আগামীকাল এসে যায়। দিন পার হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। মা আমাকে পাঁচবেলা মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন। যা যা খেতে ভালবাসি, নিজে হাতে রান্না করেছেন। আমি খানিকটা অবসর পেতে চাই, দাদা আর বাবার রাজনীতির আলাপ থেকে সরে এসে একা হতে চাই। লেখার ঘরটিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই ভেতর থেকে। হাতে টিকিটটি নিয়ে বসি, এখন আমার হাতে সব ক্ষমতা। ইচ্ছে করলে এটি আমি এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারি। এখন আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি আমি কোথাও যাবো না। টিকিটটিকে নাড়াতে থাকি হাতে, দ্রুত, খুব দ্রুত। যেন হাতপাখা এটি। ছিঁড়বো কি ছিঁড়বো না অবস্থায় বার বার বলি নিজেকে, টিকিট হাতে আছে বলেই বুঝি যেতে হবে, ছিঁড়ে ফেললেই তো হয়, ছিঁড়ে ফেল, তুমি যেও না কোথাও, যেও না। কিন্তু অদৃশ্য কে যেন আমার দেশ ছাড়তে না চাওয়ার বাসনার কথা জেনে হেসে ওঠে, হাসতে হাসতে বলে, —তুমি কেন থাকবে এ দেশে? তোমার এই বিপদের সময় কি তোমার বোঝা হয়নি কটি লোক তোমাকে সমর্থন করে! এখনও কি বোধ হয়নি! কী ভরসায় থাকবে এ দেশে!

—কেন আমাকে ভরসা করতেই হবে?

—করতেই হবে কারণ তোমাকে হত্যার জন্য লক্ষ লোকের জমায়েত হয় এই দেশে। ভরসা তো করেছিলে, লুকিয়ে যখন থেকেছিলে! তুমি কি ভেবেছো, জামিন পেয়েছো বলে তোমার সব সমস্যা এখন শেষ হয়ে গেছে! প্রতিদিন নানারকম বিপদের সামনে পড়তেই হবে তোমাকে, তখন কার ওপর ভরসা করবে?

—কেন, আমাকে যারা আশ্রয় দিল! তারা তো আমার পাশে দাঁড়িয়েছে! শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী.. আমাকে সমর্থন করেন।

—কজন? হাতে গোনো। হাতে গোনো, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, করে গোনা। হাতের কড়াগুলো তবুও তোমার বাকি থেকে যাবে, এ দেশে লোক আছে বারো কোটি। বারো কোটির মধ্যে কজন তোমার পক্ষে! কেন এ দেশে থাকবে তুমি! তোমার অভিমান হয় না! এ দেশে তুমি থাকতে চাও কেন?

—আমার আত্মীয়রা আছে। এরা আমাকে ভালবাসে।

—ভালবাসে ঠিক কথা। কিন্তু তাদের ভালবাসাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট! তুমি এখন সাধারণ একজন মানুষ নও যে, আত্মীয়দের ভালবাসা আর সমর্থন দিয়েই একশ একটা বিপদ থেকে তুমি রক্ষা পাবে। মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বাঁচবে। তোমার আত্মীয়রা খুব নিরীহ মানুষ। তাদের কোনও শক্তি নেই। তারা তোমার চেয়েও নিরীহ। বেঁচে থাকতে চাইলে চলে যাও, বেঁচে থাকলে তুমি লিখতে পারবে, জীবনে যা ইচ্ছে তা করার সুযোগ পাবে।

—নাহয় হাইডিংএ থাকার সময় ডেসপারেটলি ভেবেওছিলাম বিদেশে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন এই যাওয়াটা, বিদেশে গিয়ে পড়ে থাকাটা কি রকম যেন অদ্ভুত লাগছে। কোনও মানে হয় না। কেউ আমাকে ঠিক করে বলছেও না কবে ফিরবো।

—ফেরার কথা ভাবার সময় নেই। পরের কথা পরে ভেবো। আগে বাঁচো তো। মনে রেখো আজ যদি বিদেশিরা তোমাকে সাহায্য না করত, তুমি এ দেশে বেঁচে থাকতে পারতে না। তোমার এত সমর্থক এ দেশে হয়নি যে এ দেশে থাকার সাহস তুমি কর। ওই হাতে গোনা কজন দিয়ে কিছু হবে না। তোমার বন্ধুর চেয়ে শষনুর সংখ্যা অনেক বেশি। এক লক্ষ শষনু যদি থাকে, একজন তবে বন্ধু। এভাবে হিসেব করো। এ দেশে তুমি বাঁচার আশা কি করে করো! তোমার আত্মীয় স্বজনের কোনও ক্ষমতা নেই তোমাকে বাঁচাবার। ওরা তোমার আত্মীয় বলে ওদেরও বিপদ অনেক। তুমি চলে গিয়ে ওদেরও বাঁচাও।

—কিন্তু..

—কিন্তু কি!

—সময় তো জানি সব আবার ঠিক করে দেয়। হয়ত কদিন পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। প্রাণনাশের হুমকি কি আমার জীবনে এই প্রথম? সেই কবে থেকেই তো!

—না যাও। সরকার তোমাকে ঠেলে বের করবে। আজ না যাও, কাল যেতে হবে। কাল না যাও পরশু যেতেই হবে। এটা তোমার সিদ্ধান্ত নয়। এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।

—এই সরকার তো আমার শষনু। এই সরকার কি আমাকে বাঁচাতে চাইছে!

—তোমাকে বাঁচাতে চাইছে না। নিজে বাঁচতে চাইছে। দেশের সরকার বিরোধী মৌলবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়ুক চাইছে, বিদেশের দুর্নাম বন্ধ করতে চাইছে।

—আমার কি অন্য কোনও উপায় নেই?

—না।

—কোনও উপায়ই নেই?

—না।

অনেকক্ষণ বসে থাকি একা একা। মাথা ঘোরে, ঘোরে আমার এই প্রিয় ঘরটির সবকিছু। লেখার টেবিল। চারপাশের বইভর্তি বইয়ের তাক। ঘোরে না শেষ করা বিস্তর লেখা, ঘোরে স্তূপ স্তূপ লেখার কাগজ, ঘোরে দেয়ালে টাঙানো আমার প্রিয় তেলচিত্রগুলো, ছবিগুলো, ঘোরে পুরস্কারের পদক, ঘোরে জানালার ভারী সবুজ পর্দা। এই ঘরে দিনের পর দিন কেটেছে আমার লেখায়, পড়ায়। এই ঘরটি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাকে! আমার সব তো এখানে। আমার জীবনটিই এখানে, আমার সব স্বপ্নই এখানে। সমস্ত স্বপ্নই। ঘুরতে থাকে আমার এই জগত। লাটিমের মত ঘোরে। চাই না, তবু রাত নেমে আসে। হু হু করে রাত বেড়ে চলে। রাত তখনও তত গভীর নয়, যতটা গভীর হলে আমার বিমান-বন্দরে যাওয়ার কথা। তখনই বিশেষ পুলিশ বাহিনীর উμচ পদস্থ দুজন কমকর্তা আমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলার জন্য বাড়িতে ঢোকেন। বাড়িতে ঢোকেন পরিচয় পত্র দেখিয়ে, কারণ বিশেষ পুলিশ বাহিনীর পরনে কোনও নীল বা খাকি পোশাক থাকে না। একজন লাল শার্ট, মোটামত, আরেকজন টাই পরা, মোচঅলা। যখন কথা বলবেন, বললেন আর কারও সামনে থাকা চলবে না। বৈঠকঘরে আলো আঁধারিতে বসে তাঁরা আমার সঙ্গে দুএকটি অজরুরি কথা বলেন প্রথম। তারপর বলেন আজ রাত দেড়টা থেকেই তাঁরা নিচে পুলিশের গাড়িতে থাকবেন। তারপর যা গরম পড়েছে আজ এমন একটি সহজ কথা বলার মত বললেন একজন, কোথায় ছিলেন দুমাস?

ছিলাম।

ছিলেন তো জানিই, কোথায় ছিলেন?

আমি খানিকটা দম নিয়ে বলি, লুকিয়ে ছিলাম সে তো জানেন।

আরেকজন বললেন, হেসে, পুলিশ বাহিনীকে তো হয়রান করে ছেড়েছেন। সারা দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আপনাকে পাওয়া যায় নাই। লুকিয়ে যে ছিলেন সে তো সবাই জানে, কিন্তু কোথায়?

আমি ম্লান হাসি।

মোচঅলা লোকটি বলেন, ভয় পান নাই লুকিয়ে থাকার সময়?

পাবো না কেন? বেঁচে ফিরব, এমনই তো ভাবিনি কোনওদিন।

মোচহীন লাল শার্ট লোকটি হঠাৎ কাচের দরজা ঠেলে বারান্দায় যান। বারান্দা থেকেই বললেন, ওদিকে কিছু লোক মনে হয় জটলা করছে।

হাতের রেডিওতে রাস্তার পাহারা পুলিশদের জানালেন জটলা কেন খবর নিতে। বারান্দা থেকে ফিরে এসে সোফায় বসে উদ্বিগ্ন মুখ চোখ, বললেন, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা সব ব্যবস্থা করছি।

টাইপরা মোচঅলা বললেন, আমাদের লোক বিমানবন্দরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনক লোকদের কোথাও জড়ো হতে দিচ্ছে না। যে করেই হোক যে কোনও রকম ঘেরাও ঠেকাবো আমরা।

মোটামত লাল শার্ট বললেন, ঠিক আড়াইটায় আপনার গাড়ি যেন বের হয়। আপনার গাড়ির ঠিক পেছনেই আমাদের গাড়ি থাকবে।

এসব আমার জানা। আমি বসে থাকি জরুরি কথাটি শোনার জন্য।

ফর্সা মত টাইপরা বললেন, দুমাস কি ঢাকায় ছিলেন নাকি ঢাকার বাইরে?

ঢাকাতেই ছিলাম।

ঢাকাতেই? আশ্চর্য।

আশ্চর্য কেন?

আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে কি করে এতদিন ঢাকায় ছিলেন, তাই ভাবছি।

আমি আবারও ম্লান হাসি। ভাবি, এই এরাঁই আমাকে সারা দেশ পাতি পাতি করে খুঁজেছেন গ্রেফতার করার জন্য, আর এঁরাই এখন আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। এঁরা কি পাল্টে গেছেন? না। এঁরা এঁরাই আছেন, কেবল সরকারি হুকুম পাল্টেছে। এঁরা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন এখন, হুকুম এলে এই এঁরাই বুটের লাথি লাগাতে পারেন পিঠে। হুকুম এলে এঁরাই আমাকে গ্রেফতার করে কালো গাড়িতে তুলে জেলে ভরতে পারেন।

গম্ভীর মুখে মোচঅলা জিজ্ঞেস করলেন— এক জায়গায় ছিলেন নাকি বিভিন্ন জায়গায়?

—বিভিন্ন।

—কোনও বাড়িতে ছিলেন নাকি অন্য কোথাও?

—অন্য কোথাও মানে?

—অন্য কোথাও তো অনেক কিছু হতে পারে। দোকানে, আপিসে, গুদামঘরে।

—না ওসব কোনও জায়গায় ছিলাম না।

—দূতাবাসে ছিলেন?

—না।

—দূতাবাসের কারও বাড়িতে?

—না।

—বিদেশিদের বাড়িতে তো ছিলেন!

—না।

—তবে কি বাঙালিদের বাড়িতে?

—হ্যাঁ।

—কাদের?

—কাদের মানে?

—কাদের মানে কাদের বাড়িতে ছিলেন?

প্রশ্নটি শুনে বড় একটি শ্বাস নিই আমি। মোচহীন বলেন, আসলে আমরা তো জানিই আপনি কাদের বাড়িতে ছিলেন। পুলিশ কী না জানে বলেন!

এই প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা আমি মোচহীনের মন্তব্যের বিপরীতে প্রশ্ন করি, জানেনই যখন তখন আর জিজ্ঞেস করছেন কেন?

মোচঅলা বললেন, আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

কেন শুনতে চান? কী দরকার?

দরকার আছে।

দুজোড়া চোখ আমার মুখে পলকহীন তাকিয়ে আছে। দুটো নাক ঘ্রাণ নিচ্ছে আমার অপ্রস্তুত অবস্থার, দুজোড়া কান খরগোসের কানের মত সজাগ দাঁিড়য়ে আছে। আমি টের পাই জিভ শুকোচ্ছে আমার, জিভের পেছনও শুকোতে শুকোতে নিচে নামছে, গলা, বুক শুকোচ্ছে।

টাইপরা ফর্সা মত মোচঅলা বললেন, আপনি জামিন পাওয়ার পর থেকে যে বিমান বন্দর ঘেরাও করে আছে মৌলবাদীরা, তা তো জানেন।

জানি।

আপনাকে যদি আজকে প্রোটেকশান না দেই, তাহলে কি করে যাবেন বিমানবন্দরে বলেন। একা যাবেন? পুলিশ ছাড়া?

চোখের সামনে আবছা আলোটুকু হঠাৎ মুছে যায়। যেন ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে একা বসে আছি। কোনও নামের একটি অক্ষরও তুই উচ্চারণ করিস না, ভেতরের আমিটি বাইরের আমিকে বলছে।

লাল শার্ট এবার শক্ত কণ্ঠে বলেন, নামগুলা বলেন, যাদের বাড়িতে ছিলেন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, না বললে তো আপনার ক্ষতি। আপনি কি চান আপনার ক্ষতি হোক?

অন্ধকারর ভেতর থেকে একটি শান্ত কন্ঠ ভেসে আসে, নিজেই চমকে উঠি কন্ঠটি শুনে। না।

না?

আমার এই স্পর্ধা দেখে চারটে ছানাবড়া চোখ পরষ্পরকে দেখে।

অন্ধকার সরিয়ে আমি তখন একটু আলোর জন্য মরিয়া হয়ে জানালা দরজা খুঁজছি। আমার চোখ অন্ধ হয়ে আসছে, খোলা চোখ, যেন বুজে আছি এমন একটি বোধ। −বাঁ বোঁ করে ঘুরছে কেবল মাথা নয়, জগত। মোচহীন, মোচঅলা পর পর বলে চলছেন, তাহলে আপনি আপনার ক্ষতিই চাইছেন। তাহলে আপনি চাইছেন না বিমান বন্দরে আপনার কোনও নিরাপত্তা? তাহলে আপনি ভেবেই নিয়েছেন যে আপনি নিরস্ত্র হয়ে সশস্ত্র লোকগুলোর হাত থেকে বাঁচবেন? আমরা সময় দিচ্ছি আপনাকে, আপনি ভেবে দেখেন কি হবে আপনার, যখন আপনি বিমান বন্দরে পৌছবেন, আর আপনাকে ঘিরে ধরবে মোল্লারা!

লাল শার্টের চোখে পাথুরে দুটো চোখ রেখে বললাম, আপনাকে যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ আশ্রয় দিত আপনার খুব বিপদের দিনে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে যারা, তাদের কি বিপদে ফেলবেন আপনি? ঠিক আমার অবস্থা যদি হত আপনার, আপনি কি ওদের কারও নাম বলতে পারতেন?

লালশার্টের ঠোঁটে বাঁকা একটি হাসি। টাইপরা লোকটি নড়ে চড়ে বসে বললেন, গম্ভীর গলায়, আপনার জীবন কি এখন বিপদমুক্ত আপনি ভাবছেন?

লাল শার্ট বাঁকা হাসিটি মিলিয়ে ফেলে বললেন, এখনও কিন্তু আপনি দেশের ভেতর।

সে আমি জানি। কিন্তু আমি কারও নাম বলব না।

নাম না বললে আপনাকে বিমানবন্দরে একা যেতে হবে। পুলিশ যাচ্ছে না আপনার সঙ্গে।

এ কথার পর তিনটি প্রাণী অতল এক নৈঃশ−ব্দ্যর মধ্যে বসে থাকি। একসময় সেই নৈঃশব্দ্য থেকে উঠে এক গেলাস জল খেতে হয় আমাকে। লক্ষ্য করি গেলাসে ধরা হাতটি আমার কাঁপছে। ভেতরের ঘরে বাবা বসে আছেন, চোখদুটোয় ঔৎসুক্য লাফাচ্ছে পুলিশের সঙ্গে আমার কি কথা হচ্ছে জানতে। আমি ইঙ্গিতে তাঁর চোখদুটোকে শান্ত হতে বললাম, তাঁকেও।

জল লালশার্টও চাইলেন। বাবা আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি, উঠে এসে পুলিশদের ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন চা খাবেন? বলে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না জানতে চা এঁরা খাবেন কি না, মিনুকে পাঠালেন রান্নাঘরে চা করার জন্য। মিনু চা নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত তিনটি প্রাণী আবারও নৈশ−ব্দ্যর ভেতরে সাঁতার কাটছিলাম। চায়ে চুমুক দিয়ে টাই পরা প্রথম বললেন, তাহলে কি আপনি কি নাম বলবেন না? কিছু নামের জন্য নিজের এত বড় ক্ষতি করবেন আপনি?

কেবল নাম হলে তো কথাই ছিল। নামের আড়ালে তো মানুষ আছে।

তাতে আপনার কি? আপনি তো নিজের দিকটা দেখবেন। যে শর্তে আপনার সুবিধা হয় তা নিয়ে ভাববেন।

নামগুলো জানা আপনাদের দরকার কেন?

এমনি। জাস্ট কিউরিওসিটি। আমরা তো তাদের আর কোনও ক্ষতি করতে যাবো না। প্রশ্নই ওঠে না।

তাহলে আর জানতে চাওয়া কেন?

বললাম তো কৌতূহল।

আপনারা তো বলেছেন তাদের নাম আপনারা জানেন।

জানি কিছু। বাকিটা আপনি বললে ভাল হয়।

না। আমি বলব না।

তাদের কোনওরকম ক্ষতি হবে না, কথা দিচ্ছি। কেবল আমরা দুজন জানব, আর কেউ না।

আমার পক্ষে সম্ভব না কারও নাম বলা।

আপনার ক্ষতি হলেও না?

আমি চায়ে চুমুক দিয়ে স্পষ্ট স্বরে বললাম, না।

ভেবে বলছেন?

ভেবেই বলেছি।

ভাবার জন্য আরও সময় নেবেন?

না।

বলে আমি লক্ষ্য করি আমার হাত আর কাঁপছে না যখন চায়ের কাপটি আমার হাতে। লোকদুটো চা শেষ করেননি। দুটো কি তিনটি চুমুকের পর উঠে পড়লেন। আমি বসে থাকি, পুলিশ কি আমাকে বিমান বন্দরে তাহলে নিয়ে যাবেন না! এরকম কি হতে পারে না যে আমি যাবো না! পুলিশ আসেনি, তাই আমার যাওয়া হয়নি। এই ফাঁকিটি কি আমি এখন দিতে পারি না! নিশ্চয়ই পারি। জামিন আমাকে যদি এই শর্তেই দেওয়া হয়ে থাকে যে আমাকে দেশ ছাড়তে হবে, না হয় হয়েছে দেওয়া। কিন্তু আমি যদি বেঁকে বসি, যদি বলি যে যাবো না দেশ ছেড়ে, তবে কি আমার জামিন ফেরত নেওয়া হবে! ক বলেছিলেন, আমাকে সরকার যা খুশি করতে পারে, জেলে ভরতে পারে। আমি দেশে থাকলে মৌলবাদীদের আন্দোলন এমন তীব্র হবে যে আমাকে বাঁচাতে তখন আর কেউ পারবে না। না এ দেশ, না অন্য কোনও দেশ। অন্তত আন্দোলনের তীব্রতা কমাতে এ দেশের স্বার্থে আমাকে পাড়ি দিতে হবে আপাতত অন্য দেশে। তারপর ঘরের মেয়ে তো ঘরে ফিরে আসবই। একদিন না হয় একদিন। মাথাটি ছিঁড়ে যেতে থাকে। কোনও ভাবনা আর ধরে না। শরীরে শক্তি নেই যে উঠে দাঁড়াবো। আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া যদি সরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, এটি তো জানি সরকারি সিদ্ধান্তই, তবে তো পুলিশ আমাকে নিরাপত্তা দেবেই আজ রাতে। নিয়ে আমাকে যাবেই বিমান বন্দরে। আর তা যদি না হয়, তবে পুলিশ ছাড়াই যাবো বন্দরে, যা হয় হবে।

ভেতর ঘর থেকে মার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। কান্নার শব্দ অনুসরণ করে আলুথালু মাকে দেখি দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদছেন। চাপা স্বরে বলি, কাইন্দা কোনও লাভ হইব? বাইচা থাকতে চাইলে আমার তো যাইতেই হইব।

মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন, তুমারে আমি লুকাইয়া রাখবাম, কেউ জানব না। তুমি যাইও না মা। উপরে আল্লাহ আছেন। কেউ কিছু করতে পারব না। সব ঠিক হইয়া যাইব। তুমি শুধু বইলা দিবা ধর্মের বিরুদ্ধে আর কিছু লিখবা না। মেয়েদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে, মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য যা লিখতাছিলা,তেমন লিখবা, শুধু ধর্মের বিরুদ্ধে না লিখলেই তো হইল।

বাবা দীর্ঘ একটি শ্বাস ছেড়ে বললেন, বললেও ওরা মানবে না কিছু। ও তো বলছেই কোরানের কথা বলে নাই, তারপরও কি ওরা থামছে?

গ্রীবা শক্ত করে মা বললেন, ও তাইলে ক্ষমা চাক। যা লেখছে তার জন্য ক্ষমা চাইয়া ফেললে আর কোনও মিছিল হবে না।

আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, আমি মইরা যাবো, তবু ক্ষমা চাইব না।

কেন চাইবা না? মানুষ ভুল করলে ক্ষমা চায় না? মার হাতদুটো চেপে ধরেছে আমার হাত।

আমি কোনও ভুল করি নাই।

এত অহংকার ভাল না নাসরিন। তুমি ক্ষমা চাইয়া ফালাও, তাইলে দেখবা আর কেউ কোনও অসুবিধা করব না। মা আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন।

মার সামনে থেকে সরে আসি। আমার পেছনে উঠে আসতে আসতে তিনি বলতে থাকেন, আমি সাংবাদিকদের ডাকব, ডাইকা আমি আমার মেয়ের হইয়া ক্ষমা চাইব। না মা। এইগুলা কইর না। আমার যাইতে হইবই। আর কোনও উপায় নাই। আমি কঠিন কণ্ঠে বলি।

ইয়াসমিন সুটকেসে জামা কাপড় ঠেলে ভরছিল। মা ওর হাত থেকে আমার জামা পাজামা কেড়ে নিয়ে বললেন, এত জামা কাপড় দিতাছস কেন? ও কয়দিনের লাইগা যাইতাছে?

বাবা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বললেন, মাস দুইমাস তো বাইরে থাকতেই হইব।

ছোটদা লম্বা হয়ে শুয়েছিলেন। বললেন, ওর আর জীবনেও আসা হয় কি না দেখেন।

এক মুহূর্তে পরিবেশটাকে কেমন ভূতুড়ে করে ফেলেন ছোটদা।

এইসব কি কয় কামাল? বলে মা জোরে কেঁদে ওঠেন। মাকে সরিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলি, ধুত বোকার মত কান্দো কেন!

নাসরিন এই বাড়ি কিনছে, গাড়ি কিনছে। বাড়িডা মাত্র সাজাইছে বাড়ি ছাইড়া চইলা যাওয়ার লাইগা?

মা, তুমি বুঝতাছো না কেন? আমি কি সারাজীবনের লাইগ্যা যাইতাছি গা নাকি? কয়দিন পরই তো আইয়া পড়াম।

কামাল কইল তোমারে নাকি আর আইতে দিব না। এইসব কী কয় কামাল?

ছোটদা কী জানে? ছোটদা কি আমার চেয়ে বেশি জানে? কয়, আন্দাজি কয়। নরওয়ে আর সুইডেনে আমার অনুষ্ঠান আছে। তাই আমারে বিদেশের সরকাররা সাহায্য করছে বিদেশে যাওয়ার লাইগ্যা। দেশের অবস্থা খারাপ বইলা করছে। দেখতাছো না কি ঘটতাছে! এখন তো হাতের কাছে পাইলে আমারে টুকরা টুকরা কইরা ফেলব। বিদেশের অনুষ্ঠান শেষ হইলে তো চইলা আমার আসতেই হইব।

মা ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে বলেন, তহন কি আইতে দিব খালেদা জিয়া?

দিব না কেন? এইটা আমার দেশ না?

তাইলে যে কামাল কয় আইতে নাকি দিব না।

এমনি কয়।

এমনি কয় কেন? কামাল এমনি কইব কেন এইসব কথা। কয় কেন যে জীবনেও আসা হইব না!

আশ্চর্য। এইসব যে কি বোকার মত কর। তোমার মত বোকা আমি আর দেখি নাই।খালেদা জিয়া ত আমারে দেশের বাইরে যাইতে দিতে চায় নাই। দেখ না পাসপোর্ট নিয়া নিছিল? দেখ নাই দেশের সব রাস্তা বন্ধ কইরা দিছিল যেন বাইরে যাইতে না পারি। সরকার তো কখনও চায় নাই আমি বাইরে যাই। এখন বাইরের দেশগুলা বলছে বইলা রাজি হইছে।

কবে আইবা তাইলে?

অনুষ্ঠান শেষ হইলেই আইসা পড়বাম। এরমধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হইয়া যাইব। মোল্লারা আর কতদিন চিল্লাইব! সরকার বুইঝা গেছে মোল্লাদেরে উস্কাইলে নিজেদেরই বিপদ হয়। এহন আর উস্কাইব না।

মা শান্ত হন মাত্র কিছৃুক্ষণের জন্য। ছোটদা যখন আবার বলতে শুরু করেন, তরে আর আইতে দিব না। কারণ তুই আইলেই মোল্লারা তর ফাঁসি চাইব, সরকার পতনের আন্দোলন করব। শুনে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন মা।

দাদা মেঝেয় পা ছড়িয়ে বসা, বললেন, খালেদা জিয়ার ত আর কোনও উপায় ছিল না নাসরিনরে দেশের বাইরে পাডাইয়া দেওয়া ছাড়া। মোল্লাদেরে একটু কন্ট্রোল কইরা সরকারই অরে নিয়া আইব।

ছোটদা সোজা হয়ে বসে বললেন, তোমারে কইছে নিয়া আইব! আপদ বিদায় করতে পারলে বাঁচে খালেদা। নেক্সট ইলেকশানে আওয়ামী লীগ জিতলে আসার একটা সম্ভাবনা আছে।

আমার মেয়েরে তরা কই পাঠাইতাছস। মেয়ে কই থাকব? কার কাছে থাকব? কি খাইব! কেমনে বাঁচব! বলতে বলতে কাঁদেন মা। মার দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। এরা ষড়যন্ত্র কইরা তোমারে দূরে সরাইয়া দিতাছে। তুমি যাইও না। আমার মেয়েরে আমি কোথাও যাইতে দিব না। সুটকেস থেইকা কাপড় বাইর কর।

ছোটদা জোরে ধমকে ওঠেন, কি পাগলামি করতাছেন মা। এইবার থামেন তো!

বাবা আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন, পুলিশ কী কইতে আইছিল?

জিগাইতে আইছিল কার কার বাড়িতে ছিলাম।

কইয়া দিছ?

না।

ভাল করছ।

ছোটদাকে বলি তিনি যেন পুলিশের কোনও চাপেই বলে না দেন যে ঝর বাড়িতে ছিলাম আমি। বাড়ির লোকেরা এক ঝর বাড়ির কথাই জানেন কেবল যে ওখানে ছিলাম। বাড়ির কাউকেই বলিনি আর কোনও নাম, আর কোনও বাড়ির কথা।

সুটকেসের দিকে চোখ পড়তে সুটকেসের কাপড় কিছু আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে বলি, এত কাপড় দিছে যেন মনে হয় ছয় মাসের লাইগা যাইতাছি! এইসব এইখানে যেইভাবে সাজানো আছে, তেমনই থাকুক।

ছোটদার ঠোঁটে অদ্ভুত একটি হাসি। দাদার ফ্যাকাসে মুখে কোনও হাসি নেই, তিনি চেয়ারে বসে পা নাড়ছেন। পা গুলো খুব দ্রুত নড়ছে। সামনে তাঁর যত্ন করে কাটা গত দুমাসে দেশের পত্রিকাগুলো থেকে আমি জড়িত খবরের কয়েক দিস্তা কাগজ। বিদেশ থেকে আসা চিঠিপত্র, ফ্যাক্স।

এইগুলা নিয়া যা নাসরিন।

না।

কাজে লাগতে পারে।

না।

বিছানায় শুয়ে থাকি। আমার পাশে বাবা শুয়ে আছেন। বিছানার কিনারগুলোয় বসে আছেন ছোটদা, দাদা। ইয়াসমিন আর মিলনও আছে। মা কাঁদছেন আমার পায়ের কাছে বসে।

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন