০৬.
ছুট লাগানর জন্যে তৈরি হয়েছে রবিন আর মুসা। থেমে গেল প্রফেসরের তীক্ষ্ণ চিৎকারে। খবরদার! এক চুল নড়বে না কেউ।
প্রফেসর বেনজামিনের প্রতি কিশোরের শ্রদ্ধা বাড়ল। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর, কড়া নজর। তার আগেই প্রফেসর অবস্থাটা মনে মনে জরিপ করে নিয়েছেন। বলটা ওদের গায়ে পড়বে না, চলে যাবে পাশ দিয়ে।
লাফিয়ে গড়িয়ে ওদের দশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল বলটা। নিচের কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছে গিয়ে ধাক্কা খেল প্রচণ্ড শব্দে।
সেরেছিল। কপালের ঘাম মুছল রবিন। ওদিকেই রওনা হয়েছিলাম আমি, ভর্তা হয়ে যেতাম!
আমি হতাম না, বলল মুসা। উল্টো দিকে লক্ষ্য ছিল আমার। ওজন কত হবে? এক টন?
বেশি হবে, বললেন প্রফেসর। গ্র্যানেটের বল, এক ঘন-ফুটে ওজন। হবে…দাঁড়াও, অঙ্ক কষে…
প্রফেসর!
কথা থামিয়ে ফিরলেন প্রফেসর। অন্য তিনজনও তাকাল। হুপার ছুটে আসছে।
কাছে এসে দাঁড়াল হুপার। হাঁপাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখেছি! কোন ক্ষতি হয়নি তো আপনাদের?
না, কোন ক্ষতি হয়নি, অস্থির কণ্ঠস্বর। হুপারের দিকে চেয়ে ঘন ভুরুজোড়া কোঁচকালেন প্রফেসর। কি বলবে, জানি। শুনতে চাই না ওসব আর!
মাফ করবেন স্যার, তবু বলল হুপার, এটা রা-অরকনের অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না! একের পর এক দুর্ঘটনা-রা-অরকন আপনাকে খুন করবে, স্যার! হয়ত আমাদের সবাইকেই করবে!
রা-অরকনের অভিশাপ! বিড়বিড় করল কিশোর। প্রফেসরের দিকে ফিরল, প্রফেসর, মমিটা যে কবরে পেয়েছেন, ওখানে কি কোন কিছুতে অভিশাপের কথা লেখা ছিল?
না, মানে—ইয়ে—হ্যা..
প্রফেসরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল হুপার, ছিল! লেখা ছিল: যে এই কবরের পবিত্রতা আর শান্তি বিনষ্ট করবে, তার ওপর নেমে আসবে রা-অরকনের অভিশাপ! কবর খোঁড়ার কাজে যারা সহায়তা করেছিল, তাদের অনেকেই মরেছে। সাতজন..।
হুপার! গর্জে উঠলেন প্রফেসর। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ!
মাফ করবেন, স্যার, দুঃখিত, চুপ হয়ে গেল খানসামা।
লজ্জিত হলেন প্রফেসর। কিশোরের দিকে চেয়ে বললেন, একেবারে মিথ্যে বলেনি হুপার। রা-অরকনকে ঘিরে সত্যিই কিছু রহস্য গড়ে উঠেছে। একটা পাথরের পাহাড়ের চূড়ার কাছে ছিল ওর কবর। কবরটা লুকানো ছিল ভালমত। রাজকীয় কবর, অথচ মূল্যবান কিছু পাওয়া যায়নি সমাধিকক্ষে। শুধু সাধারণ একটা কফিনে রা-অরকন আর তার আদরের পোষা বেড়ালটার মমি। তবে, ও রা অরকন কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু কফিনের গায়ে ছাড়া কবরটার আর কোথাও তার নাম লেখা নেই, ফারাওদের কোন চিহ্ন নেই। যদি সে রা-অরকন হয়ে থাকে, তাহলে বিশেষ কোন কারণে ওরকম সাধারণভাবে কবর দেয়া হয়েছিল। তাকে। সমাধিকক্ষটা দেখে যা মনে হয়েছে, প্রাচীন দস্যু-তস্করেরা ঢুকতে পারেনি ওখানে। আর যদি ঢুকে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই খুব হতাশ হতে হয়েছিল। তাদেরকে। কিছু পায়নি।
অভিশাপের কথা কোথায় লেখা ছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কয়েকটা মাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে, তাতে। মমিটা কবর থেকে বের করে আনার পরের দিনই মোেটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে আমার প্রধান সহকারী! তার পরের দিন কায়রোর বাজারে খুন হল আমার সেক্রেটারি। একই জায়গায় প্রায় একই সময় খুন হল আরও একজন। সে-ও আমার সহকারী ছিল, বন্ধুও। জিম উইলসনের বাবা। যে শ্রমিকেরা খুঁড়েছিল, তাদের ওভারশিয়ার। মারা গেল সাপের কামড়ে। সবকটাই দুর্ঘটনা! এর মধ্যে কোন রহস্য নেই। মোটর দুর্ঘটনা, খুনখারাপি, কিংবা সাপের কামড় নতুন কোন ঘটনা নয়।
চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। ব্যাপারটাকে আধিভৌতিক বলেই মনে হচ্ছে ওদের।
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, অভিশাপের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই, বললেন। প্রফেসর। যেদিন মমিটা আমার বাড়িতে এসে পৌঁছুল সেদিনই একজন লোক। এসেছিল দেখা করতে। অ্যারাবিয়ান। নাম, জলিল—কি যেন! মমিটা দিয়ে দিতে। বলল। বেশ চাপাচাপি করল আমাকে। লিবিয়ার এক ধনী ব্যবসায়ী পাঠিয়েছে তাকে। জলিল ওই লোকটার ম্যানেজার। রা-অরকন নাকি ওই ব্যবসায়ী জামানের পূর্বপুরুষ। সেটা জেনেছে আবার এক জাদুকরের কাছে। যত্তোসব ভোগলামি! প্রথমে ভদ্রভাবে বললাম, গেল না জলিল। শেষে, ব্যবহার খারাপ করতে বাধ্য হয়েছি। যাওয়ার আগে জলিল হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছে, রা-অরকনের প্রেতাত্মা নাকি ছাড়বে না আমাকে। মমিটাকে মিশরে নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় আবার কবর না দিলে অভিশাপ নামবে আরও অনেকের ওপর।
আবার চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। ব্যাপারটাকে আধিভৌতিক বলে মেনে নিতে আর কোন দ্বিধা নেই ওদের।
তবে দুজনের মনে হল, গভীর রহস্যের সন্ধান পাওয়ায় খুশি খুশি লাগছে যেন কিশোরকে।
এখন, বললেন প্রফেসর। ওসব ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে এস দেখি, কেন। খসে পড়ল বলটা। কারণটা জানার চেষ্টা করি।
গেটের দিকে এগোলেন প্রফেসর। পেছনে তিন গোয়েন্দা, সবার পেছনে হুপার।
থামের মাথায় সুড়কি দিয়ে একটা খাজ বানানো হয়েছিল, তার ওপর বসান ছিল বলটা। আটকে দেয়া হয়েছিল সিমেন্ট দিয়ে। দীর্ঘদিন রোদ বাতাস আর বৃষ্টিতে ক্ষয়ে গিয়েছে সিমেন্ট। খাজের একটা দিক ভাঙা, ফলে বলটা পড়ে গেছে।
কোন রহস্য নেই, বললেন প্রফেসর। সিমেন্ট আর সুড়কি ক্ষয় হয়ে গেছে, ওই দেখ রিং ভাঙা। ঢালের দিকে সামান্য কাত হয়ে আছে থাম। হয়ত, অতি মৃদু ভূমিকম্প হয়েছিল, এতই মৃদু আমরা টের পাইনি। এটা নতুন কিছু না এ অঞ্চলে। মাঝেমধ্যেই এরকম ঘটে।
প্রফেসরের যুক্তি মনঃপূত হল না হুপারের। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।
প্রফেসরের সঙ্গে সঙ্গে চত্বরে এসে উঠল আবার তিন গোয়েন্দা। জাদুঘরে ঢুকল। ঘিরে দাঁড়াল রা-অরকনের মমিকে।
বুদ্ধি আছে তোমার, কিশোরের প্রশংসা করলেন প্রফেসর। মরা মমি কি করে কথা বলে, একটা যুক্তি দেখাতে পেরেছ। তবে ভুল যুক্তি। কারণ, কফিনের কোথাও কোন রেডিও লুকানো নেই।
ভালমত দেখেছিলেন তো, স্যার?।
চোখ মিটমিট করলেন প্রফেসর। নিশ্চয়। বেশ, তোমাদের সামনেই আবার দেখছি। মমিটা কফিন থেকে বের করে নিলেন তিনি। কিশোরকে খুঁজে দেখতে বললেন।
না, নেই রেডিও।
এবার সত্যিই বিস্মিত হল কিশোর। নাহ্, নেই! ইলেকট্রনিক কোন কিছুই নেই। প্রফেসর, আমার প্রথম যুক্তি ভুল হল।
প্রথম যুক্তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয়, কিশোরকে উৎসাহ দিলেন প্রফেসর। তবে পরের যুক্তিটা হয়ত ঠিক হবে। ভেবে বের করে ফেল আরেকটা কিছু।
আপাতত পারছি না, স্যার। আচ্ছা, বললেন, শুধু যখন আপনি একা থাকেন। এঘরে, তখনই মমিটা কথা বলে।
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালেন প্রফেসর। আর বলে বিশেষ একটা সময়ে। শেষ বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। এ-বাড়িতে আপনি ছাড়া আর কে কে থাকে?
হুপার। দশ বছর ধরে আমার চাকরি করছে সে। তার আগে থিয়েটারে কাজ করত, অভিনেতা। সে আমার শোফার, বাবুর্চি, খানসামা। হপ্তায় তিন দিন একজন মহিলা আসে ঘরদোর পরিষ্কার করতে, তবে ও থাকে না এখানে।
মালীর ব্যাপারটা কি? নতুন?
তা জানি না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। আট বছর ধরে রিগো কোম্পানির লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। একেকবার একেকজন লোক আসে। সবার চেহারা মনে রাখা সম্ভব না। তবে বাগান পর্যন্তই ওদের সীমানা। কখনও বাড়ির ভেতরে ঢোকে না।
হুমম! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ভুরু কুচকে গেছে। যা-ই হোক, মমিটার কথা-বলা নিজের কানে শুনতে হবে আমাকে।
কিন্তু ও তো শুধু আমার সঙ্গে কথা বলে। হুপার কিংবা জিমের সঙ্গে বলেনি। তোমার সঙ্গে বলবে বলেও মনে হয় না।
হ্যাঁ, প্রফেসরের সঙ্গে একমত হল রবিন। তোমার সঙ্গে কেন কথা বলতে যাবে মমিটা? তুমি তো ওর কাছে অপরিচিত।
এক মিনিট, হাত তুলল মুসা। কথাবার্তা মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার। এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন মমিটা সব কথা শুনতে পাচ্ছে, সব বুঝতে পারছে। ও যেন আমাদের মতই জ্যান্ত!
ঠিকই বলেছ, সায় দিলেন প্রফেসর। এসব আলোচনার কোন মানে নেই। বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
কারও কথায়ই কান দিল না কিশোর। দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল, আমার বিশ্বাস, মমিটা আমার সঙ্গে কথা বলকে। একবার কথা বললেই আরও কিছু তথ্য জোগাড় করে ফেলতে পারব আমি। প্রফেসর, বিকেলে আবার আসব আমরা। পরীক্ষা চালাব।
.
ইয়াল্লা, কিশোর কোথায়? হেডকোয়ার্টারের দেয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে চেয়ে আছে মুসা। আমাদেরকে ছটায় আসতে বলে সে নিজেই গায়েব। সোয়া ছটার বেশি বাজে।
মেরিচাচীকে জিজ্ঞেস করে এস, সকালের ঘটনার রিপোর্ট লিখছে রবিন। তিনি হয়ত কিছু বলতে পারবেন।
এসেই জিজ্ঞেস করছি, বলল মুসা। তিনি কিছু জানেন না। বলে যায়নি কিশোর। দেখি এসেছে কিনা ও। উঠে গিয়ে পেরিস্কোপে চোখ রাখল। হাতল ধরে ঘোরাল এদিক-ওদিক। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, ওই যে, এসে গেছে। শহরের দিক থেকে আসছে। ট্যাক্সিতে করে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। হয়ত ওয়াকি-টকিতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
দ্রুত ডেস্কের কাছে চলে এল মুসা। এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা লাউড-স্পীকার, বাক্সে ভরে। টেলিফোন লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ওটার। মুসা কিংবা রবিন জানত না, গত হপ্তায় ওটার ওপর আরেক দফা কারিগরী চালিয়েছে কিশোর। বাক্সের মধ্যে একটা রেডিও সেট বসিয়ে যোগ করে দিয়েছে মাইক্রোফোন আর স্পীকারের সঙ্গে। সুইচ অন করা থাকলে হেডকোয়ার্টারের ভেতরের সব আওয়াজ ট্রান্সমিট করে ওটা। প্রফেসর বেনজামিনের ওখান থেকে এসে কথাটা দুই বন্ধুকে জানিয়েছে কিশোর।
বাক্সটার দিকে চেয়ে মুখ বাঁকাল মুসা। এহ, মাইণ্ড রিডিং! সকালে কি ফাঁকিটাই না দিয়েছে আমাদের। আমরা কি বলছি সব শুনেছে! বিড়বিড় করতে করতে বাক্সের সামনে মুখ নিয়ে এল সে। একটা সুইচ অন করল। হেডকোয়ার্টার থেকে বলছি। সেকেণ্ড কলিং ফাস্ট। সেকেণ্ড কলিং ফাস্ট। সুইচটা অফ করে টিপে আরেকটা সুইচ অন করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন উঠল স্পীকারে। তারপরই পরিষ্কার ভেসে এল কিশোরের গলা। ফার্স্ট বলছি। শিগগিরই আসছি। সর্ব দর্শন তুলে দিয়েছ কেন? নামাও। দরকারের সময় ছাড়া একদম তুলবে না ওটা। গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। ওভার অ্যাণ্ড আউট।
শুনেছি, এবং বুঝতে পেরেছি, স্পীকারের সুইচ অফ করে দিল মুসা।
পেরিস্কোপ নামাতে এগিয়ে গেছে রবিন। বাজ পাখির চোখ! কিছু এড়ায় না। নামার আগে একবার চোখ রাখল পেরিস্কোপের আয়নায়। গেটের কাছে থেমেছে ট্যাক্সি। কিশোর বেরিয়ে এসেছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাঁটতে শুরু করেছে। ট্যাক্সিটা অপেক্ষা করছে। পেরিস্কোপ নামিয়ে আগের চেয়ারে এসে বসল রবিন। গিয়েছিল কোথায়!
নীরব রইল মুসা। জবাবটা সে নিজেও জানে না।
এক মিনিট পেরোল-দুই-তিন-চার-পাঁচ।…দশ মিনিট পেরোল…পনেরো…
আসছে না কেন এখনও! বলল রবিন। এতক্ষণে তো এসে পড়ার… ট্রেলারের মেঝেতে ট্র্যাপডোরের শব্দ শুনে থেমে গেল।
খুলে গেল বোর্ডটা। একটা মাথা দেখা দিল সুড়ঙ্গের মুখে। একজন বৃদ্ধ মানুষ। কাঁচাপাকা ঘন ভুরু। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। মুখে দাড়ি।
প্রফেসর বেনজামিন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আপনি এখানে এলেন কি করে? কিশোর কোথায়?
রা-অরকনের অভিশাপ নেমেছে তার ওপর, খুদে অফিস ঘরটায় উঠে এলেন প্রফেসর। রা-অরকন সব উল্টে দিয়েছে। প্রফেসরকে কিশোর আর কিশোরকে প্রফেসর বেনজামিন বানিয়েছে। টেনে মাথার সাদা উইগ খুলে ফেলল কিশোর। চশমা খুলে দরাজ হাসি হাসল দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে। তোমাদেরকে যখন বোকা। বানাতে পেরেছি, মমিটাকে নিশ্চয়ই পারব।
হাঁ করে আছে রবিন। চোখ বড় বড়।
খাইছে, কিশোর! মুসার চোখও কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন। দারুণ হয়েছে ছদ্মবেশ। আমরাই গাধা বনে গেছি। মমিটাকে বোকা বানানর কথা। কি যেন বলছিলে?
পরীক্ষা নেব, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে উইগ আর চশমাটা ভরে ফেলল কিশোর। দাড়িটা টেনে খুলে নিয়ে ভরল। কপালে, চোখের পাতায় বিশেষ রঙিন। পেন্সিলে কয়েকটা দাগ টানা হয়েছে। মাত্র কয়েকটা দাগেই অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছে। তাকে। মি. ক্রিস্টোফারের কাছে গিয়েছিলাম। একজন মেকআপ ম্যানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছদ্মবেশের এই উপকরণ সেই মেকআপ ম্যানই দিয়েছে। কি করে ছদ্মবেশ নিতে হবে, শিখিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন
মমিটাকে বোকা বানাতে, বলল কিশোর।
সে তো বলেছ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কেন বানাবে, সেটাই জানতে চাইছি।
আমাকে প্রফেসর বেনজামিন বলে ভুল করলে, কথা বলবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তাই ছদ্মবেশ নিতেই হচ্ছে। আর কারও সঙ্গে তো কথা বলে না ওটা।
আল্লাই জানে কি বলছ! এমনভাবে বলছ, যেন মমিটা দেখতে পায়, শুনতে পায়, চিন্তা করতে পারে! কিশোর, ওটা একটা মমি। তিন হাজার বছর আগে মারা যাওয়া একটা মানুষের শুকনো লাশ। ওটা কথা বলে! এবার সত্যিই বুঝি ভূতের পাল্লায় পড়লাম! কিশোর, এখনও সময় আছে। ভাল চাও তো, ভুলে যাও ওটার কথা। চল, বেড়ালটার ব্যাপারে তদন্ত করি আমরা। মমি-রহস্যের সমাধান করতে পারব না। খামোকা বেঘোরে প্রাণটা হারাব।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন। ঢোক গিলল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
তার মানে, মুসার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে কিশোর, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে চাও না? মমিটার কথা বলা শুনতে চাও না?
দ্বিধা করছে মুসা। উত্তেজিত হয়ে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছে, অনুশোচনা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আস্তে মাথা নাড়ল সে। তাই বলতে চাইছি। কিশোর, এবার হয়ত জাদুঘরের ছাদটাই ভেঙে পড়বে আমাদের মাথায়! সকালে বড় বেশি নাছোড়বান্দা মনে হয়েছে রা অরকনকে।
বেশ, বলল কিশোর, আমরা মানুষ তিনজন। একই সঙ্গে একটা কাজ করতে হবে, তার কোন মানে নেই। তুমি প্রফেসরের ওখানে যেতে না চাইলে জোর করব না। মিসেস ভেরা চ্যানেলের ওখানেই যাও। বেড়ালটা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এস। আমি আর রবিন যাচ্ছি প্রফেসরের ওখানে। কি বল, রবিন?
রবিনও ভয় পাচ্ছে যেতে। তবে প্রচণ্ড কৌতূহলের কাছে হার মানল ভয়। মাথা কাত করল সে, যাবে।
বেশ, মুসার দিকে ফিরল কিশোর। আমরা ট্যাক্সি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ইয়ার্ডের পিকআপটায় করে যাও। দেখলাম, বসে আছে বোরিস। তেমন কাজকর্ম নেই। বললে তোমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যেতে পারে ও।
দ্বিধা যাচ্ছে না মুসার। অবশেষে মনস্থির করে নিয়ে বলল, ঠিক আছে তাই যাব। সুড়ঙ্গমুখের দিকে এগিয়ে গেল।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এল মুসা। অফিসে তালা লাগাচ্ছে বোরিস। মুসাকে দেখে হাসল।
এক কথায় রাজি হয়ে গেল বোরিস। মুসাকে নিয়ে যাবে সান্তা মনিকায়।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল মুসা, কিশোরকে দেখিয়ে দেবে এবার, গোয়েন্দাগিরিতে সে-ও কম যায় না। বেড়ালটা খুঁজে বের করবেই সে। কিন্তু খচখচও করছে মনের ভেতর, দুই বন্ধুর জন্যে। রা-অরকনের অভিশাপ যদি সত্যিই নেমে আসে কিশোর আর রবিনের ওপর?
.
০৭.
জাদুঘরে একা ঢুকল কিশোর। মাথার ওপরের আলোটা জ্বেলে দিল। বাইরে এখনও দিন। সূর্য অস্ত যায়নি, তবে খাড়া পাহাড়গুলোর আড়ালে চলে গেছে। ফলে অন্ধকার নেমে এসেছে গিরিখাতে। গাঢ় ছায়া গিলে নিয়েছে যেন বিশাল পুরানো বাড়িটাকে।
বুড়ো মানুষের মত ধীরে সুস্থে নড়াচড়া করছে কিশোর, অবিকল প্রফেসর বেনজামিনের নকল। বড় জানালাগুলো খুলে দিল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল কফিনটার সামনে। ঢাকনা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখল একপাশে। একনজর দেখল মমিটাকে। ঝুঁকল ওটার ওপর। জোরে জোরে বলল, রা-অরকন, কথা বলুন। আমি শুনছি।
ভাল অভিনেতা কিশোর। গলার স্বরও পুরোপুরি নকল করেছে। প্রফেসরের কোট আর টাই পরেছে। শার্টের তলায় আলগা কাপড় তোয়ালে দিয়ে বেঁধে ভুড়ি তৈরি করেছে। খুব কাছে থেকে কেউ না দেখলে বুঝতেই পারবে না ব্যাপারটা। চোখ বন্ধ রেখে রা-অরকনের মমি নিশ্চয় ধরতে পারবে না এই ফাঁকি, আশা করছে কিশোর।
রবিন আর প্রফেসর বেনজামিন অপেক্ষা করছেন পাশের ঘরে। হুপার রান্নাঘরে। ব্যস্ত। কি ঘটছে না ঘটছে, কিছুই জানে না। নীরব রয়েছে মমি।
মহান রা-অরকন, আবার বলল কিশোর, কথা বলুন। আমি বোঝার চেষ্টা করব।
কি যেন শোনা গেল? মাথা কাত করে মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে এল। কিশোর। অদ্ভুত খসখসে কণ্ঠস্বর। হিসহিস আর ফিসফিসানিতে ভরা। আরও কিছু অদ্ভুত শব্দ মিশেছে। শব্দগুলো বোঝাই মুশকিল।
অবাক হয়ে পুরো ঘরে চোখ বোলাল কিশোর। একা রয়েছে সে। দরজা বন্ধ। ফিসফিস করে বলেই চলেছে রা-অরকন। কান পেতে আছে কিশোর। কেমন এক ধরনের আদেশের সুর রয়েছে বলার ভঙ্গিতে। কিন্তু একটা শব্দও বুঝতে পারছে না সে।
কোটের নিচে কোমরের বেল্টের সঙ্গে আটকানো রয়েছে একটা পোর্টেবল টেপ রেকর্ডার। খুলে নিয়ে ওটা মমির ঠোঁটের কাছাকাছি রাখল কিশোর। রেকর্ডিং সুইচ। টিপে দিয়েছে।
রা-অরকন, আপনার কথা বুঝতে পারছি না, জোরে বলল কিশোর। আরেকটু জোরে বলুন।
ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কথা, আবার শুরু হল। অনর্গল উচ্চারিত হচ্ছে কিছু দুর্বোধ্য শব্দ, নানারকম আওয়াজের মাঝে বোঝাই কঠিন। টেপ রেকর্ডারের মাইক্রোফোন কথা ধরতে পারবে তো?–সন্দেহ হচ্ছে কিশোরের।
মিনিটখানেক ধরে একটানা কথা বলে যাচ্ছে রা-অরকন। ভাল করে শোনার জন্যে কান মমির ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল কিশোর। ক্ষণিকের জন্যে থামল কথা। সোজা হতে গেল সে। পুরানো কফিনের বেরিয়ে থাকা সুচালো একটা কাঠের ফলায় আটকে গেল দাড়ি। হ্যাঁচকা টানে খুলে গেল গাল থেকে। বেকায়দা ভঙ্গিতে ঝুঁকে থাবা দিয়ে ধরতে গেল দাড়ি। ভারসাম্য হারিয়ে দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। নাকের ওপর থেকে খসে পড়ে গেল চশমা, উইগ খুলে চলে এল চোখের ওপর। নিজের অজান্তেই একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
অন্ধের মত উঠে দাঁড়াল কিশোর। চুলদাড়ি আবার জায়গামত লাগানর চেষ্টা চালাচ্ছে দ্রুত হাতে।
এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল রবিন আর প্রফেসর।
কিশোর, কি হয়েছে? রবিন উদ্বিগ্ন।
তোমার চিৎকার শুনলাম! বলে উঠলেন প্রফেসর। কিছু হয়েছে?
আমার অসাবধানতা, তিক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। বোধহয় সব ভজকট করে দিয়েছি! মমি কথা বলছিল…
বোকা বানিয়েছ তাহলে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
জানি না কি করেছি! কথা তো বলেছিল! দেখি, আবার বলে কিনা! আবার মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। রা-অরকন, বলুন। রা-অরকন? অপেক্ষা করছে। তিনজনে। মমি নীরব। নিজেদের শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও নিস্তব্ধ ঘরে।
লাভ নেই, অবশেষে বলল কিশোর। আর এখন কথা বলবে না মমি। দেখি, টেপে রেকর্ড হয়েছে কিনা। _ যন্ত্রটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল গোয়েন্দাপ্রধান। পেছনে এগোল রবিন আর প্রফেসর। পাশের ঘরে চলে এল।
টেপ-রেকর্ডারটা টেবিলে রাখল কিশোর। গা থেকে কোট খুলে ফেলল। খুলল পেটে বাঁধা কাপড়। তারপর টেপ রিউইও করে নিয়ে প্লে লেখা বোতাম টিপে দিল।
কয়েক মুহূর্ত শুধু স্পীকারের মৃদু হিসহিস শব্দ। তারপরেই শোনা গেল কথা। খুবই মৃদু। বোঝাই যায় না প্রায়। ভলিউম বাড়িয়ে দিলে স্পীকারের শব্দও বেড়ে যায়। আরও বোঝা যায় না কথা।
শেষ হল মমির কথা। কিশোরের চিৎকারটা শোনা যেতেই সুইচ অফ করে দিল সে। প্রফেসরের দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে পেরেছেন, স্যার?
নীরবে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। তারপর বললেন, একআধটা শব্দ পরিচিত মনে হচ্ছে, তবে মানে বুঝতে পারছি না। মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা, সন্দেহ নেই, খুবই প্রাচীন। সারা ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন লোকই আছে, যে হয়ত এর মানে উদ্ধার করতে পারবে। সে প্রফেসর জিম উইলসন, আমার সহকারীর ছেলে। হাত তুলে জানালা দিয়ে প্রফেসর উইলসনের বাড়িটা দেখালেন। দেখা যাচ্ছে, কাছে। আসলেও তাই। তবে সরাসরি যাওয়ার পথ নেই, পাহাড় ঘুরে যেতে হয়। ট্যাক্সিতে করে গেলে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগবে না। ওকে আগেই বলেছি মমিটার কথা। আমাকে সাহায্য করবে বলে কথাও দিয়েছে। চল, টেপটা নিয়ে এখুনি তার কাছে চলে যাই।
কিশোর রাজি।
হুপারকে ডাকলেন প্রফেসর। সে এলে বললেন, হুপার, আমরা জিমের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি থাক। কড়া নজর রাখবে চারদিকে। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবে আমাকে।
ঠিক আছে, স্যার।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে প্রফেসর উইলসনের বাড়ির দিকে রওনা হল তিনজনে। বিশাল বাড়িটায় একা হুপার। রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল সে। কয়েকটা প্লেট মাজছিল, শেষ হয়নি মাজা। আবার কাজে মন দিল।
বাইরে অন্ধকার নামছে। প্লেট মাজতে মাজতেই অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেল হুপার। থমকে গেল। কান পাতল।
কিন্তু আর শোনা গেল না শব্দটা। সন্দেহ গেল না হুপারের। হাতের বাসনটা নামিয়ে রেখে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। প্রফেসরের সংগ্রহ থেকে প্রাচীন এক বিশাল তলোয়ার তুলে নিয়ে পা টিপে এগোল জাদুঘরের দিকে।
যেখানে যেটা যেভাবে রাখা ছিল, তেমনি রয়েছে। কোন রকম নড়চড় হয়নি। তেমনি পড়ে আছে কফিনটা, ডালা বন্ধ। জানালা বন্ধ করে গিয়েছিল, বন্ধই আছে।
এগিয়ে গিয়ে একটা জানালা খুলল। ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে নামল চত্বরে। ঠিক তখনই আবার কানে এল শব্দটা। অদ্ভুত খসখসে ভাষায় কি একটা আদেশ দিল যেন কেউ! কে কাকে আদেশ দিল! তাকেই নয় তো! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। হুপার। দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর। পাগলের মত চারদিকে তাকাচ্ছে।
একপাশে একটা ঝোঁপের ভেতর নড়াচড়া লক্ষ্য করল। তলোয়ারটা তুলে ধরল। আত্মরক্ষার তাগিদে। আবছা অন্ধকারে দেখল, বেরিয়ে আসছে একটা মূর্তি। দেহটা মানুষের, তবে গলার ওপরের অংশ পুরোপুরি শেয়াল। দুই চোখ জ্বলছে।
আনুবিস! ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল হুপার। শেয়ালদেবতা!
এক পা সামনে বাড়ল আনুবিস। ধীরে ধীরে তুলল ডান হাত। টান টান সোজা করল সামনের দিকে। তর্জনী নির্দেশ করছে হুপারকে।
ঠিক বুঝতে পারল না হুপার, কি ঘটল। অস্বাভাবিক দুর্বল বোধ করছে। চোখের পলকে যেন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে তার শরীরের যন্ত্রপাতিগুলোতে। হাত থেকে খসে পড়ল তলোয়ার। সেই সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল সে-ও।
.
০৮.
দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি। ছোট একটা ব্রিজ-গ্যারেজের সঙ্গে রাস্তার যোগাযোগ রেখেছে। নিচে ঢালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রফেসর উইলসনের বাংলো।
সরু রাস্তা, বলল ড্রাইভার। সামনের দিক থেকে কোন গাড়ি এলে মোড় ঘোরার আগে দেখতে পাবে না। লাগিয়ে বসতে পারে আমার ট্যাক্সিতে। আপনারা যান। পাহাড়ের নিচে একটা পার্কিং লট আছে। ওখানে অপেক্ষা করব আমি।
গাড়ি থেকে নামলেন প্রফেসর বেনজামিন, রবিন আর কিশোর। ব্রিজ পেরিয়ে দেখল, গ্যারেজের একপাশ থেকে নেমে গেছে সিঁড়ি।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা। বেল বাজালেন প্রফেসর।
দরজা খুলে দিল উইলসন। আরে, প্রফেসর! আসুন, আসুন। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভাষা নিয়ে ডিকশনারি লিখছি, ঠিক সময়েই এসে পড়েছেন। তো, এই অসময়ে কি মনে করে?
জানালেন প্রফেসর বেনজামিন।
খুব উত্তেজিত মনে হল উইলসনকে। অবিশ্বাস্য! এখনই শুনব ক্যাসেটটা! বুড়ো মিয়া কি বলছে বোঝা দরকার।
পথ দেখিয়ে মেহমানদেরকে স্টাডিতে নিয়ে এলেন উইলসন। বইয়ে প্রায় বোঝাই হয়ে গেছে ঘরটা। আর আছে কয়েকটা রেকর্ড প্লেয়ার, টেপ-রেকর্ডার। ক্যাসেটটা নিয়ে একটা মেশিনে ঢুকিয়ে চালু করে দিলেন তিনি।
রা-অরকনের ফিসফিসে গলার আওয়াজ অনেক গুণ পরিবর্ধিত করে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল যেন স্পীকার। শুনতে শুনতে হতাশা ফুটল উইলসনের চেহারায়। উত্তেজনা চলে গেছে। দুঃখিত, প্রফেসর, একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছে না। রেকর্ডিং খুব খারাপ, আসল শব্দের চেয়ে মেশিনের শব্দই বেশি ক্যাচ করেছে। আরেকটা মেশিন আছে আমার। ফালতু আওয়াজ কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা আছে ওটাতে। দেখি। ওটাতে লাগিয়ে। কাজ হতেও পারে।
বেরিয়ে গেলেন উইলসন। ফিরে এলেন ছোট একটা টেপ-রেকর্ডার সেট নিয়ে। ক্যাসেটটা আগের মেশিন থেকে বের করে নিয়ে নতুনটাতে ভরলেন। টিপে দিলেন প্লে লেখা বোতাম।
.
কাজ সারতে খুব একটা দেরি হল না মুসার। প্রফেসর বেনজামিনের ওখান থেকে একবার ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। সেকথা বলল বোরিসকে।
প্রফেসর বেনজামিনের বাড়িতে যখন পৌঁছল ট্রাক, অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। একটা মাত্র আলো দেখা যাচ্ছে এত বড় বাড়িটাতে।
মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই, বলল বোরিস। যাবে?
কেউ না থাকলেও প্রফেসরের খানসামা থাকবেই, বলল মুসা। নেমে পড়ল। ট্রাক থেকে। ওর কাছেই জানতে পারব কে কোথায় গেছে, যদি গিয়ে থাকে।
হাতঘড়ি দেখল বোরিস। তাড়াতাড়ি এস। রোভারকে নিয়ে সিনেমায় যাব। ও অপেক্ষা করবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে পারবে?
আপনি চলে যান তাহলে, বলল মুসা। কত দেরি হবে, ঠিক বলতে পারছি না। পাহাড়ের নিচে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড দেখলাম। বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে না।
ঠিক আছে, ইঞ্জিন স্টার্ট দিল বোরিস। চলে গেল ট্রাক নিয়ে।
বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। বেল বাজাল। অপেক্ষা করছে দরজা খোলার। মিসেস ভেরা চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথা ভাবছে।
দ্রুত কথা বললেন মহিলা। অনেক কথাই বলে ফেলেছেন খুব কম সময়ে। হপ্তাখানেক আগে হারিয়ে গেছে তার শখের বেড়ালটা। খুব সুন্দর দেখতে। এ অঞ্চলে দুষ্প্রাপ্য। বেশির ভাগ আবিসিনিয়ান বেড়ালই বুনো স্বভাবের, পোষ মানে, তবে মনিবের সঙ্গেও ব্যবহার খারাপ করে। কিন্তু ওই বিশেষ বেড়ালটা ছিল ঠিক উল্টো। ভদ্র, কোনরকম বাজে স্বভাব ছিল না। মিসেস চ্যানেলের ধারণা, হয় বেড়ালটাকে চুরি করা হয়েছে, কিংবা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল, পথ। চিনে আর ফিরতে পারেনি।
বেড়ালটা পিঙ্গল রঙের, শুধু সামনের দুই পায়ের নিচের অংশ সাদা। চোখ দুটোতে আশ্চর্য একটা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আবিসিনিয়ায় বেড়ালের চোখ সাধারণত হলুদ কিংবা কমলা রঙের হয়। অথচ স্ফিঙ্কসের একটা চোখ কমলা, আরেকটা নীল। এই বিশেষ ব্যাপারটার জন্যে কয়েকবারই বেড়ালের মেলায় ওটাকে নিয়ে গেছেন। মিসেস চ্যানেল। দেখিয়ে লোককে অবাক করে দেয়ার জন্যে। স্থানীয় অনেক পত্র পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে বেরিয়েছেও খবরটা ফিঙ্কসের রঙিন ফটোগ্রাফসহ। জীববিজ্ঞানীদের মতে বেড়ালের চোখের রঙের সেই বৈসাদৃশ্য খুব বিরল একটা ব্যাপার।
কিন্তু এখনও দরজা খুলছে না কেন হুপার? অবাক হল মুসা। আবার বাজাল বেল। সাড়া নেই। চেঁচিয়ে ডাকল সে হুপারের নাম ধরে। তবু জবাব নেই।
চারদিকে তাকাল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। গলা আরও চড়িয়ে ডাকল হুপারকে। সাড়া না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলল জাদুঘরের দিকে। জানালা খোলা। আলো জ্বলছে ওঘরেই। ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। কফিনটা জায়গামতই রয়েছে। জানালার কাছে তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেবতা আনুবিসের মূর্তি। কোন রকম গোলমাল চোখে পড়ল না তার। কিন্তু তবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কি সেটা? মেরুদণ্ডে অদ্ভুত এক ধরনের শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে এখন।
কফিনের ঢাকনা তুলে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না। যদি একা পেয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে মমিটা? থাক, বাবা, খুলে কাজ নেই। ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল মুসা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই জানালাটার কাছে, যেটা দিয়ে দেখা যায় প্রফেসর উইলসনের বাড়ি। উঁকি দিল বাইরে। অন্ধকার বাগান। ঘরের আলো পড়েছে খানিকটা জায়গায়, তাতে আশপাশটা আরও বেশি অন্ধকার দেখাচ্ছে। কালো আকাশে অগুনতি তারা। এক বিন্দু বাতাস নেই, গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। কালো ঝোঁপগুলোর দিকে চেয়ে মেরুদণ্ডের শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল আবার। হঠাৎই ভয় পেতে শুরু করেছে সে। গেল কোথায় সব? কোন অঘটন ঘটল না তো? ঘুরে দাঁড়ানর আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল। জিনিসটা। জানালা দিয়ে আলো পড়েছে বাগানে। আলো আর অন্ধকারের সীমারেখার কাছে চকচক করছে কিছু একটা।
ভয় নেই, বলে মনকে বোঝানর চেষ্টা করল মুসা। সাহস সঞ্চয় করে জানালা টপকে নামল বাগানে। কাছে গিয়ে তুলে নিল চকচকে জিনিসটা। একটা তলোয়ার। অনেক পুরানো, ব্রোঞ্জের তৈরি। নিশ্চয় প্রফেসর বেনজামিনের সংগ্রহের জিনিস। ঠিক এই সময় মৃদু একটা শব্দ হল পেছনে। ধক করে উঠল মুসার বুকের ভেতর। পাই করে ঘুরল।
ঝোঁপের ভেতর নড়ছে কিছু একটা। পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এল ছোট একটা চারপেয়ে জীব। ধীরে ধীরে কাছ চলে এল। বেড়াল। মুখ তুলে তাকাল মুসার দিকে। পরক্ষণেই তার পায়ে গা ঘষতে শুরু করল। মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ করছে। আদর চাইছে বোধহয়।
হেসে ফেলল মুসা। দূর হয়ে গেছে উত্তেজনা, শঙ্কা, ভয়। তলোয়ারটা মাটিতে রেখে বেড়ালটাকে তুলে নিল দুহাতে। সুন্দর একটা বেড়াল। হুলো। বেশ বড়। পিঙ্গল রঙ। মৃদু ঘড়ঘড় করেই চলেছে। দুপা এগিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াল মুসা। এই সময় মুখ তুলে তাকাল বেড়ালটা তার দিকে। হাত থেকেই প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিল। ওটাকে মুসা। নিজের অজান্তেই চাপা একটা শব্দ করে উঠল, ইয়াল্লা! এটা। ফিস। মিসেস চ্যানেলের বেড়াল!-ভাবছে মুসা। এটা এখানে এল কি করে? যেভাবেই আসুক, কপালগুণেই খুঁজে পেয়েছে সে এটাকে। কিশোরের দিকে চেয়ে। খুব একখান হাসি দিতে পারবে এবারে। এত তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে গেছে কেস।
জানালার দিকে পা বাড়াল মুসা, ঠিক এই সময় ভারি একটা কিছু এসে পড়ল তার ওপর, পেছন থেকে। চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে বেড়ালটাকে ছেড়ে দিল সে। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ঘাসের ওপর। পিঠের ওপর চেপে এল একটা ভারি কিছু।
এক মুহূর্ত। তারপরই হুশ ফিরে পেল মুসা। এক গড়ান দিয়েই সরে গেল, পিঠের ওপর থেকে ফেলে দিল বোঝাটা। পাশ ফিরে তাকাল। সেই ছেলেটা। সকালে ঝোঁপের ভেতর বসে ছিল যে, যাকে ধরে ফেলেছিল। ছেলেটা উঠে দাঁড়ানর আগেই বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মুসার শরীরে। চার হাত পায়ে ভর দিয়ে চিতার মত লাফিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কোমর। এবার আর ছাড়বে না কিছুতেই।
অনেক চেষ্টা করল ছেলেটা, কিন্তু ছাড়া পেল না মুসার হাত থেকে।
মুসা আমানের হাতে পড়েছ, খোকাবাবু, বলল গোয়েন্দাসহকারী, সহজে ছাড়া পাচ্ছ না আর। কে তুমি? এদিকে এত ঘোরাফেরা কিসের? আমাকে আক্রমণ করছ কেন?
আবার ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল ছেলেটা। তারপর হাল ছেড়ে দিল। চেঁচিয়ে উঠল ইংরেজিতে, তোমরা আমার দাদা রা-অরকনকে চুরি করেছ! আমার বেড়ালটাকে ধরে রাখতে চাইছ! কিন্তু আমি জামান বংশের ছেলে জামান, সেটা কিছুতেই হতে দেব না!
দাদা রা-অরকন! চুরি করেছি! মুসা অবাক। আর ওটা তোমার বেড়াল? ভুল করছ, খোকাবাবু। বেড়ালটা তোমার নয়। ওটার মালিক মিসেস ভেরা চ্যানেল। আর আমি ওটাকে ধরে রাখতে চাইনি। ওটাই আমার কাছে এসেছে। খাতির করতে চেয়েছে। ঠেলতে ঠেলতে ছেলেটাকে জানালার কাছে নিয়ে এল মুসা। কোমর ছেড়ে দিয়ে কব্জি চেপে ধরল।
মুসার দিকে চেয়ে আছে ছেলেটা। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে না আর। তামাটে চামড়ার রঙ, কুচকুচে কালো বড় বড় দুটো চোখ। কুটি করল। তুমি দাদা রা-অরকনের ব্যাপারে কিছু জান না! ওকে চুরি করনি?
কি বলছ তাই বুঝতে পারছি না, বলল মুসা। মমিটার কথা বলছ? তাহলে ওটাকে দাদা-দাদা করছ কেন? ওটা তিন হাজার বছরের পুরানো। তোমার দাদা হয়। কি করে? কফিনের ভেতরে রয়েছে এখন। চুরি করিনি। আর করতে যাবই বা কেন?
মাথা নাড়ল ছেলেটা। কফিনের ভেতর নেই এখন ওটা।
নেই!
না, নেই। খানিক আগে দুটো লোক এসে নিয়ে গেছে। এতে তোমার কোন হাত নেই বলতে চাইছ?
রা-অরকনকে নিয়ে গেছে! ছেলেটার প্রশ্ন যেন শুনতে পায়নি মুসা। বিশ্বাস করতে পারছি না!
আমি সত্যি বলছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ছেলেটা। জামান বংশের জামান কখনও মিছে কথা বলে না।
ছেলেটাকে ধরে রেখেই জানালা দিয়ে কফিনটার দিকে তাকাল মুসা। ঠিক আগের জায়গাতে আগের মতই রয়েছে। বিন্দুমাত্র সরেনি কোনদিকে। কিন্তু ছেলেটা বলছে, সে সত্যি কথা বলছে। তাহলে?
শোন, খোকাবাবু, বলল মুসা। শুনেছি, মমিটা প্রফেসর বেনজামিনের সঙ্গে কথা বলে। ওই রহস্যের সমাধান করতেই এসেছি আমরা। কেন, কি কথা বলে, কি করে বলে, বলতে পারবে কিছু?
বিস্ময় ফুটল ছেলেটার চোখে। দাদা রা-অরকন কথা বলে! আশ্চর্য! না, আমি কিছু বলতে পারব না!
আমরাও কিছু বুঝতে পারিনি এখনও, বলল মুসা। মমিটার ব্যাপারে অনেক কিছু জান মনে হচ্ছে। আমি কিছু কিছু জানি, হয়ত সেটা তুমি জান না। এ-বাড়ির ওপর চোখ রেখেছ কেন? সকালে ঝোঁপের ভেতর কেন লুকিয়েছিলে? কোন অসুবিধে না থাকলে বলে ফেল। হয়ত মমি-রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারব আমরা। মানে, কি করে কথা বলে, কি বলে, জানতে পারব। কি, বলবে?
দ্বিধা করছে ছেলেটা। তারপর মাথা নাড়ল। বেশ, বলব সব। জামান বংশের জামান বিশ্বাস করল তোমাকে। হাত ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি।
হাত ছেড়ে দিল মুসা।
কজির কাছটায় ডলতে লাগল ছেলেটা। ঝোঁপের দিকে চেয়ে তার নিজের ভাষায় কিছু বলল চেঁচিয়ে।
কি বলছ? জানতে চাইল মুসা।
আমার বেড়ালটাকে ডাকছি। ওর ভেতরে বাস করে রা-অরকনের আত্মা। মমিটা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে ওটা আমাদের।
অপেক্ষা করে রইল দুজনে। কিন্তু এল না বেড়ালটা।
বলেছিলাম না? অবশেষে বলল মুসা। ওটা তোমার বেড়াল নয়। মিসেস চ্যানেলের। নাম, ফিঙ্কস। আবিসিনিয়ার বেড়াল, পিঙ্গল শরীর। সামনের দুই পা সাদা। দুই চোখ দুই রঙের। মহিলার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
না, গভীর আস্থা ছেলেটার কণ্ঠে। পা সাদা নয়, কালো। রা-অরকনের প্রিয় বেড়াল। যেটাকে মেরে মমি করে কফিনে তার সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল মুসা। বড় বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে জামান বংশের জামান। বেড়ালটার পায়ের রং সাদাই দেখেছে কিনা, মনে করতে পারছে না। ভাবনায় পড়ে গেল। ঠিক আছে, এ নিয়ে পরে ভাবব। এস দেখি, তোমার কথা ঠিক কিনা। সত্যিই চুরি গেছে কিনা মমিটা।
জানালা গলে দুজনে ঢুকল জাদুঘরে। ধরাধরি করে তুলে ফেলল কফিনের ঢাকনা। ঠিকই বলেছে জামান বংশের জামান। শূন্য কফিন।
ইয়াল্লা! বিড়বিড় করল মুসা। কে নিল!
তোমাদেরই কেউ নিয়েছে! চুরি করেছে আমার দাদাকে! ঝাঁঝালো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা।
না, জামান, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল মুসা। এই চুরির ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। তোমাদের বলতে কাকে বোঝাতে চাইছ? এ-বাড়িতে আমরা তিন বন্ধু এসেছি। অন্য দুজন আমার বয়েসী। মমিটা কথা বলে কেন, সে রহস্য ভেদ করতে এসেছি। সে যাই হোক, মমিটা সম্পর্কে তুমি যা জান বল, আমি যা জানি বলব। হয়ত একটা সমাধান বেরিয়েও যেতে পারে। কে চুরি করল মমিটা, তা-ও জেনে যেতে পারি হয়ত।
কি যেন ভাবল জামান। মাথা কাত করল, বেশ, কি জানতে চাও?
আমার প্রথম প্রশ্ন, রা-অরকনকে দাদা বলছ কেন?
জামান বংশের অনেক প্রাচীন পূর্বপুরুষ রা-অরকন, গর্বিত কণ্ঠ জামানের। তিন হাজার বছর আগে লিবিয়ানরা গিয়ে মিশর শাসন করেছিল। রা-অরকন লিবিয়ান। তিনি ছিলেন এক মহান রাজা। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না বলে, অত্যাচারীকে কঠোর হাতে দমন করতেন বলে, খুন করা হয় তাকে। তার লাশ নষ্ট করে ফেলতে পারে শত্রুরা-জান হয়ত, মমি নষ্ট করে ফেললে সেই লোকের আত্মা আর পরপারে গিয়ে ঠাই পায় না, প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, তাই গোপনে গোপন জায়গায় কবর দেয়া হল তাঁকে। বিনা আড়ম্বরে। তাঁর বংশের এক ছেলে। আবার লিবিয়ায় ফিরে গিয়েছিল। সেই ছেলেরই বংশধর আমরা।
জানলে কি করে এত সব? কোন প্রাচীন ডায়েরীটায়েরী…মানে ফলকে। লেখা—
মাথা নাড়ল জামান। না, ওরকম কিছু না। এক জ্যোতিষের কাছে জেনেছেন। এটা বাবা। মহা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ওই জ্যোতিষ। অতীত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। সে-ই জানিয়েছে, রা-অরকনকে অনেক দূরের এক দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিশর থেকে, বর্বরদের দেশে। ওখানে মোটেই শান্তি পাচ্ছেন না রা অরকন, তার ঘুমের খুব ব্যাঘাত ঘটছে। আমার বাবা অসুস্থ, তাই মমিটা নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন জলিলকে। সে আমাদের ম্যানেজার। সঙ্গে দিয়েছেন আমাকে। বংশের কেউ নিতে না এলে যদি কিছু মনে করে রা-অরকন, সেজন্যে।
অন্য সময় হলে বর্বর শব্দটার প্রতিবাদ করত মুসা। কিন্তু এখন অন্য ভাবনা চলেছে মাথায়। সকালে প্রফেসর বেনজামিন বলেছেন, একজন অ্যারাবিয়ান ব্যবসায়ী মমিটা নিতে এসেছিল। তার নাম জলিল। লোকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি। ও, এই জন্যেই এ বাড়ির আশপাশে এত ঘোরাফেরা তোমার? বলল মুসা। তুমি আর জলিল মিলে রা-অরকনকে চুরি করার ফন্দি এঁটেছিলে নাকি?
বর্বর প্রফেসর আমার দাদাকে দিল না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল জামান, আর কি করব? কিন্তু চুরি বলছ কেন এটাকে? আমাদের জিনিস জোর করে দখল করেছে সে। আর কোন উপায় নেই আমাদের। তাই ওকে না জানিয়েই নিয়ে যেতে চেয়েছি। দাদার আত্মার শান্তির জন্যে জান দিয়ে দিতেও আপত্তি নেই আমার। বংশের কারও অপমান সহ্য করে না জামান বংশের লোকেরা।
তোমাদের ম্যানেজার জলিল এখন কোথায়?
আছে। তাকে দেখেছ তুমি। সকালে।
দেখেছি!
হ্যাঁ, ওই মালী। যে আমাকে ধরেছিল। ইচ্ছে করেই ওর হাত কামড়ে দেয়ার সুযোগ দিয়েছিল সে আমাকে। আরবীতে চেঁচিয়ে উঠেছিল, মনে আছে? কামড়ে দিতে বলেছিল। খুব চালাক লোক। তোমাদের সবাইকে কেমন বোকা বানিয়ে। ছাড়ল।
হাঁ করে চেয়ে রইল মুসা। চমকটা হজমের চেষ্টা করছে। সেই মালীটা তাহলে। জলিল! চুরি করতে এসেছে রা-অরকনকে জামানের বাবার আদেশে! তার ভাবনা। শেষ হওয়ার আগেই পাই করে ঘুরল জামান জানালার দিকে। কান পেতে শুনছে কি যেন!
কেউ এসেছে! চাপা গলায় বলল জামান। ইঞ্জিনের শব্দ!
জানালার কাছে ছুটে গেল সে। উঁকি দিল বাইরে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। সে-ও তাকাল।
পুরানো একটা নীল রঙের ট্রাক ঢুকছে গেট দিয়ে। চত্বরে এসে থামল। দুজন। লোক নামল। দুজনেই মোটাসোটা, বেঁটে। সোজা এগিয়ে আসছে জাদুঘরের দিকে।
ওই দুজনই! ফিসফিস করে বলল জামান। ওরাই চুরি করেছে রা অরনকে! কয়েক মিনিট আগে এসেছিল আরেকবার। কম্বলে জড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কি তুলল ট্রাকে, এখন বুঝতে পারছি, মমিটাকেই নিয়েছে। ওরা চলে গেল। বাড়িটা খালি মনে হল। ঢুকে পড়লাম জাদুঘরে। ঢাকনা তুলে দেখি কফিনে নেই রা অরকন।
এদিকেই আসছে ব্যাটারা! বিড়বিড় করল মুসা। চেহারা-সুরত বিশেষ সুবিধার ঠেকছে না। আবার কি চায়?
লুকাতে হবে! জলদি! নিশ্চয় আরও কিছু চুরি করতে এসেছে!
কোথায় লুকাব? সারা ঘরে চোখ বোলাল মুসা। কোন জায়গা তো দেখছি না! চল, বাইরে গিয়ে ঝোঁপের ভেতরে…
তাহলে কি চুরি করতে এসেছে দেখব না। ওদের কথাবার্তাও শুনতে পাব না। এখানেই কোথাও লুকাতে হবে, কফিনটার দিকে চেয়ে আছে জামান। জলদি! ওটার ভেতর লুকাব। রা-অরকন নেই, আমাদের জায়গা হয়ে যাবে। জলদি এস।
ঠিক, ঠিক বলেছ, সায় দিল মুসা।
ছুটে গিয়ে কফিনে ঢুকে পড়ল জামান। চাপা গলায় ডাকল, আহ, তাড়াতাড়িন এস!
কফিনে ঢুকল মুসা। দুজনে ধরে ঢাকনাটা নামিয়ে দিল জায়গামত। পকেট থেকে একটা পেন্সিল বের করে ডালার ফাঁকে গুঁজে দিয়েছে মুসা। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, বাতাস চলাচল করতে পারবে। ভেতরে থেকে শ্বাস নিতে অসুবিধা হবে না।
পাশাপাশি শুয়ে পড়েছে দুজনে কফিনের ভেতর। ঠিক এই সময় দরজা। খোলার শব্দ হল। মেঝেতে ভারি পায়ের শব্দ।
দড়িটা খোল, ওয়েব, শোনা গেল একটা কণ্ঠ।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। খুলেছি, শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠ। মেথু, লোকটাকে মোটেই পছন্দ হয়নি আমার। আগে বলল না কেন ব্যাটা, কফিনটা সহ চায়? একবারেই কাজ সারতে পারতাম। আবার এখানে পাঠাল যখন দেব ফিস ডবল করে।
আমিও তাই ভাবছি, বলল মেথু। ডাবল চাইব। নইলে…ঠিক আছে, এস বেঁধে ফেলি।
মুহূর্ত পরেই টের পেল মুসা আর জামান, নড়ছে কফিন। একটা প্রান্ত উঠে যাচ্ছে ওপরে। দড়ি ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে নিশ্চয়। বুঝতে পারছে ওরা, কফিনের সঙ্গে ডালাটা শক্ত করে পেঁচিয়ে বাঁধা হচ্ছে। ভাগ্যিস পেন্সিলটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল! নইলে দম বন্ধ হয়েই মরতে হত!
কফিনটাও চুরি করবে ব্যাটারা। মুসার কানে ফিসফিস করল জামান। গাঢ় অন্ধকার ভেতরে। এখন কি করব আমরা?
চুপ করে শুয়ে থাকতে হবে, ফিসফিস করে জবাব দিল মুসা। এছাড়া আর কিছু করার নেই। কে বা কারা ওদেরকে পাঠিয়েছে, জানার সুযোগ পেয়েছি। কোথায় নিয়ে যায় ওরা কফিনটা জানতে পারব। নিয়ে যাক আগে। তারপর সুযোগ বুঝে বেরোনর চেষ্টা করব। হয়ত জায়গায় পৌঁছে দড়ির বাধন খুলে ফেলবে। কি, ভয় পাচ্ছ?
জামান বংশের জামান ভয় পায় না!
আমিও না, বলল মুসা। তবে অস্বস্তি বোধ করছি।
দুদিক থেকে তোলা হল কফিনটা, টের পেল ওরা।
আরিব্বাপরে! কি সাংঘাতিক ভারি! শোনা গেল ওয়েবের কণ্ঠ।
সীসা দিয়ে বানিয়েছে নাকি!…ধর, শক্ত করে ধর! ফেলে দিয়ে ভেঙ না। তাহলে একটা কানাকড়িও আদায় করতে পারব না।–
কফিনটা বয়ে নেয়া হচ্ছে, বুঝতে পারল মুসা আর জামান। ট্রাকের পেছনে তোলা হল, শব্দ শুনেই অনুমান করল।
ব্যাটা এসব জিনিস দিয়ে কি করবে? বলল ওয়েব।
কি করবে কে জানে! কতরকম পাগল আছে দুনিয়ায়! মরা লাশও কাজে লাগে। ওদের! হুহ! জাহান্নামে যাক ব্যাটারা। আমাদের টাকা পেলেই হল। এস, ওঠ। স্টার্ট দাও।
দড়াম করে বন্ধ হল কেবিনের দরজা। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। চলতে শুরু করল ট্রাক।
অবাক হয়ে ভাবছে মুসা আর জামান, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কফিনটা!
.
০৯.
বিশতম বার ক্যাসেটটা শোনা শেষ করলেন প্রফেসর উইলসন। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন প্রফেসর বেনজামিন, রবিন আর কিশোর।
কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি, অবশেষে বললেন উইলসন। কয়েকটা শব্দ বোঝা যাচ্ছে। ক্যাসেট প্লেয়ারের সুইচ অফ করে দিলেন। সিগারেটের বাক্স বের করে বাড়িয়ে ধরলেন প্রফেসর বেনজামিনের দিকে। রেকর্ড করলেন কি করে?
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলেন প্রফেসর। তার ওপর কি করে আনুবিস পড়তে যাচ্ছিল, একেবারে সেখান থেকে। মাঝপথে বাধা পড়ল। বাড়ির কোথাও একটা দরজার ঘণ্টা বাজল।
গ্যারেজের কাছে এসেছে কেউ, বললেন উইলসন। আসছি। আপনারা বসুন।
উইলসন বেরিয়ে যেতেই ছেলেদের দিকে তাকালেন প্রফেসর। বলেছিলাম না, কেউ যদি ওই ভাষা বোঝে তো জিমই বুঝবে। বাপের কাছে শিক্ষা পেয়েছে তো। তার বাপও প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় বিশেষজ্ঞ ছিল।
মমিটা তুলে আনার এক হপ্তা পর যিনি কায়রোর বাজারে খুন হয়েছিলেন? বলল রবিন।
হ্যাঁ, হাত তুললেন প্রফেসর। না না, আবার ওই অভিশাপের কথা তুল না। ওটা নিছকই দুর্ঘটনা। দস্যুতস্করের অভাব নেই ওখানে। হয়ত টাকা-পয়সা পাওয়ার লোভেই খুন করেছে বেচারাকে।
ফিরে এলেন উইলসন। হাতে ট্রে, চারটে গ্লাসে কমলার রস, আসতে দেরি হয়েছে বোধহয় এজন্যেই। সমাজসেবা, হুহ! চাদার জন্যে এসেছিল কয়েকজন। কি আনন্দ পায় ওসব করে!..যাকগে, নিন, ট্রে-টা বাড়িয়ে ধরল প্রফেসরের দিকে।
একটা করে গ্লাস তুলে নিল সবাই।
গ্লাস হাতেই গিয়ে শেলফ থেকে মোটা একটা বই বের করে আনলেন উইলসন। বিরল একটা ডিকশনারি। বাবা জোগাড় করেছিল কোত্থেকে জানি! এখন কাজে লাগবে। বইটা টেবিলে রেখে আবার ক্যাসেট প্লেয়ার চালু করে দিলেন। তিনি। তিন ঢোকে কমলার রস শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন, টেবিলে। কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। মনোযোগ দিয়ে ক্যাসেট শুনছেন, আর কি সব লিখে নিচ্ছেন। কাগজে। মাঝে মাঝে ডিকশনারি খুলে মিলিয়ে নিচ্ছেন।
শেষ হল ক্যাসেট। কলম রেখে উঠে দাঁড়ালেন উইলসন। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের তাজা বাতাস টানলেন। ফিরে দাঁড়ালেন তারপর। প্রফেসর, অনেক প্রাচীন আরবী শব্দ রেকর্ড করেছেন। আধুনিক আরবী উচ্চারণের সঙ্গে অনেক তফাৎ। মানে উদ্ধার করতে পেরেছি। কিন্তু কিন্তু…
বলে যাও, ভরসা দিলেন প্রফেসর। আমি শুনব।
প্রফেসর…ইয়ে, মানে, দ্বিধা যাচ্ছে না উইলসনের। অর্থ যা বুঝলাম, নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না! একটা মেসেজ। বলেছে: দেশ থেকে অনেক দূরে রয়েছে। রা-অরকন। ওর শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। যারা তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তাদের ওপর অভিশাপ নামুক। যতক্ষণ রা-অরকনের শান্তি না আসছে, তাদের অশান্তি হতেই থাকুক। এরপরও সতর্ক না হলে ভয়ঙ্কর মৃত্যু টেনে নিক তাদের।
মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা একটা শিহরণ খেলে গেল রবিনের। এমনকি কিশোরের চেহারা থেকেও রক্ত সরে গেছে।
অস্বস্তি বোধ করছেন প্রফেসর বেনজামিন, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। জিম, ওই অভিশাপের ভয় আমি করি না, বিশ্বাস করি না, সামনের দিকে চিবুক বাড়িয়ে দিলেন তিনি। করবও না।
ঠিকই, স্বীকার করলেন উইলসন, ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক।
পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক, ঘোষণা করলেন যেন বেনজামিন।
তবু ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই, বলল উইলসন। মমিটা কি কদিনের জন্যে আমার এখানে নিয়ে আসবেন? দেখি, আমার সঙ্গে কথা বলে কিনা ওটা। যদি নতুন কিছু বলে…
যা খুশি বলুক গে, কিছু এসে যায় না আমার, থ্যাঙ্ক ইউ। আমি এখনও বিশ্বাস করি না মমিটা কথা বলেছে। নিশ্চয় কোন রহস্য রয়েছে ভেতরে, রবিন আর কিশোরকে দেখিয়ে বললেন প্রফেসর, এদেরকে ডেকে এনেছি আমাকে সাহায্য করার জন্যে। রহস্যটার সমাধান আমরা করবই।
শ্রাগ করলেন উইলসন। মমি তার এখানে নিয়ে আসার জন্যে আর চাপাচাপি করলেন না।
ভাষাবিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল তিনজনে।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল গ্যারেজের পাশে। ব্রিজ পেরিয়ে এসে নামল রাস্তায়। ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে পাহাড়ী পথ। শখানেক গজ নিচেই পার্কিং লট, ওখানেই ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার।
গাড়িতে উঠে বসল তিনজনে। প্রফেসরের বাড়ির দিকে চলল ট্যাক্সি।
বলেছিলাম না, পেছনের সিটে হেলান দিয়ে বসে বললেন প্রফেসর, কেউ যদি পারে, জিমই পারবে। কিশোর, রা-অরকনের ফিসফিসানির ব্যাপারে আর কোন নতুন থিয়োরী এসেছে মাথায়?
না, স্যার, চিন্তিত কিশোর। ব্যাপারটা সত্যিই বড় বেশি রহস্যময়।
মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত! বিড়বিড় করল রবিন।
পৌঁছে গেল গাড়ি। নেমে পড়ল তিনজনে।
সদর দরজায় দাঁড়িয়ে বেল বাজালেন প্রফেসর।
সাড়া নেই।
আবার বাজালেন। তবু সাড়া নেই। চেঁচিয়ে ডাকলেন, হুপার! হুপার! কোথায় গেলে!
নীরবতা। সাড়া দিল না হুপার।
আশ্চর্য! আপনমনেই বললেন প্রফেসর। গেল কোথায়!
চলুন, জাদুঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ি, পরামর্শ দিল কিশোর। খুঁজে দেখলেই হবে, কোথায় কি করছে।
জাদুঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন। কফিনটা কোথায়, প্রফেসর!
কফিনের জায়গাটা শূন্য। মেঝেতে হালকা ধুলো জমেছে, তাতে কিছু আঁচড় আর ভারি জিনিস টানাহেঁচড়ার দাগ। দলা পাকানো নীল একটা রুমাল পড়ে আছে। এক জায়গায়।
রা-অরকনকে চুরি করেছে কেউ! বলে উঠলেন প্রফেসর। কিন্তু কে করল? জিজ্ঞেস করল? জিনিসটার কোন দামই নেই। মানে, কমার্শিয়াল কোন দাম নেই। বিক্রি করা যাবে না। কুটি করলেন হঠাৎ। বুঝেছি! সেই অ্যারাবিয়ান! যাকে বের। করে দিয়েছিলাম। পুলিশকে ফোন করতে হচ্ছে। কিন্তু, দ্বিধা করছেন প্রফেসর। কিন্তু ওদেরকে ডেকে আনলে সব খুলে বলতে হবে। মমি কথা বলেছে, এটাও। জানাতে হবে। আগামী কালই বেরিয়ে যাবে খবরের কাগজে খবরটা। এবং আমার ক্যারিয়ার শেষ। নাহ, পুলিশ ডাকা যাচ্ছে না। ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। চিন্তিত। অসহায় হয়ে পড়েছেন যেন। কি করি এখন? কি করি?
কোন পরামর্শ দিতে পারল না রবিন।
নীল রুমালটা তুলে নিয়েছে কিশোর। কফিনটা বয়ে নিতে অন্তত দুজন লোক দরকার। যদি, ওই জলিলই করে থাকে কাজটা, তার সঙ্গে আরও একজন রয়েছে। এই যে রুমালটা, কালিঝুলি দেখা যাচ্ছে। শ্রমিকের চিহ্ন। তাড়াহুড়োয় ফেলে গেছে হয়ত।
হাতের তালু দিয়ে কপাল ঘষছেন প্রফেসর। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন উদ্ভট! মমি কথা বলল, তারপর গেল গায়েব হয়ে… থমকে গেলেন তিনি। আরে হ্যাঁ, হুপারের কথাই তো ভুলে গেছি! ও গেল কোথায়? বদমাশরা তাকে মেরে ফেলল না তো! চল, চল, খুঁজে দেখি!
চোরগুলোর সঙ্গে হাত মেলায়নি তো? অনেক রহস্য কাহিনী পড়েছে রবিন,। যেগুলোতে বাড়ির চাকর-বাকর খানসামারাই চোর-ডাকাতের সহায়ক।
না, না, কি বল! জোরে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। দশ বছর ধরে কাজ করছে। সে আমার কাছে। চল, খুঁজে বের করতে হবে ওকে।
বাগানে বেরিয়ে এল ওরা। চোখে পড়ল তলোয়ারটা। নিচু হয়ে তুলে নিলেন। প্রফেসর। আমার সংগ্রহের জিনিস! নিশ্চয় এটা নিয়ে বাধা দিতে গিয়েছিল হুপার! বেচারাকে মেরেই ফেলল কি না কে জানে! আর পুলিশ না ডেকে পারা যাবে না!
ঘুরে দাঁড়াতে গেলেন প্রফেসর, এই সময় মৃদু একটা গোঙানি কানে এল। চত্বরের শেষ প্রান্তে একটা ঝোঁপের ভেতর থেকে এসেছে। কিশোরও শুনেছে। শব্দটা। সে-ই আগে ছুটে গেল ঝোঁপটার কাছে।
ঝোঁপের ভেতর পাওয়া গেল হুপারকে। চিত হয়ে পড়ে আছে ঘাসের ওপর। দুহাত আড়াআড়ি রাখা হয়েছে বুকে।
ধরাধরি করে চত্বরে নিয়ে আসা হল হুপারকে, শুইয়ে দেয়া হল ঘাসের ওপর-জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে যেখানে।
বেহুশ! খানসামার ওপর ঝুঁকে বসেছে প্রফেসর। জ্ঞান ফিরছে নাকি! হুপার, শুনতে পাচ্ছ? হুপার?
একবার কেঁপে উঠল হুপারের চোখের পাতা, তারপরই আবার স্থির হয়ে গেল।
আরে, দেখুন! ছায়ার দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। একটা বেড়াল। পুষি, এস, এস! হাত চেটে দিল। ওটাকে তুলে নিল রবিন!
দেখ দেখ! বেড়ালটাকে দেখছে রবিন। ওর চোখ দেখ! একটা নীল আরেকটা কমলা! জিন্দেগীতে এমন বিড়াল দেখিনি।
কি বলছ। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন। দেখি দেখি, দাও তো আমার হাতে! বিড়বিড় করলেন, চোখের রঙে বৈসাদৃশ্য!.
বেড়ালের চোখ দুটো দেখছেন প্রফেসর। আবিসিনিয়ান বেড়াল, চোখের রঙে বৈসাদৃশ্য! আপনমনেই বিড়বিড় করছেন। কি যে ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারছি না! পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত! রা-অরকনের সঙ্গে কবর দেয়া হয়েছিল তার প্রিয় বেড়ালটাকে। ওটাও ছিল আবিসিনিয়ান, দুই চোখের দুই রঙ। শরীরের রঙ পিঙ্গল, সামনের দুই পায়ের নিচের অংশ কালো। এটারও তাই!
তাজ্জব হয়ে বেড়ালটার কুচকুচে কালো দুই পায়ের দিকে চেয়ে আছে দুই কিশোর।
হুপারের হুশ ফেরানো দরকার, বললেন প্রফেসর। হয়ত ও কিছু বলতে পারবে। খানসামার একটা হাত তুলে নিয়ে তালুতে তালু ঘষতে লাগলেন জোরে জোরে। হুপার? হুপার? শুনতে পাচ্ছ? কথা বল!
খানিকক্ষণ ঘষাঘষি করার পর চোখ মেলল হুপার। চোখ প্রফেসরের মুখের। দিকে। কিন্তু মনিবকে দেখছে বলে মনে হয় না। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি!
হুপার, কি হয়েছিল? জানতে চাইলেন বিজ্ঞানী। রা-অরকনকে কে চুরি করল? সেই অ্যারাবিয়ানটা?
হুপার নীরব! কথা বলার কোন চেষ্টাই নেই।
একই প্রশ্ন আবার করলেন প্রফেসর।
আনুবিস! অনেক কষ্টে যেন উচ্চারণ করল হুপার। আতঙ্কিত। আনুবিস!
আনুবিস? আনুবিস, মানে শেয়াল-দেবতা চুরি করেছে মমিটা?।
আনুবিস! আবার একটা শব্দই উচ্চারণ করল হুপার। তারপর চোখ বুজল।
খানসামার কপালে হাত রাখলেন প্রফেসর। জ্বর। খুব বেশি। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। পুলিশকে ডাকছি না আপাতত। রহস্য আরও জটিল। হয়ে উঠেছে। রা-অরকনের মমি, তার প্রিয় বেড়াল, তারপর আনুবিস! নাহ, বড় বেশি গোলমাল হয়ে যাচ্ছে! আস্তে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। কিশোর, তোমাদের ট্যাক্সিটাই নিয়ে যাব। আমার গাড়ি আর বের করছি না। বেড়ালটা তোমাদের কাছেই থাক। হুপার ভাল হোক। ও কিছু বলতে পারলে, নতুনভাবে তদন্ত শুরু করবে। চল।
হুপারকে ছোট একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। হাসপাতালের মালিক প্রফেসরের বন্ধু। সঙ্গে সঙ্গে খানসামাকে ভর্তি করে নেয়া হল। কোনরকম অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন না প্রফেসর। _ প্রফেসরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সিতে চড়ল রবিন আর কিশোর। রকি বীচে ফিরে চলল। রবিনের কোলে বেড়ালটা, মৃদু ঘড়ঘড় করছে মাঝে মাঝেই। তবে নড়াচড়া করছে না, আরাম পেয়েছে।
কিশোর, এক সময় বলল রবিন। কি মনে হয় তোমার? রা-অরকন গায়েব। হবার সঙ্গে এই বেড়ালটার কোন সম্পর্ক আছে?
নিশ্চয়। কিন্তু কি সম্পর্ক, জানি না।
হতবুদ্ধি হয়ে গেছে কিশোর। তাকে এরকম হতে কখনও দেখেনি রবিন।
ওদিকে মুসা কি করল, কে জানে! বলল সে।
হেডকোয়ার্টারে গিয়ে না পেলে টেলিফোন করব ওর বাড়িতে, বলল কিশোর। ওখানে না থাকলে করব মিসেস চ্যানেলের বাড়িতে। তবে এতক্ষণ সান্তা মনিকায় থাকবে বলে মনে হয় না।
হেডকোয়ার্টারে ফিরে এল দুই গোয়েন্দা। বিকেলে যেখানে রেখে গিয়েছিল। মুসা তার সাইকেলটা, ওখানেই আছে এখনও। মেরিচাচীকে জিজ্ঞেস করে জানল। কিশোর, মুসা, ফেরেনি। সাইকেলটা রয়েছে, তার মানে বাড়িও ফিরে যায়নি। সান্তা মনিকায় টেলিফোন করল। মিসেস চ্যানেল জানালেন সন্ধ্যার আগেই তার ওখান থেকে বেরিয়ে গেছে মুসা। গেল কোথায়? রাশেদ চাচাকে জিজ্ঞেস করে জানল, সিনেমায় গেছে বোরিস আর রোভার। না, তাদের সঙ্গে মুসাকে দেখেননি তিনি। তাহলে?
কোথায় যেতে পারে? উৎকণ্ঠা ফুটেছে রবিনের চেহারায়।
কি জানি! কিশোরও উদ্বিগ্ন। সান্তা মনিকা থেকে প্রফেসরের বাড়িতে যায়নি তো? বোরিস ফিরলেই জানা যেত। শো ভাঙতে দেরি আছে এখনও, বলল রবিন। চল, ততক্ষণ অপেক্ষা করি।