ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। কোন উপায় বের করতে না পেরে আম্মাকে বলার জন্যে রওনা হলাম।
আমিও আন্দাজ করেছি, আম্মা বলল। আমরা নাহয় সহ্য করলাম, কিন্তু লোকে কেন করবে? রেগে আগুন হয়ে যাবে ওরা।
দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলবে।
বেঁধে রাখা দরকার।
সেই চেষ্টাই করলাম। শেকল কিংবা লোহার তার দরকার। নইলে কামড়ে কেটে ফেলবে। কিন্তু ওরকম জিনিস নেই আমাদের। প্রথমে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। তারপর মোটা চামড়া দিয়ে। কোনটাতেই কাজ হলো না। সন্ধ্যায় বেড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে ঘরে ঢুকেও সারি না আমরা, দুই মিনিটেই কামড়ে কেটে মুক্ত হয়ে চুরি করতে বেরিয়ে যায়। এক অদ্ভুত স্বভাবের কুকুর।
খড় পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে দেখা যাক, পরামর্শ দিল আম্মা।
এটাতে বোধহয় কাজ হত, কিন্তু আরলিসের জন্যে পরখ করেই দেখা হলো না। যেই আমরা দরজা বন্ধ করলাম, কাটতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করল ইয়েলার। বেরোনোর জন্যে খেপে উঠল আরলিস। ওকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম আমি আর আম্মা। কিন্তু কানেই তুলল না সে।
অনেক চেষ্টা করেও ওকে শান্ত করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে আম্মা আমাকে বলল, আর আটকানো গেল না। মরবেই এবার কুকুরটা!
আমি বললাম, না। আরেকটা উপায় আছে। বাইরে যখন পারলাম না, ঘরেই আটকে রাখতে পারি ওকে। আমার আর আরলিসের সঙ্গে থাকবে। তাহলেই আর বেরোতে পারবে না।
তাহলে তো তোদের বিছানায় গিয়ে উঠবে। উকুন ছড়াবে। চুলকানি হবে।
বিছানায় উঠতে দেব না। মাটিতে গরুর চামড়া বিছিয়ে বিছানা পেতে দেব। তাহলেই আর উঠবে না।
ঘরে আটকে রইল বটে ইয়েলার, কিন্তু মাটিতে ঘুমাতে চাইল না। রাতে ঠিকই উঠে চলে এল বিছানায়। জোর করে নামিয়ে দিলে চেঁচানো শুরু করে। কি আর করব? থাকতে দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই বাঁ হাতে দাদ দেখা দিল আমার। ওষুধ জানা আছে। তারপিন তেল ডলে দিতে সেরে গেল। ইতিমধ্যে ঘরে খাওয়ানো অভ্যেস করিয়ে ফেলেছি ইয়েলারকে। চুরি বন্ধ হয়ে গেল তার।
আমাদের খেতে ক্ষতিকর প্রাণীর উপদ্রব দেখা দিল। প্রায় সারা রাতই ওল্ড ইয়েলারকে নিয়ে খেত পাহারা দিতে হয়। বেশি যন্ত্রণা দেয় কুনেরা। রাতে আসে চোরের মত, যবের আধপাকা শীষগুলো কিছু খায়, কিছু নষ্ট করে। স্যাংকের লোভ তরমুজের ওপর। মাঝে মাঝে কয়োটও আসে তরমুজ খেতে। আর হরিণেরা যব, তরমুজ, মটরশুটি সবই খায়।
রাতে খেতের ধারে ঘুমাই। ঘরে থাকলে যে চামড়াটার ওপর শুতে চায় না ইয়েলার, সেটা বের করে নিয়ে গেছি, তাতে শুই। এখানে এটাতে শুতে আর তার কোন আপত্তি হয় না। তবে ঘুমের চেয়ে জেগে থাকা হয় বেশি। কান খাড়া করে রাখে ইয়েলার। আমি তাকিয়ে থাকি তারার দিকে। কান পেতে শুনি উষ্ণ রাতের বাতাসে দুলে ওঠা যবের শীষের শব্দ। মনে হয় আকাশে ঝুলে রয়েছে বড় বড় উজ্জ্বল তারাগুলো। ভাবি, আব্বাও কি আমারই মত শুয়ে শুয়ে এখন আকাশের তারা দেখছে?
আব্বাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে তখন। নিঃসঙ্গ নই আমি, সঙ্গে ওল্ড ইয়েলার আছে, তবু বড় একা লাগে ওই সময়টায়। বুঝতে পারি, আব্বার জন্যেই এরকম লাগে। মনে হতে থাকে, কাজ নেই কানসাসে গিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক আব্বা।
এ-ভাবনা থেকে সে-ভাবনা। ভাবি ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা। যখন আমি আব্বার মত বড় হব, নিজের ঘোড়ায় চড়ে নিজের গরুর পাল নিয়ে যাব কানসাসে। দেখব কত নতুন নতুন দেশ, উপত্যকা, পাহাড়-পর্বত, নদী, বন, ইনডিয়ানদের বাসস্থান। আকাশ পাতাল কত কি ভাবতে ভাবতে যখন ঘুম নেমে আসে চোখে, ভারি হয় পাতা, সেই সময় হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে ওল্ড ইয়েলার। আস্তে করে উঠে নিঃশব্দে এগোয় খেতের দিকে, চোর ধরার জন্যে। ঘুম দূর হয়ে যায় আমার। মিনিটখানেক পরেই কানে আসে ইয়েলারের বিকট হুঙ্কার। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিই খেতের দিকে। চেঁচিয়ে বলতে থাকি, ধর ব্যাটাকে, ধর, ইয়েলার! ছিড়ে ফেল!
কাজটা ইয়েলারও করতে চায়, কিন্তু মদ্দা কুনকে ছিড়ে ফেলা অত সহজ নয়। সাংঘাতিক যোদ্ধা। আকারে বেশি বড় নয়, কিন্তু যতই লড়াই চলতে থাকে, আমার মনে হয় ধীরে ধীরে যেন বড়ই হতে থাকে ওর শরীর। নিজের আয়তনের পাঁচগুণ বড় একটা জানোয়ারকেও কেয়ার করে না।
কুনের একটা বড় সুবিধে হলো তার চামড়া। এত মোটা, রোমশ, হড়হড়ে আর ঢলঢলে, কামড় বসানোই মুশকিল। কুকুরের দাঁতে শুধু চামড়াটাই আটকা পড়ে, মাংস লাগে না, পিছলে সরে যায়, ফলে ওই কামড়ে কোন ক্ষতি হয় না কুনের। ঝট ঝট করে ঘুরে যেতে থাকে কুকুরটার দিকে, একনাগাড়ে থাবা চালিয়ে নাকমুখ চিরে দিতে চায়। শুধু তাই নয়, কোন কোনটা এতই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, কুকুরকেই তাড়িয়ে ছাড়ে। বেশ কয়েকবার মদ্দা কুন আমাদের বেলকে তাড়া করে খেত থেকে বের করে দিয়েছিল। বাইরে আমাকে আর আব্বাকে দেখে আমাদেরও তাড়া করেছিল।
আমি খেতে ঢোকার আগেই কানে আসে লড়াইয়ের শব্দ। বেধে গেছে কুন আর ইয়েলারের মধ্যে। চলতেই থাকে। খেতের একটা অংশে যেন ঝড় বয়ে যায়। ওখানকার কোন গাছই আর আস্ত থাকে না। যখন শেষ হয় যুদ্ধ, কুন চলে যায় একদিকে, ইয়েলার আরেক দিকে। কেউ কাউকে আর ঘটাতে আগ্রহী নয়।
এত ঝগড়াঝাটির মধ্যে রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিকই, তবে সময় কাটে বড় ভাল। কুনেরা রুখে দাঁড়ায়, মারামারি করে, আর স্কাংকেরা আক্রমণ ঠেকায় অন্যভাবে। বিটকেল দুর্গন্ধ ছড়িয়ে। স্কাংক মারা কিছুই না ইয়েলারের জন্যে। একদৌড়ে গিয়ে জানোয়ারটার মাথা কামড়ে ধরে জোরে দু-একটা ঝাকি, ব্যস, ঘাড় ভেঙে খতম। কিন্তু তার পরে যে ঘটনাটা ঘটে সেটার। অভিজ্ঞতা থাকলে কোন কুকুরই পারতপক্ষে ওই প্রাণীগুলোকে মারতে যেতে চায় না। বিশাল শিংওলা পেঁচার মত ভয়ঙ্কর শিকারী পাখিও স্কাংক মেরে গায়ে গন্ধ না লাগিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে ফিরতে পারে না। এমনই গন্ধের গন্ধ, একবার গায়ে লাগলে আর যেতে চায় না। ওগুলোকে মারতে অবশ্য পিছিয়ে আসে না আমাদের ইয়েলার, কিন্তু প্রতিবারেই খুন করার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। সইতে পারে না। শুরুতে ঘোৎ ঘোৎ করে, জোরে জোরে নাক টানে, কষ বেয়ে লালা গড়ায়, শেষে বমি। বালিতে, ঘাসের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে থাকে সে, গা থেকে দুর্গন্ধ সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। শেষে কিছুতেই কিছু করতে না পেরে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। অনেক কষ্ট করে আসে বেচারা। ওকে আর সরতে বলতে মন চায় না। বাধ্য হয়ে। আমিই উঠে যাই। দূরে গিয়ে শুই। একলা থাকতে ইচ্ছে করে না তার। কয়েক মিনিট পরেই উঠে চলে আসে আমার কাছে।
আব্বা বলে, সর্দি দূর করতে স্কাংকের গন্ধের জুড়ি নেই। কিন্তু এখন গরমকাল, আমার বা ইয়েলারের কারোরই ঠাণ্ডা লাগেনি, সর্দির নামগন্ধও নেই। দু-চার দিন ওরকম কষ্ট করার পর ইয়েলারও আর স্কাংক মারতে আগ্রহ দেখাল না, আমিও চাপাচাপি করলাম না। ভয় দেখিয়ে কেবল তাড়িয়ে দিয়ে আসতে পারলেই খুশি।
রাতের বেলা বুনো জানোয়ার তাড়াতে গিয়ে অনুভব করলাম, ওই মুহূর্তে একটা কুকুর আমাদের জন্যে কতটা জরুরী। ইয়েলার না থাকলে হাজার চেষ্টা করেও আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমাকে পাত্তাই দিত না জানোয়ারের দল। ফল বাঁচাতে পারতাম না। আব্বা ঠিকই বলেছে, ঘোড়ার চেয়ে এখন একটা কুকুর বেশি দরকার আমার।
সেটা আরও ভাল করে বুঝলাম, আমাদের চিত্রা গাইটা প্রথম বাচ্চা দেয়ার পর। আমাদের প্রায় সব গরুই লঙহর্ন জাতের, দুধ তেমন একটা হয় না। বাছুরকে খাওয়ানোর পরেই শেষ। আমাদের জন্যে আর থাকে না। পাঁচ-ছয়টা গরু দোয়ালে কোনমতে টানাটানি করে দুধের চাহিদাটা মেটাতে পারি, তা-ও সব সময় নয়। সে জন্যে ভাল জাতের গরুর খোঁজে আছি আমরা।
কেবল একটা গরুই আছে আমাদের, যেটা দুধ মোটামুটি দেয়, তার নাম রোজ। কিন্তু এতই বুড়ো হয়ে গেছে বেশি দিন আর পারবে না। ওর মেয়ে বাচ্চাগুলোর ওপর আশা করেছিল আম্মা, বড় হয়ে রোজের মতই দুধ দেবে। কিন্তু প্রথম যে -তিনটে বড় হলো, তার কোনটাই আম্মার আশা পূরণ করতে পারল না। তখন যে গরুটার ওপর কারোরই কোন নজর ছিল না, সেই হাড় বের হওয়া, কুৎসিত চিত্রা গাইটাই একটা খেল দেখিয়ে দিল। বাচ্চা হলো ওটার। দুধে টইটম্বুর হয়ে গেল ওলান।
ছোট বেলা থেকেই চিত্রা বদমেজাজী। গায়ে হাত ছোঁয়ালেই রুখে দাঁড়াত। বড় হয়ে মেজাজ তো কমেইনি, বেড়েছে। তাকে শান্ত করার সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে আম্মা।
একদিন বিকেলে দেখি আমাদের অন্য গরুগুলোর সঙ্গে নেই চিত্রা। পরদিন সকালেও তাকে দেখা গেল না। আম্মা শুনে বলল, বাচ্চা হওয়ার সময় হয়েছে তো। নিশ্চয় কোথাও হয়ে গেছে, আসতে পারছে না।
সুতরাং তার পরদিন সকালে উঠে খুঁজতে বেরোলাম। চলে গেলাম পাহাড়ের দিকে। অনেক খোজাখুঁজির পর ছোট একটা ঝর্নার ধারের ঝোপের পাশে পাওয়া গেল তাকে। ঠিকই অনুমান করেছে আম্মা। চমৎকার একটা বাচ্চা হয়েছে তার। বাছুরটার দিকে এগোলাম। শিং বাগিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করতে করতে আমাকে তাড়া করল চিত্রা। গরুটার স্বভাব আমার জানা আছে। না গুতিয়ে ছাড়বে না। ঝেড়ে দৌড় দিলাম। উঁচু একটা পাথরের ওপর চড়ে তারপর শান্তি। আমাকে ওখানে তুলে দিয়ে বার কয়েক ধমক দিয়ে শাসিয়ে ফিরে গেল সে।
আবার বাছুরটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তবে আর খালি হাতে নয়, কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিলাম। বাছুর সহ ঝোপের ভেতর গিয়ে লুকিয়েছে চিত্রা। চিৎকার করে, পাথর ছুঁড়ে ঘুড়ে ভয় দেখিয়ে দুটোকে বের করার চেষ্টা চালালাম। বেরোল ঠিকই চিত্রা, তবে ভয় পেয়ে নয়, মেজাজ খারাপ করে। সোজা তেড়ে এল আমার দিকে। আবার দিলাম দৌড়। একছুটে এসে উঠলাম সেই পাথরটার ওপর।
আরও একবার বাছুরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ওল্ড ইয়েলারকে নিয়ে আসার জন্যে বাড়ি ফিরে চললাম। গরু সামলানোর ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা আছে কিনা ওর জানি না। তবু ওকে দিয়েই একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
কুকুরটাকে পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ঝোপের কাছে। চেঁচাতে লাগলাম। সেই সঙ্গে পাথর ছুঁড়ে মারাও চলল। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়েমেড়ে ঝোপ থেকে বেরোল চিত্রা। চেঁচিয়ে বললাম, ইয়েলার, থামাতো ওকে, দেখি কেমন বাপের ব্যাটা!
বাপের ব্যাটাই বটে ইয়েলার। জীবনে ওরকম কৌশলে কখনও বদমেজাজী গরু সামলাতে দেখিনি। অবাক হয়ে গেলাম ওর কাণ্ড দেখে। এমন ট্রেনিং কোথায় পেল সে!
চিত্রা তেড়ে আসতেই দৌড় দিয়েছি। একটা শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ভীষণ ভয়ে কলজে কেঁপে গেল। গরুটার শিঙের গুঁতো থেকে আর বুঝি রক্ষা নেই। কোনমতে উঠে দাড়িয়ে আবার ছুটতে গেলাম। পেছন ফিরে তাকালাম না। গরুটা কতটা কাছে এসেছে দেখার জন্যে সময় নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু খুরের শব্দ কানে এল না। বাআআ করে আর্তনাদ করে উঠল চিত্রা, যন্ত্রণায়। ঝোপঝাড় ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়ল তার ভারি শরীর।
আরও খানিকদূর এগিয়ে তারপর ফিরলাম। দেখি মাটি থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে চিত্রা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়েলার। কি করে মাটিতে পড়ল গরুটা দেখতে পাইনি। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে রাগে চিৎকার করে উঠল চিত্রা, মাটিতে পা ঠুকল, তারপর শিং বাগিয়ে তো মারতে গেল ওকে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল ইয়েলার। যেন আমারই মত ভয় পেয়েছে। কিন্তু আমার মত পাথরে উঠে নাগালের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল না। একটা ঝোপ ঘুরে চিত্রার পেছনে চলে গেল। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল গরুটার নাকের কাছে। একটিবারও দ্বিধা না করে নাক কামড়ে ধরল।
কি করে ঘটনাটা ঘটাল ইয়েলার, ঠাহর করতে পারলাম না। পরে আরও অনেকবার তাকে ওরকম করতে দেখেছি। কিন্তু কোন বারেই ভাল করে বুঝতে পারিনি কেন অমনটা ঘটছে। গরুর নাক কামড়ে ধরে নিজের শরীরটা বাকা করে একটা মোচড় দেয় সে। এক মোচড়ই যথেষ্ট। পরক্ষণেই দেখা যায় গরুর শরীরটাও পাক খেয়ে চিৎ হয়ে যাচ্ছে। খুর ওপরে তুলে দিয়ে একেবারে চিৎপাত। চিত্রার বেলায়ও এই ব্যাপারই ঘটল। ধড়াস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। এত জোরে পড়ল, ভয়ই পেয়ে গেলাম। ভুড়ি না ফেঁসে যায়!
চিত্রাও ভয় পেয়েছে। দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানোর পর দেখলাম লড়াইয়ের ইচ্ছে একেবারে তিরোহিত হয়েছে তার। আর ঘাটাতে এল না আমাদের। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে চলল ঝোপের দিকে, তার বাচ্চার কাছে।
পিছু নিলাম আমি আর ইয়েলার। মা আর বাচ্চাকে খেদিয়ে নিয়ে চললাম পাহাড়ের দিকে, যেখানে আমাদের অন্য গরুগুলো চরছে। আর বেয়াদবি করল না চিত্রা। আমাদের কিছু না করলেও দুই দুইবার পালানোর চেষ্টা অবশ্য করল, কিন্তু ছুটে গেল ইয়েলার। তাকে সামনে দেখলেই তাড়াহুড়া করে আবার পথে চলে আসে সে।
চিত্রাকে খোয়াড়ে আনার পরেও ইয়েলারকে প্রয়োজন হলো আমাদের। দুধে ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে ওলান, বাছুরে খেয়েও অনেক বেঁচে যাবে। দুধ দোয়ানোর জন্যে বালতি আনতে গেল আম্মা। এনে দিল আমার হাতে। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। ওলানে হাত দিলেই যদি লাথি মারে!
ঠিকই আন্দাজ করেছি। ওলানের দিকে হাত বাড়াতেই লাথি মারল চিত্রা। আমার মাথায় লাগানোরই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তৈরি ছিলাম বলে পারল না। আবার হাত বাড়ালাম। আরেক বার লাথি মেরে ব্যর্থ হয়ে আর সেই চেষ্টা করল না সে। তাড়া করল আমাকে। আমিও তৈরি। দিলাম দৌড়। বেড়া ডিঙিয়ে এলাম চোখের পলকে।
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে আম্মা বলল, এত সহজে পারবি বলে আশাও করিনি। আর কোন উপায় নেই। পেছনের পা খুঁটির সঙ্গে বেঁধেই নিতে হবে।
কিন্তু বাঁধাটা দুধ দোয়ানোর চেয়ে আরও কঠিন। যা পাজির পাজি চিত্রা, শুধু পা বাঁধলেই চলবে না, শিঙের তো থেকে বাঁচতে চাইলে ওর মাথাও বাঁধতে হবে। রোজ দুবার করে এই কাজটা নিয়মিত করে যাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হলো আমার। বাধ্য হয়ে শেষে খোঁয়াড়ের বাইরে দাঁড়ানো ইয়েলারের দিকে তাকালাম সাহায্যের জন্যে।
ইয়েলার, হাত নেড়ে ডাকলাম, এদিকে আয় তো। বেড়ার নিচের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল সে। লাফাতে লাফাতে ছুটে এল।
আম্মা বলল, ওকে দিয়ে কি হবে? কুকুর দেখলে আরও খেপে যাবে চিত্রা। নতুন বাচ্চা হলে সব গরুই খেপে, আর ও তো সব সময় খেপেই থাকে।
হাসলাম। তা খেপে। তবে ইয়েলারকে কিছু করবে বলে মনে হয় না।
আমার কথাই ঠিক হলো। ইয়েলারকে দেখেই শিঙ নাড়া বন্ধ করে দিল চিত্রা। চোখ বড় বড় করে তাকাল তার দিকে।
ইয়েলার, তুই এখানে দাঁড়া। কিছু করে কিনা দেখবি।
আমি কি করতে চাই ঠিক বুঝে ফেলল ইয়েলার। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল চিত্রার একেবারে মুখের কাছে। দরকার হলেই যেন চট করে নাক কামড়ে ধরতে পারে। কাটা লেজের গোঁড়াটা নাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। যেন বোঝাতে চাইল, সাবধান গরু! কিছু করলেই বুঝবে ঠেলা!
কিন্তু চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ার কোন আগ্রহই দেখা গেল না চিত্রার মধ্যে। চুপ করে দাড়িয়ে রইল। ওর গায়ে এক ধরনের কাঁপুনি হচ্ছে, টের পেলাম আমি। আবার বালতি নিয়ে গিয়ে বসলাম। লাথি মারার জন্যে আর পা তুলল না। কেবল ওলানে প্রথমবার যখন হাত ছোঁয়ালাম, সামান্য কুঁচকে ফেলল ওটা। এরপর আর কিছু না।
অবাক হয়ে গেল আম্মা। আশ্চর্য তো!…যাক, ঝামেলা মিটল। দোয়াতে আর অসুবিধে হবে না।
তিন দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল চিত্রা। কোন ঝামেলা ছাড়াই ওকে ডেকে নিয়ে যেতে পারলাম খোয়াড়ে, দুধ দোয়ানোর জায়গায়। ওখানে দাঁড়িয়ে সর্বক্ষণ ইয়েলারের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। সাত দিনের মধ্যেই সামনে ফেলে রাখা খাবারেও মুখ লাগাল। তুলে নিয়ে চিবাতে লাগল একটু একটু করে। ওলানে হাত দিলে কিছু বলে না আর।
শেষে আর ইয়েলারকেও সামনে দাঁড় করিয়ে রাখার দরকার পড়ল না। একেবারে শান্ত গরুতে পরিণত হলো সে।
পুরো কৃতিত্বটাই ইয়েলারের। এরপর ওরকম একটা কুকুরকে আমাদের কাছ থেকে যদি কেউ নিয়ে যেতে আসে, কেমন লাগে!
<