৪১.
ছেঁড়া ছিল জুডির ব্লাউস। স্তনে খামচির দাগ। লেক তীরে কেবিনে রানাকে বলেছে ও, কীভাবে ওকে চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেছে লোগান টার্সন নামের এক পশু। কখনও ভুলবে না সেই অপমান। এবং এ কারণে টার্সনের প্রাপ্য কঠিন শাস্তি। সেটা দেবে ঠিক করেছে রানা। এখন দোতলায় সিঁড়ির মুখে আছে লোকটা।
অন্য কেউ হলে গুলি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উঠত, সেটা করবে না রানা। ওপরের লোকটা ধরে নিয়েছে ও মারা গেছে পার্কারের হাতে। তবুও সতর্ক হয়ে একটা একটা করে ধাপ টপকে উঠছে রানা। ধোঁয়ার ওদিকে টার্সন। একবার গুঙিয়ে উঠল রানা। যে-কেউ ভাববে পার্কার আহত। এতে অসতর্ক হওয়ার কথা টার্সনের।
শালা শেষ, কিন্তু গুলি লেগেছে, ওহ্, আমেরিকান টানে চাপা স্বরে বলল রানা।
কোথায় লাগল গুলি? ওপর থেকে জানতে চাইল টার্সন। মাত্র সাত ধাপ ওপরেই দোতলায় আছে সে।
ছয় ফুট নিচের ধাপে মাথা নিচু করে রেখেছে রানা। চট করে দেখতে পাবে না লোকটা। চারপাশে ধোয়ার জাল। কয়েকবার কেশে উঠল রানা। যে-কেউ ভাববে ও আহত।
কুত্তাটা মরেছে তো, পার্কার?
হ্যাঁ, শেষ, কয়েক ধাপ টপকে দোতলায় উঠল রানা। ডানদিকে লোকটা, হাতে পিস্তল। যেন ধরে নিয়েছে ওটার আর দরকার নেই। টলতে টলতে হাত বাড়াল রানা, যেন ধরবে রেলিঙের মত কিছু। নিজের হাত ওপরে তুলল টার্সন। সেটা সাহায্য করতে, না ওকে বিদায় করতে, সেটা বোঝা গেল না। খপ করে তার হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিল রানা।
মুহূর্তে টার্সন বুঝে গেল, সামনে কে!
রানা ভেবেছিল লড়াই করতে চাইবে লোকটা। কিন্তু তা না করে পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকাল সে। হাত তুলে ফেলেছে মাথার ওপর। চোখে-মুখে ভয়। সত্যিকারের কাপুরুষ। শক্ত কারও সামনে পড়লে নেতিয়ে পড়ে ভেজা মুড়ির মত।
টার্সনের চোয়ালের নিচে ওয়ালথারের নল ঠেকাল রানা। পার্কার মারা গেছে।
ঘন-ঘন মাথা নাড়ল টার্সন। প্লিয! হায়, ঈশ্বর! দয়া করে আমাকে খুন করবেন না!
আমি নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করি না, নিচু গলায় বলল রানা। চারপাশে পাক খাচ্ছে ধোঁয়া। চুলোর গনগনে আগুনের মত বাড়ছে উত্তাপ। যে-কোনও সময়ে পুড়তে শুরু করবে গায়ের পোশাক। প্রচণ্ড রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে জানতে চাইল রানা, তোমার নাম লোগান টার্সন?
ভয়ে চুপ করে থাকল লোকটা।
পিস্তল তার কানে ঠেকাল রানা। যে-কোনও সময়ে গুলি করবে। নানা দিকে ছিটকে যাবে মগজ ও রক্ত।
হ্যাঁ… আমি টার্সন। আমি এদের কেউ না!
তা জানি, সেজন্যেই করে দেব বাঁচার সুযোগ।
বাঁচতে দেবেন আপনি?
হ্যাঁ। কিন্তু আর কখনও অত্যাচার করতে পারবে না কোনও মেয়ের ওপর।
টার্সনের পিস্তল নিচে তাক করল রানা। মাযল চেয়ে আছে লোকটার উরুসন্ধির দিকে।
মাত্র একবার ট্রিগার টিপল রানা।
তীক্ষ্ণ চিৎকার ছেড়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল টার্সন।
যদি নিচতলার আগুন পেরিয়ে বেরোতে পারো, হয়তো বাঁচবে তুমি।
প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতে গোঙাতে সিঁড়ির দিকে ক্রল শুরু করল টার্সন। আগুন, ধোঁয়া বা ছিঁড়ে পড়া গোপনাঙ্গের রক্তপাতে হয়তো মরবে, তবে নিজের কথা রেখেছে রানা। লোকটা বাচলেও আর কখনও কোনও মেয়েকে ধর্ষণ করতে পারবে না।
দূরে একটা দরজার ওদিকে বেডরুম। ওপাশের দরজা দিয়ে আসছে সকালের উজ্জ্বল সোনালি আলো। ওদিকে পা বাড়াবার আগে, কাঁধের ওপর দিয়ে একবার তাকাল রানা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে টার্সন। গর্জে উঠল জনের মসবার্গ বন্দুক। বারান্দায় চাপা কণ্ঠ। আগুনের শোঁ-শোঁ আওয়াজে চাপা পড়েছে কথাগুলো। তবে তখনই রানা চিনল রিক বেণ্ডারের ভারী গলা। জবাবে কী যেন বলল ময়নিহান।
হ্যাঁ, এখন বারান্দায় রানার দুই চরম শত্রু!
খ্যাট-খ্যাট শব্দে গর্জে উঠল এম সিক্সটিন। ঘরের ছাত ভেদ করে অ্যাটিকে বিঁধল গুলি। প্ল্যান অনুযায়ী বাড়ির পেছনে শত্রুদেরকে কোণঠাসা করেছে জন ও বাড। ওয়ালথার উঁচিয়ে ঘরে ঢুকল রানা। প্রথম সুযোগে শেষ করবে ন্যাশ ময়নিহান ও রিক বেণ্ডারকে।
তখনই শুনল তক্তায় ধুপ আওয়াজ। দরজার ওপাশে দেখল উড়ে চলেছে বিশাল ছায়া। তিন সেকেণ্ড পর এল কাঠ ফাটার মড়াৎ শব্দ ও কাঁচ ভাঙার ঝনঝন। ঝাঁপ দিয়ে বারান্দা থেকে পাশের দালানে গিয়ে ঢুকেছে দানব রিক বেণ্ডার।
আপাতত মুখোমুখি হওয়া গেল না। রিককে হয়তো বাগে পাবে জন ও বাড। অথবা ওদেরকে পাবে দানবটা। রানার উচিত প্রথমে ময়নিহানকে শেষ করা। বারান্দার দরজার দিকে পা বাড়াল ও।
বাইরে বিড়বিড় করে গাল বকে চলেছে কেউ।
ঘর থেকেই তাকে শেষ করবে কি না, ভাবল রানা। অনায়াসেই কাঠের দেয়াল ভেদ করবে .৩৮ বুলেট। কিন্তু তাতে খচখচ করবে মন। বদমাসটা ময়নিহান হলে নিজ চোখে দেখুক, কার হাতে মারা পড়ছে সে।
খুব সাবধানে দরজার পাশে পৌঁছে গেল রানা। একপাশ থেকে দেখল হাঁটু গেড়ে ওর বন্ধুদের দিকে গুলি করছে ময়নিহান। নিঃশব্দে সামনে বেড়ে তার মাথার তালুতে ওয়ালথারের মামল ঠেকাল রানা। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ঘুরে ওকে দেখল ময়নিহান।
.
৪২.
দুজন মানুষের চেয়েও ভারী একজন লোকের জন্যে কঠিন লং জাম্প দেয়া। গায়ের জোরে লাফ দিয়েছে রিক বেণ্ডার। কিন্তু কফুট যেতেই কমেছে গতি ও উচ্চতা। ভেবেছে ঢুকবে ওদিকের বাড়িটার জানালা ভেঙে। তবে করেছে ভুল হিসাব। জানালার পর্যন্ত না পৌঁছলেও ওজন কাজে এল রিকের। পা দিয়ে আছড়ে পড়তেই মড়াৎ করে ভাঙল দেয়াল। ঝনঝন করে ভাঙল জানালার ফ্রেম ও কাঁচ। ওর কপাল ভাল সরাসরি সামনে ছিল না কাঠের কলাম। রকেটের মত ধুলো ভরা মেঝেতে পিছলে গেল সে।
উঠে বসে হাত দিতেই টের পেল, কপাল কেটে ঝরঝর করে পড়ছে রক্ত। পায়ের আঘাতে দেয়াল ভেঙে ঢুকলেও ক্ষত তৈরি হয়েছে মাথায়। জানা নেই জানালার নিচের চৌকাঠে লেগে এই হাল। উত্তেজনা কমলে শুরু হবে ভীষণ ব্যথা। ওর প্রথম কাজ কী তা বুঝে গেল রিক। অস্ত্র হাতে ওই দুজন আছে কাছেই কোথাও। আপাতত তাদের বিরুদ্ধে লড়বে না সে। সঠিক সময় আসুক। দুহাতে ছিঁড়ে ফেলবে ওদেরকে। একজনের হাতে এম সিক্সটিন রাইফেল, অন্যজনের কাছে শটগান। এখন এড়িয়ে যেতে হবে, নইলে ভণ্ডুল হবে ন্যাশ ময়নিহানের প্ল্যান। মরুক হারামজাদা!
এখনও মুঠোয় ডেযার্ট ঈগল পিস্তল, রানার দুই সঙ্গীকে ভয় দেখাতে তিনটে গুলি দেয়ালের ওদিকে পাঠাল রিক। হাতে সময় চাই। ভেবে বের করতে হবে এবার কী করবে। দুসেকেণ্ড পর মন বলল, আগে সরে যা এখান থেকে। তারপর একজন একজন করে ওদের দুটোকে শেষ করবি।
উঠে দৌড় শুরু করল রিক। পরিত্যক্ত কিছু খামারের যন্ত্রপাতি পাশ কাটিয়ে তীরের বেগে ছুটল বাড়িটার সদর দরজা লক্ষ্য করে। কিন্তু ওই পথে বেরোলে সামনে পড়বে বন্দুকওয়ালা। বাঁক নিয়ে বাড়িটার পাশের দরজার দিকে চলল রিক। দরজা তালাবদ্ধ কি না দেখতে গেল না, দুহাত সামনে বাড়িয়ে ওটার ওপর হামলে পড়ল যুদ্ধের ট্যাঙ্কের মত। কবজা ছুটিয়ে দড়াম করে বাইরের আছড়ে পড়ল দরজা। না থেমে বামে বাক নিয়ে পাশের বাড়ির মাঝের প্যাসেজওয়ে ধরে ছুটল রিক। ডানের ছাউনিতে রয়েছে ন্যাশ ময়নিহানের বিধ্বস্ত কপ্টার।
প্যাসেজওয়ে শেষ হতেই থমকে দাঁড়াল রিক। উঁকি দিল বাড়িটার দিকে। এদিকেই কোথাও আছে কালো লোকটা। কিন্তু দেখা গেল না তাকে। ধুপধাপ আওয়াজে পাথুরে জমিতে দৌড় দিল রিক। একটু দূরেই হেনির ক্যাডিলাক। আগেই খুলে রেখেছে নরম চামড়ার ছাত, দরজা না খুলে প্রায় ঝাঁপিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। মুচড়ে দিল ইগনিশন চাবি। প্রথমবারেই গর্জে উঠল ক্যাডিলাকের ইঞ্জিন। রিক জানে, পালিয়ে যাচ্ছে না সে। সুযোগ বুঝে হামলা করবে রানা ও ওর বন্ধুদের ওপর। ময়নিহানের মত গাধা নয় সে, দুনিয়ার মানুষকে দেখাতে হবে- সে-ই সেরা তুলনাহীন! ময়নিহান শালা সত্যিকারের বুরবক! মরুক হারামজাদা!
অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে ক্যাডিলাক নিয়ে সোজা গবাদি রাখার ছাউনির দিকে চলল রিক। ঝড়ের গতি তুলছে গাড়ি। এল না একটা গুলিও। নিশ্চয়ই বোকা বনে গেছে কেলে ভূত!
কসাইখানা পাশে রেখে ছুটছে ক্যাডিলাক। নাকে এল পচা রক্ত ও গোবরের বিশ্রী দুর্গন্ধ। তীরের বেগে বাক নিল রিক। সামনেই কোথাও আছে বন্দুকওয়ালা। ওর মাথা উড়িয়ে দেয়ার আগেই খুন করতে হবে তাকে।
সিটে গুটিয়ে বসার তুলনায় রিক প্রকাণ্ড। শুয়ে পড়লেও টার্গেট হিসেবে থাকবে বাস্কেট বলের সমান মাথাটা। কিছুই করার নেই। কপ্টারের বাড়িটার কোনা ঘুরে ছিটকে বেরোবে সে। আশা করা যায় মরবে না গুলি খেয়ে। পেছনে পড়ল আগের বাড়ি। ওখানেই দেয়াল ভেঙে ঢুকেছে সে।
বাঁক নিতেই দেখল জাপানি চেহারার লোকটাকে। বন্দুক তাক করেছে বারান্দার দিকে। বারান্দা দেখল রিক। ন্যাশ ময়নিহানের মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ রানা। পরে তার ব্যবস্থা নেবে সে, আগে শেষ করতে হবে জাপানি শালাকে। ডের্ট ঈগল তুলেই গুলি করল রিক।
চরকির মত ঘুরেই ধুপ করে মাটিতে পড়ল জন হার্বার্ট। এত জোরে ছুটছে ক্যাডিলাক, রিক বুঝল না লোকটা মরেছে কি না। ঝড়ের বেগে চলেছে ক্যাডিলাক। চারপাশে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। বাতাসে উড়ছে জ্বলন্ত পঙ্গপালের মত ছাই ও স্ফুলিঙ্গ। এরই ভেতর ধসে পড়েছে বাড়ির সামনের দিক। তাতে কী, তীরের বেগে ছুটতে ছুটতে আবারও গাড়ি ঘুরিয়ে নেবে রিক। আবার তেড়ে যাবে বাড়ির পেছন দিয়ে।
ঘন ধোঁয়া থেকে পরিষ্কার জায়গায় বেরোল দ্রুতগামী ক্যাডিলাক। সামনেই ঢালু রাস্তা। ওখানেই অ্যাম্বুশ করেছিল রডনি জ্যাকসন। ঢালু রাস্তায় চাকা পিছলে ঘুরে গেল ক্যাডিলাক, আবার ছুটল বাড়ির দিকে। গতি প্রচণ্ড। নতুন করে ধোয়ার জালে ঢুকছে রিক। শিয়োর হতে ৩৫৭ বুলেট গেঁথে দেবে জাপানির বুকে। ক্যাডিলাকের চারপাশে হলদে লাল-কমলা স্ফুলিঙ্গ। ধোঁয়ায় ভীষণ জ্বলছে রিকের চোখ। কিছুই পাত্তা না দিয়ে গতি তুলছে ক্যাডিলাক গাড়ির। দেখল, সামনেই জ্বলন্ত বাড়ি থেকে বেরোল এক লোক। আগুন ধরে গেছে পোশাক, চুল ও সারাশরীরে। প্রাণপণে বিকট আর্তচিৎকার ছাড়ছে সে, টলতে টলতে সরাসরি চলে এল ক্যাডিলাকের চলার পথে।
চাইলেও বাঁক নিতে পারবে না রিক।
সরাসরি লোকটাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল ভারী ক্যাডিলাক। ছিটকে আকাশে উঠে উইণ্ডশিন্ডে পড়ল লোকটা। গাড়ির শক্ত ছাত থাকলে গড়িয়ে পেছনের মাটিতে গিয়ে পড়ত লাশ, কিন্তু চামড়ার টপ নামিয়ে রাখায় উইণ্ডশিল্ড ফাটিয়ে ওটার ওপর দিয়ে এসে সোজা রিকের কোলে নামল লোগান টার্সন।
লম্বা-চওড়া লাশ সে, ছুঁড়ে দেয়া ভারী গদার মত এসে লেগেছে রিকের বুক-পেটে। ওর নাকে-মুখে লাগল রক্ত ও আগুনের ফুলকি। মাথায় ঢুকছে না কী হচ্ছে। প্রাণপণে ধরে রাখল স্টিয়ারিং হুইল। সাঁই করে বামে ঘুরে বাড়ির সামনের ফুটপাথে উঠল ক্যাডিলাক। ভেঙে দিল বারান্দার কয়েকটা খুঁটি। আরেক লাফে নেমে পরক্ষণে গেল উল্টে। গাড়িটা গড়াতে শুরু করে পড়ল গিয়ে রাস্তা থেকে মাঠে। ওটা থেকে ছিটকে পাথুরে জমিতে পড়েছে রিক ও টার্সন।
কী হচ্ছে বুঝছে না রিক। চোখের সামনে ঝিলিমিলি, সারাশরীরে তীব্র ব্যথা। গড়িয়ে চলেছে পাথরের ওপর দিয়ে। চোখ-মুখে ঢুকেছে একরাশ বালি। টাশ করে একটা আওয়াজ হতেই বুঝল, ভাঙল পাঁজরের একটা হাড়। কসেকেণ্ড পর স্থির হলো দেহ। পড়ে আছে চিত হয়ে। চরকির মত ঘুরছে দুনিয়া। আঁধার চারপাশ। সব বড় বেশি থমথমে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল রিক, তারপর উপুড় হলো দুই হাতে ভর করে। পিটপিট করছে চোখ। থু-থুহ করে মুখ থেকে ফেলল মাটি ও ধুলো। ওকে ঘিরে রেখেছে একরাশ ধোঁয়া। গুঙিয়ে উঠল ব্যথায়। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে পাঁজরের ভাঙা হাড়। ওটার জন্যেই এত ব্যথা, তা নয়। সারা শরীরের নানান জায়গা জানান দিচ্ছে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে সে।
মটকে গেল মেরুদণ্ড?
বা ফেটে গেছে করোটি?
হবে বোধহয়!
হঠাৎ আবার সব শুনতে পেল রিক। কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করছে নিক: শুয়োর কোথাকার, উঠছিস না কেন? উঠে দাঁড়া! কে খুন করবে মাসুদ রানাকে?
গড়ান দিয়ে হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসল রিক। বনবন করে ঘুরছে মাথা। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো, ও আসলে হারিকেনে পড়া কোনও টাওয়ার।
আগুনের তীব্র হলকা সরিয়ে নিচ্ছে ধোঁয়া। সামনে চেয়ে চমকে গেল রিক। ওর দিকেই চেয়ে আছে জাপানি নোকটা! বুকে রক্তের চিহ্ন নেই! গুলি করেও মিস করেছে সে। হাতের মসবার্গ বন্দুক সরাসরি ওর পেটে তাক করেছে লোকটা।
রানার শত্রু তুমি, বলল জন, সেক্ষেত্রে তোমাকে লড়তে হবে আমার সঙ্গে।
.
৪৩.
অস্ত্রটা ফেলো, ময়নিহান, চাপা ধমক দিল রানা।
কুত্তার বাচ্চা, বিড়বিড় করল ময়নিহান। ঠোঁটে ফুটল হাসি। ওটা নকল বলে মনে হলো না রানার। তার মানে, তোমার সঙ্গে দেখা হলো। এবার মুখোমুখি লড়ব আমরা।
অস্ত্র ফেলো, নইলে খুন হবে, সহজ সুরে বলল রানা।
অস্ত্র ফেললেই বা কী, তুমি তো খুন করবেই আমাকে।
গুলিতে মরতে আপত্তি থাকলে আগুনে ঢুকতে পারো, ময়নিহানের খুলি থেকে মাযল সরাল রানা। পেছনের ঘরে দাউদাউ জ্বলছে লেলিহান আগুন। পিঠে এসে লাগছে প্রচণ্ড উত্তাপ।
তার চেয়ে আলাপ করা যাক, মিষ্টি হাসল ময়নিহান।
রাগে রানার মনে হলো ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে ও। আর আলাপের কিছু নেই। অস্ত্রটা হাত থেকে ফেলো!
ময়নিহান আঙুল ফাঁক করায় মুঠো থেকে পড়ল পিস্তল। লাথি মেরে ওটাকে আগুনে পাঠিয়ে দিল রানা।
কোটি কোটি ডলার পাবে, রানা। শুধু জানাও কত চাই। বাঁকা হাসল ময়নিহান। আমার ওপর খেপে আছ, কারণ ধরে এনেছি তোমার প্রেমিকাকে। কথা ঠিক। কিন্তু ওটা ব্যক্তিগত কিছু ছিল না। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। নিজের ক্ষতি করতে পারি না। বুঝতেই পারছ।
আমি তোমাকে ব্যবসায়ী মনে করি না। মানুষ বলেও মনে করি না।
হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, অনেকে মারা গেছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকে ছিল লোভী লোক। যে যার স্বার্থে কাজ করেছে।
তুমি নিজেও তাই, ময়নিহান। এসবই ছিল তোমার কাছে সামান্য খেলা। এ খেলায় সবসময় জিততে চেয়েছ। কিন্তু এবার হারতে হবে তোমাকে।
কাঁধ ঝাঁকাল ময়নিহান।
তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, লোকটার রাজত্ব ধসে পড়েছে বলে মোটেও চিন্তিত নয় সে।
তুমি কখনও জিতবে, কখনও হারবে, ব্যবসার নিয়ম।
ইঞ্জিনের গর্জন শুনল রানা। ক্যাডিলাক নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে চলেছে রিক বেণ্ডার। গুলি করল জনকে লক্ষ্য করে। চরকির মত ঘুরেই পড়ে গেল জন। ভঙ্গিটা দেখে রানা বুঝল, ও আহত নয়। দুজনের চোখ পরস্পরকে দেখল, তারপর আবারও ময়নিহানের দিকে মনোযোগ দিল রানা।
তোমার দোস্ত বুদ্ধিমান। ওই যে দেখো, লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
রিক বেণ্ডার আমার দোস্ত নয়, চাপা স্বরে আপত্তি তুলল ময়নিহান। তারও এসবে স্বার্থ আছে।
জানি। তবে নিজ স্বার্থে তুমি ব্যবহার করছিলে ওকে।
ভুল নয়, চিনেছ আমাকে, হাসল ময়নিহান। জিতে গেলে তুমি। তো? কী করবে? খুন করবে?
উঠে দাঁড়াতে ইশারা দিল রানা। চোয়ালের নিচে ঠেসে ধরেছে ওয়ালথারের নল। এবার শেষ করব তোমার মজার খেলা।
তার মানে ভাবছ সমান সুযোগ দেবে না? হাসল ময়নিহান, কিন্তু আমি যদি তোমাকে খুন করি? তা হলেও গুলি খেয়ে মরব তোমার বন্ধুদের হাতে?
কে বলল তুমি আমাকে খুন করতে পারবে? নল দিয়ে ময়নিহানের চোয়ালের নিচের নার্ভে খোঁচা দিল রানা। নীরবে ব্যথাটা সহ্য করল লোকটা। এখনও মুখে হাসি, যদিও ম্লান হয়েছে ওটা।
বাঁচার উপায় না দেখলে কেউ কেউ হয় অনেক বেশি বিপজ্জনক। বিদ্যুদ্বেগে ঘুরল ময়নিহান। তার কবজির কাছে ঝিলিক দেখল রানা। বামহাতে ওর পিস্তল সরিয়ে নিয়েছে টপ টেরর। ডানহাতের ক্ষুর সাঁই করে চালাল রানার ভোলা গলা লক্ষ্য করে। এবার কাটা পড়বে কণ্ঠনালী।
বহু মানুষকে এভাবে খুন করেছে ময়নিহান। কিন্তু আগেই রানা বুঝেছে, হামলা করবে সে। ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে খুন করা কঠিন। আবার না ভুগে এক গুলিতে খুন হবে এই নরপশু, তা-ও রানার মনে হয়েছে অনুচিত। প্রতিটা পদক্ষেপে তাই থেকেছে সতর্ক। একহাতে পিস্তল সরিয়ে ক্ষুরের আঘাতে গলা কাটতে যেতেই ময়নিহানের বাহুতে কে-বার গাঁথল রানা। পড়পড় করে মাংস ভেদ করে তীক্ষ্ণধার ডগা ঢুকল লোকটার পাঁজরের ফাঁকে।
কিন্তু তখনই ভীষণ দুলে উঠল গোটা দুনিয়া।
নিচে থেকে এল বিকট আওয়াজ। মুচড়ে গেল ধাতব কিছু। পরক্ষণে বাইরের দিকে লাফ দিল বারান্দা। রানার পায়ের তলা থেকে সাঁই করে সরে গেল ওটা। চমকে গিয়ে দরজার ফ্রেম খামচে ধরেছে রানা। হাত থেকে ছুটে গেছে ছোরা। বাইরে ঢালু তক্তায় চেপে পিছলে সরে গেল ময়নিহান। ধাপ করে লাগল রেলিঙে, তারপর টপকে গেল ওটা। রানা প্রথমে ভেবেছে, অস্বাভাবিক দ্রুত আগুনে পুড়েছে বাড়ির কাঠের ভিত্তি, কিন্তু পরক্ষণে বুঝল রিকের গাড়ি গুঁতো মেরেছে বারান্দার কয়েকটা খুঁটিতে। আগেই বোঝা উচিত ছিল, হাল ছাড়বে না রিক বেণ্ডার। কী করতে চাইছে কে জানে, তবে এইমাত্র প্রাণ রক্ষা করেছে ন্যাশ ময়নিহানের!
রানার চারপাশে উড়ছে আগুনের ফুলকি। ঢালু বারান্দায় পা রেখে দাঁড়াতে চাইল ও। বামহাতে ওয়ালথার। ওটা গুজল কোমরে। ময়নিহানের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে ওর ছোরা। লোকটাকে কোথাও দেখল না রানা। চোখে পড়ল, ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে রিক বেণ্ডারের দিকে চলেছে জন। ওর ইচ্ছে হলো বন্ধুর পাশে থাকতে, কিন্তু আগে ধরতে হবে ময়নিহানকে, নইলে প্রথম সুযোগে পালিয়ে যাবে কাপুরুষ লোকটা।
বাড়ির আগুনের তীব্র হলকায় পুড়তে শুরু করেছে রানার হাতের আঙুল। দরজা ছেড়ে দিল ও। পিছলে নেমে গেল বারান্দায়। পা তাক করেছে রেলিঙের দিকে। আটকে গেল। দেয়ালের মত জায়গাটায়। উঠে খুঁজল ময়নিহানকে। ডানদিকে গেছে, জন। বামে তাকাল রানা। পাশের বাড়ির কোণ ঘুরে ওদিকে চলে গেল টপ টেরর।
রেলিং টপকে মাটিতে পড়েই শরীর গড়িয়ে দিল রানা। উঠে দাঁড়াল মাত্র দুই সেকেণ্ডে। ছুটল ময়নিহানের পেছনে। বামে ধোয়া থেকে বেরিয়ে আসছে কেউ। বাড, হাতে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল।
ময়নিহানের খোঁজে যাচ্ছি, বাডকে বলল রানা। জন গেছে রিক বেণ্ডারের পেছনে। ওর হয়তো সাহায্য লাগবে।
দেখিস, আবার মেরে ফেলিস না।
কোনও কথা না বলে রানাকে পাশ কাটিয়ে ছুটল বাড।
.
নিজেকে কী মনে করিস, কুত্তার-বাচ্চা, সরু চোখ শালা? জানতে চাইল রিক বেণ্ডার। ওর দিকে মসবার্গ শটগান তাক করেছে জন। ওকে পাত্তা দিচ্ছে না দানব। মুখে কুৎসিত হাসি।
নামটা আমার জন হার্বার্ট।
বুক থেকে গুমগুম শব্দের হাসি বেরোল রিকের। ভুলে গেছে ভাঙা পাঁজরের ব্যথা। জন? মানে জনি? তো শালা তুই পায়খানা আর পেচ্ছাবখানা?
এ লোকই খুন করবে তোমাকে, গম্ভীর কণ্ঠে বলল জন।
তো কাপুরুষের মত গুলি করবি তুই, শালা? নাকি তোর দোস্ত রানার চেয়ে সাহস বেশি তোর?
কুত্তা যেভাবে মারে তেমনি গুলি করে মারব তোমাকে।
মাথা নাড়ল রিক। তা করবি না তুই। গুলিই যদি করতি, তো সেটা করতি আগেই।
আগে গুলি করিনি মানেই এখন করব না এমন নয়।
তো কর? খামোক বিরক্ত করছিস কেন?
তার আগে লাথিয়ে তোমার পাছা ফাটিয়ে দেব, জঙ্গলের ভালুক কোথাকার, নরম সুরে বলল জন।
হাসির দমকে ঝড়ে পড়া বাঁশ পাতার মত কাঁপল রিক বেণ্ডার। বক্সিং গ্লাভসের সমান আকারের হাত তুলে মুখ থেকে সরাল ধুলোবালি। দেখছে জনকে। সামনের লোকটার মাথা বড়জোর ছুঁই-ছুঁই করবে তার কাঁধ। তোর মত পুঁচকে ছুঁচো ভাবছে আমার সঙ্গে লড়ে জিতবে?
ধোঁয়া থেকে ছুটে এল কালো লোকটা, হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। ঝট করে ওটা তাক করল রিকের বুক লক্ষ্য করে।
তোর মত আরও কয়টা তেলাপোকা আছে? জানতে চাইল রিক।
পরস্পরের দিকে তাকাল জন ও বাড।
এই নির্বোধকে নিজে শায়েস্তা করতে চায় রানা, বলল জন।
ঠোঁট বাঁকিয়ে ফেলল বাড। কুঁচকে গেছে ভুরু। দরকার কী, আমরাই শেষ করে দিই ঘেয়ো কুত্তাটাকে।
পিটিয়ে মারাই ভাল, মন্তব্য করল জন।
নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ তুলল রিক। পারলে তোরা দুটো মিলে চেষ্টা করে দ্যাখ! চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি!
বন্দুক দিয়ে জ্বলন্ত বাড়ি দেখাল জন। ওদিকে হাঁটো।
কাপুরুষের মত পিঠে গুলি করবে, নাকি?
তা করব না, তবে যখন পিটিয়ে আধমরা করব, হাসতে চাই তোমার মুখের ওপর।
আগুনে পোড়া বাড়ির দিকে পা বাড়াল রিক।
ঠাণ্ডা মাথার খুনি নয় জন বা বাড। আত্মসম্মানটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সুযোগ পেলে প্রথম সুযোগে ওদেরকে গুলি করত রিক। ভাবছে, দুই গাধা যখন গুলি করেনি, এ সুযোগে হয়তো এদেরকে শেষ করে দিতে পারবে সে।
মাত্র তিন কদম হেঁটেই হঠাৎ উবু হলো রিক। গুলি এল না তার দিকে। কাজেই ঝট করে সোজা হয়েই ঘুরে দাঁড়াল সে। আগেই দুহাতে তুলে নিয়েছে লোগান টার্সনের পোড়া লাশ। ওটা ছুঁড়ল বাডের দিকে। টার্সন যখন জীবিত ছিল, তাকে মানুষ বলেই গণ্য করত না রিক, কিন্তু সে মরে যাওয়ায় আগের চেয়ে হয়ে উঠেছে কাজের। পোড়া লাশ সরাসরি উড়ে আসছে দেখে বিস্ফারিত চোখে পিছিয়ে গেল বাড। ভুলে গেছে গুলি করতে। তার দিকে তেড়ে না গিয়ে জনের দিকে ছুটল রিক।
মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়েছে জন। পোড়া লাশ নিয়ে মনে নেই দুশ্চিন্তা। বন্দুকের কাঠের বাট তুলে ছুটন্ত রিকের চোয়ালে বেদম জোরে গুতো দিল ও।
রিকের মনে হলো চোয়ালে বয়ে গেল হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ। কিন্তু তরুণ বয়সে এর চেয়েও বেশি ব্যথা সহ্য করেছে সে। জনের হাত থেকে ছো দিয়ে বন্দুক নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। চোখের কোণে দেখল, পোড়া লোগানের লাশ টপকে আসছে কালো লোকটা। তাক করছে রাইফেল। কিন্তু গুলি করতে পারবে না সে। নইলে এক পশলা গুলির বেশ কটা বিঁধবে বন্ধুর গায়ে। কালো লোকটাকে পাত্তা দিল না রিক, ঝড়ের বেগে ঘুষি চালাল জনের মুখে।
নিচু হয়ে পিছিয়ে হাতুড়ির মত ঘুষিটা এড়িয়ে গেল জন। দেহ ঘুরিয়ে কনুইয়ের গুঁতো লাগাল রিকের পাঁজরে।
জাপানি শালার শয়তানি কায়দা, ভাবল দানব। কপাল ভাল সুস্থ হাড়ে পড়েছে ওই মার। নইলে ভাঙা হাড় ঢুকত ফুসফুঁসে। বলতে গেলে ব্যথাই পায়নি সে। প্রচণ্ড জোরে কনুই নামাল খাটো লোকটার মাথার তালুর ওপর।
গুঙিয়ে উঠলেও রিকের কোমর জড়িয়ে ধরল জন। বন্ধুর মহাবিপদে ছুটে এল বাড। রাইফেল তুলেছে গদার মত করে।
কুঁজো হয়ে জনকে জড়িয়ে ধরে ওপরে তুলে বাডের দিকে ঘোরাল রিক। কিন্তু আগেই তার কাঁধে নেমেছে অ্যাসল্ট রাইফেলের বাঁট। যন্ত্রণা পাত্তা না দিয়ে জনকে ক্রিকেট ব্যাটের মত ব্যবহার করে বাড়কে ছিটকে ফেলল রিক। দুহাতে তুলল জনকে, পরক্ষণে গায়ের জোরে আছাড় দিল জমিতে। ভেবেছিল পাথরে লেগে চুরমার হবে জাপানির খুলি। কিন্তু দানবের মতলব বুঝে শেষ মুহূর্তে মাটির দিকে কাঁধ ঘুরিয়ে নিয়েছে জন, ফলে এড়িয়ে গেছে প্রচণ্ড পতন। সাধারণ কেউ চিরকালের জন্যে পঙ্গু হতো, কিন্তু ওর সারাশরীরে বেতের মত পেশি। জুডোর কায়দায় ফল ব্রেক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল। তবে বুঝে গেল, দানবের কাছে ও নিজে প্রায় শিশুর মতই অসহায়।
হাত থেকে জনকে পুরোপুরি ছাড়েনি রিক, দুই কদম সামনে এগিয়ে অবিশ্বাস্য শক্তি ব্যয় করে আবারও তুলে নিল মাথার ওপরে। পরের আছাড়ে শেষ করবে খেলা। মাথা নিচু, পা আকাশে, ব্যথায় প্রায় অবশ জন, পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়লে চুরমার হবে খুলি।
জাপানির শরীরের ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েও খুব দ্রুত সামলে নিয়েছে কালো লোকটা, দেখল রিক।
দানবের খপ্পর থেকে জনকে ছোটাতে চাইলে হাত থেকে ফেলতে হবে রাইফেল। তাই করল বাড। পরপর কটা ঘুষি বসিয়ে দিল রিকের নাকে-মুখে। বেশিরভাগ পেশাদার মুষ্টিযোদ্ধা লজ্জা পাবে ওর হাতের দ্রুতগতি দেখে। তৃতীয় ঘুষিতে ঠাস্ করে ফাটল রিকের নিচের চোয়াল। গর্জন ছেড়েই বাডের দিকে ঘুরল দানব। ব্যথায় সরু হয়ে গেছে। চোখ।
সামনে বেড়ে জনকে রিকের দিকে ঠেলল বাড। বন্ধুকে আবারও ব্যবহার করতে দেবে না ব্যাটের মত করে। রিকের দুপায়ের মাঝে ঝুলছে জন, টেনে অণ্ডকোষ ছিঁড়তে চাইল।
কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না রিক। দুহাত থেকে ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে জনকে ফেলল বাডের ওপর। ভীষণ ঠেলা খেয়ে ভাঙা পুতুলের মত হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ল সাহসী দুই লড়াকু। বন্ধুর গা থেকে সরে গড়ান দিয়ে চিত হলো জন। পাশেই বাড। ওরা পড়ে আছে ধুলোর ভেতর।
দুযোদ্ধার পায়ের কাছে থামল রিক। পেছনে আগুনের তীব্র হলকা, দাউদাউ করে জ্বলছে বাড়ি। কর্কশ স্বরে বলল দানব, এবার লাথি মেরে ফাটিয়ে দেব তোদের পেট। নরকে যাবি তোরা!
.
পাশের বাড়িটার কোনা ঘুরে ছুটে গেছে ন্যাশ ময়নিহান। কোনও উদ্দেশ্য আছে তার। একবারও পিছু ফিরে চায়নি। ইচ্ছে করলে অনায়াসেই তাকে গুলি করতে পারত রানা। কিন্তু মাথায় জেদ চেপে গেছে, মুখোমুখি হবে। দেখবে কতবড় সে!
পিছু নিল রানা। ঘুরে চলে গেল বাড়িটার দিকে। পেরোল গবাদি পশুর খামার। বাঁক নিল টিনের ছাউনির দিকে। ময়নিহানের চেয়ে ওর গতি বেশি। দূরে দেখল ছাউনির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল লোকটা।
খালিহাতে আবছা আলোর ওখানে ঢোকার আগে কোমর থেকে ওয়ালথার নিয়ে স্লাইড টানল রানা। ট্রিগারে আঙুল না ছুঁইয়ে তর্জনী রাখল ট্রিগার গার্ডের ওপর। গুলি করবে না বাধ্য না হলে।
জখম হয়েছে ময়নিহানের ডান বাহু। তবে গলা কাটতে পারবে ক্ষুর ব্যবহার করে। আরও সতর্ক হলো রানা। দরজা দিয়ে ঢুকেই সেঁটে গেল পাশের দেয়ালে। পিস্তল হাতে দেখছে চারপাশ।
ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। নাক কুঁচকে গেল পচা রক্তের দুর্গন্ধে। চোখ সয়ে যেতেই দেখল একটু দূরে ছাত থেকে দুলছে লোহার শেকল ও ঝাড়বাতির মত হুক। মৃদু ঠং-ঠুং আওয়াজ তুলছে ওগুলো। ওই যে ছুটন্ত পদশব্দ! তবে কোথাও দেখা গেল না ময়নিহানকে। অবশ্য বেশি দূরে নেই সে। ডানে বেশি দুলছে শেকল। ওদিক দিয়ে গেছে লোকটা। নিঃশব্দে পিছু নিল রানা। নাকে লাগল নাড়িভুড়ি ও পচে যাওয়া মাংসের ভয়ানক কুবাস। মনটা চাইল, ঘুরেই ছাউনি থেকে বেরিয়ে যাবে। তাতে বাঁচবে নাক। ডানে নড়ছে আরও কিছু শেকল। ওদিকে চলল রানা। টিনের দেয়ালের অনেকটা ওপরে সরু জানালা। আলো আসবে বলে নয়, বাতাস চলাচলের জন্যে। ওই পথে ঢুকছে রূপকথার দানবীয় সাপের মত ধূম্রজাল। তাতে পড়ছে রোদের সোনালি আলো।
সামনে কোথাও থেকে এল ধাতব আওয়াজ। খোলা হয়েছে কোনও দরজার ছিটকিনি। পালিয়ে যেতে চাইছে ন্যাশ ময়নিহান। ওদিকে ছুটল রানা।
একটু দূরেই আয়তাকার রুপালি বিশাল ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কোল্ড রুম। ওখানে গিয়ে ঢুকেছে ময়নিহান? লুকাতে চায় রানার কাছ থেকে?
ওয়ালথার হাতে দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা।
ছিটকিনি খোলা।
কান পাতল লোহার বাটে। ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। ভেতরটা বোধহয় ভ্যাকিউম করা সাউণ্ডপ্রুফ রুম। ময়নিহান ওখানে আছে কি না জানতে হলে ঢুকতে হবে রানাকে, এ ছাড়া উপায় নেই।
দরজা খুলতে গেলে ভেতরের প্রেশারের জন্যে রাবারের সিল তুলবে সু ধরনের শব্দ, কিন্তু ঠেলতেই নীরবে সামান্য খুলল কবাট। রানা বুঝে গেল, একটু আগে খোলা হয়েছে এ দরজা, অথবা বিদ্যুৎ নেই রেফ্রিজারেটেড ঘরে। ওর মনে হলো, দুটো ধারণাই ঠিক। টান দিয়ে দরজা খুলে তাকাল ভেতরের অন্ধকারে। হাতে ওয়ালথার। বিপদ এলে গুলি করবে। আবারও নাক কুঁচকে গেল তাজা রক্তের জঘন্য গন্ধে।
অন্ধকার থেকে ছুটে এল কে যেন!
ময়নিহানকে চরম শাস্তি দেবে রানা। ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় ছুটন্ত প্রেতাত্মার মত ছায়া লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল ও। একমুহূর্ত পর বুঝল, ওটা ন্যাশ ময়নিহান নয়। হাত বা পা নেই। মস্ত হুক থেকে ঝুলছে আস্ত একটা লাশের বুক ও পেট। রানা বুঝে গেল, সম্প্রতি এখান থেকে ঘুরে গেছে ময়নিহান। ক্ষুর দিয়ে গলা ফাঁক করেছে হাত-পা কাটা লাশটার।
এসব বুঝতে মাত্র দুসেকেণ্ড ব্যয় করেছে রানা, কিন্তু গভীর ছায়া থেকে ছুটে এল ময়নিহান। ডানহাতে ওর প্রিয় ক্ষুর। কিন্তু ওদিকে মন দিল না রানা। লোকটার বামহাতে কসাইয়ের কাঠের হ্যাণ্ডেলে চকচক করছে স্টিলের তীক্ষ্ণ হুক, দৈর্ঘ্যে অন্তত একফুট। পৈতৃক প্রাণ বাঁচাতে একলাফে ঘর থেকে বেরোল রানা।
দ্যাখ কীভাবে মরবি! ওর মাথা লক্ষ্য করে সাই করে হুক চালাল ময়নিহান।
এবার গর্দান থেকে বলের মত ছিটকে যাবে রানার মাথা। তবে শেষ সময়ে ওয়ালথারের নল দিয়ে খটাং করে হুকটাকে ঠেকিয়ে দিল ও। বুঝে গেছে, পড়েছে সত্যিকারের নরকের পিশাচের খপ্পরে। আবারও মাথা লক্ষ্য করে হুক চালাল ময়নিহান। অন্যহাতে ক্ষুরের টান দিল রানার পেট লক্ষ্য করে।
পিস্তল দিয়ে হুক ঠেকিয়ে দিলেও বিসিআই এজেন্টের জ্যাকেট বা শার্ট ঠেকাতে পারল না ক্ষুরের ফলা! পেট চিরতেই ছিটকে পিছাল রানা। বুঝল, খুব গভীর নয় জখমটা। অন্তত পায়ের কাছে ঝুলছে না নাড়িভুড়ি।
ময়নিহানকে এড়াতে অন্যদিকে সরল রানা। কাঁধে লাগল লোহার শেকল। পিঠে ধুম করে তো দিল স্টিলের স্টক-পেন। বামে এক গজ দূরে শিকের দেয়াল। কোণঠাসা করতে পেরেছে ময়নিহান, এবার খতম করবে ওকে।
বাঁদরকে হার মানিয়ে শিক টপকে হাঁটু সমান গোবরে নেমে পড়ল রানা। লোহার শিকে লেগে কমলা ফুলিঙ্গ তুলল হুক। লোকটার দিকে ওয়ালথার তাক করেও পিছাতে শুরু করেছে রানা। তাতে খেপে গিয়ে শিকের দেয়াল টপকে রানার দিকে চলে এল টপ টেরর। কমুহূর্ত আগে ওখানেই ছিল রানা।
সামনে বেড়ে রানার নাকের কাছে আবার রুপালি ঝিলিক তুলল ময়নিহান। একপাশে সরে লোকটার মাথায় পিস্তলের নল নামাতে চাইল রানা। কিন্তু পিছিয়ে গেছে টপ টেরর। গোবরে রানা পিছলে যেতেই শুনল ময়নিহানের খুশির চিৎকার। হুক তুলে লাফিয়ে এল লোকটা। গেঁথে ফেলবে রানার গলা। আত্মরক্ষা করতে ঝট করে ওয়ালথার তাক করল রানা, কিন্তু ট্রিগার গার্ডে বেধে গেল হুকের ডগা। টান খেয়ে ওর হাত থেকে ছিটকে পড়ল পিস্তলটা।
আগেই উচিত ছিল গুলি করা, হতাশ হয়ে ভাবল রানা। পড়তে গিয়েও সামলে নিয়েছে তাল। ময়নিহান মাথার ওপর তুলেছে হুক, এবার গাঁথবে ওর খুলিতে লোহার তীক্ষ্ণ ডগা। পিছিয়ে মেঝে থেকে কাঁচা গোবর তুলে শত্রুর মুখে ছুঁড়ল রানা। মার খাওয়া নেড়ি কুত্তার মত কেঁউ করে উঠল ময়নিহান। পচা গোবরের গুণে ভীষণ জ্বলে উঠেছে চোখ। সোজা হয়েই গায়ের পুরো জোর খাঁটিয়ে তার পেটে লাথি ঝাড়ল রানা। ছিটকে পিছিয়ে শিকের দেয়ালে পড়ল ময়নিহান। রাগ ও ক্ষোভে গর্জন ছাড়ল খেপা ষাঁড়ের মত। দুহাতে চরকির মত চালাল হুক ও ক্ষুর। তার বাহুর ক্ষত থেকে ছিটকে রানার মুখে পড়ল রক্ত। আবারও দুই অস্ত্র চালাল ময়নিহান। তবে এবার হুক এড়িয়ে তার কাছে পৌঁছে গেল, রানা। ওর বুটের হিল পড়ল ময়নিহানের হাঁটুর বাটিতে। পটা আওয়াজে খুলে গেল মালাইচাকি। প্রচণ্ড ব্যথায় থরথর করে কেঁপে পেছাল লোকটা। সামনে বেড়ে সরাসরি তার নাকে হাতের তালু চালাল রানা। আবছা আলোয় দেখল, প্রায় উল্টে গেছে শত্রুর চোখ। প্রায় অচেতন হলেও আবার হুক চালাল ময়নিহান। মারাত্মকভাবে আহত হবে বুঝেও ডানহাত সামনে বাড়াল রানা। কপাল ভাল, বাহুতে ঠাস্ করে হুকের তীক্ষ্ণ ডগার বদলে নামল মাঝের অংশ। ব্যথা পেলেও বাহু দিয়ে শিকের দেয়ালে হুক চেপে ধরল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে হুক ঠেলল ময়নিহানের বুকে। টলমল করছে লোকটা। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে ভাঙা নাক থেকে। সামনে বেড়ে রক্তঝরা নাকে এবার ঘুষি চালাল রানা। একইসময়ে খপ করে ধরেছে ময়নিহানের ডানহাতের ক্ষুর ধরা মুঠো।
যেন যৌন মিলনে ব্যস্ত, ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে ওরা। আগে কথা বলে উঠল রানা, আর কখনও কাউকে ব্যথা দিতে পারবে না।
আমি… শালা… তোর চেয়ে…
এটা তোমার ভুল ধারণা।
ময়নিহানের জখমি হাতে প্রায় কোনও শক্তিই নেই।
ক্ষুর ধরা হাতটা তুলে সহজেই তার গলায় পোচ বসাল রানা। দ্বিতীয় মুখের মত ফাঁক হলো কণ্ঠনালীর ক্ষত। থরথর করে কাঁপছে শিরা ও ধমনী। পরক্ষণে গলগল করে বেরোল রক্তের স্রোত। উল্টে গেল ন্যাশ ময়নিহানের অক্ষিগোলক। ধড়াস্ করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। টান খেয়ে রানার বাহুর তলা থেকে বেরোল হুক। ছোট একটা ফুটো তৈরি হলো ওর জ্যাকেটে। হুকের ডগা চলে যাওয়ার আগে নিয়ে গেছে পেশির সামান্য মাংস। তাতে আপত্তি নেই রানার।
জবাই করা গরুর মত কবার পা ছুঁড়ে থরথর করে কাঁপল ন্যাশ ময়নিহান, তারপর থেমে গেল। ওদিকে চেয়ে নেই রানা। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। পা বাড়িয়ে দশফুট দূরে পেল গোবরমাখা ওয়ালথার। ওটা পরিষ্কার করল ন্যাশ ময়নিহানের শার্টের কাঁধে। অস্ত্র কাজ করবে, না জ্যাম হবে, বোঝার উপায় নেই। কোমরে ওয়ালথার খুঁজে অন্য কোনও অস্ত্র খুঁজতে লাগল রানা।
তখনই শুনল বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ। থরথর করে কাঁপল কসাইখানার ভিত্তি। হাজারখানেক ঘণ্টির মত জোরালো ঝনঝন আওয়াজ তুলল অসংখ্য শেকল।
কসাইখানার দরজার দিকে পা বাড়াল রানা।
দেখল, বাইরে ওর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রিক বেণ্ডার। তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় না করলে শেষ হবে না এই লড়াই।
.
৪৪.
র্যাঞ্চ হাউস ও পাশের কাঠের বাড়িটা গিলে নিয়েছে লেলিহান লাল আগুন। একটু আগে তৃতীয় বাড়িটা চাটতে শুরু করেছে আগুনের শিখা। ওখানেই আছে ময়নিহানের বিধ্বস্ত কপ্টার ও চুরমার হওয়া গাড়িদুটো। ওই আস্তানার ভেতর রয়েছে প্রচুর ফিউয়েল। মাটি থেকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল তুলে নেবে রিক বেণ্ডার, এমনসময় পারমাণবিক বোমার মত ফাটল ওই বাড়িটা।
দানবটাকে কাঁপিয়ে দিল প্রচণ্ড উত্তাপের দমকা হাওয়া। জোর টান দিয়ে খুলতে চাইল গায়ের পোশাক। রিকের মনে হলো আগুন ধরে গেছে দেহে। প্রাথমিক বিস্ফোরণের ধাক্কা বিদায় নেয়ায় দেখল, এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে। জায়গায় জায়গায় হাত-পায়ের ত্বক পুড়লেও বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে কালো ধোঁয়া। বেদম কাশতে লাগল রিক বেণ্ডার। আর তখনই আকাশ থেকে শিলার মত ঝরঝর করে ঝরল ভাঙাচোরা কাঠের টুকরো। পাশেই পড়ল প্রকাণ্ড কটা জ্বলন্ত খুঁটি ও বরগা। রিক ভাবল, ওপরের কেউ খুলে দিচ্ছে সামনের পথ। ওপরের লোকটা অবশ্য নিক নয়, কারণ ওর ছোটভাই আছে ভয়ঙ্কর কোনও নরকে।
ধোঁয়ায় অন্ধ হলেও দ্বিতীয়বারের মত রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল রিক। যেখানে দেখেছে স্টক, ওখানে হাত দিতেই পেল অস্ত্রটা। অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে আগে কখনও গুলি করেনি, কিন্তু কতই বা কঠিন হবে চালানো? কাজ তো সহজ, তাক করে গুলি করে দেয়া, তাই না?
ভাল করেই মনে আছে কোথায় পড়েছে জাপানি শালা আর কেলেভূত। ওদিকে রাইফেল তাক করেই একরাশ গুলি পাঠাল রিক। কর্কশ খ্যাট-খ্যাট শব্দে হাতে লাফিয়ে উঠছে রাইফেল। কয়েক সেকেণ্ডে খালি হলো ম্যাগাযিন।
গুলির জন্যে বাতাস সরেছে বলে তৈরি হয়েছে ফট-ফট আওয়াজ। নতুন শূন্যতা পূরণ করতে ছুটে এল তপ্ত হাওয়া ও ঘন কালো ধোঁয়া। তবে নিচে দেখা গেল পরিষ্কার। যেখানে গুলি করেছে রিক, এখন ওখানে কেউ নেই!
কুত্তার বাচ্চাগুলো কই? রেগে গেল রিক। তার দশফুট ডানে দেখল জাপানিটাকে। বামে দশফুট দূরে কেলেভূত। দুজনের হাতেই এখন পিস্তল। মাযল সরাসরি তাক করেছে রিকের মাথা লক্ষ্য করে।
গুলি করবি, হারামজাদার বাচ্চারা? গলা ফাটাল রিক। কাপুরুষের বাচ্চা!
না, গুলি করব না, নরম সুরে বলল জন। রিকের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। করলে তো এতক্ষণে নরকে পৌঁছে যেতে। আমরা শুধু তোমাকে ব্যস্ত রেখেছি, যাতে উপস্থিত হতে পারেন মাননীয় অতিথি।
ঘুরে তাকাল রিক।
ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে আপাদমস্তক রক্তে মাখা মাসুদ রানা। পাথরের মত কঠিন ওর চোখ। মণি যেন কালো বরফের টুকরো। হাতে কসাইয়ের বিশাল হুক।
যে-কেউ ওকে দেখে আতঙ্কিত হবে, কিন্তু চওড়া হাসি হাসল রিক বেণ্ডার।
ঠিক আছিস তো, রানা? জানতে চাইল জন।
ভালই আছি, থমথমে চেহারায় বলল রানা।
এত রক্ত কার? জানতে চাইল বাড।
ন্যাশ ময়নিহানের।
শালার এইডস্ থাকলে তুই মরেছিস, বিরস সুরে মন্তব্য করল জন।
ওই বিপদের কথাটা ভেবে ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা।
এবার কাঠের গুঁড়িটাকে গুলি করব? রিক বেণ্ডারকে দেখাল জন।
না। মাথা নাড়ল রানা। আমাদের কিছু ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়া আছে।
বাদামি কুত্তাটা আমার ছোটভাইকে খুন করেছে। হাত থেকে গুলিশূন্য অ্যাসল্ট রাইফেল ফেলে দিল রিক। কড়া চোখে দেখল জন ও বাডকে। যেন ওরা আপত্তি তুললে গায়ে হাত তুলবে অঙ্কের কড়া স্যরের মত। ওর জন্যে প্রতিশোধ নেব।
আরেকটু হলে আমার ভাইয়ের মত দুই বন্ধুকে খুন করতে যাচ্ছিলে, বলল রানা, কাজেই এসো, আমিও নেব প্রতিশোধ।
হাতদুটো তুলে রানাকে ডাকল রিক।
মুখোমুখি হবে, কথা দিয়েছে রানা, কিন্তু এ কথা দেয়নি যে দানবের সঙ্গে লড়বে খালিহাতে। হুক উঁচু করে এগোল ও। ওটার কারণে সমান হয়েছে ওদের দুজনের হাতের দৈর্ঘ্য। ময়নিহান যেভাবে রানাকে গাঁথতে চেয়েছে, সেভাবে রিককে গাঁথার ইচ্ছে নেই ওর। কাছাকাছি পৌঁছে দানবের মাথা লক্ষ্য করে হুক ছুঁড়ল রানা।
মাথা নিচু করল রিক। তার মাথার ওপর দিয়ে গেল হুক। এ-ই চেয়েছে রানা। দানব সোজা হওয়ার আগেই লাফিয়ে উঠল ও। ওর হাঁটু সরাসরি লাগল রিকের মুখে। এমনিতে মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়ত রানা, কিন্তু এতবড় দৈত্যের বিরুদ্ধে কৌশল না খাটালে খুন হবে কয়েক মুহূর্তে। ওর শরীরের পুরো ওজন নিয়ে হাঁটু গিয়ে লেগেছে রিকের চিবুকে। খট্টাস্ শব্দে বন্ধ হয়েছে মুখ। ছিটকে পিছিয়ে গেছে দৈত্য। সে তাল সামলে নেয়ার আগেই সামনে বেড়ে গলা লক্ষ্য করে ঘুষি ছুঁড়ল রানা। দ্বিতীয় ঘুষি লাগল রিকের অণ্ডকোষের ওপর।
শরীর ঘুরিয়ে অন্ধের মত পাল্টা ঘুষি ছুঁড়ল রিক বাতাসে, তবে ওর আওতার বাইরে সরে গেছে রানা। পরক্ষণে সামনে বেড়ে আবারও ঘুষি বসাল দানবের গলায়। ওটা যেন চামড়ার ড্রাম। রিকের উল্টো হাতের চড় পড়ল রানার বুকে। তাতে ওর মনে হলো, ও সামান্য মাছি, চাপড় মেরে ওকে উড়িয়ে দিচ্ছে কিংকং। পিছিয়ে বুক ভরে বাতাস নিল রানা। গোপনাঙ্গের ব্যথায় খুঁড়িয়ে হাঁটলেও চরম খেপে গেছে রিক মার খেয়ে, রেলগাড়ির মত তেড়ে এল সে। পেয়েও গেল রানাকে নাগালে।
রিকের প্রচণ্ড ঘুষি এড়িয়ে গেল রানা। একপাশ থেকে ঘুষি মারল দানবের পাঁজরে। বুঝে গেল, দৈত্যের দেহের ভিতর আছে পুরনো ক্ষত। ব্যথা পাত্তা না দিয়ে ঘুরেই রানার পেট লক্ষ্য করে প্রচণ্ড লাথি ঝাড়ল দানব। ওটা উটের পেছন পায়ের লাথির মত, লাগলে নাড়িভুড়ি ফেটে মরত রানা। শেষমুহূর্তে সরে গেছে ঝট করে। আকাশে উঠছে রিকের বুট। একপাশ থেকে তার উরুর নার্ভ জয়েন্টে পড়ল রানার কনুইয়ের বেমক্কা গুঁতো। গভীরভাবে মাংসে গেঁথেছে চোখা হাড্ডি। টলমল করে পিছিয়ে গেল রিক। আগের চেয়ে বেশি খোঁড়াচ্ছে।
কুত্তার বাচ্চা! দাঁতমুখ খিচাল দানব। চাপড় মেরে কাটাতে চাইল ঊরুর অবশভাব।
গালি খেয়েও খেপল না রানা, সামনে বেড়েই ডানহাতি ঘুষি বসাল রিকের পেটে। পরক্ষণে আবার বামহাতি ঘুষি পাজরে। একহাতে দানবের কনুই আটকে অন্যহাতে ঘুষি মারল তার ঘাড়ে। সাধারণ কেউ ক্যারোটিড সাইনাসে চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ত, কিন্তু ঘাড়ে রিকের চাকা চাকা মাংসের তাল। গলায় ঘুষি মারতে ডানহাত তুলল রানা। কিন্তু হাত বাড়িয়ে দেয়ায় দানবের আঙুলে বেধে গেল ওর জ্যাকেট। পরক্ষণে হ্যাঁচকা টানে ওকে কাছে নিল সে। রাগ ও পরিশ্রমে দানবের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সাদা ফেনা।, নাক-মুখ না কামড়ে দেয় পশুটা, ভাবল রানা। প্রাণের ভয়ে পর পর তিনবার প্রচণ্ড জোরে কপাল ঠুকল তার নাক-মুখে। নিজেই দেখল চোখে অজস্র লাল-নীল নক্ষত্র। তারই ফাঁকে ডানহাতে ঘুষি মারল। রক্তাক্ত ক্ষতে ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠেছে রিক। কিন্তু শক্তি তার ভালুকের মত। রানাকে জাপ্টে ধরে বুকে নিয়ে ভয়ঙ্কর চাপ দিল। ব্যথায় কাতরে উঠবে না ভেবেও ওর কণ্ঠ চিরে বেরোল চাপা গোঙানি। যেন কার ক্রাশারে ভাঙা হচ্ছে ওর পাঁজর! বুঝে গেল, হাড়গোড় ভেঙে ঢুকবে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুঁসে। কানের মধ্যে দপদপ করছে রক্তের স্রোত।
রানা…দূর থেকে এল জনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ।
রানা জানে, ছুটে আসবে বন্ধুরা। তাই চিৎকার করে বলল, না, জন, বাড! এই লড়াইটা আমার আর ওর!
আগে এত ভয়ঙ্কর কারও বিরুদ্ধে লড়েনি রানা। মুখ গুঁজে আছে দানবের বুকে। মুক্ত ডানহাত রয়ে গেছে ওপরে। দেরি না করে মুঠো করে চেপে ধরল শত্রুর শিঙাড়ার সমান নাক। পরক্ষণে গায়ের জোরে ছিঁড়তে চাইল ওটা। ঝরঝর করে ওর হাতে পড়ল উষ্ণ রক্তের স্রোত। বিকট আর্তনাদ ছেড়ে ছিটকে রানাকে ফেলে পিছিয়ে গেল দানব। রানার মুঠোয় এখন তার অর্ধেক ছেঁড়া নাক।
মাটিতে পড়তে গিয়েও সামলে নিয়েছে রানা। কিন্তু হাঁফ ফেলার উপায় নেই।
বাদামি শুয়োরের বাচ্চা… গর্জন ছাড়ল রিক। দৌড়ে এল রকেট গতি তুলে। লাথি বসাতে গেল রানার কোমরে। কিন্তু একপাশে ঝাঁপিয়ে মাটিতে পড়ে শরীর গড়িয়ে দিল রানা। একটু দূরেই বিস্ফোরিত হলো ছাউনির জ্বলন্ত এক বরগা। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ওটা টপকে গেল ও। পেছন পেছন তেড়ে আসছে দানব। থমকে তুলে নিল ধোঁয়া ও আগুন ভরা বরগা। ওটার ওজন দুশ পাউণ্ডের চেয়েও বেশি। ছুঁড়ল অমানুষিক জোরে। লাফিয়ে সরে গেল রানা। বরগা মাটিতে আছড়ে পড়তেই গায়ে এসে লাগল আগুনের ফুলকি। পিছিয়ে গেল রানা। পায়ে পড়েছে এক টুকরো অঙ্গার।
চেঁচিয়ে কী যেন বলছে জন ও বাড।
পা থেকে অঙ্গার ঝেড়ে পাল্টা হাঁক ছাড়ল রানা, গুলি করবি না!
অন্য কারণে সতর্ক করছে ওরা। র্যাঞ্চ হাউসের আগুনের খুব কাছে পৌঁছে গেছে রানা। একই কথা খাটে রিক বেণ্ডারের ক্ষেত্রেও। ওরা দুজনই ভাসছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোতে। দানবের ছেঁড়া নাক থেকে লাল ঝর্নার মত ঝরছে রক্ত। তেড়ে গেল রানাকে লক্ষ্য করে। দুহাত তুলেছে গলা টিপে ধরবে বলে। উঁচু করা দুহাতের তলা দিয়ে তার বুকের কাছে পৌঁছে গেল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে ডানহাতি ঘুষি বসাল রিকের ভাঙা পাঁজরের হাড়ের ওপর। কট্টাস্ করে আওয়াজ শুনল ও। পরমুহূর্তে একটা হাত ধরে গায়ের জোরে হিপ-থ্রো করল দৈত্যকে।
ধড়াস করে মাটিতে পড়ল পাহাড়। করুণ অথচ বিকট চিৎকার ছাড়ল ও। দুহাতে চেপে ধরল বুক। হাঁপাচ্ছে হাপরের মত। হঠাৎ ঠোঁটের কশ বেয়ে নামল রক্ত ও বুদ্বুদ। কর্কশ স্বরে বলল: নিক! নিক! আমাকে মারছে লোকটা! তুই কই! করুণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। বারকয়েক পা নেড়ে থেমে গেল নিথর হয়ে।
আগুনের শো-শো ছাড়া কোনও শব্দ নেই।
ঘুরে তাকাল রানা।
অবিশ্বাস নিয়ে ওকে দেখছে জন ও বাড। পারলি তুই! বিস্মিত কণ্ঠে বলল জন।
এবার লাশ ফেলতে হবে আগুনে, বলল বাড। তা হলে থাকবে না কোনও প্রমাণ।
যুক্তিবাদী কাকে বলে, বলল জন।
ওরা সরে গেল আগুনের হলকা থেকে। দাউদাউ করে জ্বলছে র্যাঞ্চের প্রায় প্রতিটি বাড়ি। রানা দেখল, একটু দূরে আধপোড়া এক লাশ। ওটা লোগান টার্সনের। তার জন্যে কোনও করুণা এল না ওর মনে। বলেছিল খুন করবে না, করেনি। শুধু পথ দেখিয়ে দিয়েছে যেতে হবে কোন পথে।
রিক বেণ্ডারেই শেষ, নাকি আরও কেউ আছে? জানতে চাইল জন।
র্যাঞ্চ হাউসের পেছনে শেষ করেছি একটাকে, বলল বাড। মাঠে আরেকজন। তার রাইফেলটা নিয়েছি।
ছোরা দিয়ে খতম করেছি একজনকে, তা ছাড়া গুলি করেছি শুধু দেয়ালের দিকে, বলল জন।
চওড়া হাসল বাড। তুই দেয়ালের বদলে কাউকে গুলি করলে ভাবছিস লাগাতে পারতি?
কেন আমিই না নরম করলাম বেণ্ডারকে রানার জন্যে? প্রতিবাদ করল জন।
কথা ঠিক, কিন্তু ব্যাটার রক্ত প্রথম বের করল কে? বুক ঠকল বাড।
হালকা সুরে বললেও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উঠে এসেছে ওরা। মরত যে-কোনও সময়ে। এই র্যাঞ্চে এখন রয়েছে বেশকিছু লাশ। কারা মারা গেছে, সরজমিনে দেখল ওরা। আরও ফিউয়েল ঢেলে জড় করে লাশ ফেলল আগুনে। কাজ শেষে দূরের টিউব ওয়েল থেকে পানি তুলে হলো পরিচ্ছন্ন। ময়নিহানের এক কর্মচারীর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল র্যাঞ্চ থেকে। ডালাসে যাওয়ার পথে নদীর সেতু থেকে ফেলল ওদের অস্ত্র। গাড়িটা পুড়ল নির্জন এক পার্কিংলটে। হেঁটে চলল ওরা ডিএফডাব্লিউ এয়ারপোর্টের দিকে।
ন্যাশ ময়নিহান বা তার লোকদের সঙ্গে ওদের সম্পর্ক আছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই। পাহাড়ে নিনার বাড়িতে যারা মারা গেছে, প্রত্যেকে পুড়েছে আগুনে। রেস্টুরেন্টে জাজ, শেরিফ ও সিঁড়িতে লোকটার খুনের জন্যে বোধহয় দায়ী করা হবে রিক বেণ্ডারকে। ধরে নেয়া হবে নিজের ছোটভাইকেও খুন করেছে গ্যারাজে। শুধু তা-ই নয়, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ময়নিহানের র্যাঞ্চের প্রতিটি বাড়ি ও ছাউনিতে। কিন্তু কেউ খুঁজে পাবে না তাকে। ময়নিহান উধাও হওয়ায় ডালাস দখল করতে পাগল হয়ে মারামারি শুরু করবে আণ্ডারওঅর্ল্ডের ক্রিমিনাল দলগুলো।
এসবই ভেবেছে রানা। ওর জানা নেই শুরুতে কজন। ছিল ময়নিহানের সঙ্গে। তবে একজন যে র্যাঞ্চে নেই, তা বুঝে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে ও। জন ও বাডের উদ্দেশে বলল, আমরা ন্যাশ ময়নিহানের হাত থেকে জুডি ও নিনাকে ছুটিয়ে নেয়ার সময় এক মহিলা ছিল। তোরা দেখেছিস তার লাশ?
আমি দেখিনি, বলল বাড।
কাঁধ ঝাঁকাল জন। কাউকে গুলি লাগাতে পারিনি।
পাথরের মত কঠিন হয়ে গেল রানার মুখ। তার মানে, ভুল না হয়ে থাকলে সে গেছে টাম্পায় জুডি আর নিনাকে খুন করতে।
.
৪৫.
মাত্র কিছু দিন হলো টাম্পা শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় খোলা হয়েছে রানা ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। জন ও বাড় ছাড়া অন্য কাউকে এখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি এই শাখার জন্যে। পুরো গুছিয়ে নেয়া হয়নি দুই কামরার অফিস। বাইরের ঘরটায় খা-খা করছে চার সাদা দেয়াল। দরজা দিয়ে ঢুকলেই পনেরো ফুট দূরে মস্ত এক ডেস্ক ও কয়েকটা চেয়ার। বামে আরেকটা দরজা ভেতরের ঘরে যাওয়ার। ওখানেই গত একমাস ধরে বাস করেছে জন হার্বার্ট। প্রায় চৌকির মত সরু খাট, ওয়ার্লোব ছাড়া আসবাবপত্র কিছুই নেই। একপাশে অ্যাটাচড় বাথরুম।
রানার কথায় ভেতরের ওই ঘরে জুডি ও নিনাকে তুলেছে গিল্টি মিয়া ও হারাধন কই। তাতে একবারের জন্যেও আপত্তি তোলেনি মেয়েদুটো। ঘুম ও খাওয়া ছাড়া বাকি সময় গল্প করে কাটিয়ে দিচ্ছে ওরা। আলাপের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে মাসুদ রানা।
আপাতত খাটে কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে নিনা।
রানার কথাই ভাবছে জুডি।
আর যোগাযোগ করল না মানুষটা!
এখনও কি লড়ছে ন্যাশ ময়নিহানের লোকদের বিরুদ্ধে?
হয়তো তা-ই!
অথবা হয়েছে ব্যর্থ।
আহত হয়নি তো?
যদি মরে যায়?
নাহ, তা হতে পারে না!
এ কথা মনে আসতেই দেবে না জুডি!
ময়নিহান বা তার দলের সবাইকে হারিয়ে দেবে রানা।
নিশ্চয়ই পারবে।
ওর মত দায়িত্বশীল কাউকে আগে দেখেনি জুড়ি। এনওয়াইপিডিতে কাজ করে ও নিজে। শক্ত মনের অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে, কিন্তু তাদেরও নেই রানার মত যোগ্যতা। অথচ, মানুষটাকে কঠোর মনে হলেও একটু কাছে যেতে পারলে বোঝা যায়, ফুলের মত নরম একটা মন আছে তার। বন্ধুর জন্যে জান দিতেও দ্বিধা নেই। তার চেয়েও বড় কথা, বদলে চায় না কিছুই। কোনও দিক দিয়েই রানার স্বার্থ খুঁজে পাবে না কেউ। জুডিকে বলেছিল সাহায্য করবে নিনাকে খুঁজে বের করতে। সেজন্যে ভয়ঙ্কর সব শত্রু তৈরি হয়েছে ওর, নিতে হয়েছে বিপদ ও মৃত্যুর ঝুঁকি। একবারের জন্যে বলেনি এ কাজের জন্যে ওর কিছু প্রাপ্য হয় না টাকা, না মন। রানা বলেছে, জুডির বড়ভাই ওর সহযোগী ছিল। কথাটা ঠিক নয়। মাইক ছিল রানার কর্মচারী। কিন্তু বস্ হিসেবে কখনও তাকে কোনও হুকুম দেয়নি রানা। আপন করে নিয়েছিল ভাই বা বন্ধুর মত। এ সংস্থা অন্যসব অফিসের চেয়ে অন্যরকম। সে কারণে কর্মচারীরা যেমন প্রাণ দিতে রাজি থাকে রানার জন্যে, তেমনি রানা নিজেও তাদের জন্যে মরতে প্রস্তুত। অদ্ভুত মানুষ। কখনও কঠোর, কখনও নরম। বেশিরভাগ সময় নীরব। অথচ, ওর কালো দুই চোখে কত কথা, কীসের অবাক করা এক আকর্ষণ। ওর বিলিয়ে দেয়া স্নেহ ও মায়ায় আটকা পড়ে যায় সবাই। যেমন এই গিল্টি মিয়া। রানার প্রিয় কেউ জুডি, তাই দিন রাত বাইরের ঘরে বসে পাহারা দিচ্ছে সে। একটু পর পর আধখাপচা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে কিছু লাগবে কি না। প্রাণ দিতেও রাজি নিনা আর ওর জন্যে। আর হারাধন, লজ্জায় কাতর, চোখে অঢেল শ্রদ্ধা। সে-ও বারবার জিজ্ঞেস করে চা করে দেবে কি না।
সচেতন হয়ে উঠল জুডি। বাইরের ঘরে চাপা স্বরে কথা বলছে কেউ। বিছানা ছেড়ে দরজার পাশে পৌঁছে গেল ও। সামান্য ফাঁক করল কবাট।
বাজারে গেছে বলে ওই ঘরে নেই হারাধন কই। রাজকীয় ডেস্কে বসে আছে, ছোটখাটো মানুষ গিল্টি মিয়া। যাতে জুডি ও নিনার ঘুম না ভাঙে, তাই নিচু গলায় বলল, কাউকে পাবেন না, দিদি। নেই তো কেউ! সবাই কোতায় যেন চলে গেছে!
মহিলার কাঁধে হাতব্যাগ। মুখের একপাশ দেখে কু ডেকে উঠল জুডির মন। যতই মাথায় হ্যাট থাকুক, কোথাও দেখেছে তাকে। দরজা খুলে বাইরের ঘরে বেরিয়ে এল জুডি।
ওকে দেখেই খোলা ব্যাগ থেকে কী যেন বের করছে মহিলা। এবার মনে পড়ল জুডির, মাত্র দুবার ময়নিহানের র্যাঞ্চে দেখেছে তাকে। প্রথমবার আরেকটু হলে ওকে খুন করত সে। তখন ওর প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল ময়নিহান। পরেরবার দেখেছে জিম্মি বিনিময়ের সময়। ঘুরেই ভেতরের ঘরের দিকে ছুটতে চাইল জুডি। ওখানেই আছে ওর পিস্তল।
কিন্তু মহিলার হাতে কুচকুচে কালো অটোমেটিক পিস্তল দেখেই ধমকে উঠল গিল্টি মিয়া: খবদ্দার! নড়েচ তো মরেচ!
ঘুরেই ছোটখাটো মানুষটার দিকে অস্ত্র তাক করল মারি কিটন।
জুডি বুঝে গেল, এবার আর বাঁচবে না ওরা।
ট্রিগার টিপছে মহিলা। মুখে নিষ্প্রাণ হাসি।
সত্যিই গুলি হলো। তবে ঠকা শব্দটা কেমন যেন। মারি কিটনের কপালে উঠেছে আলুর মত বড়সড়ো একটা আব। এমনি সময়ে কোত্থেকে ছুটে এসে পিছন থেকে দড়াম করে ওর মাথায় লাঠির বাড়ি লাগিয়ে দিল হারাধন কই। পরক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল মারি কিটন।
লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে ছুটে এল গিল্টি মিয়া, হাতে জুডির দেখা সবচেয়ে বড় পিস্তল। একবার ওকে দেখে নিয়ে মহিলার দিকে মনোযোগ দিল রানার সহযোগী।
নে, হাত-পাগুনো বেঁদে ফেল্ দিকি, হারু।
সামনে বেড়ে মেঝে থেকে পিস্তল তুলে নিল জুডি। বুঝে গেল, জ্ঞান হারিয়েছে মহিলা। নাক ডাকছে ঘড়ঘড়ঘঘা শব্দে।
এ মরণ-ঘুম ভাঙতে কম করেও দুঘণ্টা, বুজলেন, বউদি? আর মাতার ব্যতায় বলবে দশটা ডিসপ্রিন দাও গো, নইলে গেলুম! রানার সঙ্গে সুন্দরী কাউকে দেখলেই সে মেয়েকে গিল্টি মিয়ার পছন্দ হয়ে যায়, ওর কাছে সে হয়ে ওঠে সম্ভাব্য বউদি। খুঁজে-পেতে মেঝে থেকে মার্বেলটা নিয়ে বুক পকেটে রেখে দিল গিল্টি মিয়া। এতক্ষণে মুখে ফুটল নিষ্পাপ সরল হাসি। বুজলেন, বউদি, স্যরকে বলেছি না, কখোনও ফস্কায় না আমার গুলি!
ভেতরের ঘরে বেজে উঠেছে মোবাইল ফোন। দৌড়ে গিয়ে বিছানা থেকে ওটা নিয়ে কল রিসিভ করল জুডি। হ্যালো, রানা?
জুডি, আছ মস্ত বিপদে, বলল গম্ভীর রানা, ময়নিহানের মহিলা-খুনি গেছে তোমাদেরকে খুন করতে। হাতের কাছে রাখো পিস্তল। …আর গিল্টি মিয়াকে দাও। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে…
গিল্টি মিয়া আর হারাধন অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছে। ওই মহিলাকে, বলল জুডি, কিন্তু বুঝলাম না ওই মার্বেল ভরা পিস্তল পেল কোথা থেকে!
পরে বলব, দীর্ঘ কাহিনী, শ্বাস ফেলল রানা। পুলিশ ডাকতে বলল। খুনিকে তুলে দেবে তাদের হাতে।
কিন্তু, রানা, পুলিশকে এসবে জড়ালে বেরিয়ে আসবে তোমাদের কথা, আপত্তি তুলল জুডি। অন্য কোনও উপায়…
ভেবো না, বলল রানা, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওয়ান্টেড লিস্টে ছিল মারি কিটনের ছবি। চেহারা মনে রেখেছে বাড। পরে তাকে দেখেছে র্যাঞ্চে। তখনই দেরি না করে খোঁজ নিয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে ওই সংস্থার এক এজেন্টকে খুন করেছে মহিলা। একটু আগে বাড যোগাযোগ করেছে তাদের সঙ্গে। পুলিশ তদন্ত করবে না, মহিলাকে মুঠোয় চায় ডিইএ। তাদের এজেন্ট খুনের ব্যাপার ছাড়াও তার পেট থেকে বের করবে আরও বহু কথা। নিজ স্বার্থেই ন্যাশ ময়নিহান বা আমাদের কথা চেপে যাবে সে, নইলে পড়বে মস্ত ঝামেলায়। তা ছাড়া, কোথায় আমাদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রমাণ? পুলিশ বা ডিইএ পাচাতে চাইলে বলে দেব, ছিলাম পেনস্যাকোলার পুবে রুপালি সাগর-সৈকতে এক বিচ হাউসে। অন্য কিছু প্রমাণ করুক পারলে। …এবার ফোনটা গিল্টি মিয়ার হাতে দাও।
জুডির কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে কানে ঠেকাল গিল্টি মিয়া। ইয়েস, স্যর, সবাই বেঁচে আছি। ভাববেন না। একোন আর ঘুম ভাঙবে না দুষ্টু মেয়েটার। তবে বুজতে পারছি না একটা কতা। কপালে ঠাস্ করে দিয়েছি বলে এটা কী কাজ করচে! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকচে আর ছ্যার ছ্যার করে মেজে ভাসিয়ে মুতে… ছিহ, এভাবে ইয়ে করে ভাল মেয়েরা? এতক্ষণে ওর খেয়াল হলো স্যরের সঙ্গে এসব বলা ঠিক হচ্ছে না। জিভ কেটে বলল, থুক্কু! কিচু মনে নেবেন না, স্যর।
হাসি চাপতে খুকখুক করে কাশল রানা। গিল্টি মিয়া, পুলিশ ডেকে তাদের হাতে ওকে তুলে দাও। কর্তৃপক্ষ বিদায় নিলে দেরি না করে সবাইকে নিয়ে চলে যাবে দুই নম্বর সেফহাউসে।
জী, স্যর, আপনি হলেন গিয়ে ফেরেস্তা মানুষ, ধরে নিন, ওভেনে পৌঁছে গেছি, আপনার কতা কি ফেলতে পারি? আপনি হলেন গিয়ে…
আবার! রানার ধমক খেয়ে জিভ কাটল ও।
সমযদার রানা বুঝে গেছে, অনেক কথা আছে গিল্টি মিয়ার পেটে, কিন্তু কাজের কথা আর একটাও নেই। সময় নষ্ট না করে কল কেটে দিল ও।
.
৪৬.
সামনেই ফ্লোরিডার উন্মুক্ত সুনীল উপসাগর।
জায়গাটা পেনস্যাকোলার পুবে।
রুপালি সাগর-সৈকতের অর্ধচন্দ্রের মত বাঁক ঘুরে বহু দূরে গেছে সবুজ, গভীর অরণ্য। কিছুক্ষণ হলো জ্বরের ঘোরে মাসুদ রানা দেখছে, সৈকত ধরে হেঁটে আসছে দারুণ রূপসী এক মেয়ে। সামান্য কাত হয়ে শুয়ে তৃতীয়বারের মত তাকাল রানা।
গোবি মরুভূমির মত গলা শুকিয়ে গেল ওর। ভাবছে: সত্যিই টাইম মেশিনে চেপে পিছিয়ে গেছি নাকি? আবারও সব শুরু হবে প্রথম থেকে? নাহ্, এটা বোধহয় আর কেউ। সত্যিই কি ওই অপ্সরার গন্তব্য ওর ভাড়া করা নির্জন, ছোট্ট বিচ হাউস?
আরে! সত্যিই তো মেয়েটা জুডি!
চোখ পিটপিট করে চতুর্থবারের মত তাকাল রানা।
না, এটা কোনও দৃষ্টিভ্রম নয়!
এইমাত্র বালিতে হোঁচট খেয়েছে দেবী! বিড়বিড় করে কী যেন বলল, কিন্তু সাগরের শোঁ-শোঁ আওয়াজ ও ঝিরঝিরে হাওয়ায় চাপা পড়ল ওর কথা। উঠে এল রানার সান ডেকে। বসে পড়ল পাশে। রানা কিছু বলার আগেই হাত রাখল ওর কপালে। পরক্ষণে বলল, এহূহে, জন হার্বার্ট দেখি ঠিকই বলেছেন। তুমি কেমন ধাঁচের লোক, রানা? ডাক্তার না দেখিয়ে এত জ্বর নিয়ে পড়ে আছ জঙ্গলের মধ্যে?
জ্বর কমে গেছে, আত্মরক্ষা করতে চাইল রানা।
নাক ফোলাল জুডি। কচু! ভেতরের ঘরে চলো। শুয়ে পড়বে খাটে।
তারপর কী করব? আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল রানা।
জ্বর কমলে… চোখ টিপল জুডি।
যাক বাবা, প্রথম থেকে শুরু হয়নি সব। টাইম মেশিনে চেপে ফিরতে হবে না ওকে লিটল ফোর্কে! ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল রানা। ওর কোমর জড়িয়ে ধরে কেবিনে ঢুকল জুডি।
দুজনই বুঝে গেছে, রানার ফুরিয়ে আসা ছুটির শেষ এই তিনটে দিন ওরা ঘুরে আসবে স্বর্গের চেয়েও ভাল কোথাও থেকে!
<