ভয়ঙ্করের মুখোমুখি – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

ঘণ্টা বাজার আগেই ঝন্টুর পরীক্ষার খাতা লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। ভূগোল পরীক্ষা নিয়ে কখনও ওর মাথা ব্যথা থাকে না। তবে ভালো মতো রিভাইজ না দিতেই পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা বাজলো। এমনিতে প্রথম পাঁচজনের ভেতর প্লেস না থাকলেও ভূগোলের জুলিয়ান স্যার ওর আঁকা ম্যাপ ক্লাসের ফার্স্ট সেকেণ্ড বয়দের দেখিয়ে বলেন, এস এস সিতে ভূগোলে যদি নব্বইয়ের ওপর নম্বর তুলতে চাও ঝন্টুর মতো ম্যাপ আঁকতে শেখো। সামনে কিছু না বললেও আড়ালে ফার্স্ট বয় আতিক আর সেকেণ্ড বয় বিমল মুখ বাঁকিয়ে বলে, ভারি তো ম্যাপ আকিয়ে! তাও যদি কোনওবার ফিফথও হতে পারতো।

বাড়িতে ঝন্টুর বাবা কখনও ফাস্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য আতিক আর বিমলের বাবার মতো হইচই করেন না। ঝন্টুর বাবা বলেন, আশির ঘরে নম্বর পেলেই আমি খুশি। তা তুই ফাস্ট হলি না লাস্ট হলি তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

ঝন্টুদের মিশনারি স্কুলের পড়াশোনার এমন কড়াকড়ি যে, ক্লাস এইট, নাইন, টেন-এ যারা দশের ভেতর থাকে তাদের কারও নম্বরই গড়ে আশির কম নয়।

ঘন্টা বাজার পর খাতা জমা দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো ঝন্টু। ওদের সিট পড়েছিলো জুবিলি স্কুলে। স্কুল জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ওর মনে হলো বুকের ওপর থেকে হিমালয়ের মতো ভারি একটা বোঝা নেমে গেছে। গত একটা বছর কী ধকলই না গেছে ওদের ওপর দিয়ে। নাইনে থাকতে সারা স্কুলের কর্তা ছিলো ওরা। পিকনিক, মিলাদ, সরস্বতী পুজো কিংবা সায়েন্স ফেয়ার সব কিছুর তদারকি করে নাইনের ছেলেরা। টেনে ওঠার পর সব বন্ধ। মাথার ওপর তখন এস এস সির তলোয়ার ঝোলানো থাকে। স্কুলের পর ওদের কোচিং ক্লাস, কারও আবার বাড়িতে দু তিনটে টিচার আসেন–দম ফেলার সময় থাকে না। জানে একটু বেতাল হলে স্টার কেন, ফার্স্ট ডিভিশনেও নাম থাকবে না। আর এসএসসিতে ওদের স্কুলের যে সব ছেলের ফার্স্ট ডিভিশন থাকে না, তারা লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারে না। দু বছর আগে এক ছেলে সেকেণ্ড ডিভিশন পেয়ে ঘুমের বড়ি-টড়ি খেয়ে এক কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিলো।

ঝন্টুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সুমন বললো, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলি?

ঝন্টু নির্লিপ্ত গলায় বললো, না পারার কী আছে! ও সুমনের কাছ থেকে অন্য কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

একটু পরে সুমন সেই কথাটা বললো, রবিকে আসতে বলবো?

ঝন্টু মুখে একটা নিরাসক্ত ভাব এনে বললো, ও কি আসতে চাইছে?

বারে তোকে সকালে বললাম না রবি তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়!

স্কুলের বন্ধুদের ভেতর রবি সবচেয়ে কাছের হলেও ওর সঙ্গে ঝন্টুর ঝগড়াও হয় বেশি। মাস ছয়েক আগে জুবিলি স্কুলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে রবি নাকি ইচ্ছে করে ঝন্টুকে পাস না দিয়ে নিজে মারতে গিয়ে নির্ঘাত গোলটা নষ্ট করেছে। খেলায় যদিও ওরা জিতেছিলো, খেলার পর ঝন্টু রবিকে কথা শোনাতে ছাড়ে নি আমার হ্যাটট্রিক হবে, সেটা বুঝি তোর সহ্য হচ্ছিলো না!

রবিও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নয়–ভারি তো এলেন হ্যাটট্রিক করনেওয়ালা। তোকে যে ওদের লেদু মার্কিং-এ রেখেছিলো এটুকু খেয়াল নেই, তুই করবি হ্যাটট্রিক!

লেদুর মতো দু তিনটেকে ডজ দেয়া কোনও ব্যাপারই না।

থাক থাক, দেখা আছে! ফার্স্ট হাফে পেনাল্টি মিস করে বড় বড় কথা বলিস না।

ওয়ার্ল্ড কাপের স্টাররাও পেনাল্টি মিস করে।

তবে আর কী। ওয়ার্ল্ড কাপে খেললেই পারিস।

রবির বাঁকা বাঁকা কথা শুনে ঝন্টুর মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিলো–তোকে টীমে রাখলে আমি আর খেলবো না–এই বলে রাখলাম।

তোর সঙ্গে খেলতে আমার বয়ে গেছে।

আমার সঙ্গে আর কথা বলবি না তুই।

তোর সঙ্গে কথা না বললে বুঝি আমার ভাত হজম হবে না? নাকি রাতে ঘুম হবে না?

দুদিন পরই তো ভাব জমাতে আসবি!

বয়ে গেছে তোর সঙ্গে ভাব জমাতে।

শেষের দিকে কথা বলতে গিয়ে ঝন্টুর গলা ধরে এসেছিলো, চোখ ফেটে কান্না আসছিলো। রবি ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারে এটা ও ভাবতেও পারেনি।

পরদিন ছুটির পর ঝন্টুর নাকের ডগা দিয়ে বিমলের সঙ্গে গলাগলি করে বাড়ি গেলো রবি। অন্য দিন ঝন্টুর জন্য দরকার হলে এক ঘন্টাও দেরি করে। ছুটির পর ঝন্টুর স্কাউটিং ক্লাস থাকে। রবি বকুল তলায় বসে ঝন্টুর পিটি প্যারেড আর অন্য সব কসরৎ দেখে। তারপর দুই বন্ধু এক সঙ্গে বাড়ি ফেরে।

স্কাউটিং-এর সুবাদে সুমনের সঙ্গে ঝন্টুর বন্ধুত্ব হয়েছে। তবে সুমন পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে, গাড়িতে করে স্কুলে আসে যায়, ঝন্টু ওকে রবির মতো ভাবতে পারে না। সুমনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে ঝন্টুর লাভ হয়েছে গল্পের বইয়ের ব্যাপারে। সুমনের ঘরে আলমারি ভর্তি বাংলা-ইংরেজি এ্যাডভেঞ্চার আর রহস্যের বই যা ঝন্টু পেলে গোগ্রাসে গেলে।

তবু রবির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করার পর সুমনই ওর কাছের বন্ধু। টিফিন পিরিয়ড ও রবিকে দেখিয়ে সুমনের সঙ্গে কাটায়। আর রবি ছুটির পর বিমলের কাঁধে হাত রেখে বাড়ি যায়। মাঝে মাঝে ঝন্টুর বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কারণ স্কাউটিং ক্লাসের পর ওকে বাড়ি ফিরতে হয় একা।

জুবিলি স্কুলের সঙ্গে খেলার এক সপ্তাহ পরে ঝন্টুদের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ ছিলো পগোজ স্কুলের সঙ্গে। খেলার দুদিন আগে ওদের ফুটবল ক্যাপ্টেন কামাল বললো, রবি যদি না খেলে তুই খেলবি তো ঝন্টু?

ঝন্টু বললো, রবি খেলবে না কেন?

তোকে টিমে রাখলে ও খেলবে না বলছে।

ওকে নিলেই তো পারিস?

তোর চেয়ে কি ও ভালো খেলে?

ও তো তাই মনে করে।

ও মনে করলে তো হবে না। আমি ক্যাপ্টেন। আমি রবিকে বলে দিয়েছি তুই খেলবি।

প্রথমে ঝন্টু খুব উত্তেজিত ছিলো রবিকে জব্দ করতে পেরেছে বলে। পরদিন প্র্যাকটিসের সময় ওর মনে হলো এতদিন রবির সঙ্গে খেলে দুজনের যে বোঝাঁপড়া হয়েছে সেটা মনিকে দিয়ে হবে না। প্র্যাকটিসের পর কামালকে জানিয়ে দিলো পগোজ স্কুলের সঙ্গে ও খেলবে না।

কামাল অবশ্য এ নিয়ে বেশি উচ্চ বাচ্য করে নি। কদিন ধরে টিফিনে মোগলাই পরোটা খাইয়ে সবুজ ওকে পটাচ্ছে স্ট্রাইকারের পজিশনে একটা চান্স দেয়ার জন্য। রবির জায়গায় মনিকে নামিয়েছে কামাল। ঝন্টুর জায়গায় সবুজকে নিলো। খেলার দিন মনি খুশি হয়ে কামালকে একটা টি শার্ট প্রেজেন্ট করে বসলো, যদিও খেলায় ওরা এক গোলে হেরেছিলো। তবে ফ্রেণ্ডলি ম্যাচ বলে রবি আর ঝন্টুর না খেলার ব্যাপারটাকে কেউ সিরিয়াসলি নেয়নি।

ঝন্টু চান্স পেয়েও কেন খেললো না–রবির খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো। সুমনকে ঝন্টু প্র্যাকটিসের দিনই বলেছিলো রবিকে ছাড়া ওর খেলতে ইচ্ছে করছে না। সুমনের কাছে পরে কথাটা শুনে রবির মনে হলো ঝন্টু ছাড়া আসলেই ওর কোনও বন্ধু নেই। তার পর থেকে যত দিন যাচ্ছিলো কিভাবে ঝন্টুর সঙ্গে ভাব করবে তাই নিয়ে ভাবছিলো রবি। ক্লাস নাইনে থাকতে একবার এরকম হয়েছিলো। সাত দিন না যেতেই ঝন্টুর খাতার ভেতর ও চিঠি রেখেছিলো–তোর সঙ্গে ভাব করতে চাই, লিখে। রবি একবার ভেবেছিলো ঝন্টুকে চিঠি লিখবে। পরে এরকম চিঠি লেখাটা ওর ছেলেমানুষি মনে হয়েছে। কী করবে কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে সুমনকেই ধরেছিলো ঝন্টুর সঙ্গে ভাব করিয়ে দেয়ার জন্য। সুমন বলেছে, পরীক্ষা শেষ হলে বলবে।

সেদিন সকালে সুমন যখন কথাটা পাড়লো ঝন্টুর ইচ্ছে হলো দোয়েল পাখি হয়ে আকাশে ডিগবাজি খেতে। পরীক্ষার পড়া তৈরি করার ফাঁকে ও নিজেও ভাবছিলো কেমন করে রবির সঙ্গে ভাব করা যায়। পরীক্ষার পর তিন মাস সারা জীবনের সেরা ছুটি। রবিকে ছাড়া লম্বা ছুটি ও কাটাবে কি ভাবে? তারপরও সুমনকে ওর মনের ভাব বুঝতে দেয়নি। নির্লিপ্ত গলায় শুধু বলেছে, পরীক্ষা আগে শেষ হোক।

পরীক্ষার পর সকালের জের ধরে কথাটা ঝন্টুর কাছে আবার পাড়লো সুমন। বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বললো না ঝন্টু। ওর মনের ভাব বাইরে প্রকাশ পেলে সুমন আদেখলে ভাবতে পারে। কথাটা দ্বিতীয়বার বলার পর ঝন্টু বললো, ঠিক আছে, আসতে বল রবিকে।

ঝন্টুকে বকুল তলায় রেখে সুমন গেলো রবিকে ডাকতে। শেষ পরীক্ষা দিয়ে সবাই বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে। মিনিট দশেকের ভেতরই স্কুল প্রায় খালি হয়ে গেছে। রবি একা দাঁড়িয়েছিলো ফুটবল খেলার মাঠের কাছে। সুমন ওকে বললো, রবি চল, ঝন্টু তোকে ডাকছে।

রবির বুকের ভেতর তখন প্রচণ্ড উত্তেজনা। কান খাড়া করলে সুমন ওর হার্টবিট শুনতে পেতো। উত্তেজনা চেপে রবি জানতে চাইলো, সত্যি সত্যি ডাকতে বলেছে, না তুই বানিয়ে বলছিস?

গেলেই বুঝবি ও ডাকছে না আমি বানিয়ে বলছি!

চল, গিয়ে দেখি। নিজেকে ওর প্রজাপতির মতো হালকা মনে হলো।

ঝন্টুর কাছে গিয়ে রবি কী বলবে ভেবে কিছু ঠিক করতে পারলো না। মনে হলো সব কথা দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে আছে। ঝন্টুর চোখে চোখ পড়তেই রবি আরও গুটিয়ে গেলো। সুমন অবাক হয়ে বললো, তোরা কথা বলছিস না কেন?

ঝন্টু দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো রবির দিকে–তোর সঙ্গে সেদিন খুব খারাপ ব্যবহার করেছি রবি। আমি দুঃখিত।

ঝন্টুর হাত চেপে ধরে রবি ধরা গলায় বললো, আমি নিজেও অনুতপ্ত ঝন্টু। আর কখনও এমন হবে না।

সুমন হেসে বললো, বাহ, ভাবতো হয়েই গেলো। তোরা বোস। আমি বাদাম কিনে আনি।

সুমনের স্কুলের গেটের পাশে বাদাম ওয়ালার কাছ থেকে বাদাম কিনতে গিয়ে চোখে পড়লো রাস্তার ওপাশে ওদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার রাজা আলি নিবিষ্ট মনে খবরের কাগজ পড়ছে। বাদাম কিনে সুমন রাস্তা পেরিয়ে রাজাকে গিয়ে বললো, বাবা কখন গাড়ি চেয়েছেন?

রাজা ওর হাত ঘড়ি দেখে বললো, আইজ তিনি অফিসে লাঞ্চ খাইবেন। বলছেন ঠিক পাঁচটায় যাইতে।

রাজা আলীকে প্রথম দেখে সুমনের মনে হয়েছিলো ওর মতো একজন সুদর্শন যুবক সিনেমায় না নেমে ড্রাইভার কেন হলো। মনে হয়েছে ও কখনও ছবিতে চান্স পাবে না কথার গ্রাম্য টানের জন্য।

সুমন ওকে বললো, তাহলে আমি এক ঘন্টা পরে যাবো।

আপনের ইচ্ছা হইলে থাকেন। বলে রাজা খবরের কাগজে মন দিলো।

সুমন বাদাম নিয়ে বকুল তলায় এসে দেখে রবি আর ঝন্টুর মুখে কথার ফুলঝুরি আর হাসির ফোয়ারা। সুমন মুখ টিপে হেসে বললো, ছ মাসের জমে থাকা কথা কি এক দিনে শেষ হবে?

ঝন্টু হাসতে হাসতে বললো, রবিকে বলছিলাম এত লম্বা ছুটি ও কিভাবে কাটাবে। বলে ন্যাড়া হয়ে নাকি ঘরে বসে থাকবে।

সুমন অবাক হয়ে বললো, ন্যাড়া হবি কেন রবি? বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছে নেই তো?

আরে না! লজ্জা মেশানো গলায় রবি বললো, সেজো ভাইয়ের মাথার চুল সব পড়ে যাচ্ছে। বাবা বলেছেন ওকে ন্যাড়া হতে। ভাইয়া বায়না ধরেছে আমি যদি ন্যাড়া হই, তাহলেই ও ন্যাড়া হবে। আমি বলেছি, হতে পারি একশ টাকা পেলে। ভাইয়া রাজী হয়ে গেছে।

ঝন্টু আদুরে গলায় বললো, তোর ভাইয়াকে বল না রবি, আমি পঞ্চাশ পেলেই রাজি!

কী জন্য রাজি?

ন্যাড়া হতে।

ঝন্টুর কথা শুনে রবি আর সুমন এক সঙ্গে হেসে উঠলো। হাসির শব্দে বকুল গাছ থেকে এক ঝাঁক চড়ুই উড়ে গেলো। জুবিলি স্কুলের দপ্তরি বুড়ো কৃষ্ণপদ কোথায় যেন যাচ্ছিলো। ছেলেদের হল্লা দেখে বিরক্ত হলো পরীক্ষা শ্যাষ, বাড়ি না গিয়া বড় যে ইশকুলে বইসা রইছ?

কৃষ্ণপদকে ওরা সবাই চেনে বদমেজাজি ভালো মানুষ হিসেবে। সুমন হাসতে হাসতে বললো, মনেই হচ্ছে না আমাদের স্কুল লাইফ শেষ হয়ে গেছে। বাদাম খাবে কেষ্টদা?

আমারে পোলাপান পাইছ, বড় যে বাদাম খামু?

রবি বললো, একটার ঘন্টা বাজলেই আমরা বাড়ি যাবো।

কৃষ্ণপদ আপন মনে বক বক করতে করতে চলে গেলো। সুমন বললো, ছুটি কাটানোর কথা বলছিলি। তোরা কি কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করছিস?

রবি ঠোঁট উল্টে বললো, বললেই কি যাওয়া যায়? বাবা বলেছেন বেড়াতে ইচ্ছে করলে গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে।

ঝন্টু বললো, তিন মাস লাগবে রেজাল্ট বেরুতে। এ কদিন কি ঘরে বসে মাছি মারবো?

তুই কি করবি?

করার কিছু ভাবিনি বলেই তো জানতে চাইছি কারও মাথায় কোনও প্ল্যান আছে কি না।

সুমন বললো, তোরা কি দুজনে মিলে কিছু করতে চাইছিস, না আমিও নাক গলাবো?

ঝন্টু গম্ভীর হওয়ার ভান করলো–তোর নাক ক্লাসে সবার চেয়ে বড়। যেখানে ইচ্ছে তুই নাক গলাতে পারিস।

শুধু যদি বের করার কায়দা জানিস। যোগ করলো রবি।

সুমন হেসে বললো, ভালো হয় বিকেলে যদি আমাদের বাড়িতে আসিস। তিন জন মিলে এর ভেতর ভেবে ঠিক করবো ছুটির দিনগুলোতে কী করা যায়। আসবি তো?

আসতে পারি, যদি তোর মার হাতে বানানো সেদিনের মতো সিঙাড়া খাওয়াস। এই বলে ঝন্টু রবির দিকে তাকালো, এত মজার সিঙাড়া তুই জীবনেও খাসনি।

ঠিক আছে মাকে বলবো। সুমন উঠে দাঁড়ালো–তোরা কি আরও বসবি? আমার গাড়ি এসে গেছে।

ঝন্টুও উঠে পড়লো–বিকেলে তোর বাড়িতে যেতে হলে এখন আর গেঁজিয়ে কী লাভ!,

সুমন চলে যাওয়ার পর রবি আর ঝন্টু বহু দিন পর আগের মতো একে অপরের কাঁধে হাত রেখে বাড়ির পথে রওনা হলো। কাগজিটোলা হেঁটে যেতে মিনিট পনেরো লাগে। গলির ভেতর তিন নম্বর বাড়ি ঝন্টুদের, আর সাত নম্বর হচ্ছে রবিদের।

হাঁটতে হাঁটতে ঝন্টু বললো, আমার মনে হচ্ছে কতদিন তোর সঙ্গে কথা বলি না!

মৃদু হেসে রবি বললো, ভাগ্যিস সুমন ছিলো। নইলে কতদিন এভাবে থাকতে হতো কে জানে! সুমনের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতায় ওদের মন ভরে গেলো।

ঝন্টুদের বাড়িতে মানুষ মাত্র তিনজন। ঝন্টু, ওর বড় বোন ঝুমনি, যে জগন্নাথ কলেজে বাংলায় থার্ড ইয়ার অনার্সে পড়ে আর ওদের বাবা আরিফ আহমেদ, যিনি জগন্নাথে ইংরেজি পড়ান। ঝন্টুর মা মারা গেছেন ও যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাবা আর বুমনি দুজনের আদর কখনও ওকে মার অভাবের কথা মনে করতে দেয় নি।

রবিদের বাড়িতে চার ভাই তিন বোনের ভেতর ও সবার ছোট। ওর বাবা জজকোর্টে ওকালতি করেন, সংসার মন্দ নয়। রবির জন্মের পর থেকে ওর মা নানা রকম অসুখে ভুগে খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছেন, দিনের অর্ধেক বেলা বিছানায় পড়ে থাকেন। সংসার সামলানোর দায়িত্ব ওর মেজ ফুপুর। বারো বছর আগে ফুপা মারা গেছেন, ওর কোনও ছেলে মেয়ে নেই। ছোট বেলায় রবির বাবাকে এই ফুপু কোলে পিঠে মানুষ করেছেন, তাই ফুপা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়ের সংসারই ওঁর সংসার, ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখেন।

রবি বাড়িতে ঢুকেই ফুপুকে পেলো সামনে। ফুপু, ভাত দাও, বলে সটান নিজের ঘরে ঢুকলো। পুরো ঘরটা ওর নয়। ওর তিন বছরের বড় সেজ ভাই হবি যে এবার ফাস্ট ইয়ারে পড়ে, সেও এই ঘরে থাকে। তবে দুই ভাইয়েরই আলাদা বিছানা পড়ার টেবিলও আলাদা।

বাথরুমে ঢুকে ঝটপট মুখ হাত পানিতে ভিজিয়ে রবি খাবার ঘরে ঢুকলো। ওদের বাড়িতে ছুটির দিন ছাড়া সবার এক সঙ্গে খাওয়া হয় না।

ঝন্টুদের বাড়িতে দুপুরে না খেলেও রাতে ওরা তিনজন এক সঙ্গেই খাবে। বুয়া যত ভালো রান্না করুক বুমনি রোজ ছোট ভাইর পছন্দের একটা পদ নিজের হাতে রান্না করে। হালে ঝন্টুর কাবাব খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। রান্নার বই দেখে দেখে একেক দিন একেক রকমের কাবাব বানায় ঝুমনি।

বিকেলে রবির ডাকে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় কুমনি যথারীতি বললো, সাতটার মধ্যে বাড়ি ফেরা চাই।

ঝন্টু দুঃখ পাওয়া গলায় বললো, তুই কী রে আপু! আজ এস এস সি পরীক্ষা শেষ হলো। বলতে গেলে এখন আমি কলেজ স্টুডেন্ট। আজও সাতটায় ফিরতে হবে?

ঠিক আছে আটটায়। ঝন্টুকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঝুমনি বাইরের দরজা বন্ধ করে দিলো।

সুমনদের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়ি যেতে যেতে রবি বললো, কী করবি কিছু ভেবেছিস ঝন্টু?

নারে! খেয়ে উঠেই আপুর সঙ্গে দাবা নিয়ে বসলাম। দুটো গেম হেরে মাথা ঠিক নেই। তিনজন এক সঙ্গে কোথাও গেলে কেমন হয় রবি?

কোথায় যাবি?

আমার সমুদ্র দেখার ভারি ইচ্ছে। কক্সবাজার যাবি?

সমুদ্র আমিও দেখিনি। তবে কক্সবাজার যেতে কত টাকা লাগবে জানিস?

তোর বাবাকে বললে দেবেন না?

বাবা আপত্তি না করলেও মা চেঁচামেচি করবেন।

কথা বলতে বলতে কাগজিটোলা থেকে হেঁটে হেঁটেই ওরা সুমনদের বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঝন্টুকে অবশ্য ঝুমনি রিকশাভাড়ার জন্য দশ টাকা দিয়েছিলো। অর্ধেকটা ওর বেঁচে গেলো।

কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা সুমন অপছন্দ করলো না। কক্সবাজার জায়গাটা অবশ্য ওর কাছে নতুন নয়। বাড়ির সবার সঙ্গে আগেও দুবার ও কক্সবাজার গেছে। তবে এতটা বয়স হলো, বড়দের ছাড়া একা ওর কোথাও যাওয়া হয়নি। তিন জন কক্সবাজারে গেলে মজাই হবে।

.

২.

ঠিক হয়েছিলো ওরা কোচে করে কক্সবাজার যাবে। ঢাকা থেকে নাইট কোচে উঠলে সকালে কক্সবাজার নামিয়ে দেয়। রবির বাড়ি থেকে কেউ আপত্তি করেনি। শুধু বাবা বলেছেন, যাওয়া আসার বাস ভাড়ার জন্য শ তিনেক টাকা দিতে পারি। কদিন থাকবে, কোথায় উঠবে, কী খাবে এসব ব্যবস্থা করতে পারবো না।

রবি জানে এত ভাই বোন না হলে ঝন্টুর মতো ওর বাবাও এক কথায় দেড় দু হাজার টাকা বের করে দিতেন। ঝন্টু অবশ্য রবিকে বলেছে, তুই ভাবছিস কেন? আমার দু হাজার টাকায় দিব্যি দুজনের চলে যাবে। চাই কি টেকনাফ থেকেও ঘুরে আসতে পারবো। সস্তা হোটেলে উঠলেই চলবে।

রবির তবু দ্বিধা কাটেনি—সুমন কি সস্তা হোটেলে থাকতে রাজী হবে?

যাচ্ছি সমুদ্র দেখতে টাকার গরম দেখাতে নয়। সুমনের যদি সস্তা হোটেল পছন্দ না হয় পর্যটনের মোটেলে থাকুক গে। আমরা আমাদের মতো থাকবো।

যেদিন ওরা যাওয়ার প্ল্যান করলো তার দুদিন পর সুমন ওদের দুর্ভাবনার কথা শুনে হেসে খুন হলো–তোরা এত ভাবছিস কেন? কক্সবাজারের ডিসি বাবার বন্ধু। আমরা সার্কিট হাউসেই থাকতে পারবো। কম পয়সায় রাজার হালে থাকা যায়। এক রুম হলেই। তো আমাদের চলে যাবে।

ঝন্টুর বাবা প্রথমটায় একটু চিন্তিত ছিলেন–পনেরো ষোল বছরের ছেলে, বড়দের ছাড়া এতটা পথ যাবে! সেই চিন্তাও দূর হলো শেষ মুহূর্তের ব্যবস্থায়। হঠাৎ করে সুমনের বাবার কাজ পড়ে গেলো চট্টগ্রামে। প্লেনে টিকেট পাওয়া গেলো না। ঠিক করলেন পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন। সুমন শুনে বললো, তাহলে তো তুমি আমাদের চিটাগাং পর্যন্ত লিফট দিতে পারো।

হ্যাঁ, তা পারি। তবে তারা যে পরশু যাবি বলে ঠিক করলি। আমি তো যাবো কাল।

আমি এখনই গিয়ে ঝন্টু আর রবিকে গিয়ে বলছি। কাল আর পরশু আমাদের কাছে সমান।

সুমনের বড় ভাই সুজন পড়ে ইউনিভার্সিটিতে। বললো, যেখানে যেতে হয় রিকশায় যাও। গাড়ি আমার লাগবে। সুমনের এভাবে কক্সবাজার যাওয়াটা ওর পছন্দ হচ্ছিলো না। ওকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে হবে আর সুমন সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে বেড়াবে একেবারে অসহ্য মনে হচ্ছিলো ওর।

রিকশায় করেই প্রথম ঝন্টুদের বাসায় এলো সুমন। ঝন্টুর বাবা অফিস থেকে ফিরে চা খাচ্ছিলেন। যে কারণে ঝন্টুদের যাওয়া একদিন এগিয়েছে, শুনে তার দুশ্চিন্তা কেটে গেলো। সুমনকে বললেন, খুব ভালো হয়েছে–তোমরা তোমার বাবার সঙ্গে যাচ্ছো।

গাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে রবিও খুশি হলো। তবে ওর আরও সমস্যা ছিলো। ভেবেছিলো কাল সকালে ওর জিন্‌সের প্যান্ট দুটো ধুয়ে দেবে। ওদের বাড়িতে যে যার কাপড় নিজেই দেয়। রাতে থোয়াটা ওর সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে সকালে শুকোবে কি না।

সুমন আর ঝন্টুর বিদায় হতেই ও বাথরুমে কাপড় কাঁচতে বসলো। ওর বাইরে পরার মতো প্যান্ট মাত্র দুটো। এক সেট পায়জামা পাঞ্জাবি অবশ্য আছে, যা মিলাদ টিলাদে যেতে হলে পরে।

কাপড় ধোয়ার পর ফুপু বুদ্ধি দিলেন, রান্না ঘরে মেলে দে। ভোর না হতেই শুকিয়ে যাবে।

রবিরা নিজেদের ধোয়া কাপড় নিজেরাই ইস্ত্রি করে। ফুপুর কথা শুনে রবি নিশ্চিন্ত হলো। তবে ভোরে ও ঘুম থেকে উঠে দেখলো, প্যান্ট দুটো আর তিনটা শার্ট ইস্ত্রি করা অবস্থায় ওর টেবিলের ওপর রাখা। রবি বুঝলো এ কাজ ফুপু ছাড়া আর কারও নয়। কাল রাতে ও শুনেছে ফুপু মাকে বলছেন, এইটুকুন তিনটে ছেলে কক্সবাজার যাবে, বড় কেউ সঙ্গে থাকবে না–ভারি চিন্তা হচ্ছে। মা জবাব দিয়েছেন, দুনিয়াটা বড় কঠিন জায়গা বুবু। এখন থেকে সব কিছু চিনতে শিখুক, নইলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে।

সকাল সাতটায় ইস্ত্রি ভাঙা প্যান্ট শার্টের ওপর হাত কাটা সুয়েটার গায়ে দিয়ে এয়ার ব্যাগ কাঁধে যখন রবি ঘর থেকে বেরুতে যাবে ফুপু ওর হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিলেন– এটা রাখ। ক্ষিদে লাগলে পথে কিছু কিনে খাস।

রবি কখনও যা করে না–টুপ করে ফুপুর পা ছুঁয়ে সালাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ঝন্টুকে সঙ্গে নিয়ে পৌনে আটটায় পৌঁছে গেলো সুমনদের বাড়ি।

সুমন তৈরি হয়ে ড্রইং রুমে অপেক্ষা করছিলো। ওদের দুজনকে মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানালো–তোরা পনেরো মিনিট আগে এসে গেছিস।

.

ঢাকা থেকে সকাল আটটায় রওনা দিয়ে ঠিক একটায় ঝন্টুরা পৌঁছলো চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। পথে মেঘনার ফেরিতে দেরি না হলে আরো আধঘন্টা আগে পৌঁছতে পারতো ওরা।

সুমনের বাবা বলেছিলেন চট্টগ্রামে তিনি ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন আর এই গাড়িই ওদের কক্সবাজার নামিয়ে দিয়ে সকালে ফিরে আসবে। তিনি পরদিন বিকেলে ঢাকা ফিরবেন। এও বলেছেন সুমনরা যেন আট দশ দিনের বেশি কক্সবাজার না থাকে।

লাঞ্চের জন্য সুমনের বাবা সবাইকে নিয়ে গেলেন আগ্রাবাদ হোটেলে। এত দামী হোটেলে রবি কেন, ঝন্টুও কখনও খায়নি। রবির ভয় হচ্ছিলো, যদি কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে হয় বিপদে পড়তে হবে। কোন হাতে কাঁটা আর কোন হাতে ছুরি ধরে এটা না হয় অন্যদের দেখে ঠিক করে নিতে পারবে, কিন্তু ছুরি কাঁটা দিয়ে কেটে কেটে খেতে গেলে ওকে আধপেটা থাকতে হবে।

সুমনের বাবা এই বিড়ম্বনা থেকেও ছেলেদের রেহাই দিলেন। খাবার জন্য নিয়ে গেলেন বুফে কর্ণারে। বললেন, সবাই যে যার প্লেটে খাবার তুলে নাও। ইচ্ছে করলে হাতে খেতে পারো, ইচ্ছে করলে ছুরি কাঁটা দিয়ে। যা ইচ্ছে করবে প্লেটে তুলে নাও।

রবি আর ঝন্টু খেতে বসে টের পেলো এত উপাদেয় খাবার ওরা জীবনেও খায়নি।

পোলাও আর ভাত দুইই ছিলো। তিন ধরনের মাংশ, চার রকমের মাছ আর সবজি ছিলো দুই পদের। খাবার শেষে কাস্টার্ড, আর পুডিং দুটোই ছিলো। ওরা সবাই যে যার ইচ্ছে মতো খেলো। রবির বেশি পছন্দ ছিলো চিংড়ির কালিয়া, আর ঝন্টু মজা করে খেলো কচি বাছুরের মাংশের স্টেক, এত নরম যে মুখে দিতেই মোমের মতো গলে যাচ্ছিলো।

বুফে রুমে চা সার্ভ করা হয় না। সুমনের বাবার দুপুরে খাওয়ার পর এক পেয়ালা সবুজ চা না হলে চলে না। চা খেতে ওদের তিনি নিয়ে গেলেন আধো অন্ধকার এক ঘরে। সারা ঘর অন্ধকার, শুধু টেবিলে হালকা আলোর আভাস। ঝন্টু ফিশ ফিশ করে রবির কানে কানে বললো, একেবারে ইংরেজি ছবির মতো লাগছে না?

রবি বললো, ছবি নয়, স্বপ্ন।

খেয়ে উঠে ওরা যখন হোটেলের বাইরে এলো বেলা তখন তিনটা। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ড্রাইভার রাজাকে সুমনের বাবা খাওয়ার জন্য আগেই টাকা দিয়েছিলেন। ও খেয়ে দেয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে লেটেস্ট মাসুদ রানা পড়ছিলো। সুমন লক্ষ্য করেছে রাজা অবসর সময়টা বই না হলে খবরের কাগজ পড়ে কাটায়।

সুমনের বাবাকে আগ্রাবাদের এক অফিসে নামিয়ে দিয়ে ওরা রওনা হলো কক্সবাজারের পথে। রাজা আপন মনে বললো, কক্সবাজার যাইতে যাইতে রাইত হইয়া যাইবো।

সুমনদের গাড়িটা নাইন্টি টু মডেলের হোন্ডা সিভিক। বলতে গেলে একেবারেই নতুন। রবি, ঝন্টু আর সুমন বসেছিলো পেছনের সিটে। সুমনের বাবা নেমে যাওয়াতে রাজার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে।

সুমন কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চোখ বুজে ওয়াকম্যানে ম্যাডোনার গান শুনছিলো। ঝন্টু আর রবির বহু দিনের জমে থাকা কথায় ওর কোনও আগ্রহ ছিলো না। সুমন ওদের কথা শুনছে না দেখে রবি আর ঝন্টু বলাবলি করছিলো কথা না বলার এক মাস ওরা কী কষ্টে কাটিয়েছে। রবি বলছিলো, কী যে বিচ্ছিরি লাগতো বিমলের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে!

ঝন্টু অভিমান ভরা গলায় বললো, আমার বুঝি খুব ভালো লাগতো সন্ধ্যে বেলা একা একা বাড়ি ফিরতে?

ভালো শিক্ষা হয়েছে। আর কখনও এরকম হবে না।

গত বছরও তো বলেছিলাম, আর এরকম হবে না।

আমার কী মনে হয় জানিস?

কী মনে হয়?

তুই যে আমার কত আপন এটা বুঝতে পারি তোর সঙ্গে ঝগড়া করে কথা বন্ধ করলে।

আমারও তাই মনে হয়।

রবি আর ঝন্টু কক্সবাজারের পুরোটা রাস্তাই এভাবে কথা বলে কাটিয়ে দিতে পারতো। সুমনও কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে ম্যাডোনার গানে বুঁদ হয়ে থাকতে পারতো। যাত্রায় বাধা পড়লো চট্টগ্রাম ছাড়ার এক ঘন্টা পর।

দু পাশে কোথাও ফাঁকা কোথাও ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণে সমুদ্রের শহর কক্সবাজারের দিকে। শেষ বিকেলের মায়াবি রোদ পাহাড় আর জঙ্গলের গাছের মাথায় এলিয়ে পড়েছিলো। এমন সময় সুমন বললো, রাজা ভাই, সামনে একটা লোক লিফট চাইছে।

একটা উঁচু শাল গাছের নিচে লুঙ্গি পরা, চাদর গায়ে বগলে কাপড়ের পুটলি এক লোক লিফট নেয়ার জন্য হাত তুলেছে–এটা রাজারও চোখে পড়েছিলো। ও ভেবেছিলো সাড়া না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। গাড়ির স্পীড কমিয়ে সুমনকে বললো, জানি না, শুনি না–একজনরে গাড়িতে তোলা কি ঠিক হইবো?

এই রাস্তায় বিপদে না পড়লে কেউ লিফট চাইবে না। তাছাড়া বেশভূষা গ্রামের হলেও মনে হয় শহরের লোক। গ্রামের লোককে আমি কখনও লিফট চাইতে দেখি নি।

লোকটার পাশে রাজা গাড়ি দাঁড় করাতেই ও এগিয়ে এলো। বয়স খুব বেশি হলে তেইশ চব্বিশ হবে। গায়ের রঙ এক সময় ফর্শা ছিলো, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। এক মাথা ঝাকড়া চুল, ধারালো অথচ মার্জিত চেহারা, চোখে চশমা, দেখেই মনে হয় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলে।

লোকটা ভেবেছিলো, গাড়ির পেছনের সিটে বোধহয় মালিক বসে আছে কাছে এসে একটু অস্বস্তিতে পড়লো। রাজার চেহারা আসলে রাজপুত্রের মতো। তবে ওর পাশের সিট খালি দেখে লোকটার মনে হলো ও মালিক নয়। তবু ও রাজাকেই বললো, আপনারা কদুর যাবেন?

বিরক্তি মেশানো গলায় রাজা আলী এক শব্দে জবাব দিলো–কক্সবাজার।

দেখুন, আমি খুব অসুবিধেয় পড়েছি। লোকটাকে বিব্রত মনে হলো–সঙ্গে টাকা পয়সা কিছুই নেই। আজ রাতের ভেতরই আমাকে কক্সবাজার পৌঁছতে হবে। যদি দয়া করে লিফট দেন–

রাজা মাথা ঘুরিয়ে সুমনের দিকে তাকালো। সুমন লোকটাকে সামনের সিট দেখিয়ে বললো, উঠে পড়ুন।

অনেক ধন্যবাদ। বলে কৃতজ্ঞতার এক টুকরো হাসি ওদের উপহার দিয়ে লোকটা রাজার পাশের সিটে গিয়ে বসলো। রাজা আলী গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

লোকটাকে দেখে ঝন্টুরও খুব মায়া লেগেছিলো। শক্ত সমর্থ শরীর হলেও ক্লান্ত চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো সারাদিন ওর কিছু খাওয়া হয়নি। পথে খাওয়ার জন্য সুমনের বাবা কমলা আর কলা কিনেছিলেন দাউদকান্দি ঘাট থেকে। ঝন্টুর একবার ইচ্ছে হলো লোকটাকে জিজ্ঞেস করে–কিছু খাবে কি না, পরে মনে হলো সুমন এটাকে আদিখ্যেতা ভাবতে পারে। অচেনা একজন লোক গাড়িতে ওঠাতে রবির সঙ্গেও আগের মতো কথা বলতে পারছিলো না ঝন্টু।

লোকটাকে দেখার পরই সুমনের গান শোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। রহস্য লহরী সিরিজের বই পড়া ওর অনুসন্ধিৎসু মন বলছিলো লোকটা খুব সাধারণ একজন যাত্রী নয়। কিছুক্ষণ পর ও লোকটাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

লোকটা গাড়িতে ওঠার সময়ই টের পেয়েছিলো রাজা নিছক ড্রাইভার, গাড়ির মালিক আপাতত সুমন। বয়সে ওর চেয়ে ছ সাত বছরের ছোট হবে। মাত্র গোঁফের রেখা গজিয়েছে–তুমি বলবে না আপনি বলবে ঠিক করতে না পেরে বললো, কী কথা?

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি এখানকার লোক নন। আপনার বাড়ি কোথায় জানতে পারি?

লোকটার ঠোঁটের ফাঁকে ম্লান হাসি ফুটে উঠলো–বাড়ি কোথায় জানাটা কি খুব জরুরী?

জানা উচিৎ। গম্ভীর গলায় সুমন বললো, আপনাকে যখন লিফট দিচ্ছি আপনার পরিচয় জানা দরকার।

আমাকে যদি সন্দেহজনক বা বিপদজনক মনে হয় আমি তো মিথ্যে পরিচয়ও দিতে পারি।

আমি মনে করি আপনি তা করবেন না।

ঝন্টু বললো, ওঁর যদি পরিচয় দিতে আপত্তি থাকে, তুই জোর করছিস কেন সুমন?

লোকটা একটু ইতস্তত করে বললো, না, আপত্তি কিসের! আমার বাড়ি ঢাকা। আর কিছু জানার আছে?

সুমন বললো, আপনার নাম বলেননি। কী করেন এটাও জানা দরকার।

লোকটার কথা বলার ভেতর বেশ একটা ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভাব ছিলো। আধ ময়লা চাদর আর লুঙ্গি পরা হলেও গলার স্বর, উচ্চারণ খুবই মার্জিত আর পরিষ্কার। শান্ত গলায় লোকটা বললো, আমার নাম শোয়েব আহমেদ। চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে মাস্টার্স পড়ছি।

সুমন আবার প্রশ্ন করলো, আপনি কি কোনও বিপদে পড়েছেন?

শোয়েব মৃদু হেসে প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইলো–কারও পরিচয় জানতে হলে নিজের পরিচয়ও দিতে হয়।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে সুমন বললো, সরি, আমার নাম সুমন। এরা আমার বন্ধু, ঝন্টু আর রবি। রাজা আলী আমাদের ড্রাইভার হলেও আমার বন্ধুর মতো। আমরা এবার এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি। কক্সবাজার যাচ্ছি বেড়াতে।

সাবজেক্ট কী, সায়েন্স না আর্টস?

আমরা তিনজনই সায়েন্সের ছাত্র।

পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

মন্দ নয়। আমার স্টার না থাকলেও সেভেন্টি পারসেন্টের ওপরে থাকবে। ঝন্টু স্টার পেতে পারে।

ঝন্টু বললো, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খাননি। আমাদের সঙ্গে কলা আর কমলা আছে, খাবেন?

বেশি থাকলে খেতে পারি।

ঝন্টু দুটো কলা আর এটা কমলা এগিয়ে দিলো। শোয়েব একটু ইতস্তত করে বললো, খাবার পানি আছে?

চার বোতল মিনারেল ওয়াটার কেনা হয়েছিলো পথে। মাত্র এক বোতল শেষ হয়েছে। সুমন পানির বোতল বের করে শোয়েবকে দিলো।

ঢক ঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি গলায় ঢেলে লাজুক হেসে শোয়েব বললো, ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিলো।

সুমন লক্ষ্য করলো শোয়েবের হাসি খুবই নিষ্পাপ। ওর জড়তা কাটাবার জন্য বললো, আপনাকে আমরা যদি শোয়েব ভাই বলি আপনি আপত্তি করবেন?

করবো। শোয়েবের মুখে আগের মতো নিষ্পাপ হাসি। ওর মনে হলো এই ছেলেগুলোকে বিশ্বাস করলে ও ঠকবে না।

ওরা তিনজন একটু অবাক হলো শোয়েবের কথা শুনে। একটু দমেও গেলো। শোয়েব হেসে বললো, ভাই বললে কি আপনি বলার দরকার হয়?

এবার ওদের তিন জনের মুখে হাসি ফুটলো। ঝন্টু বললো, আপনিও কিন্তু কথা বলার সময় এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনার অনেক নিচে পড়ি। আমাদের তবু তুমি বলছেন না। ভাববাচ্যে কথা বলছেন।

অনুমতি পেলে বলা যায়।  

নিশ্চয় তুমি বলবেন শোয়েব ভাই।

সুমন আর রবিরও কি একই মত?

হ্যাঁ শোয়েব ভাই। সুমন আর রবি শব্দ করে হাসলো। ঝন্টু বললো, সুমন তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলো শোয়েব ভাই।

কোন কথা?

তুমি কি কোনও বিপদে পড়েছো?

এ কথা কেন মনে হচ্ছে?

সুমন বললো, তুমি চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ো, হাইওয়ের মাঝখানে এলে কোত্থেকে? তার ওপর বলছো টাকা পয়সা নেই, আজই কক্সবাজার পৌঁছতে হবে?

শোয়েব এবার শব্দ করে হাসলো–মনে হচ্ছে তোমরা রহস্য আর গোয়েন্দা গল্পের বই পড়তে খুব পছন্দ করো।

তা করি। তুমি কিন্তু প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না।

আমার টাকা পয়সা যদি ডাকাতরা নিয়ে যায় এটাও কম বিপদের কথা নয়।

তুমি সত্যি কথা বলছে না শোয়েব ভাই। সুমন বললো, ঢাকার যে ছেলে চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পড়ে, সে কখনও লুঙ্গি পরে কক্সবাজার যাবে না। তার কাপড় চোপড়ও এরকম আধময়লা আর আন ইম্প্রেসিব হবে না।

তুমি ভালো ডিটেকটিভ হতে পারবে। আমি সত্যি–

শোয়েবের কথার মাঝখানে রাজা আলী বললো, সামনে পাঁচ ছয়টা লোক গাড়ি থামাইতে বইলতেছে।

শোয়েবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওরা সামনের রাস্তার দিকে লক্ষ্য করেনি। প্রায় একশ গজ দূরে ছয় জন লোক বেশ উদ্ধত ভঙ্গিতে গাড়ি থামানোর জন্য ইশারা করছে। দুজনের হাতে লাঠি। আরেকজনের চাঁদরের ভেতর কী আছে আল্লা মালুম, খুবই সতর্ক আর বেপরোয়া মনে হচ্ছে।

লোকগুলোর ওপর নজর পড়তেই শোয়েব উত্তেজিত গলায় বললো, গাড়ি থামাবেন না, রাজা ভাই। ফুল স্পীডে বেরিয়ে যান।

রাজা আলী গাড়ির স্পীড কমিয়েছিলো। হাত ভোলা লোকগুলো ভেবেছে গাড়ি বুঝি থামানো হচ্ছে। ওদের সতর্কতায় একটু ঢিল পড়তেই রাজা আলী পুশ করে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। ঝন্টু শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি এদের চেনো?

হ্যাঁ চিনি। তিক্ত গলায় শোয়েব বললো, ওরা আমাকে পেলে নির্ঘাত খুন করবে।

কী বলছো তুমি শোয়েব ভাই? হ্যাঁ ঝন্টু। শান্ত গলায় শোয়েব বললো, তোমরা ঠিকই অনুমান করেছে। আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি।

<

Super User