিকটায় অ্যাপাচি ইনডিয়ানদের কিছু শব্দ লেখা রয়েছে। একজন ইনডিয়ান বন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম অনুবাদ করানোর জন্যে। তাতে যার নামটা লেখা রয়েছে তিনি একজন ইনডিয়ান সর্দার। ফ্লেমিং রকে খুন করা হয়েছিল তাঁকে এপ্রিলের চার তারিখে, আঠারোশো বায়ার সালে। মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল শ্বেতাঙ্গ খনিশ্রমিকেরা।
মুসার হাত থেকে হেডব্যান্ডটা নিয়ে দেখতে লাগল টম। ভেতরের লেখাটা দেখে বলল, যদূর জানি, ইনডিয়ানরা লেখার জন্যে এ ধরনের কালি ব্যবহার করে না। তারমানে বোকা বানানো হয়েছে তোমাদের।
উঁহু, মাথা নাড়ল রবিন। বোকা বানানো হয়নি। ইনডিয়ানরা সাদা মানুষের কালি ব্যবহার করত সেখানে। সাদা মানুষদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর। তারপরেও সন্দেহ নিরসনের জন্যে সব রকম পরীক্ষা আমরা চালিয়েছি। একজন কেমিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ব্যান্ড। কালি পরীক্ষা করে তিনি জানিয়েছেন, দেখতে নতুনের মত লাগলেও এ ধরনের কালি উৎপাদন আঠারোশো আশি সালের পরে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
জবাব হারাল টম। কিশোরের দিকে তাকাল। যে দুটো লোক তোমাদের আগে ফ্লেমিং রকে গিয়েছিল, তাদের কি হয়েছে কোন খোঁজ পেয়েছ?
নাহ। ওরা স্রেফ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কোন সূত্র রেখে যায়নি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল টম। উঠে রওনা হলো টেলিফোনের দিকে।
কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
চেনাজানা সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দিতে, জবাব দিল টম, যাতে সর্বক্ষণ নজর রাখে তোমাদের ওপর। আমরা যারা ফ্লেমিং রকে যাইনি তাদের কাউকে সঙ্গে না নিয়ে কিছুদিন বেরোতে পারবে না তোমরা। বলা যায় না, কখন গায়েব হয়ে যাও।
.
.
কাকতাড়ুয়া
ইঞ্জিনে বোধহয় কোন সমস্যা হয়েছে, মুসা, বিরক্তকণ্ঠে বলল কিশোর পাশা।
পিকনিক করতে পাহাড়ে গিয়েছিল তিন গোয়েন্দা। সারাদিন ওখানেই ছিল। এখন বাড়ি ফিরছে। সাঁঝ ঘনিয়েছে। আকাশে প্রকাণ্ড থালার মত চাঁদ। রাস্তার পাশের যব খেত ঝলমল করছে চাঁদের আলোয়। মনের আনন্দে গাড়ি চালাচ্ছিল মুসা, হঠাৎ ইঞ্জিনে গোলমাল। থেমে গেছে গাড়ি।
গ্যাস পেডালে চাপ দিল মুসা। ইঞ্জিনে কোন সাড়া নেই।
হতাশ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল সে। মাঝ রাস্তায় এমন ঝামেলার কোন মানে হয়। একশো মাইলের মধ্যে কোন মানুষজন আছে বলে তো মনে হয় না।
হঠাৎ বিদঘুটে আওয়াজ করে উঠল ইঞ্জিন। তারপর চুপ। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। স্পোর্টস সেডানটাকে ঠেলতে ঠেলতে রাস্তার ধারে একটা খাদের কাছে নিয়ে এল। টর্চ লাইট দিয়ে ইঞ্জিন পরীক্ষা করে দেখল। স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল আরেকবার। লাভ হলো না।
বৃথা চেষ্টা। হাল ছেড়ে দিল কিশোর। গ্যারেজে নিয়ে যেতে হবে।
ঠেলে তো আর নিতে পারব না, মুসা বলল। রশি বেঁধে টেনে নিতে হবে। কিন্তু এখানে গ্যারেজ কই?
চারদিকে চোখ বোলাল রবিন। উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, ভাগ্যটা ভালই বলতে হবে, কিশোর। ওই দেখো, মাঠে একজন লোক। চাষা-টাষা হবে হয়তো। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে, গ্যারেজ কোথায় আছে। গাড়িটাকে টেনে নেয়ার ব্যবস্থাও হয়তো করতে পারবে।
হাত দিয়ে যব খেত দেখাল মুসা।
মাঠের মাঝখানে লম্বা একটা আকৃতি দেখতে পেল কিশোর। দাঁড়িয়ে আছে। মানুষই মনে হচ্ছে। দূর থেকে ভাল বোঝা যাচ্ছে না।
চলো, লোকটার কাছে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা।
পরামর্শটা মনে ধরল কিশোরের। রাস্তা পার হয়ে মাঠে নেমে পড়ল তিনজনে। এখানে ওখানে খোঁড়া গর্ত। চাষ করা জমিন। মাঠের মাঝখানে চলে এল ওরা। এখানেই দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।
ঠিক এই সময় কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে লাগল চাঁদ। তবে লোকটাকে দেখতে অসুবিধে হলো না কারও। চেহারা দেখে মুখ হাঁ হয়ে গেল ওদের।
লোকটার মাথায় বালতির মত উঁচু হ্যাট, গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া কালো কোট প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো। কালো চোখে কটমট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। লম্বা, বাঁকানো নাক, মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। লম্বা হাত সোজা সামনে ধরে রেখেছে। বাঁকা আঙুল। যেন শিকারী পাখির নখওয়ালা থাবা।
গা ছমছম করে উঠল মুসার। কিশোরের মনে হলো শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা পানির স্রোত নামছে। রবিনেরও কেমন যেন লাগতে লাগল। নিজেদের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল ওরা।
চাঁদকে গ্রাস করে ফেলেছে প্রকাণ্ড কালো মেঘটা। অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। চোখ কুঁচকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। লোকটাকে দেখার চেষ্টা করছে।
অদ্ভুত লোক, বিড়বিড় করল মুসা। বাজি ধরে বলতে পারি ব্যাটা কোন ভূতুড়ে বাড়িতে থাকে।
আশপাশে আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, ফিসফিস করল কিশোর। অদ্ভুত মনে হলেও ওর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।
পা বাড়াল কিশোর। তার সঙ্গে রবিন।
মুসা লোকটার কাছে গিয়ে বলল, এই যে ভাই, আমাদের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। ওটাকে গ্যারেজে নিয়ে যাবার জন্যে সাহায্য দরকার।
কোন জবাব নেই। বাতাস শব্দ তুলে বয়ে গেল যব খেতের ওপর দিয়ে। বুক ঢিবঢিব করছে ওদের। ভয় লাগছে।
এখানেই থাকি, নিচু গলায় বলল মুসা। লোকটাকে চিনি না আমরা। জানি না কোন বদ মতলব আছে কিনা তার। পিছু ঘুরলেই যদি ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে!
কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? হিসিয়ে উঠল মুসা। এত অন্ধকার! ব্যাটা আমাদের পেছনে ঘাপটি মেরে নেই তো? ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল ও।
হঠাৎ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল চাঁদ। আবার আলোর বন্যায় ভেসে গেল যব খেত। ভৌতিক চেহারাটাকে এবার পরিষ্কার দেখা গেল।
ওটা একটা কাঠের খুঁটির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁটের নিচে বেরিয়ে পড়েছে খড়। বাঁকানো আঙুলগুলো তারের তৈরি। সাদা মুখটা রং করা।
কাকতাড়ুয়া! দারুণ অবাক কিশোর। একটা কাকতাড়ুয়ার ভয়ে মরছি আমরা!
কিন্তু ওটাকে অবিকল মানুষের মত লাগছে, বলল মুসা। এমন নিখুঁত জিনিস বানাল কে? ভয়ে আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে।
আমারও, মুসা। তবে কাকতাড়ুয়া যেহেতু আছে, কাছেপিঠে খামার বাড়িও থাকার কথা। চলো, খামার বাড়ি-টাড়ির খোঁজ মেলে কিনা দেখি।
তিনজনে হাঁটা শুরু করেছে এমন সময় খনখনে কণ্ঠে কে যেন বলে উঠল, সাবধান! ভীষণ বিপদ! বাঁচতে চাইলে এখুনি এখান থেকে পালাও?
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। কিশোরের ঘাড়ের পেছনের চুলগুলো সরসর করে খাড়া হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে গেল মুসার। রবিনের বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে। বাকরুদ্ধ হয়ে কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। কথাগুলো বেরিয়েছে ওটার মুখ থেকেই!
বাতাসে কাকতাড়ুয়ার কোট উড়ছে পতপত করে, পা নড়ছে। চাঁদের আলোয় মনে হলো হাসছে ওটা। বিদ্রুপের হাসি। আঙুলগুলো বাঁকা করে সামনে বাড়ানো, যেন খামচি দিয়ে ধরার ইচ্ছে।
আমি যা শুনেছি তোমরাও কি তাই শুনেছ, মুসা? কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল কিশোর।
হ্যাঁ, জবাব দিল মুসা।
কিন্তু কাকতাড়ুয়া যে কথা বলতে পারে, রবিন বলল, শুনিনি কোনদিন!
পরীক্ষা করে দৈখি। সত্যি ওটা কথা বলেছে কিনা তা জানা যাবে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল কাকতাড়ুয়াকে, আমাদেরকে পালাতে বললে কেন? কেন পালাব? কিসের বিপদ?
জবাব দিল না কাকতাড়ুয়া। আগের মতই তাকিয়ে রইল কটমট করে।
কিশোর আরও কয়েকটা প্রশ্ন করল। চুপ হয়ে রইল কাকতাড়ুয়া। শুধু বাতাসের শব্দ ছাড়া আর সব নিশ্চুপ।
খামোকাই সময় নষ্ট করছি, বিড়বিড় করল কিশোর। খড়ের তৈরি জিনিস কি আর কথা বলতে পারে? চলো, মুসা।
চলো, বলল মুসা। কিন্তু যাব কোন দিকে
এদিক-ওদিক তাকাল কিশোর। খেতের শেষ প্রান্তে বড় একটা দালান চোখে পড়ল।
ওটা নিশ্চয়ই খামার-বাড়ি, বলল সে, চলো। ওখানেই যাই।
তাই ভাল। সায় দিল মুসা। এই ভূতুড়ে জায়গা থেকে পালাতে পারলে বাঁচি।
কাকতাড়ুয়াকে পেছনে রেখে দালানটার দিকে পা বাড়াল তিন গোয়েন্দা। মাঝে মাঝেই মেঘ চাঁদকে ঢেকে ফেলছে বলে চলার গতি মন্থর ওদের। অন্ধকারে এবড়োখেবড়ো গর্তে ভরা মাঠ দিয়ে হাঁটা কঠিন। বার কয়েক মাটির টিবিতে পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিল ওরা।
পাহাড়ে চড়ার চেয়েও বিশ্রী কাজ, একটা গর্ত লাফ মেরে টপকাতে টপকাতে মতব্য করল মুসা।
ঠিক বলেছে। সায় দিল কিশোর।
এরচেয়ে বেপোর্ট হিলসে ওঠা সহজ, বলল রবিন।
এমন সময় পায়ের শব্দ কানে এল। কেউ দৌড়ে আসছে ওদের পেছন পেছন।
কনুই দিয়ে কিশোরকে গুঁতো মারল মুসা। ফিসফিস করে বলল, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।
বুঝতে পারছি, ফিসফিস করেই জবাব দিল কিশোর। পায়ের শব্দ আমিও শুনেছি। তবে অনুসরণকারী যে-ই হোক খারাবি আছে তার কপালে।
পেছন ফিরে দেখল না ওরা, গুনে গুনে দশ কদম এগোল। যব খেতের মাঝ দিয়ে কেউ আসছে। শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। ঠিক দশ কদম যাবার পরে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। কারাতে মারের কায়দায় দাঁড়িয়ে গেছে আত্মরক্ষার জন্যে। আসন্ন হামলার জন্যে প্রস্তুত। তবে মেঘে ঢাকা চাঁদের আবছা আলোয় কাউকে দেখতে পেল না। পায়ের শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না।
ঠোঁট কামড়াল কিলোর। বেহুদা কল্পনা করে আমরা খামোকই ভয় পাচ্ছি, মুসা।
কি জানি! নীরস শোনাল মুসার গলা। তোমার কথাই হয়তো ঠিক। বাতাসের শব্দ শুনে ভাবছি কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে। তা ছাড়া এখানে আমাদের পিছু নিতেই বা যাবে কে?
ওর কথা মাত্র শেষ হয়েছে, এমন সময় যব গাছের বড় একটা অংশ দুদিকে ভাগ হয়ে গেল। একই সঙ্গে মেঘের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল চাঁদ। চাঁদের আলোয় দেখা গেল ঠোঁটে সেই বিশ্রী জ্জিপের হাসি নিয়ে ওদের সামনে হাজির হয়ে গেছে কাকতাড়ুয়াটা।
দৃশ্যটা দেখে আতঙ্কে জমে গেল তিন গোয়েন্দা। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ভৌতিক মূর্তিটার দিকে। দুহাতে যব গাছগুলোকে দুপাশে ঠেলে ধরে একটা গর্তে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। নিঃশব্দে হাসছে।
হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা চিরে খনখনে গলায় হেসে উঠল কাকতাড়ুয়া। তীব্রতর হয়ে উঠল আওয়াজ। তারপর হঠাৎই থেমে গেল।
দ্বিতীয়বার কথা বলল কাকতাড়ুয়া। কর্কশ শোনাল কণ্ঠ, ওই বাড়িতে যেয়ো না। এখুনি চলে যাও। নইলে কপালে অনেক দুর্ভোগ আছে।
দুই গোয়েন্দা আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। কথাগুলো সত্যি শুনেছে কিনা বিশ্বাস করতে পারছে না। কাকতাড়ুয়া ছেড়ে দিল যব গাছ। গাছগুলোর আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ভয়ঙ্কর মুখটা। দ্রুত মিলিয়ে গেল দুটন্ত পায়ের আওয়াজ।
পায়ের শব্দে সংবিৎ ফিরে পেল যেন তিন গোয়েন্দা। কাকতাড়ুয়াটা যেখান থেকে উঁকি দিয়েছে দৌড়ে গেল সে-জাযগায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না ওরা। ওনতেও পেল না।
ওটার পিছু নেব, চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
কিন্তু যাব কোন দিকে? রবিনের প্রশ্ন।
যেখানে ওটাকে প্রথম দেখেছিলাম সেখানে।
ছুটল ওরা। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এল আগের জায়গায়। এখানেই কাকতাড়ুয়াটাকে দেখে গেছে।
কিন্তু খালি কাঠের খুঁটিটা দাঁড়িয়ে আছে। কাকতাড়ুয়াটা নেই!
হতভম্ব হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। বেদম হাঁপাচ্ছে। তবে যতটা না পরিশ্রমে তারচেয়ে বেশি ভয়ে।
কিশোর, আমরা সত্যি কি অশরীরী কিছু দেখছি? কেঁপে গেল মুসার কণ্ঠ।
আর অস্বাভাবিক কিছু কি শুনছি? অবাক শোনাল রবিনের কণ্ঠ। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল।
জবাব দিল না কিশোর। ভূতুড়ে এ সব কাণ্ডকারখানার মাথামু কিছু সে-ও বুঝতে পারছে না।
মাঠের মধ্যে কাকতাড়ুয়াটাকে খুঁজে বেড়াল ওরা। কোথাও দেখতে পেল না। শেষে ঠিক করল খামারবাড়িতেই যাবে। খামারবাড়িতে কেউ থাকলে কাকতাড়ুয়া রহস্যের জবাব হয়তো সে দিতে পারবে। প্রেতের অভিশাপ
খামারবাড়িটা বেশ বড়। কতগুলো গাছ-পালার মধ্যে কাঠের বাড়ি। তবে খুবই দৈন দশা। বাড়ির জানালায় কোন আলো জ্বলছে না।
সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠে এল মুসা। দরজার কলিংবেল টিপল। ভিতরে কোথাও তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল বেল। কিন্তু কারও সাড়া মিলল না। আবার বেল বাজাল মুসা। এবারও কোন সাড়া নেই।
মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই, বলল কিশোর। তবে নিশ্চিত না হয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না।
পেছন দিকে কেউ থাকতে পারে, রবিন বলল। চলো। ওদিকটা ঘুরে দেখি।
বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা। চক্কর দিল বাড়িটাকে ঘিরে। কিন্তু জীবনের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। ছোট ছোট গুলো পেঁচিয়ে যাচ্ছে পা, কাঁটা গাছের খোঁচা লাগছে হাতে। সেই সাথে কানের পাশে মশার ভনভনানি তো আছেই।
গত কয়েক বছরেও এ বাড়ি কেউ সাফ-সুতরো করেনি মনে হচ্ছে, অসন্তোষের গলায় বলল কিশোর।, জবাবে কেউ কিছু বলার আগেই ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার ভেসে এল। আঁতকে উঠল ওরা।
কি-কি ওটা? কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল মুসা।
জানি না। কাকতাড়ুয়ার চিৎকার নয়তো? বিড়বিড় করল রবিন।
কাছের একটা গাছ থেকে ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা গেল। একটা পেঁচা। উড়ে আসছে গাছটা থেকে। বসল একটা ঝোঁপের ওপর। গোল গোল, বড় বড় চোখে কটমট করে তাকাল ওদের দিকে। তারপর ডানা ঝাঁপটে বুক হিম করা চিৎকারটা দিল আবার।
দুই গোয়েন্দা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে যসি হাসল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বাড়ি চক্কর দেয়া শেষ। আবার চলে এসেছে বারান্দায়। বৃথা খোঁজাখুঁজি। মানুষ জন নেই। গলা ফাটিয়ে কেউ কি আছেন? বলে ডাকাডাকি করল। কোন জবাব এল না।
ফোন করা দরকার, বলল মুসা। কাছেপিঠের কোন গ্যারেজে খবর না দিলেই নয়। কিন্তু সমস্যা হলো বাড়ির ভেতরে ঢুকব কি করে? দরজা ভেতর থেকে ছিটকানি দেয়া।
জানালা দিয়ে যে ঢুকব তারও উপায় নেই, হতাশ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। অনেক উঁচুতে জানালা!
এদিক ওদিক তাকিয়ে রবিনও কোন উপায় বের করতে পারল না।
উপায় একটা আছে, মুসা বলল। পেঁচাটা যে গাছ থেকে উড়ে এসেছে, লক্ষ করেছি ওটার একটা ভাল চিলেকোঠার জানাল ছুঁই ছুঁই করছে। জানালা খোলা থাকলে গাছ বেয়ে উঠে গেলেই হলো। তারপর ভেতরে ঢুকে পড়ব।
গাছটার নিচে চলে এল ওরা। প্রথমে মুসা চড়ল গাছে। উঁচু ডালে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল ওটা ওর ওজনের চাপে ভেঙে পড়বে না। তারপর জানালা ছুঁই ছুঁই ডালের ওপর চলে এল। হাত বাড়িয়ে জানালার কাঁচ স্পর্শ করল। ধাক্কা দিল। কাঅ্যাঅ্যাচ শব্দে খুলে গেল জানালা।
ভাগ্য ভাল আমাদের, কিশোর আর রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল মুসা। জানালা খোলা। চলে এসো।
গাছে উঠে পড়ল কিশোর। চলে এল মুসার পেছনে, মগডালে। খোলা জানালা দিয়ে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে পড়ল মুসা। তাকে অনুসরণ করল অন্য দুজন। ভিতরে ঢুকে পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করল ওরা।
টর্চের আলোয় বুঝতে পারল বেশ বড়সড় ঘর এটা। খালি। মেঝের ওপর ধুলোর ঘন আস্তরণ।
মেঝেতে কারও পায়ের ছাপ দেখছি না, বলল কিশোর। তার মানে অনেক দিন কেউ এ ঘরে ঢোকেনি।
চিলেকোঠার দরজায় টর্চ মারল রবিন। এ ঘরে ফোন নেই। নিচে আছে কিনা দেখে আসি।
দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে ওরা, এমন সময় ছাদ থেকে কিচকিচ শব্দ ভেসে এল। কালো কালো কি যেন ছাদের কড়ি-বর্গা থেকে নেমে এসে উড়তে লাগল ওদের মাথার ওপর।
বাবাগো, ভূত! বলে চিৎকার দিয়ে মেঝে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল মুসা।
খেয়ে গিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর আর রবিনও ঝাঁপ দিল মেঝেতে।
শিকার ফস্কে যাওয়ায়ই যেন দিক পরিবর্তন করল হামলাকারীরা, আবার উঠে গেল ছাদে। বর্গা ধরে ঝুলতে লাগল। সেই সাথে অনবরত কিচকিচ শব্দ করেই চলেছে।
ভ্যাম্পায়ার! বাদুড়ের রূপ ঘরে আছে! রুদ্ধশ্বাসে বলল মুসা। জলদি ভাগো!
ওঠো না, সাবধান করল কিশোর। হামাগুড়ি দিয়ে এগোও। ভূত না হলেও আবার আক্রমণ চালাতে পারে ওরা।
চিলেকোঠার মেঝের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে এগোল তিন গোয়েন্দা। দরজার সামনে পৌঁছে দ্রুত খুলে ফেলল কবাট। হামাগুড়ি দিয়েই বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তারপর বন্ধ করে দিল দরজা।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে ওরা, চোখে পড়ল আরেকটা দরজা। ওটা খুলে একটা হলরূমে ঢুকে পড়ল তিনজনে।
আমার কি মনে হয় জানো? বলল কিশোর। বাড়িটা পরিত্যক্ত। মেঝেতে কার্পেট নেই, হলরূমে কোন আসবাব নেই। ইলেকট্রিসিটি নেই…।
হঠাৎ হলরূমের শেষ মাথায় কিসের যেন শব্দ হলো। থেমে গেল কিশোর। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে। দরজাটা ভেড়ানো। ধাক্কা মেরে দরজা খুলল কিশোর। টর্চ জ্বালল। এ ঘরটাও খালি।
মেঝেতে টর্চের আলো ফেলল সে। হাসতে লাগল। ওই যে ভূতুড়ে শব্দের উৎস!
একটা ইঁদুর। মানুষের সাড়া পেয়ে দৌড়ে পালাল মেঝের গর্তে।
এদিকের সবগুলো ঘর একে একে আলাদা ভাবে পরীক্ষা করে দেখল ওরা।
দোতলায় কেউ নেই, কাজ শেষ করে জানাল মুসা।
আমিও কাউকে দেখতে পাইনি, রবিন বলল।
হু, গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। এবার নিচতলাটা দেখা দরকার।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ওরা, ঢুকল ডাইনিং রূমে। অন্যান্য ঘরগুলোর মত এটাও খালি এবং ধুলোয় ভর্তি। তবে এ ঘরে পায়ের ছাপ চোখে পড়ল ওদের।
দেখো দেখো, পায়ের ছাপ! বলে উঠল উত্তেজিত রবিন।
কেউ এখানে ছিল! ফিসফিস করে বলল কিশোর।
এবং মাত্র কিছুক্ষণ আগে! ঢোক গিলল মুসা।
টর্চের আলোয় পায়ের ছাপগুলো পরীক্ষা করল ওরা। ছাপগুলো রান্নাঘর হয়ে খিড়কির দরজার দিকে চলে গেছে। দরজাটা বন্ধ। আর দ্বিতীয় পায়ের ছাপ এসে মিশেছে লিভিং রুমে।
পায়ের ছাপগুলো একজনেরই, মন্তব্য করল কিশোর। খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সে। আবার বেরিয়ে গেছে ও পথেই।
মেঝেতে টর্চের আলো ফেলে আঁতকে উঠল মুসা। মেঝেতে কতগুলো খড় পড়ে রয়েছে। কেউ এ ঘরে খড়ের গাদা নিয়ে ঢুকেছিল। নাকি কাকতাড়ুয়াটাই…? গায়ে কাঁটা দিল তার। যে-ই হোক, এখনও এ বাড়িতেই রয়েছে সে। সম্ভবত বেসমেন্টে।
যেখানেই থাক, খুঁজে বের করব ওটাকে, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। রহস্যের সমাধান না করে যাচ্ছি না।
ঠিক বলেছ, বলল বটে রবিন, কিন্তু মুখ শুকিয়ে গেছে ওর।
রান্নাঘরে ফিরে এল ওরা। লক্ষ করল আরও কিছু পায়ের ছাপ চলে গেছে বেসিমেন্টের দরজার দিকে। তারপর নেমে গেছে সিঁড়ি বেয়ে।
সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা। ভয়ে ভয়ে চোখ বুলাল চারপাশে। বেসিমেন্ট অর্থাৎ মাটির নিচের ঘরে কেউ নেই। ধুলো জমেছে পুরো হয়ে। জানালায় মাকড়সার জাল। এখান থেকে উঠান বা বাগানে যাবার কোন দরজা চোখে পড়ল না।
পায়ের ছাপ চলে গেছে ফিউজ বক্সের ধারে। ফিউজ বক্স পরীক্ষা করল কিশোর। তার ছেঁড়া। ইলেকট্রিসিটি থেকে থাকলেও বাতি জ্বালানোর কোন উপায় নেই।
পায়ের ছাপের মালিক এখান থেকে চলে গেছে সিঁড়ির দিকে, দেখেটেখে বলল সে।
সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ওরা। যেতে যেতে রবিন বলল, ফোনটোন তো দেখলাম না এখানে। কাজেই সাহায্য পাচ্ছি না আমরা।
কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। দুটো কাজ করতে পারি আমরা এখন। হয় গাড়িতে ফিরে যেতে পারি, নয়তো এখানেই রাত কাটাতে পারি। তবে এখানে রাত কাটানোই বোধহয় ভাল হবে। মেঝেতে শুতে আমার কোন অসুবিধে নেই।
হাই তুলল মুসা। আমারও নেই। খুব ঘুম পাচ্ছে। শোয়ার মত জায়গা যখন আছেই আর দেরি করি কেন?
সে জ্যাকেট খুলে ভাঁজ করল। তারপর মাথার নিচে দিল। বালিশের কাজ দেবে জ্যাকেটটা। রবিন আর কিশোরও তা-ই করল।
শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখল, কিশোর। দেখল গাড়িতে করে একটা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা। মুসা গাড়ি চালাচ্ছে। কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে বলে খুঁজে পাচ্ছে না বাড়িটা। লোকজনকে জিজ্ঞেস করেও লাভ হচ্ছে না। বদমেজাজী লোকগুলো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না। হঠাৎ পেছন থেকে অদ্ভুত গলায় কে যেন বলে উঠল, যে বাড়িটা তোমরা খুঁজছ ওটা ডান দিকে। মোড় ঘোরো। মোড় ঘুরে নাক বরাবর চলে যাও। বাড়িটা দেখতে পাবে।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিলোর। দেখল পেছনের সীটে বসে আছে সেই কাকতাড়ুয়াটা।
ভৌতিক মূর্তিটা ওদের দিকে তাকিয়ে খনখনে গলায় হেসে উঠল। সরু, লম্বা টুপির ডগায় টোকা মেরে বলল, কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি কি ভাবে যেতে হবে। ডান দিকে টার্ন নাও।
মুসা জানে ডান দিকে খাড়া খাদ। সে বাম দিকে হুইল ঘোরাল। তর ডান দিকেই ঘুরে গেল গাড়ি। গতি কমাতে ব্রেক চেপে ধরল। কমার বদলে বেড়ে গেল স্পীড। আতঙ্কিত হয়ে দেখল সোজা খাদের দিকে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। গতি ক্রমে বেড়েই চলেছে।
পেছনের সীটে বসা কাকতাড়ুয়াটা হেসে উঠল ভয়ঙ্কর গলায়। খাদের কিনার লক্ষ্য করে ছুটে গেল গাড়ি। পরক্ষণে ডিগবাজি খেয়ে শূন্যে উঠে পড়ল, সাঁ সাঁ করে নিচে পড়তে শুরু করল, নেমে যেতে থাকল খাদের অতল অন্ধকারের দিকে। পড়ছে তত পড়ছেই! প্রতি সেকেন্ডে খাদের বিকট হ বড় হয়ে উঠছে।
বিজয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল কাকতাড়ুয়াটা। কানে হাত চাপা দিল কিশোর। খাদের পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে ওদের গাড়ি। মারা যাবে ওরা।
ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কোথায় আছে বুঝতে সময় লাগল।
ভয়ানক দুঃসপ্ন! ভাবল সে। কাকতাড়ুয়ার ভয় পেয়ে বসেছে আমাকে।
হঠাৎ বারান্দার কাঠের মেঝেতে ক্যাচকোচ শব্দ উঠল। কে যেন হেঁটে আসছে সামনের জানালার দিকে। উঠে বসল কিশোর।
কাকতাড়ুয়া!
জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। মুখে বিকৃত হাসি।
এখনও কি স্বপ্ন দেখছি? ঢোক গিলল কিশোর। নাকি সত্যিই ঘটছে এ সব
কর্কশ সুরে ফিসফিস করল ভয়ঙ্কর মূর্তিটা। এক্ষুণি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। শেষবারের মত সাবধান করছি।
জানালা থেকে মুখ সরাল কাকতাড়ুয়া। অদৃশ্য হয়ে গেল।
লাফ দিয়ে উঠে বসল কিশোর। দৌড়ে চলে এল দরজায়। জং ধরা ছিটকানি খুলতে সময় লাগল। এক ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল। চারপাশে তাকাতে লাগল।
দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে মুসা আর রবিনেরও। ওরাও চলে এসেছে। চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল মুসা, কি হয়েছে?
ঘটনাটা খুলে বলল কিশোর। কাকতাড়ুয়াটা হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল বুঝলাম না।
ওই তো! হাত তুলে দেখাল মুসা।
যব খেতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওটা। ঝলমলে চাঁদের আলোয় কাকতাড়ুয়ার কুৎসিত চেহারাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
এসো আমার সঙ্গে! চিৎকার করে বলল ওদেরকে কাকতাড়ুয়া। তারপর মাঠের দিকে ছুটতে লাগল।
ওর পিছু নেব, বলল কিশোর। ওকে ধরতে হবে। নইলে এ সব রহস্যময় কাণ্ডকারখানার কোন সদুত্তর মিলবে না।
ঠিক! রবিন বলল।
মুসাও তার সঙ্গে একমত।
যেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে কাকতাড়ুয়া সেদিক লক্ষ্য করে দৌড় দিল ওরা। রাতের আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা আরও বেড়েছে। ঝড় হবে মনে হচ্ছে। গাছের চূড়ায় হাওয়ার মাতম।
যব খেতে ঢুকে পড়ল ওরা। কাকতাড়ুয়া হেলান দিয়ে ছিল যে কাঠের খুঁটির সাথে, সেখানে এসে দেখল খুঁটি খালি। নেই ওটা।
হতাশ ভঙ্গিতে কাধ ঝাঁকাল কিশোর। কাকতাড়ুয়া কোথায় গেছে তাই জানি না। কোথায় খুজব ওকে?
ভূতের মতই হুটহাট করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, মুসা বলল। নিশ্চয় ভূত।
ভূত হোক আর যাই হোক ওকে খুঁজে বার করতেই হবে। এক কাজ করি-তিনজন তিনদিকে যাই। কারও চোখে কিছু পড়লেই চিৎকার করে জানাব। অন্য দুজন ছুটে যাব তখন তার দিকে। কি বলো?
ঠিক আছে, সায় দিল মুসা আর রবিন।
ডান দিকে মোড় নিল কিশোর, যব খেতের আরও গভীরে ঢুকে পড়ল।
সাবধানে হাঁটছে মুসা আর রবিন। দুহাতে গাছ ঠেলে সরাতে সরাতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারপাশে।
দূরে কোথাও কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল, আকাশে পলকের জন্যে ঝলসে উঠল রূপালী বিদ্যুৎ। চাঁদের আলো মেঘের আড়াল থেকে সামান্যই মুখ দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। ছায়া ছায়া অন্ধকার এখন যব খেতে। মুসার কাছে সব কেমন অপার্থিব, ভূতুড়ে লাগছে। শিরশির করে উঠল গা। ভূতদের জনন্য আদর্শ একটি রাত, মনে মনে ভাবল ও।
শক্তিশালী বাতাস এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল মেঘ, হঠাৎ ঝলমলে জ্যোৎস্নায় ভরে গেল যব খেত।
একটা যব গাছের গায়ে এক টুকরো কাপড় আটকে আছে। বাতাসে ফড়ফড় করে উড়ছে। ওদিকে দৃষ্টি আটকে গেল মুসার। টুকরোটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারল এটা কাকতাড়ুয়ার সেই শতছিন্ন কালো কোটের অংশ।
কাকতাড়ুয়া ঐদিকে এসেছে বুঝতে পারল সে। হয়তো খেতের মধ্যে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। লাফ মেরে ঘাড়ে পড়বে। কথাটা ভাবতেই বুক ঢিবঢিব শুরু হয়ে গেল তার। তবে থামল না সে। এগিয়ে চলল। বারবার ডানে বামে তাকাচ্ছে। হাত দুটো সামনে বাড়ানো। সম্ভাব্য হামলার জন্যে প্রস্তুত। তবে ভূত-প্রেতের বিরুদ্ধে কুংফু-কারাতে কতটুকু কাজে লাগবে ভেবে সন্দিহান মুসা।
বেশ খানিকটা পথ হাঁটার পরেও কিছু ঘটল না দেখে মুসা ধারণা করল কাকতাড়ুয়াটা বোধহয় এ তল্লাটে নেই। ঠিক তখনই ওর সামনে খচমচ করে একটা শব্দ হলো। শস্যের ডগা দুলছে। কিছু একটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। তাকে দেখতে পাচ্ছে না মুসা।
পাঁজরের গায়ে দমাদম পিটতে শুরু করল হৃৎপিণ্ড, বেড়ে গেছে হার্টবিট। দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। অপেক্ষা করছে। কাকতাড়ুয়াকে দেখামাত্র চিৎকার করে জানান দেবে কিশোর আর রবিনকে।
খচমচ শব্দটা ক্রমে কাছিয়ে এল। মুখ হাঁ করল মুসা, চিৎকার দিতে যাবে এই সময় যব গাছের ফাঁক দিয়ে একটা লাফিয়ে পড়ল ওর সামনে। পেছন পেছন একটা শিয়াল। শিয়ালটা ধাওয়া করেছে খরগোশকে। দুটো প্রাণীই ঝড়ের বেগে ছুটে গেল মুসার সামনে দিয়ে।
পেশীতে ঢিল পড়ল আবার ওর। খচমচ শব্দটা আবারও হচ্ছে। আবার ফিরে আসছে জানোয়ার দুটো। প্রথমে খরগোশটাকে দেখা গেল। এক দৌড়ে একটা গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ল ওটা। পরমুহূর্তেই হাজির হলো শিয়ালটা। তবে দেরি করে ফেলেছে সামান্য। শিকার হারিয়েছে বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো ওটা। শিয়ালের ভঙ্গিতে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুরে রওনা হয়ে গেল উল্টো দিকে।
অকারণ ভয় পেয়েছে ভেবে মনে মনে হাসল মুসা। তারপর আবার কাকতাড়ুয়ার খোঁজে যাত্রা শুরু করল।
ওদিকে যব খেতের মাঝ দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে কিশোর। প্রতিটি পা ফেলছে সাবধানে। গর্তেটর্তে যাতে পড়ে না যায় সে-ব্যাপারে সতর্ক। এক জায়গার জমিন কাদায়। ওখানে পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। ছাপগুলো চলে গেছে একটা ঝোঁপের দিকে। সেদিকটায় যব গাছগুলো আরও ঘন।
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল কিশোরের। এ কাকতাড়ুয়ার পায়ের ছাপ হয়েই যায় না। ছাপগুলো যেখানে শেষ হয়েছে, সে-জায়গায় পা টিপে টিপে চলে এল সে। হঠাৎ যব গাছের পেছনে একটা আকৃতি দেখতে পেল। উপুড় করা বালতির মত টুপি পরা মূর্তি। কাকতাড়ুয়া!
মট করে কিশোরের পায়ের নিচে একটা শুকনো ডাল ভাঙল। পাই করে ঘুরে দাঁড়াল কাকতাড়ুয়া। হার্টবিট বেড়ে গেল কিশোরের, গলা শুকিয়ে কাঠ।
মুসা! রবিন! জলদি এসো! কাকতাড়ুয়াটা এখানে! গলা লম্বা করে চিৎকার করতে লাগল কিশোর।
ওর কথা শেষ হবার আগেই ছুটতে শুরু করল ভৌতিক মৃর্তিটা। পিছু নিল কিশোর। কাকতাড়ুয়ার পায়ের শব্দ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে এল। অনেক দূরে চলে গেছে। তবে একটু পরেই আবার বাড়তে লাগল শব্দটা।
ওটা আমাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসছে, ভাবল কিশোর। এবার নির্ঘাত হামলা চালাবে। তবে আমিও ওকে ছাড়ছি না। জাপটে ধরব।
পায়ের শব্দ লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল কিশোর। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। অন্ধকার হয়ে গেছে যব খেত। এমন সময় কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ে। শক্ত হাতে জাপটে ধরল। কিশোরও ছাড়ল না। হামলাকারীকে সে-ও জাপটে ধরল প্রাণপণে। জড়াজড়ি করে দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে। রীতিমত কুস্তি শুরু হয়ে গেল।
লড়াইয়ের একটা পর্যায়ে দুজনেই কুস্তির প্যাঁচ থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিল। হিংস্র আক্রোশে আবার পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, তখুনি চাঁদ বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে। এবং সেই সঙ্গে রবিনও এসে দাঁড়াল ওখানে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল একটা মুহূর্ত। পরক্ষণে চিৎকার করে উঠল, আরে কি করছ তোমরা? পাগল হয়ে গেছ নাকি? নিজেরা নিজেরাই মারামারি!
তোমাকে আমি কাকতাড়ুয়া ভেবেছিলাম! ঢোক গিলল মুসা।
আমিও তো তোমাকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছি! হাঁপাচ্ছে কিশোর।
হাসতে শুরু করল রবিন।
হাসিটা সংক্রামিত হলো অন্য দুজনের মাঝেও।
তবে কাকতাড়ুয়াটাকে দেখেছি আমি, হাসি থামলে বলল মুসা। পালিয়েছে। ওটার চেহারা আর দেখব বলে মনে হচ্ছে না।
তবু আরেকবার খুঁজে দেখতে অসুবিধে কি? কিশোর বলল।
আপত্তি করল না কেউ। এবার একসঙ্গে থেকে খোঁজ চালাল ওরা। কিন্তু ব্যর্থ হলো অভিযান। কাকতাড়ুয়ার টিকিটিরও দেখা মিলল না। আবার আগের জায়গায়, কাঠের খুঁটির কাছে ফিরে এল তিনজনে।
অদ্ভুত ব্যাপার! কাকতাড়ুয়াটা আগের মতই খুটির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আবার কি বলবে ওটা? আপনমনে বিড়বিড় করল মুসা।
ওকে জিজ্ঞেস করো তো আমাদের পিছু নিয়েছে কেন? রবিনকে উদ্দেশ্য করে বলল কিশোর।
জিজ্ঞেস করল রবিন। জবাব মিলল না। কাকতাড়ুয়া নিশূপ।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। খামারবাড়িতে ফিরে যাব। ওখানে বসে সিদ্ধান্ত নেব এরপর কি করব।
যব খেতের শেষ মাথায় চলে এসেছে ওরা, গোটা আকাশ জুড়ে লকলকিয়ে উঠল বিদ্যুৎ। তীব্র আলোয় সাদা হয়ে গেল পুরো এলাকা।
পরক্ষণে বিকট শব্দে বাজ পড়ল। আঘাত হেনেছে পুরানো খামারবাড়িটিতে। বিস্ফোরিত হলো ছাদ। দাউ দাউ জ্বলে উঠল আগুন। লেলিহান শিখা এক লাফে উঠে গেল আকাশে।
দৃশ্যটা আতঙ্কিত করে তুলল গোয়েন্দাদেরকে। তবু বাড়ি লক্ষ্য করে ছুটল ওরা। বাড়ির কাছে এসে দেখল ওটা জ্বলন্ত চুম্নিতে পরিণত হয়েছে। ধসে পড়েছে ছাদ, কড়ি-বর্গা দাউ দাউ করে জ্বলছে, জ্বলন্ত তক্তা দুড়ম-দাড়ম শব্দে ছিটকে পড়ছে মাটিতে।
আগাছায় ভরা ড্রাইভওয়েতে থমকে দাঁড়াল ওরা। আগুনের ভীষণ তেজ। কাছে যাওয়া যায় না।
আমাদের কিছু করার নেই, বিড়বিড় করল মুসা। বাড়িটা গেছে।
ভাগ্যিস বাজ পড়ার সময় বাড়ির ভেতরে ছিলাম না। শিউরে উঠল কিশোর! কাকতাড়ুয়ার পিছু না নিলে এতক্ষণে পুড়ে কাবাব হয়ে যেতাম।
বাড়িটার শেষ পরিণতি তাহলে এভাবেই ঘটল, কে যেন এলে উঠল পেছন থেকে।
চট করে ঘুরল ওরা। একজন লোক। একটা পিকআপের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। বাড়ি ধসে পড়ার শব্দে গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়নি ওরা।
পিকআপ থেকে বেরিয়ে এল আগন্তুক। ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
আমি হ্যারি হ্যারিসন, নিজের পরিচয় দিল সে। পাশের খামারবাড়িটা আমার। ফায়ার ডিপার্টমেন্টকে ফোন করেই দৌড় দিয়েছি। এখুনি চলে আসবে। কিন্তু তোমরা কারা?
নিজেদের পরিচয় দিল তিন গোয়েন্দা। জানাল ওদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে রাস্তার ধারে।
ও বাড়িতে ঢুকেছিলাম ফোন করার আশায়। গ্যারেজে গাড়িটা নেয়ার জন্যে সাহায্য দরকার, কিশোর বলল। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে কাউকে দেখলাম না।
কাঁধ ঝাঁকাল কম্পটন। কোত্থেকে দেখবে? বিশ বছরে কেউ এসেছে নাকি ও বাড়িতে। খালি পড়ে ছিল। ভাড়াও দিতে পারছিলাম না। বহুকাল আগেই কে জানি গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে, ভূত বাস করে বাড়িটাতে। জায়গাটা আমার। ভাড়া দিতে না পেরে শেষে বিক্রি করে দেয়ার কথা ভাবছিলাম গত কয়েক দিন ধরে। কিন্তু হলো না। বাড়িটা তো গেল। একটা পয়সাও আর পাওয়া যাবে না ওটা থেকে। জমিটাই যা ভরসা এখন। তবে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। বাড়িটার জন্যে জমিটাও বিক্রি করতে পারছিলাম না।
যে প্রশ্নটা এতক্ষণ ধরে খেচাচ্ছিল কিশোরকে, এবার জিজ্ঞেসই করে ফেলল সে, আপনি নিজেও কি ঢোকেননি এ বাড়িতে?
তা ঢুকেছি। গত কালই তো কিচেনে ঢুকেছিলাম একটা কাজে। কেন?
রান্নাঘরে পায়ের ছাপ দেখেছি।
লিভিং রূমে খড়ও পড়ে থাকতে দেখলাম, মুসা যোগ করল।
আমি মাঠ থেকে গিয়ে সরাসরি বাড়িতে ঢুকেছি, জানাল হ্যারি হ্যারিসন। জুতোয় খড়-টড় লেগে ছিল বোধহয়।
যব খেতটার মালিকও নিশ্চয় আপনি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। আমার নতুন খামারবাড়ি ওই পাহাড়টার পেছনে।
*
সকাল হয়ে গেছে। বজ্রাঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত খামারবাড়ি এখন স্রেফ অঙ্গারের এক স্তূপ। পোড়া আবর্জনার ফাঁকে লকলকে জিভ বের করছে অগ্নিশিখা। ইতিমধে দমকলের একটা গাড়ি চলে এসেছে। কি ঘটেছে অল্প কথায় দমকল অফিসারকে জানিয়ে দিল হ্যারিসন। তারপর ফিরল তিন গোয়েন্দার দিকে।
এখানে আর কিছু করার নেই আমাদের। আমার বাড়িতে চলো। নাস্ত খাবে।
মুচকি হাসল মুসা, নাস্তা পেলে মন্দ হয় না। রবিনের দিকে তাকাল। কি বলো?
নীরবে ঘাড় কাত করে সায় জানাল রবিন। মুখে হাসি।
কিশোর বলল, খিদেয় আমারও পেট চোঁ চোঁ করছে। সারাটা রাত যব খেতে যে হারে ছোটাছুটি করলাম।
হ্যারিসন ওদের নিয়ে পিকআপে উঠল। সামনে জায়গা হলো না চারজনের রবিন বসল সামনে। কিশোর আর মুসা পেছনের খোলা জায়গায়।
ড্রাইভিং সীট থেকে মুখ বের করে পেছনে তাকিয়ে হ্যারিসন বলল, নাস্ত খেয়ে তোমাদের গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব।
শুনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল তিন গোয়েন্দা।
যাবার পথে রবিন বলল, কাল রাতে যব খেতে কার যেন চিৎকার শুনলাম।
আমার চিৎকার শুনেছ, হ্যারিসন জানাল। কুকুরটাকে ডাকবে বেরিয়েছিলাম আমি। খরগোশ দেখলেই তাড়া করে ওটা।
মাঠে যা একটা কাকতাড়ুয়া বসিয়েছেন না!
হেসে উঠল হ্যারিসন। কেউ ভয় পায় না। এমনকি কাকেরাও না।
তবে আমরা পেয়েছি!-মনে মনে বলল রবিন।
কাকতাড়ুয়ার পোশাকটা কিন্তু অদ্ভুত, আলাপ চালিয়ে গেল সে।
মজা করার জন্যে ওগুলো পরিয়েছি ওটাকে, বলল হ্যারিসন। নিলামে পাওয়া কোট-প্যান্ট, জুতোজোড়াও।
এরপর বাকি রাস্তাটুকু আর বিশেষ কথা হলো না। বাইরের দিকে তাকিয়ে গত রাতের কথা ভাবতে লাগল রবিন। ঘটনাগুলো যে সত্যি ঘটেছে, দিনে আলোয় এখন বিশ্বাস করা কঠিন।
মিসেস হ্যারিসন তাঁর স্বামীর মতই ভাল মানুষ। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালে গোয়েন্দাদেরকে। পেট পুরে নাস্তা খাওয়ালেন। রকি বীচ চেনেন তিনি ছোটবেলায় বহু বুছর থেকেছেন। সে-সব নিয়ে গল্প করলেন ওদের সঙ্গে।
নাস্তা খেয়ে মিসেস হ্যারিসনকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল ওরা মিস্টার হ্যারিসন আবার ওদের নিয়ে এল ওদের গাড়ির কাছে।
স্পোর্টস সেডানটা আগের মত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে খাদের পাশে। কম্পট ওদের গাড়ির সামনের বাম্পারে একটা রশি বাধলেন। রশির অন্য প্রান্তটা বেঁধে নিলেন নিজের গাড়ির পেছনে। তারপর টেনে নিয়ে রওনা হলেন গ্যারেজে। মুসা বসল তাদের গাড়িতে, হুইল ধরে। কিশোর আর রবিন উঠল পিকআপের পেছনে। দুই পাশের চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলল।
মাইল দশেক যাবার পরে গ্যারেজের দেখা মিলল। ওদেরকে সাহায্য করার জন্যে হ্যারিসনকে বারবার ধন্যবাদ দিল তিন গোয়েন্দা। সময় আর গাড়ির পেট্রোল খরচ করার জন্যে টাকা সাধল। কিন্তু নিলেন না হ্যারিসন। বললেন, ওদের সাহায্য করতে পেরে তিনি খুশি। তারপর পিকআপ নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন বাড়ির দিকে।
কিশোরদের ভাড়া করা গাড়িটা পরীক্ষা করে দেখল গ্যারেজের মেকানিক। সমস্যাটা ফুয়েল পাম্পে। সারিয়ে দিল ত্রুটিটা। জ্যান্ত হয়ে উঠল ইঞ্জিন। গাড়িতে উঠে পড়ল তিন কিশোর। হুইল ধরল মুসা।
আবার সেই যব খেতের সামনে দিয়েই তো যেতে হবে, তাই না? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
কাকতাড়ুয়াটাকে আবার দেখতে পারব কিনা কে জানে!
হাতের চেটো দিয়ে থুতনি ঘষতে ঘষতে বিড়বিড় করল রবিন, কিশোর, ওই কাকতাড়ুয়াটাই কিন্তু এবার আমাদের জীবন বাঁচাল।
মাথা ঝাঁকাল মুসা। যেন বাড়িটাতে বাজ পড়বে যে তা সে আগে থেকেই জানত। ওই বাড়ি থেকে আমাদের দূরে থাকতে সাবধান করেছিল। কিন্তু তারপরেও বাড়িতে ঢুকেছি দেখে কৌশলে বের করে এনেছিল।
সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। এত সব চালাকি না করে আমাদেরকে বিপদটার কথা সরাসরি জানিয়ে দিলেই পারত।
তারমানে সন্দেহ আছে তোমার? রেগে গেল মুসা। তুমি আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ।
হেসে ফেলল কিশোর। ভূতের কাছে কৃতজ্ঞ হতে বলছ?
আর কোন কথা না বলে নীরবে গাড়ি চালাল মুসা।
যব খেতের সামনে চলে এল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাকতাড়ুয়াটাকে কাঠের খুঁটির সাথে বাঁধা অবস্থায় আগের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল।
নামবে নাকি? ঠাট্টার সুরে বলল কিশোর। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে ওকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসি?।
মুখটা গোমড়া করে রাখল মুসা। জবাব দিল না।
যব খেতের দিকে তাকিয়ে আছে তিনজনেই। পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হলো কাকতাড়ুয়াটা হাসছে ওদের দিকে চেয়ে। তবে ক্রুর হাসি নয়, বোকা বোকা হাসি।
<