২১.

কিচেনের কাউন্টারে ম্যাগনাম রিভলভারটা পেয়ে খুশি হয়ে উঠল রিক বেণ্ডার। বেরিয়ে এল ভিলাজ-ও-সঁওর পেছনের দরজা খুলে। তুষার ঝড়ের মাঝে দেখল ফুটপাথে একজোড়া পদচিহ্ন, সোজা গেছে দূরে। আগের চেয়েও বেশি পড়ছে তুষার। প্রায় চোখেই পড়ছে না পায়ের আবছা চিহ্ন। তবে খুব এগিয়ে নেই ওগুলোর মালিক। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না রিক। জানা আছে কোথায় যাবে মাসুদ রানা। তার পিছু না নিয়ে সোজা ফিরল রিক ওদের ওঅর্কশপে।

আগের মতই মেঝেতে পড়ে আছে ছোটর লাশ। জমাট বেঁধেছে থকথকে রক্ত। শেরিফ ম্যাকলাস্কি আর জাজ হোল্ডকে খুন করেছে বলে এখন একটু আফসোসই হলো রিকের। রাগ আর পেটের উইস্কি বাধ্য করেছে অযৌক্তিক আচরণ করতে। তবে এ-ও ঠিক, এখন আর ওকে বাধা দেয়ার কেউ রইল না। এবার নেবে প্রতিশোধ গলা থেকে ছিঁড়ে নেবে মাসুদ রানার মাথাটা।

আবারও ছোটভাইকে দেখল রিক। এক পা ভাঁজ করে পড়ে আছে লাশ। ফার্স্ট এইড রিকভারি পযিশনে শুয়ে এখনই যেন হাত নেড়ে বাই-বাই দেবে। তবে রোগী নয়, আর কখনও সুস্থ হবে না নিক। পিঠের গর্ত দুটোয় অনায়াসেই ডানমুঠো ভরতে পারবে রিক।

ঝুঁকে ছোটভাইয়ের গাল স্পর্শ করল ও। রিগার মর্টিসে শক্ত হচ্ছে ঠাণ্ডা লাশ। সময় নিয়ে ওঅর্কশপ থেকে নিজের আঙুলের ছাপ মুছল রিক। কাজ শেষে ফিরল ভাইয়ের পাশে। আস্তে করে নিজের দিকে ফেরাল নিকের মুখ। গলে গেছে। লাশের ফ্যাকাসে নীল মণিটা।

হাসি না এলেও কর্কশ হাসল রিক। ভেবো না, চোখ নেই বলে বরং দেখতে ভালই লাগছে! বড় করে দম নিল সে। ছোটর চোখের পাতা টেনে বুজিয়ে দিল রক্তাক্ত গর্তটা।

উঠে আবারও তাকাল লাশের দিকে। বিড়বিড় করল, ছোট, যে কুত্তীর বাচ্চা এটা করেছে, খুনের আগে এমন অবস্থা করব তার, মেরে ফেলার জন্যে পায়ে ধরবে।

ঘুরে এসইউভিতে চাপল রিক। ভেতরে রক্ত, মগজ ও মাংসের আঁশটে দুর্গন্ধ। বরফঠাণ্ডা পরিবেশও এরচেয়ে ভাল, খুলে দিল সব জানালা। এসইউভি নিয়ে গলিতে থামল সে। ওঅর্কশপের দরজা টেনে আটকে দিল প্যাডলক। রানাকে খুন করে এসে ছোটভাইয়ের শেষকৃত্য সারবে রিক। আপাতত থাকুক সে ওই সমাধির মত বদ্ধ জায়গায়।

সোজা এয়ারপোর্টে এলেও ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকল না রিক। এমন জায়গায় রাখল এসইউভি, যেখান থেকে দেখা যায় ভেতরটা। যাত্রীরা দরজা দিয়ে বেরোলে পরিষ্কার দেখবে। হাতে ম্যাগনাম রিভলভার। পাশের সিটে নিকের মসবার্গ পারসুয়েডর শটগান। অবশ্য বাধ্য না হলে অস্ত্র ব্যবহার করবে না রিক। প্রথম সুযোগে নিজ হাতে খুন করবে মাসুদ রানাকে। তবে সে পালিয়ে যেতে চাইলে ফুটো করবে, চুরমার করে দেবে দুই হাঁটুর বাটি। কাঁধ থেকে ছিঁড়ে নেবে আস্ত মাথাটা। পেট ফেড়ে ওটা খুঁজে দেবে পেটের মধ্যে।

বেড়েছে তুষারপাত। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কাঁচের ওদিকে মাসুদ রানাকে। বসেছে দালানের দূর কোণের সিটে। হাতে কাগজের কাপে কফি। কখন যেন পাল্টে নিয়েছে পোশাক। না পাল্টে উপায় ছিল না, আগেরটা ছিল নিকের রক্তে ভেজা।

লোকটা একবার বেরিয়ে দেখুক!

কিন্তু টার্মিনাল ছেড়ে বেরোল না মাসুদ রানা। অন্তত এক শবার এসইউভি থেকে নামল রিক। এয়ারপোর্টে ঢুকে কোণঠাসা করতে পারবে হারামজাদাটাকে, কিন্তু বারবার চিন্তাটা মাথায় এলেও নিয়ন্ত্রণ করল নিজেকে। মদ ভরা মগজে মনে হলো টগবগ করে ফুটছে শিরার ভেতর আগুনের মত গরম রক্ত। প্রতিজ্ঞা করেছে: ওই লোকটাকে খুন করবে সে ঠাণ্ডা মাথায়।

রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরোবার সময় ভারী ওভারকোট পরে নিয়েছে রিক। তবুও ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে। এসইউভিতে ঢুকছে। বরফশীতল হাওয়া। সঙ্গে তুষারের বড্ড ঠাণ্ডা কণা। মন চাইলেও জানালা বন্ধ করল না রিক। নাকে আসছে কাঁচা মগজের বিশ্রী দুর্গন্ধ। নিজের রোমকূপ থেকেও এল মদের কুবাস। তবে মাথা ঠাণ্ডা করছে হিমশীত।

একটু পর থামল তুষারপাত।

কিছুক্ষণ পর রানওয়েতে দেখা গেল ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এয়ারপোর্ট কর্মীরা। শক্তিশালী হিটার ও কোদাল লাগানো ট্রাক সরিয়ে দিচ্ছে ভারী তুষার। ভেণ্ডার মেশিনের কাছে মাঝে মাঝে যাওয়া ছাড়া আর কোনওদিকে যায়নি মাসুদ রানা। নিজে পাথরের মূর্তি রিক, জায়গা থেকে নড়েনি। থরথর করে কাঁপছে শীতে। দেখল সিট ছেড়ে রাখস্যাক কাঁধে তুলল রানা। পেরোল ডিপারচার ডোর। আবারও এসইউভি থেকে নামল রিক। কোটের পকেটে ম্যাগনাম। সিটেই থাকল মসবার্গ শটগান। দুমিনিট পেরোবার আগেই বুকিং ডেস্কে পৌঁছে গেল রিক।

একটু পর ফ্লাইট আছে, জানাল টিকেট বিক্রেতা। সাহস নেই রিকের চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। দানবের মত লোকটার গা থেকে ভুসভুস করে বেরোচ্ছে বিশ্রী বাজে গন্ধ। কমপিউটারের কিবোর্ডে টোকা দিয়ে বলল সে, খালি আছে কয়েকটা সিট। আপনি চাইলে একটা সিট বুক করতে পারি।

কতক্ষণ পর পরের ফ্লাইট? জানতে চাইল রিক।

দুঘণ্টা পর, স্যর, চোখে চোখ তুলেও চট করে অন্য দিকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল কর্মচারী। যদি তুষার বন্ধ থাকে।

আমাকে পরেরটার টিকেট দাও, জানাল রিক। প্যান্টের পকেট থেকে ডলারের বাণ্ডিল নিয়ে টিকেটের মূল্য পরিশোধ করল সে। ওখান থেকে সরে গেল রেস্টরুমে। আয়নায় নিজেকে দেখে বুঝল, কেন আড়চোখে দেখছিল টিকেট বিক্রেতা। ওর গায়ে ধুলোবালি ও কাঁচের টুকরো। ভাল করে ধুয়ে নিল চুল ও মুখ। বেসিনে দুহাত রেখে অনেকক্ষণ নিজেকে দেখল আয়নায়। একসময়ে স্বাভাবিক হলো লালচে দুই চোখ। ক্ষণিকের জন্যে কাকে যেন দেখল আয়নায়। ওই লোকের একটা চোখের মণি বাদামি, অন্যটা ফ্যাকাসে নীল।

হাজির হয়েছে নিকের প্রেতাত্মা। রিক যখন দুহাতে গলা থেকে ছিঁড়ে দেবে মাসুদ রানার মাথা, তখনও সঙ্গে থাকবে সে।

.

২২.

আর্লিংটনের একটু দূরে ছোট এক মোটেলে উঠেছে রানা। দরজায় টোকার আওয়াজে বলল, একমিনিট!

বিছানায় বসে আছে ও, পাশে ওয়ালথার পি.পি.কে.। উঠে গিয়ে পিপহেল দিয়ে দেখল বাইরেটা।

দুই বেণ্ডার ভাইকে না দেখলে কেউ কেউ বলতে পারে, পৃথিবীর প্রকাণ্ডদেহীদের দুজন জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। জন অর্ধেক জাপানি, বাবার দিক থেকে আমেরিকান। দৈর্ঘ্যে সাড়ে ছয় ফুট।

তার চেয়েও তিন ইঞ্চি উঁচু কালো-মানিক বাড।

জন সুঠাম ও দুর্দান্ত হ্যাণ্ডসাম।

আর বাড যেন তরুণ মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর যমজ। ওকে চালিয়ে দেয়া যাবে তার আপন ভাই হিসেবে।

ওদের দুজনের পরনে টি-শার্ট, ডেনিম জ্যাকেট ও জিন্স প্যান্ট। বাডের কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ।

দরজা খুলে রানা সরতেই ভেতরে ঢুকল জন ও বাড। তার আগে দেখে নিয়েছে করিডোরের দুপাশ। ঘুরে এসেছে চারপাশ থেকে। আপাতত বিপদের সম্ভাবনা নেই।

দেখা হওয়ার পর বরাবরের মত রানাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি দুবন্ধু। দরুজা বন্ধ করে ঘুরতেই ওকে জড়িয়ে ধরল বাড। তাতে প্রকাশ পেল আন্তরিকতা। রানা আলিঙ্গন মুক্ত হতেই ওকে জাপ্টে ধরল জন। রানা ভাবল, মরেছি আজ ভালুকদুটোর মৃত্যু-আলিঙ্গনে! মনে পড়ল রিক বেণ্ডারের লাথি পড়েছে পাঁজরে। আপত্তি তুলল ও, ছাড়-ছাড়, খুন করবি নাকি!

ব্যথা দিয়ে ফেলেছি? কোথায় লেগেছে? লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে গেল জন। সরু কাঠবাদামের মত চোখে দুশ্চিন্তা।

তেমন কিছু না, বলল রানা। তবে লাথ মেরে, আমার বুক আর পিঠ এক করে দিতে চেয়েছিল।

বলিস কী!

বাদ দে, চেয়ারে বসল রানা। বিছানায় বসেছে জন ও বাড। তোরা না বললি ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছিস?

কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ওটা থেকে আসুস বি ৮৪৩ ইউএ সিক্সথ জেন কোর ল্যাপটপ বের করল বাড হিগিন্স। দেয়ালের সকেটে আটকে নিল কেবল। এ মোটেলটাকে রানার বেছে নেয়ার বড় একটি কারণ; প্রতিটি ঘরে রয়েছে ইন্টারনেট সার্ভিস। একটু পর কিবোর্ডে ঝড় তৈরি করল বাড়। মিনিটখানেক পর স্ক্রিন ঘুরিয়ে দিল রানার দিকে।

উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ন্যাশ ময়নিহান, আমাদের প্রিয় মাল্টি মিলিয়োনেয়ার, জানাল জন।

ময়নিহান সুদর্শন লোক। গায়ের রং রোদে পোড়া ব্রোঞ্জের মত। সুঠামদেহী। চুল ছোট করে ছাটা। জায়গায় জায়গায় ধূসরের ছোঁয়া। পরনে দামি পোশাক। নীল নেভি স্যুট, সাদা শার্ট, হালকা লাল টাই। যে-কেউ বলবে ভদ্রলোক। ছবিতে হাসছে সে। কিন্তু ওই হাসির ছোঁয়া নেই শীতল চোখে। ও-দুটোয় আক্রমণে প্রস্তুত হাঙরের নির্বিকার দৃষ্টি।

স্ক্রিনে আরেকটা ছবি আনল বাড।

কমবয়সী ময়নিহানের ছবি। চুল কুচকুচে কালো। চোখে একই দৃষ্টি। পরনে কমলা রঙের জাম্পস্যুট। নামের নিচে কয়েকটি সংখ্যা।

জেল খেটেছে, বলল বাড, ইউএস হাইওয়ে ৭৫ ধরে গেলেই চোখে পড়বে ফেডারাল প্রিযন সিগোভিল। ডালাস থেকে দক্ষিণ-পুবে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

মিনিমাম সিকিউরিটি, বলল জন, ময়নিহান ছিল মাত্র কিছু দিনের জন্যে। সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়নি।

কী কারণে জেল হয়? জানতে চাইল রানা।

গলা কেটেছিল এক লোকের,বলল বাড।

অথচ রাখা হলো মিনিমাম সিকিউরিটি প্রিযনে?

গুরুত্বপূর্ণ রাজসাক্ষী, বলল বাড, তলিয়ে দিয়েছে তার মালিকদের, সঙ্গে তাদের টেক্সাস সিণ্ডিকেট। খুনি ফিলিক্স ভাইদের জেলের ব্যবস্থা করেছে বলে তার খুনের অভিযোগ হালকাভাবে বিচার করে আদালত। নিরাপদে আরাম করে পার করেছে তিনটে বছর।

বেঈমানদেরকে পছন্দ করে না কেউ, বেরোবার পরে বাঁচল কীভাবে? জানতে চাইল রানা।

ক্ষুরওয়ালা জল্লাদকে সবাই ভয় পায়, বলল বাড।

জল্লাদের মতই নির্বিকারভাবে গলা কাটে, বলল জন। সে ছিল টেক্সাস সিণ্ডিকেটের টপ টেরর। ওর মালিকরাও ওর সামনে সামলে রাখত মুখ। ঠাণ্ডা মাথার খুনি। চারপাশের সবাই নাম দিয়েছে: ক্ষুরধার। টেক্সাসে এমন কোনও রঙবাজ নেই যে টক্কর দেবে তার সঙ্গে।

তা ছাড়া, আগেই চারপাশে ছিল হাত, বলল জন, ফিলিক্সদেরকে সরাবার পরিকল্পনা হয়েছিল বহু আগেই। সেটা করে ডিইএ। সঠিক সময়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে টেক্সাস সিণ্ডিকেটের বড় নেতাদের। আর তাদের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে ক্ষুরধার ন্যাশ ময়নিহানকে।

কিন্তু অপরাধী জগতে শূন্যতা তৈরি হলে চট করে পূরণ করে অন্য অপরাধীরা, বলল রানা। এক্ষেত্রে তেমন হলো না কেন? তিন বছর জেলে ছিল ময়নিহান।

গুড পয়েন্ট, রানা, বলল বাড, কিন্তু ন্যাশ ময়নিহান এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দূরে থাকল অন্যান্য সিণ্ডিকেট।. হাসতে হাসতে এসে ডালাস দখল করে নিল লোকটা।

বেশিদিন লাগল না অন্যান্য সিণ্ডিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিতে, বলল জন। কেউ কেউ বলতে লাগল, লোভী ফিলিক্সদেরকে শেষ করে কাজের কাজই করেছে ময়নিহান।

তার মানে ফিলিক্সদের জুতো পরে ঘুরতে লাগল সে? জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল বাড। ঠিক তা নয়। ডিইএর লোকের সঙ্গে লড়ে মরতে আপত্তি আছে সিণ্ডিকেটের হেডদের। ডালাসকে এড়িয়ে গেল তারা। এদিকে ময়নিহান তিন বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে দেখল, ড্রাগ ও পতিতালয় দখল করতে কামড়াকামড়ি করছে রাস্তার মস্তানরা। এতটা নিচে নাক গলাল না ময়নিহান। মন দিল রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায়। হুড়মুড় করে আসতে লাগল কোটি কোটি ডলার। তুই তো দেখেছিস, রানা, গপ করে গিলে নিয়েছিল লিটল ফোর্ক শহর। ওই ধরনের প্রজেক্টে তার পার্টনার হিসেবে আছে শক্তিশালী কয়েকটা সিণ্ডিকেট।

লিটল ফোর্কের মত আরও প্রজেক্ট আছে তার? জানতে চাইল রানা।

বেশ কয়েকটা, বলল জন।

লোকবলের অভাব নেই, বলল বাড। অসংখ্য বেণ্ডার বা ম্যাকলাস্কি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

তবে আমাদের ক্ষেত্রে তাদেরকে কাজে লাগাবে না সে, বলল জন, ফিলিক্সদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে বলে ময়নিহানের কাছে কৃতজ্ঞ অন্যান্য সিণ্ডিকেটের হেডম্যানরা। বিপদ এখানেই। ন্যাশ ময়নিহান সাহায্য চাইলে তাদের সেরা খুনিকে পাঠাবে তারা। ধরে নিতে পারিস, এ দেশের টপ টেররদের বিরুদ্ধে লড়ব আমরা।

আসুক, বলল বাড, নিজ এলাকার বাইরে সুবিধে করতে পারে না বেশিরভাগ খুনি।

তা ছাড়া, দেশের প্রতিটা সিণ্ডিকেট থেকে সেরা খুনি আসবে, তা না-ও হতে পারে, বলল রানা, নিজেদের ভেতর থাকবে তাদের প্রতিযোগিতা। আমাদেরকে খোঁজার চেয়ে নিজেরা লড়বে বেশি।

কিন্তু জীবন শেষ করতে একটা বুলেটই যথেষ্ট, মনে করিয়ে দিল জন।

কথা ঠিক, নড়েচড়ে বসল বাড।

মাত্র একজন খুনি পাঠাবে বলেনি ন্যাশ ময়নিহান, ভাবছে রানা। তারা হবে কজন, তা দেখা যাবে ভবিষ্যতে। আপাতত ওই বিষয়ে ভেবে লাভ নেই। যাই করুক, পালিয়ে যাবে না বা লুকিয়ে পড়বে না ওরা।

আমরা গুরুত্ব দেব ময়নিহানকে, মন্তব্য করল জন। হয়তো তাকে বাগে পেতে কষ্ট হবে। শুনেছি, ক্ষুর দিয়ে মানুষের গলা কাটতে ওস্তাদ সে। তেমনি জীবিত শত্রুর মুখ থেকেও ছাড়িয়ে নেয় চামড়া। ওর চেয়ে নিষ্ঠুর লোক নাকি নেই ডালাসে।

ক্রাইম সিণ্ডিকেটের হওয়া কঠিন, বলল বাড, বদনামটা এমনি এমনি হয়নি।

নিনা ভেঞ্চুরার মেসেজ পেলি? জানতে চাইল জন।

 মাথা নাড়ল রানা।

নম্বর দে, দেখি জানা যায় কি না ওই ফোন এখন কোথায়, বলল বাড।

ওর হাতে ফোনটা দিল রানা। মনে হয় না এতে কাজ হবে। নিশ্চয়ই একই চেষ্টা করে দেখেছে ময়নিহান।

হাসল বাড। কিন্তু সে কোথায় পাবে আমার কন্ট্যাক্ট? নম্বর মুখস্থ করে রানার কাছে ফেরত দিল ফোন। ওটা কাছে রাখিস। ফোন করতে পারে মেয়েটা।

জ্যাকেটের পকেটে মোবাইল ফোন রেখে বলল রানা, আরেকটা কল পাব ভাবছি।

ন্যাশ ময়নিহান? জানতে চাইল জন।

জুডির ফোন। যোগাযোগ করবে সে। ওর, জানার কথা এই ফোন এখন আমার কাছে।

তা হলে ওটা সরিয়ে ফেলাই ভাল, বলল জন। একটু চেষ্টা করলেই আমাদের লোকেট করতে পারবে।

হয়তো বাডের মত কন্ট্যাক্ট নেই তার, বলল রানা।

তা বলিনি, আপত্তি তুলল বাড, বলতে চেয়েছি, অ্যাকটিভ ফোন খুঁজে বের করা সহজ। তবে নিনার ক্ষেত্রে ওই ফোন খুঁজতে হলে সাহায্য নিতে হবে ওর সার্ভিস প্রোভাইডারের। অতটা ওপর লেভেলে হয়তো লোক নেই ময়নিহানের।

অত চিন্তা করিস না, জন, বলল রানা। ময়নিহান আমাকে খুঁজে বের করার আগে নিজেই আমি পৌঁছে যাব তার কাছে।

যদি এ এলাকায় থাকে, বলল জন।

ডালাসেই আছে, বলল রানা, নিজ আঙিনায় নিজেকে নিরাপদ ভাবছে।

কঠিন হবে না খুঁজে নেয়া, বলল বাড। একবার পাবলিক রেকর্ডস্ সার্চ করলেই পাব। রেজিস্ট্রি অফিসে গেলেই জানব কোথায় কী আছে তার।

অথবা পাবি ফোন বুকে। বিছানার পাশের টেবিল থেকে ইয়েলো পেজের বইটা নিল রানা। ধপ করে ফেলল বাডের কোলে। ন্যাশ ময়নিহান বড় ব্যবসায়ী। এই বইয়ে তার নাম-ঠিকানা থাকবে না, তা হতেই পারে না।

মৃদু হাসল বাড। কমপিউটার বন্ধ করে মন দিল টেলিফোন ডিরেক্টরিতে।

কখনও কখনও পুরনো উপায় ভাল, মন্তব্য করল রানা।

.

২৩.

 লিটল ফোর্ক থেকে যোগাযোগ করেছে দলের লোক, তাতে চমকে গেছে ন্যাশ ময়নিহান। রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল রানা। চুরমার করেছে ওটা। ভেতরে যারা ছিল, বাঁচতে পারেনি কেউ। খতম হয়েছে ময়নিহানের স্যাঙাৎ হেনরি রাইডার। লাশ হয়েছে জাজ হোল্ড। বেঁচে নেই শেরিফ ম্যাকলাস্কি। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রিক বেণ্ডারকে। ধরে নেয়া যায় বেঁচে নেই সে-ও। এমন কেউ নেই, সামলাবে ঝামেলা। লিটল ফোর্কে গিজগিজ করছে স্টেট ট্রুপার ও ফ্র্যাঙ্কফোর্টের অফিস থেকে আসা এফবিআই ফিল্ড এজেন্টরা।

তাড়া খাওয়ার আগেই ফিরছে পেশাদার খুনিরা।

 যা ভেবেছি, তার চেয়ে দেখছি অনেক বিপজ্জনক লোক এই মাসুদ রানা, বলল ময়নিহান, জরুরি ভিত্তিতে খুন করতে হবে ওকে। ফোন রেখে জুডিকে দেখল সে। মাসুদ রানা এখন কোথায়? তার সম্পর্কে কতটা জানো?

জুডির হাতে হ্যাণ্ডকাফ না থাকলেও এখনও সে বন্দি। বসে আছে চেয়ারে। ওর: ওপর চোখ রাখছে দুজন খুনি। হাত হোলস্টারের কাছে। জুডি এরই ভেতর বুঝে গেছে, অনুমতি না নিয়ে চেয়ার ছাড়তে পারবে না। টয়লেটে গেলেও সঙ্গে থাকছে একজন। দেয়া হচ্ছে খাবার ও পানি, তবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের সব গ্লাস, বাসন, চামচ। 

তার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না, বলল জুডি।

হাতদুটো পিঠে বেঁধে ওর সামনে থামল ময়নিহান। রিক বেণ্ডারের মত করে ভয় দেখাতে চাইছে না। ঠোঁটে ফুটল দয়ালু হাসি। তাতে তাকে আরও ভয়ঙ্কর লাগল জুডির।

যতটুকু জানতে পেরেছ, তা জানাও, বলল ময়নিহান।

এটা জানি, মস্তবড় বিপদে পড়েছ। যেসব অপরাধ করেছ, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে পুলিশ অফিসারকে কিডন্যাপ করা। আগ্রহী হয়ে উঠবে এফবিআই। ফলে জীবনের বাকি দিন পার করবে জেলখানায়।

মৃদু হাসল ময়নিহান। সামনে আনতেই দেখা গেল তার ডানহাতে ক্ষুর। চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে গেল জুডি।

হয়তো আর কখনও তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, অফিসার ব্ল্যাকউড। হাসিটা চওড়া হলো ময়নিহানের। কেউ জানে না তুমি এখানে। আইন মেনে লিটল ফোর্কে পুলিশী কর্মকাণ্ডে ছিলে না। সোর্সের কাছ থেকে জেনেছি, তুমি আছ ছুটিতে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ খোঁজ করলে জানবে ছিলে কেন্টাকিতে। এখন টুকরো টুকরো করে তোমাকে বিরাট এই এলাকায় ছড়িয়ে দিলে কে জানবে তুমি কোথায়?

আমার কলিগদের বলেছি, যাচ্ছি বড়বোনের সঙ্গে দেখা করতে। ওখানে না পেলে সোজা তোমার এখানে খুঁজবে ওরা। তুমি প্রথম লোক, যার ওপর চোখ পড়বে এফবিআই এর।

আমার কাছে আসবে কেন?

কারণ তাদেরকে বলেছি, আমার বড়বোনের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছে তোমার।

ও, ওই সামান্য টাকার বিল?

হ্যাঁ। নিশ্চয়ই সেজন্যে পাগল হয়ে ওকে খুঁজছ না? নতুন তথ্য চাইছে জুডি। এসবের ভেতরে অন্য কিছু আছে।

মাথা নাড়ল ময়নিহান। তোমার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানাব, কিছুই জানি না। গত দুসপ্তাহ হলো ডালাস ছেড়ে কোথাও যাইনি। সাক্ষ্য দেবে শতখানেক লোক। ক্ষুর তুলে ফলা দেখছে ময়নিহান। যথেষ্ট হয়েছে, জুডি, ধৈর্য হারাতে বসেছি। এবার মুখটা খোলো।

প্রায় অচেনা লোক মাসুদ রানা। ভাড়া করেছি, যাতে খুঁজে বের করে আমার বড়বোনকে।

টাইয়ে অদৃশ্য সুতো দেখেছে, এমন ভঙ্গিতে বুকের কাছে ক্ষুর চালাল ন্যাশ ময়নিহান। সাধারণ এক ডিটেকটিভ? গম্ভীর হয়ে গেল তার চেহারা। তাকে কোথায় পেয়েছ?

বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছি।

মিথ্যা, জুডি, আবারও হাতের ভেতর ক্ষুর লুকিয়ে ফেলল ময়নিহান। চলে গেল জুডির পেছনে। হাত রাখল কাঁধে।

জুডির মনে হলো তৃক স্পর্শ করল কোনও শীতল সাপ। শিউরে উঠতে গিয়েও থেমে গেল।

তুমি ওকে আগে থেকেই চিনতে।

না, ভুল ভাবছ।

কোথায় পরিচয় হয়েছে?

 নিউ ইয়র্কে।

জুডির এক গোছা চুল আঙুলে পেঁচিয়ে নিল ময়নিহান। নিউ ইয়র্কেই পরিচয় হলে ফ্লোরিডায় কী করছিলে?

মাথা সামনে বাড়িয়ে নোকটার আঙুল থেকে চুল ছুটিয়ে নিল জুডি।

খোঁজ নিয়েছি। তোমরা টাম্প থেকে বিমানে করে গেছ লিটল ফোর্কে। তার আগে বিমানে করে নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছ একা। নিউ ইয়র্ক থেকে আসেনি মাসুদ রানা। ফ্লোরিডাতেই ছিল। আমি কি মিথ্যা বলেছি, জুডি?

দেখা হয় ফ্লোরিডায়। ওদিকে তার কাজ ছিল।

 জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ তুলল ময়নিহান। ব্যাপার কী, জুডি? তাকে বাঁচাতে চাইছ কেন? সে না সাধারণ এক প্রাইভেট ডিটেকটিভ? সেক্ষেত্রে তার জন্যে এত মিথ্যা কেন? আবারও জুডির চুলের গোছা হাতে নিল সে। তোমরা কি পরস্পরকে ভালবাস?

না, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল জুডি। সরিয়ে নিল মাথা।

এবার আঙুলে ভালভাবে চুল পেঁচিয়ে নিল ময়নিহান।

আগেই তো বলেছি, মাত্র পরিচয় হয়েছিল।

তা হলে রেগে উঠছ কেন? তোমার চুল স্পর্শ করছি। বলে? নাকি সত্যিই ভালবেসে ফেলেছ মাসুদ রানাকে?

কোনও কারণ নেই ভালবাসার, চাপা স্বরে বলল জুডি, পাগলের মত বকবক করছ কেন?

ওর সঙ্গে কথার সময় মনে হয়েছে, সে তোমাকে পছন্দ করে।

ওর সঙ্গে কথা হয়েছে? প্রায় ফিসফিস করল জুডি। কী বলেছে?

নিষ্ঠুর হাসল ময়নিহান। জুডি পুলিশ অফিসার। এ ধরনের বিপদের জন্যে ট্রেনিং আছে। এজন্যেই ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলাপ শুরু করেছে সে। টের পেল, একবার শিউরে উঠল মেয়েটা। ময়নিহান বুঝল, যা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জানে জুডি।

তোমাকে ফিরে পেতে চায় রানা। হয়তো প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না। এতে অবাক হচ্ছ না? তোমরা না প্রায় অচেনা দুজন মানুষ?

বড়বোনকে খুঁজতে পয়সা দিচ্ছি ওকে, বলল জুডি। আমি তার খাবারের টিকেট। কেন আমাকে ফেরত চাইবে না?

না, জুডি, এর ভেতর আরও কিছু আছে। তোমাকে ভালবাসে মাসুদ রানা। আমার ধারণা, তুমি নিজেও তাকে ভালবাস। আর তাই, যা বলছ, তার চেয়ে বেশি জানো।

মাথা নাড়ল জুডি। সেটা হলো বেশি দ্রুত এবং আনাড়ির মত। আমি তো আগেই বলেছি…।

বলেছ মাত্র পরিচিত হও তোমরা। আবারও জুডির কাঁধে হাত রাখল ময়নিহান। ক্ষুরের চেপ্টা দিক বেলাল মেয়েটার কলারবোনে। ভুলিনি তোমার কথা। তবে অনেক সময়ে প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ হয় মানুষের। আমি আবার পুরনো আমলের রোমান্টিক লোক। বিশ্বাস করি এখনও সম্ভব প্রথম দর্শনে প্রেম।

চুপ থাকল জুডি। ময়নিহান ওর কলারবোন পেরিয়ে আরও নিচে নামাল ক্ষুর। ওটা থামল সুউচ্চ বুকে। এক সেকেণ্ড পর ঢুকে পড়ল ব্রার স্ট্র্যাপের ভেতর। সরে গেল ব্রা। দেখা গেল গাঢ় গোলাপি রঙের স্তনবৃন্ত। বুক ঢাকতে হাত তুলল জুডি, কিন্তু ক্ষুরের চেপ্টা দিক দিয়ে ওর আঙুল সরিয়ে দিল ময়নিহান। ঘুরে তাকাল দুই গার্ডের দিকে। তারা কঠোর মনের বলেই জুডির পাহারাদার হিসেবে রেখেছে ময়নিহান। নরম সুরে বলল সে, ছেলেরা, কতক্ষণ ধরে চেনো জুডিকে?

কয়েক ঘণ্টা, বস, বলল ডানদিকের জন।

ওকে অপরূপ সুন্দরী লাগছে?

বিছানায় পেলে ধন্য হতাম, বলল ডানদিকের লোকটা। অন্যজন চুপ।

জুডির দিকে তাকাল ময়নিহান। ধীরে ধীরে ঘুরছে চেয়ার ঘিরে। বুঝতেই পারছ, জুডি, কত দ্রুত একজন অন্যের প্রতি আকর্ষিত হয়! সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে পেরেছে আমাদের প্রিয় লোগান টার্সন।

সত্যিকারের কাদা মাখা শুয়োর! তুমি নিজেও তাই!

তা ঠিক। তবে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। তুমি বরং খুলে বলো কে এই মাসুদ রানা।

চোখ বুজল জুডি। কোটি কোটি মানুষের একজন সে।

ক্ষুর স্পর্শ করল জুডির চোয়াল। এখন যদি তোমার চেহারা ফালি ফালি করে দিই, তবুও কি তোমাকে ফেরত চাইবে মাসুদ রানা?

গালের মাংসে শীতল ধাতু ডেবে বসলেও সরার চেষ্টা করল না জুডি। ত্বক কেটে বেরিয়ে এল একফোঁটা রক্ত। সেক্ষেত্রে পয়সা পাবে না সে। তাতে আরও খেপে যাবে।

সরে গেল ময়নিহান।

ঠিক জায়গায় ব্রা বসিয়ে নিল জুডি।

দারুণ দেখালে, জুডি, বলল ময়নিহান। রক্ষা করতে চাও ভালবাসার মানুষটাকে। মন্দ নয়।

সে আমার ভালবাসার পাত্র নয়।

ঘরের আরেকপ্রান্তে গিয়ে দুহাত বুকে ভাঁজ করল ন্যাশ ময়নিহান। দেখছে মেয়েটাকে। কমুহূর্ত পর বলল, এই প্রথম মিথ্যা বললে না, জুডি। বুঝতে পারছি, পরস্পরকে বুঝতে শুরু করেছি আমরা।

ময়নিহানের দিকে না চেয়ে মেঝেতে চোখ রাখল জুডি। গাল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নামছে চিবুকে।

লোগানের দিকে মাথার ইশারা করল ময়নিহান। একটু আগে যা বললে; সেই কাজে ওকে ব্যবহার করতে পারো। তথ্য চাই আমার। তবে খেয়াল রাখবে, মরে যেন না যায়।

ঝট করে চোখ তুলে তাকাল জুডি।

 কাঁধ ঝাঁকাল ময়নিহান। রানা যদি তোমার ভালবাসার মানুষ না হয়ে থাকে, তো অন্য কেউ তোমাকে শারীরিক আনন্দ দিতেই পারে- তাই না?

চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাল জুডি, কিন্তু সেসবে কান না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ময়নিহান। পেছনে আটকে দিয়েছে দরজা। লোগান সত্যিকারের শুয়োর, বস্ সুযোগ করে দেয়ায় যে-কোনও সময়ে হামলে পড়বে এখন জুডির ওপর। পেট থেকে বের করতে চাইবে সব কথা। তাতেও মেয়েটা মুখ না খুললে ক্ষুর দিয়ে ওর শরীর কাটবে ময়নিহান। তখন উপায় থাকবে না নীরব থাকার।

সিঁড়ি বেয়ে তেতলার প্রশস্ত লিভিংরুমে চলে এল ন্যাশ ময়নিহান। পেরোল ছোট ভেস্টিবিউল। সামনেই বারান্দা। রেলিঙে দুহাত রেখে দেখল চারপাশ। ডালাসে নেই সে। এই কাঠের মস্ত বাড়ি বিশাল এক র‍্যাঞ্চের মাঝে। একমাইল দূরে গাছের সারির ওদিকে র‍্যাঞ্চের তারকাঁটার বেড়া। কাউকে আসতে হলে পেরোতে হবে খোলা এলাকা। মাসুদ রানা এলে অনেক আগেই তাকে দেখবে তার লোক।

নিনা ভেঞ্চুরা সহ, অথবা একা আসবে ওই লোক!

মাসুদ রানার মুখোমুখি হওয়ার উদগ্র আগ্রহ জন্মেছে ময়নিহানের মনে। এটা ঠিক, লোকটা ব্যবসার জন্যে খুব ক্ষতিকর, তবে এর আগে ওর মৃত এত করিৎকর্মা মানুষ দেখেনি সে।

ময়নিহান ভাবছে, ব্যবসা আর টাকার নেশা নষ্ট করেছে। তার মুক্ত মনটাকে। আজকাল মনে হয় যেন সে বন্দি। ইচ্ছে করে আবার ফিলিক্সদের হতে। আগের মতই করবে যা খুশি। বিদ্যুদ্বেগে চালাবে প্রিয় ক্ষুর। কচাকচ কাটবে মানুষের গলা। আসলে রানার বিরুদ্ধে লড়লে নিজেকে তার মনে হবে সত্যিকারের পুরুষ।

দূরের আউট বিল্ডিঙের দিকে তাকাল ন্যাশ ময়নিহান।

আগে এই র‍্যাঞ্চের একমাত্র মূলধন ছিল অসংখ্য গরু। এখন মেশিন দিয়ে সেগুলোর মাংস কুচি কুচি করে ক্যান-এ ভরে বিক্রি করা হচ্ছে দেশের নানান এলাকায়। হয়তো মাসুদ রানাকেও ওভাবে কুচি কুচি করবে সে। ক্যানে ভরে ছড়িয়ে দেবে সারা দেশে।

.

২৪.

 ক্যাপিটাল সিটি এয়ারপোর্টে নামার পর ভীষণ রেগে গিয়েছিল রিক বেণ্ডার। অস্ত্র নিয়ে বিমানে উঠবে তার উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষকে। দরকারী কাগজপত্রও ছিল না। শেষে এক স্টোরেজ ফ্যাসিলিটির স্ট্রংক্সে রেখেছে তার অস্ত্র। সংগ্রহ করবে বাড়ি ফেরার সময়। এরপর কানেক্টিং ফ্লাইটে চেপে রওনা হয়েছে ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ এয়ারপোর্ট লক্ষ্য করে। একমাত্র উদ্দেশ্য: নির্মম হত্যা। ভাল হতো ম্যাগনামটা সাথে থাকলে। তবে তা খুব বড় কোনও সমস্যা নয়। আসলে তো খালি হাতে মাসুদ রানাকে খুন করবে সে।

অবশ্য হাতে একটা আগ্নেয়াস্ত্র চাই। প্রতিদ্বন্দ্বী কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাকে খুন করতে হবে না? রানাকে হত্যার সময় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বুকে বুলেট গেঁথে দিতে দেরি করবে না রিক।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে চাপল সে। সোজা যাবে কাছের কোনও রোডহাউসে।

মেয়েলোক চাই? জানতে চাইল শুয়োরের মত লালচে মোটা ড্রাইভার। আঙুলে নিকোটিনের কালচে দাগ। একহাতে রিয়ার ভিউ মিরর ঠিক করে দেখল রিক বেণ্ডারকে।

হ্যাঁ। ওরকম কোনও জায়গাতেই যাও। গা গরম করে দেয়া নাচুনে মেয়েলোক চাই।

ভাল জায়গা চিনি।

বিশ মিনিট পর ড্রাইভারের হাতে ভাড়া ও দশ ডলার টিপস দিল রিক। নেমে পড়ল মামা লিলি-এর পার্কিংলটে। রাতের আঁধারে ওই বাড়ি হবে জমজমাট। জ্বলবে নিয়ন সাইন, ভেতরে থাকবে বিশাল স্তনের কয়েকটি মেয়ে। আঁকাবাঁকা হরফে লেখা: ওরা খুবই দক্ষ! দারুণ মজা! চলে আসুন!

আপাতত ঝিম ধরে আছে মামা লিলিয। পার্কিংলটে মাত্র দুটো গাড়ি। পুরনো এক পন্টিয়াক, অন্যটি কফি রঙা ক্লাসিক মডেলের একটা ক্যাডিলাক। পুরনো হলেও দেখতে বেশ।

জানালায় কনুই রাখল ড্রাইভার। মামা লিলিয কখনও বন্ধ হয় না, পেছন দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ন। খুঁজে নেবেন হেনিকে। রিকের মুখে একরাশ ধুলো ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল গাড়ি।

রিকের পরনে ভারী ওভারকোট। রীতিমত গরম লাগলেও গা থেকে-ওটা খুলল না। কোট বইতে গিয়ে একটা হাত আটকা পড়লে, যে-কোনও সময় আসতে পারে বিপদ। ওভারকোটের বোতাম খুলে মামা লিলিয-এর সদর দরজার দিকে চলল রিক।

আয়তাকার পোক্ত বাড়িটা কাঠের তৈরি। কবে যেন কালো রঙ করেছিল, জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। অস্বাভাবিক নিচু ছাত। এখানে যারা আসে, তাদের ভাল লাগবে না হাইওয়ে দিয়ে চলে যাওয়া সাধারণ মানুষের বিরক্তিভরা দৃষ্টি, তাই সামনে কোনও জানালা নেই। সদর দরজা আপাতত বন্ধ। হ্যাণ্ডেলে ঝুলছে একটা কাগজ। তাতে লাল রঙে মোটা করে আঁকা ডানদিকে যাওয়ার জন্য তীরচিহ্ন। না থেমে দুই গাড়ি পার হয়ে রিক চলে এল বাড়িটার পেছনে।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কঠোর চেহারার দুই যুবক। আকারে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশ বড়। পেশিবহুল। হাতে ও ঘাড়ে টাটু। চোখে নিস্পৃহ দৃষ্টি। এদের তুলনায় রিক রীতিমত দানব। ওকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দিল না দুই যুরক। তাদের একজন খুলে দিল কবাট।

বাড়িটার বাইরের মত ভেতরের রঙও কালো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টেবিল ও চেয়ার। মাঝে উঁচু এক মঞ্চ। ওখানে সন্ধ্যার পর নাচবে স্ট্রিপাররা। ঘরের আরেক প্রান্তে বার কাউন্টারের উপর সিলিঙে জ্বলছে একটা মাত্র বা। কাউন্টারের পেছনে এক মহিলা। মিউট করে দেখছে টিভি। একবারের জন্যেও রিককে ঘুরে দেখল না মহিলা।

ঘরে কারা আছে চোখ বুলিয়ে বুঝে নিল রিক।

সব মিলে খদ্দের হাফ ডন। দূরে একা বসে ড্রিঙ্ক করছে বয়স্ক এক লোক। অন্য পাঁচজন যুবক। বসেছে ঘরের পেছনের এক বুথে।

জ্যাকপট, নিচু গলায় বিড়বিড় করল রিক। বয়স্ক লোকটা বা মহিলাকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি ওই পাঁচ যুবকের সামনে হাজির হলো সে। এদের মত যুবকদেরকেই খুঁজছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েস করে বসে আছে সবাই। টেবিলের ওপর একগাদা বিয়ারের সবুজ বোতল। রিক টেবিলের সামনে থামতেই কঠোর চোখে ওকে দেখল তারা। মনে হলো না বিন্দুমাত্র কেয়ার করছে। অবশ্য রিক বুঝে গেল, দৈহিক আকার দিয়ে চমকে দিয়েছে ওদের সবাইকে।

ইচ্ছে করেই টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল রিক। ওপর থেকে তাকাল যুবকদের দিকে। ওকে দেখছে না এমন ভাব করার উপায় নেই তাদের। এক এক করে প্রত্যেকের চেহারা দেখল রিক। কড়া চোখে ওকে দেখছে তারা।

কথা বলতে চাইলে বলব কার সঙ্গে?

সেই লোক আমি, দলের মাঝ থেকে বলল এক যুবক।

এ-ই দলনেতা, বুঝল রিক। নিজের নিরাপত্তার জন্যে দুদিকে রেখেছে দুজন করে। বয়স ত্রিশ মত। খুলি কামড়ে আছে ঘন কালো চুল। শরীরে রেড ইণ্ডিয়ান রক্ত আছে। দুদিকের অন্য চারজন বয়সে কম। ছেলেমানুষ, তবে নিজেদের ভাবছে পুরুষমানুষ।

বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে রিক বলল, আমার একটা আগ্নেয়াস্ত্র দরকার।

তুমি কি পুলিশ? জানতে চাইল নেতা।

আমাকে অতটা খারাপ মনে হয় তোমার?

ভাবলে কেন যে আমার কাছে অস্ত্র আছে?

নীরবে তার চোখে তাকাল রিক। বুঝে গেছে, নাইট ক্লাবের বাউন্সার এই লোক। এদেরকে ছাড়া চলে না এই ধরনের পতিতালয়। কেউ বিনা পয়সায় স্ট্রিপারদের ন্যাংটো করতে চাইলে, প্রয়োজনে লাথিয়ে তার ডিমদুটো ফাটিয়ে দেবে এরা। পয়সা ছাড়া কিছুই হয় না এখানে।

পয়সা ছাড়বে কত? জানতে চাইল লোকটা।

তোমার কাছে কী আছে, তা দেখে তারপর ঠিক করব। রিক বুঝল, কথাটার ওজন মাপছে এমন ভঙ্গি নিয়েছে লোকটা। সবই নাটকের অংশ। ঘুরে দরজার দিকে রওনা হলো রিক। বাদ দাও। আমার পয়সা যাবে আর কারও পকেটে।

একমিনিট!

টেবিল নড়ে ওঠার খড়মড় আওয়াজ পেল রিক। কাঠের মেঝেতে বুটের শব্দ। থমকে ঘুরে তাকাল ও।

নেতার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেছে চার যুবক।

 এত তাড়া কীসের? হাসল দলনেতা। অস্ত্র, দরকার, তাই না? আমার কাছে আছে। অন্য কোথাও যেতে হবে না।

ফালতু কথার লোক নই; ব্যবসা করতে চাইলে করবে ঝটপট। বুক পকেটে চাপড় দিল রিক।

বারকাউন্টারের পাশের দরজা দেখাল দলনেতা। এসো আমার সঙ্গে।

তার পিছু নিল রিক। পেছন পেছন আসছে অন্য চারজন। থমকে এক এক করে তাদের চোখে তাকাল রিক। আমি ব্যবসা করব তোমাদের বসের সঙ্গে। তোমাদের সঙ্গে না।

রিক যেন মস্তবড় ভালুক, আর ওকে ঘিরে ফেলেছে কটা টেরিয়ার কুকুর। এরা কেউ একা কিছুই নয় দানবের কাছে। কিন্তু ভাবছে, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লে কাবু করতে পারবে। ফুলিয়ে ফেলেছে বুক। দলনেতা বললেই হামলে পড়বে অচেনা লোকটার ওপর।

কাছের যুবককে বেছে নিল রিক। দলে সবচেয়ে বড় সে। বামকানের লতি থেকে ঝুলছে ইয়াররিং। চোখে টিটকারি। মুখে ক্ষতচিহ্ন। আগে হেরেছে লড়াইয়ে। ডানহাত বাড়িয়ে তার গাল ধরে প্রচণ্ড এক চাপ দিল রিক। পরক্ষণে ধরল চোয়াল। আঙুল ডেবে গেল দুকানের নিচের নার্ভে। তীব্র ব্যথায় চিৎকার ছাড়ল সে। কিন্তু কঠিন হাতে ঘাড় চেপে ধরে তাকে পিছনে ছিটকে ফেলল রিক। পিছিয়ে একটু আগে ত্যাগ করা টেবিল ভেঙে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল যুবক।

আগেই বলেছি, নিজের কাজে যাও। কুত্তার মত পিছু নিতে হবে না।

কসেকেণ্ড দ্বিধায় পড়ল অন্যরা। পথ মাত্র দুটো। হয় হামলা করো, নইলে পিছিয়ে যাও। লড়তে আপত্তি নেই রিকের। আগে নড়ল বারকাউন্টারের মহিলা। হঠাৎ দৌড় দিয়েও তেলাপোকার মত ব্রেক কষে অন্যদিকে গেল সে।

খেপা কুকুরের মত স্যাঙাদের ধমক দিল দলনেতা, হচ্ছেটা কী? টাকা নিয়ে হাজির হয়েছে এক কাস্টোমার, আর তোমরা ঝামেলা করছ? বিদায় হও এখান থেকে!

কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে রিককে দরজা দেখাল সে। দলনেতার পেছনে ঢুকে কবাট বন্ধ করল রিক। ভাবছে, ওরা অপেক্ষা করবে। এরপর যখন ও বেরোবে, হাজির থাকবে বাইরের দুজনও। ওর অপেক্ষায় থাকবে ওরা ছয়জন।

গুদামের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রিক। দেয়ালের পাশে গাদি করে রাখা হয়েছে বিয়ার ও মদের কেস। এক কোণে তরল সাবান ও হাত মোছার কাপড়। চারপাশ দেখে নিল সে। পেছনের এক দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালল দলনেতা। এবারের ঘর জেলের সেলের মতই ছোট। ঘরের একপাশে ছোট জানালা। ওটা পেরেক মেরে বোর্ড দিয়ে বন্ধ করা। ছোট টেবিলের দুদিকে প্লাস্টিকের কম দামি দুটো চেয়ার। পায়া লোহার। টেবিলের ওপর কফির মগের দাগ। একপাশে স্টিলের কেবিনেট। প্যান্টের পকেট থেকে একগোছা চাবি নিয়ে নির্দিষ্ট চাবি বেছে বের করল লোকটা। তালা খুলে সড়সড় শব্দে টানল কেবিনেট।

তোমার নাম হেনি? জানতে চাইল রিক।

বরফের মূর্তি হলো লোকটা। চোখে সন্দেহ। অপেক্ষা করছে এরপর কী বলবে দানব।

টেবিলে রাখা মগ দেখাল রিক। ড্রাইভার বলল হেনির সঙ্গে দেখা করতে। মগেও একই নাম।

হাসল দলনেতা। হ্যাঁ, আমিই। মগটা প্রেযেণ্ট করেছে মেয়েদের একজন। বুঝতেই পারছ, ওকে সন্তুষ্ট করেছি বলে খুব খুশি ও।

চুপ করে থাকল রিক।

কেবিনের ড্রয়ার থেকে কাঠের বাক্স নিল হেনি। আরেকটা চাবি ব্যবহার করে খুলল তালা। ছোট্ট বাক্সের ড্রয়ার টানতেই দেখা গেল অস্ত্রগুলো।

টরাস আমার কাজে আসবে না, বলল রিক। অস্ত্রটা পাঁচ বুলেটের। নাম স্যাটারডে নাইট স্পেশাল। ওর হাতের তুলনায় অনেক ছোট। অন্যদুটো নেব।

সেমি-অটোমেটিক পিস্তলদুটো বের করল হেনি। প্রথমটা ড্যান ওয়েসন। পয়েন্টম্যান সিরিযের। উনিশ শ এগারো মডেলের। পেটে থাকে সাতটা ৪৫ ক্যালিবারের বুলেট। নীলচে রঙ। গ্রিপ রোজউডের। এই অস্ত্রটাও রিকের হাতের তুলনায় ছোট। তবে ব্যাকআপ অস্ত্র হিসেবে একেবারে খারাপ নয়। শেষ অস্ত্রটার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। ওটা ডেযার্ট ঈগল মার্ক নাইন্টিন। ব্যারেলটা দশ ইঞ্চি। ম্যাগাযিনে থাকে .৩৫৭ ম্যাগনাম বুলেট। আকারে ও ওজনে ড্যান ওয়েসনের প্রায় দ্বিগুণ। এ ধরনের জিনিসই পছন্দ রিকের।

গুলি?

দুটো বাক্স বের করে অস্ত্রদুটোর পাশে রাখল হেনি।

 সব মিলে দাম কত? জানতে চাইল রিক।

 দুহাজার ডলার। অ্যামিউনিশন দেব বিনা পয়সায়।

 নতুন অস্ত্র কিনলে এমনিতেই বিনা পয়সায় দেবে।

তা ঠিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রি করতে হবে। চাইলেই হাতে পাবে না অস্ত্র। দরখাস্ত জমা দেয়ার কয়েক দিন পর হয়তো অনুমতি দেবে কর্তৃপক্ষ। আমার মনে হয়নি তুমি সময় নষ্ট করার মানুষ।

অসন্তুষ্ট হয়ে গলা দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলল রিক। বুক পকেট থেকে নিল ডলারের বাণ্ডিল। পুরো পনেরো শ। ব্যস, এর ওপর এক পয়সাও না।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল হেনি। মুখে দুখী-দুখী ভাব।

 কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট লোভ দেখছে রিক। বাণ্ডিল থেকে পনেরোটা এক শ ডলার নিয়ে রাখল টেবিলে। উঁচু হয়ে আছে নোট।

ডলারগুলো নিয়ে গুনতে লাগল হেনি। এদিকে ডেযার্ট ঈগলের ম্যাগাযিনে বুলেট ভরছে রিক। কোটের পকেটে রাখল ড্যান ওয়েসন। আরেক পকেটে গেল অ্যামিউনিশনের বাক্স।

তোমার ছেলেরা দরজার ওপাশে থাকবে, হেনি? জানতে চাইল রিক।

প্যান্টের পকেটে ডলার রেখে বলল হেনি, ওদেরকে ওই শিক্ষা দিইনি।

দুঃখের কথা, চওড়া হাসল রিক, তা হলে অস্ত্র ঠিক আছে কি না বুঝতে আর কারও বুকে গুলি করতে হবে।

.

২৫.

 হালকা নীল রঙের স্যাটার্ন এসএলওয়ান ভাড়া গাড়িতে একাই আছে রানা। তেল কম খায় বলে সুনাম আছে এই মডেলের। পিছু পিছু নিজেদের ভাড়া গাড়ি নিয়ে আসছে জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। বজায় রেখেছে দূরত্ব। ওরা রানার আস্তিনের সেরা তাস। ঠিক করেছে এখন খেলবে না।

ডালাস থেকে উত্তরদিকের সড়ক ধরে চলেছে ওরা। গন্তব্য রে রবার্ট লেক। একবার ওখানে পৌঁছুলে পুবে যাবে ছোট শহর পাইলট পয়েন্ট-এ। এরপর শাখা রাস্তা ধরে পৌঁছুবে খামার এলাকায়। ওই মাঠ গিয়ে মিশে গেছে ওকলাহোমা রাজ্যের সীমান্তে। রানার গাড়িতে আছে জিপিএস লোকেশন ফাইত্তার, কিন্তু কোনও কাজে আসবে না ওটা। চারপাশে খেত, জায়গায় জায়গায় জঙ্গল। সিনথেসাইয মহিলাকণ্ঠ বারবার বলছে: ফিরে যাও যেদিক থেকে এসেছ। আরও কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে সুইচ টিপে মহিলার কণ্ঠরোধ করল রানা। বুঝতে পারছে, কঠিনই হবে ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ খুঁজে বের করা।

মাঝে মাঝে সেল ফোনের মাধ্যমে দুই বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে রানা। একমাইল পেছনে আসছে তারা। হঠাৎ বিপদ হলে সময় লাগবে ওদের ওর কাছে পৌঁছুতে। তবে বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে খেত গিয়ে মিশেছে দিগন্তে। নেই কোনও দালান-কোঠা বা শহর। ময়নিহানের লোক এলে তাদেরকে দেখা যাবে বহু দূর থেকে। কারও সন্দেহ হবে না একটা গাড়ি চলে গেলে। তবে পর পর দুটো গাড়ি গেলে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

আর্লিংটনের বাইরে ওই মোটেলে বসে নতুন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে বাড হিগিন্স। টেক্সাসে অসংখ্য স্থাবর সম্পত্তি আছে ময়নিহানের জমি উন্নয়ন ব্যবসা সংস্থার। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে বিশেষ একটি মনোযোগ কেড়েছে ওদের।

ময়নিহান র‍্যাঞ্চ।

লোকটা বেছে নিয়েছে প্রত্যন্ত এলাকায় দেশের সেরা জমি। তাকে খুঁজতে হলে প্রথমেই যাওয়া উচিত ওখানে। কাউকে বন্দি করে রাখতেও উপযুক্ত জায়গা ওটা। কেউ শুনবে না আর্তের চিৎকার। আত্মরক্ষার জন্যেও ভাল। দুমাইলের ভেতর গোপনে পৌঁছুতে পারবে না কেউ।

গুগল দেখে কোন্ দিকে যেতে হবে বের করেছে বাড। লোকেশন বুঝে নিয়েছে রানা। ম্যাপ অনুযায়ী, র‍্যাঞ্চে গেছে মাত্র একটা রাস্তা। বেরোতেও ব্যবহার করতে হবে এটাই। তবে সমস্যা হচ্ছে সঠিক পথ কোটা খুঁজে বের করা কঠিন। টুরিস্টরা যায় না ওদিকে। রাস্তায় কোনও সাইনবোর্ডও নেই। ধরে নিতে হচ্ছে, দিগন্তের ওদিকে ওই র‍্যাঞ্চ। বহু ব্যবধানে কখনও কখনও খুঁটিতে একটা-দুটো মেইলবক্স বুঝিয়ে দিচ্ছে, পাশ দিয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বেশিরভাগ ট্রেইল মানেই চেপ্টে যাওয়া ঘাসের মাঝে দুটো দাগ। বহু দূরে দূরে এসব ট্রেইল।

চুপচাপ ড্রাইভ করছে রানা। শীত আসছে বলে রাস্তার দুপাশে বাদামি ঘাসের বিশাল মাঠ। দূরে পেট পূজায় ব্যস্ত গরুর পাল। একেকটার মস্ত শিং ধনুকের মতই বড়। রানার মনে পড়ল, বেণ্ডারদের ডজ র‍্যাম গাড়ির কথা। ভাবল, এখন কোথায় দানবের মত লোকটা? আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তার ছোটভাইকে খুন করেছে ও।

নতুন করে সচেতন হয়ে উঠল রানা। ময়নিহানের কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে জুডিকে। কাজটা কঠিন, আগে খুঁজে বের করতে হবে মেয়েটা আছে কোথায়।

স্যাটার্ন থামাল রানা। মোবাইলের বাটন টিপে কল দিল জনকে। তোরা বরং আরও পিছিয়ে যা।

কোনও সমস্যা? জানতে চাইল জন।

চারপাশটা দেখতে থেমেছি, বলল রানা। গাড়ি নামিয়ে দিল বামের মাঠে। ওদিকেই কোথাও ময়নিহান র‍্যাঞ্চ। একটা কমপাস পেলে কাজ হতো।

এগোতে থাক, ওই র‍্যাঞ্চ বেশি দূরে নেই, বলল জন।

দূরের দিগন্তে আবছাভাবে সবুজের রেখা দেখল রানা। গাছ ও ঝোপ লাগিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে ওদিকে।

সোজা র‍্যাঞ্চের দিকেই চলেছি, বলল রানা। তবে দেখিনি গেট। কাছাকাছি গিয়ে আবার রাস্তায় ফিরব।

বাডের গালি শুনতে পেল রানা।

যাশশালা! বলে উঠল জন। এগোতে থাক, কিন্তু তোর দিকে যাচ্ছে একটা কপ্টার। নিচে আরও আছে দুটো গাড়ি, সন্দেহজনক।

তোদের দিকে কপ্টার থেকে বাড়তি মনোযোগ দেয়নি?

হ্যাঁ, দিয়েছে। নিচু হয়ে উড়ে আসছে। দেখতে চায় আমরা কারা। চুপ হয়ে গেল জন। বোধহয় রেখে দিয়েছে ফোন।

গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোদিকে চলল রানা। ওকে অন্যদিকে যেতে দেখলে হয়তো সন্দেহ কমবে কপ্টার পাইলটের। বহু দূরে যান্ত্রিক ফড়িংটাকে দেখতে পেল রানা। উড়ে আসছে রাস্তার ওপর দিয়ে। কালো রঙের। কী ধরনের কপ্টার বোঝ গেল না। গতি ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল। হয়তো চলে যাবে পাশ কাটিয়ে। আগের চেয়ে গাড়ির গতি বাড়াল রানা। যে-কোনও সময়ে হয়তো রাইফেলের মাযলে ঝলসে উঠবে কমলা আগুন।

কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেলেও এল না গুলি।

উচ্চতা কমিয়ে ঘুরে রানার দিকে এল কপ্টার।

আবারও ফোনে কথা বলে উঠল জন। ভালভাবে দেখে নিয়েছে। আমাদেরকে খুঁজছে না। তোর ক্ষেত্রে তেমন না-ও হতে পারে। সোজা তোর দিকে আসছি। যে-কোনও সময়ে শুরু হতে পারে ঝামেলা।

সাধারণ গতিতে আয়, বলল রানা। এখনও চিন্তার কিছু নেই। ফোন রেখে কোমর থেকে ওয়ালথার নিল ও। রাখল পাশের সিটে। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে নিয়ে মাথায় চাপাল বেসবল ক্যাপ। কে জানে, হয়তো ওটার জন্যেই আরও বেশি সন্দেহপ্রবণ হবে লোকগুলো। এরা ময়নিহানের স্যাঙাৎ হলে তাদেরকে ওর চেহারা ও দৈহিক বর্ণনা দিয়েছে রিক বেণ্ডার, জাজ হোল্ড বা শেরিফ ম্যাকলাস্কি। আবছাভাবে ওকে দেখবে ককপিট থেকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই।

ষাট মাইল বেগে কপ্টারের দিকেই চলেছে রানা। ওর চেয়ে জোরে আসছে কপ্টার। এবার ওটাকে চিনল রানা। বেল জেট রেঞ্জার। লেজে ধূসর-লাল রঙ। কোনও চিহ্ন নেই যে ধরে নেবে ওটা ন্যাশ ময়নিহানের। ভেতরে দুজন। ষণ্ডামার্কা চেহারা। মনে হলো না সহজ লোক। ভুরু কুঁচকে দেখল রানাকে।

নিজে অভিনয় ভালই করল রানা। মিষ্টি হাসল তাদের দিকে চেয়ে। হাতও নাড়ল বারকয়েক। পেছনে রয়ে গেল কপ্টার। আয়নায় ওটাকে দেখল ও। বামে বাঁক নিয়ে আবারও পিছু নিল লোকদুজন। দেখতে না দেখতে আবার চলে এল কাছে। কড়া চোখে রানাকে দেখল কো-পাইলট। অবাক হয়েছে, এমন ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রানা। জবাবে হাতের ইশারা করল নোকটা। খোল, ব্যাটা, তোর ক্যাপ!

আদেশ মানল রানা। খুলে ফেলল ক্যাপ। খাটো করে ছাঁটা চুলে হাত বুলিয়ে নাচাল দুই ভুরু। মুখ হাঁ করে বুঝিয়ে দিল: আবার কী হলো, ভাই?

রানার চেহারা দেখে খুশিই মনে হলো কো-পাইলটকে। নাড়ল মাথা। গাড়ি পেছনে রেখে এগোল কপ্টার। ধুলোয় অন্ধকার হলো চারপাশ। কপ্টারের তলা দিয়ে চলেছে গাড়ি। ওপরে উঠছে কপ্টার। আয়নায় রানা দেখল, ওটা চলেছে। পুবের সবুজ রেখা লক্ষ্য করে। বুঝে গেল, ওখানেই ন্যাশ ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ।

কিছুটা যেতেই দেখল উল্টোদিক থেকে আসছে জন ও বাডের ফোর্ড উইণ্ডস্টার মিনিভ্যান। গতি কমিয়ে থামল রানা। একটু পর পাশাপাশি হলো দুগাড়ির জানালা।

তোর জন্যে অপেক্ষা করছে ময়নিহান, মন্তব্য করল জন।

তাই মনে হচ্ছে, বলল রানা, কিন্তু এখন আবারও ওদিকে গেলে সন্দেহ করবে কপ্টারের লোকগুলো। এর পরেরবার হয়তো এত সহজে পার পাব না।

তা হলে কী করবি? জানতে চাইল জন।

রানা, সোজা যা পাইলট পয়েন্টে, এদিকে জায়গা দেখে ফিরব আমরা,বলল বাড।

তোদেরকেও দেখেছে, বলল রানা।

কথা ঠিক, ঘুরপথে যেতে পারি উত্তরদিকে, বলল জন। পরে দেখা হবে লেক হাউসে।

কথাটা যৌক্তিক। হয়তো দূরের রাস্তায় অপেক্ষা করছে। কপ্টার। ঠিক সময়ে না পৌঁছুলে কয়েক মিনিটে পৌঁছে যাবে এখানে। অন্যদিকে গেলেও খুঁজে নেবে। সেক্ষেত্রে হয়তো শুরু হবে মুখোমুখি লড়াই। ওদের তিনজনের বিরুদ্ধে প্রাণে বাঁচবে না লোকদুটো। কিন্তু রানা চাইছে না, এখনই শত্রুপক্ষ জেনে যাক সঙ্গে আছে জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। জুডিকে সরিয়ে নেয়ার সময় কাজে আসবে ওই চমক।

রওনা হ, বলল রানা, চেষ্টা করবি যেন তোদের চিনতে না পারে।

মাথা দোলাল জন।

গাড়ি নিয়ে রওনা হলো বাড।

গাড়ি ঘুরিয়ে লেক তীরে ওদের ভাড়া নেয়া কেবিন লক্ষ্য করে চলল রানা। রেকি করতে এসেছিল, সেটা ভালভাবে না পারলেও হতাশ নয়। কপ্টার দেখে আঁচ করা যাচ্ছে, র‍্যাঞ্চ হাউসে আছে ময়নিহান। অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

দেখা হবে, ময়নিহান, বিড়বিড় করল ও। আগের চেয়ে গতি তুলে ফিরছে পাইলট পয়েন্ট-এ। সময় কাটাতে গিয়ে জুডির কথা মনে পড়ল ওর। যেন চোখের সামনে ভাসল প্রথম দেখার দৃশ্য: কিছুক্ষণ হলো দেখছে, রুপালি সাগর সৈকতের বাঁক ঘুরে হেঁটে আসছে এক যুবতী। আর সব মেয়ের তুলনায় লম্বা। সরু কোমর, চওড়া কাঁধ। হাঁটার ভঙ্গি ব্যালেরিনার মতই সাবলীল। কালো চুল। আয়ত দুই চোখের মণি কুচকুচে কালো। উঠে এল বিচ হাউসের সান-ডেকে। নিচু কণ্ঠে জানতে চাইল, তুমিই কি মাসুদ রানা?

রানার মনে পড়ল লিটল ফোর্কের মোটেলে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়েছিল জুডি। সাড়া দিতে গিয়েও সামলে নিয়েছিল ও। লাল হয়েছিল জুডির দুগাল। বুঝেছে, সুযোগটা নেবে না রানা। তখন ম্লান হেসেছে মেয়েটা। নরম সুরে বলেছে, ধরে নাও, বন্ধু হিসেবে ধন্যবাদ দিতেই চুমু দিয়েছি।

অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল রানা। পরে বিড়বিড় করে কী যেন বলেছে জুডি। দারুণ সুন্দরী মেয়ে, ওকে পাত্তা না দেয়ায় চোখে ছিল রাগের ছাপ।

রানার মনে পড়ল, পরে কী বলেছে জন: দেখতে দারুণ, তাই না?

জবাবে রানা বলেছে: হোক, তাই বলে পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিবি?

হেসেছে জন। ওহ্, বলে দিয়েছে? যাহ্!

ভাবতে পারিনি মাইকের বোন।

আমিও ভাবতে পারিনি। সে তো ছিল মদ্দা মোষের মত। সব বাজে জিন ওর ওপর খরচ করে ফেলেছিল ওর বাপ। তারপর স্বর্গ থেকে নেমে এল ওই মেয়ে।

চুপ থেকেছে রানা।

কী, রানা, প্রেমে পড়ে গেলি? জানতে চেয়েছে জন।

এখনও না, বলেছে রানা।

ওর কথা শুনেই বুঝেছি, তোকে পছন্দ করে। ক্ষতি কী মেলামেশা করলে?

উচিত হবে না, জন। পাহাড়ে ওর বোনের বাড়িতে মুগ্ধ হয়ে চেয়েছি। তাতে আরেকটু হলে মাথা উড়ে যাচ্ছিল আমার। এক সেকেণ্ড দেরিতে গুলি পাঠিয়েছি।

আনমনে এসব ভাবতে গিয়ে ভুল করেছে রানা।

কখন যেন মাঠ পাড়ি দিয়ে ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে। দ্রুতগামী এক ল্যাণ্ড রোভার!

রানার গাড়ির জানালা ঝনঝন করে ভেঙে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে বুলেট বিধতেই চটকা ভাঙল ওর। এক সেকেণ্ড পর মেঝেতে দাবিয়ে দিল অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল। লাফ দিয়ে এগোল গাড়িটা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড লাগল ঘণ্টায় আশি মাইল বেগে গতি তুলতে। কিন্তু এর বেশি সাধ্য নেই এ গাড়ির। ময়নিহানের লোকদের সন্দেহ থেকে দূরে থাকতে অতি সাধারণ গাড়ি ভাড়া করেছে-রানা। তখন হুঁশ ছিল না যে লাগতে পারে তুমুল গতি।

কসেকেণ্ডে ওর পেছনে পৌঁছে গেল ল্যাণ্ড রোভার। রিয়ার ভিউ মিররে ওটাকে দৈত্য মনে হলো রানার। জিপে দুজন লোক। ড্রাইভ করছে একজন, অন্যজন অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে জানালা দিয়ে। হাতে রাইফেল। মাযল আবারও তাক করছে ওর দিকেই!

ছদ্মবেশ বৃথা গেছে, ভাবল রানা। ডানদিক থেকে উড়ে আসছে সেই ধূসর-লাল কপ্টার! আরও খারাপ খবর: ওটার দরজায় এখন দাঁড়িয়ে আছে একলোক, কাঁধে অটোমেটিক রাইফেল।

ওদের আছে ভাল মেশিনারি, সংখ্যায় ওরা বেশি এবং অস্ত্রও আধুনিক। বিড়বিড় করল রানা, ওরে, গাধা, এমন ফাঁদে কীভাবে পড়লি তুই?

.

২৬.

 নিজের কথা রেখেছে হেনি। কিন্তু রিক ভাবছে, কখন দেখাবে লোকটা তার আসল রূপ? ওর ভুল না হলে, সময় লাগবে না ভদ্রতার মুখোশ খুলতে। বাররুমে ঢুকতেই দেখল, নতুন এক টেবিল এনে ওটা ঘিরে বসে আছে চার যুবক। চেহারা গম্ভীর। উঁচু মঞ্চ পেরিয়ে দরজার দিকে যেতেই কঠোর চোখে ওকে দেখল মার খাওয়া লোকটা। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তাদের উদ্দেশে মৃদু নড় করল রিক। জরাবে মাথা দোলাল তিনজন। ভুরু আরও কুঁচকাল চতুর্থর্জন।

দরজার দিকে চলেছে রিক। শুনল হাসাহাসি করছে চার যুবক। ওকে নিয়ে হাসছে না। কপা পেছনে আসছে হেনি। মনে হলো পনেরো শ ডলার পেয়ে খুশি। হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে রিকের কথা। বিদায় দিয়ে ফিরবে ভেতরে।

ডোরওয়ের ক্রোম ফিটিঙে তাকে দেখল রিক। লোকটা ঘুরে চেয়েছে বন্ধুদের দিকে। ইশারায় কথা হয়েছে নীরবে। যা বোঝার বুঝে গেল রিক। একবার স্পর্শ করল ডেসার্ট ঈগল, তারপর সরিয়ে নিল হাত। ওকে পাশ কাটিয়ে ডাবল ডোর খুলে বেরিয়ে গেল হেনি। ঠাস করে বন্ধ হলো কবাট। ওই আওয়াজে চমকে গেছে বাইরের দুজন। তিন সেকেণ্ড পর নাইট ক্লাবের পেছনের উঠানে বেরোল রিক। ততক্ষণে লড়তে তৈরি দুই যুবক। তবে দানবীয় রিককে দেখে একটু ভড়কেই গেল তারা।

ঘাড় কাত করে ইশারা দিল হেনি। হাসি-হাসি মুখে বলল, চিন্তা নেই, রুবেল, রাসেল; বিদায় নিচ্ছে আমাদের বন্ধু।

দুই যুবকের চেহারা দেখল রিক। ফুলে গেছে একজনের গলার শিরা। চোখের তারা বিস্ফারিত। লড়বে। কোনও ইঙ্গিত ছিল হেনির কথায়। আবছাভাবে রিক শুনল, ভেতরের ঘরে পায়ের আওয়াজ। পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। হেনি। তাকে পাশ কাটাল রিক। তখনই ওর কনুইয়ে টোকা দিল লোকটা। তাতে ঝট করে ওর দিকে ঘুরল রিক। হাত বাড়িয়ে দিল দলনেতা। খুবই খুশি হলাম তোমার সঙ্গে ব্যবসা করতে পেরে।

হেনির হাত ধরলে দুই যুবকের দিকে পিঠ দিতে হবে, তাতে আপত্তি নেই রিকের। আমিও খুশি, হেনির হাতটা ধরল সে। কাজটা করেছে হিসাব কষেই। পেছনে থাক না দুজন, দেখতে পাবে বার থেকে চার যুবক বেরিয়ে এলে।

হেনির চোখে চোখ রেখে হাসল রিক।

পেছনে শুনল বুটের আওয়াজ।

আজ ভাল মুনাফা করলে, হেনিকে বলল রিক, আরও মুনাফা বোধহয় স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল হবে না।

হ্যাণ্ডশেক করা হাতটা প্রচণ্ড জোরে নিজের দিকে টানল রিক। মুহূর্তে হেনিকে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলল দুই যুবকের ওপর। মুখোমুখি সংঘর্ষে হতভম্ব হয়েছে তারা। ওই একই সময়ে প্রচণ্ড এক ঘুষিতে বামের যুবকের চোয়াল চুরমার করল রিক। ভীষণ ঝাঁকি খেল হাতে। পাশবিক শক্তি। যুবকের চোয়াল গিয়ে গুতো দিয়েছে মগজে। খুন না হলেও মাসের পর মাস খাবার খেতে পারবে না চিবিয়ে। কাটা কলাগাছের মত পড়ল যুবক। বুকটা হুমড়ি খেল হেনির কোমরে। দুজনই হুড়মুড় করে পড়ল পাকা উঠানে।

বন্ধুদের পায়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছে দ্বিতীয় যুবক। কিন্তু সামনে বেড়েই খপ করে তার শার্টের কলার ধরল রিক। একটানে তুলল মেঝে থেকে। মাঝারি আকারের লোক সে, কিন্তু রিকের কাছে নাদান শিশু। দুহাতে তাকে তুলে দরজার পাশের দেয়ালে আছড়ে ফেলল রিক। পরক্ষণে ওর হাঁটু নামল যুবকের উরুসন্ধির ওপর। এদিকে ডানহাতে বন্ধ করেছে কাছের কবাট। বার থেকে এল কজনের হৈ-চৈ শব্দ। বাইরে কী হচ্ছে বুঝেই ছুটে আসছে তারা। মাঝারি আকারের বাউন্সরকে ছাড়েনি রিক, নিজের আর চার যুবকের মাঝে তাকে রাখল ঢালের মত। চার যুবকের দুজনের হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। অন্য দুজনের হাতে ছোরা। কিন্তু একজনও ব্যবহার করতে পারল না অস্ত্র। তাদের মুখের ওপর ধুম্ করে কবাট বন্ধ করল রিক।

অকস্মাৎ হামলায় শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে মাঝারি বাউন্সার। তাতে হাল ছাড়ল না, বোকার মত ঘুষি চুড়ল রিকের চোয়ালে। মাথা নিচু করে নেয়ায় ঘুষিটা পড়ল দানবের মাথার চাঁদিতে। হাতের হাড় ভাঙল যুবকের, কিন্তু তখনই বদ্ধ দরজার ওপর বারবার তার মাথা ঠুকতে লাগল রিক। ওদিক থেকে এল চিৎকার, ঘুষি ও ধাক্কা। শুকনো কাঠের দরজা ভরে উঠল যুবকের তাজা রক্তে। কসেকেণ্ড পর রিক ছেড়ে দেয়ায় ভিজে নেতিয়ে যাওয়া ন্যাকড়ার মত মেঝেতে পড়ল মৃত যুবক।

দরজার বাইরে পোক্ত বোল্ট ও প্যাডলক। খদ্দেরদের জন্যে সামনে দরজা খুললে বোধহয় বন্ধ রাখে এদিকেরটা। পুরু ছিটকিনি লাগিয়ে দিল রিক, পরক্ষণে ক্লিক শব্দে আটকে গেল প্যাডলক।

এবার ঘুরে হেনিকে দেখল রিক।

শেষপর্যন্ত বন্ধুর তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে দলনেতা। কিন্তু হাঁটু সোজা করে দাঁড়াবার আগেই একহাতে তার গলা চেপে ধরল রিক।

চারপাশে কী হচ্ছে বুঝে ভীষণ ভয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে হেনির। সবার ভেতর সে সবচেয়ে শক্ত পেরেক। বারকয়েক ঢোক গিলে বলল, তুমি জানো, কার সঙ্গে লাগতে এসেছ?

তোকে মগ প্রেযেণ্ট করেছে যে মেয়েছেলে, মস্ত ভুল করেছে সে, আন্তরিক হাসল রিক। এবার দ্যাখ কী করি!

দুহাতে রিকের কবজি ধরে নিজেকে ছাড়াতে চাইল হেনি। কিন্তু ক্ষুধার্ত নেকড়ের চোয়াল থেকে মুক্তি নেই মোরগের। গায়ের জোরে না পেরে প্যান্টে গুঁজে রাখা পিস্তল বের করল হেনি। কিন্তু ওর কবজিটা ধরল রিক। রানাকেও এভাবে ধরেছিল বলে খুন হয়েছে ছোটভাই। দ্বিতীয়বার ভুল না করে প্রচণ্ড চাপ দিল হেনির পিস্তল ধরা কবজিতে। শুনল মুড়মুড় শব্দে গুঁড়ো হচ্ছে হাড়। দাঁতে দাঁত চেপেও হেনি ঠেকাতে পারল না বিকট, কর্কশ আর্তনাদ। প্রচণ্ড ব্যথায় বিকৃত হলো চেহারা। অবশ হাত থেকে খসে পড়ল পিস্তল। অন্যহাতে হেনির গলা টিপে ধরল রিক। মুচড়ে ভাঙল গলার কার্টিলেজ। যন্ত্রণায় ছটফট করছে হেনি, দুঠোঁটের কশ বেয়ে দরদর করে পড়তে লাগল তাজা রক্ত।

তুই কঠিন গজাল না; বরং শুকনো পাটকাঠির মতই পলকা, বলল রিক। গলা কাটা মুরগির মত ছটফট করছে হেনি। তাকে বারবেল তোলার মত করে দুহাতে মাথার ওপর তুলল রিক। টেরই পেল না টান পড়ছে কাঁধের জখমে। তিন গুনে গায়ের জোরে পাকা উঠানে আছড়ে ফেলল শক্ত পেরেককে। লাশের মত পড়ে থাকল বাউন্সর। নড়ছে না। নড়বেও না। স্থির দুই চোখ চেয়ে রইল আকাশের দিকে।

লাশের পকেট হাতড়ে পনেরো শ ডলার নিজের বুক পকেটে জল রিক। নিল লোকটার পিস্তল। মেয়েদের প্রিয় গ্লক উনিশ। পরে লাগতে পারে। হেনির চাবির গোছা নিল রিক, একটা চাবি দেখে হেসে ফেলল।

দুমিনিট পর পার্কিংলট থেকে বেরোল হেনির সাধের ক্যাডিলাক। একইসময়ে নাইট ক্লাবের সামনের দরজা খুলে ছিটকে বেরোল চার যুবক। তাদের অপমান করতে মাঝের আঙুল দেখাল রিক। পিস্তল তাক করল দুই যুবক, কিন্তু গুলি করল না। ঘুরে দৌড়ে গেল হেনির পাশে।

এবার ওদের কে বাউন্সার হবে, ভাবছে রিক। হয়তো আবার ফেরার সময় তাকে একটু বাজিয়ে দেখবে ও।

ক্যাডিলাক ছুটে চলেছে পুবে। ওদিকেই ডালাস।

গাড়িটা ট্যাঙ্কের মতই ভারী, প্রচণ্ড খাটনির জন্যে তৈরি। ঝড়ের বেগে পিছনে পড়ছে মাইলের পর মাইল। আনমনে ভাবল রিক, পেয়েছি অস্ত্র। ট্যাক্সির ভাড়া আর ড্রাইভারকে দেয়া টিপস বাদ দিলে গাড়ি ও অস্ত্রের জন্যে খরচ হয়নি এক সেণ্টও। হেনি অত লোভী না হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। কিন্তু ডলার বের করেই রিক বুঝেছে, সব কেড়ে নেয়ার লোভ সামলাতে পারবে না লোকটা। ওই লোভের কারণেই হারাল সব। অস্ত্র, টাকা, গাড়ি ও নিজের জীবন।

ক্যাডিলাকের গতি বাড়াল রিক। ৩৫ই রোড ধরে চলেছে। উত্তরদিকে। ৫৫ রুটে পৌঁছে পাশ কাটিয়ে গেল লিউইসভিল লেক ও কোরিহ্। চলেছে পুবের ডেণ্টন লক্ষ্য করে। ওখানে পৌঁছুলে যাবে পাইলট পয়েন্ট ও গ্রেসন কাউন্টি। আগেও শটগান হাতে ওদিকে গেছে। সঙ্গী ছিল শেরিফ ম্যাকলাস্কি। সেসময়ে উড়ে গেছে ময়নিহানের ব্যক্তিগত জেট বিমানে চেপে। অত গতি না পেলেও ক্যাডিলাকে আপত্তি নেই রিকের। দারুণ গাড়ি। ঠিক সময়ে পৌঁছে দেবে ক্ষুরধার ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে। ওখানে নিশ্চয়ই পাবে মাসুদ রানাকে।

.

২৭.

কাউন্টার-টেরোরিযম ট্রেনিঙের সময় আত্মরক্ষামূলক ড্রাইভিং শেখানো হয়েছে রানাকে। কিন্তু সেসময়ে ওর গাড়িটা ছিল বুলেটপ্রুফ সেডান, জিপ বা হামার। সে তুলনায় স্যাটার্ন গাড়িটা চাকাওয়ালা পনিরের মতই নরম। আততায়ী চাইলে গুলি না করে পাথর মেরেও বারোটা বাজাতে পারবে দশ বছর বয়সী পুরনো এই গাড়ির।

কপ্টারের লোকটা খুব আগ্রহী না হলেও ল্যাণ্ড রোভারের খুনি আপ্রাণ চেষ্টা করছে রানাকে গাঁথতে। ওদিকে ওর গতিরোধ করতে চাইছে কপ্টারের পাইলট। আরও নেমে এসে ভাবছে, বাধ্য করবে গাড়ি থামাতে। কিন্তু পুরো গতি তুলে কপ্টারের দিকে চলেছে রানা। ওর গো দেখে কপ্টার ওপরে তুলে নিল পাইলট। তাদেরকে বলা হয়েছে রানাকে খুন করতে, খুন হতে নয়।

রানা বুঝল, আশি মাইল বেগ আপাতত যথেষ্ট। পেছনে তেড়ে আসছে ল্যাণ্ড রোভার। সারা রাস্তাভরা গর্ত। জায়গায় জায়গায় মেরামতের চিহ্ন। তবে বড় গর্ত এড়াতে গিয়ে গতি কমিয়ে ষাট মাইলে নামাতে হচ্ছে, নইলে উল্টে পড়বে গাড়ি। খরগোসের মত লাফিয়ে ছুটছে স্যাটার্ন। পেছনে ছিটকে দিচ্ছে রাশি রাশি ধুলো ও নুড়িপাথর।

একের পর এক গুলি করছে ল্যাণ্ড রোভারের খুনি। তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় গুলিতে এন্তেকাল করেছে রানার গাড়ির পেছন কাঁচ। ঝাঁঝরা হয়েছে প্যাসেঞ্জার সিট। রানার উচিত পাল্টা গুলি করা। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। পাশের সিটে ওয়ালথার। একহাতে স্টিয়ারিং সামলে গুলি করা অসম্ভব। তীরের গতি তুলে পশ্চিমে চলেছে রানা। ওর চোখ খুঁজছে পছন্দমত জায়গা। এমন কোথাও যেতে হবে, যেখানে আত্মরক্ষা করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

সামনেই পড়বে পাইলট পয়েন্ট থেকে কলিন্সভিলে যাওয়ার দক্ষিণ হাইওয়ে ৩৭৭। কিন্তু আপাতত চারপাশে মাঠ ছাড়া কিছুই দেখছে না রানা। এদিকে-ওদিকে একটা দুটো ধূসর গাছ। কপ্টার বা ল্যাণ্ড রোভারের খুনিদের কাছ থেকে কাভার দেবে না। রানার চাই আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা ও ইটের দেয়াল। চারপাশে আছে শুধু ঘাসজমি, গাছ ও গরুর পাল।

উল্টে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাল রানা। স্পিড ডায়াল করল মোবাইল ফোনে। তিন সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে ধরতেই বলল, জলদি ফিরে আয়! জরুরি দরকার!

আসছি, জবাবে বলল জন।

বাড হিগিন্স গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়ায় চাকা ঘষার কর্কশ শব্দ শুনল রানা। স্যাটার্ন গাড়ির নিচে আলগা নুড়িপাথরের বিশ্রী কড়মড় শব্দ। গলা উঁচিয়ে বলল ও, পেছনে ল্যাণ্ড রোভারে দুজন। কপ্টারেও অন্তত আরও দুজন। সঙ্গে রাইফেল।

ফোন রেখে স্টিয়ারিং হুইল ঠিক করে নিল রানা। রওনা হয়েছে জন ও বাড। সমস্যা হচ্ছে: ওদের মাঝে ব্যবধান চার থেকে পাঁচ মাইল। রানা বুঝে গেল, বাঁচতে হলে ঠেকাতে হবে পেছনের লোকগুলোকে।

ধুলো ভরা রাস্তায় কড়া ব্রেক কষে রী-রী করা আওয়াজ তুলে থামল রানা। পিছলে গেল গাড়ির পেছনদিক। তাতে তৈরি হলো ধুলোর বিশাল মেঘ। একইসময়ে প্রচণ্ড বেগে গাড়ির পেছনে এসে তো মারল ল্যাণ্ড রোভারের গ্রিল। দুই সেকেণ্ড পর চাকা পিছলে এগোল স্যাটার্ন গাড়ি। বডির সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল চেপে ধরেছে রানা। পরের কয়েক সেকেণ্ডে তুমুল গতি তুলল গাড়িটা।

রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, ধুলোর মেঘের মাঝে রয়ে গেছে ল্যাণ্ড রোভার। তাতে খুশি হলো ও। এখনও ওকে দেখতে পায়নি লোকগুলো। আবার ব্রেক করল রানা। রাস্তা থেকে উঠছে ঘন ধুলো। ব্রেক করে গাড়ি অর্ধেক ঘুরিয়ে নিল ও। বেরিয়ে এল ওয়ালথার হাতে। পাঁচ ফুট সরার আগেই রকেট বেগে ধুলোর মেঘ থেকে এসে স্যাটার্নের ঘাড়ে চাপল ল্যাণ্ড রোভার।

আধ সেকেণ্ড রানার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল ড্রাইভার। স্যাটার্ন হালকা গাড়ি, চুরমার হলো ভারী গাড়ির ধাক্কায়। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের মত নানাদিকে ছুটল ধাতুর বড়সড় সব টুকরো। প্রাণের ভয়ে ছুটছে রানা, কিন্তু কাঁধে কী যেন ঠাস করে লাগতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। শরীর গড়িয়ে দিয়ে উঠে বসে তাক করল ওয়ালথার। সামনের দৃশ্য দেখে বিস্ফারিত হলো ওর চোখ।

স্যাটার্ন গাড়িতে গুঁতো মেরে ওটাকে ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে আকাশে নাক তুলেছে ভারী ল্যাণ্ড রোভার। উঠছে তীরের গতি তুলে। কিন্তু তিন সেকেণ্ড পর কাত হলো শূন্যে। পুরো একপাক ঘুরে দড়াম করে পড়ল রাস্তার পাশে। থামল না ভারী গাড়ি, গড়িয়ে চলে গেল পাশের মাঠে। ওটা থেকে খসে পড়ছে ধাতুর বড় বড় সব টুকরো। মাঠের মাঝে রাইফেল ওয়ালাকে দেখল রানা। কবার অস্বাভাবিক ভাঁজ খেয়েছে তার দেহ। ড্রাইভারকে দেখতে পেল না। তবে আশা করল, ওই লোকও আস্ত নেই।

শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। আকাশের দিকে তাকাল কপ্টার দেখতে। তবে চারপাশে শুধু ধুলোর মেঘ। ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্রী কটু গন্ধ। পুড়ছে ফিউয়েল, প্লাস্টিক ও মানুষের মাংস। কপ্টারের আওয়াজ শুনলেও ওটাকে দেখল না রানা। বুঝে গেল, ওকেও দেখছে না তারা। কুঁজো হয়ে ভাঙা ল্যাণ্ড রোভারের দিকে ছুটল রানা। সামনের মাটিতে চোখ, কিন্তু কোথাও নেই রাইফেলটা। গাড়ির সিট বেল্টে ঝুলে আছে ড্রাইভার। মুখ ভেসে গেছে রক্তে। ঘোলা চোখে পাগলাটে দৃষ্টি। পেরিফেরাল ভিশনে নড়াচড়া দেখে ঘুরে তাকাল রানার দিকে। মরার দশা, তবুও পাশের সিট থেকে তুলে নিল রিভলভার।

অচেনা লোক, পেশাদার খুনি। এসেছিল খুন করতেই। বাঁচলে ভবিষ্যতে খুন করবে অন্য কাউকে। দয়া এল না রানার মনে, হাতে গুলি না করে ফুটো করল তার কপাল। ঘুরে তাকাল রাইফেলওয়ালার দিকে। পনেরো গজ দূরে পড়ে আছে সে। আধপোড়া দেহ থেকে উঠছে কালচে ধোয়া। আরও সতর্ক হলো রানা। যে-কোনও সময়ে হাজির হবে যান্ত্রিক ফড়িং।

তিন সেকেণ্ড পর ওর ভাবনা বাস্তব করতেই যেন প্রায় ওর মাথা ছুঁয়ে ছুটে এল বেল রেঞ্জার। রোটর ব্লেডের জোরালো বাতাস টলিয়ে দিল ওকে। চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বিধ্বস্ত দুই গাড়ির ঘন ধোঁয়া। একদৌড়ে ল্যাণ্ড রোভারের আরেক দিকে গিয়ে কাভার নিল রানা। ওয়ালথারের দুটো গুলি গেঁথে দিল কপ্টারের আণ্ডারক্যারিজে। কোনও সুযোগ নেই পাইলটকে গুলি করার। তবে সে সরলে সুযোগ পাবে ও। পর পর দুই বুলেট কপ্টারে লাগতেই কাত হয়ে আরেক দিকে সরল পাইলট। থামল গিয়ে অন্তত এক শ গজ দূরে। আবারও ঘুরিয়ে নিল কপ্টার। দূরে রানাকে দেখে রাইফেল তুলে গুলি পাঠাল গানম্যান। বিধ্বস্ত ল্যাণ্ড রোভার ভেদ করে গেল বুলেট। কানের পাশে রানা টের পেল ওটার তপ্ত হাওয়ার ঝাপটা। আধবসা থেকে উঠেই গুলি পাঠাল রাইফেলওয়ালার উদ্দেশে। ঠিকভাবে তাক করা হয়নি, গুলি লক্ষ্যে লাগবে ভাবেনি রানা। তবে প্রাণের ভয়ে কপ্টারের আড়ালে লুকাল লোকটা। দৌড়ে ল্যাণ্ড রোভারের অন্যদিকে সরল রানা। দুসেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, সে জায়গা দিয়ে গেল বুলেট।

অপেক্ষায় থাকল রানা। গাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝ দিয়ে দেখছে কপ্টার। আবারও আসছে ওটা। শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে ওয়ালথার তাক করল ও। ঠিক সময়ে স্পর্শ করবে ট্রিগার।

কিন্তু হঠাৎ মাটির কাছে নেমে এল বেল রেঞ্জার। খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে নামল দুই লোক। দৌড়ে দুদিকে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে। হাতে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেল। মাযল তাক করেছে ল্যাণ্ড রোভারের পেছনে রানার দিকে।

এরা একই জায়গায় আটকে রাখবে ওকে, বুঝে গেল রানা। সে সুযোগে আরও লোক ও অস্ত্র নিয়ে আসবে কপ্টার পাইলট। এখন জানে, ওকেই খুঁজছে তারা। ময়নিহানের এলাকায় পাহারা দিচ্ছিল ল্যাণ্ড রোভারের লোকদুজন। কিন্তু রানা এদিকে আসতেই তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছে কপ্টার পাইলট। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দুজনের বদলে হামলা করবে ছয়জন মিলে। কোনও ঝুঁকি নেয়নি তারা।

জন আর বাড কোথায়, ভাবছে রানা। হয়তো এখনও ওরা কয়েক মাইল দূরে। আর কিছু ভাবার আগেই, মাঠের লোকদুজনের তরফ থেকে এল তুমুল গুলিবর্ষণ। ওর চারপাশে ছিটকে উঠছে ভাঙা ধাতুর ধারালো টুকরো। শুয়ে পড়ে শরীর গড়িয়ে সরে গেল রানা। আশা করছে ওকে গেঁথে ফেলতে পারবে না লোকদুটো। প্রচণ্ড বেগে যাওয়ার সময় বাতাসে ঝটকা তৈরি করছে বুলেট। ল্যাণ্ড রোভারের কঙ্কাল ঠেকিয়ে দিচ্ছে বেশিরভাগ গুলি, কিন্তু অন্যগুলো যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। রানার খুব কাছে বিঁধল কিছু বুলেট। বাধ্য হয়ে সরল ও। বুঝে গেছে, পড়েছে এমনই বাজে গাড়ায়, বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম।

দুই গড়ান দিয়ে রাস্তার পাশে অগভীর নালায় নেমে পড়ল রানা। দ্রুত ক্রল করে সরছে লাইন অভ ফায়ার থেকে।

ওদিকে এগোচ্ছে সতর্ক দুই গানম্যান। গুলি পাঠাচ্ছে। ল্যাণ্ড রোভারের দিকে। গুলি ঝাঁঝরা করল মৃত ড্রাইভারের লাশ। এ থেকে রানা বুঝল, খুন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শত্রুপক্ষ। আবারও আকাশে উঠে গেছে কপ্টার। ও মরল কি না দেখতে চাইছে পাইলট। সেক্ষেত্রে দলের লোকদুজনকে বলবে নিশ্চিন্তে এগোতে।

দুই দলে ভাগ হয়েছে শত্রুপক্ষ। রানা কপ্টার বা লোকদুটোর দিকে গুলি পাঠালে সবাই বুঝবে ও কোথায়। সেই সুযোগে আসবে অন্যদল। আবার চুপচাপ পড়ে থাকলে, এসে ওকে খুঁজে নেবে পাইলট। তখন দুদিক থেকে হামলা করবে দুই রাইফেলম্যান। পরিস্থিতি যেভাবেই দেখুক রানা, ওর বাঁচার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

নালা থেকে ঘাড় তুলে রাস্তা দেখল রানা। ভেবেছিল হয়তো ছুটে আসছে উইণ্ডস্টার মিনিভ্যান। কিন্তু ফাঁকা পড়ে আছে রাস্তা। অর্থাৎ, প্রাণে বাঁচতে হলে চাই নতুন কৌশল। এদিকে ফুরিয়ে এসেছে ওয়ালথারের বুলেট।

লিটল ফোর্কের রেস্টুরেন্টে মৃত লোকটার গ্লক সেভেনটিন হাতে নিল রানা। তৈরি হলো লড়াইয়ের জন্যে। নালা থেকে ঘাড় তুলে দেখে নিল চারপাশ।

ভাঙা ল্যাণ্ড রোভারের দিকে চলেছে কপ্টার। এবার গানম্যানরা জানবে ওদিকে নেই রানা। সতর্ক পায়ে আসবে তারা। তবে ধ্বংসস্তূপ থেকে ভলকে ভলকে উঠছে ধোঁয়া ও লাল-কমলা আগুনের শিখা। ওরা আপাতত রানার বন্ধু। কিন্তু চারপাশ পরিষ্কার করে দেবে কপ্টারের দমকা হাওয়া। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আরেক রাইফেলম্যান। রানার গুলি উড়িয়ে দিল তার কাঁধের একখণ্ড মাংস। হোঁচট খেয়ে কপ্টারে ঢুকল সে। তার আর্তনাদ শুনে ভয় পেয়েছে পাইলট। কন্ট্রোলে হ্যাঁচকা টান দিতেই বিপজ্জনকভাবে কাত হয়ে সরে গেল কপ্টার।

 রাইফেলওয়ালাকে খতম করলে সহজে কপ্টার নিয়ে ধারে কাছে আসবে না পাইলট, কিন্তু সেটা পারেনি রানা। ঘাড় সামান্য তুলে মাঠের লোকগুলোকে খুঁজল ও। তাদের একজন আছে ধোয়ার আড়ালে। অন্যজন ছুটে আসছে মাঠের আরেকদিক থেকে। এরা চাইছে দুদিক থেকে রানাকে কোণঠাসা করতে। রানা দুটো গুলি করতেই ভূমিশয্যা নিল লোকটা। রানার মতই শরীর গড়িয়ে সরে যাচ্ছে সে। থেমে গিয়ে গুলি পাঠাল রানার উদ্দেশে।

রানা বুঝে গেল, আর্মি থেকে ট্রেনিং পেয়েছে এ লোক। ওর পরের গুলি বিঁধল খুনির নাকের কাছের মাটিতে। ভয় পেয়ে ঝটকা দিয়ে সরে গেল সে।

ক্রল করে সরতে লাগল রানা। গলা শুকিয়ে গেছে ওর। নালার দুপ্রান্তে দুই খুনি হাজির হলে মহাবিপদ। আরও বড় বিপদ তৃতীয় কেউ কপ্টার থেকে গুলি পাঠালে। অনায়াসেই গেঁথে ফেলবে ওকে। কাছের লোকটা পুবে। নালায় ক্রল করে ওদিকেই চলল রানা। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর থেমে ঘাড় তুলে গুলি পাঠাল তার দিকে। কিন্তু ওর মতই সরে গেছে পেশাদার খুনি। এখন আছে আরও দশ গজ কাছে। পর পর কটা গুলি ছুঁড়ে গাঁথতে চাইল রানাকে। চারপাশের মাটি ও ঘাস ছিটকে উঠতেই চমকে উঠেছে বিসিআই এজেন্ট। বালি ঢুকেছে চোখে। ঝটপট শুয়ে পড়ল নালায়। নতুন করে টের পেয়েছে, ওই খুনি দক্ষ সৈনিক। আরেক গড়ান নিয়ে দেখল, সরাসরি নালার পাশ দিয়ে ছুটে আসছে দ্বিতীয় গানম্যান!

একইসময়ে পরস্পরের দিকে গুলি পাঠাল ওরা দুজন।

খুনির গুলি ঊরুর বাইরে ছ্যাকা দিলেও রানারটা বিঁধল তার পেটে। ছুটতে ছুটতে হুমড়ি খেয়ে মাঠে পড়ল সে। খুব বেশি দূরে নয়। হাত থেকে পড়ে গেছে অ্যাসল্ট রাইফেল। আহত হলেও খপ করে ধরল কোমরের পিস্তলের বাঁট। কিন্তু রানার পরের গুলি বিঁধল তার মাথায়। এক ঝটকা দিয়েই নিথর হলো নোকটা।

অ্যাসল্ট রাইফেলের দিকে ক্রল করবে ভাবছে রানা, এমনসময় মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দে গেল কপ্টার। তারই মাঝে শুনল ছুটন্ত পায়ের ধুপ-ধাপ আওয়াজ। নালার পাশ দিয়ে ছুটে আসছে অন্য খুনি। এখনও চিত হয়ে পড়ে আছে রানা। আকাশ বা মাঠ থেকে ওকে গেঁথে ফেলবে দুই গানম্যানের কেউ।

রানাকে খুন করা সহজ হবে মাঠের লোকটার জন্যে। মাথার পেছনে হাত নিয়ে ওয়ালথার ও গ্লক দিয়ে একইসঙ্গে লোকটার দিকে গুলি পাঠাল রানা। তাতে ভীষণ চমকে গিয়ে লাফিয়ে নালা পেরিয়ে গেল লোকটা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও হাজির হবে। বাঁচার উপায় নেই রানার।

ওর মাথার ওপর দিয়ে সগর্জনে গেল কপ্টার। দেরি না করে ওটার পেটে কয়েকটা গুলি গাঁথল রানা। মনোযোগ দিল মাঠের লোকটার দিকে। তাকে দেখল উঠে দাঁড়াতে। চোখে তৃপ্তি নিয়ে কাঁধে রাইফেল তুলেছে সে। এবার খুশি মনে স্পর্শ করবে ট্রিগার। কিন্তু পরক্ষণে তার চোখে-মুখে ফুটল দ্বিধা। পাশ ফিরে তাকাল সে। ঘুরিয়ে নিল অ্যাসল্ট রাইফেলের মাল।

এক সেকেণ্ডের এক শ ভাগের এক মুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো তার গোটা মাথা। হাই ভেলোসিটির গুলি চারদিকে ছিটকে দিল রক্তের ফোয়ারা।

নিশ্চয়ই জন ও বাড পৌঁছে গেছে, ভাবল রানা।

খুন হয়েছে পেশাদার খুনি, কিন্তু তার আগে টিপে দিয়েছে ট্রিগার। এম সিক্সটিনের বুলেট বিঁধল রাস্তার পাশে। ছিটকে উঠল মাটি। পরের সেকেণ্ডে হাঁটু ভাঁজ হতেই ধুপ করে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল খুনির লাশ।

আপাতত কপ্টারের রাইফেলওয়ালা ছাড়া আর কোনও বিপদ নেই। রানার চোখের আড়ালে গেছে কপ্টার। শুনতে পেল রাইফেলের গর্জন। তার জবাবে বুম! করে উঠল ভারী ক্যালিবারের পিস্তল। প্রায় একইসময়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার ছাড়ল কেউ। তিন সেকেণ্ড পর ধুপ করে মাঠে নামল ভারী কিছু। আবারও বু! করে উঠল পিস্তল। রানার মনে হলো বজ্রপাত হয়েছে কানের কাছে। তখনই পাল্টে গেল কপ্টারের ইঞ্জিনের আওয়াজ। উঠে বসে রানা দেখল, কাত হয়ে গেছে যান্ত্রিক ফড়িং। ফিউযেলাজ থেকে ভকভক করে বেরোচ্ছে ঘন কালো ধোয়া। উড়োজাহাজ চলেছে উত্তর দিকে। প্রতি মুহূর্তে হারাচ্ছে উচ্চতা।

রানা বুঝে গেল, যে-কোনও সময়ে ভূপাতিত হবে ওটা। সত্যিই কমুহূর্ত পর দূর থেকে এল পতনের জোরালো ফাঁপা আওয়াজ। টেক্সাসের আকাশে লাফিয়ে উঠল রাশি রাশি কালো ধোঁয়া।

বিপদমুক্ত হয়ে মৃদু হাসল রানা। ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে ঘুরে তাকাল জন ও বাডের দিকে।

কিন্তু তারা আশপাশে নেই।

তাদের বদলে কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয়েছে রিক বেণ্ডার!

.

২৮.

 মাসুদ রানার লাশ থাকবে পায়ের কাছে, এরচেয়ে বেশি কিছু চায় না রিক বেণ্ডার। খুনের আগে ভয়ঙ্কর ব্যথা দেবে মাসুদ রানাকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তেমন ভাল প্ল্যান তৈরি করেনি সে এখনও। ফালতু এলাকায় মাঠের পাশে অগভীর এক নালায় বসে আছে রানা। ওকে এভাবে এক গুলিতে খুন করলে নিজেই মনের দুঃখে মারা পড়বে রিক।

গাড়িতে করে আসার সময় কোনও পরিকল্পনা আসেনি মনে। লিটল ফোর্কে ম্যাকলাস্কি আর হোল্ডকে খুন করেছে জানলে, আর যাই হোক, দুহাত বাড়িয়ে ওকে কোলে টেনে নেবে না ময়নিহান। বরং রানাকে খুন করাতে যেসব লোক ডেকেছে, তাদেরকে লেলিয়ে দেবে রিকের পেছনে। অর্থাৎ, ওর উচিত নয় ক্ষুরধারের দরজায় কড়া নাড়া।

অথচ, ময়নিহানের সঙ্গে দেখা করার যথেষ্ট কারণ আছে। রিকের। ওই র‍্যাঞ্চেই জুডিকে রেখেছে লোকটা। আর লিটল ফোর্কে রানা দেখিয়ে দিয়েছে, সহজ বান্দা সে নয়। সুতরাং রিক বুঝে নিয়েছে, ওই লোক যাবে ময়নিহানের র‍্যাঞ্চে।

কিন্তু হঠাৎ এভাবে দেখা হবে, ভাবতে পারেনি রিক।

প্রথমে দেখেছে ধোঁয়া। তারপর কেউ মরবে সে আশায় যেমন আকাশে ঘোরে শকুন, সেভাবে ঘুরছিল ওই কপ্টার। ভাঙা রাস্তার নুড়িপাথর সরে যাওয়ার শব্দের মাঝে শুনেছে গোলাগুলির আওয়াজ। কী ঘটছে, বুঝতে অনেক বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়নি রিকের।

তুলেছে তুমুল গতি। দূরে দেখল, কপ্টার নেমে এসে পেট থেকে মাটিতে খালাস করল দুই লোককে। তাদের হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। দুদিকে সরে গেল তারা। গুলি করছে ভাঙাচোরা ল্যাণ্ড রোভারের ওপর। রাস্তার সামনে আরেকটা বিধ্বস্ত গাড়ি।

তখন পথের পাশে ক্যাডিলাক রেখেছে রিক। এমনভাবে এগিয়েছে, যাতে ওকে দেখতে না পায় কেউ। শেষ এক শ গজ দৌড়ে থেমেছে ধ্বংসস্তূপের কাছে। একসময় গাড়িটার কেমন চেহারা ছিল, বোঝার উপায় নেই। ওটাকে কাভার হিসেবে ব্যবহার করবে ভেবেছে রিক। মাঠের ওদিকে নালায় কাউকে খতম করতে অতিব্যস্ত ন্যাশ ময়নিহানের লোক। বারকয়েক রিক দেখেছে, নালা থেকে মাথা উঁচু করেছে কেউ। ক্রল করছে সে। ওর বুঝতে দেরি হয়নি, ওই লোক মাসুদ রানা না হয়েই যায় না। শক্তিশালী চুম্বকের মত ওকে টানছে নিকের খুনি শালা।

তখনই ভাঙা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে নালায় লাফ দিল এক গানম্যান। তাকে দেখেনি রানা। গুলি করছিল ওদিকের অন্যজনকে লক্ষ্য করে। আরেকটু হলে আড়াল থেকে উঠে ওই গানম্যানকে গুলি করে মারত রিক। কিন্তু সেসময় দেখল লোকটার বুক-পেট থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। দৌড়ের মধ্যে হুমড়ি খেল কিলার। আরেকবার গর্জে উঠল পিস্তল। মাটি থেকে আর উঠল না লোকটা। কপালে চড়ল রিকের ভুরু। যা ভেবেছে, তার চেয়েও বহু গুণ বিপজ্জনক লোক মাসুদ রানা!

নিজেও এত সহজে খুন করতে পারে না রিক। তখনই দেখল, তার সাধের শিকারের দিকে এম সিক্সটিন অ্যাসল্ট রাইফেলের মাযল তাক করছে আরেক কিলার। ওদিকে কপ্টারে চেপে রানার ওপর রাইফেল তাক করছে আরেক গানম্যান।

যে-কোনও সময়ে খতম হবে রিকের জীবনের চরম তৃপ্তির একমাত্র উৎস। সময় নষ্ট করল না সে। শালারা, ঠকাতে চাস আমাকে?

ওই, শালা! ধমক দিল রিক।

রাইফেল নিয়ে ওর দিকে ঘুরে তাকাল লোকটা। চোখে ফুটল ভয়। তার দিকেই চেয়ে আছে ডোর্ট ঈগল। এক গুলিতে লোকটার মাথা উড়িয়ে দিল রিক। মনে মনে বলল, আরে, দারুণ ভাল জিনিস বানিয়েছে তো শালারা!

কপ্টার থেকে সঙ্গীর লাশ দেখেছে গানম্যান। দুসেকেণ্ড পর বুঝল, ভাঙা গাড়ির আড়ালে কুঁজো হয়ে বসে আছে শত্রুপক্ষের কেউ। আরেক গুলিতে গানম্যানের পেট ফুটো করল রিক। করুণ এক চিৎকার ছেড়ে কপ্টার থেকে হুমড়ি খেল লোকটা। সাঁই-সাঁই করে নেমে এল মাটিতে। আস্ত হাড় বলতে কিছুই থাকল না তার।

ভীত চোখে রিককে দেখল পাইলট। বুঝে গেল, পালাতে হবে তাকে। কিন্তু বাঁচলে ময়নিহানের কাছে গিয়ে সব ফাঁস করবে পাইলট। তার দিকে আবার গুলি পাঠাল রিক। আগেই কন্ট্রোল নেড়ে কপ্টার ঘুরিয়ে নিয়েছে লোকটা। তাতে দমে গেল না রিক। ডের্ট ঈগলের কটা গুলি লাগল কপ্টারের ইঞ্জিনের কেসিং-এ। এবড়োখেবড়ো গর্ত থেকে বেরোতে লাগল ঘন কালো ধোঁয়া। মাঠের ষাট ফুট ওপর দিয়ে যেতে যেতে উচ্চতা হারাতে লাগল কপ্টার। তারপর হঠাৎ দুই ডিগবাজি মেরে সোজা নামল মাঠে। পরক্ষণে ফাপা এক জোরালো আওয়াজে ভাঙা ফড়িংটাকে ঘিরে ধরল লেলিহান আগুন।

খুব খুশি হলো রিক। ময়নিহানের কান ভারী করবে না পাইলট শালা। পোড়া, ভাঙা গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে চলল নালার দিকে। মাসুদ রানা আছে ওখানে। আরও সতর্ক হতে হবে। পিস্তল আছে ব্যাটার কাছে। কুত্তীর বাচ্চার নিশানাও ভয়ঙ্কর। তবে বাড়তি সুবিধে পাবে সে। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে না লোকটা।

কসেকেণ্ড পর সরাসরি রানার মাথায় পিস্তল তাক করল রিক। পিস্তল ফ্যাল, কুত্তার বাচ্চা!

দিনের আলোয় ভয়ানক কুৎসিত পিশাচ দেখছে, এমন চেহারা করেছে হতভম্ব রানা।

কী হলো, শুয়োরের বাচ্চা? শুনছিস না? দ্বিতীয়বার আর বলব না!

বড় করে শ্বাস নিলেও অস্ত্র নামাল না রানা। রিক নড়ে ওঠার আগেই ওর দিকে তাক করল দুই পিস্তল। সরাসরি শত্রুর দিকে চেয়ে আছে দুই কালো মাযল। উঠে বসল রানা। তুমিই বরং পিস্তলটা ফেলে দাও।

ধীরে ধীরে রিকের ঠোঁটে ফুটল হাসি। গুলি করলে মরবি, আমিও হয়তো মরব। কিন্তু তোকে এভাবে খুন করতে চাই না।

আর কোনও উপায় তো নেই, বলল রানা।

তো কী করা যায়, বল তো? পরস্পরকে গুলি করব?

 তাই তো মনে হচ্ছে, বলল রানা।

মাথা দোলাল রিক। তা ঠিক।

 গুলি করল না ওরা দুজনের কেউই।

রানার ওপর থেকে চোখ সরাল না রিক। তুই আমার ছোটভাইকে খুন করেছিস।

নইলে ও আমাকে খুন করত, বলল রানা। সুযোগ পেলে তুমিও বাঁচতে দিতে না আমাকে।

মাথা দোলাল রিক। মিথ্যা ভেবে লাভ নেই। একে খুন করতে পয়সা দিয়েছে ময়নিহান। তবে পরে ব্যাপারটা হয়ে গেছে ব্যক্তিগত। এক পা সামনে বাড়ল রিক। যে-কোনও সময়ে তোকে গুলি করতে পারি।

বদলে বুকে উপহার পাবে দুটো বুলেট।

তুই চাস এভাবে খুন হই আমরা দুজন?

খুশি হব তোমাকে শেষ করে নিজে বাঁচলে। মৃদু হাসল রানা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আপাতত সে উপায় নেই।

যা খুশি হোক, তাই চাস?

ক্ষতি কী?

তা হলে কী করবি? গুলি?

হয় গুলি করো, নইলে গ্যারেজে যেমন পালিয়েছিলে, তেমনি বিদায় হও এখান থেকে। ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়াল রানা। একবারের জন্যেও লক্ষ্য থেকে সরল না পিস্তলের মাযল। এক কাজ করতে পারো, আপাতত বিদায় হও। পরে কখনও লড়ব আমরা।

তাই করব ভাবছিস? আর সেই সুযোগে আমার পিঠে গুলি করবি তুই?

আমি কাপুরুষ নই, রিক। তা ছাড়া, আমি তোমার কাছে ঋণী। একটু আগে আমার প্রাণ রক্ষা করেছ।

বাঁচাতে চেয়েছি, যাতে তোর মাথা ছিঁড়ে নিতে পারি।

তা জানি। তবে আগেই তোমার মগজে বুলেট ঢুকলে খুন করার তৃপ্তি পাবে না।

কথাটা মনের ভেতর নেড়েচেড়ে দেখছে রিক। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, ঠিকই বলেছে লোকটা… মনে হয় শিক্ষিত লোক। ও হয়তো গুলি করল, কিন্তু তার আগেই ওকে গেঁথে ফেলল লোকটা। হয়তো জ্যামই হলো পিস্তল। সেক্ষেত্রে কীভাবে ব্যথা দিয়ে মারবে কুত্তাটাকে? নিজে মরতে আপত্তি নেই রিকের। বড় কথা হচ্ছে, সঙ্গে নিতে হবে হারামজাদাকে। কিন্তু সেটা পারবে, এমন কথা বলছে কে?

রাস্তার দূরে একটা কালো গাড়ি দেখল রিক।

 ঝড়ের বেগে আসছে ওটা।

রানার চোখে তাকাল রিক। তা হলে পরেই লড়ব আমরা, ঠিক?

হ্যাঁ, পরে, নিচু গলায় বলল রানা। খালি হাতে।

কথাটা খুবই পছন্দ হলো রিকের। হাসল। এক পা পিছিয়ে গেল সে, ওর দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে রানা। কাছে চলে এসেছে ইঞ্জিনের আওয়াজ। আরেকবার রানার চোখে তাকাল রিক, তারপর এক পা এক পা করে পিছাতে লাগল। গলা চড়িয়ে বলল, ময়নিহানের নোক আসছে। খবরদার, রানা! ওদের হাতে খুন হবি না! তুই কিন্তু শুধু আমার!

মনে থাকবে, মৃদু হাসল রানা। মনে পড়েছে পুরনো আমলের তুমি যে আমার বাংলা গানটির কথা।

বিধ্বস্ত ল্যাণ্ড রোভারের পাশে পৌঁছে ঘুরেই দৌড় দিল রিক। চলেছে লুঠ করা ক্যাডিলাকের দিকে। ভাবছে, এই বুঝি পিঠে বিঁধল বুলেট। আবার মনের অন্য অংশ বলছে: কাপুরুষের মত পেছন থেকে গুলি করে ওকে মারবে না মাসুদ রানা। বাউন্সার হেনির মত মিথ্যা বলার লোক নয় বাদামি কুত্তাটা। নইলে প্রথম সুযোগেই ওকে খুন করত জঙ্গলের ভেতর।

ক্যাডিলাকে চেপে বসল রিক। মুচড়ে দিল ইগনিশনের চাবি। গর্জে উঠল ভারী গাড়ি। ঘাড় কাত করে দেখল, ধুলো উড়িয়ে ঝড়ের বেগে কালো গাড়ি চলেছে রানার দিকে। বিড়বিড় করল রিক, খবরদার, খুন হবি না কিন্তু তুই!

ক্যাডিলাক নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে।

.

২৯.

 বড় দুটো ভুল করেছে রিক বেণ্ডার। যে দুই লোক গাড়ি নিয়ে আসছে রানার দিকে, তারা ন্যাশ ময়নিহানের লোক নয়। আগেই ফোর্ড গাড়িটা দেখে রানা বুঝেছে, মরিয়া হয়ে ফিরছে ওর বন্ধু জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স। দ্বিতীয় ভুল করেছে রিক ওকে খুন না করে। কষ্ট দিয়ে মারবে বলে ওকে আপাতত ছেড়ে দিয়েছে উন্মাদটা।

নিজেও কম ভুল করেনি রানা। উচিত ছিল দানবটাকে খুন করা। কিন্তু কাপুরুষের মত খুন বা খামোকা মিথ্যাচার ওর ধাতে নেই। প্রয়োজনে শত্রুর মুখোমুখি হবে, কিন্তু দৌড়ে চলে যাচ্ছে এমন কাউকে গুলি করবে না পেছন থেকে।

পিস্তল নামিয়ে ক্যাডিলাকটাকে বাঁক নিতে দেখল রানা। গাড়িটা ক্লাসিক মডেলের। চাকাওয়ালা পঙ্খিরাজ বললেও চলে। ওই জিনিস কোথা থেকে জোগাড় করল রিক, কে জানে! প্রচুর ধুলো উড়িয়ে বিদায় নিল লোকটা। ঘুরে চেয়ে বন্ধুদের গাড়ির দিকে হাত নাড়ল রানা।

কসেকেণ্ড পর ওর কাছে থামল জন ও বাড। দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। জনের হাতে পিস্তল গ্রিপসহ মসবার্গ শটগান। বাডের হাতে গ্লক সতেরো। গম্ভীর ওদের চেহারা। দেরি হবে না শত্রুকে গুলি করতে।

খেল খতম, দেরি করে ফেলেছিস, বলল রানা।

কী হয়েছে, রানা? চারপাশ দেখছে জন। চুরমার হয়েছে। দুটো গাড়ি। মাঠে জ্বলছে ভাঙা কপ্টার। লাশ ছয়জন লোকের। তোকে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্যে ছেড়ে গেলাম, আর এখন এসব কী দেখছি! চালাকি পেয়েছিস? সব মজা একাই লুটে নিচ্ছিস তুই!

চোখে না দেখলেও এখনও শোনা যাচ্ছে ক্যাডিলাকের ইঞ্জিনের ভারী আওয়াজ।

পালিয়ে যাচ্ছে কেউ, বলল বাড। উচিত হবে না ছেড়ে দেয়া।

এদিকের লোক নয়, বলল রানা। ওই লোক রিক বেণ্ডার।

বেণ্ডার? বলল জন, শেষ শুনেছি সে ছিল ময়নিহানের দলেই।

এখন আর তা নয়, বলল রানা। বিশ্বাস করিস বা না করিস, একটু আগে খুন হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ও আমাকে।

বলিস কী!

আর কেউ যাতে আমাকে খুন করে ফেলতে না পারে, গুলি চালিয়েছে ও ময়নিহানের লোকের ওপর এমন কী ফেলে দিয়েছে হেলিকপ্টার। সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে আমাকে নিজের হাতে খুন করতে চায়।

বদ্ধ উন্মাদ! চল, এবার ভাগি, বলল জন।

ঠিকই বলেছে, ভাবল রানা। উইণ্ডস্টারে চেপে বসল ওরা তিন বন্ধু। সামনের সিটে জন ও বাড, পেছনের সিটে রানা। সাবধানে স্যাটার্ন গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে রওনা হলো বাড। চলেছে সোজা পাইলট পয়েন্ট-এর দিকে।

কী হয়েছিল, প্রথম থেকে খুলে বলল রানা। শেষে যোগ করল, উপায় থাকলেও ওকে গুলি করে মারতে রাজি হয়নি রিক বেণ্ডার।

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়বে? জানতে চাইল জন।

ওটা ওর প্রাপ্য, বলল রানা।

ওর ভাইকে মেরেছিস বলে? মাথা নাড়ল বাড। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রানাকে। ব্যাটা তো বদ্ধ উন্মাদ! তুইও।

আমার প্রিয় কাউকে খুন করলে আমিও তাকে ছাড়তাম না, বলল রানা, তোরাও ছাড়বি না। একা লড়তে চাইছে। বলে ওকে দোষ দিচ্ছি না।

তুই ওর কাছে ঋণী নস, বলল জন। ওই দানবটাকে তো মানুষ বলেই গণ্য করা যায় না।

জানি, বলল রানা। হেসে ফেলল। ভাবা কঠিন, আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে রিক বেণ্ডার। তবে ওকে কথা দিতে হয়েছে আগেই কারও হাতে মরে যাব না কিছুতেই। ওর সঙ্গে লড়েই মরতে হবে আমাকে।

আসল কথাটা বল তো, রানা? ঘুরে তাকাল জন।

মৃদু হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ঠিক আছে, মিথ্যা বলব না, আমিও চাই ওকে হারিয়ে দিতে।

ওটা তো আস্ত গরিলা একটা! আঁৎকে উঠল জন। খুন হয়ে যাবি তো!

খুন হব কি না তা দেখতেই তো লড়ব, বলল রানা।

রানাটা পাগল হয়ে গেছে, গুঙিয়ে উঠল বাড। ওই গণ্ডার একাই আমাদের তিনজনকে আলুভর্তা করে দেবে!

সায় দিয়ে মাথা দোলাল জন।

নীরব থাকল রানা।

ছাড়া-ছাড়াভাবে তৈরি বাড়িঘরের মাঝ দিয়ে চলেছে, ওদের গাড়ি। দক্ষিণের ৩৭৭ হাইওয়েতে পড়ে চলল পাইলট পয়েন্ট লক্ষ্য করে। রিক বোরের গাড়ি দেখার জন্যে চারপাশে চোখ রাখল ওরা। কিন্তু অন্য কোনও দিকে চলে গেছে দানব।

একটু পর সরু শাখা-রাস্তায় পড়ল গাড়ি। দশ মিনিটে পৌঁছে গেল রে রবার্ট লেকের পারে। ওখানে একঝাড় প্রকাণ্ড ওক গাছের পেছনে ওদের ফিশিং কেবিন। এখানে বসেই জুডিকে উদ্ধার করার প্ল্যান করবে ওরা।

টেক্সান কর্তৃপক্ষের কারও সঙ্গে তোদের যোগাযোগ আছে? কেবিনের সামনে পৌঁছে জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল জন।

তবে চিবুক উঁচু-নিচু করল বাড।

একটু আগে র‍্যাঞ্চের কাছে যা ঘটেছে, এরপর ন্যাশ ময়নিহানের নাকের ডগা থেকে জুডিকে সরিয়ে নেয়া প্রায় অসম্ভব। অত্যন্ত সতর্ক থাকবে লোকটা। পরেরবার তার জমিতে হাজির হতে হলে, চাই নিখুঁত পরিকল্পনা। এদিকে হাতে সময় নেই। দেরি করলে দলের লোকদের গুছিয়ে নেবে টপ টেরর।

গোটা কয়েক রাইফেল দরকার, বাড, বলল রানা।

চাইলে দশটাও পেতে পারি, বলল বাড। তবে মনে হচ্ছে বিশেষ ধরনের রাইফেলের কথা ভাবছিস।

ঠিক, মনের কথা খুলে বলল রানা।

মাথা দোলাল বাড। কখন লাগবে?

 এখুনি।

তুড়ি বাজাল বাড। হেসে ফেলল। মাথা নেড়ে চুকচুক শব্দ করল জিভ দিয়ে। আমি ভাল ম্যাজিশিয়ান নই! তবে দেখি কী করা যায়।

রানা, কোনও প্ল্যান করেছিস? জানতে চাইল জন।

লেকের সবজেটে জলের দিকে চেয়ে বলল রানা, বারোটা বাজাব ন্যাশ ময়নিহানের মানসিক শান্তির।

.

বিপদ এড়াতে ডেণ্টন শহর ঘুরে এগিয়ে চলেছে রিক বেণ্ডার। পাশ কাটাল সিএইচ কলিন্স ফুটবল স্টেডিয়াম। ভাবছে এরপর কী করবে।

ভীষণ ব্যথা পেয়ে খুন হবে মাসুদ রানা… পুরনো কথা। কিন্তু একই কথা বার বার ভাবতে ভাবতে চলেছে রিক। তবে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য পাল্টে যাওয়ায় বুঝল, আবার চলেছে ইউনিভার্সিটি ড্রাইভের পশ্চিমে হাইওয়ে পঁয়ত্রিশের দিকে।

ডানে পড়বে বিশাল বার্গারের দোকান। আপাতত ওখানে থামবে সে। খিদে লেগেছে বলে নয়, তার দরকার পে-ফোন।

একটু পর বার্গারের দোকানের পার্কিংলটে গাড়ি ঢোকাল রিক। আশপাশে আছে কয়েকটা ভ্যান ও গাড়ি, কিন্তু ওগুলো ক্যাডিলাকের মত জমকালো নয়। রিক ঠিক করল, প্রথম সুযোগেই পাল্টে নেবে গাড়ির নাম্বার প্লেট। তবে সেজন্যে তাড়াহুড়ো করতে হবে না। মনে হয় না মামা লিলিয-এর কেউ গাড়ি চুরির কথা জানাবে পুলিশে। তবুও গাড়িটা রাখল দূরে এক ডাস্টবিনের পাশে। ঝুলছে নো পার্কিং লেখা সাইন বোর্ড। ওটা পাত্তা না দিয়ে ক্যাডিলাক থেকে নেমে আয়েস করে আড়মোড়া ভাঙল। লিটল ফোর্ক থেকে আনা সেই ওভারকোট এখনও পরনে। উচিত নয় ওটা ফেলে দেয়া। কাজে লাগছে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে। ওটা ভালভাবে জড়িয়ে নিল শরীরে। কোণ ঘুরে চলে গেল দালানের সামনে। হু-হু বইছে ঠাণ্ডা হাওয়া। যা খুঁজছে, পেয়ে গেল রিক। চারকোনা বাক্সের মত পে-ফোনের বুদ। ভেতরে ঢুকে ফোন করল সঠিক নম্বরে।

বেশ কবার রিং হওয়ার পর ওদিক থেকে রিসিভ করা হলো কল। হ্যালো?

আপনি নাকি, বস্?

রিক? জানতে চাইল ময়নিহান। রিক বেণ্ডার?

হ্যাঁ। আমি।

নীরব থাকল লাইন। রিক বুঝতে পারছে, ঝড়ের বেগে ভাবছে ময়নিহান। একটু পর বোঝা যাবে ও ফোন করে ভুল করেছে কি না। হয়তো এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

বেঁচে আছ, না? গুড! কণ্ঠ শুনে রিকের মনে হলো ময়নিহান খুশি। তবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। সবসময় খোশ মেজাজে থাকে নোকটা। পরক্ষণে কী করবে কেউ জানে না। আমি তো ভেবেছিলাম ম্যাকলাস্কি আর হোল্ডের সঙ্গে তোমাকেও মেরে ফেলেছে মাসুদ রানা।

হেসে ফেলল রিক। কেটে গেছে বিপদের কালো মেঘ। ময়নিহান জানে না ওই দুজনকে নিজেই খুন করেছে সে। পাইলটের কথাও ভাবতে হবে না। যোগাযোগ করার আগেই কপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মরেছে ওই কুত্তা। কেউ জানে না ময়নিহানের লোক মেরে সাফ করছে ও।

রেস্টুরেন্টে আমার ওপর ট্রাক চাপিয়ে দিয়েছিল হারামজাদা, জ্ঞান হারাই। যখন জেগে উঠলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে, হোল্ড বা ম্যাকলাস্কিকে বাঁচাতে পারিনি। পরে যখন সুস্থ লাগল, ততক্ষণে পালিয়ে গেছে মাসুদ রানা। তাই ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হওয়া উচিত তার পিছু নেয়া।

ওর পিছু নিয়ে এখানে এসেছ?

এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেছি। এরপর আটকা পড়লাম ব্লিযার্ডে। তবে জানতাম টেক্সাসেই আসছে লোকটা।

তা হলে তুমি এখন টেক্সাসে?

হ্যাঁ। কোথায় আছে বলল না রিক।

গুড, রিক। তো দেরি না করে চলে এসো। তোমাকে লাগবে আমার। আশপাশে এসে হাজির হয়েছে মাসুদ রানা।

আপনি জানেন সে কোথায় আছে?

না, তা এখনও জানি না। তবে বেশি দূরে নেই। চলে এসো, রিক। খুশি হব তোমাকে পাশে পেলে।

আপনি না আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়েছেন?

হ্যাঁ, ওরা পৌঁছে গেছে। ফিরেছে লিটল ফোর্ক থেকে। গম্ভীর হলো ময়নিহানের কণ্ঠ, ওদের কথা বাদ দাও, রিক। তুমি সবসময় ছিলে আমার কাছে সবার চেয়ে প্রিয়।  

কিন্তু, হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা, নিকের ব্যাপারে তোর কোনও দায় নেই, না? ভাবল রিক।

তুমি তো চাও মাসুদ রানাকে খুন করতে, ঠিক কি না?

কয়েক ঘণ্টার ভেতর র‍্যাঞ্চে পৌঁছে যাব, বস্।

 ভেরি গুড। চলে এসো।

কল কেটে দিল রিক। ভাবছে, কপালটা সত্যিই ভাল। তবে, বসের বাচ্চা জানে না, মাসুদ রানা আর ওর মাঝে পড়লে ওই শালাকেও বাঁচতে দেবে না সে!

.

৩০.

ঝকঝকে পরিষ্কার সবুজাভ জলের বিশাল লেক দেখলে মনে হয়, ওটার বয়স কোটি কোটি বছর। বাস্তবে, তৈরি করা হয়েছে উনিশ শ আশির দশকে। যে কমিশনার চেয়েছিলেন প্রেয়ারিতে পানি আসুক, তাঁর নামেই পরিচিত ওটা: রে রবার্ট লেক। আগে কখনও ভদ্রলোকের নাম শোনেনি, তবে অপূর্ব লেকটা দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জন্মেছে রানার মনে। জল প্রায় স্থির। তার ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের নীলে ভাসা সাদা মেঘ। যেন পৃথিবীর বুকে নেমেছে স্বর্গের ঘোট একটা টুকরো। তীরে ওক গাছের সারি। মগডালে কিচিরমিচির করছে হরেক জাতের পাখি। মৃদু শব্দে পাড়ে চুমু দিয়ে ফিরছে ছোট ঢেউ। বড় প্রশান্তিময় পরিবেশ।

জায়গাটা নিরালা প্রেমকানন হিসেবে চমৎকার। দূরে তাকাল ও। রো বোটে চেপে হৈ-চৈ করছে অল্প বয়সী দুই ছেলে। রানা ভাবল, জন বা বাডের জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করবে না ও। ওরাও একই কাজ করেছে আগে। কিন্তু ওই দুই ছেলের কেউ বোট থেকে পড়ে ডুবে গেলে, অন্যজন কি ডাইভ দেবে ওকে উদ্ধার করতে? আনমনে মাথা দোলাল রানা। হয়তো তাই করবে। বন্ধুর জন্যে এটা করে বন্ধুরা। কী অদ্ভুত পবিত্র বন্ধন!

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কেবিনে ফিরল রানা। এবার তৈরি করতে হবে ভাল কোনও প্ল্যান।

বিকেল গড়িয়ে গেলেও ধিকিধিকি জ্বলছে আকাশ। কেবিনের ভেতর ল্যাম্প জ্বেলেছে জন। একটু আগে ফিরেছে বাড। বিছানায় রেখেছে কাঠের দীর্ঘ ক্রেট।

ড্রাগুনভ স্নাইপার রাইফেল পেলাম না, রানাকে বলল বাড। তবে এ-দিয়েও কাজ চলবে। খুলে ফেলল ক্রেটের ডালা।

চোখ বোলাল রানা। ক্রেটে শুয়ে আছে ইউএস আর্মি এম টোয়েন্টিফোর বোল্ট অ্যাকশন স্নাইপার রাইফেল। প্রশংসার চোখে ওগুলো দেখল রানা। কেভলার ও গ্রাফাইট দিয়ে তৈরি স্টক। পিঠে ফিট করা হয়েছে লিউপোল্ড-স্টিউয়েন্স এম থ্রি আল্টা টেলিস্কোপিক সাইট। জানিয়ে দেবে বুলেটের পতন কেমন। আগেও ইউএস আর্মি ইশ্য রাইফেল ব্যবহার করেছে। বলে রানা ভাল করেই জানে, এই অস্ত্র দিয়ে একহাজার গজ দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব। ইন্টারনাল ম্যাগাযিনে আঁটবে পাঁচটা .৩০৮ উইনচেস্টার রাউণ্ড। মৃদু মাথা দোলাল রানা। যে-কোনও হিসেবে এসব অস্ত্র সত্যিই দারুণ।

কাজ চলবে বললেই হলো? ক্রেট থেকে একটা এম টোয়েন্টিফোর তুলে নিয়ে কাঁধে বাঁট ঠেকাল জন। কেবিনের আরেকদিকে তাক করল অদৃশ্য টার্গেটে। স্টিলের জ্যাকেট পরা বুলেট ছুঁড়লে দেয়াল ভেদ করে পৌঁছে যাবে লেকের ওদিকে। ওখানে কেউ থাকলে খুন হবে সে। এই মালের চেয়ে অনেক ভাল রাশানদেরগুলো।

বলা যায় না, বলল রানা, বড় কথা অস্ত্রগুলো জোগাড় করতে পেরেছে বাড।

চওড়া হাসল বাড। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর হয়ে গেল গম্ভীর। ধার করেছি। কথা দিয়েছি কাজ শেষে ফেরত দেব। আমার কিছু হলে তোরা ফেরত দিবি মালিকের কাছে। ও জানাল জয়েন্ট রিযার্ভ বেস ফোর্ট ওঅর্থের এক সার্জেন্টের নাম।

জেআরবি না নেভাল এয়ার স্টেশন? জানতে চাইল জন, স্নাইপার রাইফেল কেন?

ওখান থেকে মাঝে মাঝে উড়াল দেয় সিল ফোর্স, বলল বাড।

ময়নিহানের র‍্যাঞ্চ আর্মির দুর্গের মতই দুর্ভেদ্য হবে, ভাবছে রানা। বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা এক শ ভাগ। দলে ওরা মাত্র তিনজন। পাবে না অত্যাধুনিক অস্ত্র। দলের লোকের পেছনে থাকবে ময়নিহান। হামলা করলে করতে হবে দূর থেকে। ওদের লাগবে স্নাইপার রাইফেল। এই জিনিসই ওদের সেরা সম্পদ। রানা বুঝতে পারছে, যে কাজে নামছে, সেটায় সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। মনে মনে প্ল্যান গোছাতে শুরু করেছে, এমনসময় হঠাৎ করেই ওর পকেটে থরথর করে কেঁপে উঠল মোবাইল ফোন।

ওটা বের করে স্ক্রিন দেখে কল রিসিভ করল রানা, হ্যাঁ, কিছু বলবে?

ভালই দেখালে, বলল ন্যাশ ময়নিহান। খুশি হতাম ওখানে থাকলে। লড়লে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতই।

মোবাইল ফোনের স্পিকার চালু করল রানা।

ময়নিহানের কথা শুনবে বলে চুপ করে অপেক্ষা করছে। জন ও বাড।

তুমি থাকলে ভাল হতো, বলল রানা। তোমাকে শেষ করে ঝামেলা চুকিয়ে দিতাম।

তা হলে নাটকীয়তা থাকত না। খতম হয়ে যেত সব মজা। তুমি তাই চাও, রানা?

আমি তোমাদের নাটক বুঝি না, বলল রানা। স্রেফ শেষ করতে চাই নিজের কাজ।

পেয়েছ নিনা ভেঞ্চুরাকে?

জবাব দিল না রানা। ময়নিহান ভাল করেই জানে, ও আছে আঁধারে। নইলে আগেই যোগাযোগ করত।

তুমি তো এখনও সুন্দরী জুডিকে ফেরত চাও, তাই না? দারুণ লোভনীয় মেয়ে। চাপ দিয়ে জেনেছি, ওর ফোন এখন তোমার কাছে।

শুরু করল রানা, জুডির কোনও ক্ষতি হলে…

হেসে ফেলল ন্যাশ ময়নিহান। নরম সুরে বলল, যত দ্রুত নিনাকে হাজির করবে, ততই জলদি ফেরত পাবে জুডিকে। তাতে কমবে ওর বিপদ। যে-কোনও সময়ে ওর ওপর চড়াও হতে পারে রিক বেণ্ডার।

রিক বেত্তার?

হ্যাঁ, আমার দানব বন্ধু পৌঁছে গেছে। ভয়ঙ্কর ঘৃণা করে তোমাকে। সেজন্যে দোষ দেব না ওকে। খুন করেছ ওর ছোটভাইকে। অন্তর থেকে চাইছে তোমার হৃৎপিণ্ড কাঁচা চিবিয়ে খেতে।

নিক সাইকোপ্যাথ ছিল।

সহমত। পিয়োর সান অভ আ বিচ। তার ওপর আবার ট্যাড়া। তবুও তো ছিল রিকের ছোটভাই। তোমাকে বাগে না পেলে জুডির ক্ষতি করবে রিক, বুঝতেই পারছ।

নিনাকে চাইলে জুডির কাছ থেকে সরিয়ে রাখবে ওকে, বলল রানা।

কারও কথা শোনে না রিক, কাজেই বেশি দেরি কোরো না নিনাকে খুঁজে আনতে, হাসিখুশি ভাবটা বিদায় নিয়েছে ন্যাশ ময়নিহানের কণ্ঠ থেকে, আগামী কাল রাত পর্যন্ত সময় পাচ্ছ। এরপর টুকরো করে তোমার কাছে পৌঁছে দেব জুডিকে।

আগামীকাল রাতে দেখা হবে, কল কেটে দিল রানা।

চুপচাপ শুনেছে জন ও বাড। এবার একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল ওরা। ওদের মূল কথা: রানার উচিত ছিল ময়নিহানকে জানানো, লড়াইয়ে তার লোকদের খুন করেছে। রিক বেণ্ডার।

জবাবে রানা বলল, ওকে খুন করাত ময়নিহান।

সেটাই উচিত ছিল, বলল জন। কমত একটা শত্রু।

ব্যাপারটা কী, রানা? বলল বাড, তুই মেয়েটাকে সরিয়ে আনতে চাস, নাকি আগে তোর চাই রিক বেণ্ডারের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা?

চুপচাপ বন্ধুর দিকে চেয়ে আছে রানা।

লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকাল বাড।

জরুরি কারণে রিকের কথা ময়নিহানকে জানাইনি, বলল রানা। মিথ্যা বলছে লোকটা। রিক বেণ্ডার জুডির ওপর রেগে উঠবে, এমন কোনও কারণ তৈরি হয়নি। তা ছাড়া, ভুলে যাস্ নে, জুডি ময়নিহানের দামি জিম্মি। ওর জন্যে আড়াল থেকে বেরোতে বাধ্য হবে নিনা ভেঞ্চুরা।

কিন্তু রিক বেণ্ডারের ব্যাপারে চুপ থাকলি কেন? জানতে চাইল জন।

ভাল কথা বলেছে ময়নিহান, বলল রানা, নিজ মতে চলে রিক বেণ্ডার। তবে ময়নিহান জানে না, প্রয়োজনে বসের কথাও শুনবে না সে। এ-ও জানে না, তাদের পেছনে আমাদের পক্ষে কাজ করছে বিপজ্জনক দানব। এবার বের করতে হবে, কীভাবে তাকে কাজে লাগানো যায়।

তা হলে তুই ভাবছিস, নিজেকে তুই ওর হাতে তুলে দিবি জানালে, প্রয়োজনে জুডিকে আমাদের হাতে তুলে দেবে সে? জানতে চাইল বাড।

তা মনে হয় না, বলল রানা। ওকে ওভাবে কাজে লাগাতে গেলে খুন হবে মেয়েটা।

তা হলে ওকে দিয়ে কীসের লাভ হবে? বলল জন।

যখন নিনা আর জুডিকে বিনিময় করব, ওখানে থাকবে রিক। আমার ভুল না হলে, বাড়তি হুমকি হিসেবে ওকে রাখবে ময়নিহান। জুডির নিরাপত্তার দায়িত্ব পাবে সে। কিন্তু মনোযোগ থাকবে ওর আমার ওপর। তাকে রাগিয়ে দিলে পাব বাড়তি সুবিধে।

ভাবছিস, সে সুযোগে আমরা সরিয়ে ফেলব জুডিকে? বলল বাড।

অনেক বেশি যদি বা হয়তো ভরা প্ল্যান, আপত্তির সুরে রানাকে বলল জন।

আপাতত এ ছাড়া উপায় নেই, স্বীকার করল রানা। আরও কিছু বলতে গিয়ে দেখল দপদপ করছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। ওটা দেখে মৃদু হাসল রানা। ওই যদি বা হয়তোছাড়া জীবনটাই অর্থহীন।

ন্যাশ ময়নিহানের পর এবার কল করেছে নিনা ভেঞ্চুরা!

<

Super User