যেখানে কেউ নেই – কাসেম বিন আবুবাকার
চৈত্রের দুপুর। রোদের তাপে চারদিক খাঁ খাঁ করছে। বাহেরচর গ্রামের মাঠের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে সুঠাম দেহের অধিকারী এক সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক হেঁটে চলেছে। ঘামে গায়ের গেঞ্জি ও জামা ভিজে গেছে। রাস্তার পাশে তেমন গাছ পালাও নেই যে ছায়ায় বসে একটু বিশ্রাম নেবে। সামনে গ্রামের কিনারে একটা বাগান দেখতে পেয়ে ওখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে ভেবে দ্রুত পা চালাল। কাছে এসে একটা বড় জামগাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল। হঠাৎ বাগানের ভিতর কোনো মেয়ের আর্ত চিৎকার ও পরক্ষণে ধস্তাধস্তীর শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে উঠে বাগানের ভিতর সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাতে দেখতে পেল, একটা লোক একটা যুবতী মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিয়ে শালীনতাহানির চেষ্টা করছে। মেয়েটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে। বুড়োটা তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে লোকটার ঘাড় ধরে তুলে দাঁড় করাল। তারপর মেয়েটিকে বলল, তুমি চলে যাও। এ আর কোনো দিন তোমার পেছনে লাগবে না।
সাফিয়া প্রায় বিবস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি কাপড় গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মাতব্বরের ছেলে রশিদের হাত থেকে ইজ্জত রক্ষা পেয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল।
একসময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়াতে লাগল।
বুড়োটা বলল, ঘরে অনেক কাঁদবার সময় পাবে, এখন তাড়াতাড়ি চলে যাও।
আজ ঘরে কোনো আনাজ নেই। তাই হাজেরা মেয়ে সাফিয়াকে মাতব্বরের বাগানের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে আনতে পাঠিয়েছিল। সাফিয়া কলমী শাক তুলে পুকুরের পাড়ে উঠে রশিদকে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত পাশ কেটে চলে আসছিল। রশিদ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুইয়ে শালীনতাহানীর চেষ্টা করছিল। তারপর একজন অচেনা বুড়ো লোক এসে তার ইজ্জত রক্ষা করাতে কৃজ্ঞতায় চোখে পানি এসে গেছে। তাকে চলে যেতে বলায় একরকম ছুটে চলে গেল।
সাফিয়া চলে যাওয়ার পর বুড়োটা রশিদকে বলল, বাপের স্বভাব পেয়েছিস তাই না? মেয়ে মানুষের লালসার কারণে তোর বাপের যে দশা হয়েছে তাতেও তোর জ্ঞান হল না? আজ তোকে এমন শাস্তি দেব জীবনে আর কোনোদিন মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবি না।
রশিদ ত্রিশ বছরের শক্তিশালী যুবক। তাই তার ঘাড় ধরতে রেগে গিয়ে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বুঝতে পারল, প্রতিপক্ষ তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাকে দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে সফল হল না। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে প্রতিপক্ষের হাতের চাপ বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও রাগে ফুলছিল। প্রতিপক্ষের কথা শুনে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু গলা থেকে শব্দ বের হল না। কারণ ততক্ষণে দুই কানের নিচে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সত্যিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
বুড়োটা তার অবস্থা বুঝতে পেরে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর ব্যাগ থেকে রশি বের করে ডানহাতের কব্জির একটু উপরে বেঁধে কজ্জিটা কেটে দিয়ে একটা চোখও তুলে নিল, তারপর একটা কাগজে মেয়েদের ইজ্জতের উপর হামলা করার ফল লিখে কাগজটা তার বুকের উপর রেখে একটা মাটির ঢেলা চাপা দিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেইদকে হাঁটতে শুরু করল।
বাহেরচর গ্রামের অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই গরিব লোক। যে কয়েকজনের অবস্থা ভালো তাদের থেকে দিলদার মাতব্বরের অবস্থা সবার থেকে ভালো। তিনি বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। গ্রামে প্রাইমারী স্কুল থাকলেও হাই স্কুল প্রায় আট দশ মাইল দূরে। তাই প্রাইমারী পাশ করার পর দিলদার আর পড়াশোনা করেনি। যুবক বয়সে গ্রামের গরিব ঘরের অনেক মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করেছে। মেয়ের বাবারা দিলদারের বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বরের কাছে নালিশ জানিয়ে সুবিচার পায় নি। তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সে সব মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সালেহ উদ্দিন মাতব্বর চরিত্রহীন ছিলেন না; কিন্তু তারই ছেলে দিলদার যে কেন চরিত্রহীন হল; তা অনেক চিন্তা করেও পান নি। তাই ছেলেকে ভালো করার জন্য পাঁচ মাইল দূরের গ্রামের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।
বিয়ের পর বছর দুই দিলদারের কুকর্ম বন্ধ ছিল। তারপর পরনারীর নেশা আবার জেগে উঠে। বড়লোকের ছেলেদের অনেক চামচা থাকে। দিলদারেরও ছিল। সেই চামচারা মেয়ে জোগাড় করে দিত। এর মধ্যে তার বাবা সালেহ উদ্দিন মাতব্বর মারা গেলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর দিলদার গ্রামের মাতব্বর হলেন এবং আরো তিনটে বিয়ে করেন। তারপরও তার নারীর লোভ গেল না। সুযোগ পেলে চামচাদের সাহায্যে গ্রামের গরিব বৌ বেটিদের ভোগ করত। চারটে বিয়ে করলেও প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি মাত্র ছেলে ছাড়া অন্য তিন স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান হয় নি। সেই ছেলেই রশিদ।
রশিদের বয়স যখন বার বছর তখন তার মা মারা যায়। তারপর দিলদার মাতব্বর আবার বিয়ে করার জন্য চামচাদের মেয়ের খোঁজ করতে বললেন।
ঐ গ্রামের মঈন সেখ দরিদ্র কৃষক। বছরের বেশিরভাগ দিন সে দিলদার মাতব্বরের চাষ বাসের কাজ করে। তার বৌ সায়রা খুব সুন্দরী। তাদের একমাত্র ছেলে হালিম। হালিম যখন সাত বছরের তখন মঈন সেখ মাস দুই অসুখে ভুগে মারা যায়।
প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর দিলদার মাতব্বরের আর একটা বিয়ের খায়েস হল। তাই চামচাদের যখন মেয়ের খোঁজ করতে বললেন তখন শাকিল নামে এক চামচা বলল, হুজুর, মেয়ে আমাদের গ্রামেই আছে, দেখতে পরীর মতো।
দিলদার মাতব্বর বললেন, তাই নাকি? তা মেয়েটা কে?
শাকিল বলল, মঈন সেখের বৌ, একটা সাত আট বছরের ছেলে থাকলে কি হবে? দেখলে মনে হবে এখনো বিয়েই হয় নি।
দিলদার মাতব্বর বেশ কিছুদিন আগে মঈন সেখের অসুখের কথা শুনে একদিন দেখতে গিয়েছিলেন। সে সময় তার বৌকে ঘোমটা অবস্থায় দেখলেও শরীরের বাঁধন দেখে লোভাতুর হয়ে উঠেছিলেন। অন্য কারো বৌ হলে কয়েকদিনের মধ্যে ভোগ না করে ছাড়তেন না। মঈন সেখ তারই কামলা, তাই কিভাবে কাজটা করবেন ভেবে ধৈর্যের সঙ্গে চিন্তা করছিলেন, আর দু’একদিন ছাড়া মঈন সেখকে টাকা পয়সা সাহায্য করার অসিলায় তার বৌকে দেখার জন্য যেতেন। কিন্তু একবারের জন্যও ঘোমটা থাকার কারণে তার বৌ-এর মুখ দেখতে পান নি।
একদিন সাড়া না দিয়ে ঢুকে পড়ে দেখলেন, সায়রা স্বামীকে ওষুধ খাওয়াচ্ছে, মাথায় ঘোমটা নেই। গায়েও ভালো করে কাপড় নেই। ঐ অবস্থায় সায়রাকে দেখে মাতব্বর ভিমরি খেলেন। তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কোনো উপায় না পেয়ে কবিরাজকে অনেক টাকা দিয়ে মঈন সেখকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেন। মঈন সেখ মারা যাওয়ার পর তার বৌ ও ছেলেকে সাহায্য করার জন্য যাতায়াত শুরু করেন।
সায়রা গ্রামের অশিক্ষিত সহজ সরল মেয়ে, দিলদার মাতব্বরের কৌশল ধরতে পারল না। ভাবল, স্বামী বারমাস মাতব্বরের ক্ষেতে খামারে কাজ করত, তাই সে মারা যেতে সাহায্য করছে। ঘোমটা অবস্থায় হাত পেতে টাকা নিত।
একদিন মাতব্বর টাকা দেয়ার সময় হালিমকে দেখতে না পেয়ে হঠাৎ করে সায়রার হাত ধরে ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে ঘোমটা দেয়ার দরকার নেই। ভেবেছি, ইদ্দতের পর তোমাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে যাব।
মাতব্বরের কথা শুনে সায়রা লজ্জা পেলেও তার মতলব বুঝতে পেরে খুব রেগে গিয়ে অন্য হাতে ঘোমটা টেনে বলল, হাত ছাড়ুন, নচেৎ চিৎকার করে লোকজন ডাকব।
মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, সেটা করা কি উচিত হবে? লোকজনদের আমাকে কিছু বলার সাহস হবে না, বরং তোমারই দুর্নাম হবে।
সায়রা হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি আপনাকে বাপের মতো মনে করি, আর আপনি কিনা আমাকে বিয়ে করতে চান? যান, চলে যান এখান থেকে। আর কোনোদিন আসবেন না। কথা শেষ করে টাকাগুলো মাতব্বরের পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দিল।
মাতব্বর কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ফিরে আসার সময় বিড় বিড় করে বললেন, ইদ্দৎ শেষ হোক তারপর তোর দেমাগ ভাঙব।
মাতব্বর যখন আসেন তখন হালিম ঘরে ছিল না। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছিল। কিছুক্ষণ আগে ফিরে মাতব্বরকে মায়ের হাত ধরে কথা বলতে দেখে এতক্ষণ রান্না ঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল। ছোট ছেলে বলে ঘটনাটা বুঝতে না পারলেও মাতব্বরের কথায় মা যে খুব রেগে গেছে বুঝতে পারল। মাতব্বর চলে যাওয়ার পর ঘরের দরজার কাছে এসে বলল, মা দরজা খোল, মাতব্বর চলে গেছে।
সায়রা নিজের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে কাঁদছিল। মাতব্বর চলে গেছে শুনে। দরজা খুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
হালিম বলল, তুমি কাঁদছ কেন মা? মাতব্বর তোমাকে বকেছে বুঝি? তুমি দেখে নিও, এবার মাতব্বর এলে ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব।
সায়রা কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল, ছি বাবা, উনি মুরুব্বী মানুষ, ওরকম কথা বলতে নেই। তারপর তাকে পান্তা খেতে দিয়ে বলল, বাইরে কোথাও যাবি না, ঘরে থাকবি। আমি তোর করিম দাদাদের ঘরে যাব। দেখি তাদের সংসারের কোনো কাজ কাম করা যায় কিনা।
করিম সেখের অবস্থা মোটামুটি ভালো, তার চার ছেলে দু’ মেয়ে। সবার বিয়ে হয়ে গেছে। চার ছেলের বৌ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে করিম সেখের একান্নবর্তী পরিবার। দু’জন কাজের মেয়ে থাকলেও সায়রার দুরবস্থার কথা ভেবে করিম সেখের স্ত্রী তিনবেলা খাওয়ার বদলে তাকে কাজে রাখলেন। সায়রা তিন বেলাই খাবার ঘরে নিয়ে এসে ছেলেকে নিয়ে খায়।
সে কথা শুনে দিলদার মাতব্বর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে চামচাদের বললেন, মঈন সেখের বিধবা বৌকে কত টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করলাম, আর সে কিনা আমার কাছে না এসে করিম সেখের সংসারে কাজ নিল? ঠিক আছে, সময় হলে আমিও দেখে নেব।
দিলদার মাতব্বর সায়রার ইদ্দতের হিসাব রেখেছিলেন। চারমাস দশ দিন হয়েছে দুদিন আগে। তাই আজ চামচাদেরকে বিয়ে করার কথা বলে মেয়ে দেখতে বলেছিলেন। চামচা শাকিলের কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, তুই ব্যবস্থা কর, আমি রাজি। তারপর তিনটে একশ টাকার নোট তাকে দিয়ে বললেন, এগুলো নিয়ে তোর মাকে প্রস্তাব দিতে পাঠাবি। আর বলে দিবি টাকাগুলো যেন মঈন সেখের বিধবা বৌকে দেয়।
শাকিলের বাপ অনেক আগে মারা গেছে। তার মা রহিমন বিবির বয়স প্রায় ষাট বছর। গ্রামের সব ঘরেই তার অবাধ বিচরণ। বৌড়ী ঝিউড়ী কেউ চাচি আবার কেউ দাদি সম্বোধন করে।
রহিমন বিবি প্রায় দিনই সায়রার কাছে আসে। সায়রা তাকে দাদি বলে ডাকে। রহিমন বিবি মাতব্বরের প্রথম বৌ ছাড়া তিন বৌয়ের ঘটকালি করেছে। আজ শাকিল মাকে যখন টাকাটা দিয়ে মাতব্বরের কথা বলল তখন রহিমন বিবি বলল, মাতব্বরের এত বয়স হল, তিন-তিনটে বৌও রয়েছে, তবু বিয়ে করার সখ গেল না।
শাকিল বলল, যাদের টাকা আছে তাদের সখও আছে।
করিম সেখের তো টাকা আছে, কই, সেতো মাতব্বরের মতো চার পাঁচটি বিয়ে করে নি? আসলে মাতব্বর তোক ভালো না।
মাতব্বর ভালো না মন্দ সে কথা ভাবতে হবে না। তোমাকে যে কাজের ভার দিয়েছেন তা করতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তুমি আজই প্রস্তাবটা সায়রার কাছে দিবে।
সায়রা করিম সেখের ঘর থেকে বেলা তিনটের দিকে ভাত নিয়ে ঘরে এসে দেখল, হালিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে জাগিয়ে মায়ে পুতে খেতে বসল।
এমন সময় রহিমন বিবি এসে বলল, কাজ সেরে এখন এলি বুঝি?
সায়রা বলল, হ্যাঁ দাদি, করিম চাচার সংসারে কত মানুষ তাতো জান। খাওয়ার পর অত লোকের হাঁড়ি থালা-বাসন ধুয়ে রেখে তারপর এলাম। ছেলেটা ভুখের চোটে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কি আর করবিরে বুন, সব কপালের লিখন। অমন তরতাজা মঈনকে আল্লাহ তুলে নেবে ভাবতেই পারি নি।
সায়রা বলল, ওসব কথা থাক দাদি, এমন অসময়ে এলে যে?
রহিমন বিবি বলল, তোকে একটা কথা বলতে এলাম, কথাটা ভেবে চিন্তে উত্তর দিবি।
পাতের ভাত কমে গেছে দেখে সায়রা ছেলেকে খেতে বলে হাত মুখ ধুয়ে বলল, কি কথা দাদি?
তোর কাঁচা বয়স, স্বাস্থ্য ভালো, বাকি জীবনটা কিভাবে কাটাবি ভেবেছিস?
সায়রা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ভেবে আর কি করব? আল্লাহ কপালে যা রেখেছে তাই হবে।
তাতো হবে, কিন্তু লোকের বাড়ি কাজ করে কতদিন চলবি? পাকাপাকি কিছু একটা করাই তো ভালো।
পাকাপাকি করার কথা কি বলছ বুঝতে পারছি না।
বলছি নিকে কর। তা হলে পরের ঘরে কাজ করতে হবে না। ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। তা না হলে তুইও যেমন শান্তি পাবি না। তেমনি ছেলেটাও কষ্ট, পাবে। তা ছাড়া গ্রামের ছেলে ছোকরারা তোকে জ্বালাতন করবে। কতদিন তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবি?
সায়রা এই চার মাসের মধ্যে বুঝতে পেরেছে গহীন রাতে করা যেন তার ঘরের চারপাশে চলাফেরা করে। ভয়ে মাথার কাছে বড় হেসো রেখে সারারাত একরকম জেগেই থাকে। একবার ভেবেছিল, ভাই ভাবির কাছে চলে যাবে; কিন্তু তাদের সংসারের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে যায় নি। এখন রহিমন দাদির কথা শুনে বলল তোমার কথাগুলো আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু কি কবর ভেবে পাইনি। গ্রামের কেউ কি আমাকে নিকে করতে চাইবে? আর চাইলেও ছেলেটার কি হবে?
রহিমন বিবি বলল, তোর মতো মেয়ের নিকের বরের অভাব আছে নাকি গ্রামে? ছেলেকে নিয়েই তোকে নিকে করার জন্য কতলোক হাঁ করে রয়েছে। মাতব্বর তো তোকে নিকে করার জন্য এক পা। আমি বলি কি সবার থেকে মাতব্বরের ঘরে গেলে তুই সবদিক দিয়ে সুখী হবি। মাতব্বর তোকে রাজরানী করে রাখবে। আর ছেলেটাও মানুষ হবে।
সায়রা বলল, তা আমি জানি দাদি। কিন্তু মাতব্বরের বয়স আমার বাপের বয়সের চেয়ে বেশি। তাকে আমি বাপের মতো মনে করি, তুমিই বলো, তাকে কি নিকে করতে পারি?
বাপের মতো মনে করলে তো বাপ হয়ে যায় না। আর বয়সের কথা যে বললি, পুরুষদের আবার বয়স আছে নাকি? একশ বছরের বুড়োও বিশ বছরের ছুঁড়িকে বিয়ে করছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে তুই রাজি হয়ে যা। তারপর কাপড় থেকে তিনশ টাকা বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোর কষ্ট দেখে মাতব্বর আমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।
সায়রা টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল, এটা তাকে ফিরিয়ে দিও। যাকে বাপের মতো মনে করি, জান গেলেও তাকে নিকে করতে পারব না। অন্য কেউ হলে ভেবে দেখতাম।
কিন্তু মাতব্বর কি স্বভাবের লোক তুই তো জানিস না। এই গ্রামে বৌ হয়ে এসেছি আজ পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। সেই থেকে তার স্বভাব চরিত্র জানি। যে মেয়ে একবার তার নজরে ধরবে তাকে ভোগ না করে ছাড়ে না। এখনো সেই স্বভাব যায় নি। তুই তার নজরে পড়েছিস। অন্য কারো সঙ্গে নিকে বসতে দেবে না। আর গ্রামে এমন কেউ নেই, তার মতের বিরুদ্ধে তোকে নিকে করবে। তাই বলছি মাতব্বরের হাত থেকে বেশি দিন ইজ্জৎ বাঁচিয়ে রাখতে পারবি না। ইজ্জত বাঁচাতে হলে তাকে নিকে করা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।
সায়রা বলল, দশ বছর এই গ্রামে এসেছি। হালিমের বাপের মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা শুনেছি। তা ছাড়া হালিমের বাপ মারা যাওয়ার পর টাকা দিয়ে আমার ইজ্জৎ লুটতে চেয়েছিল। রাজি হয় নি বলে এবার বিয়ে করতে চাচ্ছে। তার মতলব আমি বুঝি। তোমাকে বলে রাখি দাদি, আমি এই লম্পট মাতব্বরকে কিছুতেই নিকে করব না। তাতে যদি আমার জান যায় অথবা গ্রাম ছাড়তে হয়, তাতেও রাজি।
রহিমন বিবি টাকাগুলো গেট কাপড়ে রেখে বলল, গ্রামের পাঁচটা বৌ বেটির চেয়ে তোকে বেশি ভালোবাসি। তাই তোর ভালোর জন্য বলছি, মাতব্বরের কথা মেনে নে। নচেৎ টাকা ফেরত দিয়েছিস জেনে কি করবে কি জানি। এবার আসিলো বুন। চলে যাওয়ার আগে বলল, আমার কথাটা ভেবে দেখিস।
সায়রাও সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, শুনে যাও দাদি, আমার ভাববার কিছু নেই। জান গেলেও আমি মাতব্বরকে নিকে করব না।
রহিমন বিবি নিজের ঘরে না গিয়ে মাতব্বরের কাছে গিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে বলল, না হুজুর সায়রা কিছুতেই রাজি হল না। তারপর সায়রা যা বলেছে বলল।
মাতব্বর তার কথা শুনে খুব রেগে গেলেও সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও। যা করার আমি করব।
কয়েকদিন পর এক গভীর রাতে মাতব্বর দুজন চামচাকে নিয়ে মঈন সেখের ঘরের দরজার কাছে এলেন। তারপর চামচা দুজনের দ্বারা বেড়া কেটে ফাঁক করে তাদেরকে বাইরে রেখে মাতব্বর একা ঘরে ঢুকে দেখলেন, হারিকেনের বাতি কমানো রয়েছে, মায়ে পুতে পাশাপাশি শুয়ে আছে দেখে সায়রাকে জড়িয়ে ধরে তার কাপড় খুলতে গেলেন।
রহিমন বিবি যেদিন এসেছিল, সেদিনই সায়রার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, মাতব্বর রাতের অন্ধকারে তার ইজ্জত লুটতে আসবে। তাই তারপর থেকে সে রাতে ঘুমায় না। মাতব্বরের লম্পটগিরী বন্ধ করার জন্য এবং নিজের ও গ্রামে গরিব ঘরের বৌ বেটিদের ইজ্জৎ বাঁচাবার এক কঠিন শপথ নেয়। আগে রাতে বিছানায় যাওয়ার সময় হারিকেনের বাতি কমিয়ে একটা হেঁসো রাখত, শপথ নেয়ার পর একটা ব্লেড কিনে এনে সেটাও বালিশের তলায় রেখে ঘুমায়।
আজও সেসব রেখে জেগে শুয়ে ছিল। মাতব্বর ও চামচাদের ফিস ফিসানি ও বেড়া কাটা সবকিছু জানতে পেরেও কিছু বলে নি। মাতব্বর ঘরে ঢুকে টর্চ লাইট জ্বালাতে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে ছিল। যখন তার কাপড় খুলছিল তখন বাধা না দিয়ে বালিশের তলা থেকে ব্লেড নিয়ে তৈরি হয়ে রইল। শেষে যখন উপগত হতে গেল তখন তার লিঙ্গটা এক হাতে ধরে অন্য হাতে ব্লেড চালিয়ে কেটে নিল। মাতব্বর অর্ত চিৎকার দিয়ে শালি মেরে ফেললরে বলে লিঙ্গের গোড়টা চেপে ধরে বিবস্ত্র অবস্থায় দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে এল। তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।
মাতব্বরের অবস্থা দেখে চামচা দুজনের আক্কেলগুড়ুম। তাড়াতাড়ি মাতব্বরকে গ্রামে কোনো ডাক্তার না থাকায় করিবাজের বাড়িতে নিয়ে গেল।
তখন গভীর রাত। কবিরাজের বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন। অনেক ডাকাডাকি করার পর কবিরাজ ঘর থেকে বেরিয়ে মাতব্বরের অবস্থা দেখে বললেন, এরকম কেসের চিকিৎসা আমি করতে পারব না। শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান। আপাতত আমি রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
মাতব্বরের আর্তচিৎকার ও লাফালাফিতে হালিমের ঘুম ভেঙে যেতে তাকিয়ে দেখল, বাবারে মারে শালী মেরে ফেললরে বলে মাতব্বর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, মাতব্বর এসেছিল কেন? তার কি হয়েছে? ওরকম চিল্লাতে চিল্লাতে চলে গেল কেন?
সায়রা তখন শাড়িটা ঠিক করে পরছিল। বলল, আমাকে ছেড়ে দে, দেখছিস রক্তে শাড়ি ভিজে গেছে।
হালিম মাকে ছেড়ে দিয়ে হারিকেনের সলতে বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় ও মায়ের। শাড়িতে রক্ত দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, এত রক্ত কেন মা?
আসল কথা বলতে না পেরে সায়রা বলল, এতরাতে মাতব্বর আমার কাছে এসেছিল বলে তার গায়ে বঁটির কোপ দিয়েছি। এসব তারই রক্ত। তারপর বলল, এসব কথা কাউকে বলবি না।
হালিম ভয়ার্তস্বরে বলল, কাল মাতব্বর যদি লোকজন নিয়ে এসে তোমাকে মারে?
চুপকর, তোকে ওসব ভাবতে হবে না। তারপর বালতি ভরে পানি এনে লাতা ভিজিয়ে ঘরের ভিতরের ও বাইরের রক্ত পরিষ্কার করতে লাগল।
মাতব্বর বাড়ির লোকজন ও চামচেরা ঘটনাটা গোপন রাখতে চেষ্টা করলেও এককান দু’কান করে সবাই জেনে গেল, অনেকে খুশী হয়ে মন্তব্য করল, যেমন কর্ম তেমনি ফল, সেই সাথে সায়রাকে সবাই বাহবা দিতে লাগল।
.
০২.
প্রায় একমাস হাসপাতালে থেকে মাতব্বর ঘরে ফিরে এলেন। হাসপাতালে থাকাতেই কিভাবে সায়রাকে শায়েস্তা করবেন চিন্তা করলে ও ঘরে ফিরে গ্রামের পরিস্থিতি দেখে আগের চিন্তা বাদ দিয়ে নতুন ভাবে চিন্তা করে কাজে নামলেন।
একদিন ফজলু ভিক্ষে করতে এলে তাকে বললেন, কতদিন আর ভিক্ষে করে খাবি? যা বলছি শোন, আমি তোকে একটা কাজ দেব। কাজটা করতে পারলে তোকে আর ভিক্ষে করে খেতে হবে না। তারপর কি করতে হবে না হবে বুঝিয়ে বলে বললেন, যদি কাজটা করতে পারিস, তা হলে সায়রার সঙ্গে তোর বিয়ে দেব, নতুন ঘর করে দেব, দশ কাটা জমিও তোকে লিখে দেব, বাজারে একটা মুদি দোকানও করে দেব। দোকানদারী করবি আর বৌ নিয়ে সুখে থাকবি।
ফজলু খুব রোগা ও খোঁড়া, কোনো কাজ করতে পারে না। তার মা ছাড়া কেউ নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা ভিক্ষে করে সংসার চালাত। বয়স বেশি হওয়ার কারণে সে ভিক্ষা করতে পারে না। এখন ফজলু ভিক্ষে করে সংসার চালায়। বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলেও কোনো মেয়ের বাপ তার কাছে মেয়ে দিতে চায় নি বলে আজও বিয়ে হয় নি। বয়সে মঈন সেখের চেয়ে দুতিন বছরের ছোট। মঈন সেখ যখন বেঁচে ছিল তখন ফজলু তাদের ঘরে যেত। এখনও যায়। সায়রাকে ভাবি বলে ডাকে।
মাতব্বরের কথা শুনে খুব খুশী হলেও চিন্তা করতে লাগল। সায়রা সুন্দরী, সেকি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে? শেষে যদি মাতব্বরের মতো অবস্থা তারও করে?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, কিরে কাজটা করতে পারবি না?
ফজলু হ্যাঁ-না কিছু বলতে না পেরে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে মাতব্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
মাতব্বর মুচকি হেসে বললেন, ঠিক আছে। যা করতে বললাম, তা যদি করতে না পারিস, তা হলে বাদ দে। এবার যা বলছি শোন, তারপর কি করতে হবে না হবে বলে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এই কাজটাও পারবি না?
এবার ফজলুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, পারব।
এই তো বাপের বেটার মতো কথা বলেছিস। যা যা বললাম মনে আছে তো?
হ্যাঁ হুজুর, মনে আছে।
তা হলে এবার যা বলে মাতব্বর আবার মুচকি হাসলেন।
.
ফজলু সারাদিন ভিক্ষা করে সন্ধ্যের সময় ঘরে ফিরে। আজ মাতব্বরের কথা শুনে তার মনে বসন্তের বাতাস বইছে। তাই সন্ধের অনেক আগেই ঘরে ফিরে এল।
তার মা জয়তুন বিবি বলল, আজ বেলা থাকতে ফিরে এলি যে?
ফজলু বলল, আজকাল আর কেউ ভিক্ষে দিতে চায় না। সবাই বলে মাফ কর।
জয়তুন বিবি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি আর করবি বাবা, আমাদের পোড়া কপাল। ভিক্ষে করা ছাড়া কি আর উপাই আছে।
ফজলু বলল, আজ শরীরটা ভালো নেই। দুপুরেও কেউ খেতে দেয় নি। তাড়াতাড়ি রান্না কর।
এমন সময় হালিমকে আসতে দেখে ফজলু বলল, কিরে বাবা, কেন এয়েছিস।
হালিম বলল, কাল রাত থেকে মায়ের খুব জ্বর। সারাদিন উঠতে পারে নি। দাদিকে মা যেতে বলেছে।
জয়তুন বিবি ছেলের দিকে চেয়ে বলল, তুই একটু দেখে আয়। আমি বেঁধে রেখে যাব।
ফজলু হালিমের সঙ্গে এসে দেখল, সায়রা কাঁথা মুড়ী দিয়ে শুয়ে আছে।
হালিম মায়ের গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বলল, দাদি ফজলু চাচাকে পাঠিয়েছে। সে বেঁধে রেখে আসবে।
কাছাকাছি ঘর বলে ফজলুর মা জয়তুন বিবি প্রায়ই সায়রার কাছে আসে। আর সায়রাও স্বামী বেঁচে থাকতে তাদের ঘরে মাঝে মধ্যে যেত। স্বামী মারা যাওয়ার পরও যায়।
সায়রার চার পাঁচের মতো জ্বর। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। কোনোরকমে চোখ খুলে বলল, ফজলু ভাই, চাচিকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বল। আমার জান কেমন করছে। আমি বোধ হয় আর বাঁচব না।
ফজলু সায়রার কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করার ইচ্ছাটা দমন করতে পারল না। সায়রার কথা শুনে সাহস করে কপালে হাত রেখে বলল, ইসরে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি মাকে ডেকে নিয়ে আসি, মাথায় পানি দিতে হবে। তারপর ঘরে গিয়ে মাকে বলল, এখুনি চল, রাধা-বাড়া পরে করো। সায়রা ভাবির খুব জ্বর, মাথায় পানি দিতে হবে।
জয়তুন বিবি ছেলের সাথে এসে সায়রার মাথায় পানি দিতে দিতে ছেলেকে বলল, তুই কবিরাজকে ডেকে নিয়ে আয়।
কবিরাজের ডিসপেন্সারী মাইল খানেক দূরে বাজারে। ফজলু গিয়ে বলল, কবিরাজ ভাই, জলদি চল। সায়রা ভাবির কাল থেকে খুব জ্বর।
কবিরাজ খুব শক্ত দীলের মানুষ। টাকা ছাড়া কারো চিকিৎসা করে না। ফজলুর কথা শুনে বলল, তোর তো কোনো বড় ভাই নেই, সায়রা ভাবি এল কোথা থেকে?
সায়রা ভাবিকে চিনলে না? মঈন ভাই-এর বৌ।
ও—মঈন সেখের বৌ-এর কথা বলছিস? মঈন সেখ তো প্রায় সাত আট মাস আগে মারা গেছে। আমার ফি ও ওষুধের দাম দেবে কে?
কবিরাজের স্বভাব ফজলু জানে। তাই বলল, মঈন ভাই মারা গেলে ও আমি তো আছি। আমি দেব। তুমি চলোতো কবিরাজ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তুইতো ভিক্ষে করে খাস, টাকা কোথায় পাবি?
ভিক্ষে করার সময় সবাই চাল দেয় না। কেউ কেউ টাকা পয়সাও দেয়। সেইগুলো আমি খরচ না করে জমিয়ে রেখেছি, সেখান থেকে দেব।
তা হলে চল বলে কবিরাজ ওষুধের ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা দিল।
ফজলু যখন কবিরাজকে নিয়ে ফিরে এল তখনও জয়তুন বিবি সায়রার মাথায় পানি ঢালছিল।
কবিরাজ সায়রাকে পরীক্ষা করে ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে কোনটা কখন খাবে বুঝিয়ে দিল। তারপর ফজলুর দিকে চেয়ে বলল, আমার ফি দশ টাকা ও ওষুধের দাম বিশ টাকা, মোট ত্রিশ টাকা দে।
এতক্ষণ পানি ঢালার পর সায়রার জ্বর একটু কমেছে। করিবাজের কথা শুনে বলল, ফজলু ভাই টাকা কোথায় পাবে? আমি ভালো হয়ে করিম চাচার কাছ থেকে চেয়ে তোমাকে দেব।
কবিরাজ অসন্তুষ্ট গলায় বলল, কিন্তু ফজলু তো টাকা দেবে বলে আমাকে ডেকে নিয়ে এল।
কবিরাজের কথা শেষ হতে ফজলু বলল, টাকা আমিই দেব। তুমি আমার সাথে এস। তারপর তাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।
কবিরাজ বেরিয়ে আসার সময় বলল, মাথায় পানি ঢালা বন্ধ করা চলবে না। জ্বর আরো না কমলে সারা রাত ঢালতে হবে।
ফজলু ভিক্ষা করে যে টাকা পয়সা পায়, তা থেকে মাকে অল্প কিছু দেয়। বাকিগুলো একটা মাটির ব্যাংকে ফেলে। ব্যাপারটা জয়তুন বিবি জেনে অসন্তুষ্ট না হয়ে বিপদে কাজে লাগবে ভেবে সন্তুষ্টই হয়েছে। কবিরাজকে নিয়ে ফজলু বেরিয়ে যাওয়ার পর বলল, ও ভিক্ষে করে কিছু টাকা জমিয়েছে। সেখান থেকে দেবে। তুই ভালো হয়ে করিম সেখের কাছ থেকে চেয়ে দিয়ে দিস। কবিরাজ কেমন লোক জানিস তো? টাকা না দিলে কারো চিকিৎসা করে না।
সায়রা বলল, হ্যাঁ চাচি, তাই দেব।
ফজলু কবিরাজকে বিদেয় করে এসে বলল, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তুমি এবার ঘরে গিয়ে রান্না কর। আমি ভাবির মাথায় পানি ঢালছি।
জয়তুন বিবি বললেন, তাই কর। হালিম ও সায়রা বোধহয় সারাদিন কিছু খায় নি। আমি হালিমকে নিয়ে যাই। রান্না করে ওকে খাইয়ে ওর হাতে সায়রার জন্য একমুঠো পাঠিয়ে দেব।
ঐ রাতে জয়তুন বিবি ছেলেকে নিয়ে সারারাত সায়রার মাথায় পানি ঢালল। সকালের দিকে জ্বর অনেকটা কমতে সায়রাই তাদেরকে ঘরে চলে যেতে বলল।
প্রায় আট ন’দিন পর সায়রা সুস্থ হল। এই ক’দিন ফজলু ও জয়তুন বিবি দিনে রাতে এসে তার সেবা করেছে। সুস্থ হওয়ার পর। সায়রা করিম সেখের ঘরে কাজে যেতে লাগল। চিকিৎসা করার কথা বলে করিম সেখের কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে একদিন ফজলুকে দিতে গেল।
ফজলু বলল, ওটা তোমার কাছে রাখ। দরকার পড়লে চেয়ে নেব।
সায়রা বলল, তুমি ও চাচি আমাকে না দেখলে মরেই যেতাম। তোমরা আমার যে উপকার করেছ, সে কথা জীবনে ভুলতে পারব না। তুমি কত কষ্ট করে টাকা জমিয়েছিলে। সেই টাকা দিয়ে আমার চিকিৎসা করিয়েছ। এই টাকা তোমাকে নিতেই হবে।
বললাম তো, টাকাটা এখন তোমার কাছেই থাক। দরকার হলে চেয়ে নেব? আমার কাছে থাকলে খরচ হয়ে যাবে বলে ফজলু তার কাছ থেকে চলে গেল।
এরপর ফজলু প্রতিদিন ভিক্ষে করে ফেরার সময় সায়রার সঙ্গে দেখা করে। যেদিন ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যায়, সেই দিন রাতে দেখা করতে যায়।
দিলদার মাতব্বর কিভাবে সায়রার ঘরে যাতায়াত করবে ও তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলবে ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সব করার আগেই সায়রার অসুখ হতে ফজলুর সাপেবর হল। মাতব্বর যা কিছু করতে বলেছিল, সে সব করতে হল না।
মাতব্বর তার চামচাদেরকে ফজলু ও সায়রার দিকে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। তাদের কাছ থেকে সবকিছু শুনে বললেন, তোমরা গ্রামে রটিয়ে দাও, ফজলু সায়রার ঘরে রাতে থাকে।
কয়েকদিনের মধ্যে চামচরা গ্রামময় কথাটা রটিয়ে দিল।
কথাটা করিম সেখের কানে পড়ার আগেই হঠাৎ একদিন তিনি মারা গেলেন। তার বড় ছেলে আসগরের বৌ চিররুগী। সায়রা তাদের ঘরে কাজে লাগার পর থেকে তার উপর আসগরের চোখ পড়েছিল। এমন কি তাকে নিকে করার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু বাপের ভয়ে তা সম্ভব হয় নি। বাপ মারা যাওয়ার পর সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল। সায়রা ও ফজলুকে নিয়ে যে কথা গ্রামে কানাঘুষো চলছে, তা শুনে দু’জনের উপরেই খুব রেগে গেল।
একদিন রাস্তায় ফজলুর সঙ্গে দেখা হতে আসগর জিজ্ঞেস করল, গ্রামের লোকজন যে কথা বলছে, তা কি সত্য?
মাতব্বর ফজলুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ যদি তোকে সায়রার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবি সায়রাকে বিয়ে করবি। তাই যখন তখন ওদের ঘরে যাস।
আসগর জিজ্ঞেস করতে মাতব্বরের শেখান কথা ফজলু বলল। আসগর খুব রেখে গেলেও সংযত কণ্ঠে আবার জিজ্ঞেস করল, সায়রা তোকে নিকে করতে চায়?
হ্যাঁ, চায়। তা না হলে আমাকে রাতে থাকতে দেয় কেন? ঠিক আছে, তুই যা বলে ঘরে এসে এক ফাঁকে সায়রাকে বলল, তুই নাকি খোঁড়া ফকির ফজলুকে নিকে করতে চাস?
গ্রামময় লোকজন বলাবলি করলেও এ পর্যন্ত সায়রার কানে পড়ে নি। আসগরের মুখে শুনে সায়রার পিত্তি জ্বলে উঠল। বলল, কে একথা বলেছে?
কে আবার বলবে? সারা গ্রামের লোক বলাবলি করছে।
তুমি কার কাছে শুনেছ?
ল্যাংড়া ফকির ফজলুর কাছে। সে নিজেই গ্রামের সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে?
এতদিনে সায়রা বুঝতে পারল, ফজলু ভাই কেন তার ভিক্ষে করা জমান টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছে? চিকিত্সা করার টাকা ফেরত দিতে কেন সে নেয় নি? কেন সে প্রতিদিন তার কাছে আসে?
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসগর বলল, তুই পরীর মতো দেখতে। আর ফজলু দেখতে চামচিৎকার মতো। তা ছাড়া সে ল্যাংড়া, শরীরের হাড় পাঁজরা দেখা যায়, তাকে নিকে করলে লোকজন তোকে ছি ছি করবে। তার চেয়ে আমার সঙ্গে নিকে বস। আমার কাছে খেয়ে পরে সুখে থাকবি। তোর ছেলেটাও খেয়ে পরে মানুষ হবে। আর শোন, লোকজনের কাছে কথাটা বেশি জানাজানি হওয়ার আগে তোকে নিকে করতে চাই।
সায়রা তখন চিন্তা করছিল, মাতব্বর ফজলুকে দিয়ে ফাঁদ পেতে তাকে জব্দ করতে চায়। আজ ফজলু এলে তাকে কি করবে না করবে ভাবছিল।
সায়রা কিছু না বলে মুখ নিচু করে রয়েছে দেখে আসগর ভাবল; সে তাকে নিকে করতে রাজি। চারদিকে তাকিয়ে কেউ নেই দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই কিছু চিন্তা করিস না। একবার শুধু হা বল, দেখবি আমি তোকে এক দু’দিনের মধ্যে নিকে করে ঘরে না তুলেছি তো আমার নাম আসগর না।
সায়রা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে বলল, মিয়া ভাই, আমাকে জড়িয়ে ধরতে সরম করল না?
আসগর বলল, আমি তো আর তোর আপন মিয়া ভাই নই। আপন ছাড়া যে কোনো সম্পর্কে বিয়ে করা যায়। চিররুগী বলে তোর ভাবি আমাকে কিছুই দিতে পারে না। তোকে নিকে করলে তুই আমাকে সবকিছু দিতে পারবি বলে আবার জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে গেল।
সায়রা তার গালে একটা চড় মেলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ছুটে সেখান থেকে নিজের ঘরে চলে এল। বিকেলে আর কাজ করতে গেল না। সিদ্ধান্ত নিল, খেতে না পেয়ে মরে গেলেও ওদের ঘরে কাজ করতে যাবে না।
আজ ভিক্ষে করে ফেরার পথে মাতব্বরের সঙ্গে দেখা হতে ফজলু বলল, আপনার কথামতো কাজ করেছি। গ্রামের লোকজন সায়রার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। এবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন না?
মাতব্বর মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, এবার তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
আপনি কিন্তু বিয়ের আগে নতুন ঘর করে দেবেন বলেছিলেন?
যা যা বলেছি সব ব্যবস্থাই করব। তার আগে তোকে একটা কাজ করতে হবে।
বলুন কি কাজ?
কাজ কিছু না। এখন আমি তোকে যা কিছু শেখাব বিচারের সময় সবার সামনে তুই সেগুলো বলবি।
বিচারের কথা শুনে ফজলু ভেবাচেকা খেয়ে গেল। বলল, কিসের বিচার? কার বিচার?
সে কথা তোর জানার দরকার নেই? শুধু শুনে রাখ, বিচারের মাধ্যমেই তোর বিয়ের ব্যবস্থা হবে।
বিচারের মাধ্যমে কথাটা শুনে ফজলু মনে করল, বিচারের লোকজনের সামনে তাদের বিয়ে হবে। তাই খুশী হয়ে বলল, লোকজনের সামনে কি বলতে হবে শিখিয়ে দেন।
কি বলতে হবে মাতব্বর তাকে বুঝিয়ে বললেন।
মাতব্বরের কথা শুনে ফজলুর মন খুশীতে নেচে উঠল। বলল, ঠিক আছে হুজুর, তাই বলব। তারপর হাঁটতে শুরু করে ভাবল, সায়রার সঙ্গে দেখা করে ঘরে যাবে। আবার ভাবল, সে তো এখন ঘরে নেই। কাজ থেকে সন্ধ্যের সময় আসে। তবু মনের তাগিদে সায়রাদের ঘরে এসে তাকে দেখে বলল, আজ কাজে যাও নি?
সায়রা ফজলুর উপর ভীষণ রেগেছিল। তার কথার উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে টাকার পুঁটলীটা এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এখুনি চলে যাও। আর কোনো দিন আসবে না।
সায়রা টাকা ফেরত দিতে ও তার কথা শুনে ফজলুর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে না পেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, যখন দরকার হবে তখন চেয়ে নেব বলেছি। এখন দিচ্ছ কেন? আর আমাকেই বা আসতে নিষেধ করলে কেন?
সায়রা রাগ চেপে রেখে বলল, গ্রামের লোকজন তোমাকে নিয়ে আমার নামে বদনাম করছে শোন নি?
ফজলু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ও এই কথা? যা সত্য, গ্রামের লোকজন সেটাই বলছে। এটা আবার বদনাম হবে কেন?
সত্য আবার কি? তুমি কি মনে করেছ? আমি তোমার সঙ্গে নিকে বসব?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করেছি।
তা হলে তুমিই গ্রামে কথাটা প্রচার করেছ?
আমি করতে যাব কেন? গ্রামের লোকজনের কি চোখ নেই। রোজ রোজ তোমার ঘরে দিন রাত আসি, তা কি তারা দেখতে পায় না? মাতব্বর হুজুরের কানেও কথাটা গেছে। আজ ফেরার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, কথাটা সত্য। শুনে খুশী হয়ে বললেন, তা হলে দু’একদিনের মধ্যে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
সবকিছু যে মাতব্বরের পাতা ফাঁদ তা সায়রার দৃঢ় বিশ্বাস হল। নিজের বোকামির জন্য রাগে ও দুঃখে সায়রা কেঁদে ফেলল। অল্পক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, তুমি যা ভেবেছ, তা ঠিক নয়। আমি তোমাকে ভায়ের মতো মনে করে তোমার সাহায্য নিয়েছি। যদি জানতাম মাতব্বরের কথামতো কাজ করছ, তা হলে অসুখে মরে গেলেও তোমার সাহায্য নিতাম না।
ফজলু বলল, মাতব্বরের কথা বাদ দাও। আমি তোমাকে নিকে করব, তুমি রাজি আছ কিনা বল?
সায়রা খুব রাগের সঙ্গে বলল, আমাকে যে নিকে করবে, খাওয়াবে কি? ভিক্ষে করে মায়ে পুতে দু’বেলা খেতে পাও না। তা ছাড়া তোমার যা সুরৎ, তোমার দিকে চাইতেই ঘেন্না লাগে। চলে যাও এখন থেকে। আবার যদি আস, তা হলে কি করি তখন দেখবে।
এবার ফজলুও খুব রেগে গেল। চড়া গলায় বলল, এই মাগি, তেজ দেখাবি। তোর তেজ না ভেঙেছি তো আমার নাম ফজলু না।
সায়রাও চড়া গলায় বলল, তেজ ভাঙতে এসে দেখিস, মাতব্বরের মতো তোর অবস্থা না করিতো আমার নামও সায়রা না।
এই কথা শুনে ফজলু চুপসে গেল। আর কিছু না বলে চলে গেল।
পরের দিন ভিক্ষে করতে বেরিয়ে ফজলু মাতব্বরের সঙ্গে দেখা করে গতকাল সায়রা যা কিছু বলেছিল বলল।
মাতব্বর রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ঐ মাগির কত তেজ দেখব। তুই চিন্তা করিস না। যেমন করে হোক তোর সঙ্গে ওর নিকে দেবই। তুই এখন যা। ভেবে দেখি কিভাবে কি করা যায়।
.
সায়রার কথা শুনে ও তার হাতের চড় খেয়ে আসগর প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেমন করে হোক প্রতিশোধ নেবে। কিভাবে নেবে ঠিক করতে না পেরে মাতব্বরের কাছে গেল।
ফজলু চলে যাওয়ার পর মাতব্বর কিভাবে তার সঙ্গে সায়রার নিকে দেবেন বৈঠক খানায় বসে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিলেন?
আসগার এসে সালাম দিল।
মাতব্বর চোখ খুলে আসগরকে দেখে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কি খবর ভাতিজা?
খবর আর কি? গ্রামের লোকজন ফজলু আর সায়রাকে নিয়ে যেসব কথা বলছে, তা কি আপনার কানে পড়ে নি?
পড়েছে। তাই তো চিন্তা করছিলাম কি করা যায়?
আপনি হলেন গ্রামের মাথা। আপনি যা করবেন সেটা সবাই মানতে বাধ্য।
আমি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একদিন গ্রামের লোকজনদের ডেকে ওদের রিচারের ব্যবস্থা করব এবং সবার মতামত নিয়ে বিচারের রায় ঘোষণা করব।
হ্যাঁ চাচা, যত তাড়াতাড়ি পারেন সেই ব্যবস্থাই করুন।
দু’একদিনের মধ্যে কবর। তুমি এখন যাও। বিচারের রায়ের ব্যাপারে আমি এখন চিন্তা করব।
<