কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা হোটেলের দিকে এগোল ফ্যারেল। ভোরের হিমেল হাওয়া বইছে। চারদিক কেমন যেন থমথম করছে। হোটলের রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে, পেছনের দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
হোটেলের বাবুর্চির কাছ থেকে কফি, বেকন, ময়দা, আর কিছু শুকনো মাংস নিল সঙ্গে নেয়ার জন্যে। সব কিছু একটা ব্যাগে ভরে স্যাডলের পেছনে বেঁধে ফেলল ওটা। তারপর স্যাডলে চেপে ঘোড়াকে হটিয়ে নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এল। জেলহাউসের সামনে যারা জটলা পাকাচ্ছিল তারা আপাতত বিদায় নিয়েছে। কফির-কাপে চুমুক দিয়ে সময় কাটাতে গেছে হয়তো-ভাবল ফ্যারেল।
সঠিক ট্রেইল খুঁজে পেতে কষ্ট হবে। ভুল হবার আশঙ্কা ষোল আনা। তবে যতটা ভাবছে ততটা অসুবিধে নাও হতে পারে; ও যাকে খুঁজছে, সাধারণ অশ্বারোহীর তুলনায় নিঃসন্দেহে দ্রুত ঘোড়া হাঁকাবে সে; সুতরাং তার ট্রেইল আলাদা করে চেনা যাবে।
শহর সীমান্তে পৌঁছে হঠাৎ দুপাশ থেকে চেপে এসেছে বাট স্ট্রীট, রাসলার ক্রিকের এপাশে ডানে বাঁক নিয়েছে, চলে গেছে দক্ষিণে। সেতু পেরিয়ে স্যাডল থেকে নামল ফ্যারেল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাস্তা জরিপ করল।
শুকনো বালিতে অসংখ্য ট্রাক, কিন্তু ট্র্যাকিংয়ে দক্ষ ক্লিফ ফ্যারেল, কয়েক মুহূর্তের পর্যবেক্ষণেই দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া একটা ঘোড়ার ট্র্যাক আবিষ্কার করল।
ধীরে ধীরে ঘুম ভেঙে জেগে উঠছে প্রকৃতি। রক্তিম আভা লেগেছে পুব আকাশে।
আবার স্যাডলে উঠে বসল ফ্যারেল। ভুরু কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকাল। এগোতে শুরু করেছে গেল্ডিং। ঘোড়ার ট্র্যাক দেখতে তেমন অসুবিধে না হলেও অসংখ্য ট্র্যাকের মাঝে নির্দিষ্ট ছাপটা প্রতিক্ষণে আলাদা করে নজরে রাখতে চোখের ওপর চাপ পড়ছে।
ট্রাক অনুসরণ করে প্রায় মাইল খানেক এগোল ফ্যারেল। এখানে ঘোড়া ঘুরিয়েছে অশ্বারোহী। ক্লিফও তাই করল। এবার অনেকটা সহজ হয়ে এল অনুসরণের কাজ। ছোটার গতি বাড়াল ও। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছে যেন এটাই আসল ট্র্যাক হয়।
পুব আকাশ ফর্সা হলো। আরও একবার ঘোড়া থেকে নামল ফ্যারেল। হাঁটু গেড়ে বসে ঘোড়ার পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করল।
কয়েক ঘণ্টা আগে এপথে গেছে অশ্বারোহী, আন্দাজ করল। ট্র্যাক চিনতে ভুল না হলে সময়ের অনুমান সঠিক হওয়ার কথা।
এখানে এসে চলার গতি কমিয়ে এনেছে আগন্তুক, বুঝতে পারল ক্লিফ। মিলে যাচ্ছে। অপরাধ সংঘটনের পর ঝড়ের গতিতে ঘোড়া দাবড়ে শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। কিন্তু ঘোড়াটাকে মেরে ফেলার ইচ্ছে নেই তার, তাই গতি কমাতে বাধ্য হয়েছে।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করল ফ্যারেল, সামনের মোড়াটার খুরে ক্ষয়ে যাওয়া নাল পরানো। পেছনের দুপায়ের নাল অপেক্ষাকৃত নতুন, তবে ওগুলোরও পেছনের দিক ক্ষয় হয়ে গেছে। সম্ভবত অনেকদিন ধরে রুক্ষ বন্ধুর পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে লোকটা।
ট্রেইল অনেকটা মানুষের চেহারার মতো, ভাবল ক্লিফ, একজন মানুষের চেহারার বর্ণনা দিতে গেলে অনেক সময় এমন দাঁড়ায়, ওই বর্ণনার সঙ্গে অন্তত হাজারখানেক লোকের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু লোকটার চেহারা কেমন জানা থাকলে, অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার ভয় থাকে না।
সন্তুষ্ট ক্লিফ আবার স্যাডলে চেপে সামনে বাড়াল। এপথ শেষ হওয়ার আগেই ফেরারী সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যাবে। বোঝা যাবে, আগন্তুক ভদ্রলোকের মতো স্বাভাবিকভাবে খোলা প্রান্তরের ওপর দিয়ে গেছে না ধরা পড়ার ভয়ে ট্রেইল গোপনের চেষ্টা চালিয়েছে।
ইতিমধ্যে সূর্য উঠে পড়েছে, গরল ঢালছে অকৃপণ হাতে। যেদিকে তাকাও বিস্তৃত বিরান সমভূমি। মাঝে মাঝে দূরে দিগন্তের কাছে গ্রে বাটের মতো দু-একটা পাহাড় দেখা যায়, সতর্ক প্রহরীর মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনও কখনও সংকীর্ণ ওঅশ চোখে পড়ছে, খাড়া পাহাড়ের মতো ওগুলার তীর।
এ-এলাকার অন্ধিসন্ধি ক্লিফ ফ্যারেলের নখদর্পণে। জানে একশো মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। পায়ের নীচের মাটি চালু হয়ে ক্রমশ ওপর দিকে উঠে গেছে, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে সিডার আর পিনন পাইনে ছাওয়া একটা গিরিপথ অতিক্রম করে আবার নীচে নেমেছে। মরুভুমির মতো বিশুষ্ক একটা প্রান্তর পেছনে ফেলে শোশন ক্রিকের উপত্যকায় শেষ হয়েছে পথের। শোশন ক্রিকে পৌঁছার আগেই পলাতক, লোকটাকে ধরতে হবে, নইলে ফসকে যাবে শিকার।
ক্লিফের দুই চোখে বরফের শীতলতা; চেহারায় ইস্পাতের কাঠিন্য। আজ শিকারীতে পরিণত হয়েছে ও, সীমাহীন আক্রোশ নিয়ে চলেছে শিকারের সন্ধানে।
সহসা বুঝতে পারল, ক্লিফ, সামনের লোকটা ট্রেইল গোপনের চেষ্টা করুক, এটাই চাইছে সে। অপরাধের প্রমাণস্বরূপ এরকম কিছু সাক্ষ্য পাওয়া দরকার।
অবশ্য এমনও হতে পারে, লাঞ্ছিত মেয়েটা লজ্জার কথা গোপন রাখবে ভেবে ট্রেইল আড়াল করার প্রয়োজনই বোধ করবে না সে।
ক্লিফের বিষণ্ণ চেহারায় করুণ হাসি ফুটে উঠল। দুনিয়ার কোনও ল অফিসার কখনও এমন করবে না-নিজেই আসামীর বিচার করতে চাইছে, তার মৃত্যুদণ্ড কামনা করছে মনে প্রাণে।
আসামীকে ধরার পর কী করবে? বিবেকের কাছে জবাব খুঁজল ফ্যারেল। অনেক ভেবেও যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর মিলল না। কী করবে জানে না ও। তবে ফেরারী লোকটার আচরণের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে, সে বাধা, দিলেহত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না; কিন্তু আত্মসমর্পণ করলে।
এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে সোনিয়ার কথা ভাবতে চাইল ফ্যারেল। মনে পড়ল কাল কীভাবে দৌড়ে আসতে দেখেছিল ওকে। শেরিফের অফিসের তুলনায় বাসা কাছে হওয়া সত্তেও ওর কাছেই ছুটে এসেছে সোনিয়া।
ওর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেছে সোনি, বলেছে অপমানের প্রতিশোধ নিতে। সক্রোধে মাথা নাড়ল ক্লিফ, না চাইলেও মনের গভীরে বার-বার জেগে উঠছে একটা প্রশ্ন: লোকটা যদি দোষী না হয়?
আরও কথা আছে: কে অপরাধী সে বিচার করার অধিকার কি ওর আছে? যদি ভুল করে ফেলে?
অনুসরণ করতে এখন কষ্ট হচ্ছে। আরও কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করার, পরও অবস্থার পরিবর্তন হলো না। কখনও কখনও পাথুরে এলাকা বেছে নিয়ে এগিয়েছে পলাতক ঘোড়সওয়ার ফলে আরও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে কাজটা। কয়েকবার ক্যাটল-ট্রেইলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সামনের ট্রাক। এদিকে কোনও জলাশয়ের দিকে গেছে, হয়তো জানোয়ারের দল। ধূর্ত লোকের পাল্লাতেই পড়া গেছে!-ভাবল ফ্যারেল, ট্রেইল গোপনে ইন্ডিয়ানদের মতো দক্ষ সে। তবে ট্র্যাকিংয়ে ক্লিফ কম যায় না। লোকটার ক্যাটল-ট্রেইল বেছে নেয়ার কারণ জলের মতো পরিষ্কার: গরু-মোষের আরেকটা পাল গেলেই তার ট্র্যাক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; কিন্তু অঘটন ঘটার আগেই পৌঁছুতে পেরেছে ফ্যারেল।
ভুরু কুঁচকে, ট্রেইলের দিকে তাকিয়ে আছে ক্লিফ, ভাবছে, এ গতিতে এগোলে শোশন ক্রিকে পৌঁছুনোর আগেই লোকটার, দেখা পাওয়া যাবে তো?
ব্যাকুল চেহারায় ফেরারীর ছোটার গতি আন্দাজ করার চেষ্টা করল ক্লিফ, নিজের গতি তুলনা করল, স্পষ্ট হয়ে গেল: এখনও বিস্তর ব্যবধান দুজনের মাঝে।
কমপক্ষে ওর পাঁচ ঘণ্টা আগে যাত্রা শুরু করেছে, লোকটা, ট্রেইল অনুসরণের ঝামেলা নেই তার, অনায়াসে দ্রুত ছুটতে পারছে। কিন্তু ক্লিফের অবস্থা এর ঠিক উল্টো।
দূরত্ব ক্রমে বাড়ছে। লোকটাকে অতিক্রম করে সামনে যাবার একটা উপায় বের করতে না পারলে ব্যবধান বাড়তেই থাকবে, চিরদিনের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে শিকার।
চোখ কুঁচকে আছে ফ্যারেলের। এলাকা সম্পর্কে জানা খুঁটিনাটি প্রতিটি তথ্য মনে মনে নেড়েচেড়ে দেখল। তারপর, হঠাৎ স্পরের খোঁচা লাগাল ঘোড়ার পেটে।
ঠিক যেখানে মরুভুমির শুরু, একটা খাড়া পাথুরে ব্লাফ আছে ওখানে। ওইপথে মরুভুমিতে পৌঁছুনোর মাত্র তিনটে ট্রেইল। তিনটেই সংকীর্ণ। ওগুলোরই একটা ব্যবহার করতে হবে লোকটাকে।
কিন্তু ওদিকে না গিয়ে যদি পুব, কিংবা পশ্চিমে যায় তাকে আর ধরা যাবে না। আবার ট্রেইল ধরে এগোলেও তার নাগাল পাওঁয়া অসম্ভব, অনায়াসে কেটে পড়বে আগন্তুক। শোশন ক্রিকে একবার পৌঁছুতে পারলে মাইলকে মাইল কোনও চিহ্ন না রেখে উধাও হয়ে যাবে সে। সুতরাং ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই।
সিদ্ধান্ত নিতে যা দেরি, প্রাণপণে ঘোড়া হাঁকলো ক্লিফ। ফেরারীর সঙ্গে দূরত্ব কমানোই এখন জরুরি, প্রয়োজনে সারারাত ঘোড়া হাঁকাতে রাজি আছে
ও। ট্রেইল ছেড়ে এলেও, এগোনোর সময় মাটির দিকে নজর রাখতে ভুল করছে না ক্লিফ। বলা যায় না ট্র্যাক মিলেও যেতে পারে।
সারা দিনে দুবার লোকটার ট্রাকের দেখা পেল ফ্যারেল, খানিকটা স্বস্তি পেল ও, ওর অনুমান ভুল হয় নি।
দুপুর গড়িয়ে গেল। ঘোড়া থামিয়ে পনের মিনিটের মতো বিশ্রাম নিল ফ্যারেল। ঘোড়াকে পানি খাওয়াল। গোটা কয়েক শুকনো ফল খেয়ে ক্যান্টিন থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো। তারপর আবার পথে নামল, এগোল দ্রুত গতিতে।
আস্তে আস্তে ওপর দিকে উঠছে মাটি, সেজ আর সিডারে ঢাকা এবড়োখেবড়ো রুক্ষ প্রান্তরে পৌঁছুল ফ্যারেল। এখানে পলাতকের সঙ্গে দূরত্ব যদি মাইলখানেক হয়, টের পাবেন না ও। আরও ওপরে উঠে এল ক্লিফ। সিডারের স্থান দখল করল স্ক্রাব পাইন।
বিকেল হলো। উত্তপ্ত প্রকৃতি, বালি উড়ছে চারদিকে। ক্লান্ত ঘোড়া নিয়ে একই গতিতে ছুটছে ফ্যারেল। এতক্ষণে আগন্তুকের সঙ্গে দূরত্ব আরও কমে আসার কথা। সন্ধ্যা নাগাদ তাকে অতিক্রম করে যাবার ক্ষীণ একটা আশা আছে।
তখন অনুমান করতে হবে, খাড়া ব্লাফ থেকে নেমে যাওয়া তিনটে ট্রেইলের কোনটা পাহারা দেয়া লাগবে। তারপরও ভুল করেছে কিনা ভেবে উৎকণ্ঠায়, থাকতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত।
সূর্যাস্তের আধ ঘন্টা আগে আবার থামল ক্লিফ ফ্যারেল। ছোট করে আগুন জ্বেলে বেকন ভেজে রুটি সেঁকল; তারপর কফি তৈরি করে রুটি আর বেকন ভাজা দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে খেল। ওদিকে নিশ্চিন্ত মনে ঘাস খেয়ে চলছে ঘোড়াটা। খাওয়া শেষ হলে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল ক্লিফ, চোখ মেলে দিল আকাশের দিকে; নানা রঙের খেলা চলছে ওখানে। সারা দিন এড়িয়ে গেলেও এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করল ক্লিফ। সরাসরি সমস্যার কথা ভাবতে চায় না ও, কিন্তু না চাইলে কী হবে, মনে পড়ে যায়। সোনিয়ার কথা ভাবলেই অনিবার্যভাবে মনে আসে ওর লাঞ্ছনার কথা, কী করবে ভাবলে চোখে ভাসে বাবার বিধ্বস্ত চেহারা একবার, একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আজ তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হলে ওর পরিণতিও বাবার মতো হবে।
সারা দিন অনুসরণ করার পর ক্লিফ, মোটামুটি নিঃসন্দেহ, সামনের লোকটা ট্রেইল গোপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তাতে অবশ্য প্রমাণ হয় না সে-ই কাল সোনিয়াকে রেপ করেছে। হয়তো অন্য কোথাও কোন অপরাধ করেছে, তাই আইনের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করছে সে।
চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন মনে, উঠে বসল ফ্যারেল। আগুন নিভিয়ে দিল। ল্যাসো ছুঁড়ে ঘোড়া ধরে পিঠে জিন চাপাল, গুটিয়ে নিল দড়িটা, তারপর, স্যাডলে উঠে দক্ষিণে রওনা হলো।
এগিয়ে চলেছে ফ্যারেল। আস্তে আস্তে রঙ পাল্টে ধূসর হলো আকাশ, গোধূলি লগ্ন। একটা দুটো তারা দেখা দিল আকাশে। কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠবে, রূপালি ছটা তার আগমনবার্তা ঘোষণা করছে।
গ্রে বাট থেকে ষাট মাইল দূরে এসে পড়েছে ক্লিফ, আরও অন্তত তিরিশ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে।
ঘোড়াকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে কিছুটা মন্থর গতিতে এগোচ্ছে ও। উত্তেজিত স্নায়ু শান্ত করার চেষ্টা করছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে।
মাঝরাতের দিকে ব্লাফের কাছে পৌঁছুল ক্লিফ ফ্যারেল। সামনে, নীচে বিস্তীর্ণ ঊষর প্রান্তর, বিরান; ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। কয়েক মাইল আগে একটা ঝর্নায় ঘোড়াকে পানি খাইয়ে ক্যান্টিন ভরে নিয়েছে ক্লিফ। ঘোড়াটা একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ব্লফের কিনারে বসে পড়ল ও, শুরু হলো অপেক্ষা। এখান থেকে মরুপ্রান্তরের অনেকদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়, অপেক্ষা করার জন্যে উপযুক্ত স্থান। সকালে আবার পথে নামলে ফেরারীর ঘোড়ার খুরের ঘায়ে ধুলো উড়বে স্পষ্ট দেখা যাবে।
চোখ দুটো বারবার বুজে আসতে চাইছে ফ্যারেলের, এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ও। স্বপ্ন দেখল, ভয়াবহ অদ্ভুত সব স্বপ্ন; চমকে থেকে থেকে উঠে বসল। রাতের হিমেল হাওয়াতেও ঘেমে নেয়ে উঠেছে।
অবশেষে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। যখন ঘুম ভাঙল, রাত পেরিয়ে গেছে, দিগন্তে ভোরের আভাস।
উৎকণ্ঠায় একলাফে উঠে দাঁড়াল ক্লিফ। পুরোপুরি ভোর হতে এখনও অনেক দেরি বুঝতে পেরে, হাঁপ ছাড়ল। ব্লাফের কিনারায় দাঁড়িয়ে মরুভূমির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
কিছু দেখা গেল না, দেখা যাবার কথাও নয়, এত তাড়াতাড়ি লোকটার বেরোবার সম্ভাবনা কম।
কয়েকটা বাসী রুটি আর বেকন ছিল, ওগুলো দিয়েই নাশতা সেরে নিল ফ্যারেল। পেট পুরে পানি খেল ক্যান্টিন থেকে। তারপর সিগারেট বানিয়ে একটা পাইন গাছে ঠেস দিয়ে বসে আয়েশ করে টানতে লাগল। মরুভূমির দিক থেকে নজর সরাল না।
কোন স্পন্দন নেই। এদিকে তাপ-তরঙ্গের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়েছে মরুর বুকে। মরুভূমির একঘেয়ে দৃশ্যে ঈষৎ বৈচিত্র্যের ছোঁয়া দিয়েছে ছড়ানো ছিটানো কিছু ক্যাকটাস, বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে অদ্ভুত চেহারা নিয়ে টিকে আছে কোনওমতে।
সময় বয়ে যাচ্ছে। সূর্য উঠে এসেছে আকাশে। কিন্তু কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই।
ভুল করে ফেলল না তো, ভাবল ফ্যারেল। উদ্বেগে কুঁচকে উঠল ভুরুজোড়া। কিন্তু ভুল হলেও এখন শোধরানোর উপায় নেই। দুপুর পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করবে ও, এর মধ্যে যদি।লোকটাকে দেখা না যায়, ব্যাকট্র্যাক করে আবার তার ট্রেইল খুঁজে বের করতে হবে। ওকে পাকড়াও না করে ফিরবে না ক্লিফ।
একটা মাছরঙা পাখি কিছুক্ষণ আশপাশে উড়ে বেড়াল, তারপর পালিয়ে গেল। বাচ্চাসহ একটা হরিণ একশো গজের মধ্যে এসে পড়েছিল, হঠাৎ গেল্ডিংটা লাফিয়ে উঠলে ভয়ে পালাল।
গরম বাড়ছে। সূর্যরশ্মি পাথর আর নীচের মরুভূমিতে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে।
আচমকা অকাক্ষিত বস্তুর দেখা পেল ক্লিফ। ডানে, দুএক মাইল দূরে, মরুভূমিতে ধুলোর মেঘ। একটা শুকনো ওঅশ থেকে সমতল মরুপ্রান্তরে উঠে এল এক ঘোড়সওয়ার।
ঝটপট তৈরি হয়ে নিল ক্লিফ ফ্যারেল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সামনের অশ্বারোহীর ট্রেইলের উদ্দেশে দ্রুত ছুটছে ও।
উত্তেজিত হয়ে পড়েছে ক্লিফ। ওর অনুমান মোটেই ভুল হয় নি।
ঝড়ের বেগে ঝাড়া দশ মিনিট ঘোড়া হাঁকাল ক্লিফ, ট্রেইলের মাথায় এসে পড়ল। ঘোড়া ঘুরিয়ে নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।
প্রায় মাইল তিনেক এগিয়ে রয়েছে লোকটা। ওপর থেকে দূরের, মরুভূমির দিকে তাকাল ফ্যারেল, কোন দিকে যাওয়া যায়?
ডানে একটা দীর্ঘ অথচ নিচু রিজ দেখা যাচ্ছে। সামনের অশ্বারোহীকে অতিক্রম করে যেতে চায় ও, রিজের বামে রয়েছে সে।
উচ্চতায় বিশ থেকে পঁচিশ ফুটের মতো হবে রিজটা, ওপাশ দিয়ে এগোলে এদিক থেকে ওদের দেখতে পাবে না, লোকটা।
ট্রেইলের শেষ মাথায় পৌঁছে ডানে ঘোড়া ঘোরাল ফ্যারেল। রিজের মাথা পেরিয়ে ছুটল। একনাগাড়ে কিছুক্ষণ সামনে এগোল ও, মাঝে মাঝে বায়ে তাকিয়ে নিশ্চিত হলো, আগন্তুক ওর উপস্থিতি টের পায় নি।
মোটামুটি প্রয়োজনীয় দূরত্ব অতিক্রম করা গেছে নিশ্চিত হয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিল ও। আরও আধ মাইলের মতো এগিয়ে রিজের চূড়ায় উঠল, তাকাল পেছনে।
মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল ফ্যারেল। অশ্বারোহীকে যেখানে দেখরে ভেবেছিল, নেই। আরও পেছনে, ব্লাফের দিকে তাকাতেই ধড়ে প্রাণ এল, আসছে অশ্বারোহী, মাইল দেড়েক দূরে রয়েছে।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ক্লিফের ঘোড়া, হাঁপাচ্ছে। আর আত্মগোপন করার দরকার নেই, ঘোড়া নিয়ে মন্থর গতিতে সোজা আগন্তুকের দিকে এগোল ক্লিফ।
থমকে দাঁড়াল অশ্বারোহী। মুহূর্তের জন্যে নিশ্চল পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলো। ঘোড়াকে বিশ্রামের সুযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ক্লিফ। আবার পিছু ধাওয়া করার প্রয়োজন হলে ছোটার জন্যে প্রচুর শক্তি লাগবে ঘোড়াটার।
আচমকা পুব দিকে ঘোড়া, ঘোরাল আগন্তুক। অনুসরণ করল ক্লিফ। গতি বাড়াল সে। ক্লিফও গতি বাড়াল।
হঠাৎ রাশ টেনে ঘোড়া থামাল লোকটা। ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী দেখল ক্লিফ মুহূর্তের জন্যে। শখানেক গজ দূরে ছিটকে উঠল বালি। তার পরপরই রাইফেলের গর্জন শুনতে পেল।
সতর্ক সঙ্কেত। পরিষ্কার জানিয়ে দিল লোকটা: যেই হও, দূরে থাকো।
কিন্তু থামল না ফ্যারেল। নতুন ধোঁয়ার কুণ্ডলীও চোখে পড়ল না। আবার দিক বদল করল আগন্তুক। সোজা পুবে যাচ্ছে, একতালে ছুটছে তার ঘোড়া।
ওর সমান্তরাল পথে ঘোড়া হাঁকাল ক্লিফ। গতিপথ বদল করার ফলে পিছিয়ে পড়েছে। মাইল খানেক সামনে রয়েছে ফেরারী। সমান তালে ঘোড়া ছুটিয়ে দূরত্ব কমিয়ে আনতে শুরু করল ক্লিফ।
ছোটার গতি একটু না কমিয়ে কোনাকুনি বামে এগোতে শুরু করল ও। হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। দুপুরের আগেই অবসান ঘটবে এ নাটকের। আগন্তুকের ঘোড়া পরিশ্রান্ত, এভাবে বেশিক্ষণ ছুটতে পারবে না ওটা।
ধীরে ধীরে মাঝের দূরত্ব আধমাইলে নামিয়ে আনল ফ্যারেলপোয়া মাইল…হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল ও, থামো!
লোকটা শুনেছে কিনা বোঝা গেল না, কিন্তু ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়ই। ক্লান্ত ঘোড়ার পেটে স্পর দাবাল সে। ফ্যারেলও স্পারের খোঁচা দিল গেল্ডিংয়ের পেটে, লাফিয়ে সামনে ছুটল ওটা।
গুলি করার চেষ্টা করছে না আগন্তুক; সামনে ঝুঁকে ঘোড়ার পিঠের সঙ্গে মিশে গিয়ে ছুটছে। কিন্তু ক্রমশ দূরত্ব কমিয়ে আনছে ক্লিফ।
আবার চিৎকার করে উঠল ও, দাঁড়াও! তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো!
ক্লিফ আগন্তুকের আনুমানিক পঞ্চাশগজের মধ্যে পৌঁছুতে লাফিয়ে স্যাভল থেকে নামল সে, ডিগবাজি খেয়ে উঠে দাঁড়াল, চট করে উঠে এল তার রাইফেল, খেঁকিয়ে উঠল।
আগেই পিস্তল বের করে নিয়েছে ফ্যারেল, আগন্তুকের বড় জোর বার চোদ্দগজ দূরে রয়েছে ও। দূরত্ব কমছে, দ্রুত। ইচ্ছে করলে এখুনি লোকটাকে হত্যা করতে পারে, আত্মরক্ষার খাতিরে সে অধিকার ওর আছে।
কিন্তু হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি ঢুকিয়ে মুহূর্তে মেরে ফেলে ওকে বাঁচিয়ে দিতে চায় না ক্লিফ।
সোনিয়ার মতো প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে একে। অবশ্য এটাই লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র কারণ নয়। হঠাৎ বাবার শেষ প্রত্যাবর্তনের কথা মনে পড়ে গেছে ওর একই ভুলের পুনরাবৃত্তি চায় না ক্লিফ।
একলাফে স্যাডল থেকে নেমে গড়িয়ে সরে গেল ও। আবার গর্জে উঠল, আগন্তুকের রাইফেল। পায়ের কাফে বুলেটের ধাক্কা অনুভব করল ও।
ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেল ফ্যারেল, ঝাঁপিয়ে পড়ল. লোকটার ওপর। রাইফেলের উত্তপ্ত ব্যারেল জাপটে ধরল দুই হাতে, হ্যাচকা টানে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল পঞ্চাশ ফুট দূরে। হোলস্টারের পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল লোকটা, পরক্ষাণে ক্লিফের হাটু আঘাত হানল তার মুখে, পিস্তল ধরা হাতের কজি ধরে মুচড়ে দিল ক্লিফ। খসে পড়ল অস্ত্রটা, লুফে নিল ক্লিফ, ঘুরিয়ে সজোরে নামিয়ে আনল আগন্তুকের মাথায়, একপাশে লাগাল আঘাতটা। ভাঙাচোড়া ভঙ্গিতে, উত্তপ্ত বালিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।
হাঁপাচ্ছে ক্লিফ, ঘন ঘন ওঠানামা করছে বুক, লোকটার দিকে তাকাল ও। তারপর এলোমেলো পায়ে ঘোড়র কাছে এসে স্যাডল থেকে ক্যান্টিন খুলে ঢকঢক করে পানি খেল, ক্যান্টিনটা রেখে ঘোড়া নিয়ে ধরাশায়ী শত্রুর কাছে ফিরে এল। একে বাঁচিয়ে রাখা কি ঠিক হলো? কিন্তু এ. ছাড়া আর কী করার আছে?
<