স্বর্গদ্বীপ -– ভলিউম ৫৪ — তিন গোয়েন্দা
প্রথম প্রকাশ: ২০০১
উজ্জ্বল নিওন আলোয় লেখা ওয়েলকাম টু নর্থ ক্যারোলিনা সাইনটা যখন চোখে পড়ল ওদের, মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে তখন।
খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে আমার, ঘোষণা করল মুসা। দুই হাত স্টিয়ারিঙে। চোখ সামনের রাস্তায় নিবদ্ধ। না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়লে জিনার কোন উপকার করতে পারব না।
ম্যাপ দেখে রবিন জানাল, সামনে আর মাইল দশেক গেলেই খাবার পাওয়া যাবে।
দারুণ! বলল উচ্ছ্বসিত মুসা। সারাদিনের মধ্যে সবচেয়ে ভাল খবরটা দিলে। গাড়িটারও পেট্রল দরকার। আমাদেরও স্ট্রেল দরকার।
কটা বাজে? হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল কিশোর। দুহাত টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল।
নাস্তার সময় হয়ে গেছে, মুসা জানাল। ঘুমিয়ে গেছিলে তো, তাই জানো না। তোমাদের দুজনকেই একটা সংবাদ দিই। ভার্জিনিয়া থেকেই আমাদের অনুসরণ করে আসছে একটা ট্রাক।
নাম্বার দেখেছ? সতর্ক হয়ে উঠল কিশোর। মুহূর্তে ঘুম উধাও হয়ে গেল চোখ থেকে।
না, রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল মুসা। বেশি দূরে। দেখা যাচ্ছে না।
মাথাটা সামান্য উঁচু করে সাবধানে তাকাল পেছনে বসা রবিন। আমিও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হতে পারে আমাদের মতই সে-ও ফ্লোরিডা থেকেই আসছে। কাকতালীয় ব্যাপার।
উঁহু, মুসা মানতে চাইল না। আমি গতি বাড়ালেই সে-ও বাড়ায়, কমালে কমায়। অনুসরণ যদি না করে থাকে, তাহলে কি খেলছে আমাদের সঙ্গে?
এসিট র্যাম্পের শেষ মাথায় এসে একটা গ্যাস স্টেশনে গাড়ি ঢুকিয়ে দিল মুসা। পাম্পের লাগোয়া একটা বড় রেস্টুরেন্ট। খামারবাড়ির মত চেহারা। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তেল ভরতে লাগল কিশোর। মুসা আর রবিন নজর রাখল রাস্তার দিকে।
ওই যে, মুসা বলল।
গ্যাস স্টেশনের পাশ দিয়ে দ্রুত সরে গেল ট্রাকটা। উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল ওটাকে।
লোক তো মনে হলো দুজন, তাই না? কিশোর বলল।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল মুসা। কিন্তু গতি তো কমাল না একবিন্দু। তারমানে আমারই ভুল ছিল। আমাদের অনুসরণ করেনি ওরা।
তেল ভরা শেষ করে রেস্টুরেন্টের সামনে এনে গাড়িটা রাখল ওরা। তারপর রেস্টুরেন্টে ঢুকল। একটা টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়ল। রাত দুটো বাজে। কিন্তু এখনও টিন-এজ ওয়েইট্রেসের মুখের হাসি মলিন হয়নি। হাসিমুখে স্বাগত জানাল ওদের। কথায় দক্ষিণাঞ্চলীয় টান। একটা করে মেন্যু তুলে দিল প্রত্যেকের হাতে।
ডিনার পাওয়া যাবে এত রাতে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
যাবে, হাসিটা উজ্জ্বল হলো আরও। দিনে-রাতে যখন খুশি যে কোন খাবার চাও, দিতে পারব আমরা।
তাই নাকি! খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়ল মুসার।
খাবারের অর্ডার দেয়া হলো। এনে দিল ওয়েইট্রেস। নীরবে খেয়ে চলল ওরা। রাত জেগে, একটানা গাড়িতে বসে থেকে ক্লান্ত। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়া শেষ করে বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল।
ভাবছি, গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল কিশোর, আমাদের ট্রাকের বন্ধুরা না এসে হাজির হয় আবার এখন।
চলেই তো গেল, জবাব দিল রবিন। আর আসবে কি?
সে আর মুসা আগে আগে হাঁটছে।
খাইছে! বলে হঠাৎ গুঙিয়ে উঠল মুসা।
দুজনে তাকিয়ে আছে ভ্যানটার দিকে।
কি দেখে থমকাল ওরা, পেছনে থাকায় বুঝতে পারল না প্রথমে কিশোর। তারপর লক্ষ করল, স্বাভাবিকের তুলনায় নিচু হয়ে আছে গাড়িটার ছাত। এর কারণ, চার চাকার রিমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এখন ওটা। চারটে টায়ারই কেটে ফালা ফালা করে দেয়া হয়েছে।
কাটা রবারগুলোর দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল মুসা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এরজন্যে পস্তাতে হবে ওদের!
পস্তানো তো পরে, কিশোর বলল। আগে ওদের নাগাল তো পেতে হবে। তার জন্যে গাড়িটা সচল করা দরকার। রাস্তার ধারে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা চাকা মেরামতের দোকান দেখেছি। দেখি, চারটে টায়ারের জন্যে কি পরিমাণ খসায় পকেট থেকে।
চার নয়, পঁচটা, শুধরে দিল মুসা। বাড়তি চাকাটাও খতম করে দিয়ে গেছে। ওই দেখো। ভ্যানের পেছনে দরজার ফ্রেমে আটকে রাখা চাকাটা দেখাল সে। কিন্তু কে করল শয়তানিটা?
রাত দুপুরে রসিকতা করতে আসেনি কেউ, কিশোর বলল। ইচ্ছে করে করেছে। ভয় দেখিয়ে আমাদের রকি বীচে ফেরত পাঠানোর জন্যে।
সামান্য কয়খান চাকা কেটে আমাদের ফেরত পাঠাবে? ভুরু নাচাল রবিন। জিনাকে না নিয়ে ফেরত যাচ্ছি না আমরা, এটা ওদের বুঝিয়ে দেয়া দরকার।
সময় হলে আপনি বুঝবে, কিশোর বলল।
শতিনেক ডলার আর পঁয়তাল্লিশটা মিনিট গচ্চা দিয়ে আবার এসে রাস্তায় নামল ওরা। ভোর রাতের নীরবতা। ঘুমন্ত পরিবেশ। কিন্তু ওদের চোখে ঘুম নেই।
কখন যে গিয়ে পৌঁছাতে পারব, নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করল মুসা।
ম্যাপ দেখে বলল রবিন, আরও তিনশো মাইল গেলে পাওয়া যাবে ফ্লোরিডার সীমান্ত।
তারপর? ফ্লোরিডা থেকে গাল আইল্যান্ড?
আজ রাত নটা-দশটা নাগাদ পৌঁছে যাব, রবিন বলল। বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছে দারুণ হবে জায়গাটা। গাল আইল্যান্ড, লোকসংখ্যা পাঁচশো সাঁইত্রিশ, গাড়িটা যেখান থেকে ভাড়া নিয়েছে, তারা একটা ছোট বই দিয়েছে। তথ্যগুলো লেখা আছে তাতে। ফ্লোরিডার দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ, সারাসোটা আর নেপসের মাঝামাঝি। বোটে করে যাওয়া যায়, আবার গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়। গাড়িতে করে যেতে হলে সীভিউ থেকে ফ্ল্যামিঙ্গো পাসের ভেতর দিয়ে আইল্যান্ড কজওয়ে পেরিয়ে যেতে হবে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে চমৎকার একটা সাদা বালির সৈকত আছে…।
বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, দেখো তো, ওয়াইল্ড পাম মোটেলটার কথা লেখা আছে নাকি?
আছে, ট্রাভেল বুকের পাতা উল্টে দেখে বলল রবিন। দ্বীপের উত্তর প্রান্তে। বলছে প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব সুন্দর ওখানকার। থাকার জন্যে বিশটা আধুনিক কটেজ আছে, এয়ারকন্ডিশনার আর টিভি সহ। সৈকতের কাছে। মার্কেটিং সুবিধা আর নাইটলাইফ সহ।
এই নাইটলাইফটা কি জিনিস? মুসার প্রশ্ন।
বুঝতে পারছি না, জবাব দিল রবিন। গেলেই বোঝা যাবে। তবে রাতের বিনোদনের কথাই বলেছে হয়তো, সেটারই নাম দিয়েছে নাইটলাইফ।
.
পাক্কা তিরিশটা ঘণ্টা রাস্তায় কাটিয়ে অবশেষে সরু আইল্যান্ড কজওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা।
নাইটলাইফের তো কিছুই দেখছি না, চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল কিশোর।
ওই যে নাইটলাইফ, হাত তুলে সামনের বাড়িটা দেখাল মুসা। কুপারস ডিনার। এখনও খোলা।
কিশোর আর রবিন দুজনেই হাসল। তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে। পুরানো ঢঙে তৈরি বাড়ি, সাদা রঙ করা। দ্বীপের মেইন স্ট্রীটের নাম কারলু রোড। এই রোডের পাশে কজওয়ের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা।
নাইটলাইফ বটে, বিড়বিড় করল কিশোর।
ওই যে, আমরা যেটা খুঁজছি, গাল আইল্যান্ড মেরিনার দিকে হাত তুলল রবিন। সাইনবোর্ডে লেখা: ওয়াইন্ড পাম মোটেল। চার মাইল।
মুসা, ডানে ঘোয়রা, বলল সে।
সাংঘাতিক ঝড় হয়ে গেছে এখানে, বিধ্বস্ত গাছপালাগুলো দেখে বলল মুসা। ভেঙে এসে রাস্তায় পড়ে আছে কিছু নারকেল আর পাম গাছ। সে-সব এড়িয়ে সাবধানে চালাতে হচ্ছে তাকে।
দিনের আলোয় নিশ্চয় অন্য রকম লাগবে, হতাশ মনে হলো রবিনকে। এখন তো একেবারে বিবর্ণ!
শুধু বিবর্ণই নয়, রুক্ষও লাগছে। রাস্তায় মানুষজন নেই। বাড়িঘরও তেমন দেখা যাচ্ছে না এদিকটাতে।
সত্যি কথা বলব? মুসা বলল। সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও দেখছি না আমি। বরং ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। দেখলে মনে হয় কাজ করতে করতে কিসের আশঙ্কায় যেন হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে উন্নয়ন। দেখছ না কেমন আধখাপচা তৈরি হয়ে পড়ে আছে বাড়িগুলো?
যা-ই বলো, কিশোর বলল, এতটা খারাপ কিন্তু না। আমি তো কার্ড তৈরি করার উপযোগী প্রচুর দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।
কথাটা ভুল বলেনি সে। গাছপালার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে ঝড়ে, কিন্তু এখনও প্রচুর গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে–ছবির মত করে সাজানো, তার ওপাশে চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে গালফ অভ মেসিকো।
যাক, এলাম শেষ পর্যন্ত, শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। পুরো আধপাক গাড়ি ঘুরিয়ে মোড় নিল। পাশ দিয়ে চলে গেল গোলাপী নিওন আলোয় লেখা ভ্যাকেন্সি সাইন। গাড়ি থামাল এনে ওয়াইল্ড পাম মোটেলের অফিসের সামনে।
ওয়াইল্ড পাম কেন নাম রাখা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে, হোটেলের সীমানার মধ্যে জন্মানো উঁচু উঁচু পামের জটলাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। প্রচুর গাছ।
জেগেই আছে মনে হয়, আলোকিত অফিসের দিকে তাকিয়ে থেকে ইমার্জেন্সি ব্রেকটা লাগিয়ে দিল মুসা।
ঘড়ি দেখল কিশোর। হাত-পা টান টান করে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার আড়ষ্টতা কাটাতে চাইল। নামার সময় হয়েছে।
হঠাৎ এক ধাক্কায় তার পাশের দরজাটা খুলে ফেলে লাফ দিয়ে নেমে দিল দৌড় মুসা।
.
০২.
কিশোরও দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে মুসার পেছনে ছুটল। অফিসের পেছনের ঘন ঝোঁপঝাড়গুলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে মুসা।
মুসা! দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ঝোঁপের অন্ধকারে মুসাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাল তার চোখ।
জবাব দিল না মুসা।
মুসা! আবার ডাকল সে।
আচমকা হুড়মুড় করে অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় বেরিয়ে এল মুসা।
অফিসের পেছনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছিল একটা লোক, কোনখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল হাত তুলে দেখাল সে। আমাদের দেখে দৌড় মারল।
চেঁচামেচি শুনে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন লম্বা এক ভদ্রলোক। বয়েস প্রায় ষাট। ছোট করে ছাটা ধূসর রঙের দাড়ি। অফিসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। পেছনে বেরোল কিশোরদের বয়েসী এক কিশোরী।
হালো, ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক, এসেছ তাহলে। তোমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
হ্যাঁ, জবাব দিয়ে দ্রুত সেদিকে এগোল কিশোর। পেছনে এল মুসা।
আমি জেরাল্ড গ্লেজব্রুক, হাত বাড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোক। ইভা তো তোমাদের দেরি দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল।
কতদিন পর দেখা! কেমন আছ তোমরা, কিশোর? এগিয়ে এল মেয়েটা। লম্বা, ছিপছিপে দেহ। সুন্দরী। লাল চুলগুলো মাথার পেছনে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘোড়ার লেজের মত করে বেঁধেছে।
চাচা, ও কিশোর পাশা, পরিচয় করিয়ে দিল ইভা। আর ও মুসা, মুসা আমান …আর এই যে, রনি।
গাড়ি থেকে নেমে চলে এসেছে রবিনও। কিশোরের কাছ থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
খুব খুশি হলাম তোমাদের দেখে, আন্তরিক কণ্ঠে বললেন মিস্টার ব্রুক এই খানিক আগেও তোমার বাবা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন তোমরা এসেছ নাকি, রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি। ইভা তো তোমাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তোমাদের মত গোয়েন্দা নাকি আর সারা দুনিয়ায় নেই।
বাড়িয়ে বলেছে, হাসল কিশোর। বন্ধু তো। প্রশংসা করা কথাবার্তা বিব্রত করে ওকে, তাই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্যে বলল, যাই হোক, আপনাদের চমকে দিতে চাই না। তবু বলতেই হচ্ছে, আপনাদের পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছিল একটা লোক। আপনারা কোন শব্দটব্দ শুনেছেন? অস্বাভাবিক কিছু?
ইভার সবুজ চোখের তারায় শংকা দেখতে পেল কিশোর।
না! দেখিনি! হঠাৎ রেগে গেলেন মিস্টার ব্রুক। তাই তো বলি! আমি আরও ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না কেন আজ? এসো, ভেতরে এসো। সব বলছি তোমাদের।
উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত একটা ঘরে ঢুকল ওরা। ফরমিকার কাউন্টার থেকে শুরু করে লাল প্লাস্টিকের চেয়ার আর অন্যান্য আসবাবপত্র সব কিছুতে ধুলো পড়ে আছে। মলিন হয়ে গেছে চেহারা, লক্ষ করল কিশোর। যত্ন নেয়া হয় না বোঝা যায়। যেন কোন কারণে ওগুলোর প্রতি একটা অনীহা জন্মে গেছে মালিকের।
পেছনে আমার বেডরূম, পর্দা ঝোলানো একটা দরজা দেখালেন মিস্টার ব্রুক। ইভারটা তার পাশে।
কাউন্টারের পেছনে সারি সারি নম্বর। প্রতিটি নম্বরের ওপরে হুক। চাবি ঝুলছে ওগুলো থেকে।
সুন্দর একটা রিসর্ট ছিল এটা, দুঃখের সঙ্গে জানালেন মিস্টার ব্রুক। ফলের হালুয়া কাটতে চাচাকে সাহায্য করল ইভা। এটা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিশোরদের আসার শব্দ শুনে কাজ রেখে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিল দুজনে। প্রচুর ট্যুরিস্ট আসত। ভালই ছিলাম আমরা। কিন্তু দুর্ঘটনাটাও ঘটল, আমরাও গেলাম।
চাচার সঙ্গে সুর মেলাল ইভা, চাচার ডকটার সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে হলুদ রেসিং বোটটা।
দুজন ট্যুরিস্ট রোদ পোয়াচ্ছিল, এই সময় এসে তো মারল বোটটা। ফুঁসে উঠলেন মিস্টার ব্রুক। দুজনকেই হাসপাতালে নিতে হয়েছে।
বোট চালকের কি খবর? জানতে চাইল কিশোর।
ওর আর কি হবে? বিরক্তিতে মুখ বাঁকালেন মিস্টার ব্রুক। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে অ্যাক্সিডেন্টের পর পরই ফুল স্পীডে পালিয়ে গেছে সে। তার মানে ইচ্ছে করে ভেঙে দিয়ে গেছে ডকটা। পুলিশ পরে জানতে পেরেছে বোটটা নাকি চোরাই বোট ছিল। চোরটাকে ধরতে পারেনি। বোটটাও নাকি আর খুঁজে পায়নি। পুলিশের ধারণা, ডকে বাড়ি লেগে বোটটারও ক্ষতি হয়েছিল। ফেটে-টেটে গিয়েছিল নিচের দিকে। পানি ঢুকে ডুবে গেছে চ্যানেলে। চোরটাও মরেছে পানিতে ডুবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।
ঘটনাটা কি জিনার নিখোঁজ হওয়ার আগের? জানতে চাইল কিশোর।
আগের দিনের, ইভা জানাল।
জিনা কি করে নিখোঁজ হলো, খুলে বলবে? অনুরোধ করল কিশোর।
বলব না কেন? বলার জন্যেই তো তোমাদের ডেকে আনলাম, ইভা বলল।
গাল আইল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে জিনার রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হওয়ার খবরটা মুসাদের বাড়িতে ফোন করে ইভাই জানিয়েছিল। মুসা গিয়ে খবর দিয়েছে। কিশোর আর রবিনকে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সেদিনই রকি বীচ থেকে গাল আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে তিনজনে।
খুক করে কাশল ইভা। জিজ্ঞেস করল, খাবে কিছু?
মাথা নাড়ল কিশোর, না, আমরা খেয়ে এসেছি। তুমি বলো।
জিনা এখানে বেড়াতে আসার পর থেকে রোজই আমরা একসঙ্গে সৈকতে বেড়াতে যেতাম। সেদিন আমার কিছু জরুরী কাজ ছিল অফিসে। চাচাকে সাহায্য করতে হয়েছিল। জিনাকে বললাম সৈকতে চলে যেতে। আমি পরে যাব।
লাঞ্চের পর খাবার নিয়ে গেলাম সৈকতে। আমাদের বসার প্রিয় জায়গাগুলোতে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না তাকে। ভাবলাম, শহরে-টহরে গেছে। চলে আসবে।
আমি অপেক্ষা করতেই থাকলাম। কিন্তু সে আর আসে না। চাচার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়েছিল সে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোটেলে ফিরে এলাম। চাচাকে বললাম সব। তখনও খারাপ কিছু সন্দেহ করিনি আমরা।
সন্ধ্যার পরেও যখন ফিরল না, ভীষণ দুশ্চিন্তা হতে লাগল। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খোঁজ নিল চাচা। আমিও কয়েক জায়গায় ফোন করলাম। কোথাও যায়নি জিনা।
একটানা কথা বলে দম নেয়ার জন্যে থামল ইভা।
গেকো গাড়িটা পরে খুঁজে পেয়েছে পেলিক্যান লেন-এ, মিস্টার ব্রুক জানালেন, পরিত্যক্ত অবস্থায়।
গেকো! চোখের পাতা সরু করে ফেলল মুসা। গেকো তো জানি এক ধরনের গিরগিটি?
আরে না না, এ গেকো সে গেকো নয়, না হেসে পারলেন না মিস্টার ব্রুক। এর পুরো নাম হেরিং গেকো। ডেপুটি শেরিফ। আমাদের এখানকার পুলিশ ফোর্স। ওই একজনের ওপরই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পুরো দ্বীপ দেখাশোনার। যাই হোক, আঙুলের ছাপটাপ খোঁজাখুঁজি করেছে সে। পেয়েছে তিনজনের। আমার, জিনার আর গাড়ির গ্যারেজের মিস্ত্রির।
মাত্র একজন পুলিশ? বিশ্বাস হচ্ছে না রবিনের। আস্ত একটা দ্বীপের দেখাশোনার জন্যে মাত্র একজন?
হ্যাঁ, বিরক্তির সঙ্গে জবাব দিলেন মিস্টার ব্রুক। অথচ দেখো, সীভিউর কাউন্টি কর্তৃপক্ষ পাশের দ্বীপ ক্যাসটেলো কী-কে দিয়েছে পাঁচজন পুলিশ। আর আমাদের মাত্র একজন। বড় বেশি পক্ষপাতিতু!
তা, আপনাদের গেকো সাহেব কোন সূত্রটুত্র পেয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।
কিছু না, জবাব দিলেন মিস্টার ব্রুক। গাড়িটা রেখেছি অফিসের পেছনে। তোমরা ইচ্ছে করলে ওটাতে সূত্র পড়ে আছে কিনা খুঁজে দেখতে পারো। তার জন্যে গাড়িটাকে টুকরো টুকরোও যদি করে ফেলতে হয়, তাতেও আমার আপত্তি নেই।
জিনাকে জিম্মি হিসেবে আটকে রেখে টাকার জন্যে নোট পাঠিয়েছে? কিংবা ফোন-টোন কোন কিছু?
কিছুই পাঠায়নি। পাঠিয়ে লাভ হবে না, জানে। আমার তো টাকা-পয়সা নেই যে দিতে পারব। শুধু কি কিডন্যাপিং; চুরি-দারি আরও কত কিছুই করছে। এই তো, জিনা নিখোঁজ হওয়ার তিন রাত আগে আমার দুটো পাম গাছ চুরি করে নিয়ে গেছে।
খাইছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। পাম গাছ! গাছ চুরি করে কার কি লাভ?
ফ্লোরিডায় কিছুদিন ধরে পামের এক ধরনের রোগ হচ্ছে, পাম-ফাঙ্গাস বলে এক জাতের ফাঙ্গাস ধ্বংস করে দিচ্ছে গাছগুলোকে, মিস্টার ব্রুক জানালেন। কাজেই এ সব গাছের এখন খুব কদর এ অঞ্চলে। সুস্থ গাছ পেলে ভাল দাম দিতে রাজি আছে অনেকে।
মজার ব্যাপার হলো, ইভা বলল, এত নিঃশব্দে কাজটা করেছে ওরা, রাতের বেলা কোন শব্দই শুনিনি আমরা। এমনকি গাছগুলো যে গায়েব হয়ে গেছে পরদিন সকালেও খেয়াল করিনি আমি। মাটিতে গর্ত দুটো প্রথমে চাচার চোখেই পড়েছে।
প্রায় সারাটা জীবনই এখানে কাটিয়ে দিলাম, মিস্টার ব্রুক বললেন, চোরের ছায়াও দেখিনি কখনও। ঘরের দরজা-জানালায় তালা তো দূরের কথা, ছিটকানিও লাগাইনি কোনদিন। কিন্তু হঠাৎ করেই বড় বড় শহরের মত চুরি-ডাকাতি আর নানা রকম অপরাধের কাজ শুরু হয়ে গেছে গাল আইল্যান্ডেও। ফোঁস করে। নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। বাস্তবে ফিরে এলেন যেন। এই দেখো, খালি নিজের দুঃখের বয়ানই করে চলেছি। এতটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছ, নিশ্চয় খুব ক্লান্ত। চলো, ঘুমানোর জায়গা দেখিয়ে দিই। আমারও ঘুম পেয়েছে।
ভাববেন না, মিস্টার ব্রুক, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর, জিনাকে তো খুঁজে বার করবই আমরা, আপনার গাছগুলোও খুঁজে বের করে দেব।
অত মিস্টার-ফিস্টার বলা লাগবে না, স্রেফ আঙ্কেল বলবে আমাকে, বলে দিলেন মিস্টার ব্রুক। নিজের বাড়ি মনে করবে। সামান্যতম অসুবিধে হলেও জানাবে আমাকে।
একটা হুক থেকে চাবি খুলে নিয়ে কিশোরের হাতে ফেলে দিলেন তিনি। দশ নম্বর কটেজটার চাবি। ওখানেই থাকার ব্যবস্থা করেছেন ওদের।
সারি ধরে হেঁটে গিয়ে শেষ মাথার কটেজটা, বলে দিলেন তিনি। জিনাকে দিয়েছিলাম তিন নম্বরটা। ও আসার পর ইভাও তার সঙ্গেই ঘুমাত।
থ্যাংকস, অ্যান্ড গুডনাইট, জেরি আঙ্কেল, দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে হাত নাড়ল মুসা।
ইভাও চলল ওদের সঙ্গে। কিশোর বলল, আসা লাগবে না। তুমি যাও। আমরা চিনে নিতে পারব।
তোমরা আসায় একটা পাষাণ নেমে গেল আমার মন থেকে, ইভা বলল। উফ, কি দুশ্চিন্তাই যে হচ্ছিল।
আর দুশ্চিন্তার দরকার নেই, রবিন বলল। জিনাকে খুঁজে বের করবই আমরা।
ইভাকে গুডনাইট জানাল তিন গোয়েন্দা। ঘরে ঢুকে ওর দরজায় ছিটকানি এবং শিকল লাগানোর শব্দ না শোনা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর রওনা হলো গাড়ির দিকে। ব্যাগ-সুটকেসগুলো আনতে হবে।
ওগুলো নিয়ে এল নিজেদের ঘরে।
খুব সুন্দর, বড় একটা ঘর। বড় বড় খাট। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে মুসা বলল, উফ, বাপরে বাপ! এত কাহিল জীবনে হইনি!
হবেই। এত পথ গাড়ি চালানো কি সোজা কথা, রবিন বলল।
কথা না বলে আর, শুয়ে পড়ো, কিশোর বলল। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে আবার ঘুম থেকে। সাতটার মধ্যে তদন্ত শুরু করে দেব। প্রথমেই খুঁজে দেখতে হবে গাড়িটা। যেটা থেকে নিখোঁজ হয়েছে জিনা।
মুসা বলল, একবার ঘুমালে এখন আমার কানের কাছে কামান দাগলেও উঠতে পারব কিনা সন্দেহ। তবু, সকাল বেলা ঠেলাঠেলি করে দেখো।
হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল কিশোর।
সবে শুয়েছে, হঠাৎ ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ হলো।
ঝট করে উঠে বসল আবার কিশোর। মুসা আর রবিনও ঘুমায়নি এখনও। শব্দটা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
ঘটনাটা কি… বলতে গেল মুসা।
কিন্তু কথা শেষ হলো না তার। ভেসে এল তীক্ষ্ণ চিৎকার।
.
০৩.
আই, কিশোর! কিশোর! চিৎকার করছে ইভা। তোমাদের গাড়ি! জানালার কাঁচ ভেঙে কে জানি ঢোকার চেষ্টা করছে!
এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ছুটে বেরিয়ে এল ওরা। রবিন গেল ইভার কাছে। মুসা আর কিশোর ছুটল গাড়ির দিকে।
ওই যে যাচ্ছে! ওই যে ব্যাটা! চিৎকার করে উঠল মুসা। ছুটন্ত মূর্তিটার দিকে দৌড় দিল সে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
কিন্তু ধরা গেল না লোকটাকে।
পালাল ব্যাটা! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা।
সামনের বাঁ পাশের জানালাটা ভেঙেছে, কিশোর বলল।
গাড়ির দিকে এগোল দুজনে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে রবিন আর ইভা।
গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিল রবিন।
কার-ফোনটা নিয়ে গেছে, তারের ছেঁড়া মাথাটা তুলে দেখাল সে। আর কিছু মনে হয় নিতে পারেনি। ইভার চেঁচামেচি শুনে দৌড় দিয়েছে।
নেয়ার মত আর তেমন কিছু ছিলও না ভেতরে। আগেই নিয়ে গেছে ওরা।
তবু, কিশোরও আরেকবার ভালমত দেখল, আর কিছু খোয়া গেছে কিনা।
সীটের ওপর পড়ে থাকা কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করল। জানালায় আটকে থাকা টুকরোগুলোও টেনে টেনে তুলে ফেলে দিল। ফোকরটা বন্ধ করে দিল প্লাস্টিকের কাপড় দিয়ে। আরও একবার ইভাকে গুডনাইট জানিয়ে শুতে গেল আবার নিজেদের ঘরে।
কিছু একটা ঘটছে এখানে, কিশোর বলল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। জিনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল। আমরা যাতে ওকে খোঁজাখুঁজি না করি, সে জন্যে নানা রকম শয়তানি শুরু করেছে এখন। ফোনটা নিয়েছে বটে, কিন্তু চুরি করার উদ্দেশ্যে আসেনি চোর। চুরি করতে এলে অত শব্দ করে জানালার কাঁচ ভাঙত না। নিঃশব্দে সারার চেষ্টা করত।
হুঁ, হাই তুলতে তুলতে বলল মুসা। সকাল বেলা দেখব, শয়তানিটা কার। এখন ঘুমানো যাক।
দ্বিতীয়বারের মত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।
রাতে আর কিছু ঘটল না।
পরদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। এক ডাক দিতেই উঠে গেল রবিন। তাকে নিয়ে গাড়িটা দেখতে চলল কিশোর।
ময়লা হয়ে আছে গাড়িটা। প্রচুর ধুলো। ব্যবহার করা হয় না বোধহয়, পরিষ্কারও করেন না সে-জন্যে। অফিসের পেছনে ফেলে রেখেছেন। অফিসের অপরিষ্কার আসবাবপত্রগুলোর কথা মনে পড়ল কিশোরের! কোন কারণে. সব কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন যেন মিস্টার ব্রুক।
এই কিশোর, দেখো, নাইলনের সুতোয় বোনা একটা ফিতে তুলে দেখাল রবিন। একদিকের গ্লোভ কম্পার্টমেন্টের কজায় আটকে ছিল।
সামনের সীটের নিচে খুঁজছিল কিশোর। ঘাড় ফিরিয়ে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, কিসের ফিতে?
যে কোন জিনিসের হতে পারে এটা, রবিন বলল। টেপ প্লেয়ার, ক্যামেরা।
এটা না তো? উজ্জ্বল হলুদ রঙের একটা স্পোর্ট-স্টাইল ক্যামেরা বের করে দেখাল কিশোর। ধাতব আংটার সঙ্গে ছেঁড়া ফিতের মাথাটা লেগে রয়েছে এখনও।
পেলে নাকি কিছু? দরজার কাছ থেকে শোনা গেল মুসার কণ্ঠ।
অ, ঘুম ভাঙল। ক্যামেরাটা মুসাকে দেখাল কিশোর।
আরি, জিনার এ রকম একটা ক্যামেরা ছিল না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। কজায় আটকে গিয়েছিল ফিতেটা। তাড়াহুড়ো ছিল, তাই ভোলার চেষ্টা না করে হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছিল। ছবিটা তুলে নিয়েই লুকিয়ে ফেলেছিল সীটের নিচে।
রবিনের দিকে তাকাল সে, রবিন, ছবিটা ডেভেলপ করা দরকার। মেইনল্যান্ডে চলে যাও। এক ঘণ্টায় ছবি দিয়ে দেয় যে সব দোকানে, ওদের কাছ থেকে করিয়ে আনে।
জানালাটা মেরামত করিয়ে আনব?
নাহ, আপাতত দরকার নেই। পরে সময় করে করা যাবে। বৃষ্টি এলে। প্লাস্টিক দিয়ে আটকেই ঠেকাব আপাতত।
গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল রবিন।
সেদিকে তাকিয়ে থেকে মুসা বলল, আমরা চলো যাই পেলিক্যান লেনে। গাড়িটা যেখানে পাওয়া গেছে। দেখে আসা দরকার।
চলো। ডেপুটি গেকো আসলেই সূত্র খুঁজেছে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে এই ফিতে আর ক্যামেরাটা আমাদের হাতে পড়ত না।
মিস্টার ব্রুকের গাড়িটা নিয়ে রওনা হল দুজনে।
কয়েক মিনিট পর জায়গাটাতে পৌঁছে গেল ওরা। ম্যাপ দেখে মুসাকে গাড়ি থামাতে বলল কিশোর। বালির ওপরে ইট বিছিয়ে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বালিতে টায়ারের দাগগুলো ভালমত লক্ষ করল সে। কিডন্যাপারের গাড়ির চাকার দাগ দেখলে যাতে পরে চিনতে পারে।
বাড়িঘর তো নেই বললেই চলে, চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা। জিনার কিডন্যাপিঙের পর বিশেষ কেউ আর আসেনি বোধহয় এদিকে। এখনও সূত্র পাওয়ার আশা আছে।
নোটবুক বের করে পেন্সিল দিয়ে তাতে নানা রকম টায়ারের দাগের নমুনা এঁকে নিচ্ছে কিশোর, এই সময় সেখানে এসে থামল একটা পুলিশের গাড়ি। স্টিয়ারিঙের নিচ থেকে ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে এল পেশীবহুল একজন লোক। কোমরের বেল্টে দুই হাতের বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে, হাঁটার তালে তালে রিভলভারের খাপ দোলাতে দোলাতে পুরানো ওয়েস্টার্ন সিনেমার নায়কদের মত কিশোরের সামনে এসে দাঁড়াল। আমি গেকো, ভারিক্কি চালে পরিচয়টা জানিয়ে যেন কৃতার্থ করে দিতে চাইল গোয়েন্দাদের। ডেপুটি শেরিফ হেরিং গেকো।
মানে মৎস্য-গিরগিটি, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল মুসার। হেরিং হলো মাছ আর গেকো গিরগিটি।
কি বললে?
না, কিছু না।
কিছু হারিয়েছ? মৎস্য-গিরগিটি কথাটা বোধহয় শোনেনি গেকো, কিংবা শুনলেও ঠিক বুঝতে পারেনি। নইলে রেগে যেত, জানা কথা।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিলোর। আমি কিশোর পাশা। হাত বাড়িয়ে দিল সে।
কিন্তু ধরল না গেকো। আঙুল দুটো যে ভাবে ঢুকিয়ে রেখেছিল, সেভাবেই রাখল। গিরগিটির মতই মাথাটা একপাশে কাত করে এক চোখ উঁচু করে তাকাল। কিশোর পাশা?
হ্যাঁ। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।
ও, তোমাদের কথাই বলেছে তাহলে গ্লেজব্রুক। নিখোঁজ মেয়েটাকে খুঁজতে এসেছ তোমরা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ওকে কিডন্যাপ করা হয়নি, রায় দিয়ে দিল ডেপুটি। সুতরাং যেখান থেকে এসেছ, সেখানে ফিরে যেতে পারো।
কিডন্যাপ হয়নি, আপনি কি করে জানলেন? কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হলো কিশোরের।
তাহলে টাকা দাবি করে নোট পাঠাত, এ তো সহজ কথা।
সব সময় টাকার জন্যে কিডন্যাপ করে না। আরও নানা কারণ থাকে।
থাকে, অস্বীকার করছি না, কথাটার কোন সদুত্তর না দিয়েই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল গেকো। তোমরা এখন অন্যের জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছ। সেটা যে। অপরাধ জানা আছে কি?
কিন্তু আমরা তো কোন ক্ষতি করছি না।
ওসব বুঝি না। এ জায়গাটা অন্য মানুষের। এবং আমি জানি, যার জায়গা, সে তোমাদের এখানে আসা পছন্দ করবে না।
চারপাশে তাকিয়ে সাইনবোর্ড খুঁজল কিশোর। কই, কোথাও তো লেখা নেই।
সব সময় যে লিখে দিতে হবে এমন কোন কথা নেই, জবাব দিল শেরিফ। আমাকে রেখেছে তাহলে কিসের জন্যে? আমার কাজ, এ রকম অপরাধ যাতে না করে কেউ সেদিকে লক্ষ রাখা।
তাহলে মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসা যেতে পারে।
ওই কথাটি চিন্তাও কোরো না, কঠিন কণ্ঠে বলল ডেপুটি। বাইরে থেকে নাক গলাতে আসা দুটো বালকের সঙ্গে প্যাচাল পাড়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ আছে নীরা লেভিনের। এটা ট্যুরিস্ট স্পট, শান্তিতে সময় কাটাতে আসে লোকে। এখানে কোন রকম গোলমাল চাই না আমি, বলে দিলাম।
সে তো বুঝতেই পারছি, মুসার দিকে ঘুরল কিশোর। চলো হে, মুসা, ডেপুটি সাহেব এখানে শান্তি বজায় রাখতে থাকুন। আমরা অন্য কাজে যাই।
গাড়িতে চড়ে রাস্তায় ওঠার পরও ওদের পিছু ছাড়ল না শেরিফ। শহরে ঢোকার পর তারপরে গেল।
শেরিফ চলে গেল সৈকতের দিকে, কুপারস ডিনারটা সামনে দেখে তার পাশে এনে গাড়ি থামাল মুসা।
ঘোট হল ঘরটায় ঢুকল দুজনে। মাত্র একজন কাস্টোমার। সুবেশী একজন অল্প বয়েসী মহিলা। সোনালি চুল। কাউন্টারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে।
কাউন্টারের উল্টো দিকে একটা টেবিলে লাল চামড়ায় মোড়া চেয়ারে বসল দুই গোয়েন্দা।
ওরা বসতেই এগিয়ে এল ওয়েইট্রেস, মহিলা। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। ধূসর রঙ লেগেছে চুলে।
মেন্যু লাগবে না আমাদের, ম্যাগি, মহিলার হালকা নীল পোশাকের বুকে সুতো দিয়ে লেখা নাম দেখে বলল কিশোর। আমাদের জন্যে ডিম, হোম ফ্রাই, আর টোস্ট।
হোম ফ্রাই হবে না, ম্যাগি জানাল। হ্যাশ ব্রাউন।
আনুন। ওতেই চলবে।
খিদে পেয়েছে খুব। গোগ্রাসে গিলছে দুজনে, এমন সময় পেছনের ঘর থকে সরু একটা দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকল একজন লোক। ওর দাগ লাগা দোমড়ানো অ্যাপ্রনের বুকে লেখা রয়েছে কুপার।
ম্যাগি, ওয়েইট্রেসকে বলল সে, গ্রিলে মাংস গেঁথে দিয়ে এসেছি। রান্নাটা শেষ করে ফেলগে। অ্যাপ্রনে মুছল তেল মাখা হাত। ওই ডেপুটিটা যদি দ্বীপের এ সব শয়তানি বন্ধ করতে না পারে, পরের বার শেরিফের ইলেকশনে প্রার্থী হয়ে অবশ্যই তার বিরোধিতা করব আমি।
মুখ তুলে তাকাল কাউন্টারে দাঁড়ানো সোনালি চুল মহিলা। কি আজেবাজে বকছ, কুপার!
না, সত্যি বলছি।
ষোলো বছর ধরে এক নাগাড়ে ডেপুটিগিরি করছে এখানে গেকো, মহিলা বলল। তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামলে হেরে ভূত হবে, জানা কথা।
না, হব না। কেন এতদিন টিকে ছিল ওই হাঁদাটা, জানো? দ্বীপে কোন অপরাধ হত না বলে। এখন যখন ঘটতে শুরু করেছে, বেশিদিন আর টিকতে পারবে না। আমার কথা ডায়েরীতে লিখে নিতে পারো তুমি, নীরা।
নীরা!
মাঝপথে থেমে গেল কিশোরের চামচ।
মুসারও কান খাড়া হয়ে গেছে।
লেখালেখির আর দরকার নেই। যার যার নিজের পথ দেখা ভাল, নীরা বলল। তোমার ভালটা তো কখনোই বুঝতে চাওনি। কতবার বলেছি, আখেরটা গুছিয়ে নাও, কিন্তু কানেই যায় না তোমার। ডেভলেপমেন্ট কোম্পানি এখনও তোমার জায়গাটা কিনে নিতে আগ্রহী।
এবং আমি এখনও বলছি, জবাব দিল কুপার, জায়গা আমি বেচব না। বেচো বেচো করে বিরক্ত করতে এসো না তো আর দয়া করে।
শোনো, কুপার, ভেবে দেখো, নীরা বলল, কি পাচ্ছ তুমি এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থেকে? এক কাপ কফি বেচতে গিয়ে দুতিন কাপ বাড়তি দেয়া, দুটো ডিম ভাজা দিলে একটা ডিম ফ্রি দেয়া-এ সব করে কেউ ব্যবসা চালাতে পারে? লাভ। হয় কিছু? বরং লস। অনেক বেশি লস। লোকসান দিতে দিতে শেষ হচ্ছ। আমি ব্যবসায়ী, আমি জানি। তারচেয়ে বেচে দিয়ে টাকা নিয়ে চলে যাও। কাজে লাগবে। কত চাও, নিজের মুখেই বলো বরং।
মহিলাটাকে ভাল লাগল না কিশোরের। বুঝতে পারছে, কুপারও তাকে দেখতে পারে না।
বেশ, নরম হওয়ার ভান করল কুপার। জায়গাটা যখন এতই তোমার পছন্দ, যাও, দিয়ে দিলাম।
রান্নাঘর থেকে সব কথাই বোধহয় কানে গেছে ম্যাগির। তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে মুখ বের করে চিৎকার করে বলল স্বামীকে, না না, কুপার, এ কি করছ!
কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠল কুপার, তুমি আবার এ সবে নাক গলাতে এলে কেন? যাও, নিজের কাজ করোগে!।
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে দুই গোয়েন্দার। প্রবল আগ্রহ নিয়ে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই নাহলে পুরুষ মানুষের মত কথা, হাসি ফুটেছে নীরার মুখে। চামড়ার পার্স থেকে চেক বই বের করল। বলল, কত চাও?
দুই হাতের তালুর দিকে তাকাল কুপার। বিড়বিড় করল, দশ লাখ।
দশ লাখ! দম আটকে ফেলল কিশোর।
দশ লাখ, কি? ভুল শুনেছে কিনা বুঝতে চাইল যেন নীরা।
কি আবার, ডলার। দশ লাখ ডলার, কুপার বলল। তুমি জানতে চেয়েছ, কত চাই। আমার দাম আমি বললাম। পছন্দ হলে নাও, নাহলে বিদেয় হও।
না না, বিদেয় হব কেন!
চেক লিখতে শুরু করল নীরা।
.
০৪.
খাইছে! এ জায়গার দাম দশ লাখ ডলার! ফিসফিস করে বলল মুসা।
হুঁ, বিশ্বাস তো আমারও হচ্ছে না, কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটছে কিশোর।
চেকটা কুপারের হাতে তুলে দিল নীরা।
হাতে নিয়ে দেখল কুপার। দেখল, সত্যি দশ লাখ লিখেছে কিনা। তারপর ধীরে ধীরে ছিঁড়তে শুরু করল। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বাতাসে উড়িয়ে দিল। নীরার দিকে তাকিয়ে হাসল, রসিকতা করলাম। কিছু মনে কোরো না।
কুপারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল নীরা। দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল দরজার দিকে।
উফ, বাঁচলাম! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ম্যাগি। আমি তো ভেবেছিলাম সত্যি সত্যি বুঝি তুমি…
দশ লাখ কেন, দশ কোটি টাকা দিলেও এ জায়গা বেচব না আমি, কুপার বলল।
এক্সকিউজ মী, কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল কিলোর, তার পেছনে এগোল মুসা। আপনাদের কথাবার্তা সব শুনে ফেলেছি। গাল আইল্যান্ডে প্রচুর জায়গা আছে নাকি নীরা লেভিনের?
প্রচুর কি বলছ? খড়খড় করে উঠল ম্যাগি। গাল আইল্যান্ডের অর্ধেকটাই তো তার।
আসলে, শুধরে দিল কুপার, জমি বেচাকেনার যে কোম্পানিতে সে কাজ করে, জায়গাগুলো তাদের। কোম্পানির মালিক ডগলাস কেইন। কারলুর শেষ ধারে, সৈকতের কিনারে তার বাড়ি। এত ধনী, যা ইচ্ছে তাই কিনতে পারে।
হ্যাঁ, ঘৃণায় নাক কুঁচকাল ম্যাগি। আর তার কেনা সম্পত্তির মধ্যে একটা হলো ওই নীরা লেভিন।
কিন্তু জায়গা বেচার জন্যে এত চাপাচাপি করছে কেন ওরা? জানতে চাইল কিশোর।
টাকা কামাইয়ের নতুন ধান্দা! রুক্ষ শোনাল ম্যাগির কণ্ঠ।
গুজব শোনা যাচ্ছে, কুপার জানাল, চিরকালই ক্যাসটিলো কীর দরিদ্র প্রতিবেশী এই গাল আইল্যান্ড। ক্যাসটিলোর পুরো পশ্চিম উপকূলটাই উপসাগরের মধ্যে ঢুকে রয়েছে। সবখানে রয়েছে সাদা সৈকত। সংস্কার করা হয়েছে ওগুলোর। নীরার মত উন্নয়নকারীরা আমাদের এই ছোট্ট দ্বীপটাকেও আরেকটা ক্যাসটিলো কী বানিয়ে ফেলতে চাইছে। আরেকটা গুজব আমি শুনেছি, ডগি, মানে ডগলাস নাকি গাল আইল্যান্ডটাকে একটা প্রাইভেট রিসর্ট বানানোর স্বপ্ন দেখছে। এখানে আসতে হলে তখন তোমাকে এটার মেম্বার হতে হবে। সরাসরি আর এ ভাবে চলে আসতে পারবে না।
কিন্তু তারপরেও, মুসা বলল, আপনার এই জায়গাটুকুর জন্যে দশ লাখ ডলার অনেক বেশি না?
তা তো বেশিই, কুপার বলল। রেস্টুরেন্টটা দিয়ে দিতে আপত্তি ছিল না আমার। কিন্তু বাড়িটা তো ছাড়তে পারব না। বহু বছর ধরে আছি। আমার মত আরও অনেকেই আছে। ভালবেসে ফেলেছি দ্বীপটাকে। থোক না সাধারণ, কিন্তু এ তো এখন বাড়ি। আর আমরা চাই, এখন যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকুক দ্বীপটা। অন্য কিছু হলে আমাদের বিদেয় হতে হবে।
তারমানে আপনার ধারণা, কিশোর বলল, ডগলাস আপনাকে তাড়াতে চাইছে?
তোমার কি মনে হয়? ভুরু নাচাল কুপার। হঠাৎ করেই যদি কোন জায়গায় অকারণে অ্যাক্সিডেন্ট, চুরি-ডাকাতি এ সব শুরু হয়ে যায়…
এবং কিডন্যাপিং, যুক্ত করল মুসা।
হ্যাঁ, ওই মেয়েটার কথা শুনেছি, কপার বলল। আর আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওকে উদ্ধারের কোন চেষ্টাই করেনি ওই গেকোটা। মেয়েটার জন্যেই এলে নাকি?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু মুসা আমান। গত রাতে এসেছি আমরা। আমাদের আরও এক বন্ধু এসেছে, রবিন মিলফোর্ড। জিমার কি হয়েছে, খোঁজ-খবর নিচ্ছি আমরা…
বাইরে খোয়ার মধ্যে টায়ার ঘষার কর্কশ শব্দে ছেদ পড়ল কথায়। গাড়ির দরজা লাগানোর শব্দ হলো। ছুটে ঘরে ঢুকল রবিন।
সদ্য প্রিন্ট করে আনা ছবিগুলো তুলে দিল কিশোরের হাতে।
বাহ, বড় তাড়াতাড়ি দিল তো, কিশোর বলল।
চলো, টেবিলে গিয়ে বসে দেখা যাক, মুসা বলল।
এক্সকিউজ আস, কুপার, বলে টেবিলের দিকে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। তিনজনে এসে বসল আবার আগের টেবিলটায়। রবিনের জন্যেও খাবারের অর্ডার দেয়া হলো।
ছবিগুলো টেবিলে ছড়িয়ে দেখতে শুরু করল ওরা।
এটা দেখো, বেশ স্পষ্ট, একটা ছবি দেখাল রবিন।
মিস্টার ব্রুকের কাঠের তৈরি কেবিন ক্রুজারের সামনে দাঁড়ানো জিনা আর ইভা। কিশোরের কাছে এটা সাধারণ ছবি মনে হলো।
ঘাটতে ঘাটতে একটা ছবিতে আটকে গেল তার চোখ। টেনে নিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, এটাই আমাদের দরকার!
হাতে নিয়ে তিনজনেই ভালমত ছবিটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। বোঝার চেষ্টা করল। ছবিতে আরেকটা গাড়ির পেছনের অংশ দেখা যাচ্ছে। মিস্টার ফ্রকের গাড়িতে বসে ভোলা। তাড়াহুড়া করে তোলার কারণে অস্পষ্ট রয়ে গেছে ছবির অনেক কিছু। বোঝা কঠিন।
ছবির এক জায়গায় আঙুল রাখল কিশোর। দেখো, এটা জেরি আঙ্কেলের গাড়ির জানালার ফ্রেম। এটা গাড়ির হুড।
আর এটা, রবিন বলল, সামনের গাড়িটার পেছনের বাম্পার।
ঠিক, একমত হলো কিশোর। আর এটা দেখো। সাদা-কালো স্টিকার। বাম্পারের বা সাইডে, নিচের দিকে লাগানো। কোন ধরনের আইডেন্টিফিকেশন নম্বর।
ভাড়া করা গাড়ির এ সব থাকে, উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। কোম্পানির নিজস্ব একটা সিরিয়াল নম্বর দিয়ে রাখে গাড়িতে।
এ ছবিটা বড় করা দরকার, কিশোর বলল। আমি শিওর, এ গাড়িটা দিয়েই জিনাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এই কোড নম্বরটা যতক্ষণ না বুঝতে পারছি…।
খাওয়া শেষ করে আর দেরি করল না রবিন। উঠে দাঁড়াল। এনলার্জ ছবিটা নিয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসছি আমি।
বেরিয়ে গেল সে।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। আমরা আর বসে থেকে কি করব? চলো, একটু সৈকতের দিক থেকে ঘুরে আসি।
ওদিকে কেন? বলতে গেল মুসা।
তদন্ত করতে। ভুলে যাচ্ছ কেন, সৈকতে যাবার পথেই নিখোঁজ হয়েছে জিনা। বলা যায় না, জরুরী সূত্র পেয়ে যেতে পারি ওদিকে।
কুপারের বিল মিটিয়ে দিল কিশোর। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চাপল দুজনে। স্টার্ট দিয়ে দক্ষিণে গাড়ি ঘোরাল মুসা। মেইন রোড ধরে সৈকতের দিকে চলল।
কি বলেছিলাম? দিনের বেলা দারুণ লাগবে! চতুর্দিকের চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে শিস দিতে শুরু করল কিশোর।
একটা মোড় ঘুরতেই সাদা সৈকত চোখে পড়ল। নারকেল আর উঁচ উঁচ রয়্যাল পামের সারি তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে সৈকতটাকে। সারা দ্বীপে এখানেই কিছু মানুষের ভিড় দেখা গেল।
দিনটা কিন্তু পানিতে নামার মতই, লোভাতুর দৃষ্টিতে সাগরের নীল পানির দিকে তাকাল মুসা।
হাসল কিশোর। পরে। সাঁতার কাটার অনেক সুযোগ পাবে।
বালির প্রান্তে সারি দিয়ে থাকা গাছের ছায়ায় গাড়ি রাখল মুসা। গাড়ি থেকে নামল দুজনে।
শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন শুনে ফিরে তাকাল মুসা। পেছনের একটা সরু গলি থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা-কালো ট্রাক। তীব্র গতিতে ছুটে এল ওদের দিকে।
এক ধাক্কায় কিশোরকে রাস্তার কিনারে ফেলে দিয়ে নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মুসা। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া ট্রাকটার গরম বাতাসের ধাক্কা লাগল গায়ে। দেখতে দেখতে ট্রাকটা মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার অন্য পাশে।
বড় বেশি তাড়াহুড়া মনে হচ্ছে, উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল কিশোর।
গা থেকে বালি, ঝাড়তে ঝাড়তে মুসা জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভারের চেহারা দেখেছ?
না। দেখার সুযোগ পেলাম কোথায়? কাল রাতে যে গাড়িটা পিছু নিয়েছিল। আমাদের, ওইটা, তাই না?
তাই তো মনে হলো, মুসা বলল। তবে এবারও লাইসেন্স প্লেটটা দেখতে পারিনি। এমন করে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে গেল।
গাড়িটার ভাবনা আপাতত মাথা থেকে দূর করে দিল কিশোর। ইভা জানিয়েছে, সে আর জিনা এদিকের সৈকতে এলে পানির কিনারে একটা পামের জটলার কাছে বসে গায়ে রোদ লাগাত। কোথায় আছে সে-রকম জায়গা, খুঁজতে শুরু করল তার চোখ।
কিছুটা দূরে সৈকত ঘেঁষে একটা লাল রঙের বাড়ি দেখতে পেল। সামনে সবুজ লন। ওটাই সম্ভবত ডগলাস কেইনের বাড়ি।
শিস দিয়ে ফেলল মুসা। খাইছে! বাড়ি একখান!
দোতলা মূল বাড়িটা ছাড়াও একটা গেস্ট হাউস, পাঁচটা গাড়ি রাখার গ্যারেজ, আর অনেকগুলো কুকুরের ঘর আছে। গ্যারেজের পাশে দাঁড়ানো একটা কালো সিডান গাড়ি। খানিক দূরে কংক্রীটের প্যাডের ওপর রাখা একটা ছোট হেলিকপ্টার।
সাংঘাতিক ধনী তো লোকটা, কিশোর বলল।
সে তো বটেই, মুসা বলল। কুপাররা বলল না, যা কিনতে ইচ্ছে হয়, কেনার ক্ষমতা আছে ডগলাস কেইনের।
নিচু একটা দেয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ওরা। সর্বসাধারণের জায়গা থেকে বাড়ির সীমানা ভাগ করা হয়েছে ওই দেয়াল দিয়ে। দেয়ালের দুই প্রান্ত থেকে ছোট ছোট খুঁটির সারি চলে গেছে সৈকতের ওপর দিয়ে পানির কাছে। খুঁটিগুলোতে শিকল লাগিয়ে বেড়া বানিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়েছে সৈকতটা। শিকলের ভেতরটা ব্যক্তিগত বুঝিয়ে দিয়েছে।
কি ভাবছ? ভুরু নাচাল মুসা। চলে যাব নাকি ওপাশে?
আমি তো জানতাম, সৈকতের কোন মালিক থাকে না। তা ছাড়া ভেতরে ঢাকা বেআইনী কথাটা যখন কোথাও লেখা নেই, মুচকি হাসল কিশোর, ঢুকে পড়লামই বা।
সহজেই বেড়াটা ডিঙিয়ে চলে গেল মুসা। তার পেছনে রইল কিশোর। লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে যেতে লাগল ডগলাসের সৈকত ধরে। দেয়ালের গায়ে গেট দেখে ভেতরে ঢোকার জন্যে মোড় নিল।
যদি দেখে? মুসার প্রশ্ন।
কি আর করবে? কিশোর বলল আবার। বড়জোর তার সীমানা থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে…
কথা শেষ না করেই থমকে দাঁড়াল সে। কুকুরের ডাক কানে এসেছে। কোন দিক থেকে এল?
জানার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। বাড়ির সীমানায় পা দিতে না দিতেই দেখে মূল বিল্ডিংটার পাশ ঘুরে ছুটে বেরিয়ে আসছে তিনটা কুকুর। ভয়ঙ্কর ডোবারম্যান পিনশার। বিকট ভঙ্গিতে দাঁত বের করে গর্জন করছে চাপা স্বরে।
কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা।
লন মাড়িয়ে ছুটে আসছে কুকুরগুলো। সামনের কুকুরটা, বিরাট একটা কালচে-বাদামী জানোয়ার সোজা ধেয়ে আসছে কিশোরের দিকে।
.
০৫.
কিশোর, জলদি! বলে এক চিৎকার দিয়েই ঘুরে ছুটতে শুরু করল মুসা। লাফ দিয়ে গিয়ে উঠে পড়ল নিচু দেয়ালটায়। কিশোর কি করছে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল।
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে কিশোর। কুকুরগুলোকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। পায়ের কাছে খটাস খটাস চোয়াল বন্ধ করছে সামনের কুকুরটা। যে কোন মুহূর্তে কামড় লেগে যাবে।
কিশোরও দেয়ালটার কাছে পৌঁছে গেল। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল দেয়ালে। উঠতে সাহায্য করল তাকে মুসা। এক মুহূর্ত দেরি না করে লাফ দিয়ে উল্টো দিকের সৈকতে নেমে পড়ল দুজনে। বালি মাড়িয়ে ছুটতে লাগল।
কয়েক সেকেন্ড পরেই সৈকতে বেরোনোর গেট দিয়ে বেরিয়ে এল কুকুরগুলো। পেছন পেছন আসতে লাগল।
উপায় না দেখে আবার দেয়াল ডিঙিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ল ওরা। দেয়ালে বসে থাকা নিরাপদ নয়। নিচু। লাফ দিয়ে ধরে ফেলতে পারবে কুকুরগুলো। বাঁচতে হলে কোন ঘরেটরে ঢুকে পড়তে হবে।
লন ধরে ছুটতে ছুটতে চোখের কোণ দিয়ে বাদামী একটা ছায়া দেখতে পেল কিশোর। কাছে এসে গেছে সামনের কুকুরটা।
ঘুরে দাঁড়াল মুসা। বুঝে গেছে দৌড়ে পরাজিত করতে পারবে না ওই ভয়ানক জানোয়ারগুলোকে। অ্যালুমিনিয়ামে তৈরি একটা লন চেয়ার তুলে নিয়ে বাড়ি মারার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল।
অ্যাই, থাম! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ শোনা গেল।
চোখের পলকে দাঁড়িয়ে গেল কুকুরগুলো। একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে তাকাল মনিবের দিকে। স্লাইডিং ডোর সরিয়ে বেরিয়ে এসেছে লম্বা একজন লোক।
রোদে বেরিয়ে এল নোকটা। ভুরু কুঁচকে রেখেছে। গোয়েন্দারা তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই হাসল। কিন্তু চোখের শীতলতা কাটল না তাতে।
দারুণ জিনিস পুষছেন, শুকনো কণ্ঠে বলল কিশোর।
ঠিকই বলেছ, লোকটা জবাব দিল। তোমাদের আগে যে লোকটা কাউকে কিছু না বলে বাড়িতে ঢুকেছিল, কামড়ে তাকে মেরেই ফেলেছিল আরেকটু হলে।
আমাকে কিছু করার আগে আমি ওর ঘাড়টা ভেঙে দিতাম, হাতের চেয়ারটা মাটিতে ফেলে দিল মুসা।
ডগলাস কেইন, মুসার কথা যেন শুনতেই পায়নি, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা।
কিশোর পাশা, কেইনের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল কিশোর। ও আমার বন্ধু, মুসা আমান।
জানি, কেইন বলল।
সত্যি? কিশোর অবাক। কি করে জানলেন?
জানানোর লোক আছে আমার, প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল কেইন। তা গাল আইল্যান্ডে কি উদ্দেশ্যে?
আমাদের এক বন্ধু নিখোঁজ হয়ে গেছে এখান থেকে, জবাব দিল কিশোর। জরজিনা পারকার। আমাদের বিশ্বাস, কিডন্যাপ করা হয়েছে তাকে।
গুরুতর অভিযোগ, হাসি মুছল না লোকটার মুখ থেকে। কিন্তু রোদের মধ্যে গরমে দাঁড়িয়ে কেন? এসো, ভেতরে এসো। ঠাণ্ডা কিছু খাবে?
ঠাণ্ডা খাওয়ার তেমন কোন ইচ্ছে নেই কিশোরের, কিন্তু ঘরের ভেতরটা দেখার সুযোগটাও ছাড়তে চাইল না। রাজি হয়ে গেল।
জিনিসপত্র সব এলোমেলো হয়ে আছে, কিছু আবার ভেবে বোসো না। গোছানোর সময় পাই না, দামী দামী জিনিসপত্রে সাজানো একটা সান-রূম পেরিয়ে দুজনকে বিরাট রান্নাঘরে নিয়ে এল কেইন। সাদা বিশাল কাউন্টারটাতে অসংখ্য বাক্স আর বাদামী ব্যাগ পড়ে আছে। কিশোরকে সেগুলোর দিকে তাকাতে দেখে বলল, কাল সন্ধ্যায় একটা ছোটখাট পাটি আছে।
ইনটারকমে কথা বলল কেইন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল একজন লোক। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশের কম হবে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। উষ্কখুষ্ক চুল। পেশী যেন ফুটে বেরোচ্ছে। নড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কিলবিল করে উঠছে হাতের পেশী।
এনডি টাওয়ার, গোয়েন্দাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল কেইন। এনডি, ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান।
আরেকটু হলেই ওদের চাপা দিয়ে ফেলেছিলাম আজ, এনডি বলল, যেন মস্ত বড় একটা রসিকতা। রাস্তায় হাঁটার সময় আরও সাবধান হওয়া উচিত তোমাদের।
যাই বলেন, দারুণ একখান ট্রাক কিন্তু আপনার, খোঁচাটা না দিয়ে ছাড়ল না কিশোর। রাস্তায় বেরোলেই দেখা হয়ে যায়…
বাদ দাও ওর কথা, কিশোরকে থামিয়ে দিল কেইন। এনডি, ওদের সোডা দাও।
বিশাল রেফ্রিজারেটর থেকে চার ক্যান সোডা বের করল এনডি।
বাপরে বাপ, কতবড় ফ্রিজ! প্রচুর খাবার ধরে নিশ্চয়, রেফ্রিজারেটরটার কাছে এগিয়ে গেল মুসা। রসে ভেজানো কালো আঙরের একটা ক্যান বের করল মুসা। খাবই যখন, ভাল করে খাই। ক্যানটা খুলতে গিয়ে ফ্রিজের দরজার দিকে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল তার হাত। বিদ্যৎ খেলে গেল যেন শরীরে।
কিশোর তখন সৈকতে ভোলা ইভা আর জিনার যুগল ফটোগ্রাফটা দেখাচ্ছে কেইনকে। মাত্র গত সপ্তাহে তোলা।
ছবিটার দিকে ঠিকমত তাকালও না কেইন। সরি। কখনও দেখিনি একে।
এনডিকে দেখাল কিশোর। আপনি দেখেছেন?
উঁহু, না দেখেই বলে দিল এনডি। পরে তাকাল ছবির দিকে।
আপনি শিওর?
মেয়েটা সুন্দরী, কোন সন্দেহ নেই। চোখে পড়ার মত। দেখলে ঠিকই মনে থাকত।
রেফ্রিজারেটরের কাছ থেকে ফিরে এল মুসা। উত্তেজনা চাপা দিতে কষ্ট হচ্ছে তার। কিশোরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতে যাবে, ফোন বাজল দোতলায়।
কোরি, ধরো তো! দরজার দিকে ফিরে চিৎকার করে বলল এনডি।
ছুটন্ত পায়ের শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে যাচ্ছে কোরি।
কয়েক সেকেন্ড পর রান্নাঘরে উঁকি দিল আরেকটা লোক, বস, আপনার ফোন! মিয়ামি থেকে। এনডি যেমন লম্বা, কোরি তেমনি খাটো। হালকা-পাতলা। মাথার কালো লম্বা চুল ব্যাকব্রাশ করা। এনডির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কুকুরগুলোকে ঘরে আটকে রাখতে যাচ্ছি।
যাও, বলে ডাকল আবার কেইন, কোরি, শোনো। এদের নাম জানো? ও কিশোর পাশা। আর ও মুসা আমান।
অস্বস্তিভরা চোখে ওদের দিকে তাকাল কোরি, কিছু বলল না।
আপনারা মনে হচ্ছে সবাই খুব ব্যস্ত, কিশোর বলল কেইনের দিকে তাকিয়ে। আমরা বরং চলে যাই।
কিন্তু যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই কিশোরের। তার ধারণা, যত বেশি সময় থাকা যাবে, তত বেশি সূত্র পাওয়া যাবে। একটা ব্যাপারে ইতিমধ্যেই শিওর হয়ে গেছে-ওদেরকে ফলো করে আসা ট্রাকটার মালিক ডগলাস কেইন।
কেউ কিছু বলছে না দেখে থাকার আশা ত্যাগ করল কিশোর। সোডা খাওয়ানোর জন্যে ধন্যবাদ। আর কুকুরগুলোকে ডেকে ফেরানোর জন্যেও।
তোমাদেরকেও ধন্যবাদ, কেন ধন্যবাদ দিল, সে-কথাটা আর খোলসা করল কেইন। কোরি, তুমি আর এনডি ওদেরকে এগিয়ে দিয়ে এসো। দেখো, কুকুরগুলো যেন আর বিরক্ত করতে না পারে।
বাইরের ঘরে কিশোররা ঢুকেছে, এই সময় দরজার বাইরে নীরা লেভিনকে দেখা গেল।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল এনডি, কাঁচের স্লাইডিং ডোরের ছিটকানিটা খুলে দেয়ার জন্যে।
ভেতরে ঢুকে কিশোরদের দেখে থমকে দাঁড়াল নীরা। কোথায় যেন দেখেছি তোমাদের?…ও, কুপারের রেস্টুরেন্টে। আমার পিছু নিয়েছ কেন?
আপনার পিছু নেব কেন? হাসিমুখে জবাব দিল কিশোর। আপনার অনেক আগেই আমরা এসেছি।
মনে মনে রেগে গেলেও রসিকতার ঢঙে মুসা বলল, মনে তো হচ্ছে আপনিই আমাদের অনুসরণ করে এসেছেন।
হয়েছে, হয়েছে! আমার কথা তুলে নিলাম! নীরস স্বরে জবাব দিল নীরা।
একটা মেয়েকে খুঁজতে এসেছে ওরা এখানে, বিশ্রী একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠল এনডি। আমরা বলে দিয়েছি সে এখানে নেই। তাই ওরা এখন চলে যাচ্ছে।
ওদের দরজার বাইরে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিতে গেল এনডি, কিন্তু কি ভেবে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। ছবিটা বের করে জিনার ছবিতে আঙুল রেখে দেখাল নীরাকে। দেখুন তো, আপনি দেখেছেন নাকি?
ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে নীরা, কিশোর তার মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করছে কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা।
তিন দিন হলো নিখোঁজ হয়েছে, কিশোর বলল। ভাবলাম, মিস্টার কেইন। কিংবা তাঁর কর্মচারীদের কেউ দেখে থাকতে পারে, সৈকতের এত কাছে বাড়ি যখন।
মেয়েটা সুন্দরী, নীরা বলল। হ্যাঁ, দেখেছি ওকে। সৈকতে ঘোরাফেরা করতে। দ্বিতীয় মেয়েটার সঙ্গে।
ওদের সঙ্গে আর কাউকে দেখেছেন?
উঁহু। ওদেরকেও দেখতাম না যদি তোক বেশি থাকত। এ সীজনে ট্যুরিস্ট খুব কম এসেছে। সৈকতে তোক প্রায় ছিলই না।
শুনলাম, টুরিস্ট আসা কমে যাওয়ার পেছনে নানা রকম কারণ রয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট, চুরি-ডাকাতি এ সব খুব বেড়ে গেছে দ্বীপে। ট্যুরিস্ট নেই, ব্যবসা নেই-ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছে। মিস্টার কুপারের মত।
ওই গাধাটার কথা আর বোলো না! রেগে উঠল নীরা। ও রকম একটা জায়গার জন্যে দশ লাখ ডলার হাতে পেয়ে যে ফিরিয়ে দেয় সে আস্ত বোকা!
কিংবা যে অত টাকা দেয়, খোঁচা মারতে ছাড়ল না কিশোর।
বরফের মত শীতল হয়ে গেল নীরার দৃষ্টি। এনডির দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল, বের করে দিয়ে এসো ওদের!
কিশোরকে বলার জন্যে তর সইছে না মুসার। ওদের বাইরে বের করে দিয়ে এনডি চলে যেতেই বলল, জানো, কি দেখে এলাম?
কি?
নানা রকমের ছবি চুম্বক দিয়ে আটকে রেফ্রিজারেটরের দরজা সাজিয়েছে।
ফ্রিজের দরজা ওরকম অনেকেই সাজায়, কিশোর বলল। তাতে অবাক হওয়ার কি আছে?
আছে। পারকার আঙ্কেলের ছবি যদি লাগানো থাকে ডগলাস কেইনের ফ্রিজের দরজায়, অবাক হবে না?