যা যা পছন্দ করি খেতে, মা সারাদিনই চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেসব মুখে তুলে দিয়েছেন, খেতে না চাইলেও মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। রাত ঘন হচ্ছে আমি ঘন ঘন চা পান করছি। মা আবারও মুখের সামনে খাবার নিয়ে এলেন। ধুত্তুরি বলে ঠেলে সরিয়ে দিলাম মার হাত। এ সময় কার খেতে ইচ্ছে করে! ঘড়ির দিকে বার বার চোখ চলে যাচ্ছে। যত কাঁটা এগোচ্ছে, তত আমার শরীর শিথিল হচ্ছে।

রাত দেড়টার দিকে দেখি দুটো গাড়ি শান্তিনগরের মোড়ের কাছে। ছোটদা দেখে বলেন, ওইগুলা পুলিশের গাড়ি।

আমাকে এখন এমন কাপড়ে ঢাকতে হবে শরীর এবং মুখ, যেন কেউ আমাকে চিনতে না পারে। ওড়নায় আবার মুখ মাথা ঢাকার পালা, বেরিয়ে থাকবে কেবল চোখ, চোখে আবার একটি কালো চশমা, আর চোখের ভুরু ইয়াসমিন এমন করে এঁকে দেয় যেন আমার ভুরু বলে কেউ ধারণা করতে না পারে। আয়নার সামনে এভাবে আমাকে সাজতে হয়, এবং খুঁটিয়ে দেখতে হয় আমি বলে কিছু আমার চেহারায় আছে কি না। নেই বুঝে সরতে হয়, সরে আমাকে দরজার দিকে হাঁটতে হয়। কারণ ছোটদা, দাদা, মিলন তৈরি, সময় হয়ে গেছে। মা এই দৃশ্য দেখতে চান না, তিনি মেঝেয় লুটিয়ে পড়ে কাঁদছেন। মার শাড়ি সরে গেছে মার শরীর থেকে। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। বাবা ধমকে থামাতে চাইছেন মাকে, আশে পাশের বাড়ি থেকে লোক জেগে যাবে বলে।

মাকে থামানোর সাধ্য কারও নেই।

মা কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমার মেয়েরা তরা ষড়যন্ত্র কইরা দেশ থেইকা বার কইরা দিতাছস। আমার মেয়েরে আমার কাছে ফিরাইয়া দে তরা। আমার মেয়েরে আমি যাইতে দিব না। কোথাও যাইতে দিব না।

বাবা, দাদা আর ছোটদার বিরুদ্ধে অভিযোগ শেষ করে মা আল্লাহ নিয়ে পড়েন, আল্লাহগো, এ কি করলা গো আল্লাহ। তোমার পায়ে পইরা কত কানছি। কত কইছি আমার মেয়েরে কোনও বিপদ দিও না। আমার মেয়েরে কই পাডাইতাছো আল্লাহ গো। আমি কি কইরা বাচবাম! আল্লাহ তুমি কি করলা। আমার মেয়েরে এত কষ্ট কেন দিতাছ। ও তো এত কষ্ট সইতে পারবো না। কষ্ট আমারে দেও আল্লাহ। ওরে আর কষ্ট দিও না। আমার মেয়েরে আমার কাছে থাকতে দাও আল্লাহ। ওরে নিও না। ওরে আমার কাছ থেইকা দূরে সরাইও না।

মাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে আমি আমার টিকিটটি দেখাই, এই দেখ মা, টিকিটে লেখা আছে ফেরার তারিখ। ঠিক এক মাস পরে আমার ফেরার তারিখ, দেখ দেখ আটই সেপ্টেম্বর। দেখছ? টিকিট আমার হাতে দেশে ফেরার। তুমি কাইন্দ না।

মা চোখ তবু মোছেন না। তবু মা কাঁদেন। আমি জানি, মাও জানেন যে আমাকে যেতে হচ্ছে, দেশে থাকার উপায় নেই বলে কোথাও যেতে হচ্ছে আমার। আমি জানি যে দেশের অবস্থা খানিকটা ভাল হলে, মৌলবাদীদের আস্ফালন সামান্য কমে এলে আমি দেশে ফিরবো, কিন্তু আমি জানি না যে মৌলবাদীদের আন্দোলন কমে এলেও, দেশের অবস্থা খানিকটা নয়, অনেকটা ভাল হলেও আমার আর ফিরে আসা হবে না। কারণ আমাকে ফিরতে দেওয়া হবে না। আমি জানি না যে আসলে এই আমার শেষ যাওয়া। আমাকে কোনওদিন আর আমার নিজের দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। সরকারের বদল হবে, কোনও সরকারই আমাকে দেশে ঢুকতে দেবে না আর। আমাকে আমার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে, সকলে জানবে সব কিন্তু কেউ কোনওদিন এত বড় একটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও টুঁ শব্দ করবে না। একজন লেখককে তাঁর লেখার অপরাধে, তাঁর মত প্রকাশের অপরাধে চরম নির্বাসনদণ্ড পেতে হবে, পুরো একটি দেশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে কেবল, কোনও আপত্তি করবে না। আমি যাচ্ছি স্বপ্ন নিয়ে যে দেশের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা কিছুতেই মেনে নেবেন না যে একজন লেখককে তাঁর লেখার কারণে নির্বাসনে যেতে হবে, তাঁরা আন্দোলন করবেন, আমাকে দেশে ফেরত নিয়ে আসার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাবেন, আমি একদিন ফিরে আসবো নিজের দেশে সসম্মানে, যেভাবে নিজের মুখখানি ঢেকে মাথা নিচু করে চরম অসম্মাননা নিয়ে নাম পরিচয় লুকিয়ে আমাকে দেশ থেকে বেরোতে হল, সেভাবে নয়, শির উঁচু করে ফিরব,নিজের নামটি নিয়ে ফিরব, লেখক হিসেবে ফিরব, লেখকের অধিকার নিয়ে ফিরবো, বাক স্বাধীনতার জয় জয়কার ধ্বনিত হবে চারপাশে, আমি ফিরব। কিন্তু আমি জানি না যে আমার স্বপ্ন পায়ে মাড়িয়ে যাবে লোকে, কেউ কখনও আমার দেশে ফিরে আসার কথা ভুলেও তুলবে না। আমি জানি না যে আমাকে দেশের লোকেরা ভুলে যাবে খুব দ্রুত, আমার কথা আর কোথাও তেমন উচ্চারিত হবে না। না, আমি কিছুতেই জানি না যে দেশ থেকে আমাকে বিতাড়িত করার এই ঘটনাটি সকলে বিস্মৃত হবে অচিরেই। অচিরেই আমাকে একটি ভুলে যাওয়া নামে, লেখকে পরিণত করবে সকলে। কেউ আর আমার কোনওরকম প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করবে না। কেবল একজনই অনুভব করবেন, তিনি আমার মা। তিনিই শুধু ভাববেন ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসুক। তিনিই কেবল আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, প্রতিদিন তাকিয়ে থাকবেন আকাশের দিকে, উড়োজাহাজে করে আমি ফিরে আসছি দেশে, এই আশায়। তিনিই শুধু ভাববেন আমাকে, তিনিই শুধু আমার না থাকাকে সইতে পারবেন না। একা একা কাঁদবেন তিনি। কেউ তাঁর ওই কান্নার দিকে ফিরে তাকাবে না।

বাবাকে বলা হয়েছে বিমান বন্দরে যাওয়ার তাঁর দরকার নেই, কিন্তু তিনি প্যান্ট শার্ট পরে তৈরি হয়ে রয়েছেন সবার আগে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবাকে অসহায় বালকের মত দেখতে লাগে। তিনি করুণ চোখে তাকাচ্ছেন সবার দিকে, যেন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোটদা বাবার হাত টেনে শোবার ঘরে নিয়ে এসে বললেন, কোনও দরকার নাই আপনের যাওয়ার। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, যাবেনই। আমি বললাম, বাবা যাবে।

না, দরকার নাই। কি দরকার! ছোটদা বললেন।

কারও তো যাওয়ার তাইলে দরকার নাই। আমি রাগ দেখালাম।

গাড়িতে জায়গা হবে না।

হবে।

দরজার কাছে যেতেই মা আমাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরে রাখেন। দু বাহুতে শক্ত করে আমাকে বুকে আঁকড়ে রাখেন। আমাকে মার শক্ত আলিঙ্গন থেকে জোর করে টেনে বের করেন দাদা আর ছোটদা। আমি বাবার হাত ধরে দরজার বাইরে বেরোই। দরজার কাছে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছজন পুলিশ ঠিক বুঝে পেল না এত রাতে কোথায় যাচ্ছে বাড়ির এতগুলো লোক।

মিলন পুলিশদের বলল, আমার খালা আজকে চিটাগাং যাইতাছে, তারে পৌঁছাইয়া দিতে যাইতাছি ।

পাহারা পুলিশও যেন না জানে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, কারণ এদের মধ্যেও মৌলবাদী থাকতে পারে, এদের মধ্যে কেউ খবর দিতে পারে যে আমি এখন বিমানবন্দরে যাচ্ছি। সরকারের ওপরতলা জানে আমি যে যাচ্ছি, নিচতলা জানে না কূটনীতির সবকিছু। এমন সতর্কতার মধ্যে ইতিউতি তাকিয়ে সবাই নীচে গ্যারেজে নেমে এল। চালকের আসনে ছোটদা, ছোটদার পাশে মিলন, পেছনে আমি দাদা আর বাবার মাঝখানে। সাদা গাড়িটি বেরিয়ে এল ইস্টার্ন পয়েন্ট থেকে। সুনসান রাস্তা, শান্তিনগরের মোড় অবদি পৌঁছতেই আমাদের গাড়ির সামনে একটি, পেছনে একটি গাড়ি চলতে শুরু করে। পুলিশের গাড়ি। পেছনে বাড়িটির দিকে তাকানো হয় না আমার। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মা, টের পাই। মার কান্নার শব্দ আমার সঙ্গে বিমান বন্দর অবদি যায়।

বিমান বন্দরে গাড়ি থেকে নামতেই দেখি মোচঅলা আর মোচহীন পুলিশ অফিসার দুজন আমার দু পাশে। সাদা পোশাকের এক দল পুলিশ ঢুকে যাচ্ছে বন্দরের ভেতরে। মাঝখানে আমি, আড়াল করে রাখা হচ্ছে আমাকে। যেতে যেতে কখন একসময় লক্ষ্য করি পেছনে আটকে পড়েছে বাবা, দাদা, ছোটদা আর মিলন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। পেছনে তাকিয়ে দেখি ওরা আমার নাগাল না পাওয়া দূরত্বে। কিন্তু আমাকে দাঁড়ালে চলবে কেন! পুলিশের তাড়ায় আমাকে হাঁটতে হয় সামনে। দূরত্ব বাড়তে থাকে। হু হু করে ওঠে বুক। সোজা আমাকে বিমানের ভেতরে নিয়ে গেলেন পুলিশ অফিসার দুজন। ভেতরে কিছু লোক বসে আছে। হঠাৎ দেখি ঙ বসে আছেন আমার আসন থেকে দু সারি কিছু পেছনে। মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয়।

জানালায় তাকিয়ে থাকি। বাইরে একটু একটু করে আলো ফুটছে।

রানওয়ে পার হয়ে যখন বিমানটি আকাশে, জানালায় চোখ রেখে দেখছি আমার ক্ষুদ্র দরিদ্র দেশটি, অভাবে অসুখে থাকা দেশটি, বারো কোটি মানুষের জনাকীর্ণ দেশ, দুর্ভিক্ষে খরায় বন্যায় ভোগা দেশটি, আমার জন্মের দেশ, আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের দেশটি। যত ওপরে উঠি দেশটি ধূসর হতে থাকে, দেশটি একটু একটু করে অদৃশ্য হতে থাকে, অদৃশ্য হতে থাকে বিমান বন্দরে নিষ্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, শান্তিনগরের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা মা, অদৃশ্য হতে থাকে আমার সকল স্বজন, সকল বন্ধু। অদৃশ্য হতে থাকে আমার জন্ম জন্ম চেনা প্রকৃতি, বাড়িঘর, উঠোন, পুকুর, অদৃশ্য হতে থাকে নদী, গাছ গাছালি, মেঠো পথ, বন, ফসলের ক্ষেত। এক ঝাঁক মেঘ এসে হঠাৎ আড়াল করে দেয় সব। মেঘ খানিকটা দূরে সরবে এই আশায় মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকি পলকহীন চোখে। মেঘ তুমি সরে যাও, আমাকে আরেকটু দেখতে দাও। মেঘ তবু সরতে চায় না। নিষ্ঠুর বিমানটি আরও মেঘ ফুঁড়ে মেঘের ওপরে উঠে যায়। আচমকা অদৃশ্য হয়ে যায় আমার দেশটি, বড় প্রিয় দেশটি।

নিজের একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দে নিজেই চমকে উঠি।

শ্বাসটি কি নিশ্চিন্তের! স্বস্তির! জীবন ফিরে পাওয়ার!

নাকি বেদনার! অনিশ্চয়তার! জীবন হারানোর!

(সমাপ্ত)

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন