মনে হতে লাগল, কোন দিনই আর ওল্ড ইয়েলারের কাছে ফিরে যেতে পারব না। বাড়ি যাওয়ার জন্যে এত তাড়াহুড়ো করছি, হাঁপিয়ে গেলাম অল্পক্ষণেই। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। পায়ের কাটাটা যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব। এখনও শক্ত হয়নি। হয়ে যেত। অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে পেশীগুলো, সে জন্যেই পারছে না। তবে ইতিমধ্যেই তার খেসারত দিতে আরম্ভ করেছে পা। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠতে লাগল যেন জায়গাটায়। আমি বাড়ি পৌঁছানোর পরও বন্ধ হলো না।

প্রথমে দেখে ভয়ে তো আঁতকে উঠল আম্মা। নানা ভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইয়েলারের অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। কানই দিল না আম্মা।

বলল, আগে তোর পায়ের চিকিৎসা দরকার। ধুয়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে। শুয়োরের দাঁতের বিষ তো জানিস না কি জিনিস। অবহেলা করলে সাপের বিষকেও হার মানাবে। দেখি, চুপ করে বসতো। নড়াচড়া একদম করবি না।

আম্মার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। যেটা ভাল বুঝবে সেটাই করবে। চুপ করেই বসলাম। তবে যখন জখমে তারপিন লাগানো শুরু করল, চুপ করে থাকা আর সম্ভব হলো না। গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে লোহা লাল করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে জায়গাটায়। শুয়োরটা যখন কামড়ে দিয়েছিল তখন এর হাজার ভাগের এক ভাগ ব্যথাও করেনি। এমন চিৎকার জুড়ে দিলাম, শেষে আরলিসও আর স্থির থাকতে না পেরে কাঁদতে শুরু করল। তবে তারপিনের জ্বালাটা যখন কমে এল, তখন টের পেলাম মোচড় দিয়ে দিয়ে ওঠা ব্যথাটা চলে গেছে।

একটা পরিষ্কার সাদা কম্বল ছিড়ে কাটা জায়গায় চেপে বসিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল আম্মা। বলল, এবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়। বিশ্রাম নে। সাত দিন আর নামবি না। হাঁটাহাঁটি একদম বন্ধ।

উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আম্মা, আমি ইয়েলারের কাছে যাচ্ছি। ওকে কথা দিয়ে এসেছি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে যাব। তুমি এসো।

আম্মা কি বলে শোনার জন্যে দাঁড়ালাম না। বাইরে বেরিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

আমি জাম্পারকে বের করে আনতে আনতে তৈরি হয়ে গেল আম্মা। মাথায় টুপি পরে ফেলেছে। দ্বিধা যাচ্ছে না এখনও। তবে আমাকে যে আর ঠেকাতে পারবে না বুঝে গেছে। জিজ্ঞেস করল, আনব কি করে ওকে?

জাম্পারের পিঠে করে। আমি ওকে দুহাতে ধরে কোলে নিয়ে বসে থাকব।

পারবি না। ও অনেক ভারি। তোর নিজেরই বসার শক্তি নেই এখন।

পারব। কাহিল হয়ে গেলে নামিয়ে দিয়ে জিরিয়ে নেব। তারপর আবার কোলে নেব।

পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে পুরো এক মিনিট পা ঠুকল আম্মা। বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বোঝাতে লাগল, ঠেলাটা ব্যবহার করতে পারব না। রাস্তা নেই। আর যা মাটির মাটি, এত উঁচুনিচু, ঠেলেও আনা যাবে না।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, এক কাজ কর, বেড়া থেকে গরুর চামড়াটা খুলে নিয়ে আয়। আমি বালিশ নিয়ে আসি।

গরুর চামড়া?

জাম্পারের পিঠে বেঁধে নে। কি করব পরে দেখিস।

আম্মা কি বুদ্ধি বের করেছে কিছু বুঝলাম না। তবে আর জিজ্ঞেসও করলাম না। সঙ্গে তো যাচ্ছেই। কি করে দেখতেই পাব।

গরুর চামড়াটা খুলে এনে জাম্পারের পিঠে ছড়িয়ে দিলাম। শুকনো চামড়ার ঘষা আর খচমচ শব্দ কোনটাই ভাল লাগল না তার। ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল।

জাম্পার! ধমক দিয়ে বললাম, চুপ থাক বলছি! মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব!

আর জ্বালাতন করল না সে। বালিশ আর দড়ি নিয়ে এসেছে আম্মা। গরুর চামড়া আর বালিশগুলো জাম্পারের পিঠে বেঁধে নিতে বলল। আরলিসকে তুলে বসিয়ে দিল বালিশের ওপর।

আমাকে বলল, তুই ওর পেছনে ওঠ। আমি হেঁটে আসব।

কাছাকাছি পৌঁছতেই শকুন উড়তে দেখলাম। নীল আকাশে কালো ফুটকির মত দেখা যায় প্রথমে, ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসে নিচে। যখন শুধুই ঘোরে তখন বুঝতে হয় খাবারের সন্ধান করছে। কিন্তু আমরা দেখলাম দ্রুত নেমে আসতে। তারমানে খাবার দেখেছে। শাঁ করে প্রায় আমাদের মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল একটা। কুৎসিত মাথাটা সামনে বাড়ানো। একধরনের শীতল শিহরণ খেলে গেল আমার মেরুদণ্ডে। তাহলে শেষ হয়ে গেছে ওল্ড ইয়েলার!

জাম্পারের আগে আগে হাঁটছে আম্মা। ফিরে তাকাল আমার দিকে। আমার মত একই কথা ভাবছে। এতটাই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম, মনে হলো সহ্য করতে পারব না।

কাঁটা ঝোপগুলোর কাছাকাছি এসে কিছুটা হালকা হলো মন। আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। হঠাৎ করে ডানা ঝাপটে ওপরে উঠে গেল একটা শকুন। আরেকটা। তারপর আরও একটা। নিশ্চয় কেউ চমকে দিয়েছে ওটাকে। কে দিয়েছে তা-ও আন্দাজ করতে পারছি।

পর মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার ধারণাই ঠিক। ইয়েলারের দুর্বল কণ্ঠ শোনা গেল। ইচ্ছে করল আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে যাই। হো হো করে হাসতে ইচ্ছে। করল। এখনও বেঁচে আছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে তৈরি!

আমরা পৌঁছে দেখলাম নালার পাড়ে আবার নেমে এসেছে শকুনগুলো। সারি দিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের দেখে উড়ে যেতে শুরু করল একের পর এক। ভারি ওই পাখিগুলো দেখতে যেমন কুৎসিত, ওগুলোর ওড়ার ভঙ্গিটাও বিশ্রী। অন্য পাখির মত বসা থেকে উড়তে পারে না। খানিক দূর দৌড়ে গিয়ে গতি সঞ্চার করে নিতে হয়। তারপর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে লাফ দিয়ে ওঠে শূন্যে। দেখে মনে হয় আবার পড়ে যাবে মাটিতে। তবে পড়ে না। ওগুলোকে দেখে এমন রাগ হলো আমার, বন্দুকটা সঙ্গে থাকলে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে দিতাম।

ওল্ড ইয়েলারের চোখে একধরনের বন্য দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ওকে বের করে আনতে গেলাম। ঘেওও করে উঠে কামড়ে দিতে এল হাতে।

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে আনলাম। চিৎকার করে বললাম, আমি, ইয়েলার, আমি!

এইবার চিনতে পারল সে। ভাল করে তাকায়ইনি এতক্ষণ। ভেবেছিল শকুন। দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল তার। এমন করে গুঙিয়ে উঠে নেতিয়ে পড়ল, যেন বিরাট ভার নেমে গেল বুকের ওপর থেকে।

গাছটা সরাতে আমাকে সাহায্য করুল আম্মা। তারপর দুজনে ধরে আস্তে করে ওকে বের করে আনলাম গর্ত থেকে। রোদে শুইয়ে দিলাম।

জখমগুলোতে রক্ত শুকিয়ে আছে। সেদিকে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করল না আম্মা। পেটের ব্যাণ্ডেজটা খুলতে শুরু করল।

আমার পাশে এসে দাঁড়াল আরলিস। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়েলারের কি হয়েছে।

আম্মার হাত থেমে গেল। বলল, আরলিস, নালায় অনেক সবুজ গিরগিটি আছে। একটা ধরে আনতে পারবে? আসার সময় ওই যে ওখানটাতেই দেখলাম একটাকে।

খুবই অবাক হলাম। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরলিসের মুখ। এতদিন গিরগিটি ধরার জন্যে শুধুই বকা খেতে হয়েছে তাকে, আজকে আম্মাই ধরে এনে দিতে বলছে। একটা মুহূর্ত দেরি না করে ঘুরে দৌড় দিল গিরগিটি ধরার জন্যে।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আম্মা। এতক্ষণে বুঝলাম। আরলিসকে সরিয়ে দিল যাতে ভয়াবহ জখমটা দেখতে না হয়। ইয়েলারের চেরা পেট দেখলে সহ্য করতে পারবে না সে।

আমাকে বলল, জাস্পারের লেজ থেকে একটা চুল ছিড়ে নিয়ে আয়। দেখিস, সরে থাকিস। লাথি খাসনে আবার।

পায়ের কাছ থেকে সরে থেকে হ্যাঁচকা টানে ছিড়ে নিলাম একটা চুল। নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল জাম্পার, লাথিও মারল, তবে লাগাতে পারল না। চুলটা এনে দিলাম আম্মাকে। কি করবে বুঝতে পারছি না। তবে যখন গায়ের গাউনে গেঁথে রাখা একটা লম্বা সুচ টেনে বের করল, বুঝে ফেললাম।

কাঁটাচেরা সেলাইয়ের জন্যে এই চুলের তুলনা হয় না, আম্মা বলল। কেন হয় না, সে কথা বলল না। আমিও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

আম্মা জানতে চাইল ইয়েলারের নাড়ি কোথাও কেটেছে কিনা। মাথা নাড়লাম। কাটাটাটা দেখিনি আমি।

তাহলে আর ওটা নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আম্মা বলল। কাটা হলেও অবশ্য কিছু করতে পারব না। ওসব মেরামত করা আমার সাধ্যে কুলাবে না।

ধীর গতিতে চলল কাজ। কাঁচা চামড়া সেলাই করাটাও একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সুঁচ ঢোকালে যে ভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে ইয়েলার, তাতেই বুঝতে পারছি কি ব্যথাটাই না পাচ্ছে সে। কিন্তু মুখ বুজে রইল। আমি ওকে ধরে রেখেছি। মাঝে মাঝে হাত চেটে দিচ্ছে আমার।

সেলাই শেষ করে পরিষ্কার এক টুকরো কম্বল তার শরীরে পেঁচিয়ে বাঁধল আম্মা। এই সময় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এল আরলিস। মুখে বিজয়ীর হাসি। হাতে ঝুলছে একটা সবুজ গিরগিটি।

সাংঘাতিক দ্রুতগতি এই প্রাণীগুলোকে কি করে অবলীলায় ধরে ফেলে সে সেটা আমার কাছে এক মহাবিস্ময়। যেন যুদ্ধ জিতে দেশ বিজয় করে এসেছে এমন গর্বিত ভঙ্গিতে আম্মার দিকে গিরগিটিটা বাড়িয়ে দিল।

পুরোপুরি অসহায় হয়ে গেল আম্মা। আরলিস পারবে না ভেবেই সবুজ গিরগিটি ধরতে বলেছিল। গিরিগিটি, সাপ, শুয়াপোকা দেখলেই যে শিউরে ওঠে, লাফ দিয়ে সরে যায়, তার হাতে যদি সেই জিনিস তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হয় অবস্থাটা কি হবে! কিন্তু আরলিসকে নিরাশ করতে পারল না আম্মা। অনেক কষ্টে একবার ছুঁয়ে দেখল কোনমতে। আরলিস কিছু সন্দেহ করতে না পারে এমন করে বলল, এটা তোমার হাতেই থাক। পরে নেব। এতে আরও খুশি হলো। আরলিস।

এবার একটা খেলা খেলব আমরা, তাকে বোঝাল আম্মা। এমন ভান করব, যেন ওল্ড ইয়েলার অসুস্থ। তার যত্ন করছি। তুমি আর সে বসবে গরুর চামড়াটার ওপর। ইনডিয়ানরা যে ভাবে রোগীকে টেনে নিয়ে যায় তোমাদেরকেও সে ভাবে নেয়া হবে।

খেলাটেলার ব্যাপারগুলো এমনিতেই আরলিসের খুব পছন্দ। নতুন খেলার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল সে। তক্ষুণি শুরু করে দিতে চাইল।

জাম্পারের পিঠ থেকে চামড়াটা খুলে নিয়ে মাটিতে বিছাল আম্মা। তার ওপর রাখল বালিশগুলো। কি করতে চায় এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি। দুজনে ধরাধরি করে ইয়েলারকে এনে রাখলাম বালিশের ওপর। নরম বালিশে থাকায় ব্যথা কম পাবে সে।

আম্মা বলল, আরলিস, বালিশের ওপর বসে ইয়েলারকে ধরে রাখো, যেন পড়ে না যায়। খবরদার, ভুলেও ওর ওপর উঠে বসবে না। রোগী রোগী খেলা খেলব আমরা। ইয়েলার রোগী। কোনভাবেই তাকে ব্যথা দেয়া চলবে না।

এমন চমৎকার খেলা আর খেলেনি আরলিস। কোনভাবেই পণ্ড করবে না, কথা দিল আম্মাকে। আম্মা যেখানে বসতে বলল লক্ষ্মী ছেলের মত সেখানেই বসল। কোলে তুলে নিল ইয়েলারের মাথা।

ইতিমধ্যে জাম্পারের গলায় দড়ি বেঁধে ফেলেছি। গলায় একটা বড় ফাঁস পরিয়েছি এমনভাবে যাতে তার দম আটকে না যায়। ফাঁসের দুদিক থেকে দুটো দড়ি বের করে কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে এলাম। ছুরি দিয়ে চামড়ার দুই মাথায় দুটো ছিদ্র করে তার ভেতরে দড়ির মাথা ঢুকিয়ে বাধলাম। অনেকখানি ফাঁক রেখেছি দুটো দড়ির মাঝে, যাতে জাম্পারের পায়ে না লাগে। পায়ে দড়ি লাগলে ভড়কে যায় সে। উল্টোপাল্টা আচরণ করে বসে।

হয়েছে, এবার তুই ওঠ, আমাকে বলল আম্মা।

আমিই বরং হাঁটি। পেছনে চামড়ার খরখর শুনলে কি করে বসে ঠিক নেই। লাঠি না দেখলে ঠাণ্ডা হবে না।

তোকে যা বলছি কর। ওই পা নিয়ে হাঁটলে মরবি। লাঠি আমিও নিতে পারব।

রওনা হলাম। অনর্গল বকবক করছে আরলিস। আনন্দে, উত্তেজনায়। জাম্পারকে নিয়ে যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই করল। চামড়াটা হিচড়ানোর শব্দ হতেই ভড়কে গেল সে। ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। গলার দড়ি খুলে ফেলতে চাইল। জিন ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধমক লাগাল আম্মা, এই জাম্পার, চুপ থাক, শয়তান কোথাকার!

একটা লিকলিকে ডাল হাতেই আছে আমার। শপাং করে বাড়ি মারলাম তার কানের ওপর। দুজনের শাসন অতিরিক্ত হয়ে গেল খচ্চরটার জন্যে। শান্ত হয়ে চলাটাই ভাল মনে করল সে। আর গোলমাল করল না। চলতে চলতে মাঝে মাঝে কেবল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল কি জিনিস টেনে নিয়ে চলেছে। যা দেখছে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না তার। তবে প্রতিবাদ করে আর পিটুনি খেতে চাইল না।

এত ভাল সময় খুব কমই কেটেছে আরলিসের। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছে সে। আমাদের জন্যে দীর্ঘ একেকটি ঘন্টা, তার জন্যে যেন একটা মুহূর্ত, ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাচ্ছে। ওল্ড ইয়েলারও ততটা কষ্ট পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নালার বালির ওপর দিয়ে যতক্ষণ হিচড়ে গেল চামড়াটা ততক্ষণ কোন ঝাঁকুনিই লাগল না। নালা ছেড়ে যখন ওপরে উঠলাম, সমতল জমির ওপর দিয়ে চলার কারণে তখনও তেমন অসবিধে হলো না। জাম্পারকে ঘুরপথে নিয়ে চলল আম্মা। বনের মধ্যে না ঢুকে যতটা সম্ভব সমভূমিতেই থাকার চেষ্টা করল। লম্বা ঘাসের ওপর দিয়ে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে চামড়াটা। এই ঘাস নরম গদির কাজ করছে অনেকটা। পিছলেও যাচ্ছে চমৎকার। কিন্তু যত চেষ্টাই করুক, সব সময় ঘাসের ওপর দিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাথর এড়ানো যাচ্ছে না। নিচে পাথর পড়লেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে আরোহীদের গায়ে।

কখনও ঝাকুনি, কখনও দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে যাচ্ছে। দমছে তো না-ই, বরং মজা পেয়ে জোরে জোরে হেসে উঠছে আরলিস। কিন্তু ইয়েলার সহ্য করতে পারছে না। তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গুঙিয়ে উঠছে।

বেশি যখন গোঙাচ্ছে, বুঝতে পারছি তার যন্ত্রণা খুব বেশি হচ্ছে। জিরানোর জন্যে তখন থামছি আমরা। তারপর আবার চলা। অন্য কারণেও থামতে হচ্ছে। পানি প্রয়োজন হচ্ছে। পানি খাওয়ানোর জন্যে একবার থামলাম পাথুরে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়। ওখানে ছোট একটা ঝর্না আছে। দ্বিতীয়বার থামলাম বার্ডসং ক্রীকের ধারে।

আমার হ্যাটে করে পানি এনে তাকে খেতে দিল আম্মা। মাথাও তুলতে পারে না, এতটাই দুর্বল। তার নাকের নিচে হ্যাটটা ধরে রাখে আম্মা, আমি মাথাটা উঁচু করে ধরি যাতে সে পানি খেতে পারে।

বাড়ি থেকে অনেক দূরের পথ, ধীরগতি, তার ওপর জায়গায় জায়গায় থামা। মনে হতে লাগল, কোন দিনই বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু পারলাম শেষ পর্যন্ত। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তখন। তারা উঠেছে রাতের আকাশে।

পুরোপুরি শক্ত হয়ে গেছে আমার পা। কোন অনুভূতি নেই। ফুলে উঠেছে। ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে একটা মরা গাছের কাণ্ড বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। জাম্পারের পিঠ থেকে নামলাম। শরীরের ভার রাখতে পারল না পা-টা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। ভীষণ দুর্বল। জখমের প্রচণ্ড যন্ত্রণা। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না।

এই শরীর নিয়ে ইয়েলারকে আনতে যাওয়ার জন্যে আমাকে অনেক বকাবকি করল আম্মা। চুপ করে রইলাম। ইয়েলারকে যে বাড়ি আনতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। ও এখনও বেঁচে আছে। তারার আলোয় দেখছি আরলিসের গাল চাটছে ও।

ঘুমিয়ে পড়েছে আরলিস।

<

Super User