০৫.
শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
দুধারের দৃশ্য বেশ লাগছে ছেলেদের কাছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়, সব কিছুই নতুন। এখানে ঠিক তার উল্টো। সব কিছুই অবিশ্বাস্য রকমের পুরানো। পাথরের তৈরি বাড়িঘর, কোথাও কোথাও হলুদ ইটের। বেশির ভাগ ছাত লাল টালির। প্রতিটি ব্লকের পর একটা করে ফোয়ারা। ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক। সেইন্ট ডোমিনিকসের সামনের আঙিনাতেই রয়েছে কয়েকশো।
পুরানো একটা ছাতখোলা বেড়ানর-গাড়ি। ড্রাইভার এক তরুণ, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। চমৎকার ইংরেজি বলে। নাম, মরিডো। গাড়িতে ওঠার পর পরই নিচু গলায় জানিয়েছে, তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারে তিন কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রিও তাকে খুবই বিশ্বাস করেন। ফিটফাট পোশাক পরনে।
ডেনজোর বাইরে পাহাড়ের কাছে চলে এল-গাড়ি। পাহাড়ী পথ ধরে উঠে গেল ওপরে। গাড়ি থেকে নেমে চূড়ায় গিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। ওখান থেকে ডেনজো নদী আর শহরের বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল আবার। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আমাদেরকে অনুসরণ করা হচ্ছে, নিচু গলায় বলল মরিডো। প্যালেস থেকে রেরোনর পর পরই পিছু নিয়েছে। পার্কে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের। ঘোরাফেরা করবেন, বিভিন্ন জিনিস দেখবেন। অনেক মজার জিনিস আছে। সাবধান, পেছনে ফিরে তাকাবেন না একবারও। ওদেরকে দেখে ফেলেছি, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেবেন না।
খুব কঠিন নির্দেশ! অনুসরণ করছে জানা সত্ত্বেও পেছনে ফিরে চাইতে পারবে না। কিন্তু কারা অনুসরণ করছে? কেন?
কি ঘটছে, জানতে পারলে ভাল হত, পথের দিকে চেয়ে আছে। মুসা। কেন আমাদেরকে অনুসরণ করছে? আমরা তো তেমন কিছুই। জানি না!
কেউ একজন হয়ত ভাবছে, জানি, বলল কিশোর।
এবং জানলে সত্যি ভাল হত, যোগ করল রবিন।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল মরিডো। বেশ বড় একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে ওরা। প্রচুর গাছপালা। লোকের ভিড়। বাজনার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
এটা আমাদের প্রধান পার্ক, গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল। মরিডো। ধীরে ধীরে হেঁটে মাঝখানে চলে যান। পেরিয়ে যাবেন ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড। দড়াবাজ আর ভাঁড়দের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন। ছবি তুলবেন। তারপর গিয়ে দাঁড়াবেন বেলুন বিক্রি করছে যে মেয়েটা, তার কাছে। ছবি তোলার প্রস্তাব দেবেন। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। আবার বলছি পেছনে তাকাবেন না। কোনরকম দুশ্চিন্তা করবেন না, অন্তত এখনও না।
এখনও না! মরিডোর কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। গাছপালার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। জোরাল হচ্ছে। বাজনার শব্দ। পেছনে ফিরে তাকাব না। কত আর সামনে তাকিয়ে থাকা যায়!
দিমিত্রিকে কি করে সাহায্য করতে পারি আমরা? নিচু গলায় বলল রবিন। অন্ধকারে হাতড়ে মরছি! শূন্য, কিছুই ঠেকছে না হাতে!
অপেক্ষা করতে হবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আমার ধারণা, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছি কি না, দেখার জন্যেই অনুসরণ করা হচ্ছে।
আরও খানিকটা হেঁটে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেক লোক। খুদে একটা ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে আটজন বাদক, হাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র। পরনে বিচিত্র উজ্জ্বল রঙের পোশাক। বাদকদলের নেতা মরিডোর। বয়েসী এক তরুণ। একটা নরম সুর বাজিয়ে থামল ওরা। প্রচুর। হাততালি আর বাহবা পেল। মাথা নুইয়ে শ্রোতাদের অভিবাদন জানিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা সুর ধরল। চড়া, দ্রুত লয়।
ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডের পাশ কাটিয়ে চলে এল তিন গোয়েন্দা। সামনে পেছনে অনেক, লোক। একবার পেছনে তাকিয়ে ফেলল মুসা। কিন্তু কে অনুসরণ করছে, আদৌ করছে কিনা, বুঝতে পারল না।
শান-বাঁধানো একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালা ওরা ॥ ট্রাম্পোনি বসানো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের বিপজ্জনক উপভোগ্য খেলা দেখাচ্ছে দুজন দড়াবাজ। মাটিতে ডিগবাজি খাচ্ছে, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে লোক হাসাচ্ছে দুজন ভাড়। মাঝে মধ্যেই এগিয়ে এসে একটা ভাঙা পুরানো। ছোট কুড়ি বাড়িয়ে ধরছে সামনে। চেহারাটাকে হাস্যকর করে তুলে পয়সা চাইছে! কেউ মানা করছে না। হেসে দুএকটা মুদ্রা ফেলে দিচ্ছে ঝুড়িতে।
সার্কাসের জায়গার পরেই মেয়েটাকে দেখতে পেল ওরা ॥ সুন্দর দেশীয় পোশাক পরনে। হাতে সুতোয় বাধা এক গুচ্ছ বড় বড় বেলুন। সুললিত গলায় গান ধরেছে ইংরেজিতে কথাগুলো বড় সুন্দর। একটা করে বেলুন কিনে নেবার আমন্ত্রণ। কোন একটা ইচ্ছে মলে নিয়ে সেই বেলুন ছেড়ে দিতে হবে। ইচ্ছেটা আকাশের দূরতম প্রান্তে নিয়ে গিয়ে তারার দেশের কোন মনের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে বেলুন।
অনেকেই কিনছে। ছেড়ে দিচ্ছে সুতো, শাঁ করে শুন্যে উঠে পড়ছে গ্যাস ভরা বেলুন, যার যার ইচ্ছে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে নীল আকাশে। ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। তারপর টুক করে মিলিয়ে যাচ্ছে এক সময়।
ভাঁড়ের ছবি তোলো, মুসা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। দড়াবাজদের ছবি তুলছি আমি। রবিন, চারদিকে চোখ রাখী ॥ দেখ, আমাদেরকে লক্ষ্য করছে কিনা সন্দেহজনক কেউ।
ঠিক আছে, বলে ঘুরল মুসা। হাতের তালুতে মাথা রেখে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন দুই ভাড়। সেদিকে এগিয়ে গেল।
রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার খাপ খুলল কিশোর ॥ পরক্ষণেই বিরক্তিতে ছেয়ে গেল চোখ মুখ। ভাল অভিনেতা সে। দেখলে যে কেউ ধরে নেবে সত্যিই বুঝি ক্যামেরা খারাপ হয়ে গেছে তা বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগল গোয়েন্দাপ্রধান।
রেডিওর বোতাম টিপে দিল কিশোর। নিচু গলায় বলল, কাস্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
স্পষ্ট, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল। ভলিউম কমিয়ে ব্রেখেছে কিশোর, কাজেই একেবারে কাছাকাছি না থাকলে কেউই শুনতে পাবে না কথা। কি অবস্থা?
ফেউ লেগেছে পেছনে, বলল কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রি সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছে। চুরি গেছে জাতীয় রূপালী মাকড়সা। নকল একটা ফেলে রেখে গেছে চোর।
তাই! অবাক মনে হল বব ব্রাউনের গলা। যা ভেবেছি, পরিস্থিতি তারচেয়ে খারাপ! সাহায্য করবে ওকে?
কি করে?
জানি না, স্বীকার করল বব। চোখ খোলা রাখ। কিছু না কিছু নজরে পড়বেই।ভেবেচিন্তে এগোতে পারবে তখন। আর কিছু
পার্কে রয়েছি। কারা অনুসরণ করছে জানি না।
জানার চেষ্টা কর। পরে জানাবে আমাকে ছেড়ে দাও। বেশিক্ষণ কথা বললে সন্দেহ করে বসতে পারে।
কেটে গেল যোগাযোগ।
ক্যামেরা ঠিক হয়ে গেছে যেন কিশোরের ॥ চোখের সামনে তুলে ধরল। ছবি তুলে গেলা একের পর এক
চারদিকে নজর ফেলল রবিন। অনেকেই চাইছে ওদের দিকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। কাউকেই সন্দেহ করতে পারল না সে। একজন ভাড় এসে দাঁড়ালা সামনে। ঝুড়ি বাড়িয়ে দিল। পকেট থেকে একটা মুদ্রা বের করে তাতে ফেলে দিল রবিন।
নতুন একটা আকর্ষণীয় খেলা শুরু করল দুই ভাড়। অন্যদিক থেকে সরে এসে তাদেরকে ঘিরে স্বরণ দর্শকরা। মেয়েটার কাছে একজনও নেই এখন।
এবার ওর ছবি তুলব, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। মুসাকে ডাকল ॥ তিনজনে এঙ্গিয়ে গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটার সামনে।
ছবি তোলার প্রস্তাব দিল কিশোর। মাথা কাত করল মেয়েটা। ছবি উঠে গেল কিশোরের ক্যামেরায়।
হাসল মেটো। গুচ্ছ থেকে একটা বেলুন বের করে বাড়িয়ে ধরল। একটা বেলুন কিনুন। মনে কোন ইচ্ছে নিয়ে ছেড়ে দিন আকাশে। ঠিক পৌঁছে দেবে মেঘের দেশের কারও কাছে।
পকেট থেকে একটা আমেরিকান ডলার বের করল মুসা। দিল। মেয়েটাকে। তিনজনের হাতেই একটা করে বেলুন ধরিয়ে দিল মেয়েটা। ডলারটা ছোট থলেতে রেখে খুচরো বের করল। বেলুনের দাম রেখে বাকি মুদ্রাগুলো এক এক করে কেলাতে লাগল মুসার হাতে। যেন গুনে গুনে দিচ্ছে, এমনি ভাবভঙ্গি। নিচু গলা বলল, চর লেগেছে। একজন পুরুষ একজন মহিলা। লোক সুবিধের মনে হচ্ছে না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারে হয়ত। একটা টেবিলে বসে পড়ন আইসক্রীম কিংবা অন্য কিছু খান। কথা বলার সুযোগ দিন ওদের।
পয়সা দিয়ে পিছিয়ে গেল মেটো।
দিমিত্রিকে সাহায্য করতে চাই, তিনজনের মনেই এক ইচ্ছে। সুতো ছেড়ে দিল। শাঁ করে শূন্যে উঠে পড়ল বেলুন। লাল, হলুদ, সবুজ। অনেক ওপরে তিনটি কালো বিন্দুতে পরিণত হল। মিলিয়ে গেল পরক্ষণেই।
খানিক দূরেই ঘাসে ঢাকা একটা খোলা জায়গা! তাতে টেবিল চেয়ার পাতা। মোটা কাপড়ের টেবিলক্লথ, লাল-সাদা চেক। একটা টেবিল বেছে নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল তিন কিশোর। এগিয়ে এল একজন ওয়েটার। মোটা গোঁফ। আইসক্রীম হট-চকোলেট স্যাণ্ডউইচ?
অর্ডার দিল কিশোর। চলে গেল ওয়েটার।
চারপাশে তাকাল তিন গোয়েন্দা। ঠিক পেছনেই ওদেরকে দেখতে পেল রবিন। সেই আমেরিকান দম্পতি। সকালে প্রিন্স পলের ছবি দেখার সময় যারা পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। হুমম! তাহলে এরাই!
ধীরে সুস্থে এগিয়ে এল দম্পতি। একটা টেবিল পছন্দ করল। তিন গোয়েন্দার ঠিক পাশেরটা। কফির অর্ডার দিয়ে হেলান দিল চেয়ারে। তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরে হাসল।
তোমরা আমেরিকান, না হেসে জিজ্ঞেস করল মহিলা। স্বর কেমন খসখসে।
হ্যাঁ, ম্যাডাম্, জবাব দিল কিশোর। আপনারাও আমেরিকান
নিশ্চয়। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছি। তোমাদের মতই।
স্থির হয়ে গেল কিশোর। ওরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছে, কি করে জানল দম্পতি।
মহিলা ভুল করে বসেছে, বুঝে গেল পুরুষটি ধামাচাপা দেবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ক্যালিফোর্নিয়া থেকেই তো এসেছ তোমরা, না-কি? ক্যালিফোনিয়ান ছেলেদের মতই কাপড়-চোপড় পরেছ।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। ক্যালিফোর্নিয়া থেকেই। গতরাতে এসেছি।
সকালে মিউজিয়মে দেখেছি তোমাদের, বলল মহিলা। আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে ছিল, ও প্রিন্স দিমিত্রি না?
মাথা ঝোঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। বন্ধুদের দিকে ফিরল। আইসক্রীম আসতে দেরি আছে। চল, হাত মুখ ধুয়ে আসি। ধুলোবালি লেগেছে। ওই যে, ওপাশে ওয়াশরুম লেখা রয়েছে। চল।
পাশের টেবিলের দম্পতির দিকে তাকাল কিশোর। আমরা হাতমুখ ধুতে যাচ্ছি। ক্যামেরাগুলো রইল টেবিলে। একটু দেখবেন? এই যাব আর আসব আমরা।
নিশ্চয় খোকা, হাসল লোকটা। নিশ্চিন্তে যাও। ক্যামেরা চুরি যাবে না।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে সার্কাসের অন্য পাশে চলে এল গোয়েন্দাপ্রধান। খানিক দূরেই ওয়াশরুম!
কি ব্যাপার? পাশে হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে বলল মুসা। ক্যামেরাগুলো ফেলে এলে কেন?
শশশ। হুশিয়ার করল কিশোর। এখন কোন কথা নয়।
আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাছাকাছি কেউ নেই। অনেক কমে এসেছে হাতের বেলুনের সংখ্যা। তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিচু গলায় বলল কিশোর, দম্পতির দিকে চোখ রাখুন। ক্যামেরাগুলো ধরলেই আমাদের জানাবেন। মিনিটখানেক পরেই আসছি।
চুপচাপ রইল মেয়েটা, যেন শোনেইনি কথাগুলো।
কয়েকটা বড় বড় গাছের তলায় একটা পাথরের বাড়ি, ওয়াশরুম। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
উদ্দেশ্যটা কি তোমার? ঢুকেই জিজ্ঞেস করল মুসা।
এগিয়ে গিয়ে একটা বেসিনের ওপরের কল খুলে দিল কিশোর। নিচু গলায় বলল, ওরা দুজন কথা বলবেই। বেফাঁস কিছু বলেও ফেলতে পারে।
তাতে আমাদের কি লাভ? ফস করে বলল রবিন। কলের তলায়। হাত পেতে দিয়েছে।
টেপ-রেকর্ডারটা চালু করে দিয়ে এসেছি, বলল কিশোর। ওদের কথাবার্তা টেপ হয়ে যাবে। আর কোন কথা নয় এখন। কাছাকাছি লোক আছে। কে যে কি, বলা যায় না!
নীরবে হাতমুখ ধোয়া সারল ওরা। বেরিয়ে এল বাইরে। ধীর পায়ে এগোল। মেয়েটার পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার তাকাল কিশোর। আধ ইঞ্চি মত মাথা নাড়ল মেয়েটা।
যেমন রেখে গিয়েছিল, তেমনি রয়েছে ক্যামেরা তিনটে। ছোঁয়নি কেউ। কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দম্পতি।
ক্যামেরার ধারেকাছেও আসেনি কেউ, হেসে বলল লোকটা। সৎলোকের দেশ। তোমাদের আইসক্রীম নিয়ে এসেছিল ওয়েটার, পরে আসতে বলে দিয়েছি। ওই যে, আসছে।
ট্রে-তে খাবার নিয়ে এসে দাঁড়াল ওয়েটার। নামিয়ে রাখল স্যাণ্ডউইচ, হট-চকোলেট আর আইসক্রীমের পাত্র।
দুপুর হয়ে এসেছে। একবারে লাঞ্চ সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল তিনজনে। আরও কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে খেতে শুরু করল।
আর কয়েক মিনিট পরেই খাওয়া শেষ হয়ে গেল দম্পতির। তিন গোয়েন্দাকে গুড বাই জানিয়ে উঠে চলে গেল।
আমাদের সঙ্গে বিশেষ কিছুই বলল না, বলল মুসা। নিশ্চয় মত বদলেছে।
ওরা নিজেরা নিজেরা কথা বলে থাকলেই আমি খুশি, বলল কিশোর। সবকটা টেবিল খালি। এখনও খাওয়ার জন্যে আসতে শুরু করেনি লোকে। নিজের ক্যামেরাটা টেনে নিল। নিচের দিকের একটা বোতাম টিপে রি-ওয়াইণ্ড করে নিল ক্যাসেটের ফিতে। ভলিউম কমিয়ে। রেখে প্লে বোতামটা টিপে দিল। প্রথমে ফিসফাস শব্দ, তারপরেই স্পষ্ট কথা। আমেরিকান লোকটার গলা।
উত্তেজিত হয়ে পড়ল রবিন। চাপা গলায় বলে উঠল, হয়েছে! কাজ হয়েছে…
শশশ! রবিনকে থামিয়ে দিল কিশোর। শুনি, কি বলে! খাওয়া বন্ধ কোরো না। ক্যামেরার দিকে তাকিও না।
আবার টেপ রি-ওয়াইও করে নিল কিশোর। প্রথম থেকে চালু করল। আরও কমিয়ে দিল ভলিউম। পাশের টেবিল থেকেও কেউ শুনতে পাবে না এখন।
নিজেদের মধ্যে কথা বলছে দম্পতি:
পুরুষ: খামোকাই পাঠিয়েছে আমাদেরকে, টেরা। ওই ছেলে তিনটে গেয়েন্দা হলে আমার নাম পাল্টে রাখব।
মহিলা: ভুল খুব একটা করে না টেরা। ও বলেছে, ছেলে তিনটে খুবই চালাক-চতুর। তিন গোয়েন্দা বলে নিজেদেরকে।
পুরুষ: ওই বলা পর্যন্তই। গোয়েন্দাগিরির গ-ও জানে না ওরা। বড় মাথা যে ছেলেটার, ওটা তো একটা বুদ্ধ। চেহারা দেখেই বোঝা যায়। হাবাগোবা, একটা গরু!
চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। মুখ টিপে হাসল। গ্রাহ্য করল না কিশোর। কোনরকম ভাবান্তর নেই চেহারায়। ওকে বোকা ভাবুক, এইই চেয়েছিল।
মহিলা: টেরার ধারণা, ওরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সি.আই. এ.-র হয়ে কাজ করছে ছেলে তিনটে।
পুরুষ: আরে দুত্তোর! সারাক্ষণই তো পেছনে লেগেছিলাম। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখেছ? কথা বলেছে? বড়লোকের বাচ্চা। স্রেফ টাকা ওড়াতে এসেছে এখানে।
মহিলা: কোন কথাই তো বললে না ওদের সঙ্গে। ডিউক রোজারের কথা তোলা উচিত ছিল, নয় কি?
পুরুষ: মোটেই না। ভুল করেছে টেরা। ওরা গোয়েন্দা হতেই পারে না।
মহিলা: আচ্ছা, ডিউক রোজারের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলেছে নাকি টেরা? আমার সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। তুমি তো অনেকক্ষণ ছিলে? কিছু বলেছে?
সতর্ক হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। কান খাড়া করল।
পুরুষ: বলেছে। দিমিত্রিকে সিংহাসনে বসতে দেবে না রোজার। সরিয়ে দেবে কোনভাবে। নিজে স্থায়ী রিজেন্ট হয়ে বসবে। তখন আমাদের আর ব্রায়ানের দলই হবে দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা।
মহিলা: গলা নামাও! কেউ শুনে ফেলবে!
পুরুষ: কাছেপিঠে কেউ নেই, কে শুনবে? রিলটা, কি সাংঘাতিক ব্যাপার হবে ভেবে দেখেছ! এমনি একটা কিছুরই স্বপ্ন দেখছিলাম এতদিন। ডিউক রোজার একবার ক্ষমতায় আসতে পারলেই আর আমাদের পায় কে? ছোট হোক, কিন্তু একটা দেশের মালিক হয়ে যাব, ভাবতে পার!
মহিলা: মন্টি কার্লোর মতই আরেকটা কিছু গড়ে তুলব আমরা!
পুরুষ: তার চেয়ে ভাল ব্যাংকিং সুবিধে দেব লোককে। যত খুশি কালো টাকা এনে জমাক, কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। তাদের দেশের সরকারের কাছ থেকে পুরোপুরি গোপন রাখা হবে কথাটা। বড় বড় অপরাধীরা এসে এখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে। ওদেরকে বরং ঠাই দেব আমরা। অবশ্যই অনেক টাকার বিনিময়ে। যে-কোন দেশ থেকে যা খুশি করে আসুক যে-কোন লোক, এখানে এসে পড়তে পারলে সে নিরাপদ। ধনী অপরাধীদের স্বর্গ হয়ে উঠবে ভ্যারানিয়া।
মহিলা: শুনতে তো ভালই লাগছে। কিন্তু যদি ডিউক রোজার রাজি না হয় এসব করতে?
পুরুষ: ধ্বংস করে দেব। ক্ষমতায় থাকতে হলে আমাদের কথা মানতেই হবে। রিটা, রসাল একটা আপেলে পরিণত হবে এই ভ্যারানিয়া। আমরা সবাই খুঁটে খাব।
মহিলা: চুপ! আসছে ওরা…
চুপ হয়ে গেল স্পীকার। বোতাম টিপে সেট অফ করে দিল কিশোর।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। বব ব্রাউন যা অনুমান করেছে, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা! অপরাধীদের স্বর্গ!
তাকে এখুনি জানানো দরকার! বলে উঠল রবিন।
হ্যাঁ, ধীরে ধীরে মাখা ঝোকাল কিশোর। পুরো টেপটাই শোনানো দরকার তাকে। তবে এখন নয়। তাতে অনেক সময় লাগবে। সন্দেহ করে বসতে পারে কেউ। মূল ব্যাপারটা শুধু জানানো যায় এখন।
ক্যামেরা তুলে নিল কিশোর। ফিল্ম বদলাচ্ছে যেন, এমনি ভাবসাব। টিপে দিল রেডিওর বোতাম।
ফার্স্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
পাচ্ছি, বলল বব ব্রাউন। নতুন কিছু?
টেপে কি কি শুনেছে, সংক্ষেপে জানাল কিশোর।
খুব খারাপ! বলল বব। মহিলা আর লোকটার চেহারা কেমন?
বর্ণনা দিল কিশোর।
মনে হচ্ছে, পিটার জোনস আর তার স্ত্রী। জুয়াড়ী। নেভাডায় বাস। ভয়ানক এক অপরাধী সংস্থার সদস্য। আর যে দুজন লোকের কথা বলল, নিশ্চয় আলবার্ট ট্যাঙ্গোরা, ওরফে টেরা, এবং ব্রায়ান বেরেট। সাংঘাতিক দুই খুনে। ওই সংস্থার সদস্য। যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি মারাত্মক ষড়যন্ত্র!
আমাদের এখন কি করণীয়? জানতে চাইল কিশোর।
প্রথম সুযোগেই হুঁশিয়ার করে দেবে প্রিন্স দিমিত্রিকে। সব কথা জানাবে। আগামীকাল সকালে চলে আসবে আমেরিকান এমব্যাসিতে। প্যালেসে থাকা এখন নিরাপদ নয় তোমাদের জন্যে। দিমিত্রিকে সাহায্য করতে একপায়ে খাড়া আছি আমরা, তবে আমাদের সাহায্য চাইতে হবে তাকে। গায়ে পড়ে কিছু করতে যাব না। থামল বব। তারপর বলল, অনেক বেশি খবর জোগাড় করে ফেলেছ তোমরা। এতটা আশা করিনি। তবে, এখন থেকে খুব সাবধান! সব সময় সতর্ক থাকবে! ওভার অ্যাণ্ড আউট!
.
০৬.
সারাটা বিকেল শহর আর তার আশপাশের মনোরম দৃশ্য দেখে কাটাল তিন, গোয়েন্দা। প্রাচীন কিছু দোকানপাট দেখল, একটা মিউজিয়মে দেখল পাঁচ-ছশো বছর আগের অনেক ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। একটা প্রমোদতরীতে করে ডেনজো নদীতে কাটিয়ে এল কিছুক্ষণ। চলে গিয়েছিল নদীর একেবারে উৎসের কাছাকাছি।
গাড়িতে চড়ার খানিক পরেই মরিডো জানিয়েছে, আবার চর লেগেছে পেছনে। তবে এবার আর আমেরিকান দম্পতি নয়। ভ্যারানিয়ান সিক্রেট সার্ভিস, ডিউক রোজার বুরবনের নিজের পছন্দ করা লোক।
হয়ত মেহমান বলেই নজর রাখছে, বলেছে মুসা।
যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার! মুখ কালো করে বলেছে মরিডো। আপনাদের প্রতি ওদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। কেন, জানতে পারলে ভাল হত!
তিন গোয়েন্দাও ভাবছে, জানতে পারলে ভাল হত। সিক্রেট সার্ভিক্স কেন আগ্রহ দেখাবে তাদের প্রতি? এখনও তেমন কিছুই করেনি ওরা। প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্য করছে, এটা ডিউক রোজারের জানার কথা নয়। তাহলে?
রাস্তার মোড়ে মোড়ে গায়কদের ছোট ছোট দল দেখা গেল। সবার হাতে একটা না একটা বাদ্যযন্ত্র আছেই। বাজিয়ে গান গেয়ে পথচারীদের মনোরঞ্জন করছে।
মিনস্ট্রেলস, মরিডো জানাল। তিনশো বছর আগে যে পরিবারটা প্রিন্স পলকে লুকিয়ে রেখেছিল, তাদেরই বংশধর। আমিও মিনস্ট্রেলদের ছেলে। বাবা ছিল প্রধানমন্ত্রী, তাকে বের করে দিয়েছে ডিউক রোজার। আমাদেরকে, মানে মিনস্ট্রেলদেরকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেন প্রিন্স দিমিত্রি। সেই প্রিন্স পলের আমল থেকেই আমাদেরকে কোনরকম ট্যাক্স দিতে হয় না। ডিউক রোজার আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা দুচোখে দেখতে পারে না আমাদের। আমরা সব মিনস্ট্রেলরা মিলে একটা গোপন দল করেছি। নাম, মিনস্ট্রেল পার্টি। অনেক ভক্ত জুটেছে আমাদের। দেশের লোক দেখতে পারে না রোজারকে।
মিনস্ট্রেলদের প্রতিটি দলের সামনে গতি কমাচ্ছে মরিডো। তাকাচ্ছে আগ্রহী চোখে। দলের কেউ একজন সামান্য একটু মাথা ঝোকালেই আবার ছুটছে সামনে।
ওদেরকে চোখে চোখে রাখছি আমরা, বলল মরিডো। আপনাদের ওপরও সারাক্ষণ চোখ রয়েছে আমাদের। প্যালেসে আছে। আমাদের লোক, এমনকি রয়্যাল গার্ডেও আছে। অনেক কিছুই জেনে গেছি আমরা। কিন্তু এই একটা ব্যাপার জানতে পারছি না, আপনাদের ওপর রোজারের এত আগ্রহ কেন! সাংঘাতিক কোন প্ল্যান নিশ্চয় করেছে ব্যাটা!
দুপাশে নতুন নতুন দৃশ্য। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের জন্যে সিক্রেট সার্ভিসের কথা ভুলে গেল ছেলেরা।
আরেকটা পার্কে বিশাল এক নাগরদোলায় চেপে কিছুক্ষণ দোল খেল তিন কিশোর। তারপর রাতের খাওয়া সেরে নিল এক রেস্টুরেন্টে। ডেনজো নদীর মাছ, সুস্বাদু। রান্নাও হয়েছে খুব ভাল।
ক্লান্ত হয়ে প্যালেসে ফিরে এল ওরা। তবে মন আনন্দে ভরা। একটা খুব সফল দিন কাটিয়ে এসেছে।
ওদেরকে অভ্যর্থনা করে গাড়ি থেকে নামাল রয়্যাল চেম্বারলেন। এখন আরেকজন। ডিউটি বদলেছে। ছোট্টখাট্ট একজন তোক। টকটকে লাল আলখেল্লা পরনে।
গুড ইভনিং, ইয়ং জেন্টেলম্যান, বলল চেম্বারলেন। আজ রাতে দেখা করতে পারবেন না প্রিন্স দিমিত্রি। দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। কাল সকালে নাস্তার সময় দেখা হবে। চলুন, আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিই। নইলে পথ চিনে যেতে পারবেন না।
অসংখ্য সিঁড়ি, করিডর, হলঘর পেরিয়ে এল ওরা চেম্বারলেনের পিছু পিছু। প্রতিটি সিঁড়ির গোড়ায় করিডরের প্রান্তে প্রহরী। অবাকই হল ওরা। সকালে, কিংবা গতরাতে এত কড়াকড়ি দেখেনি। তিনতলার ঘরে পৌঁছে দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেল চেম্বারলেন। যেন জরুরি কোন কাজ ফেলে এসেছে।
ভারি ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিল কিশোর। ঘরের ভেতরে তাকাল। গোছগাছ সাফসুতরো করা হয়েছে। বিছানায় নতুন চাদর। তবে সুটকেসগুলো যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল, সেখানেই রয়েছে। মাকড়সার জালটাও রয়েছে আগের মতই। ওটার ধারেকাছেও যায়নি কেউ। সেদিকে এগোল, সে। সুতো বেয়ে নেমে গেল বড় একটা মাকড়সা, কালোর ওপর সোনালি ছোপ। তক্তা আর মেঝের মাঝখানের ফাঁকে গিয়ে ঢুকে পড়ল সুড়ৎ করে। মাথা বের করে দিল পরমুহূর্তেই।
হাসল রবিন। সকালেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। মাকড়সার জাল আর ছিঁড়তে যাবে না ভ্যারানিয়ায় থাকতে।
মনে হচ্ছে, জিনিসপত্র কেউ হাতায়নি, বলল কিশোর। বব ব্রাউনের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। নতুন কোন নির্দেশ দিতে– পারে। মুসা, দরজার তালা আটকে দাও।
তালা আটকে দিল মুসা।
খাপ থেকে ক্যামেরা খুলল কিশোর। বোতাম টিপে দিল। ফাস্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
স্পষ্ট, ভেসে এল বব ব্রাউনের গলা। নতুন কিছু
তেমন কিছু না, জানাল কিশোর। সারা বিকেলই গাড়িতে করে ঘুরেছি। শহর দেখেছি। নতুন চর লেগেছিল পেছনে। ডিউক রোজারের লোক, সিক্রেট সার্ভিস।
দিমিত্রির সঙ্গে কথা বলেছ? কণ্ঠ শুনে মনে হল ভাবনায় পড়ে গেছে। খবরটা কিভাবে নিয়েছে সে?
দেখা হয়নি। চেম্বারলেন জানিয়েছে, সকালের আগে দেখা হবে না। প্রিন্স খুব ব্যস্ত।
হুমম! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বব, তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আটকে ফেলেনি তো! ওর সঙ্গে দেখা করা খুবই জরুরি। সকালে যেভাবেই হোক, দেখা কোরো। হ্যাঁ, এক কাজ কর, ক্যামেরা থেকে টেপটা বের করে নিয়ে পকেটে রেখে দাও। আগামীকাল এমব্যাসিতে নিয়ে আসবে। এমন ভাব দেখাবে, যেন শহর দেখতে বেরোচ্ছ। গরম হয়ে উঠছে পরিস্থিতি! বুঝেছ?
বুঝেছি, বলল কিশোর। ওভার অ্যান্ড আউট।
ট্রান্সমিটারের সুইচ অফ করে দিল কিশোর। টেপ-রেকর্ডার থেকে বের করে নিল খুদে ক্যাসেটটা। বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে, এটা তোমার কাছে রাখ। কেউ যেন নিয়ে যেতে না পারে।
পারবে না, দৃঢ়কণ্ঠ মুসার। ভেতরের পকেটে রেখে দিল ক্যাসেটটা।
ড্রয়ার হাতাচ্ছে রবিন। রুমাল খুঁজছে। কোন্ ড্রয়ারটীয় রেখেছিল, ঠিক মনে করতে পারছে না। অবশেষে একটা ড্রয়ারে পাওয়া গেল ওটা। টান দিয়ে বের করে আনল রুমাল। ভাঁজের ভেতর থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল কিছু একটা, মৃদু টুং শব্দ হল। আশ্চর্য! কি ওটা! ঝুঁকে আলমারির তলায় তাকাল। চকচক করছে জিনিসটা। বের করে হাতে নিল।
একবার দেখেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, কিশোর! মুসা! দেখ দেখ!
অবাক হয়ে তাকাল দুজনেই।
মাকড়সা! ঢোক গিলল মুসা। ফেল, ফেল!
কোন ক্ষতি করে না, বলল কিশোর। প্রিন্স পলের মাকড়সা। রবিন, আস্তে নামিয়ে রাখ মেঝেতে।
চিনতে পারছ না! ভুরু কুঁচকে গেছে রবিনের। প্রিন্স পলের মাকড়সাই। রূপালী মাকড়সা!
রূপালী মাকড়সা! রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। কি বলছ।
এটা ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা, বলল রবিন। ভল্ট থেকে যেটা চুরি গিয়েছিল। আমি শিওর। এত কাছে থেকেও চিনতে পারনি?
প্রায় লাফ দিয়ে কাছে চলে এল কিশোর আর মুসা।
ছুঁয়ে দেখল কিশোর। ঠিকই বলেছ! এটা একটা মাস্টারপিস। কোথায় পেলে?
রুমালের ভাঁজে! কেউ একজন রেখে দিয়েছে। সকালে ছিল না।
ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল। নিচের ঠোঁটে। কে রাখল? কেন? বিড়বিড় করতে লাগল। আমাদেরকে চোর বলে চিহ্নিত করতে চায় না-তো। তাহলে…
কি করব আমরা এখন, কিশোর? বলে উঠল মুসা। ওটা চুরির একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! যদি ধরা পড়ি…
আমার মনে হয়… বলতে গিয়েও থেমে যেতে হল কিশোরকে। বাইরে ভারি জুতোর শব্দ। অনেকগুলো।
মুহূর্ত পরেই দরজায় চাপড়ের শব্দ হল। নবটা ঘোরানর চেষ্টা করল কেউ। ভেতর থেকে তালা দেয়া, খুলল না। শোনা গেল কুদ্ধ গলা, দরজা খোল। রিজেন্টের আদেশ!
স্তব্ধ একটা সেকেণ্ড। তারপরই লাফ দিল মুসা আর কিশোর, একই সঙ্গে। লোহার দুটো ভারি ছিটকিনি তুলে দিল দুজনে।
ঠিকমত ভাবতে পারছে না রবিন, এতই অবাক হয়েছে। হাতে ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে এখন?
.
০৭.
জোরে জোরে কিল মারার শব্দ হচ্ছে দরজায় বাইরে থেকে।
খোল! রিজেন্টের আদেশ! আমরা আইনের লোক! আবার চেঁচিয়ে উঠল ক্রুদ্ধকণ্ঠ।
দরজায় পিঠ দিয়ে চেপে দাঁড়িয়েছে কিশোর আর মুসা। নিজেদের দেহের ভার দিয়ে দরজা আটকে রাখতে চাইছে যেন।
হাতের অপূর্ব সুন্দর জিনিসটার দিকে চেয়ে আছে রবিন। মাথায় চিন্তার ঝড়। কোথাও লুকিয়ে ফেলা দরকার এটাকে। কিন্তু কোথায়?
হঠাৎ সচল হয়ে উঠল রবিন। ছুটোছুটি শুরু করল সারা ঘরময়। চোখ জায়গা খুঁজছে। কোথায় লুকিয়ে রাখবে মাকড়সাটাকে! কার্পেটের তলায়? না। বিছানার গদি? তাও না। তাহলে, তাহলে কোথায়? কোথায় রাখলে খুঁজে পাবে না অন্য কেউ?
জোরে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে দরজায়। ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সময়ই ঘটল আরেক ঘটনা। ভীষণভাবে দুলে উঠল জানালার পর্দা। লাফিয়ে এসে ঘরের ভেতরে পড়ল দুজন তরুণ! চমকে উঠল কিশোর আর মুসা! ওদিক থেকেও আক্রমণ এল।
না না, চমকাবার কিছু নেই। কাছে এগিয়ে এসেছে এক তরুণ। ফিসফিস করে বলল, আমি। মরিডো। আর, ও আমার ছোট বোন, মেরিনা।
মেরিনা…ও আপনার বোন, ফিসফিস করেই বলল কিশোর।
সেই মেয়েটা। পার্কে বেলুন বিক্রি করছিল যে। পরনে মরিডোর মতই প্যান্ট, জ্যাকেট। দেখে প্রথমে তাই তাকে ছেলে বলে ভুল করেছে ওরা।
মাথা ঝোকাল মরিডো। জলদি আসুন, পালাতে হবে। আপনাদেরকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে ওরা! ধরতে পারলে ফাঁসি দিয়ে দেবে!
আওয়াজ পাল্টে গেছে আঘাতের। দরজা ভাঙার জন্যে কুড়াল ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তিন ইঞ্চি পুরু ভারি ওক কাঠের দরজা। এত সহজে ভাঙবে না। কয়েক মিনিট সময় নেবেই।
ঘরে বসে টেলিভিশনে সিনেমা দেখছে যেন ওরা! খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে ঘটনা। তাল পাচ্ছে না তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে যেতেই হবে এঘর থেকে, এটা ঠিক, কিন্তু কি করে, বুঝতে পারছে না।
জলদি এস, মুসা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাজ করতে শুরু করেছে আবার তার মগজ। রবিন, এস। মাকড়সাটা পকেটে ঢোকাও।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। হঠাৎ সোজা হল। দ্বিধা করল এক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে ছুটে এল।
জানালার দিকে ছুটল মেরিনা। ফিরে সবাইকে একবার ইশারা করেই টপকে ব্যালকনিতে চলে গেল। ওর পিছু পিছু ব্যালকনিতে এসে নামল কিশোর, মুসা, রবিন।
ঠাণ্ডা অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল ওরা। নিচে জ্বলছে শহরের আলো।
দালানের গা থেকে বেরিয়ে আছে চওড়া কার্নিস। সেটা দেখিয়ে বলল, প্যালেসের পেছনেও আছে। এতখানিই চওড়া। হাঁটা যাবে। আসুন আমি পথ দেখাচ্ছি।
ব্যালকনির রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল কার্নিসে।
দ্বিধা করছে কিশোর। আমার ক্যামেরা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। ফেলে রেখে এসেছি!
আর আনার সময় নেই! পেছন থেকে বলল মরিডো। দুমিনিট টিকবে আর দরজা, বড় জোর তিন। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করা যাবে না।
খুব খারাপ লাগল ক্যামেরাটার জন্যে। কিন্তু আনার উপায় নেই। মুসা নেমে পড়েছে ততক্ষণে কার্নিসে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর। দেয়ালের দিকে মুখ, পা ফাঁক করে পাশে হেঁটে সরছে মেরিনা।
গায়ে গা ঠেকিয়ে মেরিনার মত করেই সরতে লাগল মুসা আর কিশোর। বেড়ালের মত নিঃশব্দে।
ভয় পাবার সময়ই নেই। ঘরের ভেতরে দরজায় আঘাতের শব্দ হচ্ছে একনাগাড়ে। প্রাসাদের এক কোণে পৌঁছে গেল ওরা। ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা দিয়ে গেল চোখেমুখে।
ক্ষণিকের জন্যে কেঁপে উঠল রবিন, দুলে উঠল দেহ। অনেক নিচে ডেনজো নদী, রাতের মতই অন্ধকার। পাক খেয়ে খেয়ে ঘূর্ণি সৃষ্টি করেছে পানি, শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঁধ খামচে ধরল মরিডোর শক্তিশালী হাত, পতন রোধ করল রবিনের। আবার ভারসাম্য ফিরে পেল সে।
জলদি! রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল মরিডো।
চমকে উঠল একজোড়া পায়রা। এ-কি জ্বালাতন! এত রাতে ঘুম নষ্ট করতে এল কে! পাখার ঝটপট শব্দ তুলে দালানের খোপ থেকে বেরিয়ে এল পাখি দুটো, অনধিকার-চর্চাকারীদের মাথার ওপর চক্কর দিয়ে দিয়ে উড়তে লাগল। হঠাৎ বসে পড়তে যাচ্ছিল রবিন, আবার তার কাঁধ খামচে ধরল মরিডো।
মোড় ঘুরে আরেকটা ব্যালকনির কাছে চলে এল ওরা। রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নামল।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে।
এবার ওপরে উঠতে হবে, ফিসফিসিয়ে বলল মেরিনা। এই যে দড়ি। গিঁট দেয়া আছে একটু পর পরই। উঠতে অসুবিধে হবে না!
এটা কেন? রেলিঙে বাঁধা আরেকটা দড়ি নেমে গেছে নিচে, সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওদের বোকা বানাতে, জবাব দিল মেরিনা। ধরে নেবে আমরা নিচে নেমে গেছি।
ওপর থেকে ঝুলছে যে দড়িটা, সেটা ধরে উঠতে শুরু করল মেরিনা। তাকে অনুসরণ করল মুসা। তারপর দড়ি ধরল কিশোর।
ওদেরকে কয়েক ফুট ওঠার সময় দিল রবিন। তারপর দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল সে-ও। উঠতে শুরু করল ধীরে ধীরে।
আবার কার্নিসে নেমেছে মরিডো। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেল কোনায়। উঁকি দিল। দেখতে চাইছে, ওদিকে কতদূর কি করল শত্রুরা।
ফিরে এল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এখনও দরজা নিয়েই আছে। তবে এসে পড়ল বলে!
কি? মরিডোর দিকে তাকাতে গেল রবিন। ঘামে ভেজা হাত, পিছলে গেল হঠাৎ। গিটও আটকাতে পারল না, সড়সড় করে নিচে নেমে চলে এল সে। ঘষা লেগে ছিলে গেল হাতের চামড়া। তার মনে হল, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মাত্র একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই এসে পড়ল নিচে দাঁড়ানো মরিডোের ওপর। পড়ল তাকে নিয়েই। জোরে কঠিন কিছুতে ঠুকে গেল মাথা। দপ করে চোখের সামনে জ্বলে উঠল কয়েক হাজার লাল-হলুদ ফুল। তারপরেই অন্ধকার!
রবিন! কানের কাছে ডাক শুনে চোখ মেলল সে।
রবিন! শুনতে পাচ্ছেন! লেগেছে কোথাও! শঙ্কিত গলা মরিডোর।
চোখ মিটমিট করল রবিন। ওপরে তারাজ্বলা আকাশ। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মরিডো। চিত হয়ে পড়ে আছে সে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা মাথায়।
রবিন, কোথাও লাগেনি তো! আবার জিজ্ঞেস করল মরিডো। উদ্বিগ্ন।
মাথা ব্যথা করছে, অবশেষে বলল রবিন। কোলা ব্যাঙের আওয়াজ বেরোল গলা থেকে। ভালই আছি। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। চারদিকে তাকাল। একটা ব্যালকনিতে বসে আছে। পাশে, প্যালেসের পাথরের কালো বিশাল দেয়াল উঠে গেছে ওপরে। অনেক নিচে ডেনজো নদীতে মিটমিট করছে নৌকার আলো।
আমি এখানে কেন! বলে উঠল রবিন। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আপনারা…তারপরই আমি এখানে!…মাথায় যন্ত্রণা।…কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
প্রিন্স পল রক্ষা করুন আমাদের, বিড়বিড় করল মরিডো। কথা বলার সময় নেই! দড়ি ধরে উঠতে পারবেন? এই যে, দড়ি। রবিনের। হাতে দড়িটা গুঁজে দিল সে। উঠতে পারবেন?
অবাক হয়ে দড়িটা ধরে আছে রবিন। এটা কোথা থেকে এল? এর আগে কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
জানি না! ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। চেষ্টা করব।
হবে না! আপনমনেই বিড়বিড় করল মরিডো। বুঝেছি, পারবেন না। টেনে তুলতে হবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। দড়ি বেঁধে টেনে তুলব।
দড়ির মাথা রবিনের দুই বগলের তলা দিয়ে এনে বুকে শক্ত করে পেঁচাল মরিডো, গিঁট দিল। চুপ করে থাকুন। আমি উঠে যাই। তারপর টেনে তুলব। দেয়ালে অনেক ফাটল আছে। ওগুলোতে পা বাধিয়ে ওপরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করবেন নিজেকে। আমাদের সাহায্য হবে। তা যদি না পারেন, চুপচাপ ঝুলে থাকবেন। ভয় নেই, ফেলে দেব না।
দড়িতে টান পড়তেই ওপরের দিকে চেয়ে বলল, আসছে! অঘটন ঘটেছে এখানে!
দড়ি ধরে রেলিঙে উঠে দাঁড়াল মরিড়ো। ঝুলে পড়ল অন্ধকারে।
নিঃশব্দে উঠে যাচ্ছে মরিডো। সেদিকে তাকিয়ে রইল রবিন। হাত চলে গেছে মাথার পেছনে, আহত জায়গা। এখনও বুঝতে পারছে না সে, কি করে এখানে এল! সঙ্গীরা কোথায় কি করছে, বুঝতে পারছে। মনে পড়ছে, ওরা ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজায় কুড়াল দিয়ে কোপানর শব্দ। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর এসে লাফিয়ে নেমেছে। দুই তরুণ…
.
বড় একটা জানালার চৌকাঠে বসল মরিডো। লাফ দিয়ে নামল ভেতরে। ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন।
পড়ে গিয়েছিল রবিন, বলল মরিডো। খুব নাড়া খেয়েছে। চোট লেগেছে মাথায়। টেনে তুলতে হবে, নিজে নিজে উঠতে পারবে না। আসুন, দড়ি ধরতে হবে।
চারজনেই চেপে ধরল দড়ি। টান দিল। ওঠার সময় সাহায্য করেছে গিটগুলো, এখন অসুবিধে সৃষ্টি করল। প্রতিটি গিঁট বেধে যাচ্ছে। চৌকাঠের কিনারে, আটকে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টান দেয়া যাচ্ছে না। গিটের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সরিয়ে আনতে হচ্ছে অনেক কষ্টে।
ওজন বেশি না রবিনের। তাছাড়া ওরা চারজন। অসুবিধা সত্ত্বেও শিগগিরই দেখা গেল তার মাথা, কাঁধ। হাত বাড়িয়ে চৌকাঠ চেপে ধরল রবিন। দুহাত ধরে তাকে তুলে আনল মুসা আর মরিডো।
এলাম! কাঁপছে রবিনের গলা। কিছু ভেব না, আমি ঠিকই আছি। মাথা ব্যথা করছে অবশ্য, ওটা এমন কিছু না। হাঁটতে পারব। কিন্তু ব্যালকনিতে কি করে এলাম, সেটাই মনে করতে পারছি না!
পারবেন, মোলায়েম গলায় বলল মেরিনা। ওসব নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই এখন। আর কোন অসুবিধে নেই তো?
না, বলল রবিন।
আরেকটা শোবার ঘরে এসে ঢুকেছে ওরা। ভাপসা গন্ধ। অনুভবেই বুঝতে পারছে, বালি গিজগিজ করছে। তারার আবছা আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে ভেতরে। কোন আসবাবপত্র দেখা গেল না।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গেল মরিডো আর মেরিনা। নিঃশব্দে দরজা খুলল মরিডো, গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল বাইরে। ফিরে এল আবার।
কেউ নেই, বলল মরিডো। লুকানর জন্যে একটা জায়গা বের করতে হবে এবার। মেরিনা, তোমার কি মনে হয়? মাটির তলার কোন একটা ঘরে নিয়ে যাব?
ননাহ, জোরে মাথা নাড়ল মেরিনা। দড়ি দেখে ভাববে, নিচে নেমে গেছেন ওঁরা। নিচের কোন, ঘরেই খোঁজা বাদ রাখবে না ব্যাটারা। দেখ!
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিল সবাই। নিচে, আঙিনায় আলো, নড়াচড়া করছে। টর্চ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রহরীরা।
ইতিমধ্যেই পাহারা শুরু হয়ে গেছে আঙিনায়, বলল মেরিনা। ওপরেই যেতে হবে আমাদের। দিনটা কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। আগামী রাতে দেখব, অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারি কিনা। কোন একটা ডানজনের ভেতর দিয়ে পানি সরার ড্রেনে নিয়ে যাব। তারপর হয়ত নিয়ে চলে যেতে পারব আমেরিকান এমব্যাসিতে।
ভাল বলেছ, সায় দিয়ে বলল মরিডো। প্যালেসের এদিকটায় লোকজন আসে না। দড়ি নিচে নেমে গেছে, এদিকে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।…সঙ্গে রুমাল আছে আপনাদের?
আছে, পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে দিল কিশোর।
নিচে আঙিনায় ফেলে দেব সুযোগমত, বলে রুমালটা পকেটে রাখল মরিভো। জানালার ফ্রেমের মাঝখানের দণ্ডে বাঁধা দড়িটা, ওটা বেয়েই উঠে এসেছে। খুলে নিয়ে হাতে পেচাল সে। আসুন, যাই। মেরি, পেছনে থাক।
একে একে করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। দুপাশে ঘর। ওপরে ছাত। অন্ধকার। মরিডোর হাত ধরেছে কিশোর। তার হাত মুসা, মুসার হাত রবিন। তার হাত মেরিনা। পাঁচজনের একটা শেকল যেন, নিঃশব্দ কিন্তু দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল।
টর্চ জ্বেলে দেখে নিল মরিডো। দেয়ালের গায়ে একটা দরজার সামনে এসে থামল। ধাক্কা দিল খুলল না। আরও জোরে ধাক্কা দিতেই মরচে পড়া কজা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল। খুলে গেল পাল্লা। চমকে উঠল সবাই।
কান খাড়া করে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইল ওরা এক মুহূর্ত। না, কোনরকম শব্দ শোনা গেল না। ভেতরে পা রাখল ওরা। একটা সিঁড়ি ঘর।
অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সামনে আরেকটা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল মরিডো।
খোলা ছাতে বেরিয়ে এল ওরা। ছাত ঘিরে রেখেছে উঁচু দেয়াল। দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝে বড় কুলুঙ্গিমত রয়েছে।
ওখান থেকে তীর ছোঁড়া হত, গরম তেল ঢেলে দেয়া হত শত্রুর ওপর, কুলুঙ্গিগুলো দেখিয়ে বলল মরিডো। আজকাল আর ওসবের দরকার হয় না। ছাতে পাহারাই থাকে না অনেক বছর ধরে।
প্রত্যেক কোনায় সেন্ট্রিরুম রয়েছে। এক কোণে পাথরের একটা খুপরিমত ঘরে নিয়ে এল ওদেরকে মরিডো। অনেক আপত্তি প্রকাশ করার পর খুলে গেল কাঠের দরজা। ভেতরে আলো ফেলল সে। চার দেয়াল ঘেঁষে চারটে লম্বা বেঞ্চ, ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে ওখানেই শুয়ে ধুমাত সেন্ট্রিরা। ধুলোয় একাকার। ছোট ছোট ফোকর রয়েছে দেয়ালে, কাঁচ নেই।
এককালে সারাক্ষণ পাহারা থাকত এখানে, বলল মরিডো। সে অনেক আগের কথা। এখানে আপাতত নিরাপদ আপনারা। আগামীকাল রাতে আবার আসব। যদি পারি।
ধপ করে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল কিশোর। কপাল ভাল, এখন গরমকাল। নইলে ঠাণ্ডায় জমেই মরতে হত।…তো, এসব কি? কি ঘটেছিল?
কোন ধরনের ফাঁদ, বলল মেরিনা। রূপালী মাকড়সা চুরির অজুহাতে আপনাদেরকে গ্রেফতার করা হত। তারপর, কোন একটা কায়দা বের করে সিংহাসনে বসতে দিত না প্রিন্স দিমিত্রিকে। এখন পর্যন্ত এইই জানি।
আমরা চুরি করিনি রূপালী মাকড়সা, বলল কিশোর।
জানি।
কিন্তু ওটা এখন আমাদের কাছেই আছে। রবিন, দেখাও ওদের।
জ্যাকেটের এক পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। তারপর ঢোকাল। অন্য পকেটে। সতর্ক হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি খুঁজল সবকটা পকেট। ঢোক গিলল। কিশোর…নেই…! নিশ্চয় পড়ে গেছে কোথাও
.
০৮.
মাকড়সাটা ছিল আপনার কাছে? হারিয়েছেন? আতঙ্কিত গলা মরিডোর।
সর্বনাশ! বলে উঠল মেরিনা। আপনাদের কাছে এল কি করে? হারালই বা কি করে?
ভল্ট থেকে রূপালী মাকড়সা চুরি যাওয়ার কাহিনী খুলে বলল কিশোর, যা যা শুনেছিল প্রিন্স দিমিত্রির কাছে। জানাল, আসলটার জায়গায় নকলটা পড়ে আছে এখন। প্রিন্সের সন্দেহ, চুরি করেছে ডিউক রোজার, দিমিত্রির প্রিন্স হওয়া ঠেকানর জন্যে।
রবিন জানাল, ড্রয়ারে রুমালের আজ থেকে কি করে পেয়েছে সে মাকড়সাটা।
ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারছি এবার, চিন্তিত শোনাল মরিডোর গলা। ডিউক রোজারই মাকড়সাটা আপনাদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর লোক পাঠিয়েছে গ্রেফতার করতে। মাকড়সাটা পাওয়া যেত আপনাদের ঘরে। প্রিন্স দিমিত্রির অসাবধানতার কারণেই ওটা চুরি। করতে পেরেছেন, ঘোষণা করে দিত ডিউক। প্রিন্সের ওপর বিশ্বাস হারাত লোকে। আপনাদেরকে ভ্যারানিয়া থেকে বের করে দিত রোজার, আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করত। রাজ্যশাসন চালিয়ে যেত! তারপর কোন এক সময়ে নিজেকে স্থায়ী রিজেন্ট ঘোষণা করে বসে পড়ত সিংহাসনে।
কিন্তু মাকড়সাটা এখন তার হাতে নেই, বলল মুসা। আর তো এগোতে পারছে না।
পারছে, বলল মরিডো। আপনাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। ধরতে পারলেই ঘোষণা করবে, মাকড়সাটা কোথাও লুকিয়ে ফেলেছেন। আপনারা। আমেরিকান এমব্যাসিতে পালিয়ে যেতে পারলেও বদনাম থেকে রেহাই পাবেন না। তাহলে বলবে, রূপালী মাকড়সা চুরি করে নিয়ে চলে গেছেন আপনারা।
কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও বুঝতে পারছি না, বলল মুসা। রূপালী মাকড়সা হারালে কিংবা চুরি গেলে, দিমিত্রির দোষটা কোথায়? আমরা না এলেও তো ওটা চুরি যেতে পারত? আগুন লেগে কিংবা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারত। তখন?
তখন সারা দেশ শোক প্রকাশ করত দীর্ঘদিন ধরে। প্রিন্স দিমিত্রির কোন দোষ থাকত না। এখন তো বলবে, আমেরিকান কয়েকটা চোর বন্ধুকে এনে ভল্টে ঢুকিয়েছে, ফলে চুরি গেছে মাকড়সা। আসলে, প্রিন্স পল আমাদের কাছে কতখানি কি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না আপনাদের। তারই প্রতীকচিহ্ন ওই রূপালী মাকড়সা। ওটার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য, স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
হয়ত বলবেন আমরা কুসংস্কারে বেশি বিশ্বাসী, আবার বলল মরিডো। কিন্তু আজ পর্যন্ত মাকড়সার অবমাননা করে টিকতে পারেনি কেউ, ধ্বংস হয়ে গেছে। বংশ বংশ ধরে প্রিন্স পলকে ভালবেসে এসেছি আমরা। তাঁর আদেশ, তাঁর নির্দেশ এখনও ভ্যারানিয়ানদের কাছে ধ্রুববাক্য। আমরা জানি, যতদিন রূপালী মাকড়সা নিরাপদে থাকবে, ভ্যারানিয়ানরা নিরাপদ। ওটার কোন ক্ষতি হলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর। ওটা রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমাদের সরাসরি না হলেও প্রিন্স দিমিত্রি এটা হারানর ব্যাপারে জড়িত, দেশের লোক তাই জানবে। মন থেকে কোনদিনই আর তাকে ভালবাসতে পারবে না। সিংহাসনে বসার অযোগ্য মনে করবে। থামল। একটু। ভাবল। তারপর বলল, তাহলে বুঝতেই পারছেন রূপালী মাকড়সা খুঁজে পেতেই হবে আমাদের। নইলে ডিউক রোজারেরই জিত।
সর্বনাশ করেছি তাহলে! বলে উঠল রবিন। গলা কাঁপছে। ঢোক মিলল। কিশোর, মুসা, আমার পকেট খুঁজে দেখ।
তন্ন তন্ন করে রবিনের সব পকেট খুঁজল মুসা আর কিশোর, টেনে উল্টে বের করে আনল পকেটের কাপড় নেই! জামার হাতার ভাঁজ, প্যান্টের নিচের ভাজ, জুতো-মোজার ভেতর, কোথাও খোঁজা বাদ রাখল না। নেই তো নেই-ই। পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ভাব, রবিন, অবশেষে বলল কিশোর। ভাল করে ভেবে দেখ, কোথায় রেখেছিলে! তোমার হাতে ছিল ওটা, তারপর কি করলে?
মনে করার চেষ্টা করল রবিন। জানি না! হতাশ কণ্ঠ। রুমালের ভাঁজ থেকে পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হাতে তুলে নিলাম। দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ হল। জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে পড়ল মরিডো। তারপর আর কিছু মনে নেই!
হুমম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অ্যামনেশিয়া, আংশিক! মাথায় আঘাত পেলে মাঝেসাঝে ঘটে এটা। বিস্মরণ ঘটে। অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে যায় কারও, কেউ হারায় কয়েক হপ্তা, কেউ কয়েক দিন। কয়েক মিনিট হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। রবিনেরটা কয়েক মিনিট। কারও কারও বেলায় ঠিক হয়ে যায় এটা, আবার ফিরে পায় ওই স্মৃতি। ওর বেলায় কি ঘটবে, জানি না। মাথায় আঘাত লাগার তিন চার মিনিট আগের সমস্ত ঘটনা মুছে গেছে তার মন থেকে।
মনে হয় ঠিকই বলেছ, বলল রবিন। হয়ত তা-ই ঘটেছে। আহত জায়গায় হাত চলে গেল। খুব আবছাভাবে মনে পড়ছে এখন, সারা ঘরে ছুটোছুটি করছিলাম। মাকড়সাটা লুকানর জায়গা খুঁজছিলাম। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম খুব। কার্পেটের তলায়, গদির তলায়, কিংবা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখার কথা মনে এসেছিল। তবে ওসব জায়গা নিরাপদ বলে মনে হয়নি…
চুপ করল রবিন।
অন্যরাও চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। এরপর কি করেছে, মনে করার সুযোগ দিল রবিনকে। কিন্তু আর কিছু মনে করতে পারল না সে।
আমাকে দেখার পর একটা কাজ করাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, বলল মরিডো। পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা। হয়ত তাই করেছেন। তবে ভালমত রাখতে পারেননি তাড়াহুড়ায়। তারপর, যখন কার্নিসে উঠলেন, কোনভাবে পড়ে গেছে মাকড়সাটা। ব্যালকনিতে যখন আছড়ে পড়েছেন, তখনও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।
কিংবা হয়ত আমার হাতেই ছিল, পকেটে ঢোকাইনি, বলল রবিন। কোন এক সময় হাত থেকে ছুটে পড়ে গেছে। কার্নিস কিংবা ব্যালকনিতে পড়ে থাকার আশা খুবই কম, তবে সম্ভবত নিচে, আঙিনায় পড়েছে।
আঙিনায় পড়ে থাকলে পাওয়া যাবে, বলল মরিডো। ব্যালকনি কিংবা কার্নিসে থাকলেও পেয়ে যাব! কিন্তু, যদি পাওয়া না যায়… চুপ করে গেল সে।
কিংবা ঘরেও ফেলে এসে থাকতে পারেন, এতক্ষণে কথা বলল মেরিনা। হয়ত খোঁজার কথা ভাবেই না গার্ডেরা। ধরেই নেবে, আপনারা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যদি আঙিনায় পাওয়া না যায়, আগামীকাল রাতে আবার সে ঘরে ফিরে যাব আমরা। খুঁজব। কার্নিস আর ব্যালকনিও বাদ দেব না।