ব্যস, কাজ শেষ, আর গরু নেই, বলল ক্লিন্ট। শার্টের হাতায় মুখের ঘাম মুছল। এত কম জানলে কষ্ট করে ঝোঁপঝাড় থেকে বের করতাম না।

সান্ত্বনা দিয়ে হাসল বেনন আর ব্যাগলে। ব্যাগলে বলল, ওগুলোর গায়ে এখন তোমার ব্র্যান্ড আছে।

ভ্রূ কুঞ্চন কমল না ক্লিন্টের। বলল, ওদের গায়ে আমার ব্র্যান্ড আছে ঠিকই, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আগামীকাল নিজের বলে কোন জমিই থাকবে না আমার যে ওগুলোকে চরাব।

স্বাভাবিক কারণেই হতাশা বোধ করছে ক্লিন্ট। বেনন এবং ব্যাগলে ওকে মিথ্যে আশ্বাস দিল না। ক্লিন্টের সমস্ত গরু জড় করে ব্র্যান্ড করেছে ওরা। ব্র্যান্ড করা শেষে ছেড়ে দিয়ে এসেছে উত্তরের ঝোঁপঝাড় ভরা দুর্গম রেঞ্জে। আসার পথে আরও গোটা পঞ্চাশেক গরু ওরা ধরে এনেছিল, সেগুলোও সব ব্র্যান্ড করা শেষ হয়ে গেছে। সেজব্রাশের জঙ্গলে ওগুলোকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে।

ডায়ার, রিন্টি ডেনভার, কন লেভিস আর স্টেসি ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। তরুণ কাউবয়রা সিগারেট ধরাল, ডায়ার চিউয়িং টোবাকোর একটা টুকরো কামড় দিয়ে কেটে মুখে পুরল। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছে, ক্লিন্ট ডসন ওদের পরবর্তী নির্দেশ দেবে।

এবার আমরা শহরে চলে যাব, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ক্লিন্ট।

তরুণ কাউবয়দের চেহারায় আপত্তির ছাপ পড়লেও ডায়ারের চৌকো চেহারা বেশ নিশ্চিন্ত দেখাল। ডিলনের কাছ থেকে চুরি করে আনা ঋণপত্র গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাগলে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। বেশ খানিকটা বিস্মিত বোধ করছে সে। কেউ এব্যাপারে কিছু বলছে না কেন? জিজ্ঞেস না করাটা ভাল লক্ষণ। তাছাড়া ব্যাগলে ঘুমিয়ে ছিল, কোন প্রমাণ নেই যে কুকীর্তিটা সে করেছে। কিন্তু কেউই কিছু বলবে না? যতবার ব্যাগলে ঢুলুঢুলু চোখে ওর চোখে তাকাচ্ছে। বা নিচু স্বরে বেননের সঙ্গে কথা বলছে, বুকের ভেতরে অস্বস্তির ছুরি খচখচ করছে ডায়ারের। স্থির করেছে বেনন আর ব্যাগলের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। এখন ডসনের কথা শুনে মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এবার চলে যেতে কোন বাধা নেই। র‍্যাঞ্চই নেই তো সে থেকে কি করবে! এখন চলে গেলে কেউ কোন সন্দেহ করবে না। তবে কথাবার্তায় অতি উৎসাহ দেখানোটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাহলে আমার বাড়তি ঘোড়াটা নিয়ে আসি, কিছুক্ষণ চিন্তার ভান করে বলল ডায়ার। রলিন্সের এক লোক ওটার জন্যে আমাকে ভাল টাকা দিতে চেয়েছিল।

বিরক্ত দৃষ্টিতে ডায়ারের দিকে তাকাল ক্লিন্ট। তারপর চোখ থেকে বিরক্তিটুকু মুছে গেল অতি দ্রুত। যেভাবে ডায়ার বলেছে তার বাড়তি কোন ঘোড়া দরকার নেই, রাগিয়ে দিয়েছিল ওকে। ঠিকই বলেছে লোকটা। ট্রিপল বারে তার আর কোন কাজ নেই। ডেনভার, লেভিস আর স্টেসির দিকে তাকাল ক্লিন্ট। শান্ত গলায় বলল, বাড়তি ঘোড়া শহরে নিয়ে যাব আমরা। মিস রাশল্যান্ডের করালে জায়গা আছে। আশা করি সেখানে ঘোড়া রাখতে দেবে সে আমাদের।

সিগারেট নিভিয়ে করালে গেল তরুণ তিন কাউবয়। তাদের পিছু নিল ডায়ার। বেনন আর ব্যাগলের দিকে ফিরল ক্লিন্ট। তোমরা আসছ?

এখনই নয়। শহরে দেখা হবে। দূরের টিলাগুলো দেখল বেনন। এদিকের অনেক জায়গা আছে আমরা একেবারেই চিনি না। শহরে যাবার আগে এই এলাকা একবার ভাল মতো দেখে যেতে চাই।

তাহলে শহরে তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে করালের দিকে চলল ক্লিন্ট। হাত তুলে ওকে বিদায় জানাল বেনন আর ব্যাগলে, দেখল অবশিষ্ট ক্রুদের সঙ্গে আলাপ করছে ক্লিন্ট।

চলো তাহলে, বলল বেনন। তাকিয়ে আছে টিলাসারির দিকে।

চলো। সায় দিল ব্যাগলে।

দু’জন পাশাপাশি ঘোড়া ছোটাল ওরা। একটা ঢাল পার হতেই ট্রিপল বারের। বাড়িগুলো অদৃশ্য হলো। সামনে ঢেউ খেলানো ঘাসজমি। এখানে ওখানে। ঝোঁপঝাড়। টিলার যত কাছে যাওয়া যাবে, ঘাসের পরিমাণ কমে যাবে, বাড়তে থাকবে ঝোঁপ আর বুনো আগাছা।

ট্রিপল বারের সীমানায় যে টিলাগুলো মাথা তুলেছে সেগুলোর একটার সঙ্গে অন্যটার চেহারায় কোন মিল নেই। কিছু আছে ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছে, দেখে। মনে হয় ঘাসজমির তলায়, কেউ একজন আঙুল দিয়ে খোঁচা দিয়েছিল। ওই। টিলাগুলোর মাথা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। আবার কিছু আছে একেবারেই উলঙ্গ। গায়ে কিছু নেই। কালো পাথর মুখ ভেঙচি কাটছে। এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ, প্রাণহীন। ওগুলোর চুড়ে কুকুরের দাঁতের মতো চোখা। একেকটা টিলার ওরকম দশ বারোটা করে চুড়ো আছে। মন্ট্যানার এই অংশ পাহাড়-পর্বত, র্যাভিন, গোপন উপত্যকা, গুহা, আর ঝোপে ভরা দুর্গম এলাকা। ট্রিপল বারের রেঞ্জ ভাল মতো চিনতে হলে বেনন আর ব্যাগলের অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। হাতে অত সময় নেই। মোটামুটি ভাবে এলাকার একটা ধারণা পেতে চাইছে ওরা। চোখ কান খোলা রেখেছে, এগিয়ে চলেছে ট্রিপল বার রেঞ্জের ভেতর দিয়ে বার কিউয়ের দিকে।

গোল একটা টিলার কাঁধে উঠে নিচের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছে ওরা। বেশ কিছুক্ষণ পর বাঁক নেয়ার সময় ঘোড়া থামিয়ে ফেলল বেনন। আঙুল তাক করে নিচের দিকে দেখাল। একটা লোক ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। তার পেছনে একটা আরোহীবিহীন ঘোড়া।

ওই যে ডায়ার, বলল ব্যাগলে। রিলিঙ্গে যাবে বলেছিল। সে-তুলনায় অনেক সরে এসেছে দেখছি!

হাসল বেনন। ও জানে ও কোথায় যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আমরা জানি না।…এখন জানব।

প্যাঁচ আছে ডায়ারের মধ্যে, মন্তব্য করল ব্যাগলে। ক্লিন্টের তুলনায় অনেক ভাল করে জানে লোকটা, এখানে আসলে কি হচ্ছে।

চুপ হয়ে গেল ওরা। নীরবে অনুসরণ করতে শুরু করল প্রাক্তন ফোরম্যানকে। মাইল খানেক পথ টিলার কাঁধে কাঁধে চলতে পারল ওরা, তারপর সামনে পড়ল টিলার খাড়া দেয়াল। বাধ্য হয়ে আরেক দিক দিয়ে পথ খুঁজে নামতে হলো। ডায়ারকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু পরিষ্কার ধারণা আছে ওদের, কোথায় থাকতে পারে লোকটা।

ডিলনের হেডকোয়ার্টার পাশ কাটাচ্ছে ডায়ার, মাইল দেড়েক পর বিড়বিড় করে বলল বেনন। র‍্যাঞ্চ হাউজে যদি যেতে চাইত তাহলে দক্ষিণ-পুবে বাঁক নিত।

মাঝে মাঝেই ডায়ারকে দেখতে পাচ্ছে ওরা, বসে আছে স্যাড়লে কুঁজো হয়ে। অনেকটা পেছন থেকে অনুসরণ করা হচ্ছে। টিলার রাজা পেরিয়ে নদীটা যেখানে সমতল জমিতে বেরিয়ে এসেছে, সেখানে নদী পেরল ওরা। আরও এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, এখনও এগিয়ে চলেছে ডায়ার। টিলার গা ঘেঁষে যাচ্ছে কোথায় নোকটা!

কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের একটা ফাটলে ঢুকে পড়ল ডায়ার। খুবই সরু ফাটল। চওড়ায় সাত ফুট হবে না। পাশাপাশি দুটো ঘোড়া চলতে পারবে কোনমতে।

ঘোড়া থেকে নামল বেনন আর ব্যগিলে। স্যাডল রোল থেকে পুণে শার্ট বের করে ছিড়ল টুকরোগুলো ঘোড়ার খুরে বেঁধে দিল যাতে আওয়াজ কম হয়। তারপর ঢুকলা পাহাড়ী ফাটলে। এগিয়ে চলল সাবধানে এতক্ষণ আলোর মাঝে ছিল, এখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো। ফাটলের সামনে থেকে সামান্য আলো আসছিল, বাক মুরতে সে-আলোও আর থাকল না। ওপরের একচিলতে আকাশ। থেকে আবছা একটু আলো আসছে। ওটুকুই ভরসা।

ফাটলের বাইরে যত্ন করে সমস্ত চিহ্ন মুছে রাখা হয়েছিল। ভেতরে ঢোকার পর আবছা আলোতেও প্রচুর গরুর চিহ্ন দেখা গেল। পাহাড়ী কাট-এর ভেতরে গোবরের গন্ধ বেশ জোরাল। মেঝেতে ঘোড়ার খুরের চিহ্ন যত্রতত্র। নিয়মিত এজায়গা রাসলিঙের কাজে ব্যবহার করা হয়। চোখ-কান খোলা রেখে অতি ধীরে সামনে বাড়ছে ওরা। অস্ত্রের বাঁট ছুঁয়ে আছে দু’জনেরই হাত। বিপদের একটু আলামত দেখলেই গুলি করবে।

পুরো এক ঘণ্টা হলো ভুতুড়ে এই কাট-এর মধ্যে দিয়ে চলছে ওরা। শেষ মাথায় কি আছে কে জানে। দু’পাশ থেকে মাঝে মাঝে চেপে আসছে দেয়াল। কখনও কখনও মাথার ওপরের সরু আঁকাবাঁকা আলোটাও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। একসময় শেষ হলো পথ চলা। সামনে পাথুরে নির্জীব খাড়া দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই দেয়ালের পায়ের কাছে পড়ে আছে বড় বড় কয়েকটা বোল্ডার। ওগুলোর যেকোনটার পেছনে অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পাররে দু’জন অশ্বারোহী। সাবধানে এগোল ওরা। কেউ ওদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে নেই। স্যাডল থেকে নামল বেনন আর ব্যাগলে, ঘোড়া দুটো একটা বোল্ডারের পেছনে লুকিয়ে রেখে গভীর মনোযোগে দেখল আকাশ ছোঁয়া পাথুরে দেয়াল।

কিছুক্ষণ পর শ্রাগ করে দেয়ালের দিক থেকে ফিরল বেনন, নিজের পদক্ষেপের চিহ্ন দেখতে দেখতে এগোল সামনে। পাথুরে মেঝেতে পুরু ধুলো। তাতে নানারকমের চিহ্ন। মেঝের দিকে চোখ থাকায় এবার অনায়াসে পেয়ে গেল ও যা খুঁজছিল। গরু আর রাসলাররা বাতাসে মিলিয়ে যায়নি। একটা জায়গা আঙুল তুলে দেখাল বেনন। পাশে দাড়িয়ে গলা বাড়িয়ে সেদিকে তাকাল ব্যাগলে।

খানিক দূরে একজায়গায় হঠাৎ করেই প্রশস্ত হয়ে গেছে পাহাড়ী খাদ। ওখানে, ডানদিকের দেয়ালে একটা গুহা! যথেষ্ট চওড়া। একসঙ্গে চারটে করে গরু ঢুকতে পারবে। গুহার সামনে একটা বড় বোল্ডার এমন ভাবে আছে যে খাদ ধরে সামনে এগোনোর সময় গুহাটা দেখা যায় না। অন্ধকারে কালো দেয়ালের সঙ্গে প্রায় মিশে আছে গুহার ঘোর কালো মুখ।

ঘোড়া যেখানে আছে সেখানেই থাক, ফিসফিস করে বলল বেনন। ভেতরে কি আছে কে জানে!

কোমাঞ্চিদের মতো নিঃশব্দ সতর্কতায় গুহায় ঢুকল ওরা। একশো গজ সামনে হঠাৎ করেই ডানদিকে বাঁক নিয়েছে সুড়ঙ্গ, সেখান থেকে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গের মেঝে। আধ মাইল হাঁটার পর আবার বামদিকে ঘুরল সুড়ঙ্গ। দূর থেকে একটা গরুর ডাক শুনতে পেল ওরা। ব্যাগলেকে থামতে ইশারা করল বেনন, নিজে সাবধানে সামনে বাড়ল। মিনিট দশেক পর ফিরে এলো, ব্যাগলেকে সঙ্গে আসতে বলল।

এখনও উঁচুতেই উঠছে গুহার মেঝে। একটু পরেই নামতে শুরু করল। মাথার ওপর এখন আর পাহাড় নেই। আবার দেখা যাচ্ছে ওপরের একচিলতে নীল আকাশ। আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে উঠছে ফাটলের ভেতরটা। একটা বাঁক ঘুরতেই ফাটল থেকে বেরোনোর পথ দেখা গেল, চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে সূর্যের আলো।

বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। এদিক ওদিক পড়ে আছে কয়েকটা প্রকাণ্ড বোল্ডার। কিছুটা নিচে, সামনে একটা উপত্যকা। ঢালু হয়ে উপত্যকায় মিশে গেছে পাহাড়ের গা। জমিতে তাজা সবুজ ঘাস। চরছে অসংখ্য গরু। এক হাজারের কম হবে না। সবগুলোই মোটাতাজা। পুরো উপত্যকা দেখতে পাচ্ছে না বেনন আর ব্যাগলে। আরও কত গুরু আছে কে জানে। বড় একটা র‍্যাঞ্চ গড়া যাবে শুধু যেগুলো দেখতে পাচেছ সেগুলো দিয়েই।

ওগুলো একই ব্র্যান্ডের গরু নয়, বেনন, ফিসফিস করে বলল ব্যাগলে।

মাথা দোলাল চিন্তিত বেনন। ট্রিপল বার, বার কিউ আর লেজি জে-এর ব্র্যান্ড দেখতে পাচ্ছি। আরও কোন্ ব্র্যান্ডের আছে কে জানে!

ধরে নিতে হয় কোন অন্ধ লোক নিজের গরুর সঙ্গে অন্যের গরু মিশিয়ে ফেলেছে! বিড়বিড় করল ব্যাগলে।

ওই দেখো! আঙুল তুলল বেনন। যেখানে আঙুল তাক করেছে সেখানে একটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেছে উপত্যকা। ওখানে দু’জন অশ্বারোহী। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আসছে লোক দুটো।

কেগল আর ডায়ার। ভ্রূ কুঁচকে গেল ব্যাগলের। ভাল ফন্দি করেছে। দুই শত্রু-র‍্যাঞ্চের দুই ফোরম্যান একজোট হয়ে মিলেমিশে চুরি শুরু করবে এটা কেউ ভাবতে পারবে না।

এখানে আসতে বড়জোর দশ মিনিট লাগবে ওদের, বলল কেনন। বড় কোন বোল্ডারের পেছনে লুকিয়ে পড়লে দেখতে পাবে না, পাশ কাটিয়ে চলে যাবে।

ঘোড়াগুলো যদি বেশি ভীতু না হয়, যোগ করল ব্যাগলে। ওগুলো আমাদের উপস্থিতি জানান দিলে গানফাইট ছাড়া উপায় থাকবে না।

বোল্ডারগুলোর একেবারে পাশ দিয়েই পথ। তবে ধরা পড়ার ভয় খুব কম। সূর্যালোকিত উপত্যকা থেকে প্রায়-অন্ধকার গিরিপথে আসছে কেগল আর ডায়ার। বেননের ইশারায় বড় একটা বোল্ডারের পেছনে চলে এলো ব্যাগলে। বিপদ আশা করছে না ওরা, তবে অস্ত্র বের করে রেখেছে হাতে।

পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেগলের কথা কানে এলো। তোষামোদ সব সময় কাজে আসে। ডিলন ভাবছে সে এই এলাকার অঘোষিত রাজা। দম্ভে সারাক্ষণ এতই ফুলে আছে যে গড়বড় আছে টেরও পাচ্ছে না। ঝামেলা করে ফেলেছিলাম শালার প্রেমিকার গায়ে হাত তুলে। ভেবেছিলাম হারামজাদী ডিলনকে বলে দেবে। তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম, ডিলন কিছু বললেই চাকরি ছে দিতাম। দরকার হলে। ডিলনকে খুন করতাম। কিন্তু বেটি কিছু বলেনি।

ডিলনকে মেয়েটা ঘৃণা করে। যেকোন মেয়ে করবে ওরকম জোর খাটাতে গেলে। ডিলন সবকিছুতে এতই নিশ্চিত যে আর কারও মানসিকতা বোঝার, ক্ষমতা ওর নেই। শালা একটা গাধা! ডায়ারের প্রাণখোলা হাসি গিরিপথের দুদিকের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। এবারের ড্রাইভ শেষ হবার পর আর ফিরে আসার দরকার নেই, সোজা পুবে চলে যাওয়া যাবে, কি বলো? ওখানে আমরা…

দুই রাসলার দূরে চলে গেছে। পুবের কথা কি যেন বলল কেগল, শুনতে পেল না বেনন আর ব্যাগলে। লোক দু’জন অনেক দূরে চলে গেছে নিশ্চিত হয়ে বোল্ডারের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, হাঁটতে হাঁটতে একসময় ফিরে এলো প্রায়-অন্ধকার গিরিপথে রেখে যাওয়া ঘোড়র কাছে। নিরাপদেই আছে, ওদের ঘোড়া দুটো, ঝিমাচ্ছে।

ট্রিপল বারের পাঁচশোর বেশি গরু আছে ওই উপত্যকায়, একটা সিগার। ধরিয়ে বলল বেনন। অনেকদিন ধরেই গরু সরাচ্ছে কেগল আর ডায়ার। ক্লিন্ট যখন শেষ রাউন্ডআপ করে তার আগেই গরু এনে রেখেছে এখানে, তা নাহলে ক্লিন্ট টের পেয়ে যেত কত গরু আছে ওর।

আমারও তাই ধারণা। সিগারেটে কষে টান দিয়ে স্যাড়লে উঠল ব্যাগলে, বেননের পেছনে পেছনে ঘোড়া সামনে বাড়িয়ে বলল, তারমানে কেগল আর ভায়ার এখান থেকে চলে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির না করা পর্যন্ত হাতে সময় পাচ্ছি আমরা। কোন তাড়াহুড়ো নেই। গরুগুলোকে জড় করে এখনই ক্লিন্টের রেঞ্জে না ছাড়লেও চলে।

এখন বুঝতে পারছি ঋণের কাগজ নিয়ে ডিলন কেন বাড়াবাড়ি করেনি, বলল বেনন। এটা যখন চুরি যায়, আমি ভেবেছিলাম আমার গালাগালগুলো। ডায়ার ডিলনকে দিয়েছে। কিন্তু আসলে ওটা এখন আছে কেগলের পকেটে। পড়েছে কিনা খোদা জানেন। পড়লে ডায়ারকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে চাইবে।

আবছা অন্ধকার গিরিপথ থেকে এক সময় শেষ বিকেলের সূর্যালোকিত পাহাড়ী এলাকায় বেরিয়ে এলো দুই বন্ধু। দুজনই চিন্তিত। দুজনই ওরা একই। সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। হাতে অনেকগুলো ভাল তাস নিয়ে খেলছে কেগল। ক্লিট বা ডিলন, যে-ই জিতুক, আখেরে লাভ কিছু কম হবে না কেগলের। ঋণের প্রমাণ নেই, তবু যদি ডিলন উপলবার দখল করে, আইনের চোখে সেটা বৈধ হবে না। এই এলাকা থেকে আইন খুব দূরে নেই। রলিন্সে শেরিফ আছে, জাজ আছে। তারা যদি হস্তক্ষেপ করে, বিপদে পড়ে যাবে ডিলন। কিন্তু কোলের কিছু হবে না।

সে বলবে সাধারণ এক কর্মচারী সে। মালিকের নির্দেশে অন্ধবিশ্বাসে কাজ করে। গেছে, ভেবেছে মালিক আইনসিদ্ধ ভাবেই ট্রিপল বার দখল করেছে।

বিকেলে টুইন স্প্রিংস শহরে ঢুকল ক্লিন্ট, লেভিস, ডেনভার আর স্টেসি। শহরের প্রান্তে রাশল্যান্ডের বিরাট করাল। ওখানে নিজের পছন্দের ঘোড়াগুলোকে রাখত ব্যাঙ্কার। ট্রিপল বার থেকে নিয়ে আসা গোটা দশেক ঘোড়া রাখতে সেখানে থামল কাউবয়, তিনজন। ক্লিন্ট গেল শার্লির সঙ্গে দেখা করতে। বাড়িতে নেই মেয়েটা, কাজেই সেখানে হয়ে সদর রাস্তা ধরে ব্যাঙ্কের দিকে চলল সে।

হিচরেইলে ঘোড়া বেঁধে বোর্ডওয়াকে উঠল ও, ব্যাঙ্কের দরজা ঠেলে ঢুকল ভেতরে। একটা ডেস্কের পেছনে বসে আছে শার্লি, কাঁধের ওপর স্থূপ হয়ে আছে সোনালী একরাশ চুল। কাউন্টার পার হয়ে শার্লির পাশে চলে এলো ক্লিন্ট। এতক্ষণ একটা লেজারে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখছিল শালি, সদর দরজা। খোলার আওয়াজে মুখ তোলেনি। আগন্তুক কাছে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেয়ে চোখ তুলে তাকাল। অভ্যর্থনার হাসিটা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী হলো, মুহূর্ত পরেই শার্লির চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া পড়ল। কি-কি চাও, ক্লিন্ট? দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল মেয়েটা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

নিজেকে হঠাৎ করেই অনাকাক্ষিত মনে হলো ক্লিন্টের। অজান্তেই এক পা এগিয়ে গিয়েছিল ও, শার্লিকে পিছাতে দেখে অপমানিত বোধ করল। বিচলিত চোখে তাকিয়ে আছে শার্লি, হাত দুটো বুকে ভাজ করে রেখেছে।

র‍্যাঞ্চ থেকে ঘোড়াগুলো নিয়ে শহরে চলে এসেছি, আড়ষ্ট গলায় বলল ক্লিন্ট। ভাবলাম তুমি হয়তো তোমার করালে ওগুলো রাখতে দেবে।

মাথা দোলাল শার্লি। তাকাচ্ছে না, চোখ মেঝের দিকে। একবার মুহূর্তের জন্যে চোখ তুলেও দৃষ্টি, সরিয়ে নিল। অবশ্যই, ক্লিন্ট। যতদিন ইচ্ছে করাল ব্যবহার করতে পারো।…তুমি কি শহরেই থাকবে এখন থেকে? শেষ কথাটায় মেয়েটার স্বরে স্বস্তির সুর ক্লিন্টের কানে বাজল। আনন্দশূন্য হয়ে গেল অন্তরটা। ট্রিপল বার ছেড়ে আসায় ডিলনের সঙ্গে সংঘাত হবে না, এটাই কি শার্লির স্বস্তির। কারণ? ডিলন সুপুরুষ, সুঠামদেহী, বিত্তশালী, ক্ষমতাবান। আর ও? বলতে গেলে পথের ফকির।

আপাতত শহরেই থাকব, বলল ও নীরস গলায়। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে।

আমিও তাই চাই। কোন রক্তপাত ছাড়াই ঝামেলা মিটে যাক।

মেয়েটার চেহারায় উদ্বেগ আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব ফিরে এসেছে আবার। বুকের খাঁচায় ধড়াস ধড়াস করে বাড়ি খেতে শুরু করল হৃৎপিণ্ডটা, গলা শুকিয়ে এলো, নিজেকে মনে হলো করুণার পাত্র, তিক্ত হয়ে গেল ক্লিন্টের মনটা। শার্লি চাইছে ক্লিন্ট এখন। চলে যাক। অথচ কত কথা ওর বলার আছে শার্লিকে! কত কথা ও শুনতে চায় প্রাণভরে। কিন্তু মেয়েটা আচরণ দিয়ে এমন একটা অদৃশ্য দুর্লজ্জ দেয়াল তুলে দিয়েছে যে ডিঙানো যায় না চাইলেও।

আঙুলের ডগায় বার কয়েক সমব্রেরো হ্যাট হোরাল ক্লিন্ট, অস্বস্তি কাটাতে চাইল। তারপর অনিশ্চিত ভঙ্গিতে পা বাড়াল দরজার দিকে। দু’পা গিয়ে থেমে বলল, করালে ঘোড়া রাখতে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ, শার্লি। স্টেবলে রাখতে হলে যে খরচ হতো তাতে পোষাতে পারতাম না। আমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়।

ক্লিন্ট, আশা করেছিল শার্লি কিছু বলবে। মেয়েটা যখন কিছু বলল না, এক বুক হতাশা নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল ও। কাউন্টার পার হয়ে এসেছে, এমন সময়ে পেছন থেকে ডাক দিল শার্লি।

ক্লিন্ট!

ঘুরে দাঁড়াল যুবক র‍্যাঞ্চার। শিরায় শিরায় বেড়ে গেছে রক্তের গতি। কয়েক পা এগিয়ে এসেছে শার্লি। এক হাত সামনে বাড়ানো। ক্লিন্টকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে থেমে গেল। কি যেন বলার আছে, কিন্তু দ্বিধার ছাপ পড়ল চেহারায়, কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মনস্থির করল, বলবে না। হাত নামিয়ে নিল।

শার্লির কিছু বলার নেই বুঝতে পেরে ব্যাঙ্ক থেকে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো ক্লিন্ট। ঠোঁট দুটো শক্ত ভাবে বসে আছে পরস্পারের ওপর। চিনচিনে একটা ব্যথা বুকের ভেতর। কেমন করে যেন দূরে চলে গেছে শার্লি। প্রতিনিয়ত আরও দূরে চলে যাচ্ছে। যাবে। যাওয়াই নিয়তি।

রাশল্যান্ডের করালে চলে এলো ক্লিন্ট, দেখল ঘোড়াগুলোকে একটা একটা করে ছাড়ছে ডেনভার, স্টেসি আর লেভিস। ওদের কাজ শেষ হলে একসঙ্গে লিভারি স্টেবলে এলো চারজন, ব্যক্তিগত ঘোড়া ওখানে রেখে হেঁটে বেরোল স্টেবল থেকে, ঠিক করেছে সেথ হারবেনের গিমক্র্যাক হোটেলে গোসল আর খাওয়া সেরে শহরের পরিবেশ বুঝতে বেরবে।

হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেথ হারবেনন, স্টেজকোচটাকে রলিন্সের উদ্দেশে ছাড়তে দেখছে। ক্লিন্টকে দেখে জ নাচাল।

সেমিনো পীকে সোনা পাবার ব্যাপারটা কি? জানতে চাইল ক্লিন্ট। একটু বলো তো শুনি! তুমি পেলে কিছু?

হারবেনের মাথায় পাতলা চুল, কোনমতে টাক ঢেকেছে। লজ্জিত চেহারায় চুলে হাত বোলাল সেথ হারবেনন। কি আর বলব, সবার মতোই লোভে পড়ে ঠক খেয়েছি। সেজন্যে দুঃখ নেই, দুঃখ এজন্যে যে শয়তান মাইনারের কথায় শহরটা আমরা খালি করে চলে গেলাম বলেই বুড়ো রাল্যান্ড আর ক্রিসি বেচারা বেঘোরে মরল। আসলে আমার মতো মানুষের লোভের কারণেই ওদের মৃত্যু হলো।

নিজেকে খামোকা দোষ দিচ্ছ, সেথ, সান্তনা দিল ক্লিন্ট। সোনা এমনই জিনিস যে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি ঘোলা করে দেয়।

রুব বাতাসে তার চাবুকের শিস তুলল। ঘোড়াগুলো ধুলোর ঝড় তুলে ছুটতে শুরু করল, ক্যাঁচকোচ শব্দ করে দুলতে দুলতে চলল স্টেজকোচ রলিন্সের উদ্দেশে। ধুলো থিতিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ক্লিন্ট, তারপর মত বদলে সেথের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বোর্ডওয়াক ধরে এগোল। ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসও পেছন পেছন চলেছে। গল্প করছে ওরা। অনেকদিন পর শহরে এসেছে, আলাপ করছে সময়টা কিভাবে উপভোগ করা যায়।

ক্যাসিনো সেলুনের সামনে বোর্ডওয়াকে থামল ওরা, দক্ষিণ দিক থেকে আসতে দেখল ছয়জন অশ্বারোহীকে। তাদের মাঝে লিউ ডিলনকে চিনতে কষ্ট হয় না, বসে আছে বিরাট একটা বে গেল্ডিঙে { বাছা বাছা কয়েকজন গানম্যান আছে ডিলনের দলে। লোকগুলো সামনে চলে আসায় আড়ষ্ট হয়ে গেল ক্লিন্ট। পরিবেশটা হঠাৎ করেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, টের পেল তরুণ কাউবয়রা। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। হাত চলে গেল হোলস্টারের পাশে। ঠিক ওদের সামনে থামল ডিলনের দলটা। ট্রিপল বারের কাউবয়রা সংখ্যায় কম, তবে ক্লিন্ট জানে, প্রয়োজনে লড়তে ভয় পাবে না ওর ছেলেরা।

ডিলনের লোকরা একটু ছড়িয়ে অবস্থান নিল। গোলমাল করার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে জ্বলজ্বল করছে ওদের চোখ। দৃষ্টিতে আশা, ক্লিন্ট ত্যাড়ামি করলে ঝামেলা পাকিয়ে বসবে। সংখ্যাধিক্য ওদের মনে বাড়তি সাহস যোগাচ্ছে।

ডিলন তাকিয়ে আছে ক্লিন্টের চোখে, দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট টিটকারি। কাউবয়দের সহ ক্লিন্টকে শহরে দেখেই বুঝে নিয়েছে সে যা বোঝার। হার মেনে নিয়েছে। ক্লিন্ট। কিন্তু মনে পরিপূর্ণ শান্তি পাচ্ছে না ডিলন। ক্লিন্ট যদি লড়াই করে হেরে যেত তাহলে অনেক বেশি মানসিক তৃপ্তি পেত সে, কিন্তু ক্লিন্টের আচরণে কোন উগ্রতা নেই। টিটকারির হাসিতে ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল ডিলনের, কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শার্লিকে সে কথা দিয়েছে ক্লিন্টের সঙ্গে গোলমালে জড়াবে না, কাজেই বলছে না কিছু। কিন্তু মনে মনে আশা করছে কথা না বলেও ক্লিন্টকে উসকে দিতে পারবে।

অফিস থেকে বের হয়ে বোর্ডওয়াকে দাঁড়িয়ে আছে জারম্যান, তাকে পাত্তা দিল না ডিলন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্লিন্ট। ধীরে ধীরে রক্ত চড়ে যাচ্ছে মাথায়। ডিলনের ইচ্ছে পূরণ হতো, কিন্তু এই সময় খুলে গেল ব্যাঙ্কের দরজা। বাইরে পা দিয়েই পরিস্থিতি আঁচ করে ফেলল শার্লি রাশল্যান্ড। ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে গেল ক্লিন্টের দিকে চেয়ে। ক্লিন্ট যে চরম কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেটা ওর চেহারাতেই পরিষ্কার। রাস্তার দু’ধারের বোর্ডওয়াকে থেমে দাঁড়িয়েছে পথচারীরা। সবার চোখ মুখোমুখি দু’পক্ষের ওপর। বাতাসে টানটান উত্তেজনা। থমথমে পরিস্থিতি। যেকোন সময় রক্ত ঝরবে। লোভী শকুন যেমন মৃত্যুপথযাত্রীর দেহত্যাগের জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, ঠিক তেমনি করে লড়াই শুরু হবার প্রতীক্ষায় আছে টুইন স্প্রিংসের মানুষ।

লিউ! লিউ!

আর্তকণ্ঠে ডাকল মেয়েটা। কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতা ধারাল ছুরির মতো চিরে দিল নৈঃশব্দ। অপেক্ষারত মানুষগুলো ঘুরে তাকাল শার্লির দিকে। বোর্ডওয়াক থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে মেয়েটা, দৌড়ে এগোচ্ছে ডিলনের ঘোড়ার দিকে। রাজকীয় ঘোড়াটায় পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে ডিলন, চোখের হিমশীতল স্থিরদৃষ্টি ক্লিন্টের ওপর।

মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল ক্লিন্টের। ডিলনের হাঁটুতে হাত রেখে মুখ উঁচু করে মৃদু স্বরে কি যেন বলছে শার্লি। ভঙ্গিটা অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে হলো ক্লিন্টের। শার্লির কথা শুনে আস্তে আস্তে হাসির রেখা দেখা দিল ডিলনের গম্ভীর মুখে।

সমস্ত রাগ দূর হয়ে গেল ক্লিন্টের, সেজায়গা দখল করল অপরিসীম ক্লান্তি। ডিলনের লোকরা হাসছে। দেখেও দেখল না, কিছু যায় আসে না ওর। দেখল শার্লির কাঁধে একটা হাত রেখেছে ডিলন, নরম গলায় বলল কি যেন। ক্লিন্ট ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল, ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসকে একরকম ঠেলে সরিয়ে ব্যস্ত পায়ে ঢুকে পড়ল ক্যাসিনো সেলুনের ভেতরে। আরও একটু অপেক্ষা করলে দেখতে পেত শার্লির চেহারায় কি পরিমাণ অসহায়তা জমেছে। নির্বাক বোবা দৃষ্টিতে ক্লিন্টের গমনপথের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।

এমনিতে মদ বলতে গেলে পান করে না ক্লিন্ট, কিন্তু আজকে ওকে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে হবে, ভুলে যেতে হবে হৃদয়ের সমস্ত দুর্বলতা। মেয়ার্সের কাছ থেকে একটার পর একটা ড্রিঙ্ক নিল ও, ঢকঢক করে গিলল তরল। আগুন। ওর দু’পাশে ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি। খাচ্ছে ওরাও, তবে ওদের বসের মতো অতটা নয়। এইমাত্র সেলুনে ঢুকেছে ডিলনের গানম্যানরা। ওদের। সতর্ক থাকতে হবে। ডিলন যদি লাগতে আসে তাহলে সাধ্যমতো উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। তবে ডিলন বোধহয় তার লোকদের ঝামেলা না করার কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। ট্রিপল বারের কাউবয়দের ঘাটাল না তারা, একটা টেবিল ঘিরে পোকার খেলতে বসে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর ডিলন এলো। তার সঙ্গে জারম্যানও আছে। দুজনের কেউ হাবভাবে প্রকাশ করল না তারা ক্লিন্টকে দেখতে পেয়েছে। তবে ডিলন কাউন্টারে এসে দাঁড়াতেই তার এবং ক্লিন্টের মাঝখানে দাঁড়াল মার্শাল, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল সংঘাত ঠেকানোই তার উদ্দেশ্য।

কড়া চোখে মার্শালের দিকে তাকাল ক্লিন্ট। ড্রিঙ্ক করতে এসেছ দেখছি, বলল তিক্ত গলায়। সময় পাচ্ছ কি করে বুঝতে পারছি না। তোমার তো এখন ব্যাঙ্ক ডাকাতদের পেছনে ব্যস্ত থাকার কথা!

লাল হয়ে গেল জারম্যানের মুখ। তড়িৎ জবাব চলে এসেছিল জিভের ডগায়, শেষ মুহূর্তে সামলে নিল। শ্রাগ করে মনোযোগ দিল বারটেন্ডারের দিকে। লোকটা এখন ডিলনের ড্রিঙ্ক ঢেলে দিচ্ছে। ডিলন জানে, জিতে গেছে ও। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকাতেই সম্ভবত মহৎ হয়ে উঠেছে। জারম্যান অবাধ্য হয়েছিল ভুলে গেছে সেটাও, অথবা মনে রাখার প্রয়োজন দেখছে না। ক্ষতটায় মলম লাগানোর জন্যে অন্তরে তাগিদ অনুভব করছে জারম্যান।

আমি কি বলতে চাই বুঝতে পেরেছ, জারম্যান? জিজ্ঞেস করল ক্লিন্ট। জবাবে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল মার্শাল। অবজ্ঞার ছাপ পড়ল চেহারায়।

পেরেছি, ক্লিন্ট, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল। চোখ খোলা রেখেছি। আগে হোক পরে তোক কেউ একজন পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে শহরে আসবে। তখন তদন্ত এগোবে। এমনিতে ঘুরে কোন লাভ নেই, ঘোড়া দাবড়ে পাছায় ফোস্কা ফেলাই সার হবে।

তোমার মগজে তো বুদ্ধি নেই, হয়তো ফোস্কাগুলোর কোন একটাতে কিছু মগজ থাকতে পারে, নিচু গলায় মন্তব্য করল ডেনভার।

অগ্নিদৃষ্টিতে তরুণ কাউবয়ের দিকে তাকাল মার্শাল। ঈশ্বরের শপথ, মুখ বন্ধ রাখলে খালি হাতে ছিঁড়ে ফেলব তোমাকে আমি?

হুমকিতে ভয় পেল না ডেনভার। ড্রিঙ্কে মনোযোগ দিল সে। ক্লিন্ট খালি গ্লাসটা চোখের সামনে তুলে ধরে দেখল। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না আবার অর্ডার দেবে কিনা। শেষ পর্যন্ত কাউন্টারের ওপর দিয়ে গ্লাসটা ঠেলে দিল, বারটেন্ডারকে ইশারা করল ভরে দেবার জন্যে।

ধীরে ধীরে কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। এরমধ্যে সেলুনে আরও লোক এলো। লোক সমাগম বাড়তেই চাপা একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। সবাই অপেক্ষা করছে, দুই ব্র্যাঞ্চের কাউবয়দের মধ্যে যেকোন সময় লেগে যেতে পারে। প্রথম বোতল শেষ করে এখন দ্বিতীয় বোতলে আছে ক্লিন্ট। ডেনভার, স্টেসি আর লেভিসও স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশি ড্রিঙ্ক করেছে। ক্লিন্টের মনোযোগ সামনের বোতলে, কিন্তু তরুণ কাউবয়রা গরম চোখে ডিলন আর তার গানম্যানদের দেখছে। শহরের লোক যারা সেলুনে উপস্থিত আছে, পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভালই অবগত তারা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছে, কিন্তু সেলুন ছেড়ে যাচ্ছে না–যদি দেখার মতো কিছু একটা ঘটে যায়!

আরও দু’জন লোক ব্যাটউইং ঠেলে সেলুনে ঢুকল। কেগল আর ডায়ার। দরজার কাছে দাড়িয়ে পরিস্থিতি যাচাই করে দেখে নিল তারা। কেগল কাউন্টারের দিকে পা বাড়াল, ডিলনের সঙ্গে আলাপ জুড়ল। ডায়ার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করল তার প্রাক্তন বসকে। ক্লিন্টের কাছ থেকে বেশ দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল।

ডিলনের কাছ থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে তরলটুকু গিলে ফেলল কেগল, তাকাল ঘরের চারপাশে। দৃষ্টি স্থির হলো ট্রিপল বারের তিন কাউবয়ের ওপর। চোখ সরু করে ওরই দিকে তাকিয়ে আছে ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি। দু’পক্ষের চোখ থেকেই ঝরে পড়ল বিদ্বেষ। রাগতে শুরু করল কেগল। নিজেদের মাঝে নিচু গলায় আলাপ করছে তিন কাউবয়, আলাপের ফাঁকে হাসছে টিটকারির হাসি। শার্লির ব্যাপারটা? বেনন বলেছে? দাঁতে দাঁত পিষল কেগল। কর্কশ স্বরে জানতে চাইল, আমাকে কিছু বলার আছে?

হ্যাঁ। তুমি একটা ছিচকে গরুচোর। চোখের পলক ফেলল না, ডেনভার।

তোমার বাবা কে সেটা তোমার মা জানত না, বলল লেভিস। কেগলের দিকে তাকিয়ে মেঝেতে গুহ করে থুতু ফেলল স্টেসি।

তিনজনই বার কাউন্টারের সামনে থেকে খানিকটা সরে এসেছে। টলছে ওরা অল্প অল্প। মাতাল চোখে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে সবকিছু। উপস্থিত সবার নজর সেঁটে গেছে তরুণ কাউবয়দের ওপর। ডিলন কেগলকে কি যেন বলতে গিয়েও মত, বদল করল। জারম্যান বারের ওপর ধরে রাখল নিজের মনোযোগ। অতীত স্মৃতিচারণে, নিমগ্ন ছিল ক্লিন্ট, হঠাৎ করেই ও টের পেল গুরুতর কোন গোলমালে জড়িয়ে পড়েছে ওর লোকরা। সচেতন হতে চাইল ক্লিন্ট, বুঝতে চাইল ঘটনা কি ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু সময় পেল না। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল।

ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল। খাপের দিকে মসৃণ ভাবে নেমে গেল কেগলের হাত। গুলির শব্দ হলো, কিন্তু কে করল জানতে পারল না ক্লিন্ট। জ্ঞান হারিয়েছে আগেই। তার মাথায় একটা বোতল ফাটিয়েছে সেলুনমালিক স্টিভ ডেভিস।

কেগলের দ্রুততার সামনে কোন সুযোগই পেল না ডেনভার, লেভিস আর স্টেসি, অর্ধেকটা অস্ত্র বের করতে পারল না ওদের কেউ। বুকে গুলি খেয়ে ধুলোময় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল তিন কাউবয়। তাদের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল অজ্ঞান ক্লিন্টের দেহ। কিছুটা দূরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেগল। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোনদিকে কোন খেয়াল নেই। দুহাতে তার দুটো সিক্সগান। ধোঁয়া বের হচ্ছে অস্ত্র দুটোর নল থেকে।

তুমি দেখেছ, জারম্যান, কিছুক্ষণ পর বলল সে। ওরা অস্ত্রের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।

বাড়িয়েছিল, প্রতিধ্বনি তুলল জারম্যান। তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই আমার।

লোকজন এগিয়ে এলো কোলের হাতের কাজ দেখতে। ক্লিন্টের অচেতন দেহ সরিয়ে লাশগুলো পরখ করে দেখল তারা।

জারম্যান এবার কর্তৃত্ব নিল। কয়েকজনকে হাতের ইশারা করে বলল, লাশ। সরিয়ে নাও। ফিউনারাল পার্লারে দিয়ে আসবে। আর রেমন, হ্যারি, তোমরা ক্লিন্টকে জেলখানায় নিয়ে যাও। ওখানে আজ রাতটুকু থাকুক ও। আবার কোন ঝামেলা হোক সেটা আমি চাই না।

নির্দেশ পালিত হলো। লাশ নিয়ে বেরিয়ে গেল চারজন লোক। তাদের পেছনেই ক্লিন্টকে বয়ে নিয়ে জেলখানায় চলল রেমন আর হ্যারি। তাদের সঙ্গে মার্শালও বেরিয়ে এলো সেলুন থেকে।

ডায়ার তখনও টেবিলে একা বসে আছে। কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখল অনেকে। ডায়ার কি ট্রিপল বারের অসমাপ্ত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়বে?

সেলুনে এখনও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।

কিন্তু চুপচাপ নিজের টেবিলে নির্বিকার চেহারায় বসে থাকল ডায়ার। খানিক পরে সেলুনে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এলো।

<

Super User